আমেরিকান যাতাকাঠি হাতে ইন্ডিয়া ও সপ্তম নৌবহর নিয়ে অস্বস্তি
গৌতম দাস
সম্প্রতি হিলারির বাংলাদেশ সফরে হিলারি-হাসিনা আলাপে বাংলাদেশে সপ্তম নৌবহরের ঘাটি বানানোর আমেরিকান পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয়েছে বা আগিয়েছে দাবী করে বাংলাদেশের মিডিয়ায় তোলপাড় করা খবর বের হয় গত ২ জুন। এই খবরের উৎস আগের দিনের ইন্ডিয়ার টাইমস অব ইন্ডিয়ার Times Now টিভি নিউজের ওয়েব সাইটের খবর। [http://www.timesnow.tv/videoshow/4403322.cms] Times Now তার রিপোর্টের প্রথম লাইনে লিখেছে, “America’s threat to send its seventh fleet to stop liberation of Bangladesh in 1971 is a known fact. Now, 41 years later – it is America again – which wants to park its seventh fleet in the country – for its strategic interests”। এই একই রিপোর্টের বরাতে আমাদের প্রথম আলো লিখছে,”বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাঠানোর হুমকি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টা হুমকিতে নৌবহর পাঠায়নি মার্কিন কর্তৃপক্ষ। সেই সপ্তম নৌবহর আবার আলোচনায় এসেছে”। প্রথম আলোর ট্রীটমেন্ট দিয়ে লেখা রিপোর্টে প্রথম বাক্যে বাড়তি শব্দ হলো, “পাকিস্তানের পক্ষে” আর এরপরে একেবারে নতুন বাক্য, “পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টা হুমকিতে নৌবহর পাঠায়নি মার্কিন কর্তৃপক্ষ”। এবং শেষে পাঠক-সাজেশনমূলক, পাঠককে মোল্ড করা বাক্য, “সেই সপ্তম নৌবহর আবার আলোচনায় এসেছে”। [http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-06-02/news/262647] Times Now এর রিপোর্টেটা ইন্ডিয়ার ষ্ট্রাটেজিক নিজস্ব স্বার্থের দিক থেকে লেখা, সেটা ১৯৭১ এর সময়ের ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থও বটে আবার এই ২০১২ সাথের ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থও বটে। ফলে রিপোর্ট শেষ করেছে, “this base could cast a shadow on India’s own strategic interests”; অর্থাৎ সপ্তম নৌবহরকে কেন্দ্র করে Times Now কেবল ইন্ডিয়ার দুই সময়ের নিজস্ব ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থ এর মিলের দিকটাই স্মরণ করেছে। Times Now এর ঐ রিপোর্ট যেসব কথা মনে করিয়ে দিতে চায়নি তা হলো, ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়া সোভিয়েত ব্লক ছিল আর এখন ইন্ডিয়া এশিয়ার এই অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার এক নম্বর বন্ধু যেটার আনুষ্ঠানিক যাত্রা ২০০৭ সালে। অথচ প্রথম আলো, এর রিপোর্টেটা অনুবাদ করে সাথে নিজস্ব শঠতার সাথে এই গুরুত্ত্বপুর্ণ বেমিল দিকটা আড়াল করে তার পাঠককে মটিভেট করার উদ্যোগ নিয়েছে। মটিভেশনটা হলো, ৭১ সালের সপ্তম নৌবহর আমাদের জন্য সেনসেটিভ; এটাকে ব্যবহার করে উস্কানি দিয়ে বলা হচ্ছে আমরা যেন এবারও সেই একই যুক্তিতে বিরোধীতা করি। যেন ১৯৭১ এর ইন্ডিয়া আর ২০১২ এর ইন্ডিয়া একই। প্রথম আলো আমাদেরকে ভুলিয়ে দিতে চায় ২০০৭ সাল থেকে আমেরিকার যাতাকাঠি হাতে পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করা ইন্ডিয়ার সাথে আমেরিকার বন্ধুত্ত্বের মুল্য আমরা কিভাবে পরিশোধ করেছি, এখনও করে চলছি। এই বন্ধুর তীব্রতা এতই যে সারা জীবন আমেরিকার যাতাকাঠির যাতা খেয়ে অস্থির, নিষ্পেষিত বাংলাদেশের আমরা আমাদের সরকারে কে থাকবে নাকি মারা যাবে এর নির্ধারক হিসাবে আমেরিকাকে দেখে এসেছি, এখন সেই যাতাকাঠি আমেরিকা অবলীলায় ভারতকে ব্যবহার করতে ধার দিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে আমেরিকা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্বার্থ নাকি এরপর থেকে তারা ইন্ডিয়ার চোখ দিয়ে দেখবে। বড় ভাইয়ের এই হাত ইন্ডিয়ার পিঠে রাখার মুল্য কী তা আমরা বাংলাদেশে বসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে চলছি। আমাদের মঈন-ফকরু আজিব সামরিক সরকার থেকে শুরু করে এই লেজে লেজে ধারাবাহিকতায় যে হাসিনা সরকার কায়েম হলো, এটা ১৯৯৬ সালের হাসিনা একেবারেই নয়। এর ম্যান্ডেট ভিন্ন। করিডোর, টিপাইমুখ, বর্ডারে ট্রিগার হ্যাপি হত্যা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি, ছিটমহল চুক্তি, একপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সুবিধা, নিজেই নিজের শত্রু তৈরি করে নিজের নিরাপত্তা স্বার্থ যেভাবে বুঝে তার দায়ে বাংলাদেশকে সাজানো সাইজ করা, নিজের ষ্ট্রাট্রেজিক স্বার্থানুযায়ী বাংলাদেশকে সাজানো ইত্যাদিতে বাংলাদেশকে ঘিরে ইন্ডিয়ার যত ধরণের স্বার্থ-সুবিধা বের করে নেয়া যায় তার সবকিছু নিশ্চিত করার ম্যান্ডেট এবারের হাসিনার। একালের এটাই রাইজিং ইন্ডিয়া; কোনভাবেই এটা ১৯৭১ সালের ইন্ডিয়া নয়, আকাশ-পাতালের ফারাক। ম্যান্ডেটের ক্ষমতা পেয়ে হাসিনার অবস্থা এখন এমন চাপে নিষ্পেশনে যাতা খেলেও সে প্রকাশ্যে কান্নাকাটি করতেও পারেনা, কাঁদতে হয় গোপনে, বড় জোর প্রণবের সামনে। এই পুরা সময়ে আমরা প্রথম আলোকে দেখেছি এই নিষ্ঠুর দানবীয় কারবার পাঠক জনগণের থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় সর্বোচ্চ মনযোগী হতে। লঘু তরল করে উপস্থাপন। আমাদেরকে বলা হয়েছে, ইন্ডিয়ার এই যাতাকাঠির নিষ্পেশন এটা নাকি আমাদের “মনের বাঘ”, তাই আমরা চেচামেচি করে খামোখা কষ্ট পাচ্ছি, প্রকাশ করছি। শেষের দিকে চক্ষুলজ্জার খাতিরে ইন্ডিয়ার মিডিয়াই যখন লিখতে বাধ্য হয়েছে – টু মাচ, এখন বাংলাদেশের কিছু স্বার্থের দিকে সক্রিয় হওয়া দরকার, সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবু প্রথম আলো লজ্জা পায়নি। বরং আরও নতুন উতসাহে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাথে যৌথ উদ্যোগের প্রচারে লিপ্ত হয়েছে। যেন আমাদের কিছুই হয়নি, ভালই আছি। কেবল দুদেশের মিডিয়ার সাথে মিডিয়া বা সাহিত্যিকরা পরস্পরের পিঠচাপড়ে কিছু কথা বলে নাই – এটাই আমাদের সব দুঃখের কারণ। অরথম আলোর লজ্জা নাই, নিজ দেশের স্বার্থ বিরোধী হতে বেপরোয়া সে। আবারও খুব হিসাব করে আবার সেই যাতাকাঠিটাই লুকিয়ে ফেলা, আমাদের ভুলিয়ে রাখার শঠতা।
আমেরিকা যাতাকাঠি ধার দিয়ে পিঠে কেন হাত রেখেছিল – এতে ইন্ডিয়ান বর্তমান নেতৃত্ত্ব ভেবেছিল মুই কি হনু রে! গ্লোবাল পাওয়ারের স্বাদ এত মিঠা! যাতাকাঠি এত সহজলভ্য, কাজের। সর্টকাটে সব পাওয়া যায়! কিন্তু ভুলে গিয়েছিল ইন্ডিয়াকে যদি রাইজিং ইন্ডিয়া বলে বুঝতে হয় তবে অনিবার্যভাবে আমেরিকা তাঁর ষ্ট্রাটেজিক মিত্র হতেই পারে না। যে কেউই রাইজিং ইকোনমির দেশের সম্ভাবনাময় হতে চায় বা সম্ভাবনা দেখা দেক না কেন তার সাথে আমেরিকার সম্পর্ক অন্তত ষ্ট্রাটেজিক প্রশ্নে বিরোধাত্মক হবেই। মুল কারণ, রাইজিং ইকোনমি মানে আগামী দিনের দুনিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি, প্রভাবশালী অর্থনীতি, গ্লোবাল অর্থনীতি বা ক্যাপিটালিজমের প্রেক্ষিতে নতুন ভাগীদার, শেয়ার হোল্ডার। এটা যেই মান-মাত্রায় শেয়ার হোল্ডার ঠিক সেই মাত্রায় সে গ্লোবাল সামরিক-রাজনৈতিক শক্তি, সেই মাত্রায় বিস্তৃত সাম্রাজ্য এম্পায়ার। এসবের মানে উপস্থিত এক মেরুর গ্লোবাল পাওয়ারের অচল দশা, ভাঙ্গন। গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার আন্তর্জাতিক লেনদেন বাণিজ্যের নতুন মুদ্রা, গ্লোবাল রাজনৈতিক স্বার্থ বিরোধ নিষ্পত্তির যে নতুন নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠান খাড়া করে ফেলতে পেরেছিল (১৯৪৪), যেটা এখনও বর্তমান, যা কলোনী যুগ থেকে বেরিয়ে দুনিয়াকে নতুন সাজিয়ে নিতে পেরেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) ধবংসাবেশ থেকে; এই গ্লোবাল অর্ডার তার শেষ জমানা পার করছে।
রাইজিং ইকোনমি কথাটা কয়েন বা চালু হয়েছে বা বলা ভাল ভিত্তি পেয়েছে আমেরিকার এক করুণ গোয়েন্দা গবেষণা প্রজেক্ট রিপোর্ট Global Trend: US National Intelligent Council’s 2025 Project থেকে। [http://www.dni.gov/nic/NIC_2025_project.html] সারকথায়, আগামী ২০২৫ সালের দুনিয়াটায় গ্লোবাল পাওয়ার হিসাবে দেখব, কাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে থাকবে, দেখতে কেমন হবে তা নিয়ে গবেষণা করে এর ট্রেন্ড অভিমুখ বুঝাবুঝি। নতুন দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আর একক ও একচ্ছত্র শক্তি হিসাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে না। নিজের অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে যুক্তরাষ্ট্রকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পুঁজিতান্ত্রিক একমুখী প্রবাহ শুরু হয়েছে পশ্চিম থেকে পুর্বের দিকে এশিয়ায়, অর্থনৈতিক যজ্ঞের কেন্দ্র হয়ে উঠছে এশিয়া। এতে প্রতিযোগিতায় এক নম্বরে থাকা দূরে থাক,পাঁচ নম্বরে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত – এটাই যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরই ঐ গোয়েন্দা গবেষণা প্রজেক্ট রিপোর্ট সারকথা। যারা নতুন প্লেয়ার হচ্ছে এখানে তারা হলো, Brazil, Russia, India and China যাদের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে সংক্ষেপে BRIC বলে চেনানো ভিত্তি পায়, আর এই দেশগুলোকে রাইজিং ইকোনমির দেশ বলবার রেওয়াজ চালু হয়। এই হিসাবে পরের জন বলে সাউথ আফ্রিকাকে গণ্য করে BRICS বলা শুরু হয়। তবে এখানে বলে রাখা ভাল শুধু রাইজিং ইকোনমির কারণে এই গ্লোবাল ওলটপালট লক্ষণ ত্বরান্বিত হয়েছে তা নয়। বরং এর সঙ্গে একই সময়ে ঘটে গেছে আফগানিস্থান, ইরাকে ওয়ার অন টেররে লিপ্ত আমেরিকার যুদ্ধের খরচ সামলাতে গিয়ে নিজ অর্থনীতিতে আয়-ব্যায়ের ভারসাম্যহীনতা ফলাফলে ২০০৭ সালের শেষে ভয়াবহ মন্দা দেখা দেয়া। এটাই সে যোগ হওয়া নতুন ফাক্টর। এই গবেষণা রিপোর্ট আনুষ্ঠানিক প্রকাশ পায়, জুন ২০০৮ সালে। তবে আমেরিকার জন্য ভয়াবহ সব প্রাথমিক ফাইন্ডিংস আসা শুরু হয় ২০০৬ সালের মাঝামাঝি থেকে, সন্তান বুশের আমলের শেষে। এখান থেকেই ঢেলে সাজানো আমেরিকার নতুন পররাষ্ট্রনীতি, নতুন উপাদান, নতুন ষ্ট্রাটেজি, সমরনীতি, নতুন ষ্টাটেজিক হিসাব। সারকথায়, এশিয়ার ইন্ডিয়াকে কাছে টেনে পিঠে হাত রেখে চীনকে যতটা সম্ভব দাবিয়ে প্রতিযোগিতায় নিজের পঞ্চম অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব উপরে জায়গা করে নেয়া যায়, ধরে রাখা যায়।
যেকথা বলছিলাম, রাইজিং ইকোনমির দেশের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক অন্তত ষ্ট্রাটেজিক প্রশ্নে বিরোধাত্মক হবেই। কারণ, রাইজিং ইকোনমি মানে নতুন গ্লোবাল অর্ডারের সম্ভাবনা, পুরানা অর্ডারের ভস্মছাইয়ের উপর দাঁড়িয়ে। পুরানা গ্লোবাল পাওয়ার মানে ১৯৪৫ সালে গড়ে উঠা গ্লোবাল অর্থনৈতিক নতুন অর্ডার, এর প্রতিষ্ঠান আইএমএফ (ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসাবে গ্রহণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মুল্য হিসাবের কমন মুদ্রা এবং কার ন্যাশনাল মুদ্রার মান কত তা নির্ধারণের পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান), বিশ্বব্যাঙ্ক (পুজির বিচলন ও সর্বব্যাপী দেশ সীমান্ত ছাড়িয়ে বিস্তারের পুর্বশর্ত – কেন্দ্রীয়ভাবে অগ্রসর দেশগুলো রাষ্ট্রীয় দায়ে, কম সুদে ইনফ্রাষ্টাকচারাল বিনিয়োগ, যার সুবিধা নিয়ে অগ্রসর দেশের কোম্পানীগুলো ছড়য়ে পরতে পারে), জাতিসংঘ (এসব কারবার করতে গিয়ে যুদ্ধ জড়িয়ে পুঁজিপাট্টা নষ্ট না করে যুদ্ধ এড়িয়ে না হলেও দেরি করিয়ে দিয়ে ক্ষতি কমানো, এর জন্য আন্তর্জাতিক সদস্যপদ ও নিয়মকানুন তৈরি, গ্লোবাল পাওয়ারগুলোকে ভেটো-ক্ষমতাসম্পন্ন করে পরস্পরকে নাল করে একটা ভারসাম্য আনা)। আর এর বাইরে OECD (বড়লোকদের ক্লাব, পুবের গরীব দেশগুলোর বিপক্ষে পশ্চিমের দেশগুলোর স্বার্থ বুঝে নিতে জয়েন্ট অবস্থান, কৌশল নির্ধারণের কাজে গবেষণা করা)। জন্মের সময় হিসাবে OECD উপরের তিনটা প্রতিষ্ঠানের কিছুটা পরে (১৯৪৮) এবং ভিন্ন নাম (OEEC) থাকলেও পরে ঐ তিনটা প্রতিষ্ঠান দাড়িয়ে গেলে ১৯৬১ সাল থেকে বর্তমান অবস্থানে (মোট ৩৪ সদস্য) নিজেকে গুছিয়ে সীমাবদ্ধ করে নেয়। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষত্ত্ব হলো, এগুলো, কলোনী পরবর্তী যুগের থেকে (১৯৪৫) আজ পর্যন্ত যে গ্লোবাল অর্থনৈতিক বা পুঁজিতান্ত্রিক যে অর্ডার নিয়ম শৃঙ্খলা তৈরি হয়ে আছে আমরা দেখি সেসব দাঁড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠান চারটার ভিত্তির উপরে। যদিও পরে আরও অনুষঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসাবে, (NATO, UNCTAD, WTO)এসবের নাম করা যায়।
তাহলে গ্লোবাল এই অর্ডারের বদল আসন্ন, মোড় বদল বলছি এজন্য না যে রাইজিং ইকোনমির দেশগুলো অর্থনৈতিক শক্তির কারণে গ্লোবাল পাওয়ারের নতুন ভাগীদার ষ্টেকহোল্ডার হয়ে উঠে আসছে তাই। মুল কারণ, এই প্রতিষ্টানগুলোর আমেরিকার কর্তৃত্ত্ব প্রভাবের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, ফলে BRICS রাষ্ট্রগুলোর যে কেউ নিজ নতুন গ্লোবাল ক্ষমতার নিয়ে প্রবেশ করলেও পুরানা প্রতিষ্টানগুলোর উপর কখনই নিজের প্রভাব কতৃত্ত্ব নিজের আদল দিতে পারবে না, নিজের মত কাজে লাগাতে পারবে না। আর আমেরিকাও সহজেই হার মেনে এর কর্তৃত্ত্ব ছেড়ে দিবে না। তাই সোজা বক্তব্য দুনিয়ায় নতুন গ্লোবাল পাওয়ারগুলোর আবির্ভাব মানে নতুন গ্লোবাল অর্ডার, নতুন গ্লোবাল অর্ডারের সাথে ও হাতে তৈরি সামঞ্জস্যপুর্ণ প্রতিষ্টান। যদিও আসন্ন সে গ্লোবাল অর্ডারের রূপ আদল – ভিশনটা কি হবে, কেমন হবে তা এখনও যথেষ্ট পরিস্কার হয়নি। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত কোন যুদ্ধের ফলাফল হিসাবে আমরা সেটা দেখতে পাব না কি, আপসে হবে আমরা কেউ এখনও জানি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে গ্লোবাল অর্ডারের ভিশনারি নায়ক ছিলেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। এবারের রুজভেল্ট কে একজন নাকি অনেকে – আলামতেও তা কিছু জানা যায় না এখনও। কিন্তু নতুন অর্ডার যে আসন্ন তা নিয়ে বিশেষ করে মেনষ্ট্রীমে বড় রকমের তোলপাড় আলোচনা বহু আগেই শুরু হয়ে গেছে। ২০০৯ সাল থেকেই আইএমএফ চীনের নতুন গ্লোবাল ভুমিকাকে তার মুদ্রা ইঊয়ান সহ স্বাগত জানিয়ে প্রস্তুত বলে জানিয়ে রেখেছে। এনিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এরা তৈরি। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের স্বার্থ আর আমেরিকার স্বার্থ যে হুবহু এক না – একাডেমিকদের মধ্যে তা নিয়ে পরিস্কার দুরত্ত্ব বজায় রেখে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক ষ্ট্রাটেজিক পাড়ায়, আমেরিকান পুরানো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিগনিউ ব্রেজনিস্কি চীনের আসন্ন ভুমিকা মেনে নিয়ে এরপর আমেরিকার ষ্ট্রাটেজিক অবস্থান কী হওয়া উচিত তা নিয়ে বই লিখে ফেলেছেন। দুটো ভাইটাল তথ্য দিয়ে এই প্যারা শেষ করব। চীন ওয়াল্ড ব্যাঙ্কের ভিতর দিয়ে না গিয়ে নিজেই একা যে ইনফ্রাষ্ট্রাকচারাল বিনিয়োগ নিয়ে আফ্রিকায় হাজির হয়েছে তা ইতোমধ্যেই ওয়ার্ড ব্যাঙ্কের সারা জীবনের মোট পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে বেশি। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে ইতোমধ্যে চীন ইন্ডিয়াকে রাজি করিয়ে BRICS ব্যাঙ্ক খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত মাসে ইন্ডিয়ায় অনুষ্ঠিত BRICS সম্মেলনে। আকার সম্পন্ন হয়নি কাজ চলছে। আর সবচেয়ে মজার তথ্য ওয়াল ষ্ট্রিট ও হেজ ফান্ডের মালিকদের মাঝে এই অর্ডার পরিবর্তনের খবর ইঙ্গিত পৌছে গেছে শুধু নয়, তারাই নতুন অবস্থা পরিস্থিতি বুঝে BRICS ব্যাঙ্ক খোলার তাগিদ দিয়ে চলেছে। গ্লোবাল অর্ডারে আমেরিকান এম্পায়ার ভুমিকা নিয়ন্ত্রণের দিন শেষ বলে এর প্রতি এরা আগ্রহ কমিয়ে ফেলেছে। ওদিকে ইউরো বলে কিছু থাকবে কি না এর ভাগ্য আলামত পরিস্কার হতে শুরু করবে এই জুন মাসের মধ্যে গ্রীসের নির্বাচনে। এই ছোট্ট রচনায় যা বলতে চাচ্ছি, ইন্ডিয়া নিজেকে রাইজিং ইকোনমির দেশ হিসাবে যদি বুঝে তাহলে তাকে এটা মানতে হবে নতুন ভারসাম্যে নতুন গ্লোবাল অর্ডার গড়তে পুরানো গ্লোবাল অর্ডারের মাতব্বরি আগলে বসে থাকা আমেরিকার সাথে সব রাইজিং ইকোনমির সম্পর্কের ধরণ – এই প্রশ্ন হবে মুলত বিরোধাত্মক। এটা ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার না, ইনহারেন্ট। আবার বিরোধ বলতে কেউ যেন না মনে করে আমি রাশিয়া-আমেরিকার কোল্ড ওয়ারের ব্লক রাজনীতির মত কিছু মিন করছি। সেটা হবার কোন সম্ভাবনা নাই। মুল কারণ, এখানে স্বার্থ বিরোধ থাকলেও তা যতই থাক শেষ বিচারে এরা সবাই একই পুজিতান্ত্রিক গ্লোবাল সিষ্টেম ওর্ডারের মধ্যেই আছে এবং নতুন অর্ডারটাও এই বড় পুজিতান্ত্রিক ফ্রেমের মধ্যে থাকবে। ঠিক যেমন ১৯৪৫ সালের অর্ডারটাও গড়ে উঠেছিল পরানো কলোনীয়াল সীমিত লেনদেনের পুজিতান্ত্রিক অর্ডারকে ভেঙ্গে কিন্তু পুজিতান্ত্রিক সম্পর্কের লেনদেনের ভিতরেই।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ত্ব এত সব দিক বুঝেন না, বা খবর রাখেন না এটা মনে করা ভুল হবে। বুঝা সত্ত্বেও তারা আমেরিকান যাতাকাঠি পেয়ে সর্টকার্টে বাজিমাত করার পথে হাটার লোভে ছিলেন, হাটছিলেন, আছেন। কিন্তু আমেরিকান ষ্টাটেজিক স্বার্থ যে কোনভাবেই রাইজিং ইন্ডিয়ার স্বার্থ হতে পারে না, সেটাকে এখন থেকে আর গোপন (আমেরিকান দিক থেকে) ও সর্টকার্টের লোভী (ইন্ডিয়ায়) অবস্থায় ফেলে রাখার সুযোগ আর থাকল না, সব উদোম হয়ে গেল। এটাই ইন্ডিয়ার জন্য শকিং, বাস্তবতার ঝাকুনি খাওয়া।
Times Now এর ঐ রিপোর্ট এর শেষ বাক্য হলো, “this base could cast a shadow on India’s own strategic interests”; কিন্তু ইন্ডিয়ার ষ্ট্রাটেজিক ইন্টারেষ্ট টা আসলে কি তা জানা যায়নি। কি সেটা, সুনির্দিষ্ট করে আমাদের তা এখনও জানি না।
প্রথম আলো আমাদেরকে ৭১ সালের ধুয়ো তুলে নৌবহর ইস্যুতে বিরোধিতা করতে কানপড়া দিচ্ছে। এই বিরোধিতা করার সময় আমরা কি ভুলে যাব ইন্ডিয়ার বাংলাদেশের উপর আমেরিকান যাতাকাঠি ব্যবহারের সদ্য কাহিনী? আমরা অবশ্যই আমেরিকান নৌঘাটির বিরোধিতা করব, কিন্তু প্রথম আলোর কানপড়ায় না, ভারতের স্বার্থে ভারতের মত করে না, নিজের ষ্ট্রেটেজিক স্বার্থ বিবেচনা, বিশ্লেষণ করে, সবদিক বুঝে এবং একমাত্র নিজের স্বার্থে। মনে রাখতে হবে উঁপস্থিত যে দুনিয়ায় আমরা প্রবেশ করে আছি এখানে তথাকথিত আন্তর্জাতিক আদর্শ যেমন কমিউনিজম অথবা ইসলামের নামে চিল্লা দিয়ে কারো পিছনে দাঁড়িয়ে গিয়ে তার রাষ্ট্র স্বার্থে নিজেকে বিক্রি করে ফেলার যুগ আমরা অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছি।