ব্লক রাজনীতির যুগের সোভিয়েত নৌকা এখন ফুটা, ভেঙ্গে পড়েছে তবু ডান-বাম ক্যাটাগরিতে কোন নৌকায় তোলারচেষ্টা


এটা ২০১২ সাল। কিন্তু তবু এম এম আকাশ এখনও বাম অথবা ডান বলে ঘটনা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে চলেছেন সেই সত্তর দশকের মত। বাম মানে কি? তিনি কি বুঝেন সেটা এই লেখাতেও জারি রেখেছেন। সেটা হলো, সোভিয়েত ব্লকে ঢুকা, নৌকায় তুলে নেয়া আর ভুতুড়ে শব্দ “সমাজতন্ত্রের” নাম জপা। সোভিয়েত ব্লকে ঢুকা মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রটাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ব্লকে ঢুকা বাকি সব রাষ্ট্রের স্বার্থকে বলি দেয়া, বিক্রি করে দেয়া। এর বাইরে ভুতুড়ে ফেটিস “সমাজতন্ত্র” শব্দের আর সে মানে সেটা হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানা। অর্থাৎ ক্যাপিটালিজমের যে অজস্র সমস্যা, স্ববিরোধ আছে তাকে স্রেফ মালিকানার সমস্যা হিসাবে রিডুইস করে দেখা যেন রাষ্ট্রীয় মালিকানা কায়েম করলেই ধনন্তরির মত ক্যাপিটালিজম-ঘটিত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সমস্যাটা মালিকানা দিয়ে ক্যাপিটালিজমকে বুঝবার মত তরল বা সরল না, এই বুঝের ভাত নাই, ফলে ব্যক্তি মালিকানা নির্বিচারে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানা কায়েম করলেই ধনন্তরির মত ক্যাপিটালিজম-ঘটিত সব সমস্যার সমাধান কোথাও ঘটেনি, উলটা “সমাজতন্ত্র” এর বুঝ নিজেই এক অবুঝ কারবার, দুনিয়ায় টেকা অসম্ভব এটাই সে প্রমাণ করেছে। এই ভাবনার সবচেয়ে আদর্শ প্রয়োগস্থান খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়েছে। আর সাথে রেখে গিয়েছে এই এক্সপেরিমেন্টের অজস্র করুন পরিণতি যার সম্ভবত সবচেয়ে লোমহর্ষক উদাহরণ হলো কম্বোডিয়া। ব্যাক্তি মালিক উচ্ছেদ করতে গিয়ে যে গণহত্যা করতে হয়েছে সেই ক্ষত মিটাতে এখন জেনোসাইড বিচার কমিশন, ট্রুথ কমিশন করেও কম্বোডিয়ার সামাজিক বিপর্যয় রোধের কুল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রগুলো কমবেশি একই কান্ড করেছে, করে সামলিয়ে নিতে পেয়েছে। কিন্তু শেষের দিকে (১৯৭৫-৭৯) বলে ধরা খেয়েছে Red Khmers বা Communist Party of Kampuchea in Cambodia; খেমার রুজ আজ গণহত্যার আসামী। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের (চীন বা সোভিয়েত) কমিউনিষ্টরা কখনও ক্ষমতায় আসতে পারেনি। কিন্তু তাসত্ত্বেও একথা কঠিন সত্যি যে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কমিউনিষ্ট চিন্তার অর্থনীতিক ব্যবহারে ভুতুড়ে সমাজতন্ত্র ভাবনায় সাজাবার সুযোগ ও কাজ হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের বাজেট, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, রেহমান সোবহান এন্ড গং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং অর্থ পরিকল্পনা ও পাট মন্ত্রী তাজউদ্দিনের আনুকুল্যে সেসব ঘটনা ঘটেছিল। শেখ মুজিব “তোরা অর্থনীতি ভাল বুঝিস” বলে উদারহাতে এদের সুযোগ দিয়েছিলেন। এর বিষময় ফলাফল ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়া আমরা দেখেছি, সইতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু সেই রেহমান সোবহান আজও পিছন ফিরে দেখেন নি ৭৩-৭৪ এর তাঁর অর্থনীতিক ভাবনা চিন্তাগুলোর মধ্যে সমস্যা কি ছিল, কোন দায় তিনি বোধ করেন, এর কোন মুল্যায়ন তিনি কোথাও করেছেন আমরা দেখিনি। চুপচাপ বিআইডিএস হয়ে এখন সিপিডি করেছেন, যেটা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের স্থানীয় সহযোগী গবেষণা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের চিন্তা বদলাতেই পারে, ভুল থেকে মানুষ শিক্ষা নেয় তাই চোখকান খোলা রেখে নিজেকে বদলানোও দরকার হয় বটে। কিন্তু কেন কি বদলাচ্ছি এর ব্যাখ্যা দেয়া, দায় নেয়া গুরুত্ত্বপুর্ণ দিক। আমরা সৌভাগ্যবান যে এক দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়েই সব সমাজতন্ত্র ভাবনা খামোশ হয়ে গিয়েছিল, মালিকানা উচ্ছেদের নেশায় মত্ত হওয়ার দিকে যাবার সুযোগ মেলেনি, নইলে হয়ত আজ আমরা দেখতাম একা শেখ মুজিবকে খেমার রুজের মত গণহত্যার কাঠগড়ায়। এজন্য আমরা ঐ দুর্ভিক্ষকে যথেষ্ট মনে করে ওর শুকরিয়া আদায় করতে পারি। দায় আমাদের সকলের, বিশেষ করে যারা কিঞ্চিত মাত্রায় হলেও ধনন্তরি হিসাবে সমাজতন্ত্র বুঝেছিলাম, আবার গ্লোবালভাবে দেখলে গ্লোবাল এক কমিউনিষ্ট ভাবনার মধ্যে আমাদের সেই কাল কেটেছিল, চাইলেই যার বাইরে আমরা চিন্তা করতে পারতাম না। তবু দায় আমাদের। এই দায়মুক্তি আমাদের তখনই ঘটতে পারে যদি আমরা পিছন ফিরে ভুলগুলো কি ছিল তা সনাক্ত মুল্যায়ন করা, তা থেকে শিক্ষা নেয়া, ক্যাপিটালিজম বা পুঁজি ফেনোমেনাটা কি, মৌলিক সমস্যাগুলো কি –এর চরম সমাধান কি তা আজও কোথাও হাজির নাই, আমাদের বের করার জন্য কাজ করতে হবে, এর আগে কাজ চলার জন্য কি কি করব না, কি কি ভুল মনে করি অন্তত তার একটা লিষ্ট লাগবে ইত্যাদি বহু কিছু। সেসবের আগে “তার আগে চাই সমাজতন্ত্র” বলে আর ঝাপিয়ে পড়ব না অন্তত সে প্রতিজ্ঞা লাগবে। এসব কাজের আগে – এখনও এই ২০১২ সালে আবারও বাম-ডান কাটাগরি দিয়ে অর্থনীতি ব্যাখ্যা করার মানে কি? সেই সাধের ব্লক সোভিয়েত ইউনিয়নই নাই। ফলে বাম ডান ভাগ করছেন তিনি কি আশার ছলনায়? এটা একটা রীতি মত ক্রাইম; ৮০ এর দশক যদি এম এম আকাশের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ধরি তবে কম করে হলেও এখনকার তরুণেরা এর তৃতীয় প্রজন্মের, এদেরকে আমাদের অমুল্যায়িত ফেলে রাখা ভুলে বিভ্রান্ত করা অপরাধ বলে আমি মনে করি।

লেখার শেষে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রসঙ্গে আকাশ লিখছেন, “বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের সবকিছু আমরা গ্রহণ করব–তাও না আবার সবকিছু বাদ দিব তাও না”।এটা চাল চুলাহীন এক ষ্টেটমেন্ট। পাঠককে বাম-ডান সমাজতন্ত্র বুঝিয়ে এরপর আচমকা বিশ্বব্যাঙ্ক নিয়ে এই ষ্টেটমেন্ট দেবার মানে হোল তিনি যেমন ক্যাপিটালিজমকে কেবল মালিকানা-বুঝ দিয়ে সর্টকাটে সমাজতন্ত্রের জামা গায়ে তুলে নিয়েছিলেন ঠিক একইভাবে বিশ্বব্যাঙ্কের জামা পড়তে বলছেন। গ্লোবাল কাপিটালিজমের অর্ডার শৃঙ্খলার মধ্যে বিশ্বব্যাঙ্ক এই প্রতিষ্ঠানটা আসলে কি? তিনি কিভাবে বুঝেছেন এর হদিস আমরা দেখিনি। সে সবের কোন ধারণা ছাড়া তাঁর চোখ দিয়ে কেন কিভাবে গ্রহণ বর্জনের বিষয়টা আমরা বুঝব? বিশ্বব্যাঙ্কের সাথে গ্রহণ-বর্জনের সম্পর্ক ঘটা যদি জায়েজ হয়ে থাকে তবে এই লেখায় এরশাদের উত্থানকে যেভাবে ব্যাখ্যা করলেন এর তালমিল পাওয়া মুস্কিল। এছাড়া বিশ্বব্যাঙ্কের সাথে সম্পর্ক যদি জায়েজ হয় তবে আবার লেখার শুরুতে ডান-বামের কথা তোলার মানে কি? মোস্তাক, জিয়ার বিরুদ্ধে ডানে ফেরার অভিযোগ তোলার মানে কি?আবার এমন এক সময় তিনি বিশ্বব্যাঙ্কের সাথে গ্রহণ-বর্জনের কথা তুলছেন যখন গ্লোবাল কাপিটালিজমের অর্ডার শৃঙ্খলা মারাত্মক সঙ্কটে। এমন সঙ্কটে যে বিশব্ব্যাঙ্ক এর পালটা ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে, নতুন আর একটা গ্লোবাল কাপিটালিজমের অর্ডার শৃঙ্খলা দাড় করাবার প্রচেষ্টা চলছে। সফল হবে কি না, হলে কিভাবে হবে বর্তমান বিশ্বব্যাঙ্কের মত আর এক বিশ্বযুদ্ধের ভিতর দিয়ে তা দুনিয়াকে দেখতে হবে কিনা, কোন পথে কেউ জানে না।আওমরা যত দ্রুত সমাজতন্ত বুঝে গেছি বলে ভাবি এর একছটাক সময় যদি গ্লোবাল কাপিটালিজমের অর্ডার শৃঙ্খলার মধ্যে ক্যাপিটালিওজমকে মনোযোগে বুঝতে চেষ্টা করলাম তাহলে মনে হয় আমাদের এভাবে ডান-বাম করে বেরাতে হয়ত না। বহু সামাজিক বিপর্য্য় এড়িয়ে কিছু করতে পারতাম। একাজ যদি নাও পারি তবে ক্ষমা দেয়া উচিত। অন্তত পুরানো অকেজো চিন্তার আবর্জনা ঘেটে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্তিতে ফেলা এটাকে আমি অপরাধ মনে করব।

Leave a comment