বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরাশক্তি: ভারত, চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা (১)
গৌতম দাস
০১ এপ্রিল ২০১৪
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানান বিদেশি ফ্যাক্টর কাজ করে, এটা আমরা জানি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সহাবস্থান ও আঁতাতের বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে এই ফ্যাক্টরগুলো আমাদের রাজনীতিতে কি ভুমিকা নিতে পারে সে বিষয়ে বাস্তবসম্মত আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে নি। এখানে তার প্রাথমিক কিছু আলোচনা হাজির করছি।
প্রথম কিস্তিঃ
দুনিয়া এখন একটাই গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়া
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশের ভিতরের ফ্যাক্টরগুলো ছাড়াও বাইরের বিদেশি ফ্যাক্টরগুলো কেন বিরাট ভুমিকা নেবার সুযোগ পাবে এযুগে এনিয়ে প্রশ্ন তোলা যতোটুকু না রাজনৈতিক তার চেয়ে অধিক নৈতিক। অর্থাৎ আমরা নৈতিক জায়গা থেকেই তর্ক তুলে বলি যে কোন বিদেশী শক্তি আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত না বা করতে পারবে না। সেটা ভাল, কিন্তু বহু আগে থেকেই আমরা এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অধীনে বিশ্বব্যাপী লেনদেন, বিনিময় বা বাণিজ্যে ও নির্ভরশীলতার সম্পর্কের ভিতর প্রবেশ করে আছি, যেটা এক বিকল্পহীন বাস্তবতা। অর্থাৎ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আমরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই বিকল্পহীন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছি। বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ এই ভ্রমণের উলটা পথে পিছন ফিরার কথা চিন্তা করা এখন অকল্পনীয় এবং অবাস্তব। আমরা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক অবস্থায় যেমন ফিরে যেতে পারি না, ঠিক তেমনি চাইলেই ‘হস্তক্ষেপ’ বন্ধ করতে পারি না। দুনিয়ার কোন দেশই এখন আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। এযুগে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অর্থনীতি হয়ে থাকা অবাস্তব ও অসম্ভব।
আবার, দুনিয়া আগের মতো ‘পুঁজিতান্ত্রিক’ আর ‘সমাজতান্ত্রিক’ শিবিরে আর বিভক্ত নয়। দুনিয়া এখন একটাই, সেটা একটাই গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়া। অতএব একে মাথায় রেখেই আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবার নীতি ও কৌশল ঠিক করতে হবে। দুনিয়ার সকল দেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকার বাস্তবতা মেনেই বিদেশি রাজনীতি ও স্বার্থের ফ্যাক্টরগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। নিজস্ব স্বার্থ যতটা সম্ভব সুরক্ষা করার রাজনীতিই আমাদের একমাত্র গন্তব্য।
শেখ হাসিনার পক্ষে ক্ষমতায় থাকা কিম্বা বিরোধীদলের ক্ষমতা আসার সম্ভাবনা অনেকাংশেই এর এই বিবেচনাগুলো আমলে নেবার উপর নির্ভরশীল। ক্ষমতায় থাকবার জন্য কিম্বা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণের নীতি ও কৌশল নির্ণয়ও নির্ভর করে এই ফ্যাক্টরগুলোকে বাস্তবচিতভাবে বিবেচনার ওপর। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার বাইরের শক্তি কে কিভাবে সেটা করছে তার ওপর রাজনীতিতে তাদের পরিণতি অনেকাংশেই ঠিক হবে। সেটা নিশ্চিত। আবার, জনগণের দিক থেকে এই দুই পক্ষের কোন পক্ষের স্বার্থ রক্ষা প্রধান বিবেচনা হতে পারে না। বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের দিকগুলো নির্মোহ ভাবে চিহ্নিত করা, বোঝা ও বিচার করার ওপর আমাদের সামষ্টিক স্বার্থের জায়গাগুলো কোথায় নিহিত সেটা নির্ধারণ করা দরকার। এই লেখাটি সেই আলোকেই লেখা হচ্ছে। এই তিনটি স্বার্থের ক্রম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অনুমান হচ্ছে বিশ্ব ও আঞ্চলিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান স্বার্থ অর্থনৈতিক এবং এর পরে সামরিক। সামরিকতার প্রশ্নকে আমরা গণশক্তি বিকাশের অন্তর্গত বিবেচনা বলে মনে করি। এর বিকাশ ছাড়া বাংলাদেশের মতো এখনকার রাষ্ট্রের পক্ষে জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং নিজেদের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে নিজের সিদ্ধান্তে চলবার শক্তি কখনই অর্জন করতে পারবে না।
অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থেই আলাদা করে রাজনৈতিক স্বার্থের চিন্তা করা দরকার। রাজনৈতিক স্বার্থ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কোনই সন্দেহ নাই। সেই ক্ষেত্রে প্রধান ও প্রাথমিক বিবেচনা হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বিশ্ব সভায় বাংলাদেশের টিকে থাকা। সেই লক্ষ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ যেভাবে বাংলাদেশের জনগণকে বিভক্ত করছে এবং রাষ্ট্রকে সন্ত্রাসী কায়দায় জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষত ক্রমাগত গভীর করে চলেছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার। তার জন্য জাতিবাদী অথবা ধর্মবাদী আত্মপরিচয়ের রাজনীতির বিপরীতে দরকার গণশক্তি নির্মাণের রাজনীতি। যার মর্ম মচ্ছে নাগরিক চেতনা ও বোধকে শক্তিশালী করা। দল, মত, ধর্ম বা মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষাই এই দিক থেকে এখনকার প্রধান রাজনীতি, কোন প্রকার দলবাজি বা জনগণকে বিভক্ত করে এমন মতাদর্শিক ফেরেববাজিতে পা দিয়ে নিজেদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করা নয়। কিন্তু বিধ্বংসী রাজনীতিতেই আমাদের প্রবল উৎসাহ, নির্মাণের রাজনীতিতে নয়। নানান মতাদর্শিক বিতর্ক আমাদের সমাজে ও রাজনীতিতে আছে এবং আরও বহুদিন থাকবে। সেগুলোর এটা বা সেটার ভিত্তিতেই রাষ্ট্র গড়তে হবে এমন জিদ আত্মঘাতি। বরং সে তর্কবিতর্কগুলো চলতে দিয়ে, এই অর্থে এড়িয়ে একটা কমন কনসেনসাসের ভিত্তিতে নাগরিক চেতনা ও বোধে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করে নেয়া এখনকার প্রধান কাজ।
এই বাস্তবতাগুলো মনে রেখে এবং সজ্ঞান ও সচেতন তরুণদের কথা মনে রেখে এই লেখাটি পেশ করা হচ্ছে। যাদের জাগতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করা এবং সম্পদ বন্টনে সুষম ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুযোগ প্রাপ্তিতে সাম্য নিশ্চিত করার ওপর। যেদিক থেকেই বিচার করি, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করাই এখনকার কাজ। সেই ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, বিরোধ, প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাবার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি অর্জন করা দরকার। বাংলাদেশের এখন যে বিভাজন ও বিভক্তির রাজনীতি সেখান থেকে এই ব্যাপারে প্রত্যাশার কিছুই নাই। সে কারণেই বাংলাদেশের সেই সকল তরুণদের কথা মনে রেখে এ লেখা লিখছি যারা দেশের ভেতরের অবস্থা ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাস্তবচিত নতুন রাজনীতির জন্ম দিতে আগ্রহী। বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতির নানান অশুভ পক্ষের টানাপড়েনে অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবার বিপরীতে যারা সাঁতার দিতে প্রস্তুত। অসম ও অন্যায্য অবশ্যই, কিন্তু আমরা একই অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই সবাই বসবাস করি, এই ব্যবস্থার মধ্যেই আমাদের নিজেদের জন্য সর্বোচ্চ শক্তিশালী জায়গা করে নিতে হবে। সেটা কেউই আমাদের দয়া করে দেবে না।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের প্রতি আগামি দিনে ভারত, আমেরিকা, চিন ও রাশিয়ার সম্ভাব্য অবস্থান কী হতে পারে সেটা আগাম আন্দাজ করা আমাদের দরকার। যাতে এব্যাপারে আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে কিছু আগাম ধারণ আমরা করতে পারি। কয়েকটি কিস্তিতে এই লেখাটি লিখছি। এই আন্দাজ যে, তা আমাদের আগামি দিনে সামষ্টিক স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি জাতীয় অবস্থান নির্ণয়ে সহায়ক হবে বলে আশা করি।
দিল্লী ও ওয়াশিংটনের বিদেশ নীতিতে নতুন পরাশক্তিগত বিন্যাস
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী দেশগুলো কে কী ভূমিকা পালন করছে সেটা কমবেশী হয়তো আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, কিন্তু আগামি দিনে সুনির্দিষ্ট ভাবে তাদের ভূমিকা কী রূপ নিতে পারে সেটা অনুমান করার চেষ্টা আমাদের এখনি করা দরকার। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে যে ভূমিকাই নিক সবাই ভারতের আসন্ন নির্বাচনের ফলাফল কী দাঁড়ায় সেদিকে এখন সকলেই তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে।
কেন আসন্ন ভারতীয় নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার জন্য বিদেশি শক্তি সবাই অপেক্ষামান? কারণ আগের যেকোন ভারতীয় নির্বাচনের চেয়ে এবারকার ভারতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ধারক। চলতি বাংলাদেশের সরকার বিগত সরকারেরই ধারাবাহিকতা। তারা ২০০৯ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল। এই সরকারের দুই আমলেই গুমখুন, সন্ত্রাস, ও আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রকট আকার ধারণ করেছে, বিরোধী মত ও চিন্তা ও বিরোধী দলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা কার্যত একটি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিবাদী আবেগ ও মুক্তিযুদ্ধের দলীয় বয়ানের ওপর দাঁড়িয়ে জাতিবাদী উগ্রতার যে রূপ এই সরকার প্রদর্শন করছে তাকে ফ্যসিবাদ বললে কমই বলা হয়। সংবিধানের পরিবর্তন করে নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ, বিচার বিভাগ ও আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠানের চরম দলীয়করণ ইত্যাদির নানান বৈশিষ্ট্য বিচার করে ফ্যাসিবাদের এই বিশেষ রূপের আরও পরিচ্ছন্ন পর্যালোচনা দরকার। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের সেটা হোল এই নিপীড়ক, ফ্যাসিষ্ট এবং ঘোরতর ভাবে গণবিচ্ছিন্ন চেহারা নিয়েও এই সরকার টিকে আছে। টিকে থাকার পিছনে প্রধান কারণ দিল্লীতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি একক সমর্থন। বাংলাদেশে পরাশক্তির ভূমিকা বা বিদেশী ফ্যাক্টরগুলো আগামি দিনে কী করতে পারে সেই আন্দাজ বর্তমানের এই বাস্তবতা থেকে শুরু করাই সংগত। বাংলাদেশ মূলত দিল্লীর বর্তমান কংগ্রেস সরকারের অধীনস্থ ও অনুগামি একটি সরকার। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই আগামি দিনে পরাশক্তির ভূমিকা কি হতে পারে আমরা তা আন্দাজ করবার চেষ্টা করতে পারি।
গত ২০০৯ সালে হাসিনা সরকার আসার পিছনের দুবছরে (২০০৭-৮ সালে) ধরে চলা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ঠিক হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের চরিত্র এমনই হবে। এটা যখন বাস্তবায়িত হচ্ছিল তখন এই ক্ষেত্রে ভারতের এমন বাংলাদেশ নীতির সাথে আমেরিকার অনুমোদন ও সহায়ক সমর্থন ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশে দিল্লীর স্বার্থের এক সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল ওয়াশিংটন। আবার সেটা গত তিন বছর হল উলটে গিয়েছে। আমেরিকার বাংলাদেশ নীতি আর ভারতের বাংলাদেশ নীতির মধ্যে গুরুতর ফারাক ঘটে গেছে। বাংলাদেশ নীতি প্রসঙ্গে ভারতের সাথে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য ঘটেছে এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বও দেখা দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতের নির্বাচনের ফল বাংলাদেশে কী প্রভাব ফেলবে সেটা ভাবতে হবে।
আসন্ন ভারতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস সরকার তৃতীয়বারের মত নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে এমন সম্ভাবনা একেবারেই নাই বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের রাজনীতির যাঁরা বিশ্লেষক তাঁরা এই বিষয়ে কমবেশী একমত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলো কে কী ভূমিকা নেবে সেটা এই কারণেই ভারতের নির্বাচনের মুখাপেক্ষি হয়ে রয়েছে।
আগেই বলেছি, ২০০৭-৮ সালে বাংলাদেশ নীতিতে আমেরিকা ও ভারত হাতে হাত মিলিয়ে একই অবস্থান নিয়েছিল। কারণ সেটা ছিল আমেরিকার বিদেশ নীতিতে মৌলিক দুটো ইস্যুতে অবস্থান বদলের সময়কাল। ওবামা প্রেসিডেন্সীর প্রথম টার্ম শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এর আগের প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের ওয়ার অন টেররের ব্যর্থ নীতি মার্কিন নীতি নির্ধারকদের একটা অংশের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। মার্কিন জনমতের মধ্যেও। সেই বিদেশনীতি থেকে সরে এসে নতুন কি করা যায় তা নিয়ে আমেরিকার জন্য ভাবনার প্রস্তুতিমূলক সময় ছিল সেটা। তখনও হিলারি ক্লিনটনের ‘স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ’ পুরাপুরি দানা বাঁধে নি; গণ কূটনীতির (public diplomacy) আলোকে সরকার বিরোধী জনমতকে উসকিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সংস্কারের বুদ্ধি সবে দানা বাঁধছিল। যার ফল আমরা পরবর্তীতে ‘আরব স্প্রিং’ নামে হাজির হতে দেখেছি। অর্থাৎ নতুন “আরব স্প্রিংয়ের” নীতি তখনও স্থির বা থিতু হয় নাই। জুনিয়র বুশের শেষ আমলের এই অন্তর্বর্তী পরিস্থিতিতে, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ভারতের হাতে হাত মিলানো অবস্থাটা পুরাপুরি বহাল হয়েছিল। এই সময়কালটাতে বাংলাদেশের “১/১১ এর সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের” কেচ্ছা এই বলয় পরিস্থিতির মধ্যেই পাঠ করতে হবে। চিনের উত্থানকে মোকাবিলার জন্য দিল্লী ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বিভিন্ন নিরাপত্তা চুক্তি ইতোমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ভারত প্রকৃতিগত কারনেই (natural ally) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু এই ধারণাও দুই দেশে জোরে শোরে প্রচারিত হচ্ছিল। তবে দক্ষিণ এশিয়া বা আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে আমেরিকার বিদেশ নীতিতে আমেরিকা ও ভারত হাতে হাত মিলিয়ে চলার নীতি নিতে হবে এমন সিদ্ধান্তের পিছনের তাগিদ হিসাবে দ্বিতীয় আরেকটি ইস্যু ছিল। সেই ইস্যুই আমেরিকার এই গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রভাবক ভুমিকায় পালন করেছে। কী সেই ইস্যু?
অল্প কথায় বললে, সেটা হল একক পরাশক্তি ও গ্লোবাল অর্থনীতিতে আমেরিকার একক এম্পায়ার বা সাম্রাজ্য ভুমিকায় বদল অনিবার্য ও আসন্ন হয়ে ওঠা। নীতি নির্ধারকের তা দেখতে পাচ্ছিল। এই সংক্রান্ত আমেরিকান সরকারি এক বিস্তারিত সার্ভে রিপোর্টের চুম্বক অংশগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল ২০০৭ সালে। পরিপুর্ণ রিপোর্ট আসে ২০০৮ সালে। [2025_Global_Trends_Final_Report] ঐ রিপোর্টের সারকথা সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়:
১. গ্লোবাল পরাশক্তিতে আমেরিকা আর একক ভুমিকায় থাকছে না, পরাশক্তিগত গ্লোবাল ক্ষমতা অন্তত পাঁচভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আর আমেরিকা বড় জোর ঐ পাঁচের একটা হয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে;
২. গ্লোবাল অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রবাহ পশ্চিম থেকে পূবে এশিয়ামুখী হচ্ছে। আর এটা আগামি ভবিষ্যতে কখনও আর উলটা প্রবাহ নিবে না বা পরিগ্রহণ করবে না; ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্থায়ী ভারকেন্দ্র হয়ে উঠছে এশিয়া। আগে অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনায়, পশ্চিমে উন্নত বা ডেভলপড অর্থনীতি আর বাকি সবাই উন্নয়নশীল বা ডেভলপিং অর্থনীতি বলে একটা ভাগ করতে দেখা যেত। ঐ রিপোর্টে নতুন একটা বিভাজক শব্দ বা ধারণা চালু করা হয় “রাইজিং ইকোনমি” – নতুন পাঁচ পরাশক্তির বেলায় এই নতুন নাম প্রয়োগ করা হয়। ঘটনাচক্রে ঐ পাঁচ রাইজিং ইকোনমির দুটাই এশিয়ার – চিন ও ভারত। (বাকি তিনটা ব্রাজিল, রাশিয়া ও সাউথ আফ্রিকা)। আমেরিকান বিদেশ নীতিতে দ্বিতীয় ইস্যু হাজির হবার পিছনে এই রিপোর্ট সেই পটভুমি, আপাতত সংক্ষেপে এতটুকুই।
স্বভাবতই রিপোর্টটা পরাশক্তিগত দুনিয়ার এক আসন্ন মোচড়ানির নির্দেশক বা ইঙ্গিত । তাই, আমেরিকার বিদেশনীতিতে দ্বিতীয় বদলটা আসে এই রিপোর্টকে কেন্দ্র করে। ওয়াশিংটন সিদ্ধান্ত নেয় এশিয়ার দুই রাইজিং ইকোনমির একটাকে (ভারত) কাছে টেনে, পিঠে হাত রেখে দ্বিতীয়টাকে (চিন) ঘায়েল করা। লক্ষ্য, তাতে যদি পরাশক্তিগত নিজের অবস্থান কিছু হেরফের ঘটিয়ে অন্য সম্ভাব্য পাঁচের চেয়ে কিছুটা উপরে করা যায়। মনে রাখতে হবে, পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার এই তুমুল টালমাটালের যুগে কোন রাষ্ট্রের পরাশক্তিগত ভুমিকায় হাজির হবার পুর্বশর্ত হচ্ছে সবার আগে অর্থনীতির দিক থেকে পরাশক্তি হওয়া। অর্থাৎ অর্থনীতিতে শীর্ষ ভুমিকার সবলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, গ্লোবাল অর্থনীতিতে এক বড় শেয়ার দখল করে হাজির হওয়া, বৈদেশিক বাণিজ্যে একটা ভালরকম উদ্বৃত্তের অর্থনীতি হওয়া ইত্যাদি। চিনের অর্থনীতিগত উত্থান আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর শক্তির ভারসাম্যে বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার ঐ সার্ভে রিপোর্টে গ্লোবাল অর্থনীতিতে নতুন এই পালাবদলের পরিস্কার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিল। এই সূত্রে আমেরিকার নতুন বিদেশনীতির আগ্রহে আমেরিকা-ভারতের সখ্যতার শুরু ২০০৭-৮ সাল থেকে। আর আঞ্চলিক সখ্যতার প্রথম প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশে। আমাদের ১/১১ এর সময়ে তা “মাইনাস-টু” ঘটাতে হবে এমন নিয়ত নিয়েই শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই নিয়ত মাঝপথে হঠাৎ করেই হাসিনামুখি হয়ে যায়। হাসিনার হাতে ক্ষমতা দিয়ে কেটে পড়ার দিকে ১/১১ এর ক্ষমতাসীনরা তৎপর হয়ে পড়ে। কিন্তু আগেই বলেছি, সেসময়টা ছিল বুশের ওয়ার অন টেররের নীতির ব্যর্থতা থেকে আমেরিকার সরে আসার সময় কিন্তু এর বদলে নতুন “আরব স্প্রিং” এর নীতি তখনও ঠিক গুছিয়ে থিতু হয় নাই। ফলে ভারতের সাথে আমেরিকার সখ্যতার নীতিটা দাড়িয়েছিল ওয়ার অন টেররের ব্যর্থ নীতির অপসৃয়মান আলোছায়ায়। ফলে সখ্যতা আসলে দাড়িয়েছিল এক তথাকথিত কমন ‘সিকিউরিটি ইন্টারেস্ট’ এর উপর। ওয়ার অন টেররের নীতির বৈশিষ্ট হলঃ ইসলামের কোন রূপের রাজনীতির সাথেই সখ্যতা নয়, বরং ইসলামের সকল প্রকার অভিপ্রকাশ ও রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ, ইসলামকে বিশ্বসভ্যতার খাতা থেকে মুছে দেওয়া। বিপরীতে “আরব স্প্রিং” ধরনের নীতির বৈশিষ্টটা হলঃ বিশেষ ধরনের (“আরব স্প্রিং”) ইসলামি রাজনীতির সাথে সখ্যতা, বাকি সব রূপের ইসলামি রাজনীতির সাথে আগের মতই বিরোধিতা, উৎখাত, দমন, নির্মূল ইত্যাদি। তবে তা অবশ্যই আর যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে “ওয়ার অন টেরর” শ্লোগান না দিয়ে, লো প্রোফাইলে।
কিন্তু ভারতের দিক থেকে আমেরিকা “ওয়ার অন টেরর” মোডে থাকলেই দিল্লীর – বিশেষত কংগ্রেসের বেশি পছন্দের। ফলে ২০০৭-৮ এর পর থেকে আমেরিকা যতই নতুন “আরব স্প্রিং” এর নীতিতে থিতু হয়েছে, ইসলামকে একাট্টা গণ্য করে এর সকল রূপের বিরুদ্ধে লড়বার নীতি থেকে সরে এসেছে, ততই সেটা ভারতের সাথে সখ্যতার নীতিতে একটা খচখচে কাঁটা হয়ে উঠেছে। তবে আমেরিকা-ভারত সখ্যতার মধ্যের মূল কাঁটা এটা নয়। নতুন আরও বড় কাঁটা পরবর্তীতে হাজির হয়।
আগে একটা কথা বলে নেয়া ভাল, দুই রাইজিং ইকোনমির একটাকে (ভারত) কাছে টেনে পিঠে হাত রেখে দ্বিতীয়টাকে (চীন) ঘায়েল করা – কথাটা বলা যত সহজ বাস্তবে তা ঘটানো আমেরিকার জন্য এত সরল সিধা ব্যাপার নয়। ঐ রিপোর্টের ইঙ্গিত অনুযায়ী, একালে চীন-আমেরিকার এই পরাশক্তিগত নতুন টেনশন, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ঘটছে ২০০১ সাল পরবর্তী গ্লোবাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটভুমিতে। এটা কোনভাবেই আর আগের ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ের (১৯৫০-৯০) আমেরিকা-রাশিয়া দুই ব্লকে বিভক্ত দুনিয়ার টেনশন প্রতিযোগিতার মত নয়, কোন অর্থেই। কারণ, ঐ ব্লক রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট ছিল, দুই ব্লক মানে দুটা আলাদা অর্থনীতি। আলাদা বলতে, এই দুই অর্থনীতিতে পরস্পরের মধ্যে পণ্য লেনদেন বাণিজ্যসহ কোন প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, ফলে কোন নির্ভরশীলতা সরাসরি প্রায় ছিল না বললেই চলে – এমনই আলাদা। উভয়ের মধ্যে পুঁজির চলাচল, প্রবাহ, কোন বিনিয়োগ সম্পর্ক একেবারেই ছিল না। এমনকি এটা কেবল রাশিয়ার (ততকালীল ইউএসএসআর) মধ্যেও সীমাবদ্ধ তো নয়ই; রাশিয়ান ব্লকের কোন দেশকে (যেমন পোল্যান্ড) আইএমএফ লোন দিতে চাইলেও আমেরিকা তা নাকচ করে দিয়েছিল এমন রেকর্ড আছে। এমনই দুটো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত টিকে ছিল ব্লক রাজনীতিতে গ্লোবাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, এটাই ছিল পুরা স্নায়ু যুদ্ধের মৌলিক বৈশিষ্ট। বিপরীতে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার সময় থেকেই দুটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ধরনের অবস্থানের যুগের শেষ হয়। এরপর থেকে আজকের গ্লোবাল অর্থনীতি মানে সব রাষ্ট্রই একই গ্লোবাল পুঁজির অধীনস্থ ও পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত; পরস্পর নানান সম্পর্কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে তবে ওর ভিতরেই পরস্পরের স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা লড়াইয়ে ঝগড়ায় সবাই নিয়োজিত। অর্থাৎ আমেরিকা-রাশিয়ার দুই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ অর্থনীতির টেনশন প্রতিযোগিতার বিপরীতে একালে আমেরিকা-চীনের মধ্যেও ক্রম-উদীয়মান টেনশন প্রতিযোগিতা অবশ্যই আছে কিন্তু এবার এরা দুই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ অর্থনীতির নয় বরং উভয় অর্থনীতি দুনিয়া জোড়া একই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অধীনস্থ ও পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। চীন আর আমেরিকার মধ্যে এমন নতুন সম্পর্কের সুত্রপাত বা খাতা খোলা অনেক পুরানো, সেই ১৯৭১ সাল থেকে এর পক্ষে কাজ শুরু হয়েছিল। পরস্পরের কুটনৈতিক, সামরিক ও ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থের কথা মনে রেখে নানান চুক্তি, আইন-কানুন স্থির করা এবং সেগুলোর সুরক্ষাকবচ ঠিকঠাক করে আমেরিকান নেতৃত্বে পুঁজির প্রবাহ ঢেলে চীনকে সাজানোর একটা লম্বা প্রস্তুতি পর্ব পার করে আসতে হয়েছে। আজকে যে চিন আমরা দেখছি, সেই চিন গড়তে পুর্বপ্রস্তুতিমূলক সময়ে কেটে যায় ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। এরপর আমেরিকান পুঁজিবাজারের প্রতীকি কেন্দ্র ওয়াল ষ্ট্রিট নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে পুঁজির প্রবাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে। এর পরিণতিই আজকের রাইজিং ইকোনমির চিন। দুনিয়াজুড়া একই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অধীনস্থ হয়ে এক নতুন গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে চীন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু এর ফলে একইসাথে নতুন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা গ্লোবাল অর্ডার পরিগঠনের পার্শ্বফল হিসাবে নতুন এক স্ববিরোধী দিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাজির হয়। আমেরিকান রাষ্ট্রের স্বার্থ আর আমেরিকান ওয়াল ষ্টিটের স্বার্থ আর একতালে না থেকে ক্রমশ সংঘাতমূলক চরিত্র নিয়ে হাজির হতে শুরু করে। যেমন, নিজে ফুলে-ফলে রাইজিং অর্থনীতির হিসাবে চিনের উত্থান এক বিশাল সম্ভাবনা যা আসলে ক্রমশ পুঞ্জীভুত ও আকারে বেড়ে ওঠা গ্লোবাল পুঁজির প্রতীকি কেন্দ্র ওয়াল ষ্ট্রীটের ফুলে ফেঁপে উঠা, বিশ্বপুঁজির নিজেরই সম্ভাবনা, ফলে তা ওয়াল স্ট্রিটের কাছে আদরণীয়। সম্ভাবনা এজন্য যে, পুঁজির আদি ও ইন্টিগ্রাল স্ববিরোধ হল একদিকে মুনাফাসহ ফিরে আসা পুরান বিনিয়োগ এবার আকারে বড় হবার কারণে সবসময় আরও নতুন বড় বিনিয়োগের বাজার আকাঙ্খা ও দাবী করে। কিন্তু বিনিয়োগ বাজারকে সঙ্কুচিত করে ফেলার কারণ সে নিজেই। কারণ বাজার থেকে যতই যে বড় করে মুনাফা তুলে আনে তত পরিমাণই সেটা বাজারের ভোগ/চাহিদা (ফলে নতুন উতপাদন/বিনিয়োগের বাজার) কমিয়ে ফেলে। এই স্ববিরোধে হয়রান হয়ে এটা সে সমাধানের উপায় খুজে সবসময় নতুন আন-এক্সপ্লোরড বাজার (সাধারণত কোন ছোট হয়ে থাকা অর্থনীতির রাষ্ট্রে নতুন করে) যোগাড়ের তালাশে। যদিও সেখানেও আবার সমস্যা হলো, যেহেতু সেটা নিজ রাষ্ট্র নয় ফলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ফলে বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে নাকি ঐ রাষ্ট্র কোন এক পর্যায়ে বিনিয়োগ মালিকানা তার নিজের জাতীয়করণ বা রাষ্ট্রীয়করণ করে ফেলে কি না এও এক বিশাল টেনশন। এসব বিচারে আমেরিকার ওয়াল ষ্ট্রিটের চোখে চিন লকলকে লোভে লোভনীয় এক বাজার। তার ক্রম-পুঞ্জিভুত আকার বেড়ে চলা পুঁজির আয়ু, টিকে থাকার সম্ভাবনা। তবে নিজের বিনিয়োগ নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি, আইনকানুন, আন্ডারষ্টাডিং ঠিকঠাক করতে প্রথম বিশ বছর (১৯৭১-৯০) কেটে গিয়েছিল।
কিন্তু আবার রাইজিং ইকোনমির চিনের এই পরিণতিতে রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকান রাষ্ট্রের জন্য তা প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিও হয়ে উঠছে। এই দিক থেকে আমেরিকান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ আর ওয়াল ষ্ট্রীটের অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রবলভাবে পরস্পর বিরোধী। চীন রাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হলে আমেরিকান রাষ্ট্র এতে তার বিপদ দেখে আর ওয়াল ষ্ট্রীট মনে করে এতে তার কিছু আসে যায় না। গ্লোবাল লেনদেন বাণিজ্য ব্যবস্থা দাঁড় করাতে আমেরিকার নেতৃত্বে ১৯৪৪ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ, ও মুদ্রার মান নির্ণয় (এটাই আইএমএফ প্রতিষ্ঠানের ম্যান্ডেট) ও বড় পুঁজি বিনিয়োগ বাণিজ্যের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ (এটাই বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠানের ম্যান্ডেট) ইত্যাদি নিশ্চিত করতেই গড়ে তোলা হয় আইএমএফ- বিশ্বব্যাঙ্কের মত প্রতিষ্ঠান। অথচ আজ ওয়াল ষ্ট্রিটই (তার হয়ে বিশেষ করে ‘গোল্ডম্যান স্যাসে’ কোম্পানী) চীন রাষ্ট্রকে বুদ্ধি পরামর্শ ও তাগিদ দিচ্ছে চিনের নেতৃত্বে নতুন করে আগামি বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিকস (BRICS) ব্যাংক গঠন করে এগিয়ে যেতে।
কাজেই যেকথা বলছিলাম, আমেরিকার দুনিয়ায় একক পরাশক্তি হয়ে থাকার ভুমিকার জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী নতুন পরাশক্তিগুলোর উত্থান ঠেকানো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরোধ মীমাংসা কোন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের জন্য সরল কাজ নয়। ঠান্ডা যুদ্ধের কালের মত সরল কাজ ও সময় তো এটা নয়ই। তবু সরল নয় বলে ওবামার রাষ্ট্র তো চুপ করে বসে থাকতে পারে না। যতদুর সম্ভব প্রাণপণ চেষ্টা করছে, করবে। তাই, দুই রাইজিং ইকোনমির একটাকে (ভারত) কাছে টেনে পিঠে হাত রেখে দ্বিতীয়টাকে চিন ঘায়েল করে দাবড়ানোর চেষ্টা – আমেরিকার বিদেশনীতিতে দ্বিতীয় ইস্যু বা মূল বৈশিষ্ট এটাই। যতোই পুঁজি গ্লোবাল আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে ততোই শক্তির ভারসাম্য ওয়াশিংটন থেকে সরে ওয়াল স্ট্রিটে পুঞ্জিভূত হচ্ছে। নিজের এই আভ্যন্তরীণ স্ববিরোধিতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সরাসরি চিনের উত্থান বিরোধিতা করা কঠিন হয়ে উঠেছে।
বিদেশনীতিতে এই দ্বিতীয় ইস্যু যাত্রা শুরু করে ২০০৭ সালে থেকেই। কিন্তু থিতু হয়ে আরও গোছানো ভার্সনে প্রবলভাবে প্রয়োগে আসা শুরু করে ২০১১ সালের শুরুতে। নতুন এই ভার্সনে এবার ঠিক আগের মত আর চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে পিঠে হাত রেখে আদর বা কোলে তুলে নেয়া নয়। বরং চীন-ভারত দুই রাইজিং ইকোনমির বিরোধ বা দ্বন্দ্বের মাঝে অবস্থান নেয়া যাতে নিজের একটা ভারকেন্দ্র বা ভারসাম্যের ভুমিকা নিশ্চিত করা যায়। আর সেকাজের উপায় বা টুল হিসাবে এশিয়ায় নিজের সামরিক উপস্থিতি ঘটানো ও ব্যবহার করা।
ফলে এর দুটো প্রকাশ আমরা দেখি। এক. চীনের নৌপ্রবেশ পথ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে আরব সাগর পর্যন্ত নৌসামরিক উপস্থিতির ব্যাপারে আমেরিকার তৎপর হওয়া। আসলে এটা চিনের অর্থনীতির লাইফ লাইন; মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানী তেলসহ কাঁচামাল আনা আর নিজের পণ্য বিতরণ ইত্যাদির মুখ্য লাইন। আর দুই. বাংলাদেশকে তার রাজনৈতিক ও সামরিক স্ট্রাটেজির গুরুত্ত্বপুর্ণ গুরুত্বপূর্ণ এক অপারেশনাল কেন্দ্র বানানো। ম্যাপের দিক তাকালে আমরা দেখব বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান চীন-ভারতের মাঝখানে। আগে আমেরিকার ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট বা আমাদের হিসাবে যেটা ওদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেখানে বাংলাদেশ ডেস্ক বলে আলাদা কিছু ছিল না; ইন্ডিয়ান ডেস্কেরই অন্তর্গত ছিল বাংলাদেশ। নীতির নতুন পর্যায় বা গুরুত্বের কারণে এবার ২০১১ সাল থেকে আলাদা করে বাংলাদেশ ডেস্ক খোলা হয়। আর নৌ-উপস্থিতির কারণ ঠিক কোন যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া নয়। বরং চিনের অর্থনৈতিক উত্থানের ফলে পরাশক্তিগত বা ষ্ট্রাটেজিক উৎকণ্ঠার কারনে এশিয়ার ছোট ছোট রাষ্ট্র ভীত হতে পারে এই আগাম অনুমানে ভীতুদের কাছে “অভয়” বিক্রি করা। বিনিময়ে তাদেরকে নিজের বলয়ে আনা, নিজের ষ্ট্রাটেজিক পার্টনার বানানো। এজন্য আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন এক বয়ান হাজির হয় “পার্টনারশিপ ডায়লগ”। এই অঞ্চলের সবদেশের সাথে আমেরিকা “পার্টনারশিপ ডায়লগ” নামে চুক্তির জন্য তৎপর হয়ে উঠতে দেখছি আমরা। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই “পার্টনারশিপ ডায়লগ” বিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী। ধরনের দিক থেকে “পার্টনারশিপ ডায়লগ” এর ফোকাস অর্থনৈতিক নয়, বরং ষ্ট্রাটেজিক, অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সামরিক।
ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের নতুন মাত্রা ও যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সাল থেকে। তখন থেকে অস্ত্র, পারমানবিক সরঞ্জাম, সূক্ষ্ম বা প্রিসিশন টেকনোলজি ইত্যাদি পাবার বিষয়ে আমেরিকার সাথে বিবিধ লোভনীয় চুক্তি ও বিশেষ সুবিধা ভারত পেয়ে আসছে । আবার, অন্তত ১৭-১৮ টা বিষয়ে আলোচনা ডায়লগ করার জন্য জয়েন্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জাতীয় কমিটি গঠন ও পরস্পরের সুবিধা অসুবিধা আলাপ আলোচনা করে সহযোগিতার একক নীতি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। “পার্টনারশিপ ডায়লগ” বিষয়ে আলাপও হয়েছে, কিন্তু ভারত “পার্টনারশিপ ডায়লগ” চুক্তিতে এসেছে বলে স্পষ্ট জানা নাই। অথবা হলেও ওর অগ্রগতি নাই। এর মূল কারণ, আমেরিকার বিদেশ নীতির যে দুই ইস্যু বা বৈশিষ্ট নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম শুরুর চার বছরের মধ্যে ২০১১ সালের পর থেকে এটা আর তেমন স্বাদের নয় বলে ভারতের দিক থেকে অনুভুত হতে শুরু করে। দিল্লির দিক থেকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক রচনায় অস্বস্তির মুল কারণ অনেকগুলো। যেমন,
এক. ওয়ার অন টেরর থেকে সরে সহনশীল একটা ইসলাম বা আরব স্প্রিং এর দিকে আমেরিকার ঝুঁকে পড়াটা ভারতের কাছে ঠিক আগ্রহের নয়। বুশের হকিশ বা বাজপাখি যুদ্ধবাজ লাইনের ওয়ার অন টেরর ভারতের বেশি পছন্দের।
দুই. চিনের ভয়ে বড়ভাই আমেরিকার ভারতের পিঠে হাত রাখা, আমাদের মত দেশকে যাতা দেবার কাঠি দিল্লিকে একচ্ছত্র ভাবে ব্যবহার করতে দেওয়া তা খুবই উপভোগ্য ছিল। এই সময় মার্কিন নীতি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় “নিরাপত্তা নীতিতে” দিল্লীর চোখে দেখা নীতিই মার্কিন নীতি। দিল্লির কাছেও তাই এই নীতি লোভনীয় ছিল।
কিন্তু ২০১১ এর পর থেকে ওয়াশিংটনের দিল্লির হয়ে এই অঞ্চলে নিজের স্বার্থ দেখার নীতি থেকে সরে আসতে শুরু করে। বরং স্বরূপে দক্ষিণ এশিয়ায় হাজির থাকা এবং ওর মধ্য দিয়ে নিজস্ব ষ্ট্রাটেজিক সামরিক এলিমেন্ট চর্চা শুরু করে – এটা দিল্লির জন্য জন্য অস্বস্তির কারণ। বলতে গেলে মিঠা ফল আমেরিকা ক্রমশ তিতা লাগতে শুরু করে ভারতের কাছে। বিরোধ ও অস্বস্তি ফেটেফুটে প্রকাশ হয়ে পড়ার ঘটনাটা ঘটে গতবছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট বা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ওদিক কূটনৈতিক পর্যায়ে দেবযানী খোবরাগোড় এর ইস্যুতেও। এককথায় বললে দক্ষিণ এশিয়ায় দিল্লির একচ্ছত্র আধিপত্য ওয়াশিংটন মেনে নিক দিল্লি সবসময়ই এটা আকাঙ্খা করে। ওয়াশিংটন ভারতের চোখ দিয়ে নিজের স্বার্থ দেখুক, ভারতকে এ অঞ্চলের সর্দার বানাক এমনটাই ভারতের সবচেয়ে পছন্দের। এই সম্পর্কের চর্চা বেশ কিছুকাল চললেও ২০১১ সাল থেকে আমেরিকা আর সেজায়গায় থাকতে চায়নি বা পারেনি। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে নৌ ফ্লিট নিয়ে উপস্থিত থাকবার আমেরিকান আকাঙ্খাটা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর থেকেই দিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ককে পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেছে। তার নিজের ষ্ট্রাটেজিক ও সামরিক স্বার্থের দিক থেকে একে সংঘাতসংকুল বলে মুল্যায়ন করতে ও সতর্ক হতে শুরু করেছে। সার করে বললে, এই অঞ্চলে চীনের পরাশক্তিগত উত্থান ইস্যুতে একসাথে কাজ করা পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থ নিজে সরাসরি দেখভাল করবে, দিল্লী একে বিপদ হিসাবেই দেখতে শুরু করে। কারণ এর ফলে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য এতে দিল্লীর ভাগে টান পড়ে, একটা বড় ধরণের পরিবর্তন এতে অনিবার্য হয়ে ওঠে।
পরবর্তি কিস্তির লেখাগুলোঃ
প্রথম কিস্তি
দ্বিতীয় কিস্তি
তৃতীয় কিস্তি
চতুর্থ ও শেষ কিস্তি
[লেখাটা প্রথম ছাপা হয়েছিল, ২৮ মার্চ ২০১৪।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরাশক্তি: ভারত,চিন,রাশিয়া ও আমেরিকা (১)
গৌতম দাস || Friday 28 March 14 |
http://chintaa.com/index.php/chinta/showAerticle/268/ ]