বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরাশক্তি: ভারত, চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা (৩), তৃতীয় কিস্তি


তৃতীয় কিস্তি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরাশক্তি: ভারত, চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা (৩)

চীনের বাংলাদেশ নীতি ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীনের ভুমিকা

গৌতম দাস

১৮ এপ্রিল ২০১৪

http://wp.me/p1sCvy-5E

বাংলাদেশে বসে চীন প্রসঙ্গে প্রায় সব আলোচনায় সবচেয়ে যেটা সমস্যা হয়ে দেখা দেয়, লেখক ও পাঠক উভয়েই প্রসঙ্গে প্রবেশ ও পাঠ শুরু করে এটা ধরে নিয়ে যে চীন একটা ‘কমিউনিষ্ট’ বা ‘সমাজতন্ত্রী’ রাষ্ট্র। কমিউনিষ্ট বা সমাজতন্ত্র বলতে প্রচলিতভাবে কমিউনিষ্ট বা সমাজতন্ত্র শব্দটা সম্পর্কে যে পপুলার বুঝ আছে এর উপর দাঁড়ানো ধারণাটাকে বুঝিয়েছি। আর সেই সাথে, কমিউনিষ্ট চোখে দেখা অর্থাৎ ঠান্ডাযুদ্ধের ব্লক রাজনীতির যুগে আশির দশক পর্যন্ত দুনিয়াকে যেমন বলে মনে করা হত, যে চোখে দেখা ও ব্যাখ্যা করা হত সেই বুঝ দিয়ে চীনকে বুঝা বা ব্যাখ্যা করার অভ্যাস – এই সবটাকে বুঝিয়েছি। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ার কারণে পুরানা সেই চিন্তার ফ্রেম ও অভ্যাস যার উপর দাঁড়ানো ছিল সেই বাস্তবতাই আমুল বদলে গেছে, দুনিয়ার অজস্র পরিবর্তন এসেছে। আবার আমূল পরিবর্তন শুধু সোভিয়েত রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে দুনিয়ায় ঘটেছে তাই নয়। সোভিয়েত রাষ্ট্র ১৯৮৯ সালে ভেঙ্গে পড়ার অন্তত ১৮ বছর আগে ১৯৭১ সালের আর এক ঘটনা ছিল সেটা। ১৯৭১ সালের পর থেকে ক্রমশ চীন-আমেরিকার সম্পর্কের বাস্তব প্রেক্ষিতটাই যখন বহু কিছুকে আমুলে পরিবর্তিত করে দিয়ে গেছে। খুব কম মানুষই বিশেষ করে ‘কমিউনিষ্ট’ মহলে এই গুরুত্বপুর্ণ বদল নজর আমলে এসেছে। অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ার ঘটনাটা ঘটলে বা না ঘটলেও এর থেকে স্বধীন ভাবে ঘটেছিল সেই ঘটনা। এসবের দিকে বেশিরভাগ লেখক ও পাঠকের কোন নজর হুশ সেখানে থাকেনি। সেসব বিস্তারে এখানে না যেয়ে বিষয়টাকে এককথায় বললে, এখন চীন আমেরিকা উভয়েই একই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম অধীনস্ত একক অর্থনীতিতে গভীরভাবে সম্পর্কিত দুটা রাষ্ট্র। এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়লে অথবা না পড়লেও এটা একইভাবে সত্য – এই বাস্তব দিকটায় নজরে আনতে চায় না কেউ। বরং আশির দশকের ধারণা ও ব্যাখ্যা দিয়েই দুনিয়ার ঘটনাবলিকে এখনও ব্যাখ্যা ও বুঝবার কসরত করতে দেখা যায়। এমনকি সর্বশেষ গত ২৫ বছরের রাইজিং চীনের পরিবর্তনগুলোর বিষয়ে মৌলিক তথ্য সংগ্রহের ও তাতে নজর দেবার বিষয়ে সবাই পিছিয়ে। অথচ পুরান কায়দায় বাস্তবতাহীন দৃষ্টিভঙ্গির ও অকেজো তত্ত্ব ও ব্যাখ্যার বিপরীতে একেবারে গোড়ার কথাটা হলো, চীন-আমেরিকার সম্পর্ক একই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম অধীনস্ত হবার ভিত গাড়া ঘটেছিল সেই সত্তরের দশকের শুরু থেকে। আবার রাষ্ট্র দুটার সম্পর্কিত হওয়া মানে আর তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিরোধ নাই তা একেবারেই নয়। আগে অনুমান করা হত রাশিয়া-আমেরিকা অথবা চীন-আমেরিকা ব্যাপারটা “সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিতন্ত্র” ধরণের বিরোধ, যেটা ইডিওলজিক্যাল। সেই অনুমান মিথ্যা নয়। কিন্তু এব্যাপারে এর চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ পয়েন্টটা আমাদের চোখের আড়ালে থেকে গেছে। তা হল, বিরোধটা ইডিওলজিক্যাল কি না এরচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দিকটা হলো তখন চীন-আমেরিকা (অথবা রাশিয়া-আমেরিকা) এমন দুই রাষ্ট্র ছিল নিজেদের মধ্যে কোন লেনদেন বাণিজ্যের সম্পর্কহীন এবং প্যারালাল, ফলে দুই আলাদা অর্থনীতির। আর সত্তরের দশকের পর থেকে চীন-আমেরিকা (এবং রাশিয়ার বেলায় তা ১৯৯১ সালের পর থেকে) ক্রমশ হয়ে পড়েছে সবাই একই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম অধীনস্ত। উভয়েই একই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অধীনে থাকলেও সেই সাথে তাদের মধ্যে ভালরকমের স্বার্থগত বিরোধ প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তাতে আছে। কিন্তু হাতে গুণে মনে রাখতে হবে সেটা আর ‘পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র’ ধরনের ইডিওলজিক্যাল নয়। আবার আগের মতই কিন্তু নতুন রূপে পরাশক্তিগত বিরোধ আছে তাদের মধ্যে শুধু তাই না, তা বাড়ছে কিন্তু কোনভাবেই তার ভিত্তি আগের মত ইডিওলজিক্যাল নয়। এটা “রাইজিং ইকোনমির” চীন বা রাশিয়া।

“রাইজিং ইকোনমির” চীন অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা
লেখার শুরুতে নতুন পাঁচ পরাশক্তির উত্থানের কথা তুলেছিলাম। এই পাঁচের – ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকা – মধ্যে আবার সবাই “রাইজিং ইকোনমির” দেশ বলে একদর হলেও এক মোটা দাগে চীন অন্য চারটার চেয়ে ভিন্ন, আলাদা গুরুত্ত্ব বিবেচনা রাখে। রাইজিং ইকোনমি মানে যার জিডিপি ভাল, দুই ডিজিটের দিকে তরতর করে আগাচ্ছে, প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ যেখানে ছুটে যাচ্ছে, গ্লোবাল বাজার শেয়ার যার বাড়ছে ইত্যাদি। কিন্তু ভিতরে হাত দিয়ে দেখলে বুঝা যাবে, এক চীন ছাড়া আর চার রাষ্ট্রের কারও অর্থনীতির ভিত্তি ম্যানুফাকচারিং বা ইন্ডাষ্টিয়াল প্রডাকশন নয়। অবস্থাটা হলো, ঐ চার রাষ্ট্রের অর্থনীতিও চীনের মতই বিদেশি বিনিয়োগ হজম করছে কিন্তু তা মূলত মাটির নিচের সম্পদ (তেল, কয়লা, মিনারেল ইত্যাদি) তুলে আনা আর তা বিদেশে রপ্তানী বিক্রি করতে। এরপর তা বেচে-খেয়ে শেষ। ইন্ডাষ্টি বলে নতুন কোন অর্থনীতির চক্র শুরু সেখান থেকে আবার হয় নাই। যদিও বৈদেশিক রিজার্ভ আনার তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে তা এদের সবার শক্ত হচ্ছে, উদ্বৃত্বের অর্থনীতি বলেও তা আপাতত হাজির হচ্ছে। কিন্তু ইন্ডাষ্টিয়াল প্রডাকশনের কোন ভিত্তি এর নাই। আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের রাষ্ট্রের মাটির নিচের সম্পদের অন্য রাষ্ট্রের অর্থনীতির কারণে বিপুল চাহিদা তৈরি করে আছে, বাজার আছে, বিক্রি হচ্ছে, তবেই সেগুলো ‘সম্পদ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে। নইলে তা মাটির নিচের আবর্জনা বৈ কিছু নয়। রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ২০০৭-৮ সাল পর্যন্ত ১৭০ ডলার ব্যারেল ছিল। এরপর মহামন্দা দেখা দিলেও এখনও তা ১০০ ডলারের আশেপাশে, এর নিচে যায় নাই। ফলে রাশিয়ান উদ্বৃত্ত্ব অর্থনীতি বলে কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে। আভ্যন্তরীণ বাজারমুখি ইন্ডাষ্টিয়াল ভিত্তি একটা ওর আছে ঠিকই কিন্তু উতপাদন দক্ষতা, মান ও ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা চরমে ফলে তা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানীযোগ্য নয়; একারণে রাশিয়ার ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ভিত্তি কোরিয়ারও সমতুল্য নয়। ফলে রপ্তানী দূরে থাক তা টিকে থাকার জন্য ধুকছে। এসবের বিপরীতে চীনের ভিত্তি একই সাথে ইন্ডাষ্টিয়াল প্রডাকশনের এবং তা রপ্তানীর আর নিজ ব্যাপক জনসংখ্যার গুণে নিজের আভ্যন্তরীণ বিশাল ভোক্তা বাজারের উপর দাঁড়ানো। তাহলে মুল কথা হল, রাইজিং অর্থনীতির চীন অন্য চার রাইজিং অর্থনীতির চেয়ে বিশেষ। আবার অন্য দিক থেকে, এখন সারা দুনিয়া জুড়েই প্রায় রাইজিং অর্থনীতিরসহ সব রাষ্ট্রই একই এবং একটাই – এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের ভিতরে ও পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল। এই কথাটা মনে রেখে ঘটনাবলির দিকে তাকানো, মাঠের তথ্য সংগ্রহ ও এর ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হতে হবে আমাদের। এর ভিতরেই এবার পরাশক্তিগত পাশ ফেরা অদলবদল নতুন কি ঘটছে তাই এই লেখার প্রসঙ্গ। ১৯৯০ সাল থেকে হিসাব করলে আমেরিকাসহ পশ্চিমের রপ্তানী বাজারমুখি দখলের প্রতিযোগিতায় বড় প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়ার হয়ে চীন প্রায় পঁচিশ বছর কাটিয়েছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো রাষ্ট্রীয় ঋণে চীনের কাছে ঋণী। এক আমেরিকায় চীন রাষ্ট্র তিন ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদের (ক্রয় করা আমেরিকান সরকারি বন্ড, অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি ইত্যাদি) মালিক।
কিন্তু যেটা খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ বিষয় তা হল, (১) এখন পর্যন্ত চীনের এই প্রচেষ্টা পশ্চিমের এম্পেরিয়াল কায়দায় কাঁচামাল সংগ্রহ ও বাজার দখলের মত নয়। এম্পেরিয়াল কায়দা মানে পরাশক্তিগত রাজনৈতিক সামরিক শক্তি বা যাতাকাঠি ব্যবহার করে, প্রভাব বিস্তার করে জবরদস্তি খাটিয়ে সস্তায় কাচামাল সংগ্রহ ও সেই দেশে নিজের জন্য পণ্যবাজার দখল করে আগানো। বৃহত্তর অর্থে, দুনিয়ায় আগের মতই পরাশক্তিগত এম্পেরিয়াল কায়দাই চালু আছে। কিন্তু এর ভিতরেই চীন একটু আলাদা তুলনামূলকভাবে, কোন পলিটিক্যাল যাতাকাঠি ব্যবহার না করেই এক ধরনের প্রতিযোগিতাপুর্ণ “ভাল ডিল” দিয়ে ব্যবসা বাগানোর যে সুযোগ আছে তাকেই ব্যবহার করে এগিয়ে চলছে চীন। এতটুকু তুলনামূলক অর্থে এটা ভিন্ন। এককথায় বললে অন্য রাষ্ট্রের সরকারে কে থাকবে, কাকে উঠিয়ে ফেলে দিতে হবে -একাজে ‘পলিটিক্যাল লিভারেজ’ ব্যবহার করে নিজের অর্থনীতি আগিয়ে নেয়ার নীতি এখন পর্যন্ত চীনের নয়। এখনও পর্যন্ত তাই আমাদের মত ভিন দেশে চিনের স্বার্থের প্রকৃতি রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক। এই নীতির পক্ষে দাঁড়িয়ে চীন আগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। (২) দুনিয়ায় চলমান গ্লোবাল দ্বন্দ্ব বিরোধে তা কোন ধরনের সামরিক ঝগড়া বিরোধের দিকে মোড় নিলে সেখানে আর নিজেকে জড়িত না করা। বড় জোর কূটনৈতিক পর্যায় পর্যন্ত জড়িয়ে থাকা। এটা রাইজিং চিনের আর এক লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট। চীনের এই নীতিতে ব্যতিক্রম আছে তা হল, নিজ রাষ্ট্রের ভুখন্ডগত স্বার্থের (তাইওয়ান ইস্যু সহ) বিষয় হলে তবেই সামরিক দিকও সেখানে একটা অপশন। এককথায় বললে পলিটিক্যাল খবরদারী ও সামরিক ষ্টেক বা ভাগীদার হিসাবে নিজেকে না জড়িয়ে কেবল ব্যবসা, নিজের অর্থনীতি এগিয়ে নেয়া – এই হল এখন পর্যন্ত চীনা বৈশিষ্ট। এথেকে এমন বুঝা বা দাবী করা ভুল হবে যে এই নীতি চীন আগামিতে সবসময় বজায় রাখবে। তবে এখন পর্যন্ত এটা চিনের আগাবার লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট – এদিকটা যেন আমাদের নজর না এড়ায়।
উপরের যে দুটো গুরুত্ত্বপুর্ণ বিষয় আমলে আনলাম, গত ২০০৯ সালের পর থেকে ওর প্রথম বিষয়টায় চীন আরও কিছু পালক লাগিয়েছে। এককথায় বললে তা হল, পশ্চিম থেকে ধীরে ধীরে পুব বা এশিয়ামুখি হয়ে অর্থনীতিকে আগানো। এশিয়ামুখি মানে? এশিয়ামুখি ভারকেন্দ্র করে কোন এম্পেরিয়াল কায়দার মত করে ব্যবসা ও অর্থনীতি? না অবশ্যই তা নয়। কারণ, (১),পলিটিক্যাল খবরদারী বা লিভারেজ ছাড়াই প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা এই নীতি এখনও অটুট। (২) চীন এশিয়ার পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে এক পরস্পর নির্ভরশীল ও একসাথে বেড়ে উঠার অর্থনীতি দাঁড় করাতে চায়। লো টেকনোলজি এবং শ্রমঘন গার্মেন্টসের আমাদের মত পিছিয়ে থাকা দেশের রপ্তানী শিল্পের ক্রেতা হতে চায় সে নিজে। আর এর ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ মূল মেশিনারিজ, কাপড়ের মেশিনারি ও কাচামাল তৈরি থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বিদ্যুৎ ইত্যাদি আমাদের দেশের অবকাঠামোগত খাতগুলোতে সব বিষয়ে বড় বিনিয়োগ চীন এগিয়ে আসবে, প্রবেশ করবে। অর্থাৎ এশিয়ার পিছিয়ে থাকা দেশগুলো যে যা রপ্তানী করতে সক্ষম এমন পণ্যগুলোর ক্রেতা হবে সে নিজে, নিজের বাজারে তাদের প্রবেশ সহজ করবে আর তুলনায় হাইটেক কারখানা বা অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগে সে এগিয়ে প্রবেশ করবে। এভাবে লেনদেন বিনিময়ের এক নতুন যুগের এশিয়া গড়তে চায় চীন। এভাবেই এশিয়ায় পরস্পর নির্ভরশীল ও একসাথে বেড়ে ঊঠার এক এশিয়া ভারকেন্দ্রের অর্থনীতির সুচনা করতে চায় চীন। এই ইচ্ছা ও পরিকল্পনা সম্ভব হবার বা তা যে কাজ করবে এর কারণ বা পিছনে মুল শর্ত উপস্থিত আছে। ইতোমধ্যেই চীনের শ্রমমুল্য পিছিয়ে পড়া এশিয়ার দেশের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে। ফলে আমরা সেসব রপ্তানী পণ্যের ক্রেতা হবে চীন যেসব সে নিজে উতপাদন করতে চাইলে চীনের শ্রমমুল্য বেশি বলে তা তাদের পোষাবে না। এসবেরই সারকথা হলো, চীন বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে আসার জন্য আমাদের পলিটিক্যাল ষ্টাবলিটির অপেক্ষায় আছে। একথাগুলো মাথায় রেখে এই প্রসঙ্গে ২০১২ সালের অক্টোবরে ডেইলি ষ্টার পত্রিকায় বাংলাদেশে চীনা রাষ্ট্রদুতের এক সাক্ষাতকার ও একই প্রসঙ্গে পত্রিকার নিজস্ব একটা রিপোর্ট এর লিঙ্ক দেখা যেতে পারে। উপরে বাংলাদেশের প্রতি চীনা নীতির এপ্রোচ বা পেশ হওয়া প্রসঙ্গে যে ছবি এঁকেছি ডেইলি ষ্টারের এই দুই লিঙ্ক থেকে এর স্বপক্ষে কিছু যুক্তি প্রমাণ পাওয়া যাবে।

আমেরিকা বিদেশনীতি ও সেই সুত্রে ভারতের বিদেশনীতি ক্রিয়ার চীনের প্রতিক্রিয়া
উপরে যেদিকের কথা দিয়ে শুরু করেছি তা, অবশ্যই চীনের প্রতিক্রিয়া। মানে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া। কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া? লেখার শুরুতে বলা পরাশক্তিগত ওলটপালট আসন্ন পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও ভারতের ক্রিয়ার বিরুদ্ধে। কথা শুরু করেছিলাম ২০০৭ সালের আমেরিকার বিদেশ নীতির বৈশিষ্ট – এই ক্রিয়া থেকে। শুরুতে ভারতের পিঠে হাত রাখার জন্য আমেরিকান ক্রিয়ার কথা বলেছিলাম। আজকের একই পুঁজিতন্ত্রে গাথা দুনিয়ায় প্রত্যেক রাষ্ট্রের বিদেশনীতি মতিগতি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে একেবারেই উদোম হয়ে চলে। ফলে আমেরিকা ও সেই সূত্রে ভারতের চীন নীতিতে কি আছে কি বদল এসেছে তা আর কোন গোপন বিষয় নয়। বিপরীতে চীনা প্রতিক্রিয়া এবং নীতিও। পরাশক্তিগত পালাবদলের পুরা সার্ভে রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর গত ২০০৯ সালে ওবামা চীন সফরে গিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য শুরুতে মিডিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে হম্বিতম্বি দামামা ছিল। কিন্তু যখন ওবামা ফিরলেন তখন মিডিয়া জুড়ে কেবল অর্থনীতির নানান ক্ষেত্রে চীন-আমেরিকা সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তি আর সেই সাথে ওবামার ব্যাগে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার খবর। সাধারণ্যে আমরা চীন-ভারত ব্যবসায় খবর খুব কম রাখি, বিরোধ দ্বন্দ্বের খবরই ছেয়ে থাকে উপরে। চীন-ভারতের ব্যবসা বা বাজারের আকার ছিল ২০০২ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার, আর ২০১১ সালে তা বেড়ে দাড়ায় প্রায় ৭২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ আমেরিকা ও সেই সূত্রে ভারতের চীন নীতি পরাশক্তিগত পাস-ফেরার ইঙ্গিতে যতই মারমুখি সামরিক হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে এর বিরুদ্ধে চীনা প্রতিক্রিয়া ততই এদের প্রতি ব্যবসায়িক ও সহযোগিতামূলক, গরম ক্রিয়াকে ঠান্ডা করতে ঠান্ডা পানি ছিটানোর প্রতিক্রিয়া। বড়ভাই আমেরিকা পিঠে হাত রাখায় ভারত ২০০৭ সাল থেকেই নিজেকে পরাশক্তি ভাবা শুরু করে। অপ্রয়োজনীয় মাসল দেখানোর ভিতর দিয়েই সব সমস্যা বিরোধের মীমাংসা হবে এমন ভাবা শুরু করেছিল। “এই চীন আসছে” ধরণের খবরে ভারতের মিডিয়াগুলো মুখর হয়ে থাকত। এমনিতেই সবাই জানে ভারতের মিডিয়া বা থিঙ্কটাংকগুলোও স্বীকার করে যে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ ভারতীয় বাহিনীর মনে একটা ট্রমাটিক অবস্থা তৈরি করে দিয়ে গেছে। যদিও সেই থেকে চীন-ভারতের বাস্তব বিরোধ মূলত অরুণাচল প্রদেশের সীমানা নিয়ে, মূলত এই এক ইস্যুতে। সর্বশেষ গত বছর ২০১৩ এর শেষে, সীমান্ত বিষয়ক সেই সন্দেহের গোড়া উতখাত করেছে চীন। প্রথমে গত ২০১৩ সালের মে মাসে চীনা প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেছিলেন আর এর পাঁচ মাস পরে পালটা সফরে অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর চীন সফরে, সেখানেই চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ মিটানো বিষয়ে Border Defence Cooperation Agreement (BDCA) নামের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চীন-ভারত সহযোগিতা সম্পর্কের দিক থেকে এই চুক্তি সুদুরপ্রসারি ইঙ্গিতময়। এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের যুগ খুলেছে। আর এটা ঠিক ততটাই ভারতের যুদ্ধংদেহী বাজপাখি নীতির অনুসারিদের এবং সারা পশ্চিমা মিত্রসহ আমেরিকার জন্য চপেটাঘাত।
এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম আমেরিকার সার্ভ রিপোর্টের কথা। আমেরিকা নিজের একক পরাশক্তিগত ভুমিকার পতন আসন্ন রিপোর্টের এই ইঙ্গিতে দিশেহারা হয়ে এশিয়ার রাইজিং চীন-ভারত দুই ইকোনমির মধ্যে পরস্পর লাগালাগি যত তীব্র করে রাখতে পারবে ততদিন নিজের সম্ভাবনা তার আশা জীবিত থাকবে অনুমান করে আমেরিকা নিজের এশিয়া-নীতি রচনা করেছিল। ভারতের পিঠে হাত রেখে চীনকে দাবড়ানো –এভাবে সাজাতে মনস্ত করেছিল। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান চীন-ভারতের মাঝখানে বলে সর্বশেষ ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশকে নিজের ষ্ট্রাটেজিক গুরুত্বে আমল করতে শুরু করতে ততপর হয়েছিল। স্বভাবতই চীন-ভারতের এই সীমান্ত চুক্তি সেসব পরিকল্পনার আগুনে পানির ছিটা দেবার মত। এরই কিছুটা ঝলক পাওয়া যাবে foreignpolicy জার্ণালের এই রিপোর্টে। [দেখুন,India-China Border Agreement: Much Ado about Nothing]। এর শিরোনামটাই অদ্ভুত অর্থপুর্ণ, সব বলে দেওয়া। Much Ado about Nothing – এই বাক্যাবলী আসলে সেক্সপিয়ারের এক কমেডি নাটকের শিরোনাম। দুলাইনে বললে ওর কাহিনীটা হলো, এক রাজ-সৈনিকের রাজকন্যার সাথে প্রেম। ক্লোডিয়া নামে ঐ সৈনিকের এই প্রেমে বন্ধুবেশি তার শত্রু ডন জন সবরকমভাবে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সৈনিক ও রাজকন্যার মিলন ও বিয়ে হওয়া ঠেকাতে পারে নাই। বিয়ে মিলন হয়েছিল। আশা করি পাঠক বুঝতে পারছেন কেন শিরোনামটা বহু অর্থবোধক।
সে যাই হোক, ভারত ও চীন উভয় পক্ষও পারস্পরিক সম্পর্কের দিক থেকে এই চুক্তিকে “landmark legal document” অথবা “strategic benchmark” বলে উল্লেখ করেছে। চুক্তির সারকথা হল, উভয়ে ভূমিতে যে যেখানে দখল অবস্থানে আছে তা অমীমাংসিত অবস্থায় রেখেও পরস্পর মুখোমুখি হয়ে গেলে একটাও গুলি না ছুড়ে পরস্পরের প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে পরিস্থিতি যেন কোন ধরনের সশস্ত্র বিরোধের দিকে না যায় তা নিশ্চিত করবে – এভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

চীন কি আসলেই ভারতকে মুক্তার মালার মত ঘিরে ফেলার পরিকল্পনায়
তবে শুধু সীমান্ত চুক্তিই নয়, চীন-ভারতের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠতার দিক থেকে নতুন মোড় ফেরার উপাদানও মনমোহনের ঐসফরে অন্য আর চুক্তির ফলে তৈরি হয়েছে। এটা আমেরিকার জন্য চপেটাঘাতের অনুভুতি আরও তীব্র হয়েছে।
গত ২০০৭ সালের দিকে চীনা বিনিয়োগ আগ্রহের বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট দুটা গুরুত্ত্বপুর্ণ প্রকল্প ছিল, (১) মাঝখানে প্রায় ৪৩ কিমি বার্মা পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে পুর্ব চীনের কুয়েমিন প্রদেশ পর্যন্ত যোগাযোগের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প আর (২) বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প। দুটো প্রকল্পই নিজস্ব বিনিয়োগে করে দেবার ব্যাপারে চীন আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো এই আগ্রহকে ব্যাখ্যা করেছিল চীন নাকি ভারতকে মুক্তার মালার মত চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করছে, এমন ভীতি ছড়িয়েছিল। অর্থাৎ চিনের বিদেশনীতির লক্ষ্য ও ফোকাস অর্থনীতি নয় বরং ভারতকে ঘিরে ধরার মত সামরিক-ষ্ট্রাটেজিক। কিন্তু এভাবে ব্যাখ্যা করে ভীতি ছড়িয়ে যা আড়াল করে ফেলা হয়েছিল তা হল এই প্রকল্প দুটার প্রতি আগ্রহ চিনের নিজেরই অর্থনীতি বা অবকাঠামোগত স্বার্থ। ম্যাপের দিকে তাকালে আমরা দেখব চিনের কেবলমাত্র পুর্বদিকে সমুদ্রের সীমানা আছে, প্রায় পুরা পুবদিক (পুব চীন সাগর থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত) নৌপথের জন্য খোলা, এটাই চিনের একমাত্র নৌ গেটওয়ে। বাকি তিন (পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ) দিক ল্যান্ডবর্ডারে আবদ্ধ – নৌ পথে বাইরে বের হবার সুযোগ নাই। চীনের সব অঞ্চলে সুষম সুযোগ সৃষ্টির জন্য বিশেষ করে দক্ষিণ দিকে (kunming Province) ও পশ্চিম দিকে (Xinjiang and Tibet Province) অঞ্চলগুলোকে কাছাকাছি নৌপথের যোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসা – এটা প্রধানত চীনের নিজের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্বার্থ। এর উপায় হিসাবে চীন তার দক্ষিণ ও পশ্চিম দুটা দিক থেকেই কাছাকাছি কোথাও গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা চিন্তা করে। এর একটা পাকিস্তানের বেলুচিস্থানের গোয়াদার (Gwadar port) আর অন্যটা বাংলাদেশের মহেশখালির সোনাদিয়ায়। প্রথমটা চিনের পশ্চিম দিক (Xinjiang and Tibet Province) আর দ্বিতীয়টা দক্ষিণ দিকের (kunming Province) প্রদেশগুলোকে নৌপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছের হয়। গোয়াদার পোর্ট চীনা বিনিয়োগে এবং চীনা কোম্পানীর হাতে ২০০৭ সালে কনস্ট্রাকশন শেষ হয়েছে, কিন্তু পোর্টকে কেন্দ্র করে আশেপাশে রপ্তানীর জন্য উতপাদন এলাকা গড়ে তোলা আর পোর্ট অপারেশনের দায়িত্ত্ব দিয়ে চুক্তি হয় সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটির সাথে। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনকভাবে তা চালাতে না পারার কারণে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এই চুক্তির দায়দেনাসহ নতুন হস্তান্তরের চুক্তি হয় এক চীনা সরকারি অপারেটর কোম্পানীর সাথে। সেই থেকে গোয়াদার পোর্ট চীনা সরকারি অপারেটর কোম্পানির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এখন অর্থনৈতিক অর্থে ষ্ট্রাটেজিক দিক থেকে দেখলে গোয়াদার পোর্ট থেকে সবার চেয়ে বেশি লাভবান হবে চীনের অর্থনীতি। না সেটা পোর্ট পরিচালনা থেকে ব্যবসায় মুনাফা করার কারণে নয়। মুনাফা অবশ্যই হবে তবে আসল অর্থনৈতিক লাভের তুলনায় এটা নস্যি। চীন আরব দেশগুলো থেকে বছরের তার মোট চাহিদার ৬০% তেল কিনে। এই তেল আরব সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর মানে ভারত-শ্রীলঙ্কা ঘুরে, এরপর আরও দক্ষিণে নেমে, ডানে ইন্দোনেশিয়া বায়ে মালয়েশিয়ার মাঝের চিকণ মালাক্কা প্রণালি নৌপথ ধরে সিঙ্গাপুর পেরিয়ে একেবারে বায়ে মোড় নিলে তবেই দক্ষিণ চীন সাগরে মানে চীনের বন্দরে পৌছাবে। আর ভুখন্ডগত দেখলে এটা পুরাপুরি চিনের পশ্চিম অঞ্চল থেকে চিনের পুবে ভ্রমণ। কিন্তু গোয়াদার পোর্ট মূলত আরব সাগরের মুখে (এককালে তা ওমানের অধীনস্ত এলাকা ছিল। বেশিদিন নয় গত ১৯৫৮ সালে ওমানের কাছ থেকে তিন মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।) ফলে নৌপথে মধ্যপ্রাচ্যের তেল আরব সাগর থেকে বের হবার মুখেই গোয়াদার পোর্টে নামিয়ে তা পাকিস্তানের কারাকোরাম হাইওয়ে সড়ক ধরলে উত্তর-পশ্চিম দিকে (Xinjiang and Tibet Province) অঞ্চলগুলো যাওয়া সবচেয়ে সহজ, কম খরচে ও কম সময়ে। এটাই চীনের অর্থনৈতিক অর্থে ষ্ট্রাটেজিক বিরাট লাভ। এজন্য ভবিষ্যতে পাইপ লাইন স্থাপন করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে গোয়াদার হয়ে সরাসরি তেল কেনা ও পাইপলাইনে পরিবহণ করে নেবার পরিকল্পনা চীনের আছে।
তার মানে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়তে বিনিয়োগে যাওয়া সবার উপরে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে বিরাট গুরুত্বপুর্ণ। এটা ছাড়াও তুলনায় গৌণ স্বার্থ হলেও বিষয়টাকে সামরিক অর্থে ষ্ট্রাটেজিক দিক থেকে দেখলে অবশ্যই চীনের সেই সুবিধাও আছে সন্দেহ নাই। তবে এটা বাড়তি পরে পাওয়া সুবিধা। বাড়তি পরে পাবার সুবিধা নিয়ে অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যেকার প্রতিযোগিতা সবসময় থাকে এবং চলছে। যেমন, আগেই বলেছি আইনীভাবে গোয়াদার পোর্টের অবস্থান পাকিস্তানের নৌসীমান্তের ভিতর অন্তর্ভুক্ত হলেও ঐ সীমান্ত ডাঙ্গার দিক থেকে একই সঙ্গে তা পাশের ইরানের সাথে পাকিস্তানেরও সীমান্ত। আর ঠিক ইরানী ঐ সীমান্তে আর একটি নৌবন্দর তৈরি হয়েছে প্রায় সমকালীন সময়। ইরানের ঐ নৌবন্দরের নাম চাহ-বাহার (Port of Chabahar), প্রশাসনিকভাবে এটা ইরানের সিসতান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। আর এই পোর্ট তৈরির অর্ধেক বিনিয়োগ করেছে ভারত সরকার এবং এই পোর্ট মূলত ভারত ব্যবহার করে ইরানের ভিতর দিয়ে সড়ক পথে আফগানিস্তানে ভারতীয় পণ্য আনা-নেয়ার জন্য। ফলে স্বভাবতই ভারতের অর্থনৈতিক ছাড়াও সামরিক ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থ ঐ চাহ-বাহার পোর্টের কারণে এসেছে। তাহলে সামরিক ষ্ট্রাটেজিক দিক থেকে দেখলে ঐ পোর্টের কারণে যেন ভারতও পাকিস্তানকে (ফলে ভারতের চীনে প্রবেশেরও) ঘিরে টুটি চেপে ধরেছে (মুক্তামালার মত) এমন অর্থও করা সম্ভব। কিন্তু তুলনায় এই ধরনের অর্থ করে মিডিয়া প্রচারণা আমরা দেখিনা। আসলে পরাশক্তিগত পারস্পরিক অর্থনৈতিক ছাড়াও সামরিক ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থের প্রতিযোগিতা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু কোনটাকে ভয়ভীতির বিষয় বলে আভ্যন্তরীণভাবে নিজের নাগরিক বা অনেক সময় আঞ্চলিক শ্রোতাকে লক্ষ্য করে প্রপাগান্ডা করবে সেটাই গুরুত্বপুর্ণ দিক। আর এর ভিতর দিয়ে ঐ রাষ্ট্রের বিদেশনীতির একটা প্রকাশ আমরা দেখি। আমার কথা আরও স্পষ্ট হবে, বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে ভারতের আগের অবস্থান আর এখনকার অবস্থান লক্ষ্য করলে।

বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়তে চীনা আগ্রহঃ
এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের বিনিয়োগ আগ্রহের মুল কারণ চীনের কুনমিং প্রদেশের যোগাযোগ সহজ করা এই অর্থনৈতিক স্বার্থ। কিন্তু ভারত এই ব্যাপারটাতে নিজের পুবের রাজ্যগুলোর সাথে নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থাৎ অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে বিরাট লাভজনক ও প্রয়োজনীয় মনে করলেও তা চীনের উদ্যোগ আগ্রহের, ফলে ষ্ট্রাটেজিক সামরিক দিক বিবেচনা থেকে ২০০৭ সালে থেকেই প্রবল সন্দেহের চোখে তা দেখতে থাকে। সে সন্দেহ মিডিয়ায় প্রকাশ করতে থাকে। শুধু তাই না, যতদুর সম্ভব বাংলাদেশকে প্রভাবিত করে তাকে বিরত বা অনাগ্রহী রাখার চেষ্টা করে। বার্মাকেও প্রভাবিত করেছিল একই অবস্থান নিতে। বার্মা ভারতের দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছিল। কারণ বার্মার জন্য সেসময়টা ছিল দীর্ঘ কয়েকযুগ আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্থনৈতিক অবরোধে একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেখতে পাবার সময়। সুযোগটা এসেছিল ভারতের মধ্যস্থতায়। কারণ ভারতের মাধ্যমে পশ্চিমের সাথে রফা করে অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছিল তখন সেখানে। ফলে সেদিকে তাকিয়ে ভারতের প্রভাবে বার্মাও চীনা প্রকল্পে অনাগ্রহ দেখিয়েছিল। আর এই ঘটনায় তখন চীন প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ মজার। দুরদর্শী তো বটেই। চীনের পররাষ্ট্র অফিস বলেছিল, যেদিন বার্মিজ জনগণ আগ্রহ বোধ করবে সেদিনের জন্য এই প্রকল্প-প্রস্তাব আপাতত তুলে রাখা হল।

ভারত কি হুশে ফিরেছে নাকি এখনও দ্বিধান্বিত ও কৌশলী প্রকাশেই আছে
গত দেড় দুই বছর ধরে এখন ভারতই এই দুই প্রকল্পের ব্যাপারে উল্টা আগ্রহ দেখানো শুরু করেছে। এমনকি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মনমোহনের ঐ সীমান্তচুক্তি বিষয়ক চীন সফরে এক জয়েন্ট ষ্টেটমেন্টে স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাতে আরও আগ বাড়িয়ে Bangladesh-China-India- Myanmar economic corridor গড়ার লক্ষ্যে নতুন এক চুক্তি করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখিত হয়েছে।
এর মানে দাঁড়াল এতদিন চীনা প্রকল্প-প্রস্তাব নিয়ে তা নাকি মুক্তামালার মত ভারতকে ঘিরে ফেলার চীনা ষড়যন্ত্র বলে ভারত যে গল্প ছড়িয়েছিল তা ভিত্তিহীন ছিল -এটা ভারত নিজেই স্বাক্ষ্য দিল। তবে মূল বিষয় হল, ভারতের একটা অনাস্থা চীনের উপর ছিল যদিও তা তৈরি করার পিছনে দায়ী খোদ ভারতের আমেরিকান নীতি। বিস্তারে না গিয়ে সংক্ষেপে বললে এবিষয়টা হল এই যে পাঁচ রাইজিং ইকোনমির উত্থান এই ফেনোমেনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার একক পরাশক্তিগত ভুমিকার সমাপ্তি এবং তা উলটপালট ঘটিয়ে দুনিয়ার নতুন পরাশক্তিগত বিন্যাস আসন্ন -একথা লেখার শুরু থেকে বলে আসছি। কিন্তু এটা শুধু পরাশক্তিগত নতুন বিন্যাস নয়, এই ফেনোমেনার মূল তাতপর্য হলো, এটা ১৯৪৪ সাল থেকে তৈরি ও চলে আসা আমেরিকার নেতৃত্ত্বে যে গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডার চালু হয়েছিল (আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ বা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে) তার আয়ু শেষ হতে চলছে আর এটা প্রতিস্থাপিত হতে যাচ্ছে চীন বা রাইজিং অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্ত্বে। চলতি অর্ডারটাকে যদি অতীত বলি তবে দুনিয়ার গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডারের আগামি আসছে চীন বা রাইজিং অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্ত্বে। এটা চারদিক থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। এবং এটা কোনভাবেই পুরানা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এর মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেখেই এর পুনর্গঠন (চীন, রাশিয়া বা ভারতকে আরও বেশি জায়গা ছেড়ে দিয়ে) এভাবে হচ্ছে না। হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমশ ননফাংশনাল বা অকেজো প্রভাবহীন হয়ে পড়া আর চীনের নেতৃত্ত্ব নতুন সমতুল্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার মধ্যদিয়ে। এটা শুধু আমেরিকা তার সার্ভে রিপোর্টে টের পেয়েছে তাই নয়, ২০০৯ সালে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এর বার্ষিক সম্মেলন হয়েছিল তুরস্কে। সে সভায় ঐ প্রতিষ্ঠান দুটো আসন্ন গ্লোবাল অর্ডারে পরিবর্তন টের পেয়ে বা ব্যাপারটাকে পরোক্ষে স্বীকৃতি দিয়ে ঐ সম্মেলন আহবান জানিয়েছিল চীনকে। চীনের মুদ্রা ইউয়ানকে তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময়ের মুদ্রা হিসাবে (ডলার, পাউন্ড, ইউরো ও ইয়েনের পাশাপাশি) জায়গা দিতে রাজি বলে জানিয়েছিল। কিন্তু এপর্যন্ত চীন সেই পথে সাড়া দেয় নাই। না দেবার পিছনের কারণ হল, (১) চীনের প্রতি এই প্রস্তাবের অর্থ হল আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো যেগুলো আমেরিকার নেতৃত্ত্বে ও নিয়ন্ত্রণে এখন যেমন আছে ওর ভিতরেই চীনকে জায়গা দেয়া কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ অটুট থেকে যাওয়া যা চীনের স্বার্থ নয়। (২) চীনের স্বার্থ এধরণের প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ঐ নিয়ন্ত্রণ সম্পুর্ণ ভেঙ্গে (নতুন ম্যান্ডেটে) নতুন ভারসাম্যের প্রতিষ্ঠান দেখতে চাওয়া। (৩) চীনের কাছে এবং বাস্তবত ব্যাপারটা গায়ের জোরের বা চাপ দিয়ে দাবী আদায় করে নেবার বা কারও অনুগ্রহে তা পাবার বিষয় নয়। চীন সেজন্য তার আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য যত বেশি সম্ভব ইউয়ানের মাধ্যমে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়। এবছর ২০১৪ জানুয়ারিতে ইউয়ান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রার তালিকায় সপ্তম স্থান দখল করে। বিশেষ করে হংকং মার্কেটে লেনদেনের ৭৩% এককভাবে সম্পন্ন হয় ইউয়ানে।
আমরা মনে রাখতে পারি, ১৯৪৪ সালে আইএমএফ গঠনের সময় তা আমেরিকান ডলারের ভিত্তিতে সাজানো ও আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ নেতৃত্ত্ব সম্পন্ন হয়েছিল, অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র তা মানতে বাধ্য হবার পিছনে মুল কারণ সেসময় আন্তর্জাতিক লেনদেন বাণিজ্যে ডলারে বিনিময় ছিল সর্বোচ্চ ও একক আধিপত্যে এবং আমেরিকা একমাত্র উদ্বত্ত্ব বাণিজ্য অর্থনীতির রাষ্ট্র ছিল তাই। ফলে আইএমএফে আমেরিকান কর্তৃত্ত্ব ও নেতৃত্ত্ব এসেছিল সামরিক বা পরাশক্তিগত আধিপত্যের কারণে নয়। যদিও প্রতিষ্ঠানগতভাবে পুরানা গ্লোবাল অর্ডার ভেঙ্গে পড়া আর বদলে নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রতিস্থাপন যা নতুন গ্লোবাল অর্ডারের জন্ম দিবে তা ঠিক (আইএমএফ অথবা বিশ্বব্যাংকের মত) কোন প্রতিষ্টানের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে ঘটবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আসন্ন নতুন গ্লোবাল অর্ডার এই ফেনোমেনা কে BRICS ফেনোমেনা অথবা ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রতি বছরের BRICS সামিট এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। আর এই সামিট থেকে BRICS ব্যাংক নামে কার্যক্রম যা মূলত বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধেয়ে আসছে। আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক অংশ হিসাবে সারকথাটা হল, চলতি গ্লোবাল পুজিতান্তিক অর্ডারটাকে দুনিয়ার অতীত বললে দুনিয়ার আগামি হল BRICS ফেনোমেনা।
কিন্তু আমেরিকার দেয়া প্রলোভনে পড়ে BRICS ফেনোমেনাকে মনোযোগে আগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে ভারতের ভুমিকা সবচেয়ে নেতিবাচক। এককথায় বললে এখন পর্যন্ত কংগ্রেস দলের নেতৃত্ত্বে ভারতের নীতিনির্ধারকেরা দ্বিধাগ্রস্থ। একদিকে তারা বুঝে স্বীকার করে বলেই মনে হয় যে দুনিয়ার আগামি ফলে শেষ বিচারে ভারতের মূল স্বার্থেরও আগামি হল BRICS ফেনোমেনা এবং একে আগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে নিজের ভুমিকা অংশ সম্পন্ন করা। কিন্তু আমেরিকার অফার করা সুবিধাদির লোভে অর্থাৎ পুরানা গ্লোবাল অর্ডারটা থেকে কেবল নিজের জন্য কিছু সুবিধা নিংড়ে নিতে গিয়ে সে BRICS ফেনোমেনাকে আগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে নিজের ভুমিকা অংশ সম্পন্ন করতে গড়িমসি করে চলেছে। এরই বাইরের প্রকাশ হল, এতদিন খামোখা চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের জুজুর ভয় দেখিয়ে আমেরিকার সাথে গাঁটছাড়া বাধাটাকে নিজের জনগণ ও নিজের দ্বিধাগ্রস্থ ভুয়া নীতির পক্ষে ন্যায্যতা হিসাবে দেখানো। এই হোল তার মারাত্মক দ্বিধার দিক। ওদিকে ভারতের এই দ্বিধার দিকটা, খামোখা চীনের সাথে “আগামির সম্পর্কটাকে” সামরিক সংঘাতপুর্ণভাবে দেখানোর চেষ্টাটা চীনের কাছে পরিস্কার। কিন্তু চীন জানে এবং বাস্তবতই তাই যে BRICS ফেনোমেনাকে এগিয়ে নেয়া এটা জবরদস্তির বিষয় নয়, প্রতিহিংসার বিষয় নয় ভারতের সম্পুর্ণ স্বইচ্ছার বিষয়, নিজের স্বার্থ বিষয়ে হুশে আসার বিষয়। তাই এবিষয়ে চীনা নীতি অবস্থান ধৈর্য ধরার নীতি। এবং চীন তাতে বিজয় লাভ করছে। একদিকে বাংলাদেশ নীতিতে ভারত-আমেরিকার হানিমুনের জায়গায় বিরোধ সংঘাত হাজির হবার কারণে আর ওদিকে চীন-ভারতের সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের পর আগ বাড়িয়ে Bangladesh-China-India- Myanmar economic corridor গড়ার লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়তে চায় ভারত। অথচ এই অর্থনৈতিক করিডরের উদ্যোগের কাজটা এতদিন ফেলে রেখেছে ভারতের আমেরিকার সাথে এতদিনের গাটছাড়া বেধে চলার নীতি, পুরানা গ্লোবাল অর্ডারটা থেকে স্বার্থপরের মত একা নিজের জন্য সুবিধা নিংড়ে নেয়া যাবে বলে অনুমানে চলার নীতি। এছাড়া ভারতের নীতিনির্ধারকেরা কি আসলে কতটা সিনিসিয়ারলি মনস্থির করেছে যে আমেরিকান দেখানো লোভ ছেড়ে গ্লোবাল অর্ডারের আগামির পক্ষে তার নিরলস কাজ করা উচিত? আমরা এখনও নিশ্চিত নই। যতদুর বুঝা যাচ্ছে ভারত এখনও ব্যাপারটাকে আমেরিকাকে শায়েস্তা করার বিষয় হিসাবে দেখছে। হয়ত ভাবছে এভাবে আমেরিকাকে চাপে ফেলতে পারলে ২০০৭ সালের মত আবার আমেরিকার যাতা কাঠি ব্যবহার করার সখ্যতায় আমাদের মত দেশের উপর রুস্তমি চালিয়ে যাওয়া যাবে। ফলে একদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমন খুরশিদের সর্বশেষ ডিসেম্বর ২০১৩ তে ওয়াশিংটন সফর থেকে ফিরে জানিয়েছিলেন আমেরিকা যেন ভারতের চোখে দক্ষিণ এশিয়ার নিজের নিরাপত্তা স্বার্থকে দেখে – অর্থাৎ ভেঙ্গে অকেজো হয়ে পড়া এই পুরানা ২০০৭ সালের ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের ভিত্তিটাই আবার ফিরে আসুক সালমন খুরশিদ সে আকাঙ্খার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। অথচ একই সময়ে মনমোহন চীন সফরে গিয়ে Bangladesh-China-India- Myanmar economic corridor গড়ার লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়তে তাগিদ দিয়ে চীনের সাথে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা দিচ্ছেন। এই হল ভারতের মারাত্মক স্ববিরোধী বিদেশনীতি।ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি নতুন মন্ত্রী হবার পর তোফায়েল আহমেদ ভারত সফরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তাকেও ইকোনমিক করিডরের ব্যাপারে প্রবল সোচ্চার হতে দেখেছিলাম আমরা প্রেস মিটিংয়ে। যদিও গুরুত্ত্বপুর্ণ একটা টুইষ্ট ছিল সেখানে। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিনটা পার হয়েছিল একা ভারত এর পক্ষে আর অন্য পক্ষ সব দেশ, যারা বাংলাদেশে কি হয় তাতে তাদের ষ্টেক বা স্বার্থ আছে বলে অনুভব করে তারা এমন নির্বাচন দেখতে চায়নি এমন পরিস্থিতিতে। অন্যভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বললে ভারত আর আমেরিকার মুখোমুখি অবস্থানের চরম প্রকাশ ঘটেছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা আরও নির্মম। সরকারের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা ফেল করায় আমাদের চলতি বাজেট ঘাটতি ফলে এডিপিতে কাটছাট আর আগামি জুনের বাজেটেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে চলতি সরকার। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বাজেটের ঘাটতি পূরণ আর স্থবির বিদেশি বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে যেন চীন বিশাল ত্রাতা হিসাবে এখনই হাজির হয়ে যাবে। আর বাংলাদেশ যেন পশ্চিমের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবে অথবা পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য কিছুই যায় আসে না। এমনই ধারণা ছুড়েছিলেন সেদিন তোফায়েল আহমেদ।
নিজের নয় ভারতের বাংলাদেশ নীতির উপর পুরা ঠেস দিয়ে দাড়ানো হাসিনা সরকার বা এর কোন মন্ত্রী আমাদের এই ধারণা দিতে শুরু করেছিল অর্থনৈতিক সমস্যা মিটানোর জন্য এই তো চীন এসে গেছে। যেন এতদিন পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে বড়ভাই আমেরিকার ভারতের পিঠে হাত রাখা, যাতাকাঠি ধার দেয়া, নিজেকে পরাশক্তি ভাবতে শুরু করা ইত্যাদির লোভ ভারত ত্যাগ করেছে, সেই সুবাদে আমাদের উপর আমেরিকার ধার দেয়া যাতাকাঠি ব্যবহার করে সরকারে কে থাকবে তা নির্ধারণের লোভ ত্যাগ করেছে? যেন ভারত এতদিন দ্বিধা শুণ্য একাগ্র মনে আগামি গ্লোবাল অর্ডারের পক্ষে চীনের সাথে কাজ করেছে। অথচ এটা সোনার পাথরের বাটির মত। কংগ্রেসের ভারত নিজেকে পরাশক্তি ভাবার ভান করে আমাদের উপর খামোখা রুস্তমি দেখাতে চায়, আমেরিকার সাথে বাংলাদেশ নীতিতে সাংঘার্ষিক করে, একলাই রাজা ভাব দেখাতে চায়। এই হলো তার স্ববিরোধী নীতি। আমাদের উপর খামোখা রুস্তমি দেখানোর সময় ভুলে যায় ঐ রুস্তমির পিছনের যাতাকাঠিটা নিজের নয়, নিজে সে কোন পরাশক্তি নয়, ওটা আমেরিকার ধার দেয়া। আবার, চীনের সাথে সীমান্ত চুক্তি এবং Bangladesh-China-India- Myanmar economic corridor যদি আজ এতই গুরুত্বপুর্ণ মাইলষ্টোন বলে অনুভুত হবে তাহলে আমেরিকার পাল্লায় পড়ে গত সাত বছরের চীন বিদ্বেষী নীতি – চীন আসতেছে, এই সীমান্ত হামলা দিল বলে আমেরিকার কোলে উঠে পড়া – সম্পর্ককে খামোখা শত্রুতামূলক করে দেখা এসব তাহলে মারাত্মক ভুল পথ ছিল – এটা নিজেই প্রকারন্তরে স্বীকার করছে। এককথায় বললে গত সাত বছর কংগ্রেসের ভারত এক যুদ্ধবাজ মুই কি হনু রে নীতি অনুসরণ করেছে। বাংলাদেশকেও বিপদের মুখে রেখেছে। কোন হোমওয়ার্ক ছাড়া ভারতের এসব কাজকে পোলাপানি নাদান নীতি বললেও সম্ভবত কম বলা হবে। অথচ আমাদের মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে বেকুব বানিয়েছেন যে চীনের সঙ্গে ভারতের ইকোনমিক করিডর প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু হবার কারণে আর চিন্তা নাই চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতির সব সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছে। আর মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে বেকুব হয়ে এবার আমাদেরকেও বেকুব বানাতে ঐ প্রেস ব্রিফিংয়ে ইকোনমিক করিডরের ব্যাপারটা যেন আমাদের উদ্ধারকর্তা ঘটনা। একথা ঠিক যে ইকোনমিক করিডরের ব্যাপারটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বড় ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে। কিন্তু কঠিন সত্যটা হল ভারতের আমেরিকার কোলে চড়ে বসে থাকা আর চীন প্রসঙ্গে ভয়ভীতি ছড়িয়ে রাখার নীতির কারণেই ইকোনমিক করিডরের ব্যাপারটা শুরুই করা যায়নি, এখন হোমওয়ার্ক শুরু হয়েছে মাত্র। যার ফল আসতে কমপক্ষে ১০ বছর পিছনে আমরা।
আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক চীনের বিদেশ নীতির সারকথাগুলো দাঁড়াচ্ছে, ভারতের বাংলাদেশ নীতির বিপরীতে চীনের নীতির মৌলিক দিকগুলো গত প্রায় দুই দশক ধরে কোন এদিক ওদিক চড়াই উতরাই ছাড়াই একতালের। আর এর সবচেয়ে গুরুত্ত্বপুর্ণ ও নতুন বৈশিষ্টের দিক হল, চীনের নীতি কোন পলিটিক্যাল ষ্টেক বা রাজনৈতিক খবরদারি পাবার দিকে না তাকিয়ে মুলত অর্থনৈতিক। কোন কাজের চুক্তি পাবার জন্য রাজনৈতিক লিভারেজের উপর ভরসা করে তা পাবার চেষ্টা করা নয়। সরকারে কে থাকবে না থাকবে সে ব্যাপারে কোন মাথা সে ঘামায় না। গত একবছরে চীনা এমবেসি ছয়বার বিবৃতি দিয়েছে। এমন প্রতিটা বিবৃতিতেই এই নীতির প্রতিফলন থেকেছে।
তবে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে গতবছরের শেষ দিকে জাতিসংঘের কোন ভুমিকা বা মধ্যস্থতায় একটা সমাধান আনা যায় কি না এনিয়ে আমেরিকার নেতৃত্ত্বে পশ্চিমা কুটনৈতিকদের প্রচেষ্টা ছিল। ঐ প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানটা জাতিসংঘ বলেই ভেটো ক্ষমতাওয়ালা চীনকেও ঐ উদ্যোগে জড়িত ও অন বোর্ড বা নৌকায় তোলার তাগিদবোধ করেছিল পশ্চিম। সেই সুত্রে আমরা চীনকে দেখেছিলাম বিবৃতি দিতে। আবার পশ্চিম একা কোন উদ্যোগ নিলে তা যেন চীনের কাছে নিজ অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে সন্দেহজনক বা বিরোধাত্মক বলে মনে না হয় সেটা এড়ানোর কথা ভেবে পশ্চিমা উদ্যোগ নিজেই চীনকে অন বোর্ড করার তাগিদবোধ করেছিল। এছাড়া আরও একটা দিক আছে চীনকে অন বোর্ড করা মানে রাশিয়াকেও অন বোর্ডে পাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া।
চীন প্রসঙ্গে এখানেই শেষ করছি। পরের চতুর্থ ও শেষ কিস্তি রাশিয়া প্রসঙ্গে।

পরবর্তি কিস্তির লেখাগুলোঃ
প্রথম কিস্তি
দ্বিতীয় কিস্তি
তৃতীয় কিস্তি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s