অপহরণ গুম ও খুনের বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবার পিছনের গুরুতর সত্য


অপহরণ গুম ও খুনের বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবার পিছনের গুরুতর সত্য

গৌতম দাস

অপহরণ, গুম ও খুনের ভিতর ভাসছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে এটা এক চরম অবস্থানে এসে ঠেকেছে। হয়ত আরও কোন চরমে তা পৌছাবে। আতংক সমাজের প্রায় সব অংশকেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে এর আগে অপহরণ গুম ও খুন ঘটেনি, কিম্বা এখনকার মতো চরম আকার ধারণ করে নি । গত এক দেড় বছরে তো বটেই এমনকি গত ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের পর অপহরণ, গুম ও খুনের সংখ্যা ভীতিকর জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল। অথচ এখনকার তুলনায় অপহরণ গুম ও খুন তখন গণমাধ্যমে আসে নি। যারা এর শিকার হয়েছিল তাদের প্রতি গণমাধ্যম সদয় ছিল না। এখনও সাতক্ষীরায় যে অপহরণ, গুম বা খুনের ঘটনা চলছে তা নারায়নগঞ্জের মত একইভাবে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে না। বিচারবহির্ভূতভাবে এদের ‘নির্মূল’ করবার ইচ্ছাটাও সমাজের একাংশের মধ্যে প্রবল হয়ে আছে। ফলে সেই সময়ের অপহরণ, গুম ও খুনের মিডিয়া রিপোর্টিং না হবার কারণে বিষয়টাকে সরকার আড়ালে রাখতে পেরেছিল এখনও “বিশেষ বিশেষ” অপহরণ, গুম বা খুনের বেলায় পারছে। যারা অপহরণ গুম ও খুন হচ্ছে তারা “জামাত-হেফাজত-বিএনপি” ফলে রাষ্ট্রের দিক থেকে এদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ড চালিয়ে যাওয়া জায়েজ -গণমাধ্যম খুব সফলভাবেই এই বিকৃত মানসিকতার চর্চা জারি রাখতে পেরেছিল ও পারছে। যে র্যা ব-১১ এর কমান্ডারের নামে এত অভিযোগ, শীর্ষে তিনি, নারায়নগঞ্জে বদলি হয়ে আসার আগে তিনি লক্ষীপুর জেলায় ছিলেন। সেখানকার বিএনপি ও জামাত নেতা কর্মীদের হত্যার অভিযোগ নিয়মিত আমরা দেখেছি। একবার তো ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে জনরোষ থেকে স্থানীয় র্যা ব বাহিনীকে উদ্ধার করতে হয়েছিল। কিন্তু লক্ষীপুরের সেসব ঘটনায় আজকের মত আমরা সামাজিক-রাজনৈতিক কোন প্রতিক্রিয়া দেখিনি। অর্থাৎ বিচার ও আইনবহির্ভুতভাবে অপহরণ, গুম বা খুনের এক রাজনৈতিক-সামাজিক স্বীকৃতি আমরা দিয়েছি। অথচ সেই মিডিয়া ও সেই রাজনীতি আজকে অপহরণ, গুম বা খুনের বিরুদ্ধে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে চাইছে। বড়ই তাতপর্যপুর্ণ।
রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী ভূমিকা ও আইন শৃংখলা বাহিনীর আইন বহির্ভূতভাবে হত্যার পক্ষে দাড়ানো লোকের অভাব হয়নি, আর তাদের যুক্তির অভাব ঘটে নি। যেমন, এমন যুক্তিও আমরা শুনেছি যে, সর্বসাধারণের জান ও মাল রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের; অতএব রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নাগরিকদের পঙ্গু কিম্বা হত্যা করতেই পারে। খুবই মজার যুক্তি এটা। কিন্তু সমাজের ভেতর থেকেই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, কিন্তু গড়ে ওঠে সমাজেরই উর্ধে সমাজের ওপর চেপে বসে থাকা ‘দানব’ হিসাবে – এটা অতি পরিচিত পুরানকাল থেকেই চলে আসা বামপন্থি এক সবল চিন্তা ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রকে দেখবার এই পুরানা বামপন্থি চিন্তার জায়গাটা বামপন্থিদের মধ্যেও খুব একটা অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ।
সেটা দূরে থাকুক, এখন ‘রাষ্ট্র’ নামক এই দানবকেই এক স্বাভাবিক সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করবার মতাদর্শই বাংলাদেশে প্রবল। রাষ্ট্র হাজির আছে বলেই এই প্রতিষ্ঠানটি ন্যায্য, তার গঠনের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস ও চরিত্রের হদিস নেবার দরকার নাই, এই চিন্তা থেকে মুক্তি সহজ নয়। রাষ্ট্র আছে বলেই তার আর ন্যায্যতা প্রমাণের দরকার নাই, অতএব কোন নাগরিকের অধিকারের বালাই রাষ্ট্রের না করলেও চলে, এই চিন্তার প্রাবল্যের কারণেই ভিন্ন মতাদর্শের নাগরিকদের রাষ্ট্র যখন নিপীড়ন ও হত্যা করে তখন সমাজে কোন বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি হয় না। এমনকি তথাকথিত সুশীল বা লিবারেল কিম্বা প্রগতিশীলরাও নিশ্চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে, সমর্থন যোগায়।
এমনকি যারা মুখে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের কথা বলেন, তাদেরও সে ক্ষেত্রে বলতে শুনি যে মৌলিক অধিকার বা অন্য সবকিছু দেখবার আগে দেখতে হবে রাষ্ট্রের দ্বারা নিপীড়িত বা আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে খুন হওয়া নাগরিকের রাজনৈতিক আদর্শ কি? যদি উনি ইসলামি রাজনীতির হন, কি ইসলামি চিন্তার উপর ঠেস দিয়ে আছেন বলে মনে হয়, তবে তিনি মৌলবাদি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। তখন রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও হত্যার সমালোচনা দূরে থাকুক, বরং প্রয়োজনে ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’ বলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও হত্যার পাশাপাশি তাদের নির্মূল করতে নেমে পড়তে হবে। এই হল তাদের দশা। এরা মনে করে “ইসলামপন্থি মৌলবাদি বা সন্ত্রাসীরা” রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মাকান্ডে অপহরণ গুম ও খুন হয়ে গেলে দানব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কিছু নাই। কারণ তারা “জামাত-হেফাজত-বিএনপি” এর মত রাজনৈতিক আদর্শের নাগরিক। এরা বলতে চান, এই নাগরিকদের নাগরিক অধিকার জান মাল মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়লেও অথবা রাষ্ট্র তার উপর নিপীড়ন, নির্যাতনের মতো অপরাধ করলেও আগে বিবেচনায় নিতে হবে তাদের রাজনৈতিক আদর্শ কি। ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দসই রাজনৈতিক আদর্শ কেউ ধারণ না করলে কোন নাগরিক ব্যক্তির নাগরিক অধিকার নাই – এই হোল তাদের সারকথা।
বাংলাদেশে এই ধরণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধীদের সম্পর্কে একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। গত জানুয়ারির শেষে অপহরণ গুম ও খুনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রচারণার অংশ হিসাবে এক মানবাধিকার সংগঠনের সভার কাজে এক জেলা শহরে যেতে হয়েছিল। মূল প্রবন্ধ পড়ার পর সেখানে প্রথম বক্তা ছিলেন জেলা শহরেরই কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন সভাপতি; জেলা আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতিও তিনি। তিনি কথা শুরু করলেন এভাবে, মানবাধিকারের কথা বইপুস্তকে অনেক ভাবে থাকে। সেটা সেখানে থাক। খোদ ওবামাও সেগুলো মানতে পারেন না। ফলে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধেও যে অপহরণ গুম ও খুনের অভিযোগ হচ্ছে সেগুলো নিয়ে বিচারে সবার আগে দেখতে হবে যারা অপহরণ গুম ও খুনের ভিকটিম তাদের রাজনৈতিক আদর্শ কি। এটাই মুখ্য বিবেচনা। ইস্যুটাকে সেভাবেই দেখতে হবে।

“রাজনৈতিক আদর্শের” ভিত্তিতে রাষ্ট্র নাগরিককে তার নাগরিক মানবিক অধিকার বিতরণ করবে কথার অর্থ কি
কথাটার সার কথা কি? আমার পছন্দসই রাজনৈতিক আদর্শ কেউ ধারণ না করলে তাঁর নাগরিক অধিকার রক্ষার পক্ষে দাঁড়ানো বা ক্ষুন্ন হবার বিপক্ষে সোচ্চার হওয়া যাবে না। বলা বাহুল্য, আমার খুবই বেগ পেতে হয়েছিল ঐ প্রকাশ্য সামাজিক সভায় সেই বক্তার মারাত্মক বিপদজনক ও আত্মঘাতি বক্তব্যের পরিণতি কি হতে পারে তা উপস্থিত সকলকে বুঝিয়ে বলতে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাটা ঘটনাচক্রে কমিউনিষ্ট পার্টি বা সিপিবি কেন্দ্রিক। কিন্তু এর অর্থ এমন নয় যে এই বিশেষ চরিত্রের “নাগরিক অধিকার” ধারণাটা কেবল সিপিবির পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একটা ক্যাটাগরি করে বলা যেতে পারে যে, যারা নিজেদের “প্রগতিশীল” বা “চেতনার সৈনিক” মনে করেন নিজেকে মোটামুটি তাদের প্রায় সবারই অবস্থান এটা। তাই আমরা এখন দেখছি। একই বাহিনী কমান্ডারের ততপরতা লক্ষীপুরে ঘটলে কোন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। কিন্তু এবার নারায়নগঞ্জে ঘটলে প্রতিক্রিয়া হয়।
কোন “যদি” বা “কিন্তুর” আড়ালে বা কোন যুক্তিতেই রাষ্ট্র নাগরিকদের জানমালের ক্ষতি করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এতে সমাজ বা রাষ্ট্র কোনটাই টেঁকে না। নতুন কোন রাষ্ট্রও এমন ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে না। সমাজের রক্তাক্ত বিভক্তি কিম্বা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে চাইলে এই অতি গোড়ার নীতি আমাদের আত্মস্থ করতে হবে। একে উপেক্ষা বা গাফিলতি মেনে নেওয়ার কোন সুযোগ নাই। অথচ এই ন্যূনতম নীতির অভাব তাদের মধ্যেই প্রবল যাদের কাছে আমরা এই নৈতিক প্রশ্নে দৃঢ়তা আশা করি। অথচ এরাই একই নিশ্বাসে নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করেন।
আদর্শ যাই হোক কোন রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নিতে গিয়ে কোন নাগরিক যদি কোন ক্রিমিনাল অপরাধ করে বসেন তবে অবশ্যই তার অপরাধ আমলে নিতে হবে এবং বিচার করতে হবে। আদালতে অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে তিনি কেবল ঐ ক্রি্মিনাল অপরাধের জন্যই শাস্তি ভোগ করবেন। কোন ক্রমেই তার রাজনৈতিক বিশ্বাস বা তৎপরতার জন্য নয়। এটাই মূল কথা। এছাড়া আমরা ভুলে যাই রাষ্ট্রের নির্বাহি বিভাগ বিচার বিভাগ নয়। যার সোজা মানে নাগরিকের কোন কথিত অপরাধের বিচার সরকার করতে পারে না। সরকার বিচারক নয়, বড়জোর আদালতে অভিযোগ আনয়নকারী হতে পারে। অথচ সে জায়গায় আমরা রাষ্ট্রের নির্বাহী সরকারকেই অপরাধের বিচারক বানিয়ে ফেলছি। শুধু তাই নয় সরকারকেও কোন নাগরিকের রাজনৈতিক আদর্শ তাঁর পছন্দসই কিনা সেই বিচারের ভার দিয়েছি। অথচ কোন নাগরিকের রাজনৈতিক আদর্শ কেমন তা কোন আদালতের বিচারকের পছন্দসই কিনা তা বিচারের এক্তিয়ার বিচার আদালতেরও নাই। আসলে, কোন রাজনীতি ভাল না মন্দ তা একমাত্র রাজনৈতিক পাড়ায় বিচার হয় অথবা জনগণ বিচার করে। আদালত পাড়ায় কোন রাজনীতির বিচার করা যায় না, চলে না; বিচারকের সেই এক্তিয়ার কনষ্টিটিউশন দেয় না। তবে কোন রাজনীতি কনষ্টিটিউশন ভঙ্গ করলে অথবা বিরোধী হলে সেটা অন্য কথা। যেটা কোনভাবেই রাষ্ট্রের নির্বাহী অথবা বিচারকের কোন দলের রাজনৈতিক আদর্শ পছন্দ করা না করার বিষয় নয়। অর্থাৎ কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শ বা গঠনতন্ত্র রাষ্ট্রের কনষ্টিটিউশনের সাথে সংঘাতপুর্ণ বা বিরোধ তৈরি করে এমন প্রমাণিত না হলেই হল। এরপর ঐ রাজনীতি আর রাষ্ট্রের নির্বাহী অথবা বিচারকের কোনভাবেই পছন্দ অপছন্দের বিষয় নয়, এক্তিয়ার নাই। তবে যে কোন নাগরিক ঐ রাজনীতিকে (আদালতে আইনীভাবে নয় কেবল রাজনৈতিক পাড়ায়) পছন্দ করতে পারেন, বিরোধীতাও করতে পারেন। অথচ আমরা খোদ রাষ্ট্রকেই রাজনৈতিক আদর্শ বিবেচনার ভয়ংকর ও অদ্ভুত কথা বলে অবলীলায় সরকারকেই অপহরণ গুম ও খুনের ঘটনা ঘটাতে দিচ্ছি শুধু না, এর পক্ষে সাফাই যুক্তি দিচ্ছি।

দুই

নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম সহ সাতজনের অপহরণ গুম ও খুনের ঘটনায় সমাজের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ঘটছে। এটা তাৎপর্যপুর্ণ। আমার অভিজ্ঞতার জেলা আইনজীবী সমিতির ঐ সভাপতির মত আমরা অনেকেই এই সরকারের শুধু শেষের গত তিন বছরে অপহরণ গুম ও খুন করতে দিয়ে একটু একটু করে এমন দানব বানিয়েছি। যুক্তি তুলতে দেখেছি, যে পছন্দসই রাজনৈতিক আদর্শ কেউ ধারণ না করলে তাকে তো সরকারের হাতে অপহরণ গুম ও খুনই হতে হবে। এই বেহুঁশ ও আত্মঘাতি চিন্তা নিয়েই আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। আমাদের অনেকের কাছে তা খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। কিন্তু নারায়নগঞ্জের ঘটনা কি আমাদের হুঁশ ফিরিয়েছে, ফেরাতে সক্ষম হবে? এটা নির্ণয় করবার সময় এখনও আসে নি। যদিও রাজনৈতিক আদর্শ নির্বিশেষ সবারই অন্তত এটুকু হুঁশ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে যে, খারাপ কিছু একটা ঘটে গিয়েছে, যার ফল আমরা ভোগ করছি। কেউ বলছেন রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ছে, রাষ্ট্রের একটা মারাত্মক ব্যাত্যয় ঘটে গেছে কোথাও ইত্যাদি।
রাষ্ট্র কোন না কোন আদর্শের ওপর দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের টিকে থাকা ও না থাকাও সেই আদর্শের ওপর নির্ভর করে। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয় রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হলে মূল বিষয় নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ওপরই রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে। অর্থাৎ নাগরিকেরা সবাই একই রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী এমন কখনই থাকেন না। থাকার কথাও না। এমনকি মোটা দাগে অনেককে একই রাজনৈতিক আদর্শের কোন দলে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ও মতাদর্শিক দ্বন্দ্বও থাকে। কিভাবে একটি রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্র তাদের মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে তার ওপর নির্ভর করে সেই দল কিম্বা রাষ্ট্রের টিকে থাকা ও না থাকা।
যে কোন রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠি বা প্রবণতার অধিকার আছে তাদের মতাদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়বার। কিন্তু সেকাজে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করেই একমাত্র সেটা করা যেতে পারে। ক্ষুন্ন করে নয়। মোটা দাগে গণতান্ত্রিক শ্রেণিগুলো অগণতান্ত্রিক শ্রেণিগুলোর বিরুদ্ধে লড়েই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করে, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কারো নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করে গণতন্ত্র কায়েম করে না, বরং সকল নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করেই অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অগণতান্ত্রিক শ্রেণির তৎপরতা বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে গণতন্ত্র চর্চার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিচার বিভাগ এই ক্ষেত্রে একটা মুখ্য ভূমিকায় থাকে। এটাই গণতন্ত্র নিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী করবার পথ। এর কোন শর্টকা্ট রাস্তা নাই। প্রতিপক্ষকে ‘নির্মূল’ করাই যদি নীতি হয়, তাহলে প্রতিপক্ষও পালটা নির্মূলের নীতিই গ্রহণ করবে। এটা মনে রাখতে হবে। এটা দেশকে টুকরা টুকরা করবার নীতি, গড়বার বা গঠন করবার নীতি হতে পারে না।
আবার যার যার প্রত্যেকের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কায়েম দেখতে চাইলে বাস্তবে সেটা অসংখ্য রাষ্ট্রে টুকরা হয়ে যাবে। উদার গণতন্ত্র ভাল কি মন্দ সেই তর্কে না গিয়ে বলা যায়, বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি চর্চার অধিকার রাষ্ট্র ক্ষুণ্ণ করে না। মূলত নাগরিকের জানমাল সুরক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রাষ্ট্র; আবার রাষ্ট্র নাগরিকের সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হবে না, কিম্বা নিরাপত্তা ভঙ্গের কারণ হবে না -রাষ্ট্রের এই দৃঢ় প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই নাগরিকরা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব মানে বা মানাটা তার স্বার্থের অনুকুল বলে মনে করে। নাগরিকরা ভিন্ন ভিন্ন বা নানান রাজনৈতিক মতাদর্শ চর্চা করতে পারবে এটা সেখানে স্বীকৃত থাকে। ফলে সরকার বা ক্ষমতাসীন কোন গোষ্ঠির পছন্দসই রাজনৈতিক মতাদর্শ না হলে রাষ্ট্র তাকে অপহরণ গুম ও খুন করতে পারবে এই বিকৃত চিন্তা কোন সমাজে বা রাষ্ট্রে এসে গেলে সেটা ভয়াবহ নৈরাজ্যরই ইঙ্গিত বহন করে। একালে যে রাষ্ট্র নাগরিক ও মানবিক অধিকার স্বীকার করে না তার পরিণতি কী দাঁড়ায়? এককথায় এর জবাব হল আজ হোক কাল হোক রাষ্ট্র ভেঙ্গে যাবে। বাংলাদেশে যেটা এখন ক্রমশ ঘটছে। অর্থাৎ যারা এতদিন সরকারী দলের পছন্দসই রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধীদের অপহরণ গুম ও খুনের পক্ষে সাফাই গেয়ে গেছেন তারাই জেনে না জেনে নিজদের আত্মঘাতি চিন্তার কারণে রাষ্ট্র ভেঙ্গে ফেলার মারাত্মক বিপদ দাওয়াত দিয়ে ঘরে তুলেছেন। এখন আর সামলাতে পারছেন না। যে বিপদ ডেকে এনেছেন তাকে বিদায়ও দিতে পারছেন না। পারবেনও না।
অন্যদিকে, আধুনিক রাষ্ট্র মানেই সম্পত্তি বা সম্পত্তি-সম্পর্ক রক্ষার জন্য কাঙ্খিত কার্যকর ও সুপ্রিম প্রতিষ্ঠান। এখানে নাগরিক মানেই সম্পত্তির মালিক, সম্পত্তি আগলে বসে থাকা নাগরিক। এটা শুধু যে প্রচুর সম্পত্তির মালিক কেবল তার বেলায় নয়, যার এক কানি জমি বা ভিটেমাটি আছে এটা তার বেলায়ও সত্য। এমনকি যার কিছুই নাই, সেও সম্পত্তির মালিক। সেই শ্রম হচ্ছে তার শ্রম শক্তি। সেই শক্তি বাজারে বেচাকেনার অধিকার তার নিজের। তাকে দাসের মতো জোর করে কোথাও খাটানো যায় না। অর্থাৎ সেও কোন না কোন সম্পত্তি আগলে থাকা নাগরিক। আমরা বলি, রাষ্ট্রের দায়িত্ত্ব নাগরিকদের “জান ও মাল অথবা জানমাল” রক্ষা। অর্থাৎ কেবল জান বা জীবন সুরক্ষাই নিরাপত্তা নয়, একই সঙ্গে মাল বা সম্পত্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথাও শুনি আমরা।
তাহলে রাষ্ট্র যদি কেবল বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধী হয়ে বাকি সব ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের নাগরিক অপহরণ গুম ও খুন জারি রাখে তাহলে সেই রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। রাষ্ট্র ও সরকার কেবল বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের নাগরিকদের “জান ও মাল” সুরক্ষা করবে, অন্যদের নয়, এটা হতে পারে না। অথচ এই নীতির ভিত্তিতেই হাসিনা সরকারের বিগত ছয় বছর বিশেষ করে শেষ তিন বছর চলছে। “জামাত-বিএনপি-হেফাজত” অপহরণ গুম ও খুন চলছে নিরন্তর। যাদের কাছে মনে হয়েছে “জামাত-বিএনপি-হেফাজত” এর রাজনীতি ও আদর্শ তার পছন্দসই নয় তারা এতে চুপ থেকেছে, খুশি হয়েছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সমর্থন জানিয়েছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে সমর্থন ও যুক্তি তুলেছে যে হাসিনার সরকারের কাজ হচ্ছে ভিন্ন মতাদর্শীদের নির্মূল করা। নাগরিকদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার নয় বরং রাজনৈতিক আদর্শ সবার আগে বিবেচনায় রেখে অপহরণ গুম ও খুন চালিয়ে যাওয়া। হাসিনা সরকারের সবল ও এখনও টিকে যাবার পিছনে এটাই প্রধান মতাদর্শগত ভিত্তি।

আসলেই কি হাসিনা “চেতনার” আদর্শের ভিত্তিতে নাগরিক অধিকার বিলি করেছেন
নারায়ণগঞ্জের নজরুল ইসলাম সহ সাতজনের অপহরণ গুম ও খুনের ঘটনা নতুন এক উপাদান যুক্ত করেছে। “রাজনৈতিক আদর্শ” দিয়ে বিচার করলে নজরুল ইসলাম, তার সাথে খুন হওয়া আইনজীবি চন্দন সরকারসহ বাকি ছয় জন, হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অপর কাউন্সিলর নূর হোসেন, শামীম ওসমান এবং খোদ হাসিনা এদের সকলের একই “রাজনৈতিক আদর্শ” – সকলেই আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত। এমনকি র্যাদবের কমান্ডারসহ নারায়নগঞ্জ প্রশাসন সবাই একই “রাজনৈতিক আদর্শ” ধারণ করে কিম্বা তার পরোক্ষ সমর্থক। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের নাগরিকদের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব নয়, এই নীতির ভিত্তিতেই তারা প্রশাসন পরিচালনা করেছে। এভাবেই এরা হাসিনার অপহরণ গুম ও খুনের রাজনীতিতে পরিচালিত হতে স্বচ্ছন্দবোধ করে গেছে।
তবে নারায়নগঞ্জের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে ঘটনা ভিন্ন ভাবে ঘটেছে। খুনাখুনি হয়েছে শেখ হাসিনার মতাদর্শের ব্যক্তিদের মধ্যে। এটা সুস্পষ্ট ভাবেই রাষ্ট্রের ভাঙ্গন ও সরকার পতনের লক্ষণ। কারন যে নীতির ভিত্তিতে প্রশাসন এতোদিন চলছিল, সেই নীতি প্রশাসনকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে, যা সরকারকেই এখন গ্রাস করতে উদ্যত। যারা ভেবেছিলেন জামাত-বিএনপি-হেফাজত এর রাজনৈতিক আদর্শ না করে আওয়ামি লীগের রাজনৈতিক আদর্শ করলেই জানমাল সুরক্ষিত ও নিশ্চিত থাকবে, হাসিনার সরকার তা নিশ্চিত করবে সেটা এখানে একেবারেই ঘটে নাই। যারা মারা গিয়েছেন তারা আওয়ামি লীগে নাম লিখিয়েও নিজের জানমাল রক্ষা করতে পারেনি। ওদিকে যারা হাসিনার এই দানব রাষ্ট্রের তান্ডব আচরণকে সরাসরি বা প্রচ্ছন্নে সমর্থন করে গেছেন, হয়ত ভেবেছেন তিনি রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে জামাত-বিএনপি-হেফাজত ধারণ করেন না ফলে তিনি সুরক্ষিত ও নিরাপদ তাদের এখন হঠাৎ মানবাধিকারের কথা মনে পড়েছে। তারা রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করছেন। এরা শঙ্কিত যে নজরুল ইসলাম সহ সাতজন ‘অপর’ কেউ নয় আসলে ওটা তারা প্রত্যেকে, খোদ নিজেই। নজরুলের ভাগ্য সবারই আগামি ভাগ্য, অপেক্ষমান পরিণতি। ওটা নজরুল নয় নিজেরই খুড়ে রাখা আপন কবর। এই কবর তো দীর্ঘদিন ধরেই খুঁড়ছিলেন, তখন তাদের হুঁশ ছিলনা।
একই রাজনৈতিক আদর্শ আওয়ামি লীগে অন্তর্ভুক্ত থাকি আর নাই থাকি,- সম্পত্তি বা বিভিন্ন ধরণের স্বার্থ নিয়ে নিজের আপন ভাই, আত্মীয়, আপন বা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায় পার্টনার ইত্যাদিদের সাথে নানান স্বার্থ বিরোধ নিয়েই আমরা সমাজে থাকি। সমাজের মুখ্য প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের অধীনে থাকি। কিন্তু এর মানে এই না যে স্বার্থ বিরোধের ফয়সালা আমরা নিজে অপরের উপর রুস্তমিতে করি বা কেউ আমার উপর করুক। রাষ্ট্র একছত্র রুস্তম হয়ে থাকবে, আর অভ্যন্তরে একে অন্যের উপর রুস্তমি করতে দিবে না এই শর্তে নাগরিক রাষ্ট্রের রুস্তমি মেনে নেয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ঘটনা প্রমাণ করেছে হাসিনার রাষ্ট্র এই শর্ত ভেঙ্গেছে। সে নূর হোসেনকে রুস্তমি করতে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে। প্রতিটা নাগরিক চায় রুস্তমি বলপ্রয়োগে খুনোখুনি প্রতিপক্ষকে নির্মুলের পথে না, স্বার্থবিরোধ ‘বিচার’ বা আইন কানুনের নিয়মে ফয়সালা হো্ক। নারায়নগঞ্জের ঘটনায় রাষ্ট্র শর্ত ভঙ্গ করায় সকলের মনে আশঙ্কা জাগিয়েছে যে হাসিনার রাজনৈতিক আদর্শে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আপন ভাই বা আপন দলের বিরোধী স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের হাতে অপহরণ গুম ও খুন হয়ে যাওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক। এককথায় রাষ্ট্র নাগরিক নির্বিশেষে জানমালের রক্ষক আর নয়। যে কোন সময় সরকার যে কোন গ্রুপকে সমর্থন দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের জানমাল বিপন্ন করে ফেলতে পারে। এবং কখন কোন গ্রুপকে হাসিনা সরকার আর্শিবাদ জানাবে তারও কোন দিশা নাই। এক্ষেত্রে নির্ণায়ক হচ্ছে কখন কোন গ্রুপকে হাসিনা নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপুর্ণ মনে করে। অর্থাৎ একমাত্র বিবেচনা হাসিনার নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে আমার সেই জেলার আইনজীবি বন্ধু যেভাবে বলছিলেন, কারও রাজনৈতিক আদর্শ পছন্দসই লাগে কি না এই ভিত্তিতে রাষ্ট্র তার জানমালের নিরাপত্তা দিবে এই ভিত্তিতেও হাসিনা তার দানব রাষ্ট্র সাজায় নি। হাসিনার কাছেও রাজনৈতিক আদর্শ গুরুত্বপুর্ণ কিছু নয়। আসলে তাঁর একমাত্র বিবেচনা নিজে দানব ক্ষমতায় টিকে থাকা।
নারায়নগঞ্জের ঘটনা কেন্দ্রিক গণক্ষোভকে আমি এভাবে ব্যাখ্যা করছি ঠিকই। কিন্তু গণমন নিয়ে আমার এই অনুমান কতটা সঠিক সত্য নাকি একেবারেই সাময়িক ও বিচ্ছিন্ন তা জানা যাবে এই ঘটনার শেষ হয় কি করে তা দেখতে পাবার পর। এটা হতেও পারে আশঙ্কিত নাগরিকেরা তাদের ক্ষোভ বিক্ষোভকে কোন পরিণতির দিকে নিতে অবিচল থাকলেন না; আর ব্যাপারটা একটা সাময়িক ক্ষোভ হিসাবে থেকেই চাপা পড়ে গেল। সেটা যাই হোক, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সেই কমিউনিষ্ট নেতা যেভাবে রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে নাগরিক অধিকার জানমালের রক্ষার পক্ষে যুক্তি তুলে হাসিনার রাষ্টকে দানব হতে পুষ্ট করছিলেন তার সেই আকাঙ্খার অন্তত একটা পরিণতি হল এই সাত অপহরণ গুম ও খুন।
উপরের কথাগুলো বর্তমানের হাসিনার সরকারকে সামনে রেখে বলছি মানে এই নয় এটা কেবল আওয়ামি লীগ বা হাসিনার জন্য সত্য। অপহরণ গুম ও খুন কমবেশি স্বাধীনতার পর থেকেই সবসময়ই বজায় ছিল। কিন্তু এর মাত্রার ভিন্নতার দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। আজকে এই কথাগুলো আগামি যে কোন সরকার, বিএনপি অথবা জামাতের অথবা অন্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য এবং সত্য। এব্যাপারে আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ সন্দেহ নাই। তথাকথিত রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে নাগরিক মানবিক অধিকার বিতরণের রাষ্ট্র এটা যে কোন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বেলায়ই সমান বিপদজনক। আমাদের কি এই শিক্ষা যথেষ্ট হয়েছে? আগামির ভরসায়!

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s