ওবামার এশিয়া নীতির মুখ থুবড়ানো পরিণতি (প্রথম পর্ব)


ওবামার এশিয়া নীতির মুখ থুবড়ানো পরিণতি

গৌতম দাস

[এক]
পুর্ব চীন সাগরে চীন ও জাপানের দ্বন্দ্ব আর দক্ষিণ চীন সাগরে পড়শিদের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব এশিয়ায় এক বড় ইস্যু। এর ভিতরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলী এন্টি-চীন অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও জাপান দেশ দুটি সফর করে এলেন। বলা বাহুল্য, চীন-জাপান দ্বন্দ্বের মধ্যে আমরা কারও কোন শর্ত বা লোভে পরে কারও পক্ষ না নিয়ে একমাত্র নিজের স্বার্থের মধ্যে থেকে দুদেশের সাথেই ভারসাম্যপুর্ণ সম্পর্ক গড়াই একমাত্র সঠিক অবস্থান। কুটনৈতিক ভাষায় যাকে ব্যালেন্সিং বলা হয়। এশিয়া ভারকেন্দ্রিক গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন পরিস্থিতিতে ছোট বা বড় কোন শক্তির দ্বন্দ্বে শুধু বাংলাদেশ তো অবশ্যই (এবং সম্ভবত সকল রাষ্ট্রই) নিজস্ব স্বার্থমুখি একটা ব্যালেন্সিং অবস্থানে থেকে কূটনৈতিক দক্ষতা দেখানোর যুগে আমরা সবাই প্রবেশ করেছি। অর্থাৎ পুরানা রাশিয়া-আমেরিকার ঠান্ডাযুদ্ধের সময়ের ব্লকে ভাগ অবস্থান নেয়া একালে ঘটতে দেখা যাবে না। অথবা একালে চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কহীন ভারত ও আমেরিকার কোন জোট অথবা আমেরিকার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কহীন ভারত ও চীনের জোট এমনটা দেখতে পাবার কোন সম্ভাবনা নাই। এমন অবস্থা আর ফিরে আসছে না। পরস্পরের সবার সাথে সবার অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক থাকবেই। এটা থাকার পরেও স্বার্থের সংঘাত বিরোধগুলোও চলতে থাকবে। গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন বিন্যাস এই নব উত্থানের সময়ের বার্তা এটাই। তবু সব রাষ্ট্রের ব্যালেন্সিং অবস্থানের মধ্যে মোটা দাগে কেবল একটাই ভাগ জ্বলজ্বলে দৃশ্যমানভাবে ভেসে থাকবে। এই ভাগের ভিত্তি হবে – কে কে পুরানো ভঙ্গুর গ্লোবাল অর্ডার ধরে রাখার পক্ষে আর কে কে নতুন অর্ডার কায়েম করতে চায়। পুরানো গ্লোবাল অর্ডার মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আমেরিকার নেতৃত্ত্বে জাতিসংঘ, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউটিও ইত্যাদি বিভিন্ন নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যা কায়েম করা হয়েছিল এবং বাকি দুনিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে টিকে আসছে, বর্তমানে শেষ জীবন পার করছে সেই গ্লোবাল অর্ডার। মাতব্বরির এই নিয়ম-শৃঙ্খলার নামে এই অর্ডার ভাঙ্গা গড়ার এই লড়াই এখনকার মুখ্য বিষয় যা প্রবলভাবে হাজির ও ক্রমে স্পষ্ট থেকে ষ্পষ্টতর হয়ে উঠছে। বলার অপেক্ষা রাখে না পুরানা অর্ডারের যাতায় পড়ে বাংলাদেশের মত যারা এত যুগ নিগৃহীত হয়ে আসছে তা্রা এই ভাঙ্গাগড়া থেকে, আলগা দুর্বল হয়ে পড়া পরিস্থিতি থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব তুলনামূলক মুক্ত করার চেষ্টা করা, আর বুদ্ধিমানের মত এথেকে সর্বোচ্চ সুবিধা বের করে নিবার চেষ্টা করা – এটা যে যত আগে বুঝবে, হোমওয়ার্ক করে সে প্রস্তুতি নেয়ায় এখনকার কাজ। তবে একটা সাবধানবানী খেয়াল রাখা দরকার পুরানা অর্ডার আর নতুন অর্ডার বলে যে ভাগের কথা বললাম এর মানে এমন নয় যে যারা পুরানোর পক্ষে তাদের সাথে যারা নতুনের পক্ষে এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন বিনিময় নির্ভরশীলতা এগুলো ছিন্ন করে নিয়ে তা করতে হবে। সম্পর্ক বজায় রেখেই সে সম্পর্কের ভিতর এক নতুন বিন্যাস বা সাজানো, নতুন ভারসাম্য তৈরির প্রক্রিয়া হিসাবে ঘটবে এটা। ফলে জবরদস্তিতে সম্পর্ক ছিন্ন করে আগাতে হবে এমন করে আমরা যেন না ভেবে বসি।
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যপদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা জাপানের পক্ষে ছেড়ে দেয়া ও ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আসলে কি হাসিল করতে চেয়েছেন কি পেয়েছেন তা আমরা এখনও স্পষ্ট কিছু জানি না। যদিও বিশাল অংকের ঋণের প্রতিশ্রুতির কথা আমরা শুনছি। অপরদিকে চীন সফরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রসঙ্গে সমঝোতা চুক্তির বিষয়টা ঝুলে গেছে তা বুঝা যাচ্ছে। পদ্দা সেতুতে কোন বিদেশী বিনিয়োগ থাকছে না এটা এখন পরিস্কার। কেবল নির্মাণ ঠিকাদার হিসাবে এবং একমাত্র ঠিকাদার হিসাবে চীনা কোম্পানীর কথা শুনা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটা কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যদিও নিজের অর্থে সেতু নির্মাণের একটা সোজা অর্থ হল, ১% এর নিচের সুদের জায়গায় আমাদেরকে এখন কমপক্ষে ১২% সুদের অর্থে এই সেতু নির্মাণ দায় নিতে হচ্ছে। এতে শেষ চাপটা গিয়ে পড়বে সেতু পারাপারের টোলের অর্থে। প্রতি পারাপারে টোলের অর্থ কত দাঁড়াবে সেটার অর্থনৈতিক ভায়াবিলিটি কি হবে, থাকবে কি না এনিয়ে কোন ষ্টাডি কোথাও হয়েছে আমরা জানতে পারি নাই। কারণ সেতু নির্মাণ বিষয়টা এখন যেভাবে দাড়িয়েছে এর মূল বিবেচ্য অর্থনৈতিক ভায়াবিলিটি নয়, বরং সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ইজ্জত বাঁচানো। ওদিকে চীন সফরে যে ৫টি চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে এগুলোরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিবেচনা কতটুকু তা আমরা জানতে আগ্রহী, জানা দরকারও। হাসিনার জাপান ও চীন সফরে যা কিছু বিনিয়োগ চুক্তি হচ্ছে তা সরকারের ন্যায্যতার পক্ষে স্বীকৃতি ও পলিটিক্যাল লিভারেজ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা থাকবে বলা বাহুল্য। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে এটাকে বাংলাদেশের সাথে তাদের চুক্তি হিসাবে বুঝলে সঠিক হবে। ইতোমধ্যেই এটাকে সরকারের পলিটিক্যাল লিভারেজ বা স্বীকৃতি হিসাবে মিডিয়া প্রচার হতে দেখেছি আমরা। তবে আগেই বলা যায় এতে কোনভাবেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বৈধতার সঙ্কট কাটাবে না।

[দুই]
পরাশক্তিগত ঝগড়া বিবাদ এমনকি যুদ্ধ দুনিয়ায় নতুন কিছু নয়। নতুন হল, যারা পরাশক্তি হয়ে ছিল বা আছে তাদের সাইজ ছোট হয়ে আগের গুরুত্ত্ব হারাবে আর নতুন অনেকের পরাশক্তিগত উত্থান ঘটবে – এবিষয়গুলো ক্রমশ আসন্ন হয়ে উঠছে। আলামত ফুটে উঠছে চারদিকে। আর এসব উলটাপালটের ভিতরে আবার যেটা একবারেই নতুন এবং যেদিকটায় আমাদের অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে তা হল, পরাশক্তিগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক। এখনকার দুনিয়াতে হবুসহ পুরানো পরাশক্তিগুলো সকলে গভীরভাবে অর্থনীতি, বাণিজ্য, লেনদেন ইত্যদিতে এক পরস্পর নির্ভরশীলতার সম্পর্কে ক্রমশ সবাই ডুবে যাচ্ছে এবং তা আরও গভীর হতে থাকবে। থাকতেই হবে, কারণ কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছা পছন্দ-অপছন্দের উর্ধে এ’এক অবজেকটিভিটি বা বাস্তবতা। দুনিয়া জুড়ে একক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম আরও প্রবলভাবে বিস্তারি হয়ে উঠছে, পরাশক্তিসহ সকল রাষ্ট্র বা অর্থনীতিকে যা ধরে রেখেছে, সকলেই সেখানে অন্তর্ভুক্ত। পরস্পর নির্ভরশীলতার এই সম্পর্কের দিকটাই একেবারেই নতুন। এখানে কেন্দ্রীয় বিষয় “পরস্পর নির্ভরশীলতা” এবং গ্লোবাল একটা ক্যাপিটালিজম অর্ডার। এর আগের ল্যান্ডমার্ক সময় হিসাবে যদি দুটো বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে রাখি, যখন আজকের চলমান অর্ডারের জন্ম হয়েছিল সে সময়গুলোতেও “পরস্পর নির্ভরশীলতার” এমন বাস্তবতা হাজির ছিল না। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পঞ্চাশের দশক থেকে আমেরিকা-সোভিয়েত ঠান্ডাযুদ্ধের রেষারেষির কালে দুনিয়ায় প্রথম পরিকল্পিতভাবে যে দুটা আলাদা আলাদা (পরস্পর নির্ভরশীলতাহীন ভাবে) অর্থনীতির ধারা তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল, তাও টিকে নাই। বদলে যাওয়া ১৯৭১ সাল থেকে চীনের নতুন ধারা এবং ১৯৯১ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে পড়ার ভিতর দিয়ে সে উদ্যোগের সমাপ্তি ঘটেছে। তারচেয়েও বড় কথা সেটাও আর ফিরে আসছে না, আসবে না। বরং আগামিতেও “পরস্পর নির্ভরশীলতা” দুনিয়ায় মুখ্য হয়ে থাকছে। আর নতুন এই দিকটাতে আমাদের অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।
কিন্তু এমন প্রশ্ন আমাদের অনেক্র মনের আছে যেমন, চীনের বদলে যাওয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে পড়া কি ভাল হয়েছে? এমনভাবে বা এমনদিক থেকে প্রশ্ন করে যেন আজকের আগামি ব্যাপারটাকে আমরা বুঝতে না যাই। কারণ এটা উচিত-অনুচিত অথবা ভাল-খারাপের প্রশ্ন নয়। আবার দুনিয়াব্যাপী শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্ব আকারে দুনিয়াকে বুঝতে যাওয়া কি ভুল ছিল? না একেবারেই তা নয়। ক্যাপিটালিজমের ভিতরে অনেকেরই দুনিয়ার এম্পেয়ারের ভুমিকায় হাজির হওয়া, কমিউনিষ্টরা যেটাকে “সাম্রাজ্যবাদ” শব্দ দিয়ে ধরে ব্যাখ্যা করতে চায় তা এখনও আগের মতই সমান বিপদজনক শত্রু হয়ে আছে। ফলে এদিক থেকে বুঝার মধ্যে আমাদের কোন ভুল নাই। কারণ লড়াই সংগ্রামের মৌলিক বিষয় একই আছে। তাহলে ঘটল কি? আসলে ঘটেছে যা তা হলঃ কোর্স বা গতিপথে বদল। অথবা বলা যায় লড়াই সংগ্রামের মূল বিষয় বা নীতি নয় কৌশলে বদল। যেমন, আগে মনে করা হয়েছিল লড়াইটা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এম্পেরিয়াল প্রকাশের বিরুদ্ধে আলাদা প্যারালাল এক গ্লোবাল (“কমিউনিষ্ট”) অর্থনীতি কায়েম করে লড়াটাই উপযুক্ত ও সঠিক কৌশল। কিন্তু সেটা খুব কার্যকর হয় নাই, কাজের হয় নাই। আকাঙ্খিত ফল দেয় নাই। ফল দেয় নাই এই অর্থে যে এটা শত্রু পরাস্ত হওয়ার দিক থেকে যত না তারচেয়ে বেশি হল নিজেরই অর্থনৈতিক বিকাশ, নিজের জনগণকে ভাল অর্থনীতিক জীবন দেয়া, কাজের সংস্থান ইত্যাদি করা যায়নি। আসলে একাজে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম থেকে আলাদা ও প্যারালাল অর্থনীতি কায়েমের চেষ্টা, এটা অনেকটা পুরানা আগে থেকে হাজির ক্লাবে যোগ দিয়ে তাদের সাথে খেলব না, আলাদা নিজেই ক্লাব বানিয়ে নিজের নিয়মে খেলা এধরণের ঘটনা ছিল সেটা। আর আজকের নতুন পরিস্থিতিতে যা হতে দেখছি, চলতি ক্রমশ পরাশক্তিগত উলটাপালট নতুন বিন্যাস পরিবর্তনের ভিতর যে অভিমুখ এখানে নতুন কৌশলটা হল, পুরানা ক্লাবে যোগ দিয়ে তাদের সাথে খেলতে খেলতেই ক্লাবের কর্তৃত্ত্বে ভাগ বসিয়ে আগের খেলার নিয়ম বদলে দেয়া। একথা বলে আবার এমন দাবি করা নয় যে কৌশলের এই বদলটা খুব ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করে নেয়া হয়েছে। বরং আগের কোর্স বা পথ কাজ করে নাই বা ফলদায়ক হচ্ছিল না বলে সেই পরিস্থিতিতে বাস্তবে বিকল্প কি করা যায় সে বিবেচনা থেকে নেয়া। এর পিছনে তত্ত্বগত স্বচ্ছতা ছিল কি ছিল না বা আছে কিনা আমরা হদিস পাই না। ফলে কথাগুলো বলা হচ্ছে নতুন আসন্ন অবজেকটিভ বাস্তবতাকে যেমন দেখা যাচ্ছে এর অর্থ তাতপর্যের দিককে ব্যাখ্যা করে।
তাহলে যেকথা বলছিলাম আসন্ন বা পুরানা পরাশক্তিগুলোর নতুন বিন্যাস এবং গুরুত্বপুর্ণ বিষয় তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক – সেটা গভীর পরস্পর নির্ভরশীলতার এক সম্পর্ক। কিন্তু গভীর পরস্পর নির্ভরশীলতা সম্পর্ক পরাশক্তিগত বিন্যাস নতুন আকার নিচ্ছে একথা বলার অর্থ এমন নয় যে আগের মত পরাশক্তিগত ঝগড়া বিবাদ প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন উবে গেছে। বরং সবলভাবে বহাল আছে। সর্বশেষ ইউক্রেন প্রসঙ্গে পরিস্থিতি ও এর গতিপ্রকৃতির দিকে নজর দিলেই আমরা তা বুঝব। এবং এটা কোনভাবেই আগের ঠান্ডাযুদ্ধের কালের লড়াই এর মত নয়। সেটা আর ফিরে আসবে না। উপরের এই পটভুমিতে এবারের লেখার প্রসঙ্গ “সাউথ চায়না সি বা দক্ষিণ চীন সাগর”।

সাউথ চায়না সি বা দক্ষিণ চীন সাগর
চীনের অর্থনৈতিক উত্থানে পুরানা এম্পেরিয়াল মোড়ল আমেরিকা ক্রমশ অগুরুত্বপুর্ণ হয়ে পড়ছে ফলে চীনের সাথে পারস্পরিক ঘোরতর বাণিজ্য অর্থনীতির সম্পর্কের ভিতরেও একইসাথে নানান গুরুতর ঝগড়া মনকষাকষির পরিস্থিতিতে সাউথ চায়না সি বা দক্ষিণ চীন সাগর এখন এক গুরুত্ত্বপুর্ণ ইস্যু। এই শতক থেকে ক্রমশ গ্লোবাল অর্থনীতি বা আরও সঠিকভাবে বললে গ্লোবাল পুজিতান্ত্রিক অর্ডারের ভারকেন্দ্র হয়ে উঠছে এশিয়া। ওবামার “এশিয়া নীতি”এই নতুন এশিয়ায় ঝগড়া বিবাদের ভারকেন্দ্র করতে চাইছে সাউথ চায়না সি বা দক্ষিণ চীন সাগর এলাকাকে। এটা আসলে আমেরিকার নেতৃত্ত্বে সারা পশ্চিমের দুনিয়ার উপর একক পরাশক্তির গুরুত্ত্ব হারানোরই এক প্রতিক্রিয়া। অবজেকটিভ এই বাস্তবতা যতই আসন্ন হয়ে উঠুক – বিনা যুদ্ধে না দিব সুচাগ্র মেদিনী – এই দশায় কেউই নিজের একক পরাশক্তির মুকুট ও ভুমিকা বাধ্য না হলে হারাতে চায় না। অতএব সাউথ চায়না সি অর্থাৎ চীনে পণ্য-জাহাজ আসা যাওয়ার মুল নৌরুটকে কেন্দ্র করে -আমেরিকা চাইলে এই গুরুত্ত্বপুর্ণ নৌরুট বাধাগ্রস্থ করতে পারে – এমন অবস্থা তৈরি করে নিজের গুরুত্ত্ব জাহির করার উপায় করতে চাইছে এই এলাকাকে। আমেরিকার দিক থেকে এটা নিঃসন্দেহে এক আগাম সামরিক উস্কানি পদক্ষেপ। ঢলে পড়া নিজের পরাশক্তিগত অবস্থানের ক্রমশ অগুরুত্ত্বপুর্ণ হয়ে পড়া দশাকে, অসুস্থ বুড়া শুয়ে পড়া ঘোড়াকে চাবুক মেরে খাড়া করার মত চেষ্টা এটা। এটাকে আমেরিকার এক শেষ চেষ্টাও বলা যেতে পারে। কিন্তু কতদুর আমেরিকা যেতে পারবে? সেদিকটা বুঝাবুঝির জন্যই এই আলোচনা।
শুরুটা হয়েছিল আমেরিকান একক সিদ্ধান্তে, ২০০৮ সালের দিকে, যখন সাউথ চায়না সি কে নিয়ে দুনিয়ার কোথাও এমনকি মিডিয়াতেও কোন কোনায় কোন উত্তেজনা, কোন খবর ছিল না। তবে সরব ছিল কেবল আমেরিকার সামরিক ষ্ট্রাটেজিক প্রস্তুতির দলিলগুলোতে। এমনই এক গুরুত্ত্বপুর্ণ প্রকাশ্য দলিল হল, এক আমেরিকান প্রফেসর ডঃ ওয়াল্টার এন্ডারসনের আমেরিকান কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির (আমেরিকান প্রতিনিধি পরিষদ বা আমাদের হিসাবে আমেরিকান পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটি) কাছে সাক্ষ্য দিয়ে বলবার জন্য তৈরি দলিল। (সাউথ চায়না সি সম্পর্কে পাঠককে এক ভৌগলিক ধারণা দেবার জন্য নিচে এক প্যারায় এক সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছি। সেখানে ব্যবহৃত ছবি এন্ডারসন সাহেবের ঐ দলিল-রিপোর্ট থেকে নেয়া।) দলিল-রিপোর্টটা মূলত ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক মানে এশিয়ার দুই “রাইজিং ইকোনমির” একটা, ভারতের ঘাড়ে চড়ে বা পিঠে হাত রেখে দ্বিতীয়টা মানে চীনকে ঘিরে ধরা – এই বুদ্ধিতে সাজানো। আমেরিকান নির্বাহী প্রেসিডেন্টের সাউথ চায়না সি তাক করে সাজানো বিদেশনীতি আরও কয়েক বছর আগেই নিয়েছিল। আমেরিকান নির্বাহী প্রেসিডেন্টের বিদেশনীতির বিস্তারিত মূল দলিল প্রকাশ্যে প্রায় না পাওয়া যাওয়ার মত। তবে মুল দলিলে কি আছে তার কিছু ধারনা পাওয়া যায় আমেরিকান কংগ্রেস কমিটি বা প্রতিনিধি পরিষদ বা কখনও সিনেট কমিটির শুনানীগুলোতে। কারণ এই শুনানীগুলো প্রকাশ্য পাবলিক দলিল। এটা নির্বাহী প্রেসিডেন্ট কি করছেন তার একটা সংসদীয় স্ক্রটিনী বা নিরীক্ষার চোখ রাখা, আর আমেরিকান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতার চেক এন্ড ব্যালেন্স। আলোচ্য যে দলিলের কথা বলছি তা ভারত আমেরিকান নতুন সম্পর্কের ছক কেন সঠিক সে সম্পর্কে মাষ্টার মানুষ হিসাবে এন্ডারসন সাহেবের ২০০৮ সালের জুন মাসে আমেরিকান প্রতিনিধি পরিষদকে দেয়া লিখিত সাক্ষ্য। প্রতিনিধি পরিষদের সেটা স্বাধীনভাবে বুঝে নিবার উদ্যোগ। আর এন্ডারসন সাহেব সেখানে মাষ্টারি এক্সপার্টে কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়ে কি বলেছিলেন সেই দলিল এটা।

চীনের চোকিং পয়েন্টSouth china sea1

এটা চীনের উপকুলীয় সীমান্ত সম্পর্কে এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। ম্যাপে চীনা ভুখন্ডের দিকে তাকালে আমরা দেখব চীনের দক্ষিণ-পুর্ব থেকে পুর্বে বিস্তৃত ভুখন্ডের প্রায় পুরাটাই সমুদ্রে উন্মুক্ত। আর অন্য বাকি সবদিকের সীমান্ত ভুখন্ডগতভাবে আবদ্ধ বা ল্যান্ডলকড। অর্থাৎ এটাই চীনের বাইরের সাথে নৌ যোগাযোগের প্রবেশ দ্বার। ছোটবড় মিলিয়ে অন্তত ছয়টা আন্তর্জাতিক নৌবন্দর এই দক্ষিণ-পুর্ব তীরে। এই অর্থে দক্ষিণ-পুর্ব ভুখন্ড আসলে এক লম্বা উপকুলীয় অঞ্চল, দক্ষিণ চীন সাগর এবং পুর্ব চীন সাগর নামে মোটা দাগে যা আলাদা যদিও এটা অবিচ্ছিন্ন এক উপকুল অঞ্চল। এদুটোর মধ্যে বাণিজ্য গুরুত্ত্বের দিক থেকে আবার সাউথ চায়না সি বা দক্ষিণ চীন সাগর সবচেয়ে চালু। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া পেরিয়ে চীনের উপকুলে প্রবেশের দিক থেকে প্রথমে পড়বে দক্ষিণ চীন সাগর, ফলে পুর্ব চীন সাগরের চাইতে দক্ষিণ চীন সাগর উপকুল বাণিজ্যের দিক থেকে চীনে প্রবেশের প্রধানদ্বার। আর মধ্যপ্রাচ্য মানে আরব সাগর থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত এই নৌরুট চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য – পণ্য বা কাঁচামালের জাহাজ আসা যাওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্ত্বপুর্ণ। চীনের আমদানি জ্বালানি তেলের ৬০ ভাগ এই নৌরুট (Sea line of communication) ব্যবহার করে এসে থাকে। ফলে সে অনুপাতে চীনের উতপাদিত রপ্তানি পণ্যের জাহাজ বহর যাতায়াত করে এই নৌরুটেই। আবার দক্ষিণ চীন উপকুলে প্রবেশের মুখে সবচেয়ে বেশি পড়শি রাষ্ট্রের সমাহার। চীন থেকে বেড়িয়ে লাগোয়া পড়শি ভিয়েতনামকে পেরিয়ে যতই দক্ষিণে যাওয়া যাবে (ম্যাপ জুম বড় করে দেখুন) ততই মুখোমুখি হবে – ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া (পিছনে অষ্ট্রেলিয়া), ব্রুনাই, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি রাষ্ট্রের উপকুল – এর পরে বঙ্গোপসাগর। আর ওদিকে পুর্ব চীন সাগরের আশাপাশে পড়শি রাষ্ট্র হল কেবল দুই কোরিয়া আর জাপান।

এন্ডারসনের সাক্ষ্য দলিল
মোটা দাগে বললে US Congress hearing on India-US relationship দুইটা অংশে বিভক্ত। প্রথমভাগে, কেন আমেরিকার ভারতকে পারমাণবিক অস্ত্র সহযোগিতাসহ আধুনিক ও সুক্ষ্ম অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ করা উচিত সে সম্পর্কে ন্যায্যতা দিচ্ছেন এন্ডারসন। আর সেই সাথে কেন আমেরিকান যাতার চাপে বাকা হয়ে থাকা আমাদের মত দেশের উপর এপর্যন্ত ব্যবহার করা আমেরিকান যাতাকাঠিটা আমাদের এই অঞ্চলে সবার উপর ব্যবহারের জন্য ভারতকে ধার দেয়া দরকার সেই সুপারিশ রাখছেন তিনি। এর আগে আমার অনেক লেখায় “যাতাকাঠি তত্ত্বের” রেফারেন্স আনতে এন্ডারসনের এই দলিলের কথা বলেছি। কিন্তু এবার আজকের এই লেখায় ঐ রিপোর্টের দ্বিতীয় ভাগকে উদ্ধৃতিতে আনছি। প্রথমভাগকে যদি বলা হয় আমেরিকা ভারতকে কি কি দিবে এর তালিকা বিষয়ক তবে দ্বিতীয়ভাগটা হল আমেরিকা কি কি নিবে সে বিষয়ক। দ্বিতীয় ভাগে আমেরিকার প্রত্যক্ষ চাওয়া হল এশিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতিকে ভারত যেন সমর্থন জানায়, চীন ঠেকানোর আমেরিকান স্বার্থের ভিতরে ভারত যেন তারও আঞ্চলিক ভুকৌশলগত স্বার্থ হিসাবে দেখে, নেয়। তবে কথাটা বললাম প্রত্যক্ষ ভাষায়। কিন্তু “এশিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতিকে ভারতের সমর্থন” আমেরিকার এই স্বার্থ পরিকল্পনাকে খোলাখুলি তো বলা যায় না। তাই সেটা এখানে উপস্থাপিত হয়েছিল অন্য শব্দাবলিতে আড়াল করে। এন্ডারসনের রিপোর্টের ভাষায় এটা তাই “managing the rise of China”,মানে চীন ঠেকানো বা মোকাবিলা। কথাগুলো টুকে এনেছি এন্ডারসন ভারতের সাথে আমেরিকার বিশেষ সম্পর্ক কেন হবে -কমন স্বার্থগত মৌলিক দিকগুলো কি তা আমেরিকান কংগ্রেসকে মানাতে গিয়ে কি বলছেন সেখান থেকে নেয়া। বলছেন, “This is based on the strong fundamentals of a convergence of interests on key issues, such as curbing religiously-inspired radicalism, managing the rise of China, defeating the Taliban in Afghanistan, and working towards stability in South Asia and beyond”. নিজ দায়িত্ত্বে করা এর অনুবাদ হলঃ (ভারত আমেরিকার আলাদা আলাদা স্বার্থগুলো) মৌলিকভাবে যেসব জায়গায় মিলেছে তা হল, ধর্ম-অনুপ্রাণিত উগ্রতা ঠেকানো, চীনের উত্থানকে মোকাবিলা, আফগানিস্তানে তালেবানদের পরাজিত করা এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে কাজ করা; আরও সামনে আগানো। অর্থাৎ আমেরিকা নিজের পরাশক্তিগত স্বার্থ আড়াল করে আলকায়েদা তালেবানের উপর দোষ চাপিয়ে এক ইতিবাচক ভঙ্গি তৈরি করে কথাগুলো বলা হয়েছে। কিন্তু যতই কথার ফুলঝুড়িতে আলকায়েদা তালেবানের উপর দোষ চাপিয়ে বলা হোক, প্রথমভাগে আমেরিকার ভারতকে পারমাণবিক অস্ত্রে সহযোগিতাসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ করার যে কথা বলা হয়েছে এগুলো কোনযুক্তিতেই আলকায়েদা তালেবান মোকাবিলার অস্ত্র নয় এটা সবাই সহজেই বুঝবেন, মানবেন। ফলে যেটা বলা হচ্ছে, দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কটা নাকি মূলত ভারত-আমেরিকার “সিকিউরিটি এলায়েন্স” –প্রশ্ন করা যায় এই সিকিউরিটি এলায়েন্স কার বিরুদ্ধে? আলকায়েদা তালেবান নাকি উদিয়মান চীনের বিরুদ্ধে? বলা বাহুল্য এটা চীন। ফলে এখান থেকে চীন ঠেকানোর আমেরিকার মুখ্য স্বার্থটা স্পষ্ট বুঝা যায়। কিন্তু ভারতের দিক থেকে দেখলে ভারত কি বুঝে একই ভাষায় এটাকে মুলত সিকিউরিটি এলায়েন্সের ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক বলে বুঝেছিল? “সিকিউরিটি এলায়েন্স” এর প্রসঙ্গটা যথেষ্ট পুরানা ২০০১-২০০৮ সালের বুশ আমলের;যেমন,বুশের “natural partners” (President Bush in 2006), “strategic allies” (Prime Minister Vajpayee in 2004), and in 2005 Prime Minster Manmohan Singh declared that it is a relationship with “no limits” ইত্যাদি। তার মানে আসলে উভয় রাষ্ট্র উভয়কে ফাঁকি দিয়ে চলছিল। এটা ঠিক যে ভারত আমেরিকার সাথে “চীন বিরোধী” কোন সামরিক বা নিরাপত্তা জোটে ভিড়তে চায় না আবার, একই সাথে এশিয়া কোন একক পরাশক্তির সামরিক প্রভাব দখলে চলে যাক এটাও ভারত চায় না – একথা আমেরিকাকে সে আগেই জানিয়ে রেখেছিল। এন্ডারসনের রিপোর্টও এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, “……no single power (i.e., China) should dominate Asia, but India will not support an anti-Chinese alliance and rather will seek ways to integrate China more closely into a larger Asian context.”। তবু ভারত ভান করেছিল যেন আমেরিকার চীন ঠেকানোর নামে এশিয়ায় সাউথ চায়না সি তে সামরিক উত্তেজনা তৈরির স্বার্থটা সে ধরতেই পারে নাই। ভারতের ভান বলছি একারণে যে এন্ডারসনের রিপোর্টের দ্বিতীয়ভাগ পরিস্কার করেই একেবারে ম্যাপ এঁকে (যেট আমি এখানে ব্যবহার করেছি) সাউথ চায়না সি পর্যন্ত চীনের নৌবাণিজ্যের রুট কি করলে আটকে বা বাধা তৈরি করা সম্ভব (এন্ডারসনের ম্যাপে যাকে চোকিং পয়েন্ট বলে লাল কালিতে চিহ্নিত করেছে) তার উল্লেখ আছে। অথচ এটা তো চীনের বাণিজ্য জাহাজের (সামরিক নয়) অবাধে নৌরুটে চলাচলের মত সাধারণ বিষয়। যা সরাসরি ভারতের অর্থনীতি বা সামরিক কোন সমস্যা নয়, কোনভাবেই সমস্যার ইস্যু নয়, চীনের এশিয়ায় একক সামরিক কর্তৃত্ত্ব নেয়া রুস্তমি হুমকিও এটা নয়। ওদিকে আমেরিকান সংসদীয় কমিটির কাছে এন্ডারসনের এই স্বাক্ষ্য কোন গোপন দলিল নয় বরং এটা দুনিয়ার পাবলিকের কাছে খোলা ফলে ভারতেরও অজানা বিষয় নয়। আবার অন্যদিকে আমেরিকাও ভান করেছিল। ভারতের কাশ্মীর বা উত্তর-পুর্বের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নির্মুল সে আমেরিকার “টেররিজম” শব্দের আড়ালে করতে চাইছে আমেরিকা যেন এটা বুঝতেই পারে নাই। কিন্তু এই পারস্পরিক ছলনার সম্পর্ক নেংটা হতে সময় লাগে নাই। আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর রাখতে চায়। এই খায়েস ২০১২ সালে প্রকাশ হওয়া মাত্র ভারত নিজের বিপদ টের পায় যে এটা আসলে চীন ঠেকানো বা চীনের জন্য বিপদ নয়, আসলে খোদ ভারতের জন্যও সমান বিপদ। ফলে ভারত-আমেরিকার হানিমুনের সম্পর্কে টান ধরে, আস্থা বিশ্বাসের ছলনার পর্দা সরে গিয়ে সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এন্ডারসনের এই রিপোর্টের পরের তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালের শুরুতে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এরপরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। কুটনীতিক খেবড়াগোরে আর বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত-আমেরিকার বিবাদ আরও চরমে পৌছায়।
বিপরীতে চীনের দিকে তাকালে আমরা দেখব পরাশক্তিগত মাসল দেখিয়ে চীনের উত্থান ঘটে নি। অন্তত এখনও ঘটছে না। সত্তরের দশকে ভিয়েতনামের বিপ্লবের পরের চীন দুনিয়ার কোন বিরোধ বিবাদে আর সামরিকভাবে অংশগ্রহণ করে নাই। আসলে পরাশক্তি ভাব যতটা না মাসল ফুলিয়ে দেখাবার বিষয় তারচেয়ে -অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ত্ব অর্জন করা পরাশক্তি হবার পুর্বশর্ত -এই নীতিতে সমস্ত মনোযোগ চীন নিজের অর্থনৈতিক বিকাশের দিকেই ঢেলেছে। কেবল নিজের ভুখন্ডগত বিষয় (তাইওয়ানকে নিজের ভুখন্ড মনে করে ফলে তাইওয়ানসহ) ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোন বিবাদের ইস্যুতে চীন সামরিক সংশ্লিষ্টতা রাখেনি। তাই চীন তার অর্থনৈতিক নৌচলাচল ও প্রবেশ রুট সাউথ চায়না সি তে নিজে যেচে কোন সামরিক উত্তেজনা তৈরির কোন কারণ নাই, করেও নাই,উঠেও নাই। কিন্তু এখন উঠেছে। কেন?
আমেরিকা নিজে ক্ষয়িষ্ণু ও ক্রমশ অগুরুত্ত্বপুর্ণ হয়ে পড়া হলেও তার পরাশক্তিগত দাপটের এখনও অন্যের দরকার আছে, এশিয়ার অনেকেই তাকে চায় এই অবস্থা তৈরি করতে তার নেয়া প্রথম সিদ্ধান্ত হল ২০১০ সালে। তার মোট সামরিক শক্তির ৬০ ভাগ এশিয়ামুখি বা প্রশান্ত মহাসাগরে সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা, বাকি চল্লিশ ভাগ সামর্থ আটল্যান্টিক মহাসাগরে। এর আগে এটা সমান পঞ্চাশ ভাগে ছিল। একই সাথে নিজ মিলিটারি বাজেট মোটের উপর দশ ভাগ ছাটাই করেছিল। কারণ আফগানিস্থান ও ইরাক যুদ্ধের খরচ সামলাতে গিয়ে গ্লোবাল মহামন্দায় আমেরিকান রাষ্ট্র ও অর্থনীতি আর নতুন করে সামরিক ব্যয় বইতে অপারগ হয়ে গিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত প্যাকেজেরই অংশ হল, ইরাক থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার আর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার। অর্থাৎ প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্তের কারণ যুদ্ধ মিশন সম্পন্ন হয়েছে তা নয় বরং যুদ্ধের খরচ যোগাতে রাষ্ট্রের অপারগতা। কিন্তু এশিয়ায় এক আগাম অনুমানের ভীতি ছড়ানোও সে শুরু করেছিল। ভীতির বয়ানটা হল, চীন অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠলে পড়শি রাষ্ট্রগুলোর জন্য তা হুমকি হয়ে উঠবে। ফলে পড়শিদের আমেরিকান সামরিক সহায়তার দরকার হবে। আর তাই এই সহায়তা বিক্রির দোকান খুলে আগেই এশিয়ায় বসে পড়া আমেরিকার দরকার।
গত ছয় মাস ধরে সাউথ চায়না সি বা দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা অথবা নিচের সম্পদের দখল নিয়ে উত্তেজনা চলছে পড়শি ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনের সাথে। ওদিকে পুর্ব চীন সাগরে দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বিরোধ জাপানের সাথে। এতে অসুস্থ বুড়া শুয়ে পড়া ঘোড়াকে চাবুক মেরে খাড়া করার চেষ্টায় রত আমেরিকার পরাশক্তিগত ভুমিকার ন্যায্যতা হাজির হতে শুরু করেছে। আমেরিকান পরিকল্পনা সফল বলতে হয়। কিন্তু ঘটনা শুরু হচ্ছে কোথা থেকে সেদিক থেকে আমাদের নজর যেন না সরে যায়। আমেরিকার ২০১০ সাল থেকেই তার এশিয়ামুখি করে সামরিক শক্তির পুনর্গঠন আর একইসাথে “পার্টনারশীপ ডায়লগ” এর নামে চীনের পড়শি দেশগুলোকে ভড়কিয়ে নিজের সামরিক নৌকায় তোলার চেষ্টা শুরু করে,চীনের পড়শিদেরকে সামরিক নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ করতে থাকে। এই ঘটনা থেকে এশিয়ায় সামরিক উত্তেজনার শুরু। যাদের সাথে আগে থেকেই চুক্তি আছে যেমন জাপান, তাও ঝালাই করে নেয়।
চীনের দিক থেকে দেখলে আমেরিকার এই পদক্ষেপ নিজের জন্য হুমকি মনে না করার কারণ নাই। কারণ এটা তার সামরিক না বাণিজ্য জাহাজ অবাধ চলাচলের ইস্যু। এমনিতেই এশিয়ার মহাসাগর প্রত্যক্ষভাবে আমেরিকার নিজ ভুখন্ডের উপকুলীয় কোন উন্মুক্ত নীল জলরাশি অঞ্চল নয়। তাহলে সে কেন এখানে? এর ন্যায্যতা কি?
[বাকি অংশ দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে সমাপ্ত]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s