ওবামার এশিয়া নীতির মুখ থুবড়ানো পরিণতি (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)


ওবামার এশিয়া নীতির মুখ থুবড়ানো পরিণতি (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

গৌতম দাস

প্রথম পর্ব এখানে দেখুন

রবার্ট ডি কাপলান। তাঁকে আমেরিকার এক প্রভাবশালী নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মনে করা হয়। প্রভাবশালী Stratfor ম্যাগাজিনের চীফ ভুরাজনৈতিক বিশ্লেষক তিনি। আমেরিকান রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্যও তিনি। “Beijing’s Caribbean Logic” শিরোনামে গত মার্চ ২০১৪ তিনি এক আর্টিকেল (আসলে তাঁর নতুন বইয়ের এক আর্টিকেল) লিখেছেন। ওখানকার সারকথা হলঃ বৃটিশ বা ফরাসী সাম্রাজ্য যখন দুনিয়াকে লূট দখলের কলোনী রাজত্ত্ব করে রেখেছিল এর শেষের দিকে আর বিপরীতে আমেরিকার যখন অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশ পরাক্রমশালী হয়ে উঠছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগের সেই সময়ে আমেরিকা প্রথম ক্যারেবিয়ান সাগরের কর্তৃত্ত্ব নিয়েছিল কলোনী মাষ্টার বৃটিশ সাম্রাজ্য শাসকের বিরুদ্ধে। ক্যারেবিয়ান সাগর হল, মার্কিন দেশের দক্ষিণ দিকে যেখানে আমেরিকা মানে উত্তর আমেরিকা আর দক্ষিণ (বা ল্যাটিন) আমেরিকা বিভক্ত হয়েছে সেই বিস্তৃর্ণ সাগর জলরাশি। ক্যারেবিয়ানের উত্তরদিকে আমেরিকার মিয়ামি, মেক্সিকো আর ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র পানামা, কিউবা জামাইকা ইত্যাদি আর দক্ষিণদিকে কলম্বিযা, ব্রাজিল ইত্যাদি রাষ্ট্র – সেই অঞ্চল। এটাই উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাকে এক চিকন ভুখন্ডগত (সবচেয়ে চিকন অংশটাই পানামা রাষ্ট্র) সংযোগে ধরে রেখেছে। আবার বলা যায় ঐ চিকন ভুখন্ড পুবে আটলান্টিক মহাসাগর অঞ্চল আর পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল এভাবে মহাসাগর দুটোকে বিভক্ত করে রেখেছে। আমেরিকা নিজের অর্থনৈতিক পরাশক্তিগত উত্থানের যুগে প্রথমেই সে তার নিজ ভুন্ডের দক্ষিণের ক্যারেবিয়ান সাগরের দখল নিয়েছিল, বৃটিশদের থাকতে দেয়নি। এখন কাপলান ঐ লেখায় যুক্তি দিচ্ছেন, তাহলে আজকের রাইজিং ইকোনমির চীন কেন এশিয়ায় জলরাশিতে আমেরিকাকে ঢুকতে দিবে? চীন তো আসলে আমেরিকার “ক্যারেবিয়ান লজিকই” প্রয়োগ করছে। তাই কাপলানের লেখার শিরোনাম “বেইজিং এর ক্যারেবিয়ান লজিক”।
কাপলানের কথার এক ধরণের গুরুত্ত্ব আছে সন্দেহ নাই। তবে তিনি এম্পেয়ার বা সাম্রাজ্যবাদের নষ্টামির পিছনের ভাবাদর্শগত ন্যায্যতা খুজতে গিয়েছেন। কিন্তু এতে যেদিকটা আড়ালে পড়ে গিয়েছে তা হল, চীন নিজে প্রথমে কাউকে হটিয়ে এশিয়ার জলরাশিতে নিজের কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যায় নাই। উত্তেজনাহীন নিঃতরঙ্গ এশিয়ার জলরাশিতে জাহাজ নৌরুটে পণ্য আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহার করে চীন তার অর্থনীতিতে বিকাশ সাধন করে যাচ্ছিল। তার পড়শিরাও যার যার মত নিজের অর্থনীতিতে মশগুল ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে চীনের পড়শিদেরকে আমেরিকার নৌ-সামরিক শক্তি অফার করা, নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ করার উস্কানি থেকে। স্বভাবতই এটা চীনের দিক থেকে বিরাট হুমকি মনে করারই বিষয়। বিশেষত তার নৌবাণিজ্য বা পণ্য আনা-নেয়ার প্রধান রুট এশিয়ার জলরাশি বিশেষত সাউথ চায়না সি অবাধ চলাচল এলাকা রাখার স্বার্থে, এই কারণে। দাবার পালটা চালের মত, আমেরিকার ঐ পদক্ষেপের ফলে চীনের এতদিনের -দুনিয়ার কারো সাথে সামরিক সংঘাতের সম্পর্কে সে নাই – এই নীতি থেকে সরে গিয়ে চীনের এখনকার নীতি হয়ে দাড়িয়েছে – যারাই আমেরিকার কাছে আশ্রয় খুজছে, সামরিক জোটে আবদ্ধ হতে চাইছে বা হয়ে আছে এমন সব দেশের প্রতি চীনের ভুমিকা মাসল দেখানোর। যেমন উদাহরণ হিসাবে জাপানের প্রসঙ্গঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের জাপান ঐ অঞ্চলের সকলের কাছেই এক কলোনী মাষ্টার হিসাবে পরিচিত; চীনসহ দুই কোরিয়াকে সে কলোনী দখল করে রেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর মৃত এবং জীবিত জাপানী যারা যুদ্ধাপরাধী হিসাবে ফাঁসি সাজাপ্রাপ্ত এদের সহ সকলের উদ্দেশ্য নির্মিত স্মৃতিসৌধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে কখনই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ফুল দিতে যান নাই। কিন্তু এবার গিয়েছেন। এঘটনাটা চীন ও কোরিয়াকে বিক্ষুব্ধ করেছে। এরচেয়ে হাস্যকর হল তিনি নিজের ফুল দিতে যাওয়ার পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলছেন, দুনিয়ার সব রাজনৈতিক নেতারাই নিজ দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন তাই তিনি গিয়েছেন। বিপরীতে চীনের প্রতিক্রিয়া হল, পিছনের ইতিহাস না ঘেটে যখন আমরা সামনের দিন নির্মাণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচনের চেষ্টা করছি তখন এই আচরণ খুবই বিভেদমূলক ও শত্রুতা উস্কে দেয়ার। একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়া ক্ষোভ জানিয়ে বলেছে এটা কোরিয়ান জনগণের অনুভুতিকে পায়ে মাড়ানো। এছাড়া ছোট্ট যে দ্বীপের মালিকানা নিয়ে জাপান-চীনের বিবাদ সেটাও কলোনী দখল যুগের মালিকানার বিবাদ। স্পস্টতই জাপানের ভুমিকা মাসল ফোলানোর, খুচিয়ে পুরান ঘা তাজা করার, টেনশন তৈরি করার। এর পিছনের কারণ হল, আমেরিকার সাথে বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের সামরিক চুক্তি আছে যে জাপান আক্রান্ত হলে সেটাকে আমেরিকা নিজের উপর আক্রমণ মনে করবে, ফলে জাপানের শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিবে। এসব কিছু মিলিয়ে এককথায় বললে, চীন বর্তমান অবস্থান নিয়েছে, এশিয়ার জলরাশিতে আমেরিকার কোন ভুমিকা সে দেখতে চায় না – এটাই তার নীতি ও আকাঙ্খা।

সাংগ্রিলা ডায়লগঃ
এশিয়ায় জলরাশিতে উস্কানি তৈরি করে আমেরিকার নিজের কদর বাড়ানো, বিপরীতে চীন আমেরিকান জোট পাকানোর বিরোধীতা তার বর্তমান নীতি, এর ফলে এখনকার সময়টাকে বলা যায় এটা এশিয়ার জন্য মাসল দেখানো, টেনশনের পিঠে টেনশন তৈরি করার এক সময় চলছে। কিন্তু এটা কোথায় গিয়ে শেষ হতে পারে বা কিভাবে থিতু হতে পারে – সেই ছবিটাকে ধরার জন্য গতমাসের শেষদিকে ৩০ মে থেকে তিনদিন সিঙ্গাপুরের সাংগ্রিলা হোটেলে এশিয়ার বার্ষিক (১৩তম) নিরাপত্তা সম্মেলন হয়ে গেল, সেখানকার রিপোর্টিং কে ব্যবহার করব।
বৃটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক International Institute for Strategic Studies (IISS)এর দায়িত্ত্বে পরিচালিত সাংগ্রিলা ডায়লগ মূলত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ২৮ দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদেরকে নিয়ে বার্ষিক আলোচনাসভা বা ডায়লগের স্থান। থিঙ্কট্যাঙ্ক IISS এটাকে “The IISS Asia Security Summit” বলে পরিচিত করিয়ে থাকে। শুরুতে মূল উদ্যোক্তা ছিল আমেরিকা; থাইল্যাণ্ডকে সাথে নিয়ে এর আয়োজক হয়েছিল ২০০২ সালে। উদ্দেশ্য পরাশক্তিগত স্বার্থগুলো ডায়লগ আলোচনার মাধ্যমে যতটা সম্ভব বুঝে শুনে নেয়া। ঐ ২৮ দেশের মধ্যে আমেরিকা বৃটেন রাশিয়া চীন জাপান কোরিয়া ভারত পাকিস্তান অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি প্রায় সকলেই অন্তর্ভুক্ত। এটাকে বলা যায় গ্লোবাল অর্থনীতি এশিয়ামুখি ভারকেন্দ্রে চলে আসার আর এক প্রতিক্রিয়া। “সাংগ্রিলা ডায়লগ” (Shangri-La Dialogue বা সংক্ষেপে SLD) নাম হবার পিছনের কারণ এটা শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক চেন হোটেল সাংগ্রিলার “সিঙ্গাপুর সাংগ্রিলায়” আহুত হয় বলে সেখান থেকে এই নেয়া নাম।
Shangri-La Dialogue 2014 সভার এবার উদ্বোধনী বক্তৃতা করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। খুবই আক্রমাণাত্মক তাঁর বক্তৃতার সারকথা হল, রুল অব ল এট সি অর্থাৎ সমুদ্র বিষয়ে আইনের শাসনে চলতে হবে সবাইকে। মানে সীমানা বিবাদ মীমাংসায় চীনকে আন্তর্জাতিক আইন কনভেনশন ইত্যাদির মধ্যে আসতে হবে। “আইনের শাসন” কথাটা শুনলে সকলের সহজেই আকৃষ্ট হবার ইচ্ছা জাগে, তাই তাঁর এই শব্দ দিয়ে বলা। সেকথায় পরে আসছি। শিনজোর পরে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল তাঁকে সমর্থন করে বক্তৃতা উত্তেজনা আরও এক ধাপ সুরে চড়িয়ে দেন। চাক হেগেল চীনকে অভিযুক্ত করেন,“অস্থিতিশীল করার দেশ” “আগ্রাসী শক্তি” ইত্যাদি বলে। মিডিয়া রিপোর্ট বলছে, আগে থেকেই আমেরিকা ও জাপানের উপর ক্ষিপ্ত ছিল বলে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্ত্ব চীনাদল আসেনি, এর বদলে এসেছে চীনা সামরিক জেনারেলদের নেতৃত্বে এক চীনাদল। সেই জেনারেলও বক্তৃতায় পালটা জাপানের দানবীয় সামরিক অতীতের কথা তুলে মুখ ছুটিয়েছিল। বলেছেন, “চীন যে কোন “নির্মম ফ্যাসিষ্ট এবং সামরিক দাঙ্গাবাজ আগ্রাসনকারীর আসরে ফিরে আসা প্রতিহত করবে”। আর আমেরিকা সম্পর্কে বলেছে্ন, “চীনের বিরুদ্ধে ঘোট পাকাচ্ছে, সকলকে খেপিয়ে তুলছে”। চাক হেগেলের বক্তৃতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে বলেছে এটা “কল্পনাতীত”, “আধিপত্যসুলভ, হুমকির মত এবং হস্তক্ষেপমূলক” বক্তব্য। এবিষয়ের সারকথাটা বলবার জন্য পশ্চিমা সাপ্তাহিক “ইকোনমিষ্ট” থেকে ধার নিব। সাংগ্রিলা ডায়লগ শুরুর দিন তিনেক আগে ওবামা “ওয়েষ্ট পয়েন্ট” বলে খ্যাত আমেরিকার এক মিলিটারি একাডেমিতে বক্তৃতায় ক্যাডেটদের আশ্বস্ত করার ছলে বলেছিলেন, ”আমেরিকা অবশ্যই বিশ্ব পরিসরে নেতৃত্ত্ব দিয়ে যাবে” এবং “আমেরিকার জোট-বন্ধুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সে এক-পক্ষীয়ভাবে সামরিক বল প্রয়োগ করবে”। ইকোনমিষ্ট বলছে,এসব কথা চীনের নজরে না আসার কারণ নাই, তাই সম্ভবত চীনা জেনারেলের এমন প্রতিক্রিয়া। এছাড়া ইকোনমিষ্টের রিপোর্টের কিছু শেষকথা চীনা অবস্থান ভাবনাকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছে মনে করা যেতে পারে। অনুবাদ করে বললে তা দাঁড়ায়,- “…… চীন আমেরিকা জাপানের এসব কথাবার্তা, এক ‘পুরানা বিশ্বব্যবস্থার’ মাতবরদের কথা হিসাবে দেখছে যা তার কাছে গ্রহনীয় নয়। চীনের দিক থেকে দেখলে ‘পুরানা বিশ্বব্যবস্থা’ মানে পশ্চিমের স্বার্থে বিশেষত আমেরিকার নেতৃত্ত্বে জারি করা অর্ডার, এক নিয়ম-কানুন শৃঙ্খলা। যা নিজ শাসন-শৃঙ্খলার বাসার ভিতর উত্থিত চীনকে অন্তর্ভুক্ত হতে দেয় অবশ্যই, কিন্তু ততটুকুই যতটুকুতে চীন ঐ বাসাতে আগে থেকে সেট করা নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুগত হয়ে মেনে নেয় আর ওদিকে অন্য দেশগুলো ঘোট পাকিয়ে চীনের বিরুদ্ধে সমালোচনা জারি রাখে। এসব তারা করে এই বিশ্বাসে যে এভাবে চীনের বিরাট শক্তি হিসাবে উত্থানকে দমায়ে রাখতে পারবে”।

এশিয়া নীতির সম্ভাব্য পরিণতি
“সাংগ্রিলা ডায়লগে” কি ঘটেছে সে প্রসঙ্গে এরপরে নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট থেকে নেয়া কিছু কথা বলে শেষ করব। এই লেখার পরের নিচের অংশ বেশিরভাগই টাইমসের রিপোর্ট থেকে টুকে নেয়া ছোট ছোট ঘটনা বর্ণনা, সাথে নতুন কিছু ব্যাখ্যামূলক পয়েন্ট তাতে যোগ করে লেখা হবে। টাইমসের মূল ইংরাজি রিপোর্ট এখানে আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।
টাইমসের রিপোর্টের শিরোনামটাই মজার,“জোটবন্ধুরা চীনা চ্যালেঞ্জের মুখে, আমেরিকা কাপাকাপি দশায় এশিয়ায় ডুবতে বসেছে” । শিরোনাম থেকেই যথেষ্ট সরাসরি কথাবার্তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতিকালে পড়শিদের সাথে চীন যেসব বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে বিশেষ করে ভিয়েতনাম ও জাপানের সাথে; যেমন, ভিয়েতনামের এক মাছধরা নৌকা ডুবিয়ে দেয়া ও সাগরের নিচের তেল তোলার রিগ বসানো নিয়ে ভিয়েতনামের সাথে বিরোধ আর জাপানের সাথে এক ছোট দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বিরোধ, জাপান গোয়েন্দা সার্ভিলেন্স স্থাপনার খুব কাছে দিয়ে চীনা যুদ্ধজেট বিমানের উড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে ঐ অঞ্চলে। অন্যদিকে আগেই বলেছি, ঐ অঞ্চলে চীনের পড়শিদের সাথে আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং পার্টনারশীপ ডায়লগ প্রোগ্রামে আমেরিকা নিরাপত্তা ফেরি বিক্রির চেষ্টায় রত; যাতে এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে এক শক্ত জোট খাড়া করে আমেরিকা নিজের পরাশক্তিগত উপস্থিতির ন্যায্যতা তৈরি করতে পারে। এসব বিষয়কে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তা নিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং প্রাক্তন এক অষ্ট্রেলিয়ান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা হলেন Hugh White। ওয়াশিংটনের সাথেও তাঁর ঘনিষ্টভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তাঁর বরাতে টাইমস পত্রিকা লিখছে, চীনের লক্ষ্য আমেরিকাকে দেখানো যে সে যদি এশিয়ায় এভাবে এন্টি-চীন শক্তিজোট খাড়া করতে চায় তবে তাকে চীনের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ার রিস্ক নিতে হবে। White বলছেন, “চীন উদ্দেশ্যপুর্ণভাবে দেখতে চায় যে আমেরিকা চীনের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তার পড়শিদের সাথে জোট বাধার চেষ্টা – এভাবে এই অঞ্চলে আমেরিকার নেতৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা -এটা টিকাতে পারবে না”। চীন যেন বাজি ধরে বসেছে সবশেষে ক্লান্ত ও ঘরমুখে গুটানো আমেরিকা পিছু হটবেই আর এতে এশিয়াতে নিজের প্রভাব যতটুকু আছে তা খুইয়ে প্রকারন্তরে এটা চীনের শক্তিকেই বাড়িয়ে তুলবে।
টাইমস আরও জানাচ্ছে, ওবামা প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিরা ব্যক্তিগতভাবে ভিতরের অনেক খবর দিচ্ছেন। বলছেন, চাক হেগেল ও আমেরিকা প্রশাসন জনসমক্ষে জাপানের পিছনে সমর্থনে দিয়ে যাবার কথা বলে চলবে এমনকি কিছুটা মাত্রায় ফিলিপাইন, ভিয়েতনামের মত অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও তা করে যাবে। কিন্তু প্রশাসন আসলে নিজেকে চীনের সাথে মুখোমুখি সংঘাত অবস্থাতেই দেখছে। এটা দেখে প্রশাসনে হতাশা বাড়ছে যে নিজে সকলকে নিয়ে এমন এক খেলার প্যাচে জড়িয়ে যাচ্ছে যা যুদ্ধের পরিণতি ডেকে আনতে পারে। টাইমস ম্যাগাজিন আরও লিখছে, প্রশাসনের আর এক সিনিয়র কর্মকর্তা আমেরিকান নীতির সমস্যাগুলো নিয়ে মন খুলে কথা বলতে নাম প্রকাশ না করে বলছেন, “দেশগুলোর (বিবদমান চীনের পড়শিরা) কেউ বিষয়টা সামলাতে সাহায্য করছে না”; জাপানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে আমেরিকা যদিও জনসমক্ষে সবসময় জাপানকে সমর্থনের কথা বলে যাবে কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তারা সমপর্যায়ের জাপানী কর্মকর্তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বারবার বুঝাচ্ছেন যে যে কোন পদক্ষেপ নেবার আগে সাতবার ভাবতে; আর তারা যেন কোনভাবেই চীনকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়ার অবস্থায় না নেয়।
ওদিকে আর এক কর্মকর্তা বিক্রম জে সিং, গত ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত যিনি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার দায়িত্ত্বের আমেরিকার উপ-সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন তিনি বলছেন, “ তাদেরকে যদি স্কুলের বাচ্চা ধরি তাহলে বলতে হয় তারা আসলে হাতে কাঁচি নিয়ে চারিদিকে খেলা করে বেড়াচ্ছে”। “ছোটখাট জিনিষ থেকেই দুর্ঘটনায় বা হিসাবের ভুলের ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যেমন যুদ্ধপ্লেন চলতে চলতে খামোখা বিপদজনক গোত্তামারা মোড় নেয়া থেকে দুর্ঘটনা বা আগ্রাসী মনোভাবের প্রকাশের ফলে অযাচিত পালটা সামরিক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখিতে পড়তে হতে পারে”।
সাংগ্রিলা ডায়লগের সভায় চাক হেগেল ও তার সাথী সামরিক বাহিনীর অনুগামি দল জয়েন্ট চীফ অব ষ্টাফের চেয়ারম্যানসহ বাঘা জেনারেলরা খুবই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন ব্যাডমিন্টন খেলার কর্কের মত দৌড়াদৌড়ি করে। কেন? কারণ, ঐ সভায় প্রধান উস্কানিদাতা বক্তা ছিলেন জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। প্রধান বক্তা হিসাবে তার বক্তৃতার পর ডায়াসে থাকা অবস্থায় তিনি এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এক তরুণ চীনা অফিসার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, দ্বীপের মালিকানা বিরোধকে কেন্দ্র করে তিনি কি চীনের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার কথা ভাবতে রাজি আছেন? প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে ছুপা জবাবে তিনি বলেছেন, “আমরা সবাই মিলে উদ্যোগ নিয়ে রাখাটা জরুরী” যাতে কোন “অজানা, যদি ঘটে যায় এমন ঘটনাকে ঠেকানো যায়”। আমেরিকান জেনারেলরা তাই দৌড়াদৌড়ি করে সবার কাছে গিয়ে নিশ্চয়তা নিচ্ছিলেন “অজানা, যদি ঘটে যায় ঘটনা” যেন কোনভাবেই না ঘটে।
এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর ও পুর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ Andrew L. Oros বলেছেন,”কোন বিরোধ সংঘাতের মুখোমুখিতে ওর রেফারি হওয়ার চেয়ে বরং যেকোন ভাল শিক্ষক জানেন বাচ্চাদেরকে সব কিছুর আগে ডিসিপ্লিন আচরণ শিখিয়ে নিতে হয়”। এখানে “রেফারি” প্রসঙ্গে টিটকিরি করে বলা হয়েছে। এমন হওয়ার কারণ,ওবামার প্রথম টার্মে তার নতুন “এশিয়া পলিসি” হাজির করেন যেখানে রেফারি মানে “এশিয়ায় আমেরিকার pivot বা ভারকেন্দ্র ভুমিকা” থাকবেই একথা বারবার উচ্চারিত হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আমেরিকান ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে অক্টোবর ২০১১ সালে নিজে এনিয়ে এক আর্টিকেল লিখেছিলেন, America’s Pacific Century শিরোনামে। ঐ আর্টিকেলের প্রথম বাক্য ছিল “As the war in Iraq winds down and America begins to withdraw its forces from Afghanistan, the United States stands at a pivot point”. ফলে এখান থেকেই ওবামার এশিয়া পলিসি মানেই শব্দটা কয়েন হয় নতুন শব্দে “এশিয়াতে আমেরিকার পিভোটাল রোল” বা রেফারি ভুমিকা – এভাবে। আমেরিকান একাদেমিকরা সেকথার সুত্র ধরে এখন ঠাট্টা মশকরা করে বলছেন, “ওবামার রেফারি ভুমিকা”। কারণ অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, ওবামার এশিয়া পলিসির অর্থ এন্টি চীন মাতবরির আমেরিকান জোট এভাবে না ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে যায়। এবং সেক্ষেত্রে এই নীতি অকার্যকরে হয়ে যাবে।

ওবামা্র মানে গ্লোবাল পুঁজির স্ববিরোধ
উপরে এন্ডারসন সাহেবের রিপোর্টের ম্যাপে দেখিয়েছিলাম লাল গোল দাগ দেয়া “চোকিং পয়েন্ট”। চোকিং পয়েন্ট এর আক্ষরিক মানে শ্বাসরুদ্ধ করে চেপে ধরার এমন সহজ জায়গা। অর্থাৎ চীনের অর্থনীতির শ্বাসরুদ্ধ করে দেবার মত সহজ জায়গা কোনটা – চীনের পণ্য বাণিজ্য জাহাজের নৌচলাচল পথে এমন দুটো জায়গা যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই চিকন হয়ে থাকা কিছু অংশ পার হতে হয়। এর একটা ইরানের নৌসীমায় হরমুজ প্রণালী (সমুদ্র নৌপথের চিকন অংশকে বাংলায় প্রণালী আর ইংরাজিতে strait বলা হয়ে থাকে) আর অন্যটা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ভুখন্ডের মাঝে মালাক্কা প্রণালী। প্রণালীতে কোন যুদ্ধজাহাজ আড়াআড়িভাবে রেখে দিলে অথবা ঠিক প্রণালীর উপর কোন বাণিজ্যিক জাহাজও ডুবিয়ে দিতে পারলে ঐ নৌচলাচল পথকে সহজেই কয়েক মাসের জন্য স্থবির রুদ্ধ করা সম্ভব। ফলাফল এটা চীনের অর্থনীতিকে অকেজো করে দেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। তাই টুটি চেপে ধরার চোকিং পয়েন্ট।
আমেরিকার সাথে চীনের ১৯৭১ সালে প্রথম সম্পর্ক স্থাপনের সময় দেনা-পাওনার মৌলিক যেদিকটা নিয়ে রফা হয়েছিল তা হল, চীন আমেরিকার ওয়াল ষ্ট্রিটের পুঁজি নিজ ভুখন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিবে, পুঁজিকে প্রয়োজনীয় আইনী সুরক্ষা দিবে। বিদেশী পুঁজি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করে নেয়ার মত কোন পদক্ষেপ নিবে না। (এগুলো আজকাল আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাবার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্ত হয়ে গেছে।) বিনিময়ে আমেরিকান রাষ্ট্র চীনকে জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতাওয়ালা সদস্যপদ পাবার সহযোগিতা থেকে শুরু করে চীনের বিকাশে অর্থনৈতিক, ষ্ট্রাটেজিক,পণ্যবাজার সুবিধা ইত্যাদি চীনা স্বার্থের দিকগুলোতে বাধা তো হবেই না বরং সহযোগিতা করবে। এটা চীনের দিক থেকে খুব স্বাভাবিক চাওয়া। কারণ চীনে বিদেশী পুঁজি এসে উতপাদন বাণিজ্য করতে গেলে এগুলো তার স্বাভাবিক অনুষঙ্গ চাওয়া। কারণ মূলত তা ওয়াল ষ্ট্রিটের পুঁজির স্বার্থেই, কারবার ভায়াবল হওয়া, তার মুনাফাসহ আরও স্ফীত হওয়ার স্বার্থেই। কিন্তু সে প্রসঙ্গটা এখানে এখন তোলার কারণ আছে। আমেরিকা-চীনের প্রথম সম্পর্কের সময়ের মৌলিক দিকটা খুবই সংক্ষেপে এখানে বলা হলেও তবু এটুকু থেকে একটা জিনিষ পরিস্কার যে এই রফার ভিতর আমেরিকান রাষ্ট্রের জন্যই এক বড় বিপদ লুকিয়ে ছিল, এখনও আছে। বিশাল ভুখন্ড ও জনসংখ্যার চীন মানে বিশাল আভ্যন্তরীণ বাজার আর ওদিকে সস্তা শ্রমে প্রতি জোড়া হাতে সস্তায় রপ্তানিযোগ্য ও কমপিটিটিভ পণ্য উতপাদন – এতে চীনের দুনিয়া কাপানোর কথা সন্দেহ নাই। এতে এক বিশাল অর্থনৈতিক উত্থান চীনকে সবদিক থেকেই পরাশক্তি করে তুলবে, তা সকলেরই জানা ছিল। যেটা আবার খোদ আমেরিকা রাষ্ট্রের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ও হুমকি। কিন্তু শুরু থেকেই এটা টের পাবার পরও আমেরিকান রাষ্ট্রের কিছুই করার ছিল না। কারণ এটাই গ্লোবাল পুঁজির আপন স্ববিরোধীতা। যেমন, একদিকে ওয়াল ষ্ট্রিটের স্বার্থ হল সবসময় নতুন নতুন অফুরান বিনিয়োগের বাজার তাকে পেতেই হবে,ওটাই তার প্রাণভোমরা। যেভাবেই হোক অফুরান বিনিয়োগের বাজার তাকে পেতেই হবে। অন্যদিকে ওয়াল ষ্ট্রিট পুঁজির নিজেরই আকার দেয়া দানব এমপায়ার বা দুনিয়ায় সবাইকে পিটায় ধমকায় বেড়ানো “সাম্রাজবাদ” রাষ্ট্র। কিন্তু আমেরিকান রাষ্ট্রের এমন কিছু নিজস্ব স্বার্থ আছে যা সব সময় তারই ওয়াল ষ্ট্রিটের স্বার্থের সাথে হাত ধরাধরি করে চলে না, চলতে পারে না। এমনিতেই ওয়াল ষ্ট্রিটের মালিক রাষ্ট্র নয় ব্যক্তিবর্গ, যার মুনাফা লাভালাভে আকার বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রের এর উপর কোন নগদ লাভ নাই কর্তৃত্ত্ব নাই। ফলে ওয়াল ষ্ট্রিটের একান্ত নিজ স্বার্থে খোদ আমেরিকান রাষ্ট্রকে বিপদে হুমকির মুখে ফেলে হলেও তার বিনিয়োগ বাজার চাই। ফলে রাষ্ট্র টিকে থাকার স্বার্থ আর ওয়াল ষ্ট্রিটের টিকে থাকার স্বার্থ এখানে এক নয়, এক তালে নয়। এজন্য একদিকে চীনে প্রবাহিত গ্লোবাল পুঁজি (ওয়াল ষ্ট্রিট যার কেন্দ্র বা প্রতীকী নাম) এর ফুলেফলে বেড়ে উঠা সুরক্ষা করতে ওবামা কমিটেড ও বাধ্য আবার বিপরীতে রাইজিং চীন রাষ্ট্র আমেরিকান রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে ওর চেয়েও বড় পরাশক্তি হয়ে উঠার বিপদে নিজেই হুমকিতে, দুনিয়ায় নিজের একছত্র সাম্রাজ্য বা এম্পায়ার ভুমিকার মুকুট যায় যায় অবস্থা। তাই একদিকে ওবামা চীনের চোকিং পয়েন্ট মানে টুটি টিপে ধরার জায়গাটা খুজে বেড়ায় আবার ওর খুজে বেড়ানো দেখে রাইজিং চীনের খারাপ প্রতিক্রিয়া হুমকিতে তটস্থ হয়ে যায় সে। নিজেই জাপানকে উস্কানি দেয় আবার নিজেই তাকে জোরে চিৎকার করতে না করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের (জাতিসংঘ,আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউটিও ইত্যাদি) গড়ে এগুলো নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ত্বের মাধ্যমে আমেরিকান রাষ্ট্র দুনিয়ায় তার সাম্রাজ্যের রুস্তমি চালায়, আমেরিকান মাতবরিতে সাজানো তৈরি এসব প্রতিষ্ঠানে ঢুকার চেয়ে চীন বরং আবার নতুন করে নতুন ভারসাম্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে চায়। এর ভিতরই নিজের স্বার্থ দেখে স্বস্তিবোধ করে। BRICS যার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। ওদিকে ওয়াল ষ্ট্রিটের এক বিশাল মোড়ল “গোল্ডম্যান স্যাসে” কোম্পানী তাই নিজেই BRICS গড়তে পরামর্শ উতসাহ জুগিয়েছে কারণ এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেই তা তাকে নতুন আয়ু দিবে। তাতে আমেরিকান রাষ্ট্র ডুবে মরল না বাচল এটা তার কাছে গৌণ, মুখ্য হল কে তাকে অফুরন্ত নতুন নতুন বিনিয়োগ বাজার এনে দিচ্ছে। ওয়াল ষ্ট্রিটের বাইরে আফ্রিকাকে মাথায় রেখে দুবাই আর চীনকে মাথায় রেখে সিঙ্গাপুরে পুঁজি বাজার ক্রমশ বড় ও বিকশিত কেন্দ্র হয়ে উঠছে। ওবামা তাই একদিকে এশিয়ায় এন্টি চীন নয়, এশিয়ায় নিজের পিভোট বা ভারকেন্দ্র অথবা রেফারির ভুমিকা দেখে। আবার একইসাথে এখনও দুনিয়াকে নিজ রাষ্ট্রের সাম্রাজ্য নেতৃত্ত্ব চালিয়ে যাবার স্বপ্নে চীনের চোকিং পয়েন্ট হাতড়ে বেড়ায়। গ্লোবাল পুঁজির স্ববিরোধীতা স্বভাব এভাবে চারদিক থেকে ফুটে উঠে।
এখন ফলাফল? টাইমসের ঐ রিপোর্টের শেষ অংশে চীনের সাঙহাইয়ের ফুদান ইউনিভার্সিটির ‘আমেরিকান ষ্টাডি সেন্টার’ এর ডিরেক্টর Wu Xinbo এর উধৃতি দিয়ে বলছে, “ওবামা প্রশাসন সম্ভবত এশিয়ার আকাশ ও নৌ-সীমা বিষয়ক বিবাদ্গুলোকে হাওয়া দিয়ে জাগিয়েছে আমেরিকার এশিয়া নীতির দিকে মনোযোগ দিবার কথা তুলে”। সে আসলে চীনের নার্ভ পরীক্ষা করতে গেছিল। “একারণে চীন আর কখনও এশিয়ায় আমেরিকার নেতৃত্ত্বে শক্তিজোট পাকানোর বিষয়্টাকে স্বাগত জানাবে তা যেন কেউ আর আশা না করে। চীনের স্বার্থের দিকটাই এরা উপেক্ষা করেছে”। অবস্থা দেখে ওদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট গত মাসের ১৯ মে তারিখে “নতুন এশিয়ার নিরাপত্তা কৌশলের” রূপরেখা হাজির করেছেন এক আন্তর্জাতিক সভায়। ওখানে আহুত সম্মেলনে উপস্থিত দেশগুলো ছিল চীন রাশিয়া ও অন্যান্য এশিয়ান দেশ। কিন্তু আমেরিকাকে বাইরে রাখা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছে, এটা চীনের জেনেবুঝে নেয়া সিদ্ধান্ত।

কয়েনের উলটা দিক
কিন্তু কয়েনের আর একটা দিক থেকে কিছু কথা বলা দরকার। আমেরিকার সাথে এই টানাপোড়েন করতে গিয়ে চীন সাগরের পড়শি বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর কাছে চীন একটা খারাপ ম্যাসেজ পাঠিয়ে ফেলেছে। আকাশ বা নৌপথ অথবা সাধারণভাবে সীমানা বিষয়ক কোন বিবাদ বিতর্ক উঠলে এর সমাধান কি তবে সামরিক পথেই লাঠির জোরে করতে চায় নতুন রাইজিং চীন? নাকি জাতিসংঘের আনক্লজ পদ্ধতি পছন্দ না হলে আরও ভাল কোন আন্তর্জাতিক সালিসের পথে করতে চায়? এদিকটা নিয়ে চীনকে অবশ্যই ভাবতে হবে। যদিও মূলত চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্ত্বে আর এক পলিটিক্যাল জোট হাজির হয়েছে দেখা যাচ্ছে, নামঃ Conference on Interaction and Confidence Building Measures in Asia (CICA)। এর নামের মধ্যে ইন্টার-একশন আর কনফিডেন্স বিল্ডিং মানে “পারস্পরিক আলাপ আলোচনা” ও “পরস্পরের আস্থা অর্জন” শব্দ দুটোর তাতপর্য আছে অনুমান করা যায়। কারণ CICA এর সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়া জানা গেল, ওখানে সব সিদ্ধান্ত হতে হবে সকলের সর্বসম্মতিক্রমে। জাতিসংঘ জন্ম দেবার আগের ৫-৭ বছর ধরে এমনিভাবেই বিভিন্ন ধরণের নানান জোটের জন্ম হয়েছিল, সবগুলো টিকে নাই বটে তবে সবগুলো উদ্যোগের মিলিত পরিণতি্তে জন্ম হয়েছিল জাতিসংঘ। বলা বাহুল্য, একদিকে CICA উদ্যোগের আর অন্যদিকে চীনের পড়শিদের সাথে চীনের বিরোধ মীমাংসার পথ – এদুটো পরস্পর অসামঞ্জ্যপুর্ণ। আমরা আশা করব এদিকগুলোতে চীন মনোযোগী হবে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s