অন্যের বাড়িঘর দেশ দখল করে তাদেরই হত্যা করার ‘সেলফ ডিফেন্স’


অন্যের বাড়িঘর দেশ দখল করে তাদেরই হত্যা করার ‘সেলফ ডিফেন্স’

গৌতম দাস

http://wp.me/p1sCvy-7N

১৯ জুলাই ২০১৪।
জায়নিস্ট ইসরায়েলের হাতে গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যার উৎসব চলছে। আর এ হত্যাযজ্ঞের পক্ষে ছদ্ম-ন্যায্যতার ইসরায়েলি বয়ান হল, ইসরায়েল নাকি নিজের ‘সেলফ ডিফেন্সের’ জন্য এটা করছে, সুতরাং এটা জায়েজ। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমেরিকা, ব্রিটেন ইত্যাদির বয়ান হল, তারা ইসরায়েলের সেলফ ডিফেন্সের অধিকার সমর্থন করে। পশ্চিম র‍্যাশানাল, বুদ্ধির যুক্তি ছাড়া তারা কথা বলে না। তো তাদের সেলফ ডিফেন্সের শঠতা চাপাবাজি যদি মেনে নিই, তো তাহলে ফিলিস্তিনিদেরও সেলফ ডিফেন্সের অধিকার থাকার কথা। শুধু তা-ই না, অন্তত জায়নিস্টদের চেয়ে তা দ্বিগুণ বেশি হওয়ার কথা। কারণ ইসরায়েল এমন এক রাষ্ট্র, যে অন্যের বাড়িঘর খোদ রাষ্ট্রের ওপর দখলদার। এছাড়া এর রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রতিদিন বাড়ে, এমন অদ্ভুত এক রাষ্ট্র। ফলে প্রথমত. ফিলিস্তিনিদের নিজের রাষ্ট্রভূমি রক্ষার জন্য সেলফ ডিফেন্স প্রতিরোধ সব আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ ও স্বীকৃত। দ্বিতীয়ত. নিজের জান ও মাল রক্ষা, আত্মরক্ষার জন্য সেলফ ডিফেন্সে পাথর ছুড়ে মারা, গুলতি মারা, হাতে তৈরি রকেটসহ আরও কিছু সবই বৈধ ও স্বীকৃত। কিন্তু তা পশ্চিমা শঠতা হল এব্যাপারে তারা নিশ্চুপ।

রুজভেল্ট ও চার্চিলের আটলান্টিক চার্টার ১৯৪১
পরপর চারবারের (১৯৩৩-৪৫) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে নাকে খত দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেয়া দলিল হল, আটলান্টিক চার্টার ১৯৪১। না আমি এতটুকুও বাড়িয়ে বলছি না, এটা আসলেই নাকে খত দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেয়া দলিল। এর প্রমাণ হল, ‘হিজ ম্যাজেস্টির’ ব্রিটেন মানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখনো সবচেয়ে বড় রুস্তম কলোনি মাস্টার, আমরাও তখন ব্রিটিশ-ভারত কলোনির অধীন। অথচ ওই আটলান্টিক চার্টারে চার্চিল স্বীকার করে সই করছেন, যা বলে ওর সারকথা হলো কলোনি দখল করা যাবে না, কলোনি দখল অন্যায়। যেমন— ঐ চার্টার ছিল মূলত আমেরিকা ও ব্রিটেনের এক যৌথ ঘোষণা। ওখানে আটটা দফা আছে, যার প্রায় সবই দুনিয়ায় কলোনি দখল ও শাসন আর না চালানো সংক্রান্ত, যদিও কলোনি শব্দ উচ্চারণ না করে তা লেখা হয়েছে। প্রথম দফা বলছে “দুই রাষ্ট্র নিজ ভূখণ্ড বড় করতে কামনা করে না (seek no aggrandizement, territorial or other)”। দ্বিতীয় দফা বলছে, “তারা অন্যের ভূখণ্ড নিয়ে নিজ ভূখণ্ড বড় করার খায়েস রাখে না যদি সে ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের স্বাধীনভাবে প্রকাশিত হওয়ার ইচ্ছা না থাকে”। তৃতীয় দফা বলছে, “কোন ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের নিজ পছন্দের সরকার বেছে নেয়ার অধিকারকে তারা সম্মান করে। তাদের সার্বভৌম নিজ সরকার যা জোর করে অন্যে উত্খাত করেছে, সেটা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে দেখতে চাওয়া— ওই জনগোষ্ঠীর ‘অধিকার’ এবং আমাদের তা সম্মান জানাতে হবে”। অতএব দেখা যাচ্ছে, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রুস্তম কলোনি মাস্টারকে দিয়ে এসব স্বীকার করিয়ে নেয়া নাকে খত দেয়া ছাড়া আর কি! আগ্রহীরা পুরা আটলান্টিক চার্টার ১৯৪১ দেখে নিতে পারেন এখানে। বাঘ ঘাস খায় না। তবে কখনও কখনও বাধ্য হয়ে খায়। কখন ও কেন ঘাস খায় তা কি পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল, রুজভেল্টের স্বপ্নের আগামী দুনিয়াটা কি ছিল, তা নিয়ে অন্য কোথাও আলোচনা করব। আপাতত দু-একটা বাক্য খরচ করব কেবল। ১৯৩৯ সালে অর্থাৎ আটলান্টা চুক্তির দেড়-দুই বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছিল। হিটলারের জার্মানি ফ্রান্স দখল শেষ করে ফেলেছে। আর ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে দাঁড়িয়ে এবার ব্রিটেন দখলের বুদ্ধি আঁটছিল। তাই চার্চিল এসেছিলেন রুজভেল্টের কাছে ভিক্ষা মাঙতে যেন তিনি পক্ষ নেন, পাশে দাঁড়ান। ফলে ব্রিটিশ এম্পায়ারের বিস্তর কলোনি যায় যাক, খোদ নিজ ভূখণ্ডটা যদি রক্ষা করা যায়, চার্চিলের কাছে সেই মামলা ছিল ওটা। আর রুজভেল্টের দিক থেকে দেখলে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর আগামী দুনিয়াটা দেখতে কেমন হবে দেখা সে স্বপ্নের প্রথম দলিল ছিল আটলান্টা চার্টার। কলোনি সম্পর্কের দুনিয়া রুজভেল্টের চোখে হারাম ছিল। তিনি চেয়েছিলেন এক গ্লোবাল ক্যালিটালিজম, ওয়াল ষ্ট্রিটের চোখে দেখা সে স্বপ্নে দুনিয়াটা ছিল পুঁজি বিনিয়োগের বাজার আর বাজার। নিজের সেই স্বপ্নে সায় দেয়ার বিনিময়ের শর্তেই কেবল রুজভেল্টে ইউরোপকে উদ্ধারে রাজি হতে চেয়েছিলেন। তাই ওটা ইউরোপের কলোনি মাস্টারদের দাসখতের দলিল। পরের বছর ১৯৪২ সালের পয়লা জানুয়ারী তারিখে এই “আটলান্টিক চার্টারকেই ভিত্তি” মেনে জাতিসংঘ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। এই জাতিসংঘের কাজ কী হবে, সেসবের বিস্তারিত যা জাতিসংঘ চার্টার নামে খ্যাত সেসব লিখে, গৃহীত হয়ে জাতিসংঘ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ১৯৪৫ সালে। সেলফ ডিফেন্স, রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার কথাগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে জাতিসংঘ। কাজেই ইসরায়েল নিজের সেলফ ডিফেন্সের জন্য গাজায় রক্তের নদী বইয়ে দেয়া জায়েজ বলে দাবি পশ্চিমের র‍্যাশানাল মনের বুদ্ধির যুক্তিতেই নাজায়েজ এবং একশ ভাগ মিথ্যা; ভণ্ডামি হিপক্রাসি।

যেভাবে জায়নিস্ট ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে জবরদখল নিল
ফিলিস্তিনিদের দুঃখের শুরু শুধু না, তাদের ফোরফ্রন্টে রেখে সারা দুনিয়াকে বে-ইনসাফ, অনাচার অত্যাচার হত্যা নিপীড়নের দুনিয়া বানানোর কারবারের শুরু বলা যেতে পারে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে। কলোনি লোভি ব্রিটিশের বাসনা ছিল যে, ভূমধ্যসাগর দিয়ে মিসর ফিলিস্তিন হয়ে আগেই দখল হয়ে থাকা ব্রিটিশ-ভারত পর্যন্ত ভূখণ্ডগতভাবে পুরাটাই নিজের কলোনি বিস্তার ছড়ানো। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফা ব্রিটিশ ও ফরাসি আক্রমণের মুখে সারা দুনিয়ার প্রতি যে আহ্বান (যেখান থেকে খেলাফত আন্দোলনের সূচনা) রেখেছিলেন, তা আংশিক হলেও আজ সত্যি হয়েছে। মিসর, ফিলিস্তিনসহ সারা মধ্যপ্রাচ্য ১৯১৮ সালের আগে ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। সাম্রাজ্য রক্ষার প্রতিযোগিতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল তার প্রধান প্রতিযোগী ও শত্রু। ওদিকে লেট কামার উদীয়মান জার্মান ছিল তাই তার টেকনোলজি ও ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ইউরোপীয় পার্টনার। সেই সূত্রে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (আগস্ট ১৯১৪-নভেম্বর ১৯১৮) পক্ষ-বিপক্ষ ভাগের দিক থেকে তুরস্ক ছিল জার্মানির পক্ষে আর ব্রিটিশ ও ফরাসিদের বিপক্ষে। সে যুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে অটোমান তুরস্কেরও পতন হয়। যুদ্ধ শেষে অটোমান এম্পায়ার এলাকাগুলো ভাগ করে নেয় ব্রিটিশ ও ফরাসিরা। এই হলো মোটাদাগে ইতিহাসের ঘটনা। ব্রিটিশ ও ফরাসি দুই কূটনীতিকের (Sir Mark Szkes এবং Georges Picot) স্বাক্ষরিত ভাগবাটোয়ার গোপন চুক্তি হয়েছিল, যার নাম Szkes-Picot Agreement of 1916 অর্থাৎ চলমান যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৯১৬ সালে এই চুক্তি হয়েছিল। এ চুক্তি অনুসারে একদিকে বাগদাদকে রাজধানী করে উত্তরে মসুল আর দক্ষিণে বসরা এ তিন অঞ্চলকে নিয়ে নতুন রাষ্ট্র ইরাকের জন্ম দেয় ব্রিটিশরা, সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের তীরের মিসর ও ফিলিস্তিনকে নিজের ভাগে নেয়। অন্যদিকে এ দুয়ের মাঝখানে লেভান্ট অংশ দেয়া হয় ফরাসিদের। Levant ইতালি-ফরাসি উৎসের এ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ইংরেজিতে রাইজিং অর্থাৎ উদিত হওয়া, মানে যেখানে সূর্য সবার আগে ওঠে, সেই অঞ্চল, এই অর্থে। একসময় ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরের গ্রিস থেকে মিসর পর্যন্ত সব দেশকেই এক শব্দে লেভান্ট অঞ্চল বলা হত। ভুমধ্যসাগরের পুর্ব তীরের দেশগুলোতে আগে সুর্য উঠে বলে এই নামের উতপত্তি। কালক্রমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তার শাসিত সিরিয়া, লেবানন এবং আজকের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয়ের কিছু অংশ, যা ফরাসিদের দিয়ে দেয়া হয়, ফরাসিরা একত্র এই ভূখণ্ডকে লেভেন্ট অঞ্চল নামে ডাকত। [নেপথ্যে বলে রাখি চলমান ইরাকে খলিফা রাষ্ট্র ঘোষণার সময়ে ISIL শব্দের অর্থ ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভেন্ট। অর্থাৎ যারা ব্রিটিশ-ফরাসিদের ইরাক ও লেভেন্ট বলে কলোনি ভাগবাটোয়ারা মানেনা। এই হল লেভান্ট নামের তাতপর্য।] তবে অটোমান সাম্রাজ্য অঞ্চলকে ব্রিটিশ-ফরাসিরা ভাগ করে নিলেও এর আইনি কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতায় একটা রাখঢাক ছিল। বলা হয়, ‘লীগ অব নেশান’-এর কাছ থেকে ব্রিটিশ-ফরাসিরা এ অঞ্চলগুলোয় ‘ম্যান্ডেট’ হিসেবে শাসন অধিকার পেয়েছিল। [লীগ অব নেশন হলো জাতিসংঘের আগের রূপ ও ভার্সন। গঠিত হয় ১৯২০ সালে, কিন্তু শুরুর দশ বছরের মধ্যে কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে, ওর সদস্যদের একে অন্যকে কলোনি দখল করে নেয়ার বিরুদ্ধে বাকি সকলে ন্যূনপক্ষে নিন্দা করতে না পারার কারণে। এরপর তা অকার্যকর পড়েছিল ১৯৪১ সালে আটলান্টা চুক্তি স্বাক্ষরের আগ পর্যন্ত। এরপর লিগ অব নেশনের পুনর্জীবন ঘটে নতুন নামে নতুন চুক্তিতে। ১৯৪২ সালের এক ঘোষণায় এর নাম হয় জাতিসংঘ।] অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের তিনশ বছরে ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কলোনি দখল করে কেটেছে অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর এবার যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায়ের উছিলার যুক্তিতে জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করে আর অটোমান সাম্রাজ্যকে ভাগ করে নেয়। ওই ক্ষতিপূরণ আদায় এবং অটোমান সাম্রাজ্যের নতুন ভাগবন্দোবস্ত দেয়ার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯২০ সালে লিগ অব নেশন গঠিত হয়েছিল। ম্যান্ডেট কথার কাগজপত্রের কনসেপ্টটা হলো, অটোমান সাম্রাজ্যের রাজ্যগুলো লীগ অব নেশানের ‘ট্রাস্টি পরিষদ’ নামের এক বিভাগের হাতে হাওলা করা হলো। এরপর ট্রাস্টি পরিষদ ওর নতুন বিলি বন্দোবস্ত দিল ব্রিটিশ ও ফরাসিদের। এ নতুন বিলিবন্দোবস্তের আইনি নাম ‘ম্যান্ডেট’। লীগ অব নেশন গঠনের আর্টিকেল ২২, এটা ম্যান্ডেট সংক্রান্ত আর্টিকেল।

ম্যান্ডেটঃ লীগ অব নেশন গঠনের আর্টিকেল ২২
আর্টিকেল ২২ বলছে, ‘গত যুদ্ধের ফলে যেসব কলোনি ও ভূখণ্ড, যেগুলো আগের রাষ্ট্রের সর্বভৌমত্বের শাসন অধীনে আর নেই, যেগুলোয় বসবাসকারী বাসিন্দারা শক্তি দেখানোর আধুনিক বিশ্বে (strenuous conditions of the modern world) নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চলার উপযুক্ত হয়নি, এগুলোয় এ মূলনীতি প্রয়োগ করা হবে যে, এসব জনগণের ভালোমন্দ ও বিকাশ দেখাশোনার জন্য এক সভ্যতার বিশ্বস্ততা ট্রাস্ট (sacred trust of civilisation) গঠন করা হবে এবং তাদের নিরাপত্তা বিষয়টা এ ট্রাস্টের ওপর ন্যস্ত হবে আর ট্রাস্ট পরিষদ গঠন বিষয়টা লীগ অব নেশন উদ্যোগ চুক্তির অংশ গণ্য হবে”।
“এই মূলনীতিকে বাস্তবায়নের সবচেয়ে ভালো উপায় হবে, এসব জনগণকে কোনো অগ্রসর জাতির অভিভাবকত্বে (tutelage) হাওলা করে দেয়া, যারা তাদের সম্পদ, অভিজ্ঞতা অথবা তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ দায়িত্ব পালনে সমর্থ হবে, যারা নিজ ইচ্ছায় এই দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক এবং লিগ অব নেশনের তরফ থেকে এ অভিভাবকত্ব ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হিসেবে দেয়া হবে ও তারা চর্চা করবে”।
“ম্যান্ডেট দায়িত্বপ্রাপ্তরা ট্রাস্টি কাউন্সিলের কাছে অর্পিত দায়িত্ব বিষয়ে এক বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করবে। ম্যান্ডেট দায়িত্বপ্রাপ্তদের কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রশাসন ক্ষমতা কীভাবে চর্চা করবে, তা এককভাবে ট্রাস্টি কাউন্সিল নির্ধারণ করে দেবে, যদি না এ বিষয়ে লিগের সদস্যদের দ্বারা আগে থেকেই একমতের কোনো সিদ্ধান্ত থাকে।
একটা স্থায়ী কমিশন গঠন করা হবে, যারা ম্যান্ডেট দায়িত্বপ্রাপ্তদের দেয়া বার্ষিক রিপোর্ট গ্রহণ ও নিরীক্ষা করবে এবং তাদের পর্যবেক্ষণের সব বিষয়ে ট্রাস্টি কাউন্সিলের কাছে পরামর্শ রাখবে”।
আগ্রহিরা মূল কপির বিস্তারিত এখানে পাবেন, এখানে সবচেয়ে বড় তামাশাটা হলো, পশ্চিমা ‘সভ্যতা’ কলোনি দখলটাকে নিজ সভ্যতার গৌরব বলে চালিয়ে দেয়া হলো। আবার নিজেই স্বীকার করছে, যে দুনিয়াটাকে তারা “শক্তি দেখানোর আধুনিক বিশ্ব” বানিয়েছে। মানে কলোনি মাস্টারের মাসল দেখানোর ঠেলায় অন্যের নিজ ভূখণ্ড, রাষ্ট্র ও জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার কাজটা তারাই অসম্ভব করে রেখেছে। এছাড়া স্টাডির বিষয় হলো, কথার চাতুরিতে কীভাবে ম্যান্ডেটের নামে আবার কলোনি দখলকে ন্যায্যতা দেয়া হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় নভেম্বর ১৯১৮। কিন্তু এর অন্তত এক বছর আগে অর্থাৎ অটোমান সাম্রাজ্য তখনো বহাল, এ অবস্থায় ইসরায়েলি রাষ্ট্র গঠনের ভ্রূণ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। দলিলের নাম বেলফোর ঘোষণা (Balfour Declaration 1917), বেলফোর (Arthur James Balfour) ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের তত্কালীন পররাষ্ট্র সচিব। তিনি একটা চিঠি লিখেছিলেন Walter Rothschildকে। ওয়াল্টার হচ্ছেন জার্মান ইহুদি বাবা লর্ড নাথন রথসচাইল্ডের (জার্মান উচ্চারণে রথশিল্ড) সন্তান, পুঁজি ব্যবসায়ী, সরকারি বন্ডের প্রধান ব্যবসায়ী। ইউরোপের চার দেশের চার শহরে চার ছেলে বসে সে সময় পারিবারিকভাবে তারা প্রতিদিনের আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময় হার ঠিক করতেন। আজকের হিসাবে ওই পরিবারটাকে সেসময়ের আইএমএফ বলা অত্যুক্তি হবে না। বেলফোরের চিঠিটা ঠিক কোনো সরকারি ঘোষণা নয়। তবে তিনি ইহুদিদের জায়নিস্ট রাষ্ট্রের স্বপ্নের পক্ষে তার সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ও সহানুভূতির কথা জানাতে এ চিঠি লেখেন। পরে এ চিঠিকেই বেলফোর ঘোষণার দলিল হিসেবে আবির্ভূত ও দাবি করা হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো এক. ফিলিস্তিনিদের ভূমির ওপরই একক জায়নিস্ট রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্রিটিশ সরকার কে? কারণ ওই ভূখণ্ডের ওপর তখনও বৃটিশের কোনো কর্তৃত্ব নেই, এখতিয়ার নেই। তখনো তা অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। দুই. ঐ চিঠিতেই বেলফোর আবার বলছেন, “এতে ওই ভূমিতে বসবাস করছে, এমন অ-ইহুদিদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকারের বিরুদ্ধে যায়— এমন কিছু করা হবে না। অথবা অন্য দেশে বসবাসরত ইহুদিদের অধিকার ও রাজনৈতিক স্ট্যাটাস সেখানে যা ভোগ করছে, তা এখানেও অটুট রাখা হবে”। অর্থাৎ মুখে বলছেন, অ-ইহুদিদের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করবেন, কিন্তু বাস্তবে তা অসম্ভব কারণ তিনি এক জায়নিস্ট রাষ্ট্রের স্বপ্ন অনুমোদন করছেন। এছাড়া অন্যের ভূখণ্ডের ওপর কীভাবে এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন, তাদের নির্মূল বা উত্খাত না করে। সুতরাং তারা আগেই জানতেন এটা কথার কথা। অর্থাৎ আজ তো এটা পরিষ্কার যে, বেলফোরের সরকারের নিজ প্রতিশ্রুতিও নিজে রক্ষা করেনি। দ্বিতীয়ত. অন্য দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের তিনি মাইগ্রেট করে আনার পরিকল্পনা করছেন এটাও পরিষ্কার। শুধু তাই না, সেসব দেশে ইহুদিরা যেমন রুস্তম হয়ে ছিলেন, জায়নিষ্ট রাষ্ট্রে এখানেও তাদের তেমন রুস্তমি নিশ্চিত করবেন। বাস্তবে আজ সেটাই হয়েছে। কিন্তু এর আইনগত দিকটা আরো মারাত্মক। অন্যকে তাঁর নিজ বাড়িঘর জমিজমা এমনকি দেশ থেকে উত্খাত করে সেখানে কারো স্বপ্নের রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করতে চাওয়া— আইনগতভাবে একথা চিঠিতে বলা এটাই মারাত্মক প্রমাণিত অপরাধ।
জায়নিস্ট ইসরায়েল রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা করা হয় ১৯৪৮ সালে। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের ঘোষণার সময় ওর ভূখণ্ড কোনটা কতটুকু তা ওই ঘোষণার অঙ্গ। কিন্তু যতবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে, (১৯৬৭ বা ১৯৭৩) প্রত্যেকবার নতুন নতুন ভূমি দখল করে তাকেও নতুন সীমানা বলে দাবি করা হয়েছে। এসবই হয়েছে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সব আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। আর পশ্চিমের পরাশক্তিগত দাপটই সেখানে একমাত্র রুস্তম কর্তা, নির্ধারক। আসলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রগুলোর ওপর চাপ ধরে রাখতেই এমন নুইসেন্স টিকিয়ে রাখা হয়েছে। পশ্চিমের পরাশক্তিগত রুস্তমি হল জায়নিষ্ট ইসরায়েলি রাষ্ট্র টিকে থাকার উৎস। অতএব একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গ্লোবাল পুঁজিতন্ত্রের ওপর বর্তমান পরাশক্তিগত রুস্তমির সমাপ্তি এবং ভারসাম্য উলট-পালট ও দুর্বল হয়ে গেলেই জায়নিষ্ট ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে। দুনিয়ায় যে কোনো জায়নিস্ট রাষ্ট্রের বিলুপ্তি অনিবার্য। প্যালেষ্টাইনী প্রতিরোধ, হামাসের প্রতিরোধ লড়াইয়ের বিজয় অনিবার্য।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। লেখাটা গত ১৯ জুলাই ২০১৪ দৈনিক বণিকবার্তা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে আরও কিছু এডিট করে আবার ছাপা হল। এছাড়া চিন্তা ওয়েবেও একটা ভার্সান ছাপা হয়েছে।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s