ইরাকঃ আধুনিক রাষ্ট্র লজিকের আর বিপ্লবের আন্তর্জাতিকতার সমস্যা
গৌতম দাস
http://wp.me/p1sCvy-7Y
০১ আগস্ট ২০১৪।
চলমান ইরাকের সঙ্কট গত কয়েকমাসে মিডিয়ায় নতুন মাত্রায় শিরোনাম হতে শুরু করেছে প্রথমে ISIL এর আন্দোলন নামে পরে ইরাককে খলিফা রাষ্ট্রের ঘোষণায়। এতে সমস্ত মনোযোগ গিয়ে জড় হয়েছে এই শব্দ দুটোতে – ISIL আর খলিফা রাষ্ট্র। এটা ইরাক রাষ্ট্রের সঙ্কটের এক নতুন মাত্রা। যদিও ইরাক রাষ্ট্রের সঙ্কটকে এখানে ব্যাখ্যা করব মূলত ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর থেকে; ইরান বিপ্লবের সাথে ইরাকের ভাগ্য ঘোরতরভাবে সম্পর্কিত। এটা সঙ্কটের অবশ্যই দ্বিতীয় পর্যায়। আর প্রথম পর্যায়ের আর এক সঙ্কটও ছিল যেটাকে ১৯১৯ সালে বৃটিশ-ফরাসী কলোনি মাষ্টারের দেয়া জন্ম সঙ্কট বলা চলে, সেটা কলোনি ভাগবাটোয়ারার স্বার্থে ইরাকের বর্তমান রাষ্ট্র সীমানা যখন টেনে ইরাক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়েছিল। তবে প্রসঙ্গ এখানে দ্বিতীয় পর্যায়ের সঙ্কটের দিকেই, ওর গোড়ার কিছু মৌলিক ইস্যুর দিকে পাঠকের নজর ফিরাব।
দেশে দেশে বিপ্লবের কথা আমরা অনেক শুনেছি। শুনে আমরা অনেকে আপ্লুতও হই। বিপ্লবী ক্ষমতা্র উত্থান – বলতে প্রচলিতভাবে অনেকে যেমন অনেকে ধরে নেন একটা কমিউনিষ্ট বিপ্লব ঠিক তা নয়। এখানে বিপ্লব বলতে শুধু কমিউনিষ্ট বিপ্লবে তা সীমাবদ্ধ এমন ধরে না নিয়ে বরং ইরানের মত ইসলামি বিপ্লব অথবা যেকোন র্যা ডিক্যাল বিপ্লবী ক্ষমতাকেও ধরে নিয়ে কথা বলব। আবার, মোটা দাগে যেকোন “বিপ্লবী ক্ষমতা” বিষয়টাকে তিনটা পর্বে ভাগ করতে পারি -১) বিপ্লবী ক্ষমতা তৈরি, ২) তা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল আর ৩) পরের এক বড় ধাপ হল সে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা। কিন্তু প্রথম দুইটা পর্যায় সম্পর্কে আমরা যতটা অনুসরণ করি ও খবর রাখি “ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার দিকটা” আমাদের কাছে ততটাই অনালোকিত হয়ে দৃষ্টির বাইরে থেকে গেছে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার এই কাজটা নিয়ে এপর্যন্ত কোন রাজনৈতিক তত্ত্ব নাই। তবে কিভাবে বাস্তব ইতিহাসে তা ঘটেছে সেদিকে এখানে আলো ফেলব।
বিপ্লব কমিউনিষ্ট অথবা ইসলামি হোক, তা এক গ্লোবাল বিপ্লবের ধারণা
“বিপ্লবী ক্ষমতা” বিষয়টা্র প্রথম দুই পর্ব – বিপ্লবী ক্ষমতা তৈরি ও ক্ষমতা দখল উদ্যোগেরও আগের কাজ, বিপ্লবী তত্ত্ব বা আইডিয়া হাজির করার একটা পর্যায় থাকে। ইডিওলজি (ideology) হিসাবে আইডিয়া (idea) – এদিক থেকে দেখলে যেহেতু এটা আইডিয়া অর্থাৎ চিন্তা বা ভাব ফলে এমনিতেই তা নিজ ভুখন্ড ছাড়িয়ে দুনিয়ায় যেকোন কোণে তা ছড়ানোর যোগ্য। চিন্তা ও চিন্তার প্রভাব রাষ্ট্রীয় সীমানা দিয়ে আটকে রাখা যায় না; বিশেষত ইডিওলজি যদি নিজেই গ্লোবাল হয় অর্থাৎ গ্লোবালভাবে ঘটবার, ঘটাবার দাবি কর্তব্য সাথে নিয়ে হাঁটে সেক্ষেত্রে ‘আইডিয়া মানেই তা রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে দুনিয়াব্যাপী প্রয়োগ-প্রযোজ্য’ – এই কথাটা আরও পোক্ত হয়ে উঠে। এই বিচারে কমিউনিষ্ট বিপ্লব অথবা ইসলামি বিপ্লবের ধারণা –এগুলো গ্লোবাল বিপ্লবী তত্ত্ব; গ্লোবাল ইডিওলজি; এর প্রয়োগ-প্রযোজ্য এলাকা দুনিয়াব্যাপী – ‘প্যান’ বা নিখিল জুড়ে।
কিন্তু একটা বিপরীত বাস্তবতা হল, আইডিয়া গ্লোবাল হলেও যে মানুষ বা যারা এই আইডিয়া বাস্তবায়নের জন্য লড়বে তাদেরকে নির্দিষ্ট ভুখন্ড দাঁড়িয়েই লড়তে হয়, এর অন্যথা হবার যো নাই। যেমন কমিউনিষ্ট বিপ্লবের তত্ত্বটা গ্লোবাল, কিন্তু সুনির্দিষ্ট ভুখন্ড রাশিয়াতেই সেটাকে প্রয়োগে বাস্তব সত্য করে তুলতে গিয়েছিলেন লেনিন ও তার সাথীরা। অথচ আগেই বলেছি, যা নিয়ে বিপ্লবীরা লড়বে সেই চিন্তা, ভাব বা আইডিয়া মাত্রই ওর প্রয়োগ প্রযোজ্যতা প্রভাব তখনও গ্লোবালই থেকে গিয়েছিল। আবার, ওদিকে তত্ত্ব গ্লোবাল বলে স্বাভাবিকভাবে এর এনিমি বা শত্রুও তো গ্লোবালই হবে। কেন শত্রুও গ্লোবাল হবে সে কথাটা আবার অন্য আর দিক থেকে আরও বেশি সত্য। যেমন, যতদিন যাচ্ছে জাতীয়, স্থানিক বা লোকাল ক্যাপিটালিজম বলে আর কিছুই থাকছে না, থাকবে না; স্থানীয় অর্থনীতিগুলো ততই পরস্পর আরও ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত ও গভীর থেকে গভীরতরভাবে পরস্পর নির্ভরশীল এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম হয়ে উঠছে, আরও উঠবে। লোকাল ক্যাপিটালিজমের শুরু থেকেই এই অভিমুখ চোখা হয়ে হাজির ছিল। ফলে এর বিপরীতে ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে নানান ভুখন্ডে প্রতিরোধ যেকোন লোকাল রাষ্ট্রীয় সীমার আন্দোলন লড়াই সংগ্রাম হলেও ওর গ্লোবাল দিক ছিল ও আছে এবং সেটা আর পিছনের শত বছর মত সুপ্ত না থেকে স্পষ্ট মুর্ত হয়ে হাজির হচ্ছে, হবেই। ফলে স্থানীয় ইতিহাস মানেই তা এখন স্পষ্ট গ্লোবাল ইতিহাসের উপাদান হয়ে হাজির হচ্ছে। অন্যভাবে বললে যে কোন স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন মাত্রই তাতে গ্লোবাল আকার ধারণ করার উপাদান থাকবে।
তাহলে সারকথাটা দাড়ালো, আইডিয়া গ্লোবাল তবু স্থানীয় ও সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রে দাঁড়িয়েই সুনির্দিষ্ট ভুখন্ডে প্রকাশিত প্রতিভাত সুনির্দিষ্ট ও আপাত লোকাল কিছু ইস্যুকে কেন্দ্র করেই লড়াই সংগ্রাম শুরু ও সংগঠিত হচ্ছে, হবেই। আর লোকাল এসব আন্দোলনের গ্লোবাল দিক অভিমুখ থাকলেও বাইরে থেকে দেখে তাকে আবার আপাত লোকাল আন্দোলন ও সংগ্রাম মনে হবে। কিন্তু এবার গুরুত্ত্বপুর্ণ প্রশ্ন – কে এই লড়াইয়ে বাধা হবে? বাধা দেবার শক্তি হবে মূলত লোকাল রাষ্ট্রই। অবশ্যই এমনও হবে, ফোরফ্রন্ট্রে লোকাল রাষ্ট্র থাকবে যদিও গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের সুত্রে সহজেই সম্পর্কিত থাকা গ্লোবাল পরাশক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধাদানের জন্য স্থানীয় রাষ্ট্রের পক্ষে ভুমিকাও নিবে। অর্থাত মোটের উপর সাক্ষাত বা ইমিডিয়েট শত্রু লোকাল রাষ্ট্র।
এখন আইডিয়াল বা আদর্শ হত, সারা দুনিয়ায় গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে নানান ভুখন্ডে এবং নানান চেহারার প্রতিরোধ আন্দোলন লড়াইগুলোকে এক কো-অরডিনেশন ধরণের কেন্দ্রের মাধ্যমে যদি পরিচালিত হতে দেখা যেত। কো-অরডিনেশন বা সমন্বয়ের অনুভুত তাগিদ হাজির থাকাটা সবচেয়ে স্বাভাবিক কারণ দেশে দেশে সব প্রতিরোধ লড়াইগুলোর শত্রু কমন – গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম। যাহোক আগেই বলে নিয়েছি এটা আইডিয়াল। তাহলে বাস্তবটা কেমন? এব্যাপারে বাস্তব ইতিহাসে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো খুবই খারাপ। শব্দটা “কো-অরডিনেশন ধরণের এক কেন্দ্র” বলেছি, কারণ এশব্দের পিছনের অনুমানটা হল দুনিয়াব্যাপী প্রতিরোধের আন্দোলনগুলো যতটা সম্ভব পরস্পর একে অপরের সহযোগী হয়ে কাজ করতে পারা উচিত – আর তাতে সবাই উপকার পাবে। কিন্তু বাস্তব ইতিহাসে আমরা দেখেছি এটা একটা কো-অরডিনেশন কেন্দ্রের বদলে হাজির হয়েছে যে আগে বিপ্লবী ক্ষমতা দখল করেছে সেই রাষ্ট্রের একান্ত স্বার্থে ও নেতৃত্ত্বে এক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। যেমন লেনিনের রাশিয়া বা মাওয়ের চীন। যার কাজ আর কো-অরডিনেশন থাকেনি, বাস্তবে হয়ে দাড়িয়েছে নিজ রাষ্ট্রের একান্ত স্বার্থে অন্যদের সকলকে ব্যবহার – অন্য দেশ, রাষ্ট্র, দল গোষ্ঠিকে ব্যবহার। এতে বাস্তবে আসলে কি ঘটে সেখানে? বিপ্লবী ক্ষমতা দখলের পরের রাষ্ট্র একটা মহান কিছু হয়েছে মনে হতে পারে কিন্তু শেষ বিচারে তো সেটা রাষ্ট্রই – আধুনিক রাষ্ট্রেরই কোন একরূপ সেটা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের লজিকও বলবত হবে সেখানে। আর সে লজিকটা হল, রাষ্ট্রের সহজাত বৈশিষ্টমূলক স্বভাব হল সে নিজ রাষ্ট্র সীমার মধ্যকার কেবল নিজ জনগোষ্ঠির স্বার্থকে সবকিছুর উপর প্রাধান্যে রাখে। সেজন্যই সে রাষ্ট্র। ফলে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইডিয়া বাস্তবায়নের বাস্তব উপায় হতে গিয়ে পরিণত হয় নিজ সংকীর্ণ স্বার্থে ঐ আইডিয়াকে টেলারিং ও খাটো করে নিজ একান্ত স্বার্থের অধীন করে ফেলে। ব্যাপারটা এবার আরও সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে বলি।
যেমন কমিউনিষ্টদের বিপ্লবের উদাহরণ হিসাবে সোভিয়েত বিপ্লবকেই যদি ধরি তবে দেখব বিপ্লব ঘটেছিল আসলে কেবল রুশ দেশে, রাশিয়ায়। তাই আসলে ওটা ছিল কেবল রুশ বিপ্লব, অন্তত প্রথম পাঁচ বছর, ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম হবার আগে পর্যন্ত। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আসল বিপ্লবটা যেটানে ঘটেছে বিজয়ী নতুন সেই রুশ রাষ্ট্র যেন বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকে, টিকে থাকতে ব্যর্থ না হয় সেজন্য কেন্দ্রে কোর হিসাবে রুশ রাষ্ট্রকে রেখে পড়শি দেশগুলোকে যেন ওকে ঘিরে ধরা এক প্রতিরক্ষা বর্মের বলয় হয় সে কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, গঠিত সেই বর্মের নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। রুশ বিপ্লবে পড়শি-রাষ্ট্রগুলোকে বলি দেবার এই কাজটা আরও সহজ হয়েছে কারণ ১৯২২ সালে যেটাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলা হল অর্থাৎ যাদের ব্যবহার করা হল এরা আগে থেকেই রুশ সম্রাট জারের রুশ সাম্রাজ্যের অধীনস্ত ছিল। ফলে রুশ সাম্রাজ্যের সীমানাটাই নতুন নামে সোভিয়েত রাষ্ট্রের সীমানা হল। আর এবার কেন্দ্রে থাকল রুশ রাষ্ট্রের একান্ত স্বার্থ – নিজের প্রতিরক্ষা অথবা অন্যভাষায় বললে নিজ বিপ্লব টিকানো। আজকের পুতিনের রুশ ফেডারেশনকে কেন্দ্রে রেখে এমন [রুশসহ মোট] ১৫ রাষ্ট্র (Russia,Ukraine, Belarus, Turkmenistan, Uzbekistan, Tajikistan, Kazakhstan, Kyrgyzstan, Georgia, Armenia, Azerbaijan, Estonia, Latvia, Lithuania, Moldavia) মিলিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছিল সেসময়। [এরই বিপরীত পথ পরিক্রমাটাই আমরা দেখেছিলাম ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে আবার ১৫ রাষ্ট্রে তার ভাগ হয়ে যাওয়ায় ভিতর।]
কিন্তু ষ্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন খাঁড়া করেও যেন তাতে নিশ্চিত বা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ঐ সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরেও আবার বাফার ষ্টেট এর এক বর্ম গড়ে তোলা হয়েছিল – রুমানিয়া, চেকোশ্লোভিয়া, যুগোশ্লোভিয়া, পোল্যান্ড এমনকি পরে পুর্ব জার্মান এদের নিয়ে। অর্থাৎ ব্যাপারটা দাড়িয়েছিল, রুশ রাষ্ট্রের প্রথম নিরাপত্তা বর্ম সোভিয়েত ইউনিয়ন আর এরও উপরে দ্বিতীয় নিরাপত্তা বর্ম হিসাবে এই রাষ্ট্রগুলো ছিল বাফার ষ্টেট বা স্যাটেলাইট ষ্টেট। উদ্দেশ্য একটাই, বিপ্লবের কেন্দ্র রুশ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সুরক্ষা। আর এটা করতে গিয়ে পড়শিরা “দুনিয়ার মজদুর এক হও” নামে শ্লোগানের আড়ালে প্রত্যেকে নিজে বলি হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া “বিপ্লব রপ্তানি” বলে আরও একটা কথা আছে। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে স্ব স্ব দেশের পার্টিগুলো “দুনিয়ার মজদুর এক হও” নামে ঐ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সুরক্ষার পক্ষেই স্থানীয় পার্টি নীতি অনুসরণ করেছিল। তাতে বাস্তবে এর অর্থ দাড়িয়েছিল নিজ জনগোষ্ঠিগত রাষ্ট্রস্বার্থ ভুলে সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিদেশ নীতির অন্ধ অনুসরণ করা বললে কম হবে, বলতে হবে সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিদেশনীতি বাস্তবায়নের বর্ধিত অংশ হওয়া। আর সামগ্রিকভাবে এই ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে গ্লোবাল কমিউনিষ্ট আন্দোলন। [যদিও পরিস্কার থাকার দরকার আছে,একথাগুলো বলতে গিয়ে কেউ যেন মনে না করেন যে, “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগানটা ভুল ছিল এমন দাবি করা হচ্ছে। না তা নয়। বরং বলা যায়, শ্লোগান বাস্তবায়নের উপায় কৌশলে অপব্যবহার ঘটেছে আর তাতে শ্লোগানের অর্থ বদলে গেছে।] ফলে এখান থেকেই শ্লেষাত্মক মন্তব্য “মস্কোতে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে ছাতা ধরা” এর বাস্তবতা টের পাওয়া যায়। অর্থাৎ মস্কো একান্ত নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থে নিজের রাষ্ট্র ক্ষমতা সুরক্ষা বা বাইরের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য পড়শি রাষ্ট্র বা ভিন্ন রাষ্ট্রকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিল। আর একাজে আরও বিশেষ সহায়ক হয়েছিল বিপ্লবের ইডিওলজি আন্তর্জাতিক বা প্যান ধরণের ছিল তাই। অন্যের রাষ্ট্রস্বার্থকে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থে বলি দেবার কাজটা আরও সুবিধার ও সহজ হয়েছিল তাতে।
লেনিনের দেশে ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পরে একটা আভ্যন্তরীণ তর্ক উঠেছিল এক দেশে একটা বিপ্লবী ক্ষমতা দখলের পরে তাকে একাই টিকিয়ে রাখা সম্ভব কি না। সম্ভব হলে তা কি উপায়ে? এটা খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ রাষ্ট্রতত্ত্বের বিতর্ক ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বিতর্কের কোন সমাধান হয় নাই। তত্ত্বগতভাবে এর কোন সমাধান বের করা হয় নাই। লেনিনের জীবদ্দশায় নয় [রুশ বিপ্লবের পরে লেনিন মাত্র ছয় বছর বেঁচে ছিলেন।] তাঁর মৃত্যুর পরেও আর কখনও নয়। বিপ্লব টিকিয়ে রাখার উপায় হিসাবে সংকীর্ণ কেবল নিজ রুশ রাষ্ট্রস্বার্থে বাস্তবে যা করা হয়েছিল, মনে করা আর বাস্তবে ঘটানো হয়েছিল তা ষ্টালিনের হাতে ও নেতৃত্ত্বে। আর সেটা হল, অন্য সব বিপ্লব সমর্থক রাষ্ট্র আর দেশে দেশে কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোকে রুশ রাষ্ট্র বিপ্লবের স্বার্থে নিজের রাষ্ট্র টিকানোর স্বার্থে ব্যবহার করা। এবং এটাকেই গ্লোবাল কমিউনিষ্ট আন্দোলনের নামে “দুনিয়ার মজদুর এক হও” কথার বাস্তবায়নের পথ বলে তাকে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
আধুনিক রাষ্ট্র ধারণার সহজাত মৌলিক বৈশিষ্ঠের লজিকটা হল, রাষ্ট্র কেবল নিজের, মানে নিজ জনগোষ্ঠির কমন স্বার্থ হাসিলের পক্ষে কাজ করে যাওয়াই ওর একমাত্র কাজ। এখানে নিজ রাষ্ট্র সীমানার বাইরের কোন জনগোষ্ঠি বা স্বার্থ দেখার কাজ নিজ রাষ্ট্রের নয়। বরং সুযোগ পেলে রাষ্ট্র অন্যকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। ফলে রাষ্ট্রের একান্ত স্বার্থ মানে যে স্বার্থের জন্য সে অন্ধ। আবার অন্যদিকে, কোন রাষ্ট্র নিজ একান্ত স্বার্থের পক্ষে যদি কাজ না করে তবে খোদ নিজ অস্বস্তিত্ত্বই সঙ্কটে পড়ে।
অন্যদিকে গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক ইডিওলজি রাষ্ট্র সীমানা ছাড়িয়ে প্রযোজ্য এবং প্রয়োগ হতে চায়। সে দাবি করে একই সাথে সে সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্র এবং অন্য সব রাষ্ট্রের বেলায়ও একই চিন্তার ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে। এটা স্ববিরোধী। কারণ রাষ্ট্রস্বার্থ কখনও কখনও সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থের ভিতরে নিজেরও স্বার্থ ফলে কমন স্বার্থ দেখতে পারে বটে কিন্তু এর মানে এই না যে রাষ্ট্র দুটোর স্বার্থ সবসময় সব ইস্যুতে এক হবেই; কারণ পরক্ষণেই ভিন্ন ইস্যুতে তাদের পরস্পর বিরোধি দেখতে পাওয়া তা হবে সবচেয়ে স্বাভাবিক। এর মুল কারণ গ্লোবাল ইডিওলজি আর রাষ্ট্রস্বার্থ সবসময় হাত ধরাধরি করে চলে না, চলতে পারে না। আর এক বড় কারণ, রাষ্ট্রস্বার্থগুলো হাজির হয় আভ্যন্তরীণ জনগোষ্ঠিগত কমন স্বার্থ – এর উপর ভিত্তি করে। ফলে রাষ্ট্রস্বার্থগুলোর সমন্বয় – আবার এটা ঠিক দুটো স্বার্থের সমন্বয় নয় বরং বিশেষ করে গ্লোবাল আইডিয়ার মৌলিক শিক্ষা বা গাইড লাইনের আলোকে রাষ্ট্রস্বার্থগুলোকে ঢেলে সাজানো ও সমন্বয়।
তাহলে কোন গ্লোবাল ইডিওলজির (কমিউনিজম বা ইসলামের মত যাই হোক) কি কোন ভবিষ্যত নাই? প্রয়োগ যোগ্যতা নাই? না, এখানে আলোচনায় তা বলতে চাওয়া হয়নি। এই রচনায়, প্রয়োগ যোগ্যতা নাই তা বলা হয়নি বরং এটা কিছু মৌলিক প্রায়োগিক সমস্যার দিকে নজর আকর্ষণের চেষ্টা বলা যেতে পারে। আর কে অস্বীকার করতে পারে গ্লোবাল ইডিওলজি ছাড়া মজলুমের মুক্তি অসম্ভব। এছাড়া গ্লোবাল ইডিওলজি নাই তো গাইডিং প্রিন্সিপল নাই একথা কে না মানবে। অর্থাৎ গ্লোবাল ইডিওলজি এক গভীর প্রয়োজনীয় ও মৌলিক জিনিষ। যেকোন আইডিয়া বা চিন্তার দুনিয়াব্যাপী সার্বজনীন অংশটাই দুনিয়ার ভবিষ্যত। তাহলে আধুনিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রস্বার্থ আর ইডিওলজি যদি কখনও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় তখন এই সংঘাতের সমাধান কি? বাস্তবতা তো বাস্তবতাই। এমন বাস্তবতা ঘটবেই। ফলে কখনও যদি আমাদের মুখোমুখি হতেই হয় তাহলে অন্তত নিজ একান্ত রাষ্ট্রস্বার্থটাকে গ্লোবাল ইডিওলজির স্বার্থ বলে চালিয়ে দেয়া অন্তত আমরা সৎভাবে পরিত্যাগ করতে পারি। দ্বিতীয়ত, কো-অরডিনেশন। অর্থাৎ আইডিয়ার মৌলিক দিকগুলো পরস্পর শেয়ার করা। তবে ঐ আইডিয়া প্রত্যেক ভুখন্ডে আলাদা আলাদা প্রয়োগ কৌশলের পরিচালিত হওয়ার ব্যাপারটা ছেড়ে দেয়া এবং যতদুত সম্ভব পরস্পরের সহযোগী হবার চেষ্টা করা। এভাবে বাস্তব কাজের ভিত্তির দিয়ে ঐক্য পৌছানোর চেষ্টা করা। কিন্তু কোন রাষ্ট্রের একান্ত সংকীর্ণ স্বার্থ আড়াল করার উপায় হিসাবে ইডিওলজির ভুমিকাকে ব্যবহার করা যাবে না, এই রচনায় এদিকটাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। আরও কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।
যেমন ১৯৭৯ সালে ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে বসে। অজুহাত হল আফগান কমিউনিষ্ট বারবাক কারমেল নাকি বিপ্লব করেছে, তাই সোভিয়েত আর্মি আফগানিস্তান মার্চ করছে। অথচ আসল ট্রিগার ঘটনা হল সে বছরের শুরুর ইরান বিপ্লব। অপ্রতিনিধিত্ত্বশীল হয়ে থাকা মুসলমান পপুলেশনে অধ্যুসিত সেন্ট্রাল বা মধ্য এশিয়ায় [যা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ] না ইরান বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবে বিদ্রোহ বিপ্লব দেখা দেয়। তা ঠেকাতে আগাম একশনে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, [ইরান ও সেন্ট্রাল এশিয়ার মাঝে] আফগানিস্তান দখল করে উদ্দেশ্য একে বাফার ষ্টেট হিসাবে ব্যবহার করা – সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রের যেটা একান্ত স্বার্থ। কিন্তু সারা দুনিয়ার মস্কো সমর্থক কমিউনিষ্ট পার্টিগুলো চোখ বন্ধ করে রাশিয়ার সাম্রাজ্য স্বার্থকেই গ্লোবাল কমিউনিষ্টদের স্বার্থ ফলে নিজ স্বার্থ দাবি করে এর সমর্থনে নিজ নিজ দেশ মিছিল সমাবেশ করে। এখানে “সাম্রাজ্য স্বার্থ” শব্দটা সচেতনে ব্যবহার করেছি। কারণ বৃটিশ-ভারত আমলে বৃটিশ সাম্রাজ্য আর জার সাম্রাজ্য ঠিক একইভাবে একইকারণের উভয়েই [Anglo-Afghan War (1878-1880)] আফগানিস্তান দখলের লড়াই করেছিল। ওখানে তখন ট্রিগার ঘটনা ছিল, এর আগে জার সম্রাট সেন্ট্রল এশিয়া অঞ্চল দখল করেছিল আর সেই ভয়ে আফগানিস্তা্নের বাদশা জারের সাথে এক অনাক্রমণ চুক্তি করেছিল। কিন্তু এতে বিপরীতে আবার ভয় পেয়েছিল বৃটিশ-ভারতের বৃটিশ সাম্রাজ্য। তার ভয় সন্দেহ হল যে জারের সাম্রাজ্য আর বৃটিশ সাম্রাজ্যের সীমানার মাঝে এতদিন বাফার রাষ্ট্র হয়ে থাকা আফগানিস্তান না জারকে বৃটিশদের উপর বাড়তি সুবিধা করে দেয়। তাই বৃটিশ সাম্রাজ্য আগাম আফগানিস্তানে হামলা করেছিল। এই প্রসঙ্গে আমরা যেন ভুলে না যাই যে মধ্য এশিয়াসহ জার সাম্রাজ্যের সীমা যতদুর ছিল রুশ বিপ্লব সেই সেই পুরানা সীমা নিয়েই নিজেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে পুনর্গঠন করে নিয়েছিল। এই বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বলা চলে সেই জার সাম্রাজ্যই কিন্তু এবার রুশ কমিউনিষ্ট নেতৃত্ত্বে। মধ্য এশিয়ায় ইরানী বিপ্লবের প্রভাব ঠেকাতে ভয়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাই আফগানিস্তান দখল করেছিল। সারকথা, এখানে কমিউনিষ্ট ইডিওলজির ভুমিকা হয়ে গিয়েছিল রুশ রাষ্ট্রের নিজ সংকীর্ণ স্বার্থ আড়াল করার উপায়।
সমতুলনীয় আর এক ঘটনার উদাহরণ হল, ৬৯-৭১ সালের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চীনা কমিউনিষ্টরা আয়ুব-ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে লড়ুক নেতৃত্ত্ব দেক এটা কমিউনিষ্ট চীন তার একান্ত স্বার্থের সাথে যায় এমন বিষয় মনে করতে পারে নাই। কারণ আজকের চীনের যে উত্থান দেখছি এর সুচনা পর্ব, ততকালে কূটনৈতিক সম্পর্কহীন চীন ও আমেরিকার বিশেষ সম্পর্কের শুরু, সুচনা বা প্রস্তুতি পর্ব ছিল ঐ সময়টা। যেখানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব ও পরে ইয়াহিয়ার ভুমিকা ছিল চীন-আমেরিকা উভয়েরই ঘনিষ্ট বন্ধু হিসাবে বিশ্বস্ততার সাথে দুতয়ালী করে দেয়া, কথাচালাচালি ঘটিয়ে দেয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্ত্বপুর্ণ ততদিনে চীন-আমেরিকার সম্পর্কের ডিল ফাইনাল করতে ১৯৭১ সালের ০৯ জুলাই ভোরবেলা দুদিনের জন্য কিসিঞ্জারকে পাকিস্তান ভ্রমণের সময়কালিন গোপনে চীন ভ্রমণ [গোপন এই সফরের কোড নাম ছিল, “মার্কোপোলো”] ও চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌএন লাইয়ের সাথে সরাসরি সাক্ষাতে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেয়া ইত্যাদি। তবে এঘটনার প্রকাশ্য আলামত শুরু হয়েছিল ঠিক তিনমাস আগে ০৭ এপ্রিল ১৯৭১। ঐদিন হঠাত চীনের চেয়ারম্যান মাওসেতুং আমেরিকার এক টেবিল টেনিস খেলোয়ার দলকে চীন ভ্রমণের আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেন। দিন তারিখের দিকে দেখলে ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটেছে। আর এর সাত দিন পরে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌএন লাই আমেরিকান টেবিল টেনিস দলের সাথে সাক্ষাত অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছিলেন, ১৯৪৯ সালের পরে এরাই প্রথম কোন আমেরিকান অতিথি। “আপনারা আমেরিকান জনগণ ও চীনা জনগণের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক নতুন ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা করলেন”। চৌএন লাইয়ের এর ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন, আগামি বছর তিনি চীন সফরে যাচ্ছেন বলে মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ সারা দুনিয়া জানে এই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নাই। On April 7, 1971, Chinese Chairman Mao Zedong made a decision to invite the United States table tennis team to visit China. On April 14, Premier Zhou Enlai met with the US ping-pong players, the first visiting American guests since 1949. Zhou told the US players: “You open a new historical chapter in the bilateral relations between Chinese people and American people.” এই ডিলের অংশ হিসাবে এখানে তিনটা ঘটনা উল্লেখ করব। (১) চীন ঐ ১৯৭১ সালের অক্টোবর ২৫ তারিখে জাতিসংঘের প্রথম সদস্যপদ পায় যে সদস্যপদ পাওয়া ১৯৪৯ সালে মাও এর চীন বিপ্লবের পর থেকে মূলত আমেরিকার আপত্তিতে আটকে ছিল। আপত্তির মূল কারণ, ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠনের সময় থেকে ওর নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাওয়ালা পাঁচ সদস্যের একজন ছিল চায়না। কিন্তু মাত্র চার বছর পর ১৯৪৯ সালে মাওয়ের বিপ্লবের পর থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত তাইওয়ান নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাওয়ালা সদস্য। অর্থাৎ মূলভুমি মাও এর নয়াচীন জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত দেশই নয় আর চীন বলতে জাতিসংঘের চোখে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাওয়ালা চীন মানে এক ছোট দ্বীপ তাইওয়ান। অর্থাৎ মাও এর চীনের জন্য ১৯৭১ সালের অক্টোবর ২৫ খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ দিন। এদিন থেকে চীন শুধু জাতিসংঘের সদস্যপদই পায় নাই, একেবারে সরাসরি ভেটো ক্ষমতাওয়ালা পাঁচ সদস্যের একজন হয়ে গিয়েছিল, আমেরিকান আপত্তি প্রত্যাহারে। এবং সমান গুরুত্ত্বপুর্ণ, তাইওয়ানের ষ্টাটাস তখন থেকে জাতিসংঘের অস্বীকৃত ভুখন্ড। অর্থাৎ তাইওয়ান নয়াচীনের অঙ্গিভুত ভুখন্ড অংশ – নয়াচীনের এই দাবিকে সরাসরি না হলেও প্রকারন্তরে স্বীকৃতি দেয়া হয় জাতিসংঘ। (২) আর দেরি না করে পরের বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রথম চীন সফরে যান। এরপর থেকে চীন-আমেরিকার সম্পর্কের ভীত্তিমূলক নীতিগুলোর খসড়া ও বুঝাপড়াগুলো তৈরি হতে থাকে। মূল বিষয়, চীন নিজেকে আমেরিকার দানব-পুঁজি বাজার প্রতীকিভাবে যা ওয়াল ষ্ট্রিট নামে পরিচিত তার কাছে উন্মুক্ত করে দিবে। বিনিময়ে আমেরিকান বাজার চীনা পণ্যের জন্য উন্মুত্ত হবে ইত্যাদি। এগুলো ঠিকঠাক তৈরি, আলোচনা, দেনদরবার নিগোশিয়েশন ইত্যাদি শেষ হতে ১৯৭৮ সাল লেগে যায়। (৩) আর ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারী থেকে চীন আমেরিকা পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়ে ইতোমধ্যে তৈরি সমস্ত ডিল আনুষ্ঠানিক করে নেয়। আর ঐদিন থেকে তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে আমেরিকা।] ফলে এসব গুরুত্ত্বপুর্ণ কারণে আয়ুব ও ইয়াহিয়া এরা দুজনই চীনের কাছে খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ত্ব ছিল। তাই চীনের স্বার্থের খেদমত করার বিনিময়ে বাংলাদেশের (ততকালীন পুর্ব পাকিস্তান) চীনা কমিউনিষ্টদেরকে ৬৯ সালের পর আয়ুব ও ইয়াহিয়া নিজেদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত করতে চীনের কমিউনিষ্ট পার্টিকে অনুরোধ রেখেছিল। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করতে ছাত্রদের অংশ বাদ দিলে মূলত শ্রমিকদের সংগঠিত করতে নির্ধারক ভুমিকা ছিল ভাসানীর নেতৃত্ত্বে অধীনস্ত বাংলাদেশ চীনের কমিউনিষ্ট পার্টিগুলো। আর ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের চীনা কমিউনিষ্টরা নিজ স্বার্থের চেয়ে চীনা রাষ্ট্রস্বার্থকে জেনে অথবা না জেনে প্রাধান্যে রেখেছিল।
তাহলে সারকথায় বললে, একই আন্তর্জাতিক ইডিওলজির দুই রাষ্ট্র আইডিওলজির মিল আছে এমন হলে একজনের স্বার্থে অপরজনের বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সব সময় সেখানে থাকবে। উপরে চীনের উদাহরণ্টা আনলাম এটা দেখানোর জন্য যে দুই রাষ্ট্রস্বার্থ কেমন সরাসরি পরস্পর বিরোধি ১৮০ ডিগ্রি হয়ে যেতে পারে তা বুঝাতে। অতএব এটা আসলে যে কোন আন্তর্জাতিক আইডিওলজির সমস্যা অথবা বলা যায় আধুনিক রাষ্ট্রের সমস্যা। অথবা এই দুইয়ের মধ্যকার স্ববিরোধ। আমরা যে রাজনীতিই করি না কেন এই কঠিন বাস্তবতা আমাদের নজরে নিতে হবে, বাস্তব সমাধান খুজতে হবে। কারণ আমাদের আন্তর্জাতিক আইডিয়া বিপ্লবের তত্ত্বও দরকার, আবার রাষ্ট্রস্বার্থগুলোর মুখোমুখি হওয়া একে অন্যকে ব্যবহার করে ফেলা এগুলো এড়ানোর উপায় জানতেই হবে।
ইরান রাষ্ট্রের সঙ্কট অথবা “ইরানি স্বার্থের ইরাক রাষ্ট্র”
ইরাক সঙ্কট নিয়ে লিখতে বসে এতক্ষণ উপরের লেখা অংশকে কমিউনিষ্টদের প্যাচাল মনে করবেন পাঠকের কেউ হয়ত, লিখলাম কেন অনেকের মনে তা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। লিখলাম এজন্য যে এই সমস্যাটা কেবল সোভিয়েত বা চীনা কমিউনিষ্টদের বেলায় ঘটে বা সত্যি তাই নয়। যেকোন গ্লোবাল আইডিয়ার ক্ষেত্রেও ঘটবে। কারণ মুলত সমস্যাটা যে কোন আন্তর্জাতিক ইডিওলজির সমস্যা অথবা বলা যায় আধুনিক রাষ্ট্রের সমস্যা।
তাই আমরা এখন দেখব কমিউনিষ্ট বিপ্লব না হওয়া সত্ত্বেও ইরান বিপ্লবও একইভাবে নিজরাষ্ট্রের টিকানোর স্বার্থে পড়শিদের ব্যবহার করেছে।
ইসলামও নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক ইডিওলজি। যারা খলিফা ধারণার রাজনীতি ধারণ করেন সেটা আরো ঘোরতর আন্তর্জাতিক বা প্যান ধারণা। ইরানী বিপ্লব যদিও যতটা না আন্তর্জাতিক তার চেয়ে বেশি জাতীয় বৈশিষ্টের। তবু এটা সুনির্দিষ্ট এক ইডিওলজিক্যাল বিপ্লব। আবার তা পশ্চিমের মত অর্থে একটা আধুনিক রাষ্ট্র না হলেও নতুন ধরণের তবুও মোটা দাগে তা মর্ডান রাষ্ট্র বৈশিষ্টেরই। আর ইরান বিপ্লবে কমিউনিষ্টদের সাথে সবচেয়ে বেশি মিলের দিকটা হল, নিজ বিপ্লব রক্ষা করার সমস্যা, বিপ্লব রপ্তানি এবং নিজ রাষ্ট্রস্বার্থে ইরাক রাষ্ট্রকে বলি দেয়া এসব কিছুই সে ঘটিয়েছে। কিছু উদাহরণ দিব।
এক) ইরান বিপ্লবের পরেপরেই ১৯৮১-৮৭ প্রতিবছর হ্বজ করতে গিয়ে নিজ বিপ্লবের পক্ষে প্রচার প্রপাগান্ডা করতে আর সৌদি রাষ্ট্র শাসকের নিন্দা করতে এক সংগঠিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। কারণ হ্বজ মানে সারা দুনিয়া থেকে মুসলমানেরা সেখানে সমবেত হয়। ইরান রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিবছর মক্কা ও মদিনায় মিটিং মিছিল সমাবেশ বয়ান আয়োজন করে আসছিল। এতে সৌদি কর্তৃপক্ষের মনে মক্কা ও মদিনার ধর্মীয় স্থানগুলো তাদের দখল পরিকল্পনা আছে এই সন্দেহ ক্রমশই বাড়ছিল। ১৯৮৬ সালে ইরানী দলবদ্ধ রাষ্ট্রীয় হ্বাজিদের (মোট হ্বাজি দেড় লাখ) প্রায় ১০০ জনকে এক্সপ্লোসিভসহ ইমিগ্রেশনে আটক করা হয়েছিল। এসব নিয়ে পরের বছর হ্বজের সময় যথেষ্ট টেনশন বইতেছিল। দ্বিতীয় দিনে ইরানীদের বিশেষ সমাবেশ সামলাতে গিয়ে সৌদি সরকার তাতে (১৯৮৭ সালে ৩১ জুলাই) সরাসরি গুলি করে, কঠোর হাতে দমন করতে গিয়ে স্পটেই চারশতের উপর হ্বাজি ও সৌদি পুলিশ মারা গিয়েছিল। এই ম্যাসাকারের ঘটনা নিশ্চয় আমাদের অনেকের মনে আছে। এঘটনাতে সৌদি ইসলাম ভাল না ইরানী ইসলাম ভাল অথবা ইরান না সৌদি সরকার কে সঠিক ছিল সে ব্যাপারে বিচারকের ভুমিকায় বসা এখানকার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। এই রচনার উদ্দেশ্যও নয়। ফলে তা উহ্য রেখেও বলা যায় ইরান নিজ বিপ্লব নিজ রাষ্ট্র সুরক্ষার তাগিদে ফলে এর পক্ষে দুনিয়ায় মুসলমানদের মনে জায়গা করে নেবার বাসনায় – তার বিপ্লব ধারণার রপ্তানির বাসনা – থেকেই এটা ঘটিয়েছিল, এটুকু বলা যায়।
দুই) অন্যদিকে, নিজ বিপ্লবী রাষ্ট্র সুরক্ষা নিরাপদ করতে ইরাকি শিয়াদের তাকে ব্যবহার করতে হবে এই বাসনা যে ইরানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ত্বের ছিল তা আজকে দাঁড়িয়ে পরিস্কার বলা যায়। যদিও এই বাসনা প্রকাশ্য নয়, এর বাইরের দিকটা হল তাঁরা নিপীড়িত ইরাকি শিয়াদের পাশে দাঁড়াতে চাইছে। একথা ঠিক যে সাদ্দামের আমল ইরাকি শিয়াদের অবদমন আর নিপীড়নে কেটেছে। কিন্তু সেই দশার সুযোগে ইরাকি শিয়াদেরকে ইরানী বিপ্লব ও রাষ্ট্র সুরক্ষা করতে ব্যবহার করার কারো আকাঙ্খা ন্যায্য হতে পারেনা। ওদিকে ইরানী বিপ্লবের পর, ১৯৮০-৮৮ এই সময়টা ইরাক-ইরান যুদ্ধে কেটেছে। অথচ আদর্শ হতে পারত সাদ্দামের সাথে ইরানের কোন সমঝোতা চুক্তিতে পৌছানো যাতে ইরাকের মোট পপুলেশনের ৬০-৬৫ ভাগ ইরাকি শিয়ারা ইরাক রাষ্ট্র ক্ষমতায় উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ত্বের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায়, অবদমন আর নিপীড়ন থেকে মুক্তি পায়, বিনিময়ে ইরাকের দিক থেকে ইরানী বিপ্লবও নিরাপত্তা সুরক্ষার নিশ্চয়তা পায়। কিন্তু তা ঘটেনি। ইরাক-ইরানের পরস্পরের প্রতি সন্দেহ অবিশ্বাসই মুখ্য হয়ে উঠে ফলে আট বছর ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলে। আজকের পরিস্থিতি দেখে মনে করার কারণ আছে যে স্বাধীন ইরাকি রাষ্ট্র হিসাবে ইরাকি শিয়ারা ইরাকেই টিকে থাক, ইরাক রাষ্ট্র অটুট থাকুক – এটা নয় বরং ইরানী রাষ্ট্র নিরাপত্তা সুরক্ষার কাজে ইরাকি শিয়াদের ব্যবহার করাই ইরানের লক্ষ্য ছিল।
আজকের ইরাক রাষ্ট্রের বাস্তবতা এমন জায়গায় পৌছিয়েছে যে, “ইরাকি” অর্থাৎ নিজ ইরাকি রাষ্ট্রের জন্য আকাঙ্খা কারও নাই, ইরাক ভুখন্ডে যারা আছেন তারা আসলে শিয়া, সুন্নি অথবা কুর্দি – ইরাকি কেউ নাই, ইরাকি রাষ্ট্র আকাঙ্খা করে, রাখে বাস্তবায়ন দেখতে চায় এমন আর কেউ নাই। এজন্য বাস্তবত ইরাক রাষ্ট্রটা আসলে কোথাও নাই। সবাই এর সমাধান দেখেছে হয় শিয়া, না হয় সুন্নি অথবা কুর্দি হয়ে। ইরাকি নাগরিকের দিক, ইরাকি হয়ে থেকে সমাধান দেখার কেউ নাই। একমাত্র নাগরিক পরিচয়েরই রাষ্ট্র হতে হয় অর্থাৎ রাষ্ট্রে নাগরিক মাত্রই সকলে সমান মর্যাদার, [মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদ রচনা করে এমন রক্ত, বংশ, গোত্র, গায়ের রং বা অন্য বর্ণবাদিতা, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, নারী-পুরুষ ধরণের ভাগ, পাহাড়ি-সমতলী ধরণের ভুগোল ভাগ ইত্যাদি যত রকমের ভেদটানা সম্ভব সেসব কিছুর উর্ধে সকলে সমান মর্যাদার নাগরিক] একে অন্যের মর্যাদার নিশ্চয়তাকারি এমন না হলে শিয়ারা যদি শিয়া পরিচয় মুখ্য করে রাষ্ট্র হতে চায় তবে বাকি সবাইও নিজের নিজের পরিচয় ঝান্ডা খাড়া করবে। ইরাকি রাষ্ট্র বলে কিছু খাড়া হবে না। এটাও রাষ্ট্রতত্ত্বের আর এক মৌলিক শিক্ষা।
তিন) একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমেরিকার সাথে পরমাণু ইস্যুতে ইরানের চরম বিরোধ থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট বুশের ২০০৩ সালের ইরাক হামলা ও দখলে ইরানের সম্মতি ছিল। আমেরিকার ইরাক দখল ইরানের নিরাপত্তার জন্য এক বড় একটা ঘটনা হবার কথা অথচ অবাক বিষয় এঘটনায় আমেরিকার উপস্থিতি ইরান রাষ্ট্রের দিক থেকে সে কোন হুমকি অনুভব করেনি। তাই সম্মতির প্রশ্ন উঠছে। না হলে ইরানী বিপ্লব যে জন্ম থেকেই যেখানে আমেরিকার সাথে একনাগাড়ে সরব বিরোধ চালিয়ে গেছে তা থাকা সত্ত্বেও সেই আমেরিকা ইরাক দখল করে ইরানের ঘাড়ের উপর এসে বসেছে অথচ ইরানের কোন অস্বস্তি নুন্যপক্ষে কোন আপত্তির বিবৃতিও আমরা দেখি নাই কেন? শুধু তাই না ২০০৬ সাল থেকে সেই যে ইরানের পছন্দের নুরে আল মালিকি প্রধানমন্ত্রী হলেন তা এখনও চলছে। আর বুশ তাকে পরিচিত করিয়েছিলেন “আমাদের লোক” হিশাবে। কারণ মালিকি ছিলেন সেই বিন্দু যেখানে আমেরিকা ও ইরানের কমন স্বার্থ এক হয়েছিল। কিন্তু সেটা ইরাকের নিজের রাষ্ট্রস্বার্থে নয়, বরং ইরান মালিকির ইরাকের ভিতর নিজ রাষ্ট্রের সুরক্ষা নিরাপত্তা দেখেছিলেন। সাদ্দামের শিয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমাধান নিশ্চয় এবার শিয়া প্রাধান্যে সুন্নিদের উপর অত্যাচার নয়, অথবা এবার সুন্নিদের অপ্রতিনিধিত্ত্বশীল করে রাখা নয়। তাও আবার পরদেশি ইরানের স্বার্থের এক রাষ্ট্র হয়ে। আসলে “ইরানি স্বার্থের ইরাক রাষ্ট্র” এই বাক্যটাই স্ববিরোধী। ভিন রাষ্ট্রের স্বার্থে কেউ আর নিজের রাষ্ট্র থাকে না, থাকতে পারে না। ওদিকে মুকতাদর আল সদর ও অন্য কয়েকজন ইরাকি আয়াতুল্লাহ (যেমন সিসতানি) কখনও কখনও শিয়া পরিচয়ের উপরে উঠে ইরাকি হতে চেয়েছেন। কিন্তু বারবার তারা চুপ করে গেছেন। অন্তত তারা যে গলার ও প্রভাব-ক্ষমতার জোরের দিক থেকে সংখ্যালঘু তা প্রমাণ হয়েছে।
(চার) গত কয়েক মাসে ISIL বলে যে বিদ্রোহীদের আমরা দেখছি এটা মূলত আলকায়েদা ঝোকের অংশ সাথে পুরানা বাথিষ্ট (সাদ্দামের দলের নাম) আর সুন্নি গোত্র প্রধানদের সমন্বয়ের এক সুন্নি জোট। যেখানে আলকায়েদা অংশের সাথে বাকি অংশের এলায়েন্সের কমন ভিত্তি হল দুটো –বাগদাদ দখল ও ইরাকি রাষ্ট্রকে ইরানি প্রভাব মুক্ত করা। এছাড়া কোন আদর্শগত বড় মিল এখানে নাই বরং অমিল বেশি। এই জোট উত্তর-পশ্চিমের মসুল দখল করে যখন বাগদাদের দিকে ধাবমান তখন মালিকির ইরাকি সেনাবাহিনী প্রতিরোধ না করে আগেই ময়দান ফেলে বাগদাদে পালিয়ে আসে। অবস্থা দেখে অনেকেই প্রথমে একে বাগদাদের সেনাবাহিনীর মনোবলের ঘাটতি মনে করেছিল। কিন্তু একদিন পরে ইরাকের আকাশে দেখা গেল সিরিয়ান এয়ারফো্র্সের বোমা বর্ষণ। অর্থাত সিরিয়ান এয়ারফো্র্সকে ISIL এর উপর বোমাবর্ষনের সুবিধা করে দেবার জন্য মালিকি নিজ সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু এই বোমাবর্ষনের উদ্দেশ্য আরও ভয়ঙ্কর। এর মাধ্যমে ইঙ্গিত দেয়া হয়েও গেছে যে আমেরিকা-ইরান (সাথে বগলদাবা সিরিয়া)[এই অর্থে সিরিয়া থেকে ইরান এই শিয়া জোট] একজোট হয়ে ISIL বা সুন্নি ও আলকায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই করা – এটা ঘটানো সম্ভব। এর প্রবল সম্ভাবনা একটা আছে। আর এতে ইরানের প্রবল আগ্রহ আছে। তার মানে সুন্নি জোটের বিরুদ্ধে এটা আমেরিকা-ইরানের কোন কূটনৈতিক ভাবালাপ নয় একেবারে জয়েন্ট মিলিটারি অপারেশন – এমন ভাবনা কল্পনা করা ইরানের জন্য ডালভাত। এই ইঙ্গিত ভয়ঙ্কর। এটা ইরান রাষ্ট্রের জন্ম থেকে আমেরিকান রাষ্ট্রনীতির বিরোধীতাকে অর্থহীন প্রমাণ করেছে। ইরান নিজ সংকীর্ণ রাষ্ট্রস্বার্থে আমেরিকার সাথে সামরিক জোট করে আগানোর নিজ ইচ্ছা প্রকাশ করার মধ্যে কোন অস্বস্তি দেখে নাই। এভাবে ইরাক নামের কোন রাষ্ট্র জাহান্নামে যাক, ইরান [আর সেই সুত্রে আসাদের সিরিয়া রাষ্ট্রও] রাষ্ট্রের স্বার্থ সুপ্রীম। তা যেকোন উপায়ে হাসিল করতে হবে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম! এর কিছুদিন পরে বাগদাদে মালিকির প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড, সেনাবাহিনী, আল সদরের বাহিনী ইত্যাদি মিলে যে সামরিক মহড়া আয়োজন করেছিল সেখান থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এটা ইরাকের বাগদাদ রক্ষা নয়, বরং বাগদাদকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে, সেখানে বসে ইরান রাষ্ট্রের সুরক্ষা প্রতিরক্ষার ফিজিক্যাল মহড়া ও মাসল দেখানো ছিল সেটা। অর্থাৎ এটা প্রকাশ্যেই প্রমাণ করেছে মালিকির ইরাকি রাষ্ট্র এমনই এক অদ্ভুত “রাষ্ট্র” যা সাজানো হয়েছে নিজ নিঃস্বার্থ হয়ে ইরান রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা নিজ করণীয় ও কর্তব্য বলে ঠিক করেছে। সেই সাথে ইরানী সেনাবাহিনী ও গার্ড বাহিনী যে ইতোমধ্যেই বাগদাদে এসে ততপরতা শুরু করেছে এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাগদাদে দুজন ইরানী সেনা অফিসারের মৃত্যুর ঘটনা থেকে। ইরান আনুষ্ঠানিক ভাবে তা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করতেও দ্বিধা করেনি।
ব্রেজনেভের সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখল করে নিজ একান্ত রাষ্ট্রস্বার্থে অন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহারের উদাহরণ তৈরি করেছিল। এবার ইরানের একান্ত রাষ্ট্রস্বার্থের এক ইরাক সাজিয়ে ইরান আরও বিশাল উদাহরণ তৈরি করল।
তাহলে বিপ্লব বলতে সেটা রাশিয়ার সোভিয়েত বিপ্লব হোক কি ইরানের ইসলামি বিপ্লব – গোড়ার সমস্যা একই, আধুনিক রাষ্ট্রের লজিক ও বিপ্লবের আন্তর্জাতিকতার সমস্যা।
[এই রচনা পাঠে পাঠকের প্রতি কিছু পরামর্শঃ] আলোচ্য শিরোনামের লেখাটা চূড়ান্ত কিছু নয়, প্রাথমিক প্রস্তাব। আরও এডিটেড একটা ভার্সান পরে হাজির করার ইচ্ছা রাখি। এখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন বা ইরান সম্পর্কে বেশ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য সংযোজিত করা হয়েছে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য এমন একেবারেই নয় যেন পাঠকের এথেকে এসব দেশের প্রতি বিরূপ মনোভাব অথবা ঘৃণা তৈরি হোক – তা রাষ্ট্রীয় বা ইডিওলজি যেকোন অর্থে। অথবা এমন নয় যে বাংলাদেশের স্বার্থে এসব দেশের কোন ইতিবাচক অবদান নাই। অথবা এমন নয় যে নতুন আইডিয়া হিসাবে এসব দেশের বিপ্লবের কোন আবেদন এবং আমল করার মত রাষ্ট্র-ধারণায় গুরুত্ত্বপুর্ণ কোন তত্ত্বীয় অবদান, সংযোজন নাই। অথবা এমন নয় যে এসব দেশের রাষ্ট্রনীতির সাথে বাংলাদেশের মানুষের কোন স্বার্থ মিল হবার ভবিষ্যতে কোন সম্ভাবনা নাই। ফলে এমন ধারণা করা সঠিক হবে না। অথবা বাংলাদেশে আমি কোন জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ফেরি করতে চাইছি, কোন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিই এখন ভরসা এমন কোন ইঙ্গিত করছি। অথবা নাগরিক ধারণাকে কোন না কোন জাতীয়তাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ বা আটকে রেখে ফেরি করছি। এসব অনুমান অমূলক হবে ও লেখকের প্রতি অবিচার করা হবে। এক হিসাবে নানা দেশের এখানে যা কিছু তথ্য সংযোজিত হয়ে আছে সেগুলোকে ঐতিহাসিক অবজেক্টিভ ফ্যাক্ট ও রিয়েলিটি হিসাবে গ্রহণ করলে সুবিচার করা হবে। অর্থাৎ আমাদের পরস্পরের রাষ্ট্রস্বার্থগুলো ওসব জায়গায় কমন থাকতে পারেনি – এর উদাহরণ হিসাবে নিলেই যথাযথ হবে। তবে অবশ্যই আমি জোর দিব একথা বলে যে, আইডিয়ার নামে আড়ালে একে অন্যকে একান্ত স্বার্থে ব্যবহার – একাজে বিরত থাকা এবং ঘোষণা দিয়ে তা পরিত্যাগ করতেই হবে।