বিজেপির নাকি মোদীর সমর্থন, কোন দিকে
গৌতম দাস
১০ জানুয়ারি ২০১৫।
গত ০২ জানুয়ারি ২০১৫ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির এক নেতা তথাগত রায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হিন্দুদের এক ধর্মীয়-সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে এসে বক্তৃতায় বলেছেন, “বিজেপি সরকার উপলব্ধি করেছে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দেওয়া উচিত এবং সেই কাজটি তারা করেছে। এটা আমি আপনাদের নিশ্চিত করেই বলতে পারি” – -প্রথম আলো ২ জানুয়ারি ২০১৫। এখানে সমর্থন মানে কি? বিগত কংগ্রেস সরকারের মত ও মাত্রায়? বিগত কংগ্রেস সরকার যেভাবে বাংলাদেশে পছন্দের সরকারের থাকার ব্যাপারে মরিয়া হয়েছিলেন অথবা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং যেমন ঐ নির্বাচনের ব্যাপারে মরিয়া অবস্থান নিয়েছিলেন তেমন? এই প্রশ্নটা নিয়ে নাড়াচাড়া করব।
প্রথমত, আমার মনে হয়, বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের বক্তব্য সংক্রান্ত এই খবরটা নিশ্চিত খবর বা মোদী সরকারের অবস্থান হিসাবে নিতে আমাদের আরও দুচারদিন অপেক্ষা করা সঠিক হবে। কারণ হাসিনা ও মোদী সরকারের সম্পর্কের মধ্যে এমন কোন ফরমাল বা দৃশ্যমান প্রকাশ কিছু দেখা যায় নাই যা থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে মোদী কংগ্রেসের মতন ও মাত্রায় হাসিনার সমর্থক হয়ে উঠছেন। বিজেপির নেতা তথাগত রায়ের পরিচয় তিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাবেক সভাপতি। অর্থাৎ তিনি মোদীর বিজেপি সরকারের ঠিক কেউ নন অথবা এই বিষয়ে কথা বলার সরকারি মুখপাত্র ধরণেরও কেউ নন। তিনি নিজে এটা দাবিও করেন নাই। এমনকি এব্যাপারে তিনি যে সতর্ক তা জানাতে তিনি ওখানে বলছেন, “যদিও ভারত একটি দেশ। তারা আরেকটি দেশের সঙ্গে কাজ করবে এটি স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে বিজেপি নেতা হিসেবে আমার বলা উচিত না, তার পরও আমি আপনাদের জানাতে চাই…………” । একই বিষয়ে দৈনিক মানবজমিন বলছে, “আমি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এটা বলতে পারি না। আমরা একটি দেশের সঙ্গে দেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করি। তবে বাংলাদেশের বিষয়টা ভিন্ন। আপনাদের (উপস্থিতদের উদ্দেশে) বোঝার জন্য বলছি”। অর্থাৎ তিনি মূলত বলছেন, সরকারি প্রতিনিধি তিনি নন ফলে আইনী দিক আর তাছাড়া কুটনৈতিক দিক থেকে কথাটা তার বলা উচিত না। এদিকটায় তিনি সচেতন তবু তাঁর অনুমিত একটা “সত্য” কথা তিনি আমাদের জানাচ্ছেন। অর্থাৎ এতটুকু নিশ্চিত বলা যায় খবরটা কেন্দ্রীয় বিজেপি দলের হয়ত কিন্তু মোদীর সরকারের নিশ্চিত অবস্থান হিসাবে না নিয়ে বরং তা নিশ্চিত হতে আমাদের অপেক্ষা করাই উচিত হবে। অপেক্ষা বললাম এজন্য যে অনুমান করি, এখন বাংলাদেশের অনেক পত্রিকারই “কলকাতা প্রতিনিধি” বা “দিল্লি প্রতিনিধি” আছে। ফলে দুচারদিনের মধ্যে উতসাহী তাদের কেউ সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদী বা নুন্যতম তাঁর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকবরউদ্দিনের কাছে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে আমাদের জন্য খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে আনবেন।
দ্বিতীয় কারণ
অপেক্ষা করতে চাওয়া বা নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার আরও কারণ আছে। এমন দ্বিতীয় ও তৃতীয় এভাবে আরও দুটো কারণ এখানে বলব। দ্বিতীয় কারণটা এককথায় বললে, ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিন্যাস পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপুর্ণ বদল ঘটেছে। সেই পটভুমির মধ্যে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় কারণটা বলব। বিগত পাঁচ বছরে একনাগাড়ে কিন্তু ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন এক রাজনৈতিক বিন্যাস বা পোলারাইজেশন বিরাট তাতপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। গত বছর ২০১৪ সালের ভারতের কেন্দ্রীয় লোকসভা নির্বাচনের (যেটার ফলাফলে মোদী প্রধানমন্ত্রী) সময়ে থেকে এর এক চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে। আর আগামি ২০১৬ সালের মে মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক বা বিধানসভা নির্বাচন। কিন্তু এর সাথে বাংলাদেশের কি সম্পর্ক তা বুঝতে একটু বিস্তারে যেতে হবে। সেই পোলারাইজেশনের তাতপর্য না বুঝলে বাংলাদেশের সাথে এই প্রাদেশিক নির্বাচনের সম্পর্ক সবটা বুঝা যাবে না। তাই পশ্চিমবঙ্গের ভিতরের রাজনৈতিক গঠন বিন্যাস প্রসঙ্গে আগে একটু বিস্তারে যাব।
আগামি ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তখন বাংলাদেশের সরকারে যেই থাক পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাংলাদেশ নামটা নানা উছিলায় বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে। আমি পশ্চিমবঙ্গ বলেছি ভারত বলি নাই। এই নির্বাচনে নির্ধারক ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটারের ২৮% ভোটার মুসলমান। এই তথ্য এখন খুবই নির্ধারক এক তথ্য। ইতোমধ্যেই এই মুসলমান ভোটারদের ব্যাপক অংশ ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমুল কংগ্রেসের ভোটার সমর্থক হয়ে নতুন এক সমীকরণে একাত্ম হয়েছেন। আগে ১৯৪৭ সালের পর থেকে এরা প্রথমে কংগ্রেসের ভোটার, আরও পরে আশির দশক থেকে সিপিএমের ভোটার পরিচয়ে এতদিন ছিল। ইতোমধ্যেই তারা মমতার তৃণমুল কংগ্রেসের পক্ষে একচেটিয়া পোলারাইজ হয়েছে্ন। আগের কংগ্রেস অথবা সিপিএমের ভোটার থাকায় সময় এরা উভয় ক্ষেত্রে “সেকুলার” ভোটার হয়ে ছিল। অর্থাৎ সেকুলার পরিচয় তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সঠিক অবস্থান ভাবতেন। কিন্তু এখন মমতা তাদেরকে “তারা যা তাই”, অর্থাৎ “সাচার কমিটি রিপোর্টের” ভাষায় অবহেলিত এবং মুসলমান পরিচয়েই গ্রহণ করেছেন। ভারতের বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, ২০০৬ সালের শেষে প্রকাশিত ভারতের মুসলমানদের দুরাবস্থা বিষয়ক যে ডিটেল সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, “সাচার কমিটি রিপোর্ট” নামে যা পরিচিত, এটা প্রকাশিত হবার পর থেকে ধীরে ধীরে এর প্রভাব পড়তে থাকে পশ্চিমবঙ্গের ভোট ও ক্ষমতার প্যাটার্ণে। ঘটনার প্রভাবের প্রথম দৃশ্যমান প্রকাশ ঘটে ২০১১ সালে; যখন বিগত ৩৪ বছর ধরে একনাগাড়ে আসীন সিপিএমের বামফ্রন্ট সরকার প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচনে মমতার তৃণমুলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। বিধানসভা ২০১১ এর ফলাফলে মোট ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৮৪ আসন একাই মমতার পক্ষে যায়। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হন। মুসলমান ভোটারদের সাথে মমতার এলায়েন্স তখনও তেমন পোক্ত হয় নাই। কিন্তু মমতা মুখ্যমন্ত্রী হবার পরে ভোটার ভাগিয়ে আনার শুধু তাঁর মুখের প্রতিশ্রুতি নয়, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের যেসব সামাজিক আইনী বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর সাথে ক্ষমতায় আসা মমতার সরকারের দেয়ানেয়া রফাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। এর প্রকাশ হিসাবে মমতা রাজ্যসভায় মুসলমান ভোটারদের নেতা প্রতিনিধি হিসাবে মোহম্মদ হোসেন ইমরানকে মনোনীত করে পাঠান। ভারতের পার্লামেন্ট লোকসভা আর প্রাদেশিক বিধানসভার সমন্বয়ে আরও একটা আইন প্রনয়নী প্রতিষ্ঠান হল রাজ্যসভা। রাজ্যসভার সদস্য প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। প্রত্যেক প্রাদেশিক সরকারের রাজ্যসভায় সদস্য মনোনয়ন দেয়ার কোটা থাকে। মুসলমান ভোটারদের সাথে মমতার এই এলায়েন্সের গড়ে নেবার পরে এই এলায়েন্সের তাতপর্যের চরম প্রকাশ ঘটে গত বছর ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় লোকসভা নির্বাচনে। নির্বাচনের ফলাফলে লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়া মোট ৪২টা আসনের ৩৪টাই একা মমতা দখল করে। যেটা আগের ২০০৯ সালের নির্বাচনে ছিল মাত্র ২০ আসন। যদি মনে রাখি ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় লোকসভা নির্বাচনের মোদী-ঝড় বা জ্বরের কথা যেখানে প্রায় সব আঞ্চলিক দল উড়ে ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই ঝড়েও উলটা মাত্র দুটো আঞ্চলিক দল, তামিলনাডুতে (মাদ্রাজ) এক আঞ্চলিক দল এবং কলকাতায় তৃণমুল, আগের চেয়ে আরও বড় সংখ্যাগরিষ্টতার আসন সমর্থন নিয়ে টিকে গিয়েছিল। মমতা টিকে যাওয়ার প্রধান কারণ বলা হয় তিনি মুসলমান ভোটারদের সাথে আগেই এলায়েন্স পোক্ত করে ফেলেছিলেন তাই।
ওদিকে মোদী ঝড়ের গত নির্বাচনের পরে আরও কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। ঐ নির্বাচনের সময় থেকে উঠা মোদী-ঝড়ের সুবিধায় বিজেপিও পশ্চিমবঙ্গে তাদের মোট ভোটের শেয়ার বাড়িয়ে আগের ৪% থেকে ১৭% এ নিতে সমর্থ হয়। ভোটার পোলারাইজেশন ট্রেন্ড বিচারে দেখা গেছে, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস এদের সেকুলার ব্লক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তাদের ভোটাররা ছুটছে তৃণমুলের দিকে। আর এই ছুটাছুটিতে আবার বিজেপি ভোট বেড়েছে সম্ভবত মোদীর দেখানো অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্নের কারণে। ফলে এখন আগামি পশ্চিমবঙ্গ ২০১৬ প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতা পেতে বিজেপি প্রচন্ডভাবে আকাঙ্খী ও আগ্রাসী দল হয়ে উঠেছে। তাই আগামি ২০১৬ নির্বাচনে “২৮% মুসলমান” এই তথ্যটা প্রধান ফ্যাক্টর ও একে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে, দলগুলো নিজের নির্বাচন কৌশল সাজানো শুরু হয়ে গেছে। কারণ সবাই বুঝে গেছে “২৮% মুসলমান” ভোটারের বাক্স এখন মমতা যেটা সহজে বদল হচ্ছে না। ফলে বাকি হিন্দু ও অন্যান্য ৭২% ভোটার ভাগ হবে তৃণমুল, বিজেপি, বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের মধ্যে। ফলে “মুসলমান” শব্দটা ইতোমধ্যেই মমতার সাথে গাটছাড়া বেধে ফেলেছে, আর বাকি বিরোধী বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেসের কাছে আক্রমনের শব্দ মুসলমান, আর শব্দটা টেনেটুনে এর আরও নতুন অনেক অর্থ হচ্ছে যেমন – “জঙ্গী”, “অনুপ্রবেশকারি”, “জামাত”, “বাংলাদেশী” ইত্যাদি। এককথায় এই শব্দগুলোর সুত্রে বাংলাদেশ নামটা বহু বিচিত্রভাবে আ্সা শুরু হয়েছে। এসবের সারকথা, এগুলো পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটারদের মমতার দিকে পোল বদলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিক্রিয়া। আর এসব নির্বাচনী প্রপাগান্ডার ট্যাগ আমাদের উপরেও নানান উতপাত নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে, আমরা এখন মোদী-হাসিনার সম্পর্ক কেমন সে বিষয়ে এই চারটা দল যে যখন যেভাবে বললে নিজের নির্বাচনী কৌশলের পক্ষে বা বিপক্ষে কাজে লাগে সেভাবেই নানান ব্যাখ্যা দিতে দেখতে পাচ্ছি, আগামিতে আরও পাব। বিজেপি নেতা তথাগত রায় বাংলাদেশে এসে যে বয়ান দিয়েছেন তা এই আলোকে দেখাই বুদ্ধিমানের হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে এই বক্তব্যগুলো সত্য-আধাসত্য-মিথ্যা যাই হোক এগুলো মুলত একেবারেই পশ্চিমবঙ্গের দলগুলোর আঞ্চলিক নির্বাচনী স্বার্থমূলক বক্তব্য, তাও আবার একেবারেই নির্বাচনী রেঠরিক বয়ান। কোনমতেই এই রেঠরিকগুলোকে মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের বৃহত্তর স্বার্থ বয়ান নয়, ফলে আমাদের জন্য সেভাবে দেখাও হবে মারাত্মক ভুল।
তৃতীয় কারণ
তৃতীয়ত, নরেন্দ্র মোদী তাঁর সরকার ও বিজেপি দলের মধ্যে ব্যবহারিক একটা সুক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ ফারাক বজায় রাখতে চান। এনিয়ে গত ২০১৪ নির্বাচনের প্রচারণা চলার সময় থেকেই তিনি মিডিয়াতে ধারণা দিয়ে আসছেন। এখন বাস্তবেও এর প্রমাণ রেখেছেন। যেমন, কেন্দ্রীয় বিজেপির সভাপতি অমিত শাহকে কলকাতার আগামি ২০১৬ নির্বাচনে দলকে জিতিয়ে আনার প্রকাশ্য এসাইমেন্ট সঁপেছেন মোদী। কলকাতায় দলকে জিতানোর জন্য মমতার চরম বিরোধী হয়ে সর্ববিধ কৌশল ঠিক করবেন তিনি একক দায়িত্বে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী আবার সেই মমতার সাথেই সখ্যতার এক ওয়ার্কেবল সম্পর্ক রেখে চলবেন, চলতে চান। অর্থাৎ বিজেপি দলের প্রাদেশিক স্বার্থ আর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থ, কর্মকাঠামোর মধ্যে এমন একটা ব্যবহারিক ফারাক তিনি বজায় রাখতে চান। এই হল সরকার ও দলের ফারাক বিষয়ে মোদীর ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গের এসাইমেন্ট কাজে নেমে অমিত শাহ সারদা অর্থ কেলেঙ্কারি ও বর্ধমানের খাগড়াগোড়ে বোমা হামলা নিয়ে, গোয়েন্দা র ও তদন্তকারী সংস্থা NIA কে যতটা সম্ভব ম্যানিপুলেট করে নিজের ষড়যন্ত্র প্রপাগান্ডায় সামিল করেছেন। যতদুর এই কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুল কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত হওয়া তা ক্ষুন্ন না হয়। এমনকি খাগড়াগোড়ে বোমা হামলা নিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সফর করিয়েছেন। অমিত শাহ নিজে নয়, কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান আর মোদীর পররাষ্ট্র প্রশাসনের মাধ্যমে হাসিনা সরকার ও তার গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে সম্পর্ক করিয়েছেন, সফর বিনিময় করিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে না জড়িয়েই তিনি এটা করাতে পেরেছেন। কারণ ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগ যেকোন প্রাদেশিক ইস্যুতে পররাষ্ট্র বিষয়ে সার্ভিস সহায়তা দিতে পারে। অমিত শাহ বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি হলেও তিনি মোদীর সরকারের কেউ নন, সরাসরি কোন পদে বা মন্ত্রীসভায় তিনি নাই। কিন্তু মোদী এসব বিষয়ে নিজেকে জড়াবেন না, ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোও মোদীর বৃহত্তর স্বার্থ নীতির উপর আঁচ-প্রভাব না ফেলে, না ফেলার সীমার মধ্যে থেকে যতদুর সম্ভব অমিত শাহকে সমর্থন দিতে পারে এভাবে কাজ করেছে। যেমন, অমিত শাহ কলকাতার জনসভায় মমতাকে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গী আমদানি করেছেন, সারদা কেলেঙ্কারির অর্থ খাগড়াগোড়ে বোমা হামলায় মমতা ব্যবহার করেছেন – এসব অভিযোগ এনে আক্রমণ করেছেন। সারদা অর্থ কেলেঙ্কারি কথার অর্থ, সারদা হল বাংলাদেশের ডেসটিনির মত এক কোম্পানীর নাম; ফলে ডেসটিনির মতই কলকাতায় প্রকাশ হয়ে সারদার অর্থ কেলেঙ্কারি। মমতাকে সারদা অর্থ কেলেঙ্কারির, “জঙ্গী”, “অনুপ্রবেশকারি”, “জামাত”, “বাংলাদেশী” এসব শব্দে অভিযোগ তুলে পর্যদুস্ত করা অমিত শাহের পশ্চিমবঙ্গে জেতার নির্বাচনী কৌশল, তাই। কিন্তু অমিত শাহ বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি হলেও এগুলো ঠিক আবার মোদী সরকারের বাংলাদেশ নীতিকে প্রতিফলিত করে না। মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের বৃহত্তর কেন্দ্রীয় স্বার্থের পক্ষে কাজেই মূলত নিমগ্ন থাকতে চাই। তাই মোদীর সরকারের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, সারদার অর্থ পাচার আর বোমা হামলা, বাংলাদেশ এগুলোর মধ্যে কোন সম্পর্ক নাই। কেন্দ্রীয় তদন্ত প্রতিষ্ঠান NIA তারও ফরমাল ফাইন্ডিং রিপোর্টে একই কথা বলেছে। এমনকি তারা রিপোর্টে বাংলাদেশ বা জেএমবির নাম আনে নাই, তবে সন্দেহের পর্যায়ে -খুজে নিশ্চিত হতে হবে ধরণের কিছু কথা সেখানে রেখেছে। অর্থাৎ অমিত শাহের কলকাতার পাবলিক বক্তৃতা যা উভিযোগ তুলেছেন সেকথার সাথে মোদীর মন্ত্রী সামঞ্জস্য রাখে নাই। এই অসামঞ্জস্য নিয়ে মিডিয়ায় কথাও উঠেছে। এখানে নেপথ্যে বলে রাখা যায়, আমাদের অর্থমন্ত্রী সপ্তাহ দুয়েক আগে কলকাতায় বিজনেস চেম্বারের এক সভায় গিয়ে এক কলকাতার সাংবাদিককে বলেছেন, “সারদার টাকা ঘুরপথে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়েছে এবং সেখান থেকে সেই অর্থ বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবিকেও দেওয়া হয়েছে – এমন কোন তথ্য মেলেনি”। আর এসব তর্ক থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছেন মোদী তবু কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ম্যানিপুলেট না করে স্বাভাবিক কাজের পক্ষে অবস্থান উপরে রেখেছেন। দলের অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে সে ভিত্তিতে সরকারের বক্তব্য সাজাতে যান নাই। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল, দল আর সরকারের মধ্যে ফারাক রাখার নীতি মোদীর অনুসরণ করার কারণ ঠিক কোন নৈতিক বা কনষ্টিটিউশনাল বাধ্যকথার দিক ভেবে নয়। মূল কারণ হল, মোদী সারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকতে চান যেন অভিযোগ না আসে যে তিনি কোন একটা বা দুইটা প্রদেশ বা রাজ্যের দিকে কান্নি মারা প্রধানমন্ত্রী। তিনি গুজরাট বা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের দিকে কান্নি মারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী – এই পরিচয় তিনি একেবারেই চান না। সেজন্য এই নীতিগত অবস্থান।
আবার পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সরকারের সাথে চার প্রাদেশিক দল বা শাখা দল -তৃণমুল, বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস এরা সবাই দেখাতে চায় তাদের সম্পর্ক খুবই ভাল এবং স্ব স্ব নির্বাচন কৌশলের পক্ষে বাংলাদেশ আছে। এমনটা দেখানোর একটা সুক্ষ্ম প্রতিযোগিতা সবার আছে। যদিও এই দল চারটার চোখে সবার ইস্যু একটাই, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটার। তবে সেখানে তফাত হল, মমতার অবস্থান মুসলমান ভোটারদের পক্ষে আর বাকি তিন দলের বিপক্ষে। যেমন আগামি ফ্রেব্রুয়ারি মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতার আসন্ন বাংলাদেশ সফরে নুমান করি, নিজের নির্বাচন কৌশল কেন্দ্রিক যে ধারণা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দিবেন তা হল, মমতা “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ” বা জঙ্গী অনুপ্রবেশ ঘটছে এই বয়ান মানেন না, বিরোধী তিনি এটা আমাদেরকে বুঝানো। কারণ মনে রাখতে হবে নির্বাচনী কৌশল হিসাবে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস কমবেশি এদের সবার অবস্থান মমতার অবস্থানের বিরোধী। আর মমতা বাদে বাকি তিনদল প্রত্যেকের বয়ান কমবেশি – সারদা অর্থ কেলেঙ্কারির, “জঙ্গী”, “অনুপ্রবেশকারি”, “জামাত”, “বাংলাদেশী” এইসব অভিযোগ দিয়ে সাজানো। অনেকে অবাক হতে পারে কিন্তু “সেকুলারিজমের” বড়াই করা দশার কমিউনিষ্ট সিপিএমের বয়ানও কমবেশি এটাই। সিপিএমের বাংলাদেশি কাউন্টার পার্ট হল মেনন-ইনু, মূলত মেননের দল। সেজন্য তারাও হাসিনা সরকারকে নিজেদের রাজনৈতিক মিত্র বা কাছের সমভাবাপন্ন মনে করে।
অতএব তৃতীয় এই কারণে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের বক্তব্যকে নিশ্চিত মোদী সরকারের অবস্থান বলে সিদ্ধান্তে না গিয়ে আমি তাই অপেক্ষার কথা বলছি।
সারকথা, আগামি ২০১৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দল বা শাখার বক্তব্যগুলো তাদের নির্বাচনী কৌশলের আলোকে দেখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ঝাপিয়ে পরা যাবে না। তা বোমা হামলা, জঙ্গী “অনুপ্রবেশকারী” অথবা হাসিনাকে সমর্থন এমন যাই ইস্যু হোক। মোদী সরকারের অবস্থান সরাসরি মোদীর মুখ থেকে বা কোন মুখপাত্রের মুখ থেকে শুনলে তবেই তা নিশ্চিত বলে বুঝতে হবে।
সর্বশেষ অমিত শাহের খালেদাকে ফোন বিষয়ে
লেখার উপরের এই পর্যন্ত অংশটা লিখে শেষ করেছিলাম ঠিক ৬ জানুয়ারি ভোরবেলায়। প্রকাশ করা হয় নাই। পরে আরও বড় বিস্তারিত করতে চেয়েছিলাম। তাও হয় নাই। আপাতত তাই, কোন আপডেট না করে নোট আকারেই প্রকাশ করলাম। ইতোমধ্যে গতকাল থেকে ঢাকায় অমিত শাহের ফোন বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে।
উপরের কথাগুলো সাজানোর কাঠামো অনুসারে অমিত শাহের ফোন করা বা না করা যাই হোক তা থেকে একই কারণে এটা মোদী সরকারের অবস্থান হিসাবে নিশ্চিত ধরে নেয়াটা এখনই ঠিক হবে না। কারণ আগেই বলেছি অমিত শাহ মোদী সরকারের কেউ নন, কোন মুখপাত্রও নন। কিন্তু অমিত শাহ ফোন করেছেন অথবা করেন নাই মোদী সরকারের হাসিনার প্রতি মনোভাবে বাংলাদেশের চলমান খালেদা “অবরোধ” প্রেক্ষিতে কি নেতিবাচক হয়ে গেছে? অবশ্য অবশ্য অবশ্যই হয়েছে। কংগ্রেসের মতন করে হাসিনার পক্ষে তো নয়ই বরং ডায়লগ ও নতুন নির্বাচনের পক্ষে মোদীর ভারত সরকার ঘুরতে যাচ্ছে। এই প্রাথমিক ইঙ্গিতকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে, ফলে তা তাতপর্যপুর্ণ মনে করছি – অমিত শাহ এর কথিত ফোনের প্রেক্ষিত থেকে তা নয় বরং বিশেষ কিছু মিডিয়া রিপোর্ট থেকে। যেমন টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে বিএনপির নজরুল ইসলাম খানের সাক্ষাৎকার বিষয়ে একই দিনে দুদুটা রিপোর্ট টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ছাপিয়েছে। এছাড়া টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সম্পাদকীয় বিভাগের রুদ্রনীলের ব্লগে লেখা মুল্যায়ন, রুদ্রনীল ঘোষের নিজের নামে বাংলায় প্রায় একই সারকথা মানবজমিন ০৯ জানুয়ারি ২০১৫ পত্রিকার লেখা “রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা ঘুচাতে এখনই সংলাপ দরকার”। আর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একই মুল্যায়নের একেবারে সম্পাদকীয় লিখে নিজেরই আগের অবস্থান উলটে দেয়া।
ভারতে যেসব মিডিয়া বিজেপিকে বেশি কাভারেজ দেয় এদের মধ্যে জি-নিউজ টিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং আনন্দবাজার অন্যতম। বিশেষত গত নির্বাচনের পরে অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এসাইনমেন্টে আসার পর থেকে আনন্দবাজারের অমিত শাহকে সার্ভিস সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। অমিত শাহ যখন সারদা আর বোমা হামলা নিয়ে নির্বাচনী প্রপাগান্ডায় ঝাপিয়ে পড়লেন তখন থেকে তাঁর প্রধান মিডিয়া হাতিয়ার আনন্দবাজার। সময়ে তা এমন জায়গায় গেছে যে সোর্সছাড়া খবর, গোয়েন্দা সুত্রের নামে চালানো বাপ-মাহীন রিপোর্ট, একেবারে অমিত শাহের মমতা ও বাংলাদেশের অনুপ্রবেশী মুসলমান বা জামাতের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডার কার্বন কপিও ছাপা হয়েছে। এই চক্রের ফ্যারে পড়ে সেসব প্রপাগান্ডা আবার বাংলাদেশের প্রথম আলো আনন্দবাজারের সুত্রে ছাপিয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। রিপোর্টের টার্গেট ছিল, মমতার রাজ্যসভার সদস্য ইমরান-সারদা-বর্ধ্মানের বোমা হামলা-জামাত এসব কিছুকে এইসুত্রে গেথে গল্প লেখা। সেই সন্ধ্যায় আওয়ামি ঘরানার তিন টিভি আবার প্রথম আলোর ঐ মিথ্যা রিপোর্টের বরাত দিয়ে খবর প্রচার করেছে। মাত্রাছাড়ানি টের পেয়ে অথবা কোন কারণে প্রথম আলো সে অবস্থান থেকে সরে আসে দুদিন পরে। আর ড্যামেজ কন্টোল ও ব্যালেন্স করতে এবার শুধু ইমরানের পালটা ডিফেন্স বক্তব্য নিয়ে রিপোর্ট ছাপে। উপরে বলেছি এসব প্রপাগান্ডা মোদী সরকারের মন্ত্রী, অনুসন্ধান রিপোর্ট সবাই নাকচ করে দিয়েছে। সেই আনন্দবাজার এবার খোদ সম্পাদকীয় মানে নিজ সম্পাদকীয় অবস্থান ব্যক্ত করেছে। খালেদাকে আটকে রাখার উদ্বেগ, গনতন্ত্রের জন্য উদ্বেগ ইত্যাদি জানিয়ে উলটা হাসিনাকে অভিযুক্ত করে বলছে – এগুলো হাসিনার “কেমন ধরনের গণতন্ত্র?”, এগুলো হাসিনার “প্রতিহিংসার ক্রিয়া”, “অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িবার আশঙ্কা প্রবল”, “মৌলবাদীরা তাহার সুযোগ লইতে পারে” ইত্যাদি। আনন্দবাজার বিএনপি-জামাত জোটের পক্ষে সাফাই দিয়ে বলছে, “বিএনপি ও তাহার জোটসঙ্গী জামাতে ইসলামির যৌথ আন্দোলন সহজেই হিংসাত্মক হয়, তাহা সত্য। কিন্তু অতিরিক্ত দমন নীতি জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাহিরে আসার পথটিই রুদ্ধ করিতে পারে, স্বাভাবিক নিষ্ক্রমণের পথ না পাইয়া এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ অন্তর্ঘাতেই বিস্ফোরণের পথ খুঁজিবে”। হাসিনাকে দোষী করে তাঁকে নমনীয় হতে বলেছে আর খালেদার আন্দোলন ন্যায্য বলে সাফাই দিয়েছে। আনন্দবাজারের এই অবস্থান পরিবর্তন বিজেপির অমিত শাহের অবস্থান পরিবর্তন বলে মনে করার ইঙ্গিত বলে মনে করার কারণ আছে। তবুও এখনই এটাকে মোদী সরকারের অবস্থান বলে নিশ্চিত বুঝতে দেরি করতে বলব। তবে অবশ্যই এটা প্রাথমিক ইঙ্গিত।
মোদীর সাথে অমিত শাহ এর সম্পর্ক
মোদীর সাথে অমিত শাহ এর সম্পর্ক কি কেমন তা জানা থাকলে নজরুল ইসলাম খানের সাক্ষাতকার থেকে আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পর্যন্ত ঘটনাবলীর আঁকা গ্রাফ থেকে বের হওয়া ইঙ্গিতগুলোর সম্ভবত কিছু তাতপর্য উদ্ধার পাওয়া যেতেও পারে। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিতে রাজনীতিক নেতাকে অনেক ডার্টি-কাজ করার বা ময়লাঘাটার প্রয়োজন অনুভব করতে হয়, যেগুলো খাস প্রমাণ না থাকলেও কানাঘুষায় বা আধাপ্রমাণে তা অপ্রকাশিত থাকে না। ফলে সেসব কাজ এটা মূল নেতা করলে আবার তাঁর ইমেজের বিরাট কাল দাগ লেগে ক্ষতি হয়। সেটা এড়াতে মূল নেতা তা খুব কাছের বিশ্বস্ত একজনকে দিয়ে করিয়ে থাকেন। মোদীর তেমন বিশ্বস্ত লোক হলেন অমিত শাহ। মোদীর প্রথমবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহের উত্থান। আর সর্বশেষ ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় লোকসভার মোট ৫৪০ আসনের নির্বাচনে একা সবচেয়ে বড়ভাগের আসন সংখ্যা হল ৮০ আসনের রাজ্য, উত্তর প্রদেশ। মোদী সেই উত্তর প্রদেশ জয় করে আনার জন্য গুজরাট থেকে অমিত শাহকে এসাইমেন্ট নায়কের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেন। অমিত শাহকে তখন কেন্দ্রীয় বিজেপির সেক্রেটারিও করে দেয়া হয় আগে। নির্বাচনের ফলাফলে চমক দেখিয়ে তিনি ৮০ আসনের ৭২ টাই একা বিজেপির পক্ষে আনেন। তবে সেজন্য তার দুর্ধর্ষ নামের সাথে আরও কালি লেগেছিল। এই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিযোগে আদালতের মামলাগুলোতে তিনি আসামি। তাঁর এসাইমেন্টের সফলতার কৌশল বড় অদ্ভুত, সময়ে অবিশ্বাস্য। দাঙ্গার অভিযোগ তার নামে থাকে কিন্তু তিনিই আবার কোন সংখ্যালঘু অথবা জাত-ধারণায় সময়ে কোন উচুজাত অথবা নিচুজাতের কাউকে ঐ স্থান থেকে বিজেপির হয়ে নির্বাচন করিয়ে এবং জিতিয়েও আনতে পারেন। এসব ডার্টি কাজে গুজরাট থেকে উত্তর প্রদেশ পরিক্রমায় তার নামে যতগুলো মামলা আছে এর সব পেন্ডিং আর তিনি জামিনপ্রাপ্ত। গুজরাটের পর থেকে এপর্যন্ত তিনি আর কখনও কোন বিজেপি সরকারে সরকারি পদ নেন নাই, আড়ালে ক্ষমতাধর থেকেছেন। চলতি মোদী সরকারেরও তিনি কেউ নন। তিনিই হলেন এখন কেন্দ্রীয় বিজেপির সভাপতি এবং পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ নির্বাচনে দলকে জিতানোর এসাইনমেন্টে মুল দায়িত্বপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে অমিত শাহ মোদীর হয়ে আগমনী বার্তা দেবার ভুমিকা নিয়ে থাকতে পারেন। অর্থাৎ মোদী এখনই সরকারকে জড়াতে চান না, হয়ত কিছু প্রস্তুতি বাকির কারণে। এমনটা হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে একাজ তাঁর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী এসাইমেন্টের সাথে সম্পর্কিত কিছু নয়। অসম্ভব নয় যে এটা আলাদা এসাইনমেন্ট। অর্থাৎ অমিত শাহ আর মোদীর অবস্থানের এখানে এক হতে পারে। এখানে তিনি মোদীর আগমনী বার্তার বাহক। ফলে এটা দল-সরকারের ফারাকের দিক থেকে বুঝতে চাওয়া ভুল হবে। বরং মোদীর আগমনী বার্তা মানে মোদী যে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে যাচ্ছেন তা আগাম জানাচ্ছেন অমিত শাহ এভাবে অনুমান করতে সমস্যা নাই। আপাতত এই পর্যায়ে এটা অনুমান হিসাবেই থাক। তবে বেশিদিন নয়, এমাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সম্ভবত এটা আরও স্পষ্ট পরিস্কার হয়ে সকলের কাছে ধরা দিবে। দেখা যাক।
লেটেষ্ট আপডেটঃ সকাল, ১৪ জানু ২০১৫
[ইতোমধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন মিডিয়ায় মুখ খুলেছেন, গত পরশু ১২ জানুয়ারি ২০১৫। তাঁর বক্তব্যের অর্থ কি, নতুন কি বললেন আর কি বললেন না তা নিয়ে আমার কিছু মন্তব্য নিচে সংযোজিত করে দেয়া হল।]
অমিত শাহের টেলিফোন করা না করা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিতর্কিত হয়ে আছে। এর ভিতরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিনের এক বক্তব্য আজ প্রথম আলোসহ অনেক মিডিয়া ছাপিয়েছে। প্রথম আলো বলছে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই, আগামী দিনেও থাকবে না। বাংলাদেশ কিভাবে চলবে তা সে দেশের সরকার ও জনগণই ঠিক করবে”।
এখন এই বক্তব্য কি অমিত শাহের টেলিফোন করা না করা নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্কের কোন অবসান ঘটাল? প্রত্যক্ষভাবে অবশ্যই নয়। দৈনিক যুগান্তর থেকে জানা যাচ্ছে, অমিত শাহ বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেও তিনি এর জবাবে বলেন, “বাংলাদেশে কী ধরনের সমাজ থাকবে, কোন বিষয় প্রাধান্য পাবে, তা ঠিক করে দেওয়ার কেউ ভারত নয়। বাংলাদেশের সরকার ও সে দেশের জনগণই ঠিক করবে কোন সমাজে কীভাবে তারা থাকবে”।
তাহলে কি দাড়াল?
তবু অনেকে এই বক্তব্য -অমিত শাহ ফোন করেন নাই – এমন অর্থ বের করার জন্য চেষ্টা করবেন হয়ত। সে চেষ্টা বিফলে যাবে সন্দেহ নাই, আর বিতর্কের অবসানও হবে না। তবে এই বক্তব্য থেকে সবাই মানবেন এমন কিছু সিদ্ধান্তে আসা যায়।
যেমন, হাসিনার প্রথম পাঁচ বছর আর পরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে যেভাবে দাবি করছিলেন ওর সারকথা ছিল –যা কিছুই হোক তাদের হাসিনাকেই চাই। এমন প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের জায়গায় মোদীর সরকার এখন নাই এটা আকবরউদ্দিন পরিস্কার করেছিলেন। সুজাতা সিং চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে আমাদের মিডিয়াকে সেসময় নিজে দুটো বাক্য বলেছিলেন। এক, নির্বাচন হবার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় হাসিনার এগিয়ে যাওয়া উচিত। দুই, সকলকে নিয়ে নির্বাচনের চেষ্টার বদলে যত বেশি দলকে পারা যায় তাদের নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। আর ওদিকে এরশাদের সাথে দেখা করে তাঁকে বলেছিলেন, জামাত ক্ষমতায় এসে যাবে সেটা ঠেকাতে এরশাদের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এখন সৈয়দ আকবরউদ্দিন আমাদের বুঝিয়ে দিলেন তিনি কোনভাবেই সুজাতা সিং নন। সুজাতা সিং এখনও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব থাকলেও তিনি আর এখন কংগ্রেসের না মোদীর সরকারের সচিব হয়ে আছেন। একথাটাও সৈয়দ আকবরউদ্দিন প্রচ্ছন্নে আমাদের জানালেন। তবে সুজাতার চক্ষুলজ্জা ফিরে এসেছে কিনা আমরা এখনও জানি না। গত বছর তিনি মোদীর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের সময় সঙ্গী হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মোদী সরকার চান নাই সেই তিনি আবার বাংলাদেশের মিডিয়ার মুখোমুখি হন অথবা সুজাতার পুরান বক্তব্য ঘেঁটে মোদী সরকারকে কোন বিব্রত পরিস্থিতির মুখে ফেলেন। ফলে আমরাও জানতে পারিনি সুজাতা সিংয়ের চক্ষুলজ্জা ফিরেছে কি না। সেই থেকে সৈয়দ আকবরউদ্দিনই মিডিয়ায় বাংলাদেশ ইস্যু সামলাচ্ছেন। অবশ্য উপরের কথাগুলোর অর্থ এমনও না যে বিড়াল মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ সব রাষ্ট্রই নিজের স্বার্থ, সক্ষমতা আর সুযোগ অনুযায়ী অন্যকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে। এটা বন্ধ হবার হয়ে গেছে বা যাবে সেকথা এখানে বলা হচ্ছে না। তবে সেটা কূটনৈতিক সীমা, কনভেনশন আর শোভন বা চক্ষুলজ্জা ইত্যাদি সীমায় থেকে অপ্রকাশ্যে চলতেই থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।
সৈয়দ আকবরউদ্দিনের এই বক্তব্য একইসাথে এবছরের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের বাংলাদেশে এসে দাবি করা বক্তব্যকেও নাকচ করে।
ওদিকে কলকাতার আনন্দবাজার ১০ জানুয়ারি জানিয়েছে, “বিজেপির মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ এ দিন দিল্লিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করলেও খালেদাকে তাঁর দলের সভাপতির ফোন করা বা না-করা নিয়ে একটি কথাও বলেননি। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক থেকেও সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দিয়ে বিষয়টির মীমাংসা করা হয়নি”। এই পরিস্থিতি দেখে আনন্দবাজার নিজে ঐ রিপোর্টের শেষে মন্তব্য করেছে, “তবে কি বিজেপি বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না, নাকি বিএনপি-র সঙ্গে ভবিষ্যৎ বোঝাপড়ার পথ খোলা রাখতেই মুখ বন্ধ রাখার কৌশল?”।