মোদীর ভারত এবং বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যে বদল (২)
গৌতম দাস
২৩ জানুয়ারি ২০১৫
পরাশক্তি হওয়ার নির্ণায়ক
কোন রাষ্ট্রের পরাশক্তি (সুপার পাওয়ার অথবা গ্লোবাল পাওয়ার বলে যেটা আমরা বুঝাই) খেতাব পাবার নির্ণায়ক কি? অনেকের মনে হতে পারে পারমাণবিক বোমা বানানোর ক্ষমতা আর সে বোমা কোন রাষ্ট্রের সংগ্রহে থাকলেই তাকে বোধহয় পরাশক্তি বলা যায়। আসলে এই ধারণার কোন ভিত্তি নাই। তবু কারও কারও এমন ধারণা থাকে। সেটা তৈরি হবার পিছনের কারণটা হল – কোন রাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা এটা নিঃসন্দেহে তার সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতার একটা মাত্রা ও সেই মাত্রাকে প্রকাশ করা মাত্র। কিন্তু শুধু ঐ একটা মাত্র দিয়ে ঐ রাষ্ট্রের সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা প্রকাশ পায় একথা সত্যি না – ভুল অনুমান এখানে। অর্থাৎ সার কথাটা হল, কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতাকে সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা বলে বুঝা – এটা ভুল। আবার পরাশক্তি ধারণা মানে কেবল কোন সামরিক সক্ষমতার প্রশ্নও নয়, বরং সামরিকের সাথে ষ্ট্রাটেজিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্ন এবং সর্বোপরি সব ধরণের সক্ষমতার মূল ভিত্তি হল ঐ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্ন। কারণ কারও পরাশক্তি হয়ে উঠার প্রথম শর্ত নিজ অর্থনৈতিক সক্ষমতা। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হলে, উদ্বৃতের অর্থনীতিতে পৌছালে তা বাকি সামরিক, স্ট্রাটেজিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতার পুর্বশর্ত বলে এরপর পরাশক্তি হয়ে উঠা কিছু সময়ের ব্যাপার কেবল। যদিও, এটা ঠিক যে নিজের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র হাতে থাকলে শত্রুর কাছ থেকে বড় বা সর্বাত্মক ধরণের হামলা বা আক্রমণ আসার সম্ভাবনা এটা কমায় মাত্র। আবার শত্রুর উপর এই বোমা ব্যবহার করে পাল্টা হামলা চালানোর সুযোগও একই কারণে খুবই সীমিত হয়ে যায়। যেমন ভারত-পাকিস্তান কখনও কোন বড় বা সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ায় না একারণেই। দুদেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে কেউই যুদ্ধকে বড় করতে বা ছড়াতে চায় না – সীমিত স্তরে রাখতে চায়। কারণ কোন পক্ষ অপর পক্ষের হাতে চরম নাস্তানাবুদ হয়ে গেলে সে অপমাণিত বোধ থেকে এটা তাকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে উস্কানি দেয়া হয়ে যেতে পারে। এছাড়া এই অস্ত্র ব্যবহারের আগে প্রকৃতি ও মানুষের উপর বিকিরণ বিষয়ে পার্মানেন্ট ক্ষতির কথাও বিবেচনায় নিতে হয়। না নিয়ে গত্যন্তর থাকে না। কারণ বিকিরণের প্রভাব তার নিজ ভুখন্ডেও আসতে পারে। ফলে সামগ্রিক বিবেচনায় পারমাণবিক বোমা মূলত আত্মরক্ষামূলক; এবং তাও সীমিত অর্থে।
আত্মরক্ষামূলক কথার আরও মানে হল সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা যাই থাক না কেন, কোন রাষ্ট্রের সে সক্ষমতা তার প্রতিপক্ষের তুলনায় ছাড়িয়ে গেলেও হামলা করার সময় আক্রমণকারী যুদ্ধ সীমিত স্তরে রাখার চেষ্টা করবে। করবে এই ভয়ে যে সেক্ষেত্রে উপায়হীন দেখে আক্রান্ত প্রতিপক্ষ, দুর্বল হলেও, নিজের কাছে মজুদ থাকা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভেবে বসতে পারে, সেদিকে যেন উস্কানি দেয়া না হয়। আবার আক্রমণকারী শত্রুরও যদি পারমাণবিক সক্ষমতা থাকে সেক্ষেত্রে উভয় পক্ষই যুদ্ধ সীমিত স্তরে রাখার চেষ্টা করে থাকে, উভয়কেই কড়া সর্তক থাকতে হয় যেন কেউ কাউকে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে না দেয়। সর্বশেষ ভারত-পাকিস্তান কারগিল যুদ্ধে এই প্রবণতাই দেখা গিয়েছিল। ফলে নিট ফলাফল হচ্ছে পারমাণবিক বোমা সংগ্রহে থাকার কারণে উভয় পক্ষকেই যুদ্ধ সীমিত স্তরে রাখার চেষ্টা করতে হয়, উভয়কেই একটা স্ব-আরোপিত সীমা তৈরি করে ও তা মানতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করে শত্রুকে ঘায়েল বা ক্ষতি করার জন্য নয়, বরং ভয় দেখানো এবং ভয় পাবার দিক থেকে এটা আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করে।
আবার ২০০১ সালের পরে আমেরিকার আফগানিস্তান বা ইরাক হামলার বেলায় ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন; ঐক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন নয় যে আমেরিকার পারমাণবিক সক্ষমতা আছে বলেই সে সহজে ঐ দুই দেশকে আক্রমণ করে পদানত ও দখল জারি করতে পেরেছিল। যদিও আফগানিস্তান বা ইরাকের হাতে পারমানবিক বোমা থাকলে ফারাক কিছু হতেও পারত। পারমাণবিক বোমা মূলত ভয় দেখানোর অস্ত্র, যতটা ঠেকিয়ে রাখার অস্ত্র ততটাই তা ব্যবহারের নয়। এসব কারণে, জাপানে ১৯৪৫ সালে এই বোমা ব্যবহারের পর বিশ্বে কোন যুদ্ধ সংঘাতে আর কোথাও এর ব্যবহার হয় নাই। এছাড়া ইদানীং বোমা কেন, পরমাণু এনার্জির ব্যাপারেও প্রত্যেক দেশেই জনগণ যেভাবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে, ব্যবহার-বিরোধী জনমত প্রবল হচ্ছে তাতে বোমা সংগ্রহে থাকলেও তা ব্যবহারের বিরুদ্ধে খোদ নিজ জনগণেরই মনোভাব প্রবল বাধা হয়ে উঠতে পারে, এটা নাকচ করা যায় না। অতএব বাস্তবে এই অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগ সম্ভাবনা খুবই সীমিত।
আবার আর একদিক থেকে দেখলে, পারমাণবিক সক্ষমতা মানে নুইসেন্স করার ক্ষমতাও বটে; যেমন উত্তর কোরিয়া। সে তার পারমাণবিক সক্ষমতাকে ব্যবহার করছে দেশের ভিতরে ও বাইরে একটা ভয়ের রাজত্ব তৈরির কাজে। একদিক থেকে মনে হতে পারে উত্তর কোরিয়ার শাসক এই বোমার জোরে নিজ সার্বভৌমত্ত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু আবার অন্যদিক থেকে যদি প্রশ্ন করি, সার্বভৌমত্ব রক্ষা মানে কি? এর অর্থ খুঁজতে ভিতরে ঢুকলে দেখা যাবে, উত্তর কোরিয়ায় এর আসল অর্থ হয়ে আছে নিজ অর্থনীতিকে ক্ষুদ্র বামন করে রাখা, এমনকি বর্তমান ক্ষমতার অধীনেই ন্যূনতম সংস্কার করার আগ্রহ না দেখানো, জনগণের উদ্যমকে দাবিয়ে রাখা, জীবনের মান অচলায়তনে আটকে ধুঁকে ধুঁকে মরা ইত্যাদি। ফলে এগুলো করে কার সার্বভৌমত্ব রক্ষা হচ্ছে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হই আমরা। সবমিলিয়ে দেশের ভিতরে বাইরে সবার কাছেই উত্তর কোরিয়ার বর্তমান ক্ষমতাসীনদের হাতে পারমাণবিক সক্ষমতা অন্যদের চোখে ‘নুইসেন্স’ হিসাবেই হাজির হয়ে আছে। অতএব এখানেও আমরা দেখছি, উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক বোমার অধিকারী বলেই পরাশক্তি হিসাবে গণ্য নয়।
যদিও পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়ে উঠাকেই পরাশক্তির হয়ে উঠা বলে ভুল অনুমানের ধারণা এক সময় বেশ প্রকট হয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় কোন রাষ্ট্রের সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা বলতে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়া বাদে অন্যান্য দিক বিকশিত করবার দিকে ঝোঁক ক্রমশ বেড়েছে। আগের কিস্তিতে বলেছিলাম সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা কোন রাষ্ট্রের কেমন থাকবে কি থাকবে না অথবা তা কতটা হবে এটা মূলত নির্ভর করে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও শক্তি অর্জনের উপর। পারমাণবিক সক্ষমতা তো নয়ই এমনকি সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা কথাটাও ঠিক কারও পরাশক্তি হবার পরিমাপক অথবা নির্দেশক নয়। কারণ সামরিক খরচ বইবার মত একটা সামঞ্জস্যপুর্ণ উপযুক্ত ও যোগ্য অর্থনীতি সবার আগে থাকতে হবেই। এর উপরই দাঁড়াতে পারে সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা কথাটার অর্থ। এক্ষেত্রে এখনকার রাশিয়া এক আদর্শ উদাহরণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে থাকার সময় এর যে সামরিক সক্ষমতা ছিল এখন রাশিয়ান ফেডারেশন হয়ে যাবার পর সে নিজ অর্থনীতির মাপে নিজের আগের সামরিক সক্ষমতাকে ছেঁটে কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। সেটাও বহাল রাখতে পারছে অর্থনীতির ইন্ডাষ্টিয়াল সক্ষমতা্র ভিত্তি দিয়ে নয়, মাটির নিচের তেল-গ্যাস বিক্রির অর্থনীতি দিয়ে, ধুঁকে ধুঁকে।
অতএব, নতুন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় যে কোন রাষ্ট্রের জন্য সবার আগে দরকার একটা দ্রুত প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি অর্জনের সক্ষমতা নীতি গ্রহণ করা। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে সম্পদ বিতরণ ও বণ্টনের নীতি ও কার্যকর ব্যবস্থা যেন আভ্যন্তরীণ সংকট রাষ্ট্রের সক্ষমতাকে ভেতর থেকে দুর্বল করতে না পারে। এই দুটো দিক অর্জিত হলে সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা আসা কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তারপরও কোন দেশ নিজেকে পরাশক্তি বলে গণ্য নাও করতে চাইতে পারে। অর্থাৎ গণ্য হওয়াটা ঠিক অনিবার্য বা জরুরিও নয়।
মনে রাখতে হবে পরাশক্তি ধারণাটা মূলত ঐতিহাসিক। অর্থাৎ দুনিয়ায় একটা বিশেষ সময়ে বিশেষ শর্তে এই ফেনোমেনা হাজির হয়েছে যেটা ভিন্ন সময় শর্ত পরিস্থিতি এটা উধাও হতে পারে। ফলে অনিবার্য বা চিরন্তন কিছু নয়। দুনিয়ায় কলোনি শাসনের আবির্ভাবের কাল থেকে ধারণাটার উদ্ভব। ধারণাটা মূলত কোন রাষ্ট্রের গ্লোবাল প্রভাব আধিপত্য কেমন এরই এক নির্দেশক। আবার অন্যদিক থেকে নেতিবাচক। আন্তঃরাষ্ট্রীয় লেনদেন বিনিময় সম্পর্ককে কেবল জবরদস্তি খাটানো বিনিময় সম্পর্ক হিসাবে জারি রাখা, জবরদস্তিতে নিজের মতাদর্শগত দিকটা দুনিয়ার অন্য জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া, নিজেকেই একমাত্র সভ্যতার ধারক-বাহক, আদর্শ বিবেচনা করা -এগুলো হল পরাশক্তি ধারণাটার ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য। পরাশক্তির এটা খারাপ অর্থ। তবে আগামী দিনের নতুন কোন গ্লোবাল অর্ডারে যদি পরাশক্তি ধারণার প্রত্যক্ষ ও খারাপ অর্থগুলো কমতে কমতে নাই হয়ে যায় তবু এরপর কোন রাষ্ট্রের নিজ অর্থনৈতিক সক্ষমতার উপর ভর করে সামরিক সক্ষমতার সূত্রে গ্লোবাল প্রভাব রাখার বিষয়টা থেকে যাবে, সম্ভবত সহসাই উবে যাবে না।
সম্ভাবনা সম্পন্ন হয়তো, কিন্তু ভারত পরাশক্তি নয়
পরাশক্তি শব্দটার এই স্বল্প ব্যবচ্ছেদ থেকে আমরা এতটুকু স্পষ্ট হতে পারি যে, পরাশক্তি ধারণার বিচারে ভারত কোন পরাশক্তি এখনও নয়। কিন্তু তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতকে পরাশক্তি বিবেচনা করার কথা উঠেছে। এর কিছু কারণ নিশ্চয় আছে, সেদিক যাব। যেমন, ২০০৪ সালের মে মাসে কংগ্রেসের ইউপিএ সরকারের প্রথম টার্মে ক্ষমতায় আসার পরের বছর ২৭ জুন ২০০৫, ভারত-আমেরিকা একটা “ডিফেন্স প্যাক্ট” সই করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার সহায়তায় ভারতের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানো। এ উপলক্ষে টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৯ জুন ২০০৫ এর রিপোর্টিং এর প্রথম বাক্যটা এরকম, “India and the United States have signed a 10-year defence relationship agreement that gives credence to the Bush administration’s pledge to help India become a major world power in the 21st century.” এই বাক্যের ভিতরের পরের অংশটা ইন্টারেস্টিং। বলছে, “ভারতকে ২১ শতকে ‘মেজর ওয়ার্ল্ড পাওয়ার’ বা পরাশক্তি হতে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি আমেরিকা দিয়েছিল এই চুক্তি তার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে”। এখন পরাশক্তি কথার আমরা আসল যে অর্থ, গ্লোবাল অর্থনীতিতে ন্যূনতম শীর্ষ তিন-চার জনের একজন হওয়া -এমন অর্থবোধে গত দশ বছরেও ভারত পরাশক্তি হয়েছে এমন কোন রিপোর্ট অথবা দাবি আমরা কোথাও দেখি নাই। তাহলে এই মিডিয়া রিপোর্টটা এমন কেন? এটা পড়ে অনুমান করা যায় যে অর্থে ভারতের পরাশক্তি হওয়া মানে করা হয়েছে, তাও আবার আমেরিকার সহায়তায়, এটা কারো পরাশক্তি হওয়া বুঝায় কি না? অন্য রাষ্ট্রের সহায়তায় কেউ পরাশক্তি হতে পারে কি না এমন প্রশ্ন বা সন্দেহ এই রিপোর্টে নাই। এছাড়া এই রিপোর্টটা মূলত ভারতকে আমেরিকার সামরিক হার্ডওয়ার ও টেকনোলজি সরবরাহ সংক্রান্ত। অর্থাৎ এতে ভারতের বড়জোর সামরিক সক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু তাতে ওয়ার্ল্ড পাওয়ার বা পরাশক্তি হবার সম্পর্ক কি – সে প্রশ্ন করতে মিডিয়া ভুলে গেছে। রিপোর্টের এসব ভুয়া অনুমান উদোম করতে এই রিপোর্ট থেকে আরও কিছু প্রসঙ্গ তুলে আনব।
প্রথমত রিপোর্ট জানাচ্ছে, “Hugely ambitious in its size and scope, the agreement envisages a broad range of joint activities, including collaborating in multinational operations ‘when it is in their common interest,’ ”। অর্থাৎ ঐ ডিফেন্স প্যাক্টে আছে, দুই রাষ্ট্রের কমন স্বার্থ বলে উভয়ে মনে করলেই ‘টেররিজম ধ্বংস’ জাতীয় কোন কিছুর উছিলা তুলে ভারত আমেরিকার সাথে বহুজাতিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে ঐ “টেররিষ্ট” দেশের বিরুদ্ধে লড়তে সম্মতি জানাচ্ছে। এই পত্রিকার রিপোর্ট নিজে অবশ্য চুক্তিতে কেবল এমন অনুচ্ছেদ থাকাকে ভারতের “উচ্চাকাঙ্ক্ষা” হিসাবে দেখছে। আর এই চুক্তি অনুমান করছে এভাবেই নাকি “two militaries to promote security” তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পক্ষে আগিয়ে যাবে। রিপোর্টের আর এক অংশ বলছে, “The framework agreement also envisages what is tantamount to the U.S and India jointly policing the world.”। এখানে পত্রিকা প্রতিরক্ষা চুক্তিটা সম্পর্কে নিজস্ব মন্তব্য লিখে বলছে, যেন ভারত-আমেরিকা যৌথভাবে বিশ্ব-পুলিশের ভূমিকায় নামতে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্ব-পুলিশী করার খায়েস রাখার বিপদের দিকটা নিয়ে পত্রিকা আপত্তি তুলছে। তৃতীয়ত, ঐ ডিফেন্স প্যাক্টে সই করেছিলেন, যুদ্ধবাজ বুশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফিল্ড আর ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। চুক্তি স্বাক্ষর শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রণবকে এক রিপোর্টার প্রশ্ন করেছিলেন, এটা “playing a subservient role to a uni-polar US agenda” অর্থাৎ ভারতের দিক থেকে দুনিয়াতে এক মেরুর মাতবর আমেরিকার এজেন্ডার অধীনস্থ হওয়া হয়ে যাচ্ছে কি না। এর জবাবে প্রণব আমেরিকাকে বিশাল ঠকান ঠকিয়ে এই চুক্তি জিতে এনেছে এমন এক মিচকি হাসি দিয়ে বলেছেন, “This is the real deal…we have both put down what we want for the next decade… “he didn’t expect convergence or agreement on all issues at all times.”। তর্জমা করলে, “এটাই তো আসল খেলা, … পরের দশক পর্যন্ত আমরা কি চাই তা উভয়েই ওখানে লিখে রেখেছি।… সব ইস্যুতে সবসময় আমাদের উভয়ের একমত হতে বা মিলতে হবে এটা আমি আশা করি না”। প্রণবের এমন আস্থাবাচক মুচকি হাসির কারণ, ঐ প্যাক্টের আর এক অনুচ্ছেদ হল এরকম, “এই চুক্তি ভারতের স্বতন্ত্র অবস্থান নেয়ার অধিকার খর্ব করে না”। “ The agreement does not preclude India’s right to its independent views.”। এই হোল প্রণবের “ভারত পরাশক্তি” নামক প্রপাগান্ডার ফানুস। তবে ফানুস উড়িয়ে একটা ভাব তো ছড়ানোই যায় যে আমরা এই তো চাঁদে চলে যাচ্ছি। সে যাক, কিন্তু ‘আমেরিকাকে মহা ঠকিয়েছে’ ভাবটা প্রণব বেশিদিন ধরে রাখতে পারেন নি। ভারত প্রথম ধাক্কা খায়, ২০১১ সালের প্রথম অর্ধে যখন বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর রাখার পরিকল্পনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। স্বভাবতই ওবামার এই ইচ্ছার ভিতরে ভারত এবার খোদ নিজেরই নিরাপত্তার জন্য হুমকি আর বিপদের দিকটা দেখেছিল। ভারত আমেরিকান পরাশক্তির যাঁতাকাঠি ধার পেয়েছিল ২০০৬ সালের শেষ থেকে; বাংলাদেশে কে সরকারে আসবে থাকবে, কি শর্তে থাকবে তা ঠিক করার কর্তা হওয়ার ভিতর দিয়ে। এটাও প্রণবের চোখে পরাশক্তি ভাবার সুখবোধ হতে পারে।
দুই হাজার চৌদ্দ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে কথাবার্তার পর নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে মার্কিন কম্পানিগুলোকে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ভারতে প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সীমা ছিল ২৬%, সেটা এখন বাড়িয়ে ৪৯% করা হয়েছে। দুই হাজার পনেরো সালে ভারত ও মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তি শেষ হবার কথা ছিল। মোদীর মার্কিন সফরের পর সেটা আরও দশ বছর বাড়ানো হয়েছে।
কিন্তু ধরাকে সরা জ্ঞান করার ভারতের সেই সুখবোধে টান পড়তে শুরু করে প্রায় একই সময় ২০১১ সাল থেকে। এরই এক প্রকাশ্য রূপ হল, বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভারত-আমেরিকার দুই মেরুতে অবস্থান। অর্থাৎ আমেরিকার বিদেশনীতি আর ভারতের বিদেশনীতি হরিহরাত্মার মত একই আত্মা না হলেও “নিরাপত্তা”, “টেররিজম” এসব শব্দের আড়ালে উভয় রাষ্ট্র উভয়কে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলছিল। এই হরিহর মিলনের মধ্যে কোন খটমটর নাই, আসবে না এই ভাব ছড়ানো হয়েছিল। এমন মিথ্যা ধারণাটা উন্মোচিত হয়ে যেতে শুরু করেছিল ২০১১ সাল থেকে। অথচ ভারত ও আমেরিকা দুজনেই জানত যে মূলত আমেরিকার চীন ঠেকানোর ইচ্ছা থেকে এসব ঘটছে এবং ঘটানো হচ্ছে। যদিও আসলে চীন ঠেকানো অসম্ভব এটাই অবজেক্টিভ বাস্তবতা। একেই আগের কিস্তিতে “উদ্বৃত্ত বাস্তবতা” বলেছিলাম। এই বাস্তবতা অস্বীকার করে যতটুকু ও যতদিন আমেরিকা পরাশক্তি হিসাবে নিজের উঁচু জায়গা জাগিয়ে রাখতে পারে সেই উদ্দেশ্য সাধনে সাময়িক সে ভারতের পিঠে হাত রেখেছিল। কিন্তু উভয়েই এই জানা জিনিষটা লুকানোর ভাব ধরেছিল। বিশেষত ভারত ভাব ধরে ছিল যে সাদা চোখে ধরা পড়া জিনিষটাও সে দেখেও দেখে নাই। যেন এটাই তার পরাশক্তি হবার পথ, যেন আমেরিকা তাকে পরাশক্তি হতে সহায়তা করছে, এই ধারণা প্রণবের সরকারই মিডিয়াতে ছড়িয়েছিল।
আজকের দুনিয়ার মুল দ্বন্দ্ব
আজকে চীন আমেরিকার প্রতিযোগিতা দ্বন্দ্বের মুল বিষয় হল, আগামি গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার কে নিয়ন্ত্রণ করবে? একালেও ব্রিটেনের সাথে আমেরিকার ছোটখাটো স্বার্থবিরোধ দ্বন্দ্ব আছে কিন্তু এই দ্বন্দ্ব তুলনায় তেমন একেবারেই কিছু নয়। তবে এককালে, ব্রিটেন ও আমেরিকার সত্যিকারের একটা বড় দ্বন্দ্ব ছিল, যা ক্রমশ চরমে উঠা আর ফয়সালার সময়কাল ছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টা (১৯১৪-১৯৪৪), এই ত্রিশ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিতর দিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের কর্তা হিসাবে ব্রিটেনের পতন ও পরাজয় নিশ্চিত করে আমেরিকার মাতব্বরিতে নতুন গ্লোবাল অর্ডার সাজিয়ে নেয়া হয়েছিল। যদিও বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে হাজারো বই-পুস্তক সিনেমায় হাজির বয়ান আছে। যেখানে যুদ্ধের মুল প্রতিপাদ্য হল হিটলারের জার্মানি, ইটালি বনাম বাকি পশ্চিমা শক্তি – যেন এমন এক “ন্যায়ের যুদ্ধ” সেটা। জেনারেলদের বীরত্বের এক এক গাথা সেগুলো। কিন্তু কোন বর্ণনায় যেটা বলে না তা হল, ঐ যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ধারক তাতপর্য। তা হল, সারা দুনিয়াকে উপনিবেশ বা কলোনিতে ভাগ করে নেয়া, এক একটা সাম্রাজ্যের অধীন করে রেখে দেয়া আর শিরোমনি হিসাবে থাকা বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা সীমিত বিকশিত গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডারটা ঐ বিশ্বযুদ্ধ শেষে হস্তান্তর হয়ে আমেরিকার হাতে চলে যাওয়া। সেটা ছিল আমেরিকার দিক থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণে -এই প্রথম জাতিসংঘ, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে এক নতুন গ্লোবাল অর্ডার সাজিয়ে নেয়া আর নিজের পরাশক্তিগত উত্থান। অর্থাৎ আগে বৃটিশ সাম্রাজ্যের নেতৃত্বে নড়বড়ে অবিকশিত এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার ছিল কিন্তু এর কোন আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তো ছিলই না। এমনকি কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও ছিল না, ছিল Rothschild family এর পারিবারিক ব্যাংকের মত কিছু প্রতিষ্ঠান মাত্র। এসবের বিপরীতে কায়েম হয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে এক প্রাতিষ্ঠানিক গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার। তবে তা ছিল তখনকার “উদ্বৃত্ত বাস্তবতায়” আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতার জোরে, সামরিক বা গায়ের জোর দেখিয়ে নয়। আর, ব্রিটেন সেকালের উদীয়মান শক্তি আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের পুরানা কলোনি ব্যবস্থা অর্থাৎ তখনকার গ্লোবাল অর্ডারকে টিকানো বাস্তবত অসম্ভব ছিল বলে কিছুই করতে পারে নাই। তবে পরাজিত হবার পর ব্রিটেন আবার আমেরিকার নেতৃত্বে যে নতুন গ্লোবাল অর্ডারটা খাড়া হল সেখানে আমেরিকার খুবই ছোট পার্টনার হয়ে আমাদের মত ছোট অর্থনীতির উপর রুস্তমির ভাগ যতদূর পায় তা টুকিয়ে সেই থেকে দিন চালাচ্ছে।
আজ চীন আমেরিকার প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব ১৯৪৪ সালের ব্রিটিশ-আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বড় দ্বন্দ্বের মতই। দ্বন্দ্বটা একই ধরণের, পুরান ঢলে পড়া গ্লোবাল অর্ডার বনাম আসন্ন নতুন গ্লোবাল অর্ডার; এর নিয়ন্ত্রণ করবে কে –সেটাকেই আমরা আর এক অর্থে মাতবর বা পরাশক্তি হবার লড়াই বলছি। আজ চীন আমেরিকার নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্ডারটা চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছে। এটা ভেঙ্গে দিয়ে নিজের নেতৃত্বে নতুন গ্লোবাল অর্ডার কায়েম করতে চাইছে। দ্বন্দ্বের সারকথা এটাই। ফলে চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্ব লড়াইয়ের মুখে আমেরিকা ভারতকে পাশে রাখতে চায় যাতে ভারত চীনের সাথে নতুন গ্লোবাল অর্ডার খাড়া করবার সহযোগী সাথী না হয়ে ওঠে। সে লক্ষ্য হাসিল করতে আমেরিকা ভারতকে পরাশক্তি হবার মিথ্যা লোভ দেখিয়েছে। মিথ্যা এজন্য যে, পরাশক্তি হওয়াটা কারও সহযোগিতায় পাওয়া না পাওয়ার উপর নয় বরং আপন অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করার উপর নির্ভর করে। ফলে বিষয়টা দাঁড়িয়েছে আমেরিকা প্রলুব্ধ করেছে আর প্রণবের কংগ্রেস সে লোভে মশগুল থেকেছে। এভাবেই স্বপ্ন দেখতে দেখতে কংগ্রেস ইউপিএ সরকারের দশ বছর পার হয়েছে। আর সেই থেকে ভারত একটা পরাশক্তি এমন ভুয়া ধারণা মিডিয়ায় খামাখা চালু হয়ে রয়েছে।
আগে বলেছি ভারতের সামরিক শক্তিতে শ্রীবৃদ্ধি হলেও এর মানে তার পরাশক্তি হওয়া নয়। তাছাড়া মুল কথা, কোন রাষ্ট্র কাউকে সহযোগিতা দিয়ে পরাশক্তি বানিয়ে দিতে পারে না। তবু সামরিক হার্ডওয়ার টেকনোলজির আকাঙ্ক্ষা ও লোভে ভারত আমেরিকার এই প্ররোচনায় পা দিয়েছে। তাও হয়ত হতে পারে। কিন্তু, আমেরিকা কি চীন ঠেকাতে গিয়ে ভারতকে পরাশক্তি হবার সম্ভাবনা বাস্তব করে তুলতে পারে? অর্থাৎ আমেরিকা যদি চীনের পরাশক্তি হওয়া খর্ব করতে চায় সেই আমেরিকা আবার আর এক পরাশক্তি হতে ভারতেকে কি সহযোগিতা আদৌ করতে পারে? কেন করবে? জবাব হল করতে পারে না, কোন কারণ নাই। তবু ভারত সেটা বিশ্বাস করে যে সে পরাশক্তির হতে চলেছে বা হয়ে গয়েছে। এমন স্বপ্নে দিল্লী বিভোর থেকেছে।
তাহলে সারকথা, ভারতের পরাশক্তি হবার আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সঠিক মৌলিক করণীয় কাজ হল সবার আগে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করা, সবার আগে অর্থনীতি ফোকাস করে এগিয়ে যাবার নীতি গ্রহণ করা। “নিরাপত্তার” নামে বাকচাতুরি, আমেরিকাকে ফাঁকি দিতে পারছে মনে করা -এগুলো আসলে নিজেকেই ফাঁকি দেওয়া, সদর রাস্তা থুয়ে ব্যাকডোরে কাজ হাসিল করার মত শর্টকাট কাজ – পণ্ডশ্রম। আবার অন্যদিকে প্রণবের কংগ্রেসের দশ বছরে সর্বোচ্চ জিডিপি ছিল একমাত্র ২০১০ সালের প্রথম দুই মাস, ডাবল ডিজিটে। এরপর এটা পড়তে পড়তে কংগ্রেসের বাকি আমল ছিল পাঁচের নিচে। গত বছর কংগ্রেসের পতনের পরে, এসবের বিপরীতে যা কিছু বুঝে বা মনে করেই হোক মোদীর ভারতের উত্থান অর্থাৎ অর্থনীতি ফোকাস করে নিজের আগানোর নীতি নির্ধারণ স্বভাবতই সঠিক পদক্ষেপ। যদিও মোদী আমেরিকার সাথে ডিল করবে কি করে সে প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিতই রয়েই গেছে।
জুন-সেপ্টেম্বর মোদীর ক্ষমতার প্রথম চার মাসের পরে
আগের কিস্তিতে বলেছিলাম বিগত কংগ্রেসের শেষ কাল থেকে আমেরিকার সরে গেলেও ‘পরাশক্তি ভাব’ ধরা ভারতের তিতে বলেছিলাম বিগত কংগ্রেসের শেষ কাল থেকে আমেরিকার সরে গেলেও ‘পরাশক্তি ভাব’ ধরা ভারতের গোয়েন্দা-আমলাদের মানসিক আমোদ, আদর্শ এবং সুখবোধের উৎস হয়ে থেকে গেছে। আমলাদের এমন মনোগাঠনিক প্রভাব সত্ত্বেও মোদি নিজেকে পরিচালিত করতে সুযোগ পেয়েছিলেন প্রথম চার মাস। এর মধ্যেই ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ওবামার সাথে শীর্ষ বৈঠকের সময় ঘনিয়ে আসে। ফলে আমেরিকার সাথে ভারতের সামরিক হার্ডওয়ার পাবার বিষয়সহ অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সামনে আসে, গোয়েন্দা-আমলাদের মনোগাঠনিক প্রভাবের বাইরে মোদি আর থাকতে পারেন নাই। এর সম্ভাব্য কারণ, মোদী এবং তাঁর টিম ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাব্য যে পথে পরিচালিত করতে চান এনিয়ে স্বপ্ন পরিকল্পনায় যতটা হোমওয়ার্ক করেছেন ততটা সময় আমেরিকার সাথে ডিলিং এর বিষয়ে দিতে পারেন নাই। এর কারণ ভারত-আমেরিকার দেনাপাওনার ফোকাস সিম্পল অর্থনৈতিক নয়। এছাড়া ভারতের চাওয়াগুলো কি করে আদায় করবেন, এমনকি তা কোন জায়গায় রেখে কংগ্রেস সরকার বিদায় নিয়েছে সেখান থেকে এর বাধাগুলো চিহ্নিত করা এবং উত্তরণের পথ কি হতে পারে এনিয়ে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তার টিমকে স্টাডির কাজ দিয়ে হয়ত শুরু করতে হত। আর মুখ্য বিষয় কংগ্রেসের অকেজো “নিরাপত্তা” লাইনের বদলে নিজের “অর্থনীতি” লাইনে চলতে চাইলেও আমেরিকার কাছ থেকে ভারতের সামরিক হার্ডওয়ার পাবার বিষয়সহ অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সেই একই রয়ে গেছে।
ওদিকে নতুন গ্লোবাল অর্ডার যা ভারতেরও অর্থনৈতিক স্বার্থ, তা নির্মাণে BRICS ও AIIB মত প্রতিষ্ঠানগুলো গড়তে মোদী কি চীনের মতই পাশে থেকে সক্রিয় উদ্যোগ নিবেন? নাকি আমেরিকার প্ররোচনায় সেই উদ্যোগে গড়িমসি করে বিনিময়ে আমেরিকার থেকে নিজের অমীমাংসিত স্বার্থগুলো আদায়ে একে ব্যবহার করবেন? বিগত কংগ্রেস এই বিনিময়ের লাইন বজায় রেখে এগিয়েছিল, যদিও বাস্তবে তাতে ভারতের কোন স্বার্থই হাসিল হয়নি, কোনদিকে তেমন ফল দেয় নাই।
সমান মালিকানা শেয়ার, সমান ভোট ফলে মতামতের সমান ওজন
দ্বিতীয় আর এক দোনোমনা অবস্থা ভারতের রয়ে গেছিল। BCIM অথবা BRICS গড়ার প্রশ্নে। যেসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত বা নতুন সিস্টেম গড়ার প্রাইমারি মূলধন বিনিয়োগের প্রশ্ন ছিল সেখানেই চীনের শেয়ার যাতে কোনভাবেই বেশি না হয় তা ঠেকানোর বিষয়টাকে মুখ্য বিবেচনা করে এগিয়েছে। অন্যভাবে বললে ভারত এমন নিয়ম আরোপের পক্ষে কাজ করেছে যাতে উদ্যোক্তাদের সবার বিনিয়োগ সমান হতে হবে, এই নিয়ম আরোপের পক্ষে যুক্তি তুলেছিল। বাস্তবে যে কথার মানে হল, BCIM অথবা BRICS প্রতিষ্ঠানগুলো আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্যারালাল প্রতিদ্বন্দ্বী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়াতে নিজস্ব প্রাইমারি মূলধন চাহিদা যাই থাক এবং তা পূরণের চাহিদা সম্মিলিতভাবে থাক আর না থাক, তাকে ছেঁটে ভারতের নিজের নিচু বিনিয়োগ ক্ষমতার মাপের সীমায় আটকে বামন ও অকার্যকর করে রাখা। ফলাফলে এগুলো প্রভাবশালী কার্যকর প্রতিষ্ঠান হোক না হোক তা ভারতের বিবেচনার বিষয় নয়। অথবা সেকেন্ডারি বিবেচনা। একথা ঠিক আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের গঠন নীতি অনুসারে, ওসব প্রতিষ্ঠানে আমেরিকান শেয়ার সবার চেয়ে বেশি বলে, যে কোন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাধারণ মালিকানা নীতি অনুসারে মালিকানা শেয়ার যার বেশি মানে ভোটের ক্ষমতা তার বেশি, মানে তার নিজের অবস্থান মতামতের ওজন অন্য সবার চেয়ে বেশি। এর ফলাফলে এগুলো হয়েছে আমেরিকান স্বার্থে কান্নি মারা প্রতিষ্ঠান। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের গঠন নীতি অনুসরণে নতুন করে BCIM অথবা BRICS গড়তে গেলে তা একই সমস্যার জন্ম দিবে। ফলে ভারতের উদ্বেগ জেনুইন। কিন্তু এই উদ্বেগের সমাধান করবার ফর্মুলা কোনভাবেই উদ্যোক্তা মালিকানা সবার শেয়ার সমান করে দেয়া হতে পারে না। কারণ এর অর্থ তাতে প্রতিষ্ঠানগুলো বামন ও অকার্যকর করে রাখা হবে। ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতার মাপ মানে ততোধিক নিচু মূলধন বিনিয়োগের ক্ষমতা। মনে রাখতে হবে আমরা এই প্রাইমারি মূলধন বিনিয়োগ বলতে বাণিজ্যিক বিনিয়োগের কথা বলছি না। এটা অবকাঠামোগত অথবা নতুন অর্থনৈতিক সিস্টেম গড়ার প্রাইমারি বীজ-পুঁজির কথা বলছি। যে বিনিয়োগের লক্ষ্য মুনাফা নয়, এই বিনিয়োগ থেকে মুনাফা আসবে আধা পার্সেন্টের নিচে অথবা হয়ত কোন মুনাফাই নয় এমন। ফলে ভারতের এমন বিনিয়োগ সক্ষমতা বাণিজ্যিক বিনিয়োগ সক্ষমতার চেয়েও কম হবে। তাহলে আমাদের এই পথে নয়, অন্য সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। অর্থাৎ ভারতের উদ্বেগ অস্বস্তি জেনুইন, কিন্তু সমাধানের প্রস্তাবনা নয়। কি হতে পারে সম্ভাব্য সমাধান?
মালিকানা শেয়ার ভিত্তিতে ভোট বা বক্তব্যের ওজন – সিদ্ধান্ত ও পরিচালনা নীতি এমন না করে সদস্যদের মালিকানা শেয়ার অবশ্যই অসমান হবে আর তা যার যাই হোক, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি যদি হয় কনসেনসাস বা ঐক্যমত্য এবং অবজেক্টিভ টেকনিক্যাল সিদ্ধান্ত বিবেচনা তাহলে সহজেই এই সমস্যার একটা সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। অর্থাৎ কারও মালিকানা ভোটকে তার অবস্থান বক্তব্যের ওজন থেকে বিচ্ছিন্ন করা। অবস্থান মতামতকে নিজ মেরিটে গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী হতে হবে, ভোটের ক্ষমতার জোরে নয়। এটা করতে পারলে প্রধান সুবিধা যা পাওয়া যাবে তা হল, চীনের হাজির প্রবল বিনিয়োগ সক্ষমতাকে BCIM অথবা BRICS ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়তে পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করা। যেটা BCIM অথবা BRICS বা AIIB এসব প্রতিষ্ঠানকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মত প্যারালাল সমতুল্য প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে হাজির করতে পারে। ঠিক এরকম অন্য কারও কোন প্রস্তাবও হতে পারে। কিন্তু মূলকথা, মালিকানা ভোটের ভয়ে নব প্রতিষ্ঠানগুলোকে বামন করে রাখা যাবে না। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে নতুন কিন্তু বামন প্রতিষ্ঠান করা আর না করা সমান। কোন অর্থ হয় না তাতে।
প্রণবের বিপরীতে মোদীর ভারত কি এসব দিকে ভাবতে রাজি? আমরা একেবারেই নিশ্চিত নই। আমরা অপেক্ষা করছি। মোদী সম্পর্কে মূল্যায়নে শেষকথা বলার সময় এখনও আসেনি। আর তাঁর “অর্থনীতি” ফোকাসের নীতির কারণে এই নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মোদীর পক্ষে এমন চিন্তা করা অবশ্যই সম্ভব হলেও তিনি তা করবেন, তাঁর গোয়েন্দা-আমলাদেরকে পিছনে ফেলে আগাতে পারবেন এতদূর এখনই বলা ঠিক হবে না। তবে আরও কিছু ফেভারেবল দিক আছে; যেমন, চীনের প্রতি তাঁর সাধারণ মনোভাব অন্তত প্রণবের মত নয়। আমেরিকার প্রতি সাধারণ মনোভাবও অন্তত প্রণবের কংগ্রেস বা ভারতের গোয়েন্দা-আমলাদের মত নয়। আমেরিকা ভারতকে একটা “পরাশক্তি ভাব” দিবার সক্ষমতা বাস্তবতায় থাক আর না থাক তাকে ঢলে পড়তে হবে, না দিলে আবদার অথবা আকাঙ্ক্ষার সুখবোধে বিভোর থাকতে হবে – এমন একেবারেই নয়। তবুও মোদীর অবস্থান দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ওবামার সাথে মুলাকাতের প্রথম পর্ব মোদীর শেষ হয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। তাতে মোদীর ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের অমীমাংসিত এবং জট পাকিয়ে যাওয়া ইস্যুগুলোর সাথে সাক্ষাত বাস্তবতার সাথে পরিচিত হয়েছেন। আমরা অনুমান করতে পারি, আমেরিকার সামরিক হার্ডওয়ার টেকনোলজি পাবার বিষয়ে তিনি যতদূর নমনীয় হওয়া সম্ভব হবেন। কিন্তু সেটা BRICS বা AIIB এসব প্রতিষ্ঠানকে অকেজো করে রাখার বিনিময়ে নয়। এই ভরসা রাখছি এজন্য যে শেষ বিচারে মোদী তাঁর অর্থনীতি” ফোকাস থেকে সম্ভবত কোনভাবেই সরবেন না। কারণ তাঁর “অর্থনীতি” ফোকাস আকাঙ্ক্ষাকে জীবিত রাখতে চাইলে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব তাঁর চেয়ে ভাল আর কে বুঝে। এই পটভূমিতে ওবামা এমাসেই ভারত সফরে আসছেন বিশেষ দাওয়াতি হিসাবে। ভারতের “প্রজাতন্ত্র দিবস” মানে কনষ্টিটিউশন গৃহীত হবার দিন, ২৬ জানুয়ারি উৎযাপনে, প্রধান অতিথি হিসাবে। থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজারভার হিসাবে খ্যাত সি রাজামোহন এটাকে বলছেন ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের দিক থেকে মোড় ঘুরার সফর। অর্থাৎ ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের মধ্যে যে দোলাচল আছে তা অনেকটা থিতু হবার সফর। তিনি একটা বিশেষ দিকে নজর এনেছেন যার সারকথা হল, গত সেপ্টেম্বরের মোদীর সফরের সময় ওবামা-মোদী উভয়ে তাদের আমলা প্রশাসনের অবস্থান মতামতকে পিছনে ফেলে বাণিজ্য বিষয়ে ঝগড়ার মীমাংসা করেছিলেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, পত্রিকায় তিনি লিখছেন, … suggests that the two leaders had personally driven their bureaucracies to bring the dispute on trade facilitation to an end.। ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের মধ্যে সামরিক ইস্যু ছাড়াও অন্য মুল ইস্যু হল WTO সম্পর্কিত বাণিজ্য সুবিধাদি নিয়ে বিতর্ক। অর্থাৎ আমলা প্রশাসনের মতামতের ভিত্তিতে পুরাপুরি পরিচালিত না হয়ে বরং এর উপরে নিজেদের রাজনৈতিক বিবেচনাকে স্থান দেবার একটা চল মোদী-ওবামা উভয়ের মধ্যে আছে। এই বিচারে ওবামার এই সফর থেকে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে থিতু হচ্ছে এর আরও কিছু অগ্রগতি এখানে আমাদের দেখতে পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও রাজামোহনের দৃষ্টিতে এই সফরকে দেখার করার দরকার নাই। মনে রাখতে হবে, তিনি ভারতকে আমেরিকার “ষ্ট্রাটেজিক পার্টনার” হিসাবে দেখতে চাইবার লোক। এখানে “ষ্ট্রাটেজিক পার্টনার” কথাটা ভাঙলে এর সারার্থ, চীন বিরোধী হয়ে ভারত-আমেরিকার আগানোর ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থ জোট।
নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রতি প্রণব মুখার্জির দৃষ্টিভঙ্গী
প্রণবের বিপরীতে মোদীর ভারত কি এসব দিকে ভাবতে রাজি? সে প্রসঙ্গে যাবার আগে পুরানা গ্লোবাল অর্ডারের প্রতি প্রণবের মনোভাব সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেয়া যাক। এটা শুধু প্রণবের মনোভাব নয় বরং বিগত কংগ্রেসের সরকার যে রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করেছে তা হল – ভারত চীনের সাথে এসব প্রতিষ্ঠান গড়তে চলে যেতে পারে আমেরিকাকে এই ভয় দেখিয়ে এটাকে জিম্মির বুটি বানিয়ে এ থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা। সারকথায় পুরানা গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডারটার আয়ু আরও লম্বা করে দেওয়া। যেমন, ভারতের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি হয় নি সেটা বিবেচ্য না, কিন্তু ভারতের লোভ বর্তমান জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে চীন বা আমেরিকার মতই ভেটো মেম্বার কিভাবে হওয়া যায়। আর এই লোভের কথা টের পেয়ে আমেরিকারও তাকে মুলা ঝুলিয়ে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মিথ্যা লোভের তীব্রতা বুঝার জন্য ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হাসিনার প্রথম ভারত সফরে মনমোহন-হাসিনার যে ৫১ দফা যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর হয়েছিল এর ৪৮ নম্বর দফা দেখা যেতে পারে। ঐ দফা বলছে, “ভারতের ভেটো মেম্বার হবার খায়েসে বাংলাদেশ ভারতকে সমর্থন করে”। অর্থাৎ এর অর্থ হল, প্রণবের ভারত কল্পনায় নিজেকে এমন এক আগামী দুনিয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে আদতে পুরানা গ্লোবাল অর্ডারটাই থাকবে আর আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম ভারতকে চীন ঠেকানোর পুরস্কার হিসাবে তাদের স্বার্থে সাজানো গ্লোবাল অর্ডারকে টিকিয়ে রাখে এমন জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের মতই সমান গ্লোবাল ক্ষমতায় ভারতকে পাশে বসাবে। এভাবে পুরান ময়লার ভিতরে প্রণবের ভারত নিজের ভবিষ্যৎ দেখে, এর বেশি ভাবতে পারে না। এটা ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বের চিন্তা-প্রতিবন্ধতার সমস্যা, তারা স্বপ্ন দেখতেও শিখেনি। তারা জানতে শিখতে খবর করতে এখনও অক্ষম যে ১৯৪৪ সালে কোন শর্ত বা পরিস্থিতিতে পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এসব গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানগুলো আমেরিকা গঠন করে নিতে পেরেছিল। কাদের মধ্যে ভেটো ক্ষমতা ভাগ করে নেয়া হয়েছিল, কেন তা সম্ভব হয়েছিল। এ সম্পর্কে স্টাডি করে সেটা না বুঝলে এটা বুঝা যাবে না এই অর্ডার ভেঙ্গে পড়বে কেন এবং কখন। কোন্ আলামত দেখলে তা বুঝা যাবে। অথবা কেন তারা আজ গ্লোবাল অর্ডারের পড়তি দশায় ভারতকে তাদের সমান আসনে বসাবে অথবা আদৌ বসিয়ে দিতে পারে কি না। একদম মৌলিক প্রশ্ন – জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা কি কেউ কাউকে অনুগ্রহ করে অথবা চীনকে জিম্মি করার বুটি হিসাবে দিবার বিষয়? নাকি নিজেই নতুন গ্লোবাল অর্ডার গড়ে নিজেই তা নিবার বিষয়? প্রণবের কংগ্রেস চিন্তা কতবড় নাবালক এরই প্রমাণ এগুলো। ভারতের ভেটো সদস্য হবার স্বপ্ন দেখাটা শুধু স্বপ্ন অর্থ কোন সমস্যার নয়। কিন্তু চিন্তার দেউলিয়াত্ব বা সমস্যা হল, নতুন গ্লোবাল অর্ডার গড়ে উঠার উদ্যোগে সামিল না হয়ে বরং আমেরিকার অনুগ্রহে পাবার চেষ্টা আর পুরান অর্ডারের ময়লা ঘেঁটে এর মধ্যেই নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপায় মনে করা। তারা ভুলে থাকতে চায় অথবা খেয়াল করেই হয়ত দেখেনি যে, আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম ভারতকে তাদের সমমর্যাদা দিবার লোভ দেখানোর অর্থ কি? এটা কি পশ্চিমের নিজেদেরই ঢলে পড়া গ্লোবাল অর্ডারে নিজেদের গুরুত্ব বা মর্যাদাকে চ্যুত করা নয়? সারকথায় পশ্চিমের উপস্থিত সমস্যা হল, পুরান গ্লোবাল অর্ডারের পড়ে যাওয়াটাকে কি করে ঠেকানো যায় অথবা অন্ততপক্ষে দেরি করিয়ে দেয়া যায়। সেই দশায় সে কাকে কি দিতে পারে? কেন দিবে? আমাদের সৌভাগ্য যে প্রণবের এসব এবসার্ড স্বপ্ন তাদের সরকার ক্ষমতা থাকা অবস্থাতেই অকেজো, ফলহীন বৃক্ষ হয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল। তাসের ঘরের মত প্রণবের স্বপ্নের ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক নন-ফাংশনাল হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এটা আজ প্রমাণিত যে এই লাইন অনুসরণ করে ভারতের পাতে কিছুই আসেনি। আমেরিকার সাথে তার জমে উঠা দূরে থাক, এশিয়ায় আমেরিকার ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থকে জায়গা করে দিতে গেলে এখন খোদ ভারতের মৌলিক স্বার্থ জলাঞ্জলি যায় এটা আজকের বাস্তবতা। ফলাফলে আমেরিকার সাথে মনোমালিন্য আর ঝগড়া তুঙ্গে নিয়ে কংগ্রেস ভারতের ক্ষমতাকাল শেষ করেছিল।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, প্রণবের এই অবাস্তব ও অকেজো আমেরিকান অনুগ্রহ পাবার স্বপ্নের বলয়ের মধ্যেই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে। হাসিনা-প্রণব সম্পর্কের গভীরতা বাংলাদেশকে দিল্লি হয়ে মার্কিন অনুগ্রহের মধ্যে রাখা সম্ভব হয়েছিল, ঢাকা ওয়াশিংটনের বিভিন্ন ইস্যুতে দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও। প্রণবের দিল্লি বোঝাতে চেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার দায় দিল্লির, বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন মনোমালিন্য সেই ক্ষেত্রে বড় কোন সংকট হয়ে ওঠে নি। প্রশ্ন হচ্ছে দিল্লীর মার্কিন অনুগ্রহ পাবার মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থ কি? সেটা বোঝা যাবে ভারতের মনমোহনের সাথে শেখ হাসিনার যৌথ ঘোষণার মধ্যে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে যা স্বাক্ষরিত হয়েছে। অর্থাৎ হাসিনার ক্ষমতায় আসার প্রায় ঠিক একবছর পর। এটা ভারতের সমর্থনে হাসিনার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার স্বপ্ন, হাসিনা মানে দিয়েছিলেন যে তার স্বার্থই বাংলাদেশের স্বার্থ। এমনকি দল হিসাবে এটা আওয়ামী লীগের স্বার্থ এটাও অনিবার্য ধরে নেয়ার কারণ নাই। প্রণবের সরকারের আয়ু-দশাতেই এটা প্রমাণিত যে প্রণব ও কংগ্রেসের স্বপ্নটাই অবাস্তব। ইতোমধ্যে ভারতে সরকারই বদলে গিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এখনও সে পথেই আছেন। ভারতের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যে সকল বিষয় ভারতের স্বার্থে যায় তাকেই হাসিনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানদণ্ড মেনে সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছেন।। এই ভরসায় যে দিল্লী তাতে অনুরাগ বোধ করবে এবং মূল্য হিসাবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ভারতের স্বার্থ হয়ে উঠবে। প্রণব যেমন ছিলেন, এখন মোদীও যেন হাসিনার পক্ষে ভারতের সমর্থন নিয়ে হাজির হন বা হবেন। কিন্তু এর মিসিং লিঙ্ক হল, প্রণব বা কংগ্রেস সরকার ক্ষমতাচ্যুত। যদিও একই চিন্তার লাইনের গোয়েন্দা-আমলারা রয়ে গেছেন। কিন্তু মোদী কি গোয়েন্দা-আমলাদের দ্বারা প্ররোচিত প্রভাবিত হবেন? এখনও কিছুই স্পষ্ট নয়। আপাতত এতটুকু বলা যায় যে মোদীর সরকার পরিচালনা নীতি স্পষ্টতই সেদিকে নয়। মোদী প্রণবও নন।
[এই রচনা প্রথমে চিন্তা ওয়েবে ছাপা হয়েছিল এখানে গত ১৮ জানুয়ারী ২০১৫। এখন এখানে আরো আপডেটসহ আবার এডিট করে ছাপা হল।]