মমতার বাংলাদেশ সফর ও প্রত্যাশা
গৌতম দাস
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
ছোট লিঙ্কঃ http://wp.me/p1sCvy-9n
পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ঢাকা সফরে এসেছেন। এমন সময়ে তার আসা যখন আমরা বিরাট রাজনৈতিক সংকট, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। এই সংকটে ভারতের অবস্থান কোন দিকে এ’সম্পর্কে জানতে আমরা আগ্রহী, বিশেষত দিল্লি আর কলকাতার অবস্থানের ঐক্য ও পার্থক্য আমরা বুঝতে চাই। বলা বাহুল্য, এখানে ভুল করার বিশেষ কোন অবকাশ নাই যে মমতা একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোন প্রতিনিধি তিনি নন, প্রতিনিধিত্ব তিনি করছেনও না, করার সুযোগও নাই। তাহলে মমতার এই সফরের প্রয়োজন দেখা দিল কেন?
এর দুটো দিক আছে। এক, হাসিনা সরকার কেন মমতার সফরে আগ্রহ দেখালেন? আর দুই, মমতা এই সফর কেন প্রয়োজন মনে করলেন? এই দুটো বিষয় নিয়ে আমরা এখানে কথা তুলব।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের দিক থেকে বিচারে ভারতের কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকতে পারে তবে দিল্লির নীতি নির্ধারক শক্তি হিসাবে মনেকরে তাকে গণনায় নেবার কোন কারণ নাই। না রাষ্ট্রীয় প্রটোকল হিসাবে না ব্যবহারিক সুবিধার কারণে। ভারতের যে কোন রাজ্য সরকারের সাথে আমাদের সৌজন্যমূলক সম্পর্ক থাকাটাই যথেষ্ট, কারণ খামাখা সম্পর্ক খারাপ করার কোন মানে হয় না। ভারতের কনষ্টিটিউশনে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক অনুসারে যেসব প্রাকৃতিক সম্পদ রাজ্যের ভাগে পড়েছে সে বিষয়ে কোন বৈদেশিক চুক্তির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হলে রাজ্য সরকারের মতামতের সঙ্গে সমন্বয় করার বাধ্যবাধকতা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আছে। তবে আবার কোন বিদেশি কোম্পানীকে কারখানার জমি বরাদ্দ দেবার ক্ষেত্রে রাজ্যের ভুমিকাই প্রধান, কেন্দ্র সেই ক্ষেত্রে পিছনে। ইত্যাদি। কিন্তু বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলোকে নিয়েই যে ভারত ইউনিয়ন সেই সমগ্র ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করার এখতিয়ার একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের। কেন্দ্রীয় সরকার কি করে রাজ্য সরকারকে নিজের প্রতিনিধিত্বের অধীনে আনবে সেটা নিশ্চিত করবার দায়ও কেন্দ্রীয় সরকারের। যেমন কেন্দ্রীয় সরকার নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে কোন চুক্তি করার সময় রাজ্য সরকারকে কেমন করে দিল্লির সিদ্ধান্ত-বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করে সেটা তাদের ব্যাপার। আমাদের সাথে চুক্তি করতে আসবে কেন্দ্রীয় সরকার, তার দায়দায়িত্বও কেন্দ্রীয় সরকারের । তবে বুদ্ধিমানের মত “ইনফরমালি” আমাদের জেনে রাখা জরুরি ও ভাল যে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি রাজ্যের সম্মতি রয়েছে কিনা। ঐ সম্মতি সাথে নিয়ে কেন্দ্রের প্রতিনিধি এসেছেন কি না। অর্থাৎ ঐ ইস্যুতে ভারতের যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-আমলা কথা বলতে এসেছেন ‘বাস্তবে’ তিনি রাজ্যেরও প্রতিনিধিত্ব সত্যিই করছেন কিনা সেটা আমাদের জানা থাকা দরকার। কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে কোন মতদ্বৈততা থাকতে পারে যা না জানলে দিল্লির সঙ্গে কোন বিষয়ে চুক্তি এক হাওয়াই চুক্তি হয়ে থেকে যেতে পারে। এমন রেকর্ডও আছে যেমন, কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী-আমলা জানতেন যে তারা রাজ্যকে সহমতে না নিয়েই বাংলাদেশে চুক্তি করতে আসছেন। তবু তারা এসেছেন আর আসার আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বলে এসেছেন যে চুক্তিটা হয়ে যাবার পরে আপনার আপত্তি আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে চিঠি দিলে আমরা এরপর চুক্তির বাস্তবায়ন না করে ফেলে রাখব। ফলে আপনার অসুবিধা হবে না। এতে সত্যমিথায় যাই থাকুক দিল্লি এটা করে এবং দুর্বল প্রতিবেশির সঙ্গে তাদের এ ধরনের অসৎ সম্পর্ক চর্চা অস্বাভাবিক কিছু নয় বাংলাদেশে এই বিশ্বাস বেশ প্রবল। গত তিস্তাচুক্তির সময় এমন কথা শোনা গেছিল। এরপর আমাদেরকে জানানো হল যে মমতার জন্যই নাকি ঐ চুক্তিটা হয় নাই। অথচ এটা তো আমাদের জানার বা শোনার কথা নয়। কারণ আমাদেরকে যদি এমন কথা শুনতেই হয় তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলে যারা আমাদের কাছে এসেছিলেন সেই মনমোহন সিং বা প্রণব মুখার্জি আসলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কেউ ছিলেন না, তারা প্রতিনিধি ছিলেন না। ভারতের প্রতিনিধিত্বের ম্যান্ডেট বাস্তবে তাদের ছিল না। সরকারে থেকেও তারা সরকারি নন। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যেন যার গোডাউনে মাল নাই অথবা যে মাল আছে সেটা তাঁর নিজের নয় সেই পার্টির সাথে পণ্য বিনিময় চুক্তি করতে গিয়েছিলাম আমরা। এই পরিস্থিতিতে আমরা কি দেখলাম? দেখলাম যে চুক্তি হতে গিয়েছে দিল্লির সঙ্গে, কিন্তু তার কোন খবর নাই, আর অন্যদিকে কলকাতার মুখ্যমন্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, খাতির জমানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। অর্থাৎ যেটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায় এবং কাজ উভয়ই আমরা নিজের কাঁধে নিলাম। সেই থেকে বাংলাদেশে কলকাতার মুখ্যমন্ত্রীর গুরুত্ব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছি কিম্বা ভারতের রাজনীতিবিদরা আমাদের প্রতারিত করবার জন্য কি ধরনের ছুতা ব্যবহার করে তার বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা সম্পর্কে আমাদের ভালই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
ভারতের এই কপট কূটনীতি প্রসঙ্গে আরও দুটো কথা বলা জরুরি। এমনিতেই হাসিনার এই ভারত-খাতিরের জমানায় আমরা ভারতের সাথে বাংলাদেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো যেন কেবল তিস্তা আর ল্যান্ড বাউন্ডারির দুই ইস্যু সেই স্তরে নামিয়ে এনে দিয়েছিলাম। সীমান্ত হত্যা, বাকি নদীর পানি বন্টন ইত্যাদি আর কোন ইস্যু যেন আমাদের আর নাই। ওদিকে ল্যান্ড বাউন্ডারি – আমাদের সাধারণ্যের প্রচলিত ভাষায় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি – তা মুলত ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরার মধ্যে সেকালে স্বাক্ষরিত হওয়া এক চুক্তি। ফলে সেকালের ঐ চুক্তিতেই তা শেষ হবার কথা। কিন্তু সেকালে চুক্তি একটা হয়েছিল বটে কিন্তু বাস্তবায়নের খবর আজও হয় নাই। অর্থাৎ আজও কাগজে কলমে মীমাংসিত বিষয়টা আসলে একটা অমীমাংসিত ইস্যু হয়ে আছে। ছিটমহল বিনিময় চুক্তির শর্ত অনুসারে দুই রাষ্ট্রের সংসদে ঐ স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসম্মতি জানিয়ে অনুমোদন দেবার কথা ছিল। বাংলাদেশে আমরা তা সততার সঙ্গে করেছিলাম সেকালেই, কিন্তু ভারতের পার্লামেন্ট এখনও তা করেনি। আদালতে মামলা আছে এই অজুহাতে এখনও সেটা পেন্ডিং। যদিও ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে ঐ চুক্তি হতে পারে বলে রায় দিয়ে মামলা চূড়ান্ত নিস্পত্তি করে দিয়েছে গত ১৯৯৪ সালেই। সেই থেকে ইস্যুটা ঝুলে ছিল। এদিকে এখনকার পার্লামেন্টে চুক্তির বিপক্ষে দেওয়া আপত্তির যুক্তি বেশ অদ্ভুত। ভারতের বিগত পার্লামেন্টে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি বা মমতার দলের আপত্তি ছিল এরকম যে, যেহেতু এখানে সমান পরিমাণ ছিটমহলের জমি বিনিময় হবে না, ভারত কম পাবে তাই এই চুক্তি তারা পার্লামেন্টে পাশ করবে না। প্রথম ধাক্কায় শুনতে অনেকের মনে হতে পারে যে এই কথায় বোধহয় যুক্তি আছে। কিন্তু সে ধারণা ভিত্তিহীন। অল্পকথায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট চুক্তিটা হতে পারে বলে রায় দিয়েছিল ওর যুক্তিটা শুনলে আমরা বুঝব যে এসব কথা ঈর্ষাকাতর এক পেটি-মনের চিন্তা ও ছলনা মাত্র।
যেকোন আধুনিক রাষ্ট্রের গঠনের ভিত্তিগত ধারণা বা পিছনের চিন্তা হল, নতুন রাষ্ট্র ঘোষণা মানেই ওর ভুখণ্ডগত সীমারেখাসহ তা উল্লেখ করে তার ওপর ঐ রাষ্ট্রের সার্বভৌম এখতিয়ার ঘোষণা। পরবর্তিতে রাষ্ট্রের কোন নির্বাহী (প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা পার্লামেন্ট) ঐ ঘোষিত রাষ্ট্রীয় ভুখন্ডের কোন অংশ অন্য কোন রাষ্ট্রকে দিয়ে দিতে বা বিনিময় করার ক্ষমতা রাখে না। এই যুক্তিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার ঐ চুক্তি অবৈধ এবং পার্লামেন্ট ঐ চুক্তির পক্ষে অনুসিদ্ধান্ত জানাতে পারে না বলে আদালতে মামলা করা হয়েছিল। এর বিপরীতে এই মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে নিস্পত্তি করার যুক্তি হল – ঠিকভাবে দেখলে এটা ভারতের ভূখন্ড বাংলাদেশকে দিয়ে দেওয়া বা বিনিময় করার মত কোন চুক্তি নয়। মূলত এটা, ১৯৪৭ সালে তৎকালীন ভারত-পাকিস্তান দুটো আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সময় উল্লেখিত ভুখণ্ডের কোন অদল-বদলও নয়। বরং চুক্তিটা হল, ঐ গঠন-ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মাঠপর্যায়ে সীমা চিহ্নিত করণের পর্যায়ে দীর্ঘকালীন বিষয়টি অমীমাংসিত ফেলে রাখা বিষয়ের মীমাংসা। অতএব এই চুক্তি হতে পারে। অর্থাৎ এটা মাঠ পর্যায়ে সীমা চিহ্নিত করণের মামলা মাত্র। কোন জমি অদলবদলের চুক্তি নয়।
একই যুক্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এখন একমাত্র সমান পরিমাণ জমির বিনিময়ই কেবল এই চুক্তি হতে পারে বা হতে হবে এমন কথার কোন ভিত্তি নাই। তাহলে বিনিময় বলা হচ্ছে কেন? কারণ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশ ঘেরা ভুখন্ডে অথবা বাংলাদেশের নাগরিকের বেলায় উলটা ভারতের ভুখন্ডে এই অবস্থায় আছে। ফলে উভয় পক্ষেই নাগরিকেরা নিজ নিজ মুল রাষ্ট্র ও ভুখন্ডের সাথে যুক্ত হবে তাই বিনিময় ধরণের একটা ধারণা এখানে প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু আইনী ভাষায় এটা মূলত উভয় রাষ্ট্রের অমীমাংসিত সীমানা চিহ্নিত করণের মামলা। এখানে চিহ্নিতকরণের পরের হিসাবে কারও ভাগে জমি কম বেশি হতেই পারে। কিন্তু সেই হিসাবটা চুক্তির ভিত্তি নয়, সেটা চুক্তির জন্য কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়। অতএব ভারতের পার্লামেন্টের বিরোধীদের যুক্তি ভিত্তিহীন। এছাড়া বাংলাদেশের চোখে দেখলে, এটা মমতার বা তার রাজ্য সরকারের বিষয় নয়। এটা সমগ্র ভারতের প্রতিনিধিত্ত্ব করে বলে দাবিদার কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। তাদেরই আইনী বাধ্যবাধকতা। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার আপত্তি কি এটা শোনা বা দেখার দায়দায়িত্ত্ব আমাদের নয়। ফলে মমতার কাছে আমাদের দেনদরবার করার কোন যুক্তিই নাই। রাষ্ট্র হিসাবে আমরা চিনি কোন রাজ্য সরকার নয় কেবল কেন্দ্রীয় সরকারকে, যে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করে দাবি করে আমাদের সাথে চুক্তি করতে আসে বা এসেছিল।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটা হল পানি চুক্তি, বিশেষ করে তিস্তা পানি চুক্তি। মমতাসহ যারা এই চুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিল তাদের যুক্তির প্রসঙ্গে যাব। এ প্রসঙ্গে প্রায়ই একটা কথা শুনতে পাই যে, নদীতে পানিই নাই ভারত দিবে কোথা থেকে। অথবা প্রাকৃতিক পানি এখন কমে আসছে তাই আমরা কতদুর কি করতে পারি। অথবা মমতার ক্লাসিক যুক্তি – তিস্তার পশ্চিমবঙ্গ অংশের অববাহিকা অঞ্চলের লোকেরাই চাষাবাদের পানি পাচ্ছে না, আমরা আর কি দিব। ইত্যাদি। অর্থাৎ পানি চুক্তির প্রসঙ্গটা যেন ভারতের প্রয়োজন মিটানোর পর আমাদের দিবার মত পানি থাকে কি না এর ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া এই “প্রয়োজন” কথাটাকে কি দিয়ে ব্যাখ্যা করব? বুঝব? পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পানির ‘প্রয়োজন’-এর সীমা কিভাবে কোথায় টানব? মানুষের প্রয়োজনও অসীম। এখানে পুরা তর্কটাকে পর্যবসিত করা হয়েছে আগে পশ্চিমবঙ্গের “প্রয়োজন” মিটাতে হবে এরপর বাংলাদেশ। না থাকলে নাই। ভারতের দিক থেকে এটা একটা ম্যানেজমেন্টের প্রশ্ন। কিভাবে তারা তাদের “প্রয়োজনের” সমস্যাটাকে আগে মিটিয়ে নেবে তারপর বাংলাদেশের জন্য কি করতে পারে সেটা বিবেচনা করবে। অর্থাৎ ভারত সদয় পানিদাতা আর আমরা ঐ দাতার ভিক্ষাপ্রার্থী। আন্তরাষ্ট্রীয় কমন নদীর ক্ষেত্রে ভাটির দেশ আমরা, উজানের দেশ ভারত পানি আটকে রেখে দিয়েছে আর আমরা তার ভিক্ষা প্রার্থী? তাই কি? আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের দেনাপাওনা ভিক্ষা বা দয়ার উপর দাঁড়ায় না। বিশেষত স্বার্থের প্রশ্নে দয়া বা ভিক্ষা চলে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি দয়াদাক্ষিণ্য প্রদর্শনে পর্যবসিত হয়।
না আমরা মোটেই পানিভিক্ষাপ্রার্থী না। আন্তর্জাতিক নদী আইন বলছে, উজান দেশের মত ভাটির দেশও সমান কমন নদীর পানির ভাগীদার। এটা তার হক। এছাড়াও উজানের দেশ নদীর মুল ধারা থেকে খাল কেটে বা বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিতে সে পারে না। তিস্তা নদীর ক্ষেত্রে নদীর সিকিম অংশে তাই করা হয়েছে। তাহলে দাঁড়ালো, পানি ভাগাভাগির আসল ভিত্তি হল, ভাটির দেশের হক ও অধিকার। উজানের দেশের কাছে সে পানির জন্য ভিক্ষাপ্রার্থী নয়। আগে উজানের দেশের পানির প্রয়োজন মিটানো এরপর যদি থাকে তবে বাংলাদেশ পাবে এই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে দিল্লিকে দেয়া হয় নি, দেয় না। অতএব ভারতের পানির প্রয়োজন কত তা জানারও কোন প্রয়োজন আমাদের নাই। অথচ পানি ভাগাভাগির আলাপ উঠলেই ভাগের ভিত্তি কি এটা অস্পষ্ট থেকে যায়। ভাগের ভিত্তি কি তা অস্পষ্ট রেখে মিডিয়াসহ সব জায়গার আলাপ শুরু হয়ে যায় ভারতের প্রয়োজনের গল্প। আজ পর্যন্ত কোন পানির আলোচনায় পানি ভাগের ভিত্তি কি এনিয়ে কোন কথা আমরা শুনি নাই। সব খানে বয়ানটা হল ভারত পানির সদয় দাতা। আশা করি মমতার এই সফরেও আমরা এই একই গান শুনতে পাব। মমতা দির দয়ার ওপর তিস্তার পানি পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে গণমাধ্যমগুলো এই বাজে তর্ক করে যাবে।
দুই
মমতার দিক থেকে তাঁর বাংলাদেশ সফরের তাগিদটা কি? আমার আগের লেখায় বলেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নির্বাচন আগামি বছর ২০১৬ সালের মে মাসে। ইতোমধ্যে মমতা এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন। ৩৪ বছরের বামফ্রন্টকে পরাজিত করে গত ২০১১ সালে নির্বাচনে রাজ্য সরকার দখলের চেয়েও প্রভাবের দিক থেকে এটা আরো বড় বিপ্লব। বড় তার তাৎপর্য। কে কি ধরণের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে ভোটে জিতেন সেই ভোটারদেরকে বলা হয় কনস্টিটুয়েন্সী। আমরা এই ধারণাকে নামিয়ে ক্ষুদ্র করে অর্থ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এমপি কোন এলাকা থেকে জিতে এসেছেন ঐ “এলাকার” অর্থে আমরা কনস্টিটুয়েন্সী শব্দটাকে নামিয়ে এনেছি। যদিও এর মূল অর্থ এমপি কাদের প্রতিনিধি, কোন ভোটাররা তাকে ভোট দিয়েছেন তারাই ঐ এমপির কনস্টিটুয়েন্সী – এটাই এর অর্থ।
তো এই অর্থে মমতার দল তৃণমুলের মূল কনস্টিটুয়েন্সী এখন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটাররা। যেখানে মুসলমান ভোটার মোট ভোটারের ২৮%। যারা এরআগে প্রথমে কংগ্রেস ও পরে বামফ্রন্টের ভোটার ছিল। এখন মমতার অবদান তিনি মুসলমান ভোটারদের মুসলমান হিসাবেই মুক্তি দিয়েছেন, তাদের এখন আর “সেকুলার” ভোটার বলে অকেজো ধারণার আড়ালে লুকানোর দরকার নাই। তারা যা তাই। পিছিয়ে পড়া দশা থেকে বের হতে তাঁরা এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের রিসোর্স বরাদ্দে নিজের অংশ দাবি করতে পারে। আগামি দিনে কতদুর এর বাস্তবে পারবে কি দাঁড়াবে সেসব আলাদা প্রশ্ন। অর্থাৎ এসবের প্রতি রাজনৈতিক স্বীকৃতির প্রসঙ্গ এখন সামনে এসে গেছে। একধরণের রাজনৈতিক স্বীকৃতি এসেছে, এখন দেখার বিষয় অর্থনৈতিক অর্থে এটা কতটা কতদিনে বাস্তবায়িত হয়। মুসলমান ভোটারদের ইস্যু বাকি সব কলকাতা কেন্দ্রিক দল যেমন বিজেপি, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জন্য বিরাট মাথাব্যাথার ইস্যু হয়ে গেছে।
এর অর্থ বাকি ৭২% ভোট এখন তৃণমূল সহ চারটা দলের মধ্যে ভাগ হবে, ভোটের সংখ্যার এই সংখ্যাতত্ত্ব পশ্চিমবঙ্গের আগামি নির্বাচনে মূল নির্ধারক, মূল নির্বাচনি ইস্যু। এখান থেকেই দলগুলোর রাজনৈতিক বয়ানের ভিন্নতা এবং মিল। যেমন ইদানিং বিজেপি ও বামফ্রন্টের বয়ানের ফারাক খুজে পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। কারণ এখন মূল বয়ান হতে হবে এন্টি-মুসলমান যেটা এন্টি-তৃণমূল হয়ে কাজ করবে, তৃণমূলকে কাটবে। কিন্তু সরাসরি এন্টি-মুসলমান বয়ান তো দেয়া যায় না, এতে সেকুলারদের সেকুলার জামা আর গায়ে থাকে না, আপনাতেই খুলে পড়ে। আবার ভারতের নির্বাচনী আইনে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই বয়ানটা কিছুটা বদলে হয়েছে – আড়াল করতে করা হয়েছে ‘জঙ্গী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বয়ান’। জঙ্গী-সন্ত্রাসী মানেই তো মুসলমান এই সূত্রে। শুধু তাই নয় পড়শি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানে একটা হিন্দু-মনের চোখে মুসলমান, হিন্দুর ‘অপর’ — এ ছাড়া কলকাতা ভিন্ন কিছু ভাবতে পারে তার প্রমাণ খুবই কম। আর কি! বাংলাদেশকে এটাতে জড়াতে পারলে বয়ান আরও পোক্ত হবে। ফলে এই হল, বাংলাদেশ-জঙ্গী-সন্ত্রাস বয়ানের সুত্র। মমতা বাদে বাকি তিন দলের আসন্ন নির্বাচনে প্রপাগান্ডার কৌশলও তাই মুসলমানদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে।
মমতার বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার। বাংলাদেশের বর্তমান সংকটের সময় শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলারদের তুষ্ট করার চেষ্টা করবেন মমতা। কলকাতায় হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারের বিপরীতে একদিকে মুসলমানদের ভোটের ক্ষেত্রে একচেটিয়া সমর্থন ধরে রাখা, অন্যদিকে বাংলাদেশের ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলারদের সঙ্গে অতিরিক্ত মৈত্রী প্রদর্শন করে কলকাতার হিন্দুদের অভিমান হ্রাস করা — এই দোদুল্যমান রাজনীতি মমতা ব্যানার্জির। বাংলাদেশ সফরে নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের ইমপ্রেস হবার কিছু নাই। এখনকার সফরে বাংলাদেশের ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলারদের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করলেও পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সহমর্মিতার প্রয়াস বাংলাদেশের জনগণ সমর্থন করবে। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং ইসলাম বিদ্বেষী রাজনীতির বিপরীতে সীমান্তের দুই পাশের জনগণের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জি কী ভূমিকা রাখেন তা দেখার জন্য নজরে এই দেশের জনগণের আগ্রহ আছে।
বর্ধমান জেলায় একটা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল গত বছর অক্টোবরে। সেটা কাজে লাগিয়ে এই প্রপাগান্ডায় আলো-বাতাস লাগানো হয়েছে। ওদিকে সারদা কেলেঙ্কারি নামে এক অর্থ কেলেঙ্কারিতেও মমতার দল অভিযুক্ত হয়ে আছে। (সারদা কেলেঙ্কারি হল আমাদের ‘ডেসটিনি” কেলেঙ্কারির মত সমতুল্য ঘটনা।) এই দুইয়ে মিলে প্রপাগান্ডার গল্প জমিয়ে তোলা হয়েছে। এই গল্পকে আরও সুনিপুণ করতে বাংলাদেশের জামাতকেও টেনে আনা হয়েছে। যাতে মূলত এন্টি-মুসলমান ক্যাম্পেনটাকে জামাত-জঙ্গী-সন্ত্রাসী এসব শব্দের মোড়কে হাজির করা যায়। সেটা জায়েজ এমন একটা ন্যায্যতাও টানা যায়। জামাত পর্যন্ত প্রসঙ্গ টানা শুরুর কারিগর মূলত পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর। গত ২০১৪ মে মাসের কেন্দ্রীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন উপলক্ষ্যে কলকাতা বামফ্রন্টের প্রধান সমাবেশ থেকে তিনি এই বয়ান দিয়েছিলেন। মুসলমান কনস্টিটুয়েন্সী মমতার কাছে হারানোর দুঃখের তীব্রতা আমাদের এভাবেই তিনি জানিয়েছিলেন। তখনও বর্ধমান ইস্যু হাজির হয় নাই। পরে এই ইস্যু হাজির হলে বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি অমিত শাহ — যিনি পশ্চিমবঙ্গের আগামি নির্বাচনে দলকে জিতানোর মূল দায়িত্বে এখন আসীন — তিনি বিমান বসুর বয়ানটাকেই এবার বাড়তি আকার দেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গে আগামি নির্বাচনে তখন থেকে অনেকবার উচ্চারিত শব্দ হয়েছে বাংলাদেশ, আগামিতেও থাকবে, নির্বাচন পর্যন্ত। কিন্তু অমিত শাহের এসব কারবারে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী সরকার নিজেকে দূরে রাখতে চান। যদিও তার বিশ্বস্ত প্রধান অমিত শাহকে তিনিই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দলকে ক্ষমতাসীন করার এসাইমেন্ট সঁপেছেন। তবু নিজের হাত ধুয়ে রাখতে, আর তা রেকর্ডে রাখতে মোদী ইতোমধ্যেই ভারতীয় পার্লামেন্টে নিজের এক মন্ত্রীর লিখিত বিবৃতি পাঠ করিয়ে পরিস্কার করেছেন যে, বাংলাদেশ-বর্ধমান-সারদা ইস্যু এসব মিলিয়ে যে বয়ান তার পক্ষে তদন্তকারি গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ এর রিপোর্টে প্রমাণ করার মত তথ্য মিলেনি। অমিত শাহ ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন, র কে আর সেই সাথে এনআইএ-এর বাংলাদেশ সফর, পালটা বাংলাদেশ থেকেও আমাদের গোয়েন্দাদের সফর ইত্যাদিতে প্রশাসন পর্যায়ে অনেকদুর ব্যবহার করেছেন। মোদী সরকারের বিবৃতির পরে তবুও পশ্চিমবঙ্গ পর্যায়ে প্রপাগান্ডা এখনও একই রকম রয়ে গেছে। কারণ জঙ্গী-সন্ত্রাসের ভীতিটা রয়েই গেছে।
মমতার প্রত্যাশা
এই পটভুমিতেই মমতা বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি কি চাইবেন হাসিনার কাছে?
মমতা চাইবেন, হাসিনা যেন পশ্চিমবঙ্গের চলতি নির্বাচনী প্রপাগান্ডার লড়াইয়ে, বাংলাদেশকে জড়িয়ে যে জঙ্গী-সন্ত্রাসের বয়ান চলছে একে পরিপুষ্ট না করেন। হাসিনা নিজে এমন কোন বয়ান যোগ না করেন যেটা এই বয়ানকে পরিপুষ্ট করে। বরং বাংলাদেশের নাম যতই উঠুক তিনি যেন এটা ভারতের এক আঞ্চলিক এবং একেবারেই নির্বাচনী রেঠরিক সেদিক থেকে দেখেন। যার বিপরীতে কলকাতার বয়ানের বিরুদ্ধে যায় হাসিনার নিজস্ব পালটা বয়ানে যদি তেমন কিছু হাসিনা যোগ করতে রাজি হন তাহলে সেটা মমতার চরম পাওয়া হবে। আর যদি তা না-ই পারেন, তবে যেন চুপ থাকেন, তাহলেও মমতার জন্য এটা ভাল কাজে লাগবে। এই হবে মমতার চাওয়া। এটাই তার বাংলাদেশ সফরের মুল উদ্দেশ্য। অবশ্য সেটা যাই হোক এই সফর থেকে একটা বাড়তি সুবিধা তিনি পাবেন। মমতা যে বাংলাদেশ থেকে “যাওয়া” জঙ্গী সন্ত্রাসীর আশ্রয় প্রশ্রয় দেবার নেত্রী নন — যে প্রপাগান্ডা কলকাতায় তাঁর বিরোধীরা জারি রেখেছে – তার প্রমাণ তিনি এবার করতে পারবেন। সেটা হবে এরকম যে, তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন এবং হাসিনার দ্বারা ভাল আপ্যায়িত হয়েছেন। তিনি জঙ্গী সন্ত্রাসীর আশ্রয় প্রশ্রয়দাত্রী হলে কি এই মর্যাদা পেতেন!
কিন্তু মমতা যেভাবে যা চাইবেন তাই হাসিনা দিবেন এমন কোন কারণ নাই। তাহলে হাসিনা কিসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিবেন? তাঁর সিদ্ধান্ত নিবার ভিত্তি হবে মমতা কি দিতে পারেন যা তার ক্ষমতাকে পোক্ত করতে কাজে লাগতে পারে। হাসিনার সরকারের পক্ষে মোদীর সমর্থন আনার ক্ষেত্রে মমতা সঠিক লোক নন, বরং উলটা। তবে তিস্তার পানি বা ল্যান্ড বাউন্ডারি ইস্যুতে তিনি আপত্তি করবেন না এমন ধারণা মমতা ঘোষণা করতে পারেন। যদিও এমন ঘোষণা মানেই এগুলো সরাসরি বাংলাদেশের পেয়ে যাওয়া নয়। যদিও ল্যান্ড বাউন্ডারি ইস্যু আগামি ২৩ মার্চের মধ্যে ভারতের পার্লামেন্টে চুড়ান্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে এবং তা মোদীর ক্রেডিটে আসবে। তার চেয়েও বড় কথা হাসিনার কাছে এর মূল্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটে সরাসরি তাকে সাহায্য করে এমন কোন ইস্যু নয়। বাংলাদেশের চলতি সংকটের যাত্রায় যদি হাসিনা ক্ষমতায় টিকে যেতে পারেন তবে এরপরে হয়ত প্রপাগান্ডায় এটা তাঁর কাজে লাগতে পারে। সারকথায় মমতা যা দিতে পারেন তা হাসিনার চলতি ক্ষমতা-সংকটকে সরাসরি সাহায্য করতে পারে এমন কিছু নয়। ফলে মমতার অফার হাসিনার জন্য বড়জোর অপ্রত্যক্ষ এক সুবিধা মাত্র। আগামিতে কাজে দিবে এমন। এধরণের বিচারের প্রেক্ষিত থেকে হাসিনার সিদ্ধান্ত পরিচালিত হবে বলে অনুমান করা যায়। এই সফরের বাকিটা হবে হাসিনা ও মমতার উভয়ের জন্যই শো-আপ এর লাভালাভ।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
[এই লেখাটা গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ চিন্তা ওয়েব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে আবার সামান্য এডিট করে ছাপা হল।]