নতুন গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ চীনের বিশ্বব্যাংক আসন্ন
http://wp.me/p1sCvy-9O
আজ ৩১ মার্চ ২০১৫। দুনিয়ার শাসন ও নিয়ন্ত্রণে হাতবদল হয়ে আমেরিকার বদলে চীনের নেতৃত্বে চলে যাবার দিক থেকে দিক থেকে খুবই তাতপর্যপুর্ণ দিন। এই মুহুর্তের গ্লোবাল মিডিয়া তোলপাড়ে মূল খবর AIIB বিষয়ক। সব খবরেই একটা শব্দ দেখা যাবে –AIIB যার সংক্ষেপ ভাঙলে দাড়ায়, Asian Infrastructure Investment Bank। পুরা মার্চ মাস ধরেই প্রতিদিনের খবর আজ কোন রাষ্ট্র AIIB ব্যাংক গড়ার উদ্যোগে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল। আজ এবিষয়ে সম্মতি জানানো ও উদ্যোক্তা স্বাক্ষর করার শেষ দিন।
সারসংক্ষেপ
এককথায় বললে AIIB ১৯৪৪ সালে গঠিত হওয়া বিশ্বব্যাংকের তুল্য ও প্রতিদ্বন্দ্বি প্রতিষ্ঠান, এই অর্থে চ্যালেঞ্জকারি প্রতিষ্ঠান। তাই বিশ্বব্যাংকের ধারণা থেকে AIIB কে বুঝা সহজ হবে। সেসময় আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক গড়ে তোলা হয়েছিল আমেরিকার সবচেয়ে বেশি মালিকানা শেয়ার রেখে আর সারা ইউরোপকে নিজের জুনিয়র সাগরেদ জুটিয়ে। জাতিসংঘের ১৯১ সদস্যের মধ্যে প্রায় সব রাষ্ট্রই মুল প্রতিষ্ঠান আইএমএফের সদস্য। আর আইএমএফের সদস্য হওয়া বিশ্বব্যাংকের সদস্য রাষ্ট্র হবার পুর্বশর্ত। এভাবে প্রায় সকল রাষ্ট্রই বিশ্বব্যাংকের সদস্য। কেউ ঋণগ্রহিতা খাতক কেউ বিনিয়োগকারি হিসাবে। সেই থেকে দুনিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এক গ্লোবাল অর্থব্যবস্থা কায়েম এবং এই মাধ্যমে দুনিয়ার অর্থব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নেয় আমেরিকা। গত ৭০ বছর ধরে আজও সেই রুস্তমি চলছে। তবে অবশ্যই সেই নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব আগামি বছর থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাঙ্গা হাটের মত হতে থাকবে।
AIIB আগামি বছর থেকে কার্যকর হয়ে গেলে কি বিশ্বব্যাংক ভেঙ্গে পড়বে – এর জবাব হল না কোনভাবেই তা হবে না। তাহলে কি হবে? আমাদের মত দেশের দিক থেকে বললে, বিশ্বব্যাংক যে ঋণ আমাদের সরবরাহ করে আমরা যার খাতক তা হল, বিশ্বব্যাংক আমাদেরকে ইনফ্রাষ্টাকচার বা অবকাঠামো খাতে প্রায় না সুদে কনসেশনাল ঋণ দেয়। এই অবকাঠামো বলতে ফিজিক্যাল (রাস্তাঘাট ব্রিজ ইত্যাদি খাতে) ও হিউম্যান (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে) এই দুই ধরণের অবকাঠামো খাতেই ঋণ। অবকাঠামো বলার বা এই শব্দে চিনানোর কারণ এগুলো ঠিক বাণিজ্যিক ততপরতা হিসাবে দেখে দেয়া ঋণ নয়। ঋণ ব্যবসার বাজারের ততপরতায় টার্মোনোলজি হিসাবে যা বাণিজ্যিক ঋণ নয় তা বুঝাতে অবকাঠামো ঋণ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। বাণিজ্যিক কি না তা বুঝবার মূল নির্ণায়ক সুদের হার। বিশ্বব্যাংকের অবকাঠামো ঋণের সুদ ০.৭৫% অর্থাৎ ১% এর নীচে। এটা ঠিক অর্থের উপর সুদ নয় বরং, ঋণের বিষয়টা পরিকল্পনা, প্রজেক্ট নেয়া, তা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের যে অফিস পালতে হয় সেই অফিস পালা-পরিচালনার খরচ। যেকোন ব্যাংকের ভাষায় এটাকে সুদ না বলে সার্ভিস চার্জ বলে। এতক্ষণ সব শুনে তো বিশ্বব্যাংকের সবই ভাল মনে হচ্ছে। তাহলে বিশ্বব্যাংক অবকাঠামো ঋণ দেয় কেন? কি ঠেকা তার? এককথায় বললে, গ্লোবাল পুঁজি বাজারে (ওয়াল ষ্ট্রিট, সিঙ্গাপুর বা দুবাই থেকে মুলত পরিচালিত) আমরা যেন আরও বড় খাতক হই। বাংলাদেশের অর্থনীতি যত বড় হবে আমরা ততই পুঁজিবাজারের চোখে আকর্যণীয় বাজার হয়ে ধরা দিব। অবকাঠামো খাতে ঋণ দিয়ে বিশ্বব্যাংক আমাদের অর্থনীতিতে গ্লোবাল পুঁজিবাজারে বাণিজ্যিক পুঁজি পাবার চাহিদা, আকাঙ্খা সৃষ্টি করে। আর এই গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা এমন ভাবে সাজানো এক সিস্টেম যার কারণে এর বিভিন্ন শর্তের ফ্যারে পড়ে আমাদের অর্থনীতি রাজনীতির উপর পরাশক্তিগত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।
এশিয়ার অর্থনীতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অবকাঠামো খাতে আগামি দশ বছর পর্যন্ত যে ঋণের চাহিদা আছে এর অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না। এশিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি অবকাঠামো ঋণ চাহিদা পূরণ করে থাকে। অর্থাৎ এদের মিলিত সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় অর্ধেকের কম। ফলে বাস্তবতা হল যে, এই প্রতিষ্ঠান দুটো চাইলেও AIIB এর উত্থান রোধ করতে পারবে না। অর্থাৎ AIIB প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসাবে হাজির হবে। এছাড়া গত অন্তত বিশ বছর ধরে চীনের লাগাতর বড় রকমের উদ্বৃত্বের অর্থনীতি হিসাবে হাজিরের কারণে চীনের বিনিয়োগ বিশেষ করে অবকাঠামো বিনিয়োগ সক্ষমতা ট্রিলিয়ন ডলারে হিসাব করতে হবে। প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে চীনের নেতৃত্বের AIIB এর শর্ত ভিন্ন ও সুবিধাজনক হবার সম্ভাবনা। যেমন আমাদের আলোচিত পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প প্রস্তাব ছিল বিনা সুদ বা সার্ভিস চার্জ। অবশ্য সেই সাথে দুই বিলিয়নের ঋণে কনসালটেন্সী ফি এর অপশন (তুলনায় খুবই কম মাত্র ৫৫ মিলিয়ন) ছিল না। তবে বাংলাদেশ চাইলে নিজ খরচে কনসালটেন্ট নিয়োগ দিতে পারত। এই প্রস্তাব আলোচনা, নিগোশিয়েশনের দিকে আর যায় নাই ফলে চুড়ান্তভাবে তা কোথায় দাড়াত তা আমাদের সামনে নাই। কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ দিকটা হল, এই প্রকল্পে ঋণ পাবার সম্ভাব্য উৎস এখন আর একা বিশ্বব্যাংক-এডিবির জোটই নয়, এদের একচেটিয়া কারবারের অবস্থায়, শর্ত ডিকটেট করার সুবিধাজনক অবস্থায় আর নাই এটা প্রতিষ্ঠিত। AIIB হাজির হয়ে গেলে এই প্রতিষ্ঠান আরো সংগঠিতভাবে নতুন সুবিধাজনক শর্ত নিয়ে হাজির হবে। সারকথা হল, এশিয়ায় ঋণ চাহিদা পুরণের ক্ষেত্রে চাহিদা-যোগানের গ্যাপের কারণে AIIB এর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবি থেকে যাবে। কিন্তু কে কত ভাল সুবিধাজনক শর্ত দিতে পারে এনিয়ে প্রতিযোগিতা দেখা দিবে। ফলাফলে আমেরিকান নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের নেতৃত্বে নতুন গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হাজির হতে থাকবে। শুরুতে যেটা দেখা দিবে তা হল, চীনের কাছে দুনিয়ার প্রভাব কর্তৃত্বে হারাতে থাকবে, শেয়ার দিতে হবে। এক পর্যায়ে সমস্ত কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে এখনকার অর্থব্যবস্থায় যেমন আমেরিকান কর্তৃত্বের অধীনস্ত হয়ে ইউরোপ ছোট সাগরেদ বা জুনিয়র পার্টনার হয়ে থাকতে হচ্ছে আমেরিকা চীনের অধীনে সে ভুমিকাটাও পাবে কি না সন্দেহ আছে। কেন? সে প্রসঙ্গে নিচে এখন প্রবেশ করবে চলতি ঘটনাবলি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে।
তার আগে সার সংক্ষেপ টানব ওয়াশিংটনের এক থিঙ্কট্যাঙ্ক Peterson Institute for International Economics এর প্রতিষ্ঠাতা Fred Bergsten এর কথা দিয়ে। চলতি মার্চ মাস জুড়ে সারা পশ্চিমে যত থিঙ্ক ট্যাংক, একাদেমিক মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠান আছে সব জায়গায় আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই AIIB বা চীনের উত্থান আর এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমের ক্ষমতা কর্তৃত্বের সৌধ ভেঙ্গে কী রূপ আকার নিবে সেসব। বাইরের দিক থেকে দেখলে এটা নেহায়েতই আর এক ঋণদানের প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব। কিন্তু এর আসল অর্থ তাতপর্য Fred Bergsten এর বরাতে শুনব। তিনি আমেরিকারই আর এক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান NPR আর সাথে আলাপকালে AIIB প্রসঙ্গে বলছেন, “I think the fact that it is China and this is part of the broader competition for global leadership, economic leadership, broader political leadership – that is, I think, a central part of this equation.”। বাংলা করে বললে, “ব্যাপারটা হল আসলে চীন। এটা চীনের সাথে দুনিয়ার নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক নেতৃত্ব, বৃহত্তর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইত্যাদি পাবার বৃহত্তর প্রতিযোগিতা – এটাই এই সমীকরণের কেন্দ্রীয় বিষয়।
চলতি মার্চেই আচমকা ট্রিগার দাবানোর কাজটা করল বৃটেন
গত সাত বছর ধরে চলতি “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়” একটা মোচড়ানির কথা বলে আসছি। প্রায় সব রচনাতেই মুখ্য ইস্যু ছিল এটাই। এই মোচড়ানি ঠিক ব্যবস্থাটা ভেঙ্গে পড়ার অভিমুখি নয় বরং কাঁধ বদল অথবা আরেক কাতে পাশ ফরে শোয়া ধরণের অবস্থায় যেতে চাওয়া বলতে পারি। চলতি শতকের শুরু থেকে চীনের প্রবল অর্থনৈতিক উত্থান থেকে সেই মোচড়ানি, চলতি “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়” আসন্ন বদলের আলামত ক্রমশ স্পষ্ট দৃশ্যমান করে তুলছিল। লক্ষণগুলো ক্রমান্বয়ে ফুটে উঠছিল, পড়া যাচ্ছিল। সে ইঙ্গিত দেখে আরও সুনির্দিষ্ট করে জানতে আমেরিকান সরকারি সার্ভে, গবেষণা ষ্টাডি রিপোর্ট হয়েছে গত ২০০৮ সালে। এই রিপোর্টটাকে বলা যেতে পারে ঘুর্ণিঝড়ের রিপোর্টের মতন। আর এখানকার “ঘুর্ণিঝড় আসন্ন” বলে পুর্বাভাস মানে আমরা বুঝেছিলাম এটা আর পিছনে ফিরবে না, আঘাত হানবেই। এসব ক্ষেত্রে আমরা তখন খালি ক্ষয়ক্ষতি কত কি কম করা যায় করণীয় হিসাবে কেবল সেখানেই সব মনোযোগ নিবদ্ধ করি – এই রিপোর্টটাও ছিল তেমনি। আসন্ন ওলটপালট বদলের ঝাপ্টার অভিমুখ বিশ্লেষণ করে ঠিক করা হয়েছিল কি করলে এর প্রভাব আঁচ আমেরিকার উপর কমানোর চেষ্টা করা যায়, একে যতটা দেরি করিয়ে দেয়া যায় – এমন। সে মোতাবেক আমেরিকান বিদেশনীতিতে বদল করা হয়েছিল। আমেরিকার কাছে ভারতের দাম গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছিল। তার ঠেলা বাংলাদেশের ঘাড়ে কিভাবে এসে পড়েছিল সেসব আমরা জানি। কিন্তু “আসন্ন” বুঝা যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু আঘাত হানাটা কোনখান থেকে কেমন করে শুরু হবে তা স্পষ্ট হচ্ছিল না। কারণ চলতি “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা”টা দাঁড়িয়ে আছে মানে চারটা গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে – আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্লোবাল অর্থনীতিক ব্যবস্থা, জাতিসংঘ গ্লোবাল রাজনৈতিক (পরাশক্তিগত) ক্ষমতা, আর ডব্লিউটিও গ্লোবাল পণ্য রফতানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কায়েম করে। ফলে আসন্ন নতুন “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটার” আঘাত হানা বলতে বুঝতে হবে যখন এই চারটা প্রতিষ্ঠানের কোন এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জকারি কোন ঘটনা ফেনোমেনা দেখা যাবে। অর্থাৎ এতদিন আসন্ন বলতে আমরা বুঝেছি তত্ত্ব, ফ্যাক্টস ফিগারের প্রজেকশন দিয়ে বাস্তব আঘাত বা চ্যালেঞ্জকারি পালটা প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেখা দিয়েছে এমন ভাবে নয়।
আমাদের অপেক্ষার পালা সম্ভবত শেষ। আগামি দিনের ইতিহাসে মার্চ ২০১৫ সম্ভবত চিহ্নিত হতে যাচ্ছে নতুন “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার” শুরুর কাল হিসাবে।
“আসন্ন” শুনতে শুনতে আর সহ্য করতে না পেরে প্রথম গুলি ছুড়া মানে ট্রিগার দাবানোর কাজটা করে বসলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যমেরনের বৃটেন। আকস্মিকভাবে গুলিটা একেবারে তাক করলেন আমেরিকার দিকে। এটা সেই আমেরিকা বৃটেনসহ ইউরোপও যার নেতৃত্ব ও খবরদারি মেনে ১৯৪৪ সালে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে এক নতুন গ্লোবাল অর্থনৈতিক (পুঁজিতান্ত্রিক) ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আর এরপর বিগত ৭০ বছর ধরে এই ব্যবস্থার দুনিয়াজুড়ে রুস্তমিতে বৃটেন আমেরিকার ছোট পার্টনার হয়ে সাথ দিয়ে চলেছে। কিন্তু সম্ভবত আর নয়, এবার ছন্দে পতনের সুর। গত সত্তর বছরের ওস্তাদ-সাগরেদের আস্থার সম্পর্ক এই মুহুর্তে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। গত ১২ মার্চ ২০১৫ বৃটিশ সরকার আমাদের জানিয়ে দিলেন যে, বৃটেন চীন প্রস্তাবিত ও নিয়ন্ত্রিত নতুন Asian Infrastructure Investment Bank (AIIB) ব্যাংক গড়ার উদ্যোগে সামিল হতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ এবার কাঁধ বদলের মত করে আমেরিকার বদলে চীনের সাথে সাথ মিলিয়ে নতুন এক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে AIIB ব্যাংক গড়তে সম্মতি জানিয়ে দিল। মাত্র পাঁচ মাস আগে গত বছর অক্টোবর ২০১৪ চীন সাংহাই শহরে এক সম্মেলন ডেকেছিল যারা AIIB এর উদ্যোক্তা সদস্য হতে ইচ্ছুক এমন সব রাষ্ট্রকে। ঐ সম্মেলন থেকেই মূলত প্রাথমিকভাবে একাই ৫০ বিলিয়ন ডলার পুঁজি ঢালার ঘোষণা দিয়েছিল চীন, যেটা পরে ১০০ বিলিয়ন ডলার হবে। সেই থেকে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের স্বাক্ষর চলছে। উদ্যোক্তা-স্বাক্ষরের সুযোগ শেষ হবে এই মাসের শেষ দিন, ৩১ মার্চ ২০১৫ । তাই ব্রিটেনের সিদ্ধান্তের এই হুড়োহুড়ি আকস্মিকতা। বৃটেনের ১২ মার্চের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে আমেরিকার দিক থেকে বিরাট আচমকা ঘুষি খেয়ে পড়ে যাবার মত। গত সত্তর বছর ধরে সারা ইউরোপকে আমেরিকা ভাগ দেবার সময় সবার চেয়ে বৃটেনকে আলাদা চোখে দেখেছে, ভাগবিতরণে মাছের মাথাটাই বৃটেনের পাতে দিয়ে গেছে। ওদিকে চীন যে এমন পালটা প্রাতিষ্ঠানিক আঘাত করবে সেটা আমেরিকার জানা থাকলেও, কিছু প্রস্তুতি ততপরতা থাকলেও সে আঘাতের ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়ায় বিশেষ করে বৃটেন যে লীড নিয়ে পক্ষ বদল করতে পারে – এটা আমেরিকারও বিবেচনায় আছে এমন কোন আলামত গ্লোবাল মিডিয়াতে কখনও চোখে পড়ে নাই। গত বছর প্রকাশ্যে চীনের AIIB উদ্যোগের আগেও অন্য দিক থেকে আগানোর আর এক উদ্যোগ ছিল চীনের। গত ২০০৯ সাল থেকেই ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, নিজে আর সাউথ আফ্রিকা এই পাঁচ রাইজিং ইকোনমিকে নিয়ে BRICS ব্যাংক গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল চীন। এটা সবার জানা। কিন্তু চীনের ব্রিক উদ্যোগের প্রতি আমেরিকার মতই সারা ইউরোপের আগ্রহ বা প্রতিক্রিয়া শুরু থেকেই শীতল ছিল, যেন এটা তাদের চায়ের কাপ না, কিছু এসে যায় না ধরণের। ফলে সম্ভবত সেই উদাহরণ সামনে থাকাতে চীনের যে কোন উদ্যোগ প্রচেষ্টার প্রতি ইউরোপ টলে, ঢলে যেতে পারে এই দিকটা আমেরিকা খাটো করে দেখেছে। কিন্তু বৃটেনের এই আঘাতই শেষ নয়। বৃটেনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার চারদিন পড়ে জানা যাচ্ছে যে এটা একা বৃটেনের সিদ্ধান্ত নয়। গত ১৭ মার্চ -জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালীও বৃটেনের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করার ঘোষণা প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। বার্তা সংস্থা এপির বরাতে আমরা জানছি জর্মান অর্থমন্ত্রী এই বিবৃতি দিয়েছেন। অথচ গত বছর অক্টোবরে যখন সাংহাইয়ে AIIB সম্মেলন ডাকা হয় তাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা প্রকাশ্যে ততপরতা চালিয়েছিল যাতে এশিয়ার অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া মত দেশ যারা এশিয়া নীতিতে আমেরিকাকে অনুসরণকারি ও আমেরিকার ষ্ট্রাটেজিক শেয়ার পার্টনার, এরা AIIB উদ্যোগে যেন যোগ না দেয়। তবু সেসময় বৃটেন প্রকাশ্যে AIIB উদ্যোগের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বক্তব্য দেয় নাই। এখন বৃটেনের যোগ দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর আমেরিকা প্রকাশ্যেই নিজের অখুশি, অস্বস্তি জানিয়েছে। বৃটিশ অর্থমন্ত্রী জবাবে মিডিয়াকে বলেছে, এটা বৃটেনের “জাতীয় স্বার্থে নেয়া সিদ্ধান্ত” এবং এমন সিদ্ধান্ত নেবার আগে এব্যাপারে তারা আমেরিকাকে জানিয়ে ও কথা বলে নিয়েছে।
দুনিয়াজুড়ে রুস্তমিতে আমেরিকার নিজের একক নীতি সিদ্ধান্ত গুলোর মধ্যে প্রধানত অর্থনৈতিক বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ইউরোপের সাথে সমন্বয় করতে সাত শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানদের একটা ক্লাব আছে যার নাম জি৭ বা গ্রুপ সেভেন। জি৭ এ ইউরোপের ভিতরকার চার রুস্তমি রাষ্ট্রের মধ্যে বৃটেন ওর একজন। জি৭ থেকেও AIIB উদ্যোগের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন প্রকাশ্য বক্তব্য আসে নাই। ওদিকে AIIB সাংহাই উদ্যোক্তা প্রস্তুতি সম্মেলনেই ২০ রাষ্ট্র প্রতিনিধি সদস্য স্বাক্ষর করে ফেলেছিল। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মাল মুহিতও তাদের একজন -গিয়েছিলেন, স্বাক্ষর করেছেন। এখন বৃটেনের ঘোষণার আগেই ইতোমধ্যে মোট উদ্যোক্তা সদস্য সংখ্যা ত্রিশে পৌচেছে। তবে এতদিন এরা সবাই ছিল কেবল এশিয়ার সদস্য। বৃটেনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর এশিয়ার অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া যাদেরকে আমেরিকা ধমকায়ে বিরত রেখেছিল অথচ এসব প্রত্যেক দেশের ব্যবসায়ী, একাডেমিসিয়ান, পরামর্শক এবং এমনকি কোন কোন মন্ত্রীও AIIB তে যোগ দেবার প্রকাশ্যে পক্ষে ছিল ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিল। এখন এমন সব রাষ্ট্রেই সে তর্ক আবার জোরাল হয়েছে, যোগ দিবার পক্ষের লোক ও যুক্তি বেড়েছে। গত ২০ মার্চ রয়টারের খবর অষ্ট্রেলিয়া যোগদানের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। জাপান দ্বিধাবিভক্ত কাপাকাপিতে। থিঙ্কটাংক এক্সপার্টরা বলছেন জাপান যদি যোগ দেয় তাহবে এশিয়ার সর্বশেষ দেশ, এবং বিশেষ শর্তে। দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে মিডিয়ায় ইঙ্গিতপুর্ণ খবর বেরিয়েছে যে তারা নাকি ৫% শেয়ার আর একটা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দরাদরি করছে। যদিও এক ক্যাবিনেট মিটিংয়ের শেষে কোরিয়ান অর্থমন্ত্রী এই জল্পনাকল্পনা স্বীকার করতে চান নাই। ওদিকে ইউরোপের মধ্যে বৃটেনের সাথে জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালীর যোগ দেবার কথা আগে বলেছি। ইতোমধ্যে তা অনুসরণ করে আরও এগিয়ে যোগদানের ঘোষণা করেছে লুক্সেমবার্গ এবং সুইজারল্যান্ড। তবে বৃটেনের সাথে জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালী – এরা ইউরোপের কারা? এটা জেনে রাখা দরকার। আমেরিকার নেতৃত্বে এতদিনের গ্লোবাল মাতবর প্রতিষ্ঠানে আমেরিকার ক্ষমতায় সুখের ভাগ নিবার ভুমিকায় ইউরোপের মধ্যে চার রাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে বড় সাগরেদ – চার ইউরোপিয়ান বৃটেন, জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালী। আমেরিকান নীতির সাথে চোখবন্ধ ধরণের সমর্থনের সবচেয়ে বেশি থেকে কম কার এই ধারাবাহিকতা মেনে নামের ধারাবাহিকতাগুলো লিখা হয়েছে। এই চারের বাইরে ইউরোপের বাকি রাষ্ট্র, এমনকি সে বাকি ইউরোপের রাষ্ট্র বলতে (ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৫) ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই চার বাদে বাকি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও আর কেউই প্রভাবশালী নয়। এখানে প্রভাবশালী কথার অর্থ বর্তমান বিশ্বব্যাংকে ইউরোপের টপ বড় মালিকানা শেয়ার হোল্ডার হল এরা সেই এই চার রাষ্ট্র। আবার যেমন, জি৭ – এই সাত রাষ্ট্রের গ্রুপের মধ্যে চার ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্র হল – এই চার রাষ্ট্র। এই গ্রুপের সদস্য কে হতে পারে তা মানার ভিত্তি হল দুনিয়ায় সঞ্চিত সম্পদ কোন রাষ্ট্রের হাতে বেশি এমন তালিকার উপরের সারির প্রথম সাত রাষ্ট্র। এই সাত রাষ্ট্রের মোট সম্পদ দুনিয়ার মোট সম্পদের ৬৪ শতাংশ। একটা ফুটনোট, যদিও এখানে জি৭ এর ক্রাইটিরিয়া বলার সময় শব্দটা ‘সম্পদ’ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এই শব্দের প্রকৃত অর্থ বিনিয়োগ ক্ষমতা অথবা বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোন্ডিং বা দাতা মালিক। এছাড়াও মনে রাখতে হবে চীন জি৭ এর সদস্য নয়, হতেও চায়নি, অফারও করা হয় নাই। ফলে এই তিন রথি বৃটেনের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করার সারার্থ হল, ইউরোপের প্রধান চার মোড়ল আমেরিকাকে এতিম করে দিয়ে চীনের নেতৃত্বে AIIB উদ্যোগের পক্ষে চলে যাচ্ছে। এর ফলে সারা এশিয়া ও ইউরোপের মূল অর্থনীতিগুলো AIIB উদ্যোগের পক্ষে চলে যাচ্ছে বলা যায়। গত বছরের সাংহাই সম্মেলনের আগে আমেরিকান আমলা কুটনীতিকরা নিজেদের পিঠ চাপড়িয়েছিল এই বলে যে এই উদ্যোক্তা সম্মেলন মোট সদস্য সংগ্রহের সংখ্যা ২০ হয়েছে বটে কিন্তু চীন ও ভারত বাদে এশিয়ার বড় অর্থনীতির কেউ আর এর সদস্য হতে আসেনি। আর সেই সাথে ইউরোপ থেকেও কেউই আসেনি। এটা তাদের কূনৈতিক লবির সাফল্য। অর্থাৎ চীন উদ্যোগের বিরুদ্ধে কানপড়া দেয়া, ভাঙরি দেয়ার, ভয় দেখানোর তাদের প্রচেষ্টাটা সফল। স্বভাবতই এই হিসাবের মধ্যে এশিয়ার জাপানকে বাইরে রেখে বলা। কিন্তু মাত্র পাঁচ মাস পড়ে সে দৃশ্যপট এখন একেবারে বদলে গিয়েছে, আগামিতে আরও বদলে যাবে সে আলামত দেখা যাচ্ছে। আর দৃশ্যপট বদলে দিবার পিছনের ট্রিগার টানার মত কাজটা করেছে বৃটেন। নিজে একা শুধু নয় ইউরোপের বাকি তিন মুল মুরুব্বিদেরও সাথে আনার কাজ হয়ে গেছে সেটা। এটা এমন এক ঘটনা যা ১৯৪৪ সালের পর থেকে দুনিয়াতে ঘটতে দেখা এমনকি কল্পনা করাও খুব সহজ ছিল না।
ওদিকে অষ্ট্রেলিয়ার ঘনিষ্ট পড়শি, রাজনীতি-অর্থনীতিতে প্রায় সমনীতি অনুসরণকারি নিউজিল্যান্ডও আনুষ্ঠানিকভাবে AIIB তে যোগদান করেছে। তবে বৃটেনের পরের তিন ইউরোপীয় রাষ্ট্র ঠিক কি বলে এই আগ্রহের কথা জানিয়েছে সেটাও বেশ গুরুত্বপুর্ণ। বার্তা সংস্থা এসোশিয়েটেড প্রেস জর্মন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রচারিত তাদের তিন রাষ্ট্রের আগ্রহ-পত্রকে উধৃত করে জানাচ্ছে, “তিন ইউরোপীয় দেশ চলতি ডেভেলবমেন্ট ব্যাংকগুলোর অংশীদারির পাশাপাশি AIIB তে যোগদানের পরিকল্পনা করছে যাতে এশিয়ায় প্রচুর অবকাঠামো ঋণের চাহিদা মিটাতে AIIB তে ফান্ড সরবরাহ করে তাতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে”। ফ্রান্স, ইটালি ও জর্মনি আন্তর্জাতিক ও ইউরোপীয় পার্টনারদের সাথে ঘনিষ্ট সমন্বয় রেখে AIIB এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়ে কাজ করতে আগ্রহী যাতে এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় যেটা এর পরিচালনা, সুরক্ষা, ঋণ বিতরণ ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে ‘বেষ্ট ষ্টান্ডার্ড ও প্রাকটিস’ অনুসরণ করতে পারে”।
এখানে শুরুতে চলতি “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার” কথা বলছি মানে একটা সিস্টেমের কথা বলছি। যেমন সাধারণ মানুষ বলে “একটা সিস্টেম করে নিয়েছি” – আসলে ঠিক তাই-ই বুঝাচ্ছি। অর্থাৎ এটা একটা সিস্টেম, এর অর্ডার, এর আইন-কানুন, নিয়ম প্রটোকল, প্রভিশন, ম্যান্ডেট, ট্রিটি-সম্মতিচুক্তি ইত্যাদি সব মিলিয়েই – এটা এক ব্যবস্থা। গত ১৯৪৪ সালে এই ব্যবস্থার জন্মটাকে বলা হয় দুই বিশ্বযুদ্ধের সার ফলাফল। যার মাখন হল আমেরিকার নেতৃত্বে কর্তৃত্বে জন্ম নেয়া এক “গ্লোবাল সামগ্রিক ব্যবস্থা”। প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে বললে, এই ব্যবস্থা মুখ্যত চারটা গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান – আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাতিসংঘ এবং ডব্লিউটিও এর মাধ্যমে দুনিয়ায় ততপর ও হাজির। এছাড়া আরও প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো মূলত আমাদের মত দেশগুলোর উপর গ্লোবাল ঐ চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে বাকি প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের সমন্বয় করে। অর্থাৎ সেগুলো সরাসরি আমাদের মত দেশের স্বার্থের বিপরীত প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে আমাদের মত দেশের সদস্যপদ নাই। যেমন G7, OECD। চার গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের জন্মের কথা বলছিলাম। না, ১৯৪৪ সালে এটা ঠিক বন্দুকের মুখে ফেলে সই করিয়ে নেয়া ঘটনা নয়। আর আমরা তখন কলোনি মাস্টারের বৃটিশ-ইন্ডিয়ার অধীনস্ত। ফলে আমাদের কথা বলার কিছু নাই। সব কলোনি মাস্টারের সারা ইউরোপের কাছে রুজভেল্টের আমেরিকা তখন হয়ে উঠেছিল একমাত্র ত্রাতা। সে এক অবজেকটিভ বাস্তবতা, পরিস্থিতি যেটা একদিক থেকে সবাই উপায়হীন এক অন্ধকার ভবিষ্যতে, অন্যদিকে একমাত্র আশা ভরসা রুজভেল্ট ও তার আমেরিকা। এবং আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধোত্তর ইউরোপকে বিশেষত ইটালিকে ত্রাণ দিবার ক্ষমতা বাস্তবতা একমাত্র আমেরিকার ছিল এবং দিয়েছিল। আর বিগত ১৯৪১ সালে বৃটেনকে আটলান্টা চার্টারে স্বাক্ষর করিয়ে নেবার পর থেকে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত আমেরিকা স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপের সবার যুদ্ধের সিংহভাগ রসদ ও খরচ যুগিয়েছে। আবার, যুদ্ধশেষে এরপরেও আবার পুনর্বাসন, পুনর্গঠন এর জন্য ধার, বিনিয়োগ সবই এসেছে ঐ আমেরিকা, একই উৎস থেকে। ১৯৩৩ সাল থেকে সারা ইউরোপের তাগিদ আমেরিকা যেন একটা “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা” গড়ার উদ্যোগ নেয়। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু ১৯১৪ সালের পর থেকে ১৯৪৪ সালে পর্যন্ত এই ত্রিশ বছর ধরে কলোনি শাসনের হাত ধরে দুনিয়ায় যে খুবই সীমিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা চালু ছিল তা একেবারেই প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছিল। এই বাস্তবতার মধ্যেই ঐ চার গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে “নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা” গড়ে উঠেছিল। উপরে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে যে বাস্তবতার বন্দীত্বে সারা দুনিয়াকে আমেরিকার হাতে এনে দিয়েছিল এর মুল চাবিকাঠি হল, আমেরিকার অর্থনীতির প্রবল উত্থান, একমাত্র অর্থনীতি যার মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেও উদ্বৃত্ব সম্পদ সঞ্চিত হয়েছিল। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আয়-ব্যয়ে টানাভাবে উদ্বৃত্ব থাকছিল। যুদ্ধের আগের (১৯১৪) দুনিয়া ছিল যার যত কলোনি দেশ দখলে আছে সে তত বড় সাম্রাজ্যের রাজা। আর যুদ্ধের পরে হল উলটা ইউরোপের সব কলোনি দখলকারি মাস্টারেরা দেউলিয়া, সবাই আমেরিকার প্রজা, আমেরিকা একমাত্র দাতা। যেকথা বলছিলাম, আমেরিকার অর্থনীতির প্রবল উত্থান, একমাত্র উদ্বৃত্ব অর্থনীতি – এটাই তার নেতৃত্বে যেকোন নতুন গ্লোবাল অর্ডার কায়েম হবার পিছনের শর্ত, অবজেকটিভ বাস্তবতা তৈরি করে। এই অর্থে চলতি একুশ শতকের শুরুতে দ্বিতীয় দশক ১৯৪৪ সালের আশেপাশের সময়ের বাস্তবতা পরিস্থিতির সাথে তুলনীয়। নিশ্চয় সবটা হুবহু নয়, যেমন আমরা এখন কোন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে নাই। কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ যে দুনিয়ায় একমাত্র অর্থনীতি চীনের, যেখানে সবচেয়ে দ্রুত এবং বেশি উদ্বৃত্ব সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে। এর তুলনায় কাছাকাছিও কেউ নাই। উদ্বৃত সম্পদ মানেই পুনবিনিয়োগের ক্ষমতা। গ্লোবাল অর্থনীতিতে অবকাঠামোখাতে সবচেয়ে প্রভাবশালী বিনিয়োগ ক্ষমতা। তাই AIIB শুধু বিশ্বব্যাংক বা এশিয়ার এডিবিকে চ্যালেঞ্জ করেই থেকে থাকবে না। অপ্রত্যক্ষে আইএমএফকেও চ্যালেঞ্জ করবে। চীনের নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যাবস্থা কায়েমের পথে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে। এই প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত যাব পরে।
কেন আমরা গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওলটপাল্টকে জানব, কোন জায়গায় বসে দেখব
আবার চলতি শতকের প্রথম দশক মানে (২০০১-১০) সালের সময় থেকেই দুনিয়া জুড়ে নানান ঘটনায় বারবার আলামত ফুটে উঠছিল যে ‘গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়’ এক মহা-ওলটপালট আসন্ন বলেছি। গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কথার সোজা মানে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গ্লোবাল ক্যাপিটালের ততপরতা, ফেনোমেনা -গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম। তবে একে ক্যাপিটালিজম বলে চিনিয়ে দিলে আমরা ‘ক্যাপিটালিজম কত খারাপ দেখেছ’ ধরণের এক নৈতিক সমালোচনার দিকে যেন ধাবমান না হয়ে যাই। সেটা আমরা বহু যুগ থেকে করে আসছি। এখন পরিপক্ক হবার সময়। ফলে এটা কত খারাপ বা ভাল এই প্রশ্নের চেয়েও অর্থনৈতিক এই সিষ্টেম বা ব্যবস্থাটাকে বুঝা, কিভাবে ততপর আছে করছে টিকে আছে তা বুঝা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ আমাদের এই বুঝাবুঝির উদ্দেশ্যের দিকটা কি তা না ভুলে বা হারিয়ে সব সময় সামনে সমুন্নত রাখা। উলটাপালটা জঙ্গল পিটিয়ে পরিস্কার থাকতে হবে যে সে উদ্দেশ্য এটা নয় যে এই ব্যবস্থাটা ভাল না খারাপ, চাই কি চাই না। কারণ এই ব্যবস্থা ভাল না খারাপ, চাই অথবা না চাই এর চেয়েও বড় দিকটা হল এই ব্যবস্থার মধ্যেই আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে ও হবে আরও অনেকদিন। ফলে উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশে আমাদের সুনির্দিষ্ট করণীয় কি হবে সেই লক্ষ্যে ব্যবস্থাটাকে বুঝাবুঝি। এই গ্লোবাল ব্যবস্থাটা ভিতরেই বদল ওলটপালট কি হচ্ছে আর এতে আমাদের উপর এর ততপরতা, নড়াচড়ার প্রভাব কোথায় কিভাবে পড়বে আসছে আসবে তা অনুমান করে আর তা থেকে নিজেদের কম্পিটিটিভ এডভ্যানটেজ বা তুলনামূলক সুবিধার দিক কি, কি আমাদের জন্য উন্মোচিত হচ্ছে এসব মিলিয়ে একটা সম্ভাব্য কৌশল নির্ণয়ে পৌছানো। অর্থাৎ এটা দূরে দাঁড়িয়ে বা গ্যালারিতে বসে মজা দেখা না, ভাল খারাপ বলে রায় দেয়া না। আমরা সংশ্লিষ্ট হয়েই আছি, থাকতে হবে এই উপলব্দি জাগিয়ে রেখে সম্ভাব্য নিজ করণীয় কৌশল কি হতে পারে তা বুঝাবুঝির দিকে নিজেদের নিবদ্ধ করা।
চলতি গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা আজীবন দুনিয়াতে এমনই ছিল ব্যাপারটা তেমন নয়। দুনিয়াতে এটা সাজিয়ে নিজেকে মেলে ধরেছিল ১৯৪৪ সালের সময়কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পটভুমিতে। এই হিসাবে গত ৭০ বছর ধরে এই ব্যবস্থার রুস্তমি কায়েম আছে। আর আগেই বলেছি, প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে বললে, অর্থনৈতিক দিকটা সাজানো ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়ে আছে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক, রাজনৈতিক বা পরাশক্তিগত দিকটা জাতিসংঘ আর ব্যবসা বাণিজ্য মানে আন্তর্জাতিক ট্রেডের দিকটা ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ‘সাজানো ও নিয়ন্ত্রণ’ এভাবে বলাতে এসবের নেতিদিকটা তুলে বলা হল। কিন্তু আমাদের উপর এসব প্রতিষ্ঠানের ভুমিকা কেবলই নেতিবাচক এমন ধারণা ও এপ্রোচে নেয়া ভুল হবে। কারণ নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও শেষ বিচারে এর ইতিবাচক দিকটা হল একটা গ্লোবাল সিষ্টেম এতে চালু হয়েছে। দুনিয়াতে কোন সিষ্টেমই চালু ফাংশনাল বা কার্যকর নাই এই সিনারিওটা বাংলাদেশে আমাদের জন্য কোন সুখকর দৃশ্যপট নয়। গ্লোবাল সিষ্টেম নাই কথার সিধা অর্থ, নিজ নিজ রাষ্ট্রসীমার বাইরে কোন কমিউনিকেশন লেনদেন, পণ্য বিনিময় বাণিজ্য, বিনিময় মুদ্রা, ভাব বিনিময় দেয়ানেয়া কিচ্ছু নাই। এমন দৃশ্যপটটা বাংলাদেশের শ্রম, জীবন ব্যবস্থার জন্য বর্তমানের চেয়ে আরও দুঃসহ। অর্থাৎ সারকথাটা হচ্ছে, কোন গ্লোবাল ব্যবস্থা আমাদের অবশ্যই চাই। কিন্তু তাতে আমাদের উপযুক্ত শেয়ার, আমাদের স্বার্থ আমাদের কথা ভয়েস শোনানোর উপযুক্ত ব্যবস্থাও চাই। মানে এটা স্রেফ কোন প্রতিষ্ঠানের নিপাত যাকের মামলা নয়।
আইএমএফ জন্মের আগে মুদ্রার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল না
যেমন ১৯৪৪ সালের আগের দুনিয়াটা দেখতে কেমন ছিল তা যদি আমরা খুজি তাহলে দেখব চলতি “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা” ধরণের কাছাকাছি তুল্য কিছু নাই। আছে কলোনি সম্পর্কের অধীন এক খুবই সীমিত অপুষ্ট এক বিনিময় ব্যবস্থা। কলোনি মানে কলোনি-দাস জনগোষ্ঠীর আত্মস্বীকৃতি এই মৌলিক দিকটাই সেখানে অনুপস্থিত। লেনদেনের গ্রহণযোগ্য কোন আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে কিছু দাড়ায় নাই, ছিল না। যদিও ভাল দিকটা ছিল কোন মুদ্রা মানে কোন না কোন প্রাইভেট ব্যাংকের নোট। ঐ নোট দেখালে সেই ব্যাংক নোটের বদলে গচ্ছিত রাখা সমতুল্য সোনা ফিরিয়ে দিত। এটাকে গোল্ড ব্যাকড নোট – বলা হয়। এই সময়ে চালু কলোনি অর্থনৈতিক সিষ্টেমের এক গুরুত্বপুর্ণ উল্লেখযোগ্য লক্ষণ চিহ্ন হল, কোন দেশের মুদ্রা কি হবে ওর মান হার কি হবে তা নির্ধারণে ঐ কালের কলোনি সাম্রাজ্য রাষ্ট্র ধরণের বৃটিশ বা ফরাসী এমপায়ার রাষ্ট্রের কোন হস্তক্ষেপ (অবমুল্যায়ন বা অতিমুল্যায়ন) ছিল না। মুদ্রার মান হার নির্ধারিত হত বাজার দিয়ে – শেষ বিচারে প্রাইভেট বা পারিবারিক ব্যাংকের হাতে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের হাতের বাইরে। এককথায়, কলোনি আমলে মুদ্রা ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু অসুবিধার দিকটা ছিল, আন্তঃ কলোনি মাষ্টারের মধ্যে বিনিময় যেমন বৃটিশের সাথে ফরাসী বিনিময় খুবই সীমিত অপুষ্ট পর্যায়ের। আর আমরা নিজেরা তখনকার বৃটিশ-ইন্ডিয়ার আমরা গোনায় ধরিনা, বাইরে। তবে মূল একমুখি উদ্বৃত পাচার একটা ছিল বৃটিশ-ইন্ডিয়া থেকে বৃটেনমুখি। এটাকে পণ্য বিনিময় বলা কষ্টকর। একথা নিসন্দেহে সত্যি যে আমরা কলোনি ধরণের বিনিময় ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে ১৯৪৪ সাল থেকে আমেরিকার ওয়াল ষ্ট্রিটের অধীনস্ত গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মধ্যে পড়েছি। তবু তুল্য বিচারে এটা ভাল। এই ব্যবস্থা অসাম্যের হলেও অন্তত পণ্য, মুদ্রা, টেকনোলজি, ভাব ইত্যাদির বিনিময়ের দিক থেকে এটা অনেকানেক ব্যাপক বিস্তৃত ফলে কলোনি যুগের ব্যবস্থার তুলনায় ভাল। আবার ওয়াল ষ্ট্রিটের অধীনস্ত গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে খারাপ দিক হল, এর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক গড়তে ও একে কার্যকর করতে গিয়ে সাধারণভাবে “রাষ্ট্র ও মুদ্রাকে” গভীরভাবে সম্পর্কিত তো বটেই নিজ মুদ্রার মান হার বাজারের বদলে রাষ্ট্রের হাতে চলে গিয়েছে। “সমাজতন্ত্রী মনের” বিচারে অনেকের মনে হতে পারে এটা ভালই তো, বাজারের প্রাইভেট ব্যাংকের বদলে মুদ্রার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়েছে। কিন্তু এই বুঝ মিথ্যা আর ফাঁকির বুঝ, প্যারাডক্স।
আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে গ্লোবাল বিশ্বব্যবস্থাটাকে আগের কলোনি যুগের সঙ্গে তুলনা করছিলাম। প্রথমটাকে ১৯৪৪ সালের সুচনা ঘটনা মানলেও পরেরটা ১৯৪৪ সালের আগে বলতে আসলে ১৯১৪ সালের আগে বুঝতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু ১৯১৪ সাল তাই এর আগে। কারণ ১৯১৪-১৯৪৪ এই ত্রিশ বছর সময়কালকে তুলনায় বলা যায় “নো সিষ্টেমের” যুগ। এমনকি অন্তর্বর্তিকালীন সময়ও সেটা নয় যে নতুন ব্যবস্থা সেখানে তৈরি হতে শুরু করেছে এমন। বলা যায় ঐ সময়টা পুরান কলোনি ব্যবস্থাকে কেবল ভাঙ্গছে আর ভাঙ্গছেই নতুন ব্যবস্থা জন্মানোর আলামত নাই, ফলে যে যেমনে পারে কোন মতে দিন গুজরান, সংকটের দিন পাড় করা ধরণের কাল। এসবের মূল কারণ যুদ্ধ আর চেপে বসা ক্রমবর্ধ্মান যুদ্ধের খরচ – এটাই সবার আগে চলতি মুদ্রার বাজার ব্যবস্থাকে নন-ফাংশনাল করে দিয়েছিল। আগেই বলেছি ঐ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট ছিল, প্রাইভেট ব্যাংক হলেও সোনা মজুদ রাখার বিনিময়ে সম-পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো আর প্রতিদিন যে পরিমাণ সোনা বা ভিন্ন প্রাইভেট ব্যাংক মুদ্রা ফেরত আসলে আর যে পরিমাণ বের হলে গেল এর সাম্য প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তিতে পরের দিন সকালের মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেয়া। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এই দুই গুরুত্বপুর্ণ ভিত্তির উপর আস্থা নষ্ট হয়ে পড়ায় ব্যবস্থাটাই নন-ফাংশনাল হয়ে যায়। এর উপর আবার – যেমন ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড তখনও প্রাইভেট ব্যাংক তবে মুদ্রা ছাপানোর একমাত্র লাইসেন্সধারি। এবং সেই সাথে ব্যক্তি একাউন্টধারি খাতকের মতই বৃটিশ রাষ্ট্রও তার একাউন্টধারি গ্রাহক মাত্র। এই বিশেষ গ্রাহককে যুদ্ধের খরচে মিটাতে ব্যাংককে প্রচুর বেধরক ধার দিতে হয়েছে, আবার কবে ধার শোধ করতে পারবে সে আলামত নাই। এই পরিস্থিতিটা হল, ব্যাংক থেকে সোনা বেরিয়ে গেছে যার ফেরার আলামত নাই। এই ক্ষতির ফলাফল সব খাতকের উপর পড়েছিল। দেশে বিদেশে পাউন্ড মুদ্রার উপর কারও আস্থা নাই। এটা ১৯৩০ সালের পর থেকে, একমাত্র নগদ সোনার বিনিময়েই আমেরিকার সাথে এক ধরণের সীমিত বিনিময় ঘটেছিল তাও আবার ওকে ঠিক বাণিজ্য নয় একমুখি বিনিময় বলা যেতে পারে। আমেরিকান ব্যবসায়ীর অস্ত্র বা যুদ্ধের রসদ নামিয়ে বিনিময়ে নগদ সোনা নিয়ে ভেগে পড়া ধরণের। আমেরিকার “ক্যাশ এন্ড ক্যারি আইন” ১৯৩৫, ১৯৩৭ এসবের সাক্ষ্য।
আবার এখনকার দুনিয়ায় সব রাষ্ট্রেই একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা রিজার্ভ ব্যাংক নামে প্রতিষ্ঠান থাকা স্বাভাবিক ফেনোমেনা হয়ে গেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক – মানে মুদ্রা, মুদ্রার মান, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ এসবের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠা করার এক প্রতিষ্ঠান থাকাটা অবশ্যম্ভাবি মনে করা হয়। কিন্তু এর ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ফেনোমেনাটা ১৯৪৪ সালের আশেপাশের সময়ের। তবে ১৯৪৪ সালের আগের ত্রিশ বছরে সময়ের ভিতর। তবে কিছুটা একমাত্র ব্যতিক্রম যেমন আমেরিকার ফেডারল রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৩ সালে। এবং কারণও ভিন্ন। এর পিছনের কারণ ঠিক ডলারের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নয়। বরং তার আগে আলাদা আলাদা প্রাইভেট ব্যাংকের আলাদা সিলের নোট তো বটেই – এক আমেরিকান রাজ্যের নোট আর এক রাজ্যে গৃহীত হত না, চালু ছিল না। অর্থাৎ প্রত্যেক রাজ্য তার অর্থনীতির উদ্বৃত্ব নিজ রাজ্যেই পুনবিনিয়োগ হতে ধরে রাখতে চাইত। ১৭৭৬ সালে জন্মের পর থেকেই এই রক্ষণশীল অবস্থান ব্যবস্থা ছিল। মুল বিষয়ছিল ফেডারেল ব্যবস্থার নামে এক রাজ্য যেন অন্য রাজ্যের উপর বাড়তি সুবিধা না নিতে পারে। যেটা খুব সম্ভবত পরবর্তিতে পুঁজির সঞ্চয় বেড়ে যাওয়া বা উলটা করে বললে নিজ রাজ্যে পুনবিনিয়োগের সুযোগ সীমিত হয়ে আসায় অপর রাজ্যে বিনিয়োগ সন্ধানে বের হওয়া বাস্তবতা হয়ে পড়েছিল। এছাড়া রাজ্যগুলোর মধ্যে সমন্বয়, একসাথে পরিকল্পনা ইন্টগ্রেশনে ও ফেডারেল ব্যবস্থা কার্যকর থাকার সুবিধার দিক চিন্তা করে ফেডারেল রিজার্ভ নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করা হয়। আর ওদিকে ইউরোপে প্রায় সব দেশে এমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৩০-১৯৪৬ সালের মধ্যে। এর মূল কারণ এককথায় বললে, ১৯৩০ এর মহামন্দা ফলে প্রত্যেক রাষ্ট্রের মুদ্রার অবমুল্যায়ন ঘটিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য রাষ্ট্রের উপর রপ্তানি বাণিজ্যের সুবিধা পেতে চেয়ে করা হয়েছিল। যদিও এসবের মিলিত ফলাফল শেষ পর্যন্ত শুণ্য। কারণ সবাই কমালে কেউ কারো উপর সুবিধা হাসিল করতে পারেনি। সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মুদ্রার অবমুল্যায়ন তখনই করা সম্ভব যখন মুদ্রার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধরণের কিছু আছে। মুদ্রা যদি বাজার আর প্রাইভেট ব্যাংকের হাতে পরিচালিত হয় তবে রাষ্টের অবমুল্যায়নের খায়েসে তারা সাড়া দিবে না। ওদিকে ১৯১৪ সালের পর থেকেই রাষ্ট্র নিজেই প্রাইভেট ব্যাংকের খাতক হিসাবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশির ঘাটতিতে, সেই ঘাটিতি পুরণে ঋণ নেয়া আর ঋণশোধের ব্যর্থতায় দেউলিয়া – এই দশা থেকে একটা আপাত সুরাহা চাচ্ছিল রাষ্ট্র। যেমন, মুদ্রার অবমুল্যায়ন বা মুদ্রাস্ফীতি আগে নেয়া ঋণের প্রকৃত মুল্য ক্ষয়ে যায় বা কমিয়ে দেয়। রাষ্ট্রের নিজের পুরানা দেউলিয়াত্ব কাটানো এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কেউ ১৯৪৪ সালের আগেই মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারি প্রাইভেট ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে ঘোষণা করে। এছাড়া সব স্থানীয় মুদ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর আইডিয়ার বাস্তবায়ন ও এর কার্যকরি প্রতিষ্ঠান হওয়া একমাত্র সম্ভব এর প্রত্যেকে সদ্স্য রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রত্যেক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক অস্তিত্ত্ব থাকার পুর্বশর্ত। তাই বাস্তবে দেখা যায়, কোন রাষ্ট্রের আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর সদস্যলাভ করতে চাইলে ঐ রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কিছু আছে কি না, ঐ রাষ্ট্রের স্থানীয় মুদ্রা তা ঐ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে কি না এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর যে কমন ফরম্যাটে অনুসারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ততপরতার বিষয়ক বেস ডাটা সংগ্রহ ও সরবরাহের উপযোগী কি না ইত্যাদি সদস্যপদ লাভের টেকনিক্যাল পুর্বশর্ত।
এসব ঘটনাবলির ভিতর দিয়ে মুদ্রা সরবরাহের উপর অবমুল্যায়ন্সহ সব ধরণের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের মাধ্যমে আইএমএফ হাতে নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থা ভেঙ্গে নিজ নিজ স্থানীয় মুদ্রার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রথম ঘটনাটা ঘটা শুরু এখান থেকে।
AIIB এর উদ্যোক্তা-সদস্য হবার সুযোগ এই মাসেই শেষ, এরপর এই বছর শেষের মধ্যে মালিকানা শেয়ারসহ ম্যান্ডেট চার্টার আইন কানুন শেষ করে আগামি বছরের শুরু থেকে এই ব্যাংক কার্যকর হতে চায়। এই উদ্যোগের সাথে একটা জিনিষ নিশ্চিত থাকা যায় যে ডলারের বদলে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে আন্তর্জাতিক পণ্য বিনিময়ের মুল্য শোধের ব্যবস্থা খাড়া করা একটা মূল উদ্দেশ্য হবে। সব দ্বিধা ছেড়ে আগেভাগে বৃটেনের আগিয়ে আসার পিছনের বড় কারণ এটা। সে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, হংকংয়ের বাইরে ইউয়ানে পণ্য বিনিময়ে দ্বিতীয় ক্লিয়ারিং হাউস হতে চায় লন্ডন। অর্থাৎ গ্লোবাল অর্থনীতিতে কার্যকর বড় বড় প্রভাব আমরা দেখতে শুরু করব আগামি বছর থেকে। AIIB চালু হলে এর প্রভাব প্রতিক্রিয়া কোথায় কোথায় কিভাবে কতটুকু পড়বে, আমাদের অর্থনীতির জন্য কি সুবিধা অসুবিধা আনবে সেসব দিক নিয়ে আলো ফেলার চেষ্টা করব পরের পর্বে।