নতুন অর্থ ব্যবস্থা গড়তে চীনা উদ্যোগের সঙ্গে ব্রিটেন
গৌতম দাস
০৯ এপ্রিল ২০১৫
আগামী দিনের ইতিহাসে ১২ মার্চ ২০১৫ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে সম্ভবত বিবেচিত হবে। ঘটনাটার শুরু, গত বছরের অক্টোবরে চীনের সাংহাইয়ে চীন কর্তৃক প্রস্তাবিত Asian Infrastructure Investment Bank (সংক্ষেপে AIIB), এর উদ্যোক্তা সদস্য হতে আগ্রহী দেশগুলোর আহূত এক সম্মেলন থেকে এই ব্যাংকের কার্যক্রমের হাজিরা ঘোষণা করেছিল। AIIB কার্যকর হলে তা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা রাখতে শুরু করবে। ওই সম্মেলন থেকে উদ্যোক্তা পত্র বা Memorandum of Understanding (MOU)-এ স্বাক্ষর করা শুরু হয়েছিল। উদ্যোক্তা সদস্য কারা কারা হতে চায় সেই সম্মতি জানানোর খাতা তখন থেকে খোলা হয়েছিল। উদ্যোক্তা স্বাক্ষরদান বন্ধ হওয়ার শেষ দিন ৩১ মার্চ ২০১৫। উদ্যোক্তা সম্মেলন হয়ে যাওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় ১৩ মার্চ ২০১৫ হঠাৎ করে ব্রিটেন ওই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা-উদ্যোক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। আমেরিকার নেতৃত্বে দুনিয়ার ওপর মাতবরি, আধিপত্য প্রভাব জারি রাখার উদ্দেশ্যে মাতবর পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় আলোচনার জন্য ‘জি৭’ বা গ্রুপ সেভেন নামে একটি সংগঠন আছে। গ্রুপ সেভেন অন্তর্ভুক্ত সাত রাষ্ট্রের সবাই তবে আলাদা আলাদা করে AIIB-এর ঘোষণার সময় ঘটনাটিকে বাঁকা চোখে দেখেছিল। এখন ‘জি৭’-এর ব্রিটেন একমাত্র রাষ্ট্র যে দলছুট হয়ে বিপরীত ক্যাম্পে যোগদানের সিদ্ধান্ত জানাল। ওদিকে ব্রিটেনের এ সিদ্ধান্তে আমেরিকা সবচেয়ে অখুশি ও অসন্তুষ্টি জানিয়েছে। জবাবে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের অবস্থান নিয়ে কথা হয়েছে।’ আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষায় ‘এটা সারপ্রাইজ সিদ্ধান্ত’। বোঝাই যাচ্ছে, AIIB-এর উত্থান বা আবির্ভাব কোনো সাধারণ ব্যাংক আবির্ভাবের মতো ফেনোমেনা নয়। এটি ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়েই ফাংশনাল হতে যাচ্ছে, ফলে স্বভাবতই তা হবে এ দুই প্রতিষ্ঠানের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলের ভেতর দিয়ে ওই যুদ্ধের পর থেকে (১৯৪৪) ইউরোপকেন্দ্রিক কলোনি শাসনের যুগের সমাপ্তি টেনে অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে আমেরিকান নেতৃত্বে নতুন করে পশ্চিমা শাসন দুনিয়াতে কায়েম হয়েছিল। এর সবচেয়ে তাৎপর্যময় দিকটি ছিল, আমেরিকা নিজের আধিপত্যের নতুন কাল শুরু করেছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে – আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাতিসংঘ আর ডবিস্নউটিও এসব গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। এ চার প্রতিষ্ঠানের প্রথম দুইটি গ্লোবাল অর্থনীতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য, তৃতীয়টি গ্লোবাল রাজনৈতিক (পরাশক্তিগত) ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য আর চতুর্থটি গ্লোবাল পণ্য রফতানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য। এভাবেই দুনিয়াতে নিজের অধীনস্থ নিজেদের দিকে কান্নি মারা এক গ্লোবাল আধিপত্য ব্যবস্থা কায়েম ও যাত্রা শুরু করা হয়েছিল। গ্লোবাল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দুনিয়ায় আধিপত্য করার এ ফেনোমেনা এর আগের ৩০০ বছরের কলোনি যুগেও দেখা যায়নি। কলোনি যুগ সেটা পারেনি। যেমন আইএমএফের প্রধান ভূমিকা বা ম্যান্ডেট হলো, আন্তর্জাতিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা চালু রাখা। সে কাজে মুখ্য প্রয়োজনীয় হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিনিময় মুদ্রা। আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আয়ব্যয়ের ঘাটতিতে পড়া সদস্য কোনো রাষ্ট্রকে ধার দিয়ে ঘাটতি পূরণ – এ দুই মূল কাজের মাধ্যমে গ্লোবাল মুদ্রা ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ করে আইএমএফ সে ভূমিকা বাস্তবায়ন করে থাকে। মানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের সঙ্গে আর তিনটি প্রধান মুদ্রার তুল্য বিনিময় হার নির্ধারণ করে, এরপর বাকি সব সদস্য রাষ্ট্রের মুদ্রার বিনিময় হার সেই নিরিখে নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করে থাকে। এটা বলা বাহুল্য যে, এ প্রাতিষ্ঠানিকতা একচেটিয়া আমেরিকা বা এর মুদ্রা ডলারের অধীনে নিয়ন্ত্রণে আমাদের মতো গরিব বা ছোট অর্থনীতির দেশের ওপর আধিপত্য কায়েম করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এ অস্বস্তি সত্ত্বেও এর ভেতর দিয়ে পড়ে পাওয়া সুবিধার দিকটি হলো, আমেরিকার দিকে কান্নি মারা হলেও এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বিনিময় লেনদেন ব্যবস্থা, যেটাকে গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা অর্ডার বলছি তা দুনিয়ায় সেই থেকে চালু হয়ে আছে। চলতি এ গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় আগের প্রায় ৩০০ বছরের কলোনি যুগের মুদ্রা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও মান নির্ধারণের লক্ষ্যে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম ঘটেনি। এমনকি কোনো কলোনি মাস্টার যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রাষ্ট্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কিছু ছিল না। আর মুদ্রার মান বা হার নির্ধারণ নিয়ন্ত্রণও কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করত না। ব্যাংক অব ইংল্যাল্ডকে মাত্র ১৯৪৬ সালে সরকার অধিগ্রহণ করে ব্রিটেনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের দায়িত্বে হাজির করে। দেশের ব্যাংক ব্যবসা ও স্থানীয় মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে নিতে হবে – এ ধারণাটি ১৯৪৪ সালে আইএমএফের জন্মের সমসাময়িক ঘটনা। কারণ আইএমএফ প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমেই নিজের উপস্থিতি, কর্তৃত্ব তৎপরতা ও কার্যকারিতা কায়েম করে থাকে। সে সময় এসবের কোন বালাই ছিল না। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় লেনদেন ছিল খুবই সীমিত পর্যায়ে। ফলে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হতো কোনো প্রাইভেট ব্যাংকে নয়, যেমন হত রথশিল্ড-পরিবার ধরনের পারিবারিক ব্যাংকের মাধ্যমে; বাবা রথশিল্ড আর তার তিন ছেলে ইউরোপের চার শহরে বসে পরস্পরের যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিদিন সকালে বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিতেন। এভাবেই এক মুদ্রা বিনিময় হার ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ফলে সীমিত পণ্য বিনিময় বাণিজ্য ব্যবস্থা সে সময় চালু ছিল। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় কথা হলো, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই মুদ্রা বিনিময় হারের এই ব্যবস্থার প্রতি বাজারের আস্থাহীনতার কারণে ভেঙে পড়েছিল চিরদিনের জন্য। পরে শেষমেশে এ প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতিতে ১৯১৪ থেকে ১৯৪৪ এই ৩০ বছর কোনো আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য মুদ্রা বলে কিছু ছিল না। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় লেনদেন প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। এরপর এমন দুর্দশায় পৌঁছানো ইউরোপ বারবার অনুরোধ করে একেবারে হাতে-পায়ে ধরার অবস্থায় পৌঁছে, আমেরিকার নেতৃত্বে নতুন করে এক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় (আইএমএফ) আমেরিকান ডলারকে একমাত্র আন্তর্জাতিক মুদ্রা মেনে নতুন গ্লোবাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সূচনা হয়। আমেরিকার হাতে-পায়ে ধরা আর ডলারকে একমাত্র আন্তর্জাতিক মুদ্রা মেনে নতুন গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সাজানো – এসবের মূল কারণ একটাই। তা হলো ১৯১৪ সাল থেকেই যুদ্ধে জড়িয়ে ইউরোপের প্রতিটি রাষ্ট্র যুদ্ধের খরচ জোগাতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় আয়ব্যয়ের মারাত্মক অসামঞ্জস্য ঘাটতির মুখোমুখি হয়। পরিণতিতে প্রত্যেকেই জাতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েও অন্য দেশের মুদ্রার তুলনায় নিজ মুদ্রার একটি স্থিতিশীল মান বা হার ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। বিপরীতে সে সময়ের একমাত্র উদ্বৃত্ত অর্থনীতির রাষ্ট্র ছিল আমেরিকা। তাই ডলারকে একমাত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মুদ্রা মেনে নতুন করে গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সাজানো, ফলে গ্লোবাল বাণিজ্য বিনিময় লেনদেন ব্যবস্থা সাজানো ছাড়া কারও উপায় ছিল না। আইএমএফের জন্ম হয় এভাবেই। সে থেকে ডলারকেন্দ্রিক অন্য মুদ্রার হার নির্ণয়, প্রত্যেক রাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্যের খাতায় ডলার হিসাবের মুদ্রা হয়ে পড়া ও অন্যান্য মুদ্রার হার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি করে আসছিল আইএমএফ। সংক্ষেপে এ হলো ডলারের উত্থান ও শাসন কাহিনী। কিন্তু ১০ বছরে ক্রমেই চীনের অর্থনৈতিক উত্থান সে কাহিনীতে নয়া ওলটপালট আসন্ন হওয়ার আলামত দেখা দিতে শুরু করেছে।
শুরু করেছিলাম ইতিহাসের কথা তুলে। সে আগামী দিনের ইতিহাস মানে কোন ইতিহাসে- ‘গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক’ অর্থনৈতিক ইতিহাসে। অর্থাৎ গ্লোবাল অর্থনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা বা অর্ডার শৃঙ্খলের ওপর এবার চীনের নতুন করে নতুন প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার প্রভাব – এটা শুধু গ্লোবাল অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এ প্রভাব পড়বে ও ধীরে ধীরে বাড়বে- দুনিয়ার পরাশক্তিগত ভারসাম্যে, গ্লোবাল রাজনীতিতে, স্ট্র্যাটেজিক ও সামরিক ইত্যাদি সব গ্লোবাল ফেনোমেনাকে তা প্রভাবিত করবে। চলতি একুশ শতকের প্রথম দশক (২০০১-২০১০) গ্লোবাল পরাশক্তিগত পরিস্থিতিতে দুইটি নতুন ইঙ্গিত হাজির হতে দেখা দিয়েছিল। প্রথমটি গ্লোবাল রাজনৈতিক ফেনোমেনা আকারে। দুনিয়ায় পশ্চিমের ক্ষমতা আধিপত্যের শাসনকে চ্যালেঞ্জকারী ‘ইসলাম প্রশ্ন’কে সামনে আনা বা তুলে ধরার নতুন রাজনৈতিক ফেনোমেনা। গ্লোবাল রাজনীতিতে ইসলামের এ নয়া প্রভাব আর এর পাল্টা পশ্চিমের ‘ওয়ার অন টেরর’ কোথায় গিয়ে শেষ হবে, পরিণতিতে আগামীতে দুনিয়া দেখতে কেমন হবে তা এখনও ফয়সালা হয়নি। তা আদৌ হবে কিনা, নাকি কে হেরে যাবে তা এখনও অমীমাংসিত অসমাপ্ত। তবে ছড়িয়ে পড়া বা বিস্তৃতির দিক থেকে বললে গ্লোবাল রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব ভালোই ছড়িয়েছে, ল্যাটিন আমেরিকা বাদে সব মহাদেশকেই তা স্পর্শ করে ফেলেছে বলা যায়। এছাড়া ওদিকে ঐ দশকের দ্বিতীয় ফেনোমেনাটা হলো গ্লোবাল অর্থনীতিতে চীনের উত্থান। আর এর প্রভাবে আমেরিকার একক পরাশক্তিগত ভূমিকা নড়বড়ে হয়ে নতুন এক পরাশক্তিগত ভারসাম্য আসন্ন হওয়ার ইঙ্গিত। এর রাজনৈতিক ইঙ্গিতগুলো অনুভূত হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই; কিন্তু আমেরিকার সরকারি গবেষণা, স্টাডি এবং প্রাপ্ত নিউমেরিক্যাল ডাটা প্রজেকশন থেকে প্রথম নতুন চিত্র স্পষ্ট হয় ২০০৭-৮ সাল থেকে। অর্থনীতিতে গ্লোবাল পুঁজির প্রবাহ পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী হতে শুরু করেছে- এ তথ্যগত স্বীকৃতি তখনকার প্রকাশিত রিপোর্ট থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, পুঁজির এ প্রবাহের ধরন কেবল একমুখী অর্থাৎ ভবিষ্যতে আবার কোনোদিন এর বিপরীতমুখী হওয়ার সম্ভাবনা নেই- এটাও সেই গবেষণালব্ধ ফলে প্রকাশিত হয়। এ গবেষণা হয়েছিল আমেরিকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের’ অধীনে এবং ২০০৮ সালে জনসমক্ষে প্রকাশিত রিপোর্টে। এমনিতেই এমন পরিসংখ্যানগত গবেষণা রিপোর্ট প্রতি চার বছর অন্তর প্রকাশিত হওয়া এক চলমান ঘটনা। তবে ২০০৮ সালের রিপোর্ট ছিল স্বভাবতই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই রিপোর্টকে বলা যেতে পারে, গ্লোবাল অর্থনীতি ও পরাশক্তিগত পরিস্থতিতে আসন্ন নতুন করে সাজানো ভারসাম্যের ইঙ্গিত। এসব ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান কী হতে যাচ্ছে সেসব জানা ও জানানো। কিন্তু বাস্তবে সে জায়গায় চীন পৌঁছাবে কী করে আর তাতে উপস্থিত মাতবররা কে কি ভূমিকা নেবেন এসবের বাস্তব রূপ আকার দিতে যাচ্ছে AIIB-এর আবির্ভাব। কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত বাণিজ্যের চীন যে এমন কিছু করতে যাচ্ছে তা অনেক আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। যেমন- নিজ বাণিজ্যের উদ্বৃত্তের অর্থ নিয়ে চীন চুপচাপ পুরনো কান্নি মারা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক যেমন আছে, তেমনি রেখে এতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুনিয়াতে নিজের নতুন প্রভাব যোগ করার চেষ্টা করা – এটাকে চীন সঠিক মনে করেনি। তাই এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি, ভোটিং রাইট ইত্যাদিতে সংস্কারের দাবি করেছিল। প্রতিষ্ঠান দুইটি ২০০৯ সালের বার্ষিক সম্মেলন থেকেই এ ব্যাপারে নিজের সম্মতির কথা জানান দিয়েছিল। কিন্তু আমেরিকান রাজনৈতিক নেতৃত্ব এতে সাড়া দেয়নি। প্রতিষ্ঠান দুটোর সংস্কার প্রস্তাবের ফাইল সেই থেকে আমেরিকান কংগ্রেসে পড়ে আছে। ফলে ২০০৯ সাল থেকেই চীন বিকল্প উদ্যোগ নেয়ার পথে চলতে শুরু করে। আর এতে বিশেষত রাশিয়ার প্রবল আগ্রহে BRICS ব্যাংক নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ শুরু হয়। রাইজিং ইকোনমির পাঁচ দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকাকে নিয়ে রাশিয়াতে প্রথম ব্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সে থেকে প্রতিবছর ব্রিক সম্মেলন হওয়া সত্ত্বেও ইন্ডিয়ার নড়বড়ে হাফ-হার্টেড ভূমিকার জন্য ব্রিক কার্যকর প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে এখনও অনেক দূরে থেকে যায়। এ অবস্থা দেখে চীন আর এক বিকল্প উদ্যোগে আগানো শুরু করে। মাত্র ২০১৩ সালে AIIB-এর ঘোষণা দিয়েই পরের বছর ২০১৪ সালে AIIB এর উদ্যোক্তা সম্মেলন ডেকে বসে চীন। ব্রিক ব্যাংক উদ্যোগের চেয়েও AIIB-এর উদ্যোগ বাস্তবায়ন অনেক গতিশীল। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ব্রিটেনের এতে যোগদানের সিদ্ধান্ত বিরাট সাড়া ফেলতে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া অক্টোবরের AIIB-এর উদ্যোক্তা সম্মেলনে প্রায় যোগ দিয়েই ফেলেছিল; কিন্তু ওবামার কড়া হুমকি ও লবিংয়ের কারণে এরা শেষে থমকে যায়। এবার ব্রিটেনের সিদ্ধান্তের প্রভাবে ওবামার বাধা পেরিয়ে দেশ দুইটি এবার সম্ভবত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে। এ বছরের শেষ থেকে উদ্যোক্তারা AIIB-কে কার্যকর করে ফেলতে চান। AIIB-এর উত্থান ৭০ বছরের গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানোর ওলটপালট ঘটনা হিসেবে হাজির হতে যাচ্ছে।
দুইঃ
চীনের বিশ্বব্যাংক, এবার “উন্নয়ন” এর অর্থ কি বদলে যাবে
আগের পর্বে বিশ্বব্যাংকের আদলে এবং একে চ্যালেঞ্জকারী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চীনের নেতৃত্বে AIIB ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে বলেছিলাম। AIIB ব্যাংক গড়ার লক্ষ্যে চীনের সাংহাইয়ে প্রথম উদ্যোক্তা সম্মেলন হয়েছিল গত বছর ২৬ অক্টোবর। ওই সম্মেলনে এশিয়ার বাইরের কোনো রাষ্ট্র যোগ দিতে আসেনি। AIIB প্রসঙ্গে আগের লেখাতে ফোকাস করেছিলাম ১২ মার্চ, আচমকা ব্রিটেনের যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তকে। এবারের ফোকাস অন্যদিকে। AIIB-তে বিশ্বব্যাংকের মতোই শুধু কোনো রাষ্ট্রই এর সদস্য হতে পারে, কোনো প্রাইভেট কোম্পানি বা ব্যক্তি নয়। আর সম্মেলনের দিনেই কে কে উদ্যোক্তা হতে চায় এমন রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি স্বাক্ষর বইয়ে সই করেছিল এশিয়ার ২০টি রাষ্ট্র। এরপর সে স্বাক্ষর খাতা খুলে রাখা হয় পরবর্তী পাঁচ মাস, ৩১ মার্চ পর্যন্ত। মঙ্গলবার শেষ দিন গত হয়েছে। এর মানে কি এখন আর কেউ সদস্য হতে আবেদন জানাতে পারবে না? না ঠিক তা নয়। ৩১ মার্চের পরের আবেদনে কেউ সাধারণ সদস্য হতে পারবে, কিন্তু আর উদ্যোক্তা সদস্য হতে পারবে না। যেমন- বাংলাদেশ উদ্যোক্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল, স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ উদ্যোক্তা সদস্যদের একজন। তাতে বাংলাদেশের বাড়তি কী লাভ হতে পারে? লাভ হল। এখন শুধু উদ্যোক্তা সদস্যরাই বসে আগামী বছর থেকে কাজে নেমে যেতে চাওয়া AIIB ব্যাংকের ম্যান্ডেট অর্থাৎ এর গঠনপ্রণালি ও কার্যপ্রণালির আর্টিকেল লিখবে। আর একটু সোজা কথায়, কে কত শেয়ার মালিকানা নেবে, পরিচালনায় কে কোন পদপদবি নেবে-পাবে, দায় নেবে, পরিচালনার নীতি, সদস্যপদের চাঁদা ধার্যের নীতি, ঋণ দেয়ার নীতি ইত্যাদিসহ পরিচালনার সব বিষয়ে নির্ধারণ করতে পরস্পরের সঙ্গে নিগোসিয়েশনের টেবিলে বসবে, নিজ নিজ অর্থনীতির সক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে, নীতি তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। যারা ৩১ মার্চের পর সদস্যপদের আবেদন করবে তারা আর এই টেবিলে বসার সুযোগ পাবে না। এ হলো ফারাক। তবে একথা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, ওই টেবিলে বসাটাই আবার শেষ কথা নয়, নিজ অর্থনীতির সক্ষমতা, আরও স্পষ্ট করে বললে মূলত কী পরিমাণ উদ্বৃত্ত সম্পদের অর্থনীতি আমার রাষ্ট্রের আছে এবং তা কতটা দীর্ঘ লাগাতার- এসবই ঠিক করে দেবে নেগোসিয়েশন টেবিলে আমার গলার স্বরের ওজন কেমন হবে। তবে আবার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার মতো ইস্যুগুলো নেগোসিয়েশনের মতো বিষয় নয়। বরং প্রতিষ্ঠানের নিজের দক্ষ ও স্বচ্ছ হয়ে টিকে থাকা না থাকার বিষয়। তাই এসব বাস্তবে বেস্ট যা করা সম্ভব তাতে সবার ঐকমত্যই ঘটবে তা আশা করা যেতে পারে। আর কিছু প্রসঙ্গে সিরিয়াস বিতর্ক দেখা দেবেই, তা বলা বাহুল্য।
যেমন ‘উন্নয়ন’ বা ইংরেজিতে ‘ডেভেলপমেন্ট’ শব্দের কথাই ধরা যাক। অনেকে আমরা হয়তো খেয়াল করেছি অথবা না, তবে এটা বুঝি এ শব্দটা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে চলে এমন এক শব্দ। এ শব্দের বিশেষ অর্থ ১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্মের পর থেকে নতুন বিশেষ অর্থে কয়েন করে নেয়া হয়। বিশেষ কিছু বোঝানোর শব্দ হয়ে যায় এটা। এ শব্দ আর এর ভাবের প্রভাবে আমাদের রাজনীতির ভোকাবুলারিও বদলে গেছে। যেমন বলা হয়, আমরা ‘উন্নয়নের রাজনীতি’ করি বা করব। এমন ভাবের বাক্য ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্ব্বার থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত চালু এবং সরকার বা বিরোধী সবাই ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, অহরহ ব্যবহার করি। ভোটার, জনগণের কাছেও এর অর্থ আছে, নিজের মতো করে বুঝে, কমিউনিকেটেডও হয়, পৌঁছায়। ভোটার-জনগণও কিছু একটা বোঝে। তাহলে এমন প্রশ্ন তুললাম কেন যে, AIIB ব্যাংক গঠনের নেগোসিয়েশনের কালে উন্নয়ন শব্দটা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিতে পারে? সে প্রসঙ্গ হলো এ পর্বের রচনার ফোকাস। কিন্তু সরাসরি সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বরং কিছু বিষয় ধারণা পরিষ্কার করার ভেতর দিয়ে যাব। যেমন- AIIB ব্যাংক কী? এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলতে হচ্ছে এটা বিশ্বব্যাংকের আদলে এবং বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জকারী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও সেই সূত্রে আইএমএফ এরা কেমন প্রতিষ্ঠান, কী করে, কেমনে করে ইত্যাদি সম্পর্কে সোজা ভাষায় কিছু ধারণা দেয়া ছাড়া AIIB ব্যাংক নিয়ে কোনো ধারণা স্পষ্ট করা যাচ্ছে না। তাই এবারের সেকেন্ডারি প্রসঙ্গ হলো এ দুই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সংক্ষেপে একটা ধারণা দেয়া।
আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বাস্তবিক কার্যকারিতার দিক থেকে এর তাৎপর্য বলা হয়, এটা যেন আমেরিকা রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির বর্ধিত হাত ধরনের প্রতিষ্ঠান। কথাগুলো প্র্যাকটিক্যাল অর্থে বলা কথা, আইনি নয় বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যান্ডেট বা এর গঠনপ্রণালি ও কার্যপ্রণালির আর্টিকেলে সরাসরি এমন কথা লেখা নেই। কিন্তু আমরা সবাই জানি, টের পাই যে, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর যে কোনো সিদ্ধান্তের ওপর আমেরিকার প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রবল শুধু নয়, একচেটিয়া।
আইএমএফের বেলায়, এরকমটা সম্ভব করে তোলা হয়েছিল সদস্যপদ লাভের নিয়ম বা শর্ত যেভাবে আরোপ করা হয়েছে সেখান থেকে। প্রত্যেক রাষ্ট্রকে তার অর্থনীতির সাইজের অনুপাতে নির্ধারিত-ধার্য সদস্য চাঁদা দিয়ে তবেই সদস্যপদ পেতে হয়। যেহেতু এটি ঠিক ব্যাংক নয়, সদস্য রাষ্ট্রের ওপর ধার্য বিভিন্ন পরিমাণ চাঁদা একাট্টা করে তৈরি একটি ফান্ডমাত্র, ফলে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা শেয়ার যার বেশি পরিচালনা সিদ্ধান্তে তার বক্তব্যের মূল্য তত বেশি। এ কায়দায় আইএমএফের ওপর আমেরিকান প্রভাব বেশি নিঃসন্দেহে; কিন্তু সেটা কায়েম করা হয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি আমেরিকার, ফলে সদস্য পদে প্রবেশের চাঁদা তার সবচেয়ে বড়, এই কায়দা করে। তবে এভাবে সংগৃহীত আইএমএফের ফান্ড ঠিক বাণিজ্য বিনিয়োগের পুঁজি হিসেবে বা মুনাফা লাভের উদ্দেশে খাটানো হবে এমন ফান্ড নয়। এ ফান্ড ব্যবহার করা হয় শুধু কোনো সদস্য রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ব্যয়ে ঘাটতি থেকে গেলে। সেক্ষেত্রে ওই বাড়তি ব্যয় মেটানোর জন্য এ ফান্ড থেকে শর্তসাপেক্ষে তাকে ঋণ দেয়া হয়। তবে মাত্র ০.৭৫% সুদে, অর্থাৎ ওই ঋণ সুদে খাটানোর জন্য বা মুনাফা কামানোর জন্য নয় বরং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যয় তুলতে সার্ভিস চার্জ হিসেবে নেয়া হয়। তাই এত স্বল্প পরিমাণ। এটাই আমাদের মতো এলডিসি বা স্বল্পোন্নত (অর্থনীতির) দেশের বেলায় দেয়া কনসেশনাল আইএমএফ ঋণ সুবিধা। আর মধ্যম আয়ের দেশ হলে সার্ভিস চার্জের ওপর কিছু মুনাফাও ধার্য হবে। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই সাধারণভাবে ধার দেয়ার পূর্বশর্ত হলো, সদস্য দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে আইএমএফের ফর্দ অনুসারে সংস্কার আনতে হবে। এমন এক চুক্তিতে রাজি হতে হবে, আর তা মনিটরিং ও সঠিক পালন সাপেক্ষে কিস্তিতে ধাপে ধাপে ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে। এ হলো আইএমএফের একটি প্রধান দায়িত্ব- ম্যান্ডেট বা ঘোষিত উদ্দেশ্য। আইএমএফের দ্বিতীয় করণীয় বা ম্যান্ডেট হলো, প্রত্যেক রাষ্ট্রের মুদ্রার মান-হার অন্য মুদ্রার তুলনায় কত তা প্রতিদিন সকালে প্রকাশ করা। এখানে অন্য মুদ্রা মানে, সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক লেনদেন হয় এমন চারটি মুদ্রা- ডলার, ইউরো, পাউন্ড ও ইয়েন। এ চারের গড় করে প্রতিদিন তা ডলারে প্রকাশ করা হয়। আইএমএফের ভাষায় আর তার খাতাপত্রে প্রতিদিনের এ গড় মূল্যের নাম SDR, এমনকি প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের আইএমএফ অ্যাকাউন্টের অবস্থা কি, এর হিসাবকিতাব করা ও রাখা হয় SDR মূল্যে। এ অর্থে বলা হয়, আইএমএফের নিজস্ব মুদ্রার নাম SDR. আইএমএফের ওয়েবসাইটে প্রতিদিনের SDR-এর দাম লটকানো থাকে। যেমন ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ১ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে এক USD = 0.724763 SDR। আগেই বলেছি, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের দাতা বা খাতক সদস্য শুধু কোনো রাষ্ট্রই হতে পারে। কারণ এর লক্ষ্য রাষ্ট্র মানে রাষ্ট্রের মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এভাবেই আমেরিকার দুনিয়ার অর্থব্যবস্থার ওপর প্রভাব, কর্তৃত্ব আইএমএফের মাধ্যমে রাখার অবস্থা তৈরি হয়। তবে একটি সুবিধার দিকও আছে, কোনো রাষ্ট্র বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি বাধিয়ে না ফেললে আইএমএফের কাছে বন্ধক বা শর্তের বন্ধনে পড়ার দরকার হয় না।
এবার বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে আমেরিকার প্রভাব-প্রতিপত্তির আয়োজন প্রসঙ্গে। কোনো কোনো ব্যাংকের নামের মধ্যে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’, ‘ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘রিকনস্ট্রাকশন’ ইত্যাদি থাকতে দেখা যায়। নামের মধ্যে কামের অর্থাৎ ওই ব্যাংক কী ধরনের ব্যাংক, এর চিহ্ন ধারণ থাকে, ইতিহাসও লুকিয়ে থাকে। যেমন ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’, ‘আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’, ‘ইউরোপিয়ান ব্যাংক অব রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। আবার বিশ্বব্যাংকের পুরো নাম IBRD, ভেঙে বললে, ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক অব রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। আমাদের রাজনীতি ও সমাজে ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়ন শব্দটা আমাদের এদিকে সত্তর দশক থেকে আমদানি ঘটেছিল, পরিচিত হতে শুরু করেছিল। পশ্চিমা দেশেও এ শব্দটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পরিচিতি পেতে শুরু করে। যত জায়গাতেই ডেভেলপমেন্ট শব্দের ব্যবহার দেখা যাক না কেন ওই শব্দ আসলে অর্থ করে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট। অর্থাৎ ডেভেলপমেন্ট মানেই ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট বুঝলে তবে ডেভেলপমেন্ট শব্দের অর্থের তালাশ মিলবে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কথাটা সংক্ষিপ্তি পেয়েছে শুধু “ডেভেলপমেন্ট” বা ‘উন্নয়ন’ উচ্চারণ করে। কিন্তু ইনফ্রাস্ট্রাকচার মানে আবার কী? বাংলায় এর প্রতিশব্দ আমরা করে নিয়েছি ‘অবকাঠামো’। প্রতিশব্দ জানলেও তবু প্রশ্ন থেকে গেল, অবকাঠামো মানে আবার কী, কার অবকাঠামো, কী সূত্রে – এসব বুঝতে আমাদের যেতে হবে ক্যাপিটাল বা ‘পুঁজি’ ধারণায়। কারণ এসব শব্দ পুঁজি ধারণার চোখে দেখা এবং দেখে তৈরি হওয়া সংশ্লিষ্ট আরও ধারণা এবং ডেরিভেটিভ বা অনুসৃত শব্দ। অর্থাৎ পুঁজি এ ফেনোমেনার চোখ দিয়ে না দেখলে তা থেকে অনুসৃত শব্দগুলোর অর্থ খুলবে না। অবকাঠামো ঋণ বলতে ফিজিক্যাল (রাস্তাঘাট, ব্রিজ ইত্যাদি খাতে) ও হিউম্যান (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে) এ দুই ধরনের অবকাঠামো খাতেই ঋণ বুঝায়। অবকাঠামো বলার বা এ শব্দে চেনানোর কারণ এগুলো ঠিক বাণিজ্যিক তৎপরতা হিসেবে দেখে দেয়া ঋণ নয়। ঋণ ব্যবসার বাজারের তৎপরতায় টার্মোনোলজি হিসেবে যা বাণিজ্যিক ঋণ নয়, তা বোঝাতে অবকাঠামো ঋণ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। কোনো ঋণ বাণিজ্যিক কিনা, তা বোঝার মূল নির্ণায়ক সুদের হার। বিশ্বব্যাংকের অবকাঠামো ঋণের সুদ ০.৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ শতাংশের নিচে। এটা ঠিক ঋণের অর্থের ওপর সুদ নয় বরং ঋণ দিবার বিষয়টা পরিকল্পনা, প্রজেক্ট নেয়া, তা বাস্তবায়ন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অফিস পালতে হয় সেই অফিস পালা-পরিচালনার খরচ। ব্যাংকের ভাষায় এটাকে সুদ না বলে সার্ভিস চার্জ বলে। এতক্ষণ সব শুনে তো বিশ্বব্যাংকের সবই ভালো মনে হচ্ছে। তাহলে বিশ্বব্যাংক অবকাঠামো ঋণ দেয় কেন? কী ঠেকা তার? এককথায় বললে, গ্লোবাল পুঁজিবাজারে (আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট, সিঙ্গাপুর বা দুবাই থেকে মূলত পরিচালিত) আমরা যেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরও বড় বাণিজ্যিক বিনিয়োগের খাতক হই। যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতি যত বড় হবে, বৈদেশিক ঋণ চাহিদা যত বাড়বে, আমরা ততই গ্লোবাল পুঁজিবাজারের চোখে আকর্ষণীয় বাজার হয়ে ধরা দেব। অবকাঠামো খাতে ঋণ দিয়ে বিশ্বব্যাংক মূলত আমাদের অর্থনীতিতে গ্লোবাল পুঁজিবাজারের থেকে বাণিজ্যিক পুঁজি পাওয়ার চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। এটাই তার মূল কাজ, ম্যান্ডেট। কিন্তু অবকাঠামো খাতে ঋণ দেয় বলে সে ব্যাপারটিকে এদিক থেকে হাজির করে বলবে সে ‘দারিদ্র্যদূরীকরণ’ করছে। তবে কথা ঠিক বাণিজ্যিক বিনিয়োগের উপযুক্ত খাতক হয়ে যাওয়ার পড়ে পাওয়া (এটা টার্গেট নয় এই অর্থে) এবার পাওয়া বৈদেশিক ঋণের অবকাঠামোর খাতে ব্যয়, ফলে নতুন কাজ সৃষ্টির শর্ত তৈরি। এভাবে গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা এমনভাবে সাজানো এক সিস্টেম যার কারণে এর বিভিন্ন শর্তের ফেরে পড়ে আমাদের অর্থনীতি রাজনীতির ওপর পরাশক্তিগত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে এত দিন একচেটিয়া কর্তৃত্ব পেয়েছে আমেরিকা। এখন চীনের নেতৃত্বে AIIB বা গ্লোবাল অর্থ ব্যবস্থার পাল্টা প্রতিষ্ঠান হাজির হয়ে যাওয়া মানে আমেরিকার কর্তৃত্বের ভাগে টান পড়া। শুধু তাই নয়, ‘উন্নয়ন’ শব্দের অর্থ আমেরিকা যেভাবে নির্ধারণ করে রেখেছে তা বদল হওয়ার সম্ভাবনা। যেমন- উন্নয়ন লোনের পাবার সঙ্গে হিউম্যান রাইট পরিস্থিতি ভাল কি না তা শর্তযুক্ত করে হিউম্যান রাইট নাই এর উসিলায় হস্তক্ষেপ করার সুবিধা এখন আমেরিকার আছে। এখন লোন পাওয়ার বিকল্প উৎস চীন হাজির হয়ে গেলে সেখানে উন্নয়ন শব্দের অর্থ কী দাঁড়াবে? অন্ততপক্ষে চীনের নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে কান্নি মেরে উন্নয়ন শব্দের নতুন অর্থ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সে হিউম্যান রাইট বা পরিবেশকে কি ঋণ বিতরণের সাথে শর্তযুক্ত করবে অথবা করবে না? এটা কী হয়, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
[এখানে প্রকাশ করা লেখাটা এর আগে বাংলা দৈনিক “আলোকিত বাংলাদেশ” এর উপ-সম্পাদকীয় হিসাবে আমার নামেই ছাপা হয়েছিল। এখানে এক ও দুই পর্ব আকারে তেমন কোন নতুন এডিট না করেই এই ওয়েবে সংরক্ষণের জন্য সংকলিত করে প্রকাশ করা হল।]