লেখার ছোট লিঙ্কঃ http://wp.me/p1sCvy-a7
বাস্তবে যা পাওয়া যায় তাই বাস্তব, যা বাস্তব করা যায় না তাই আদর্শ
ভারতের এখন বিজেপির সরকার ক্ষমতাসীন আর এর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি। বাংলাদেশে মোদী সম্পর্কে পাবলিক পারসেপসন হল, “ও মোদী উনি তো বিজেপি, আর সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি সম্পর্কে কি আর নতুন বলব”। মোটা দাগে বললে এই বয়ান এটাও এক সত্য। এথেকে এই বয়ান কনষ্ট্রাকশনের পিছনের অনুমানগুলো কি তাও বুঝা যায়, আমরা কমবেশি জানি। তবে অবশ্যই এমন বয়ান যথেষ্ট নয়। আবার এই বয়ানের কারিগর এক সেকুলার মন, মানে “কমিউনিষ্ট”, “প্রগতিশীল”, লিবারেল উদারবাদী ইত্যাদির হলেও ইসলামী মনের দিক থেকে যারা দেখেন তারাও এই বয়ানের বিরুদ্ধে বিশেষ আপত্তি করবেন না। কারণ তাদের আপত্তি-জাত সিদ্ধান্তও কমবেশি একই। এজন্য এই বয়ান ডমিনেটিং বা প্রায় সব পক্ষের উপরে দাঁড়ানো ও ছেয়ে থাকা বয়ান। এখন একথা মেনে নিয়েও বিজেপির মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী মোদী হিসাবে একশনে ততপর – এই ডায়ানামিক পরিস্থিতির দিকে নজর ফেলতে এই লেখা। ডায়ানামিক কেন? বলা হয়, কোন রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল নিজেকে যাদের দল বলেই মনে করুক না কেন, দলের পতাকা বা সাইনবোর্ডে যে রংকেই প্রতীকী চিহ্নে হাজির করুক না কেন ঐ ব্যক্তি বা দল আসলে কেমন বৈশিষ্টের রাজনীতির – তা নির্ধারকভাবে বুঝার উপযুক্ত একমাত্র উপায় হল ওর ততপরতা, মানে ষ্টেপ বা পদক্ষেপগুলো কি, কেমন এর ভিতর দিয়ে তাকে বুঝতে চেষ্টা করা। কারণ শেষ বিচারে এসব পদক্ষেপগুলোই ঐ দল বা ব্যক্তির প্রকৃত রাজনৈতিক প্রতীকী রং-চিহ্ন আঁকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল বা কোন রাজনৈতিক ট্রেন্ডকে ওর ঘোষণাপত্র গঠনতন্ত্র এগুলো দিয়ে চিনা যায় না, চিনতে হয় ওর বাস্তব পদক্ষেপ, বাস্তব ঘটনায় ওর বাস্তব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রকা্শ, অবস্থান নেয়া, করণীয় মনে করে বাস্তবে যা করে ইত্যাদি এসব দিয়ে। সোজা কথায়, রাজনীতির ঘোষিত প্রতীকী রঙ কমিউনিষ্ট গাড় লাল বা ইসলামি গাড় সবুজ যাই দেয়া থাক না কেন ওর রাজনীতির আসল রঙ কতটা ফিকে বা ট্রু কালার কী তা বুঝতে হয় ওর পদক্ষেপ দেখে। কোন কমিউনিষ্ট পার্টির দলের রঙ আর পদক্ষেপে ফারাক – এঘটনাকে অনেকে ঘোষিত রংয়ের বিচ্যুতি বা “আদর্শ বিচ্যুতি” বলে চিনাতে পারে। কিন্তু এটা বিচ্যুতি কিনা সেই তর্কে আমাদের জড়ানোর চেয়ে বাস্তব প্রেক্ষিতে রংটা কি, ঐ রঙয়ের অর্থ কি সেটা বুঝার দিকে মনোযোগ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ “আদর্শ লইয়া আমরা কি করিব”। আদর্শ তো আদর্শই, তা কখনই বাস্তব নয়। আদর্শ সব সময়ই আগাপাশতলা অবাস্তব তবে, এক প্রাক-আইডিয়া মাত্র। যা হুবহু বাস্তবে হাজির করা যায় না, হয় না। অথবা বাস্তবে হাজির হতে গেলে তা আসলে কি হয়ে যায় সেটাই মুখ্য ফোকাস। বুঝার বিষয়। আদর্শ কি রূপ কল্পনায় এঁকে সে মাঠে নেমে ছিল তা শত মোহনীয় হলেই বা আমাদের কি লাভ, কি যায় আসে তাতে। বাস্তব মানে চলমান ডায়ানামিক পরিস্থিতিতে যা আকার নেয়। ফলে এখানে একজামিনের বিষয় বাস্তব মোদী। এই অর্থে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বাস্তব পদক্ষেপ সমূহ। সেই ট্রু কালারের খোঁজে এই রচনা।
গত বছর ২০১৪ সালের ২৬ মে নরেন্দ্র দামোদর মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তার রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি, এই দলের পরিচয়েই তিনি প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতো তিনিও একজন গুজরাটি হলেও গান্ধীর সাথে তুলনায় অন্য অনেক কিছুর চেয়ে তার সবচেয়ে বড় ফারাক হলো প্রজন্মে। ১৯৪৭ সালের পর ভারতে যাদের জন্ম এমন প্রজন্মের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় শিখরে। গুজরাট রাজ্যের পরপর তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সেই সাথে প্রথমবারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ের গুজরাটের দাঙ্গা, মুসলমান হত্যার দাগ ও এর দায়দায়িত্বের মূল অংশীদার তিনি। এতে মামলা বা আইনি দিক থেকে রেহাই পেয়ে গেলেও এর রাজনৈতিক দায়দায়িত্বের দিক থেকে তিনি কখনই মুক্ত হবেন না। তার দল সম্পর্কে আপামর সাধারণ ধারণা হলো, আমাদের দেশের ও ভারতের সেকুলারদের ভাষায় বলা হয় এটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল।
যদিও বিজেপি সম্পর্কে মূল্যায়নের মূল দিকটা হলো জন্ম থেকেই বিজেপি ইসলামফোবিক দল, মুসলমানবিদ্বেষী দল। আরো পরিষ্কার করে বললে, বিজেপির বয়ানের সারকথা হলো ভারতে ধর্ম ও সংস্কৃতিতে হিন্দুত্ব বলে একটা কিছু আছে। বিশেষ সেই হিন্দুত্ব ধারণাজাত ও একে ভিত্তি মেনে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দল বিজেপি; এই হিন্দুত্ব ধারণা শ্রেষ্ঠ, এমন বয়ানের ওপর দাঁড়ানো সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা আধিপত্যের স্বপ্ন ও অনুমান এ দলের আছে।
কথা আরও আছে, কথিত হিন্দুত্বের এই সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা আধিপত্যের প্রাবল্য মেনেই ভারতে অন্য যেকোনো ধর্ম, রাজনৈতিক শক্তি বা বয়ান হাজির থাকতে পারবে। এই হলো বিজেপির আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন বা ভিশনে দেখা কাঙ্খিত ভারত। যেমন, ভারতের প্রাচীন সামাজিক ও ক্ষমতা কাঠামোয় হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রমের বিষয়টি আমরা কমবেশি বুঝি। মানে এক কালে সমাজে কার কী পেশা হবে, সামাজিক মর্যাদা কী হবে এসবের ভাগ-বণ্টন ও বিভক্তির ভেতর দিয়ে শাসক ব্রাহ্মণদের সামাজিক ক্ষমতা চর্চা হত। এই অর্থে এটা ভারতের সামাজিক শ্রমের এক বর্ণ বিভাজন। একালে ক্যাপিটালিজমের পাল্লায় পড়ে এবং ক্রমশ বিস্তারে সে কাঠামো কেবল ভাঙছে আর ভাঙছে, দুর্বল হচ্ছে। তবুও ঐ মৌল কাঠামোটা সমাজে এখনো নির্ধারক ভূমিকা রেখে চলে, টিকে আছে। আমাদের চলতি ভাষায়, এটা এক জাতপাত ব্যবস্থা। বিজেপির ইমাজিনেশন বা কল্পচিত্রটা হলো তাদের হিন্দুত্ব ধারণার বাইরে আর কোনো ধর্ম, বা মতাদর্শ যা আছে সেগুলোকে বড়জোর তারা পুরনো বর্ণাশ্রমের ধারণার ভেতরেই যেনবা আর একটা জাত-বর্ণ কেবল এতটুকু মর্যাদা তারা সব ‘অপর’দের দিতে পারে, চায়। অর্থাৎ নানান জাত-বর্ণের মতোই নিজ হিন্দুত্বের অধীনস্থ যেন আর এক জাত হয়ে কেউ চাইলে থাকতে পারে। এতটুকু ‘অপর’ সে সহ্য করতে রাজি আছে। যেখানে বিজেপির হিন্দুত্ব ধারণাজাত সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধীনস্থ থাকবে সব জাত, ধর্ম, বয়ান সবকিছুই।
বিজেপি কংগ্রেসের সেকুলার ধারণা গ্রহণ করে না। তবে পপুলার পারসেপশন হলো, কংগ্রেস অন্তত মুখে বলা বা আড়াল হিসেবে নিজেকে সেকুলার বলে দাবি জানায়, তাই সে বিজেপির চেয়ে একটু বেশি ভালো। বিজেপি এই ভান করা ঠিক মনে করে না। তবে আমরা সেকুলার ধারণার প্রতি আগাম বিশেষ পক্ষপাতিত্বের ঝোঁক থেকে না দেখলে সম্ভবত এর সঠিক ব্যাখ্যা হবে বিজেপি ও কংগ্রেস দুটোই মূলত ‘হিন্দুত্ব’ ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী দল। অর্থাৎ ঐতিহ্য কথার আড়ালে ‘হিন্দুত্ব’ বয়ানে গঠিত এক সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের ভারত হতেই হবে। উভয় দল এই চিন্তায় অভিন্ন এবং তাদের মৌলিক চাওয়া। কিন্তু নিজেকে বাইরে উপস্থাপনের প্রশ্নে কংগ্রেস সেকুলার জামা পরে নেয়া ঠিক মনে করে, আর বিজেপি এর বালাই রাখতে রাজি নয়। মানে দাঁড়াল, এ বিষয়ে এই দু’টি দলই ‘হিন্দুত্ব’ ধারণার হিন্দু ছাড়া ভিন্ন কোনো ধর্ম বা বয়ানের কাউকে একই সাম্য-মর্যাদা দেওয়া বা কোনো সামঞ্জস্য বিধান দূরে থাক, কোনো আংশিক শেয়ার দিতেও রাজি নয়। আবার এভাবে উদ্ভূত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ছাড়া অন্য কোনো ভিত্তিতে পুনর্গঠন করে নিতে পারে, আগামিতে হতে পারে এমন সম্ভাবনা এই দুই দলই মনে করে না। এ বিষয়ে ভাবতে পারে না বা চায় না। এমন না চাওয়ার পেছনে বড় এক অনুমান আছে যেটা আবার দুটো দলেরই চিন্তার মৌলিক ভিত্তি। এটাই আবার কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুই দলের মধ্যে বিরাট এক মিলের দিক। সেটা হলো, দুই দলের প্রধান ধারণা হিন্দুত্ব, তবে দুইভাবে ইমাজিন বা কল্পচিত্রে এঁকে নেয়া, পরিগঠিত এক হিন্দুত্ব। দুই দলেরই দৃঢ়বিশ্বাস হলো, এই ‘হিন্দুত্ব’ ধারণাটা হলো নানা জাতপাতের ভারত, নানা প্রদেশের ভারত, সমতলী-পাহাড়ি ভারত ইত্যাদি নানা স্বার্থ বিরোধের ভারতকে এক রাখার চাবিকাঠি। এক ভুতুড়ে হিন্দুত্ব পরিচয় (দুইভাবে তৈরি) এটাই ভারতকে এক রাষ্ট্রে ধরে রাখার ভিত্তি। এমন ভাবনার পেছনের অনুমান হলো, এই হিন্দুত্ব ধারণার ভেতর গোঁজামিল, অসামঞ্জস্যতা যাই থাক হিন্দুত্ব ধারণা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ না করলে গতি নেই। ভারতে কোন ‘রাজনৈতিকতা’, রাজনৈতিক ভিত্তি আরম্ভ করা সম্ভব নয়।
এমন ভাবনা কেন?
ক্ষমতা, আইন, জাতিগঠন, রাষ্ট্র, জাতি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে মৌলিক ধারণাগুলো গত অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের হাত ধরে দুনিয়ায় হাজির হয়েছে। তবু এভাবে উদ্ভবের ভিতরে এর অস্পষ্টতা অস্বচ্ছতাও কম নয় বরং সময়ে মারাত্মক। উপরে অনেকগুলো শব্দ উল্লেখ করে মৌলিক বিষয় ও ধারণাগুলোকে চিনিয়েছি। তবে গুরুত্বের কমবেশির দিক এসব শব্দ বা ধারণার মধ্যে মূলত ‘পলিটিকস’, ‘পলিটিক্যাল কমিউনিটি’ ধারণা দুটো প্রধান। বাকি ধারণাগুলো এই দুই ধারণা সাপেক্ষে নির্মিত ও অর্থপুর্ণ হতে পারে, নইলে নয়। চিন্তার দিক থেকে মূলত ‘পলিটিকস’, ‘পলিটিক্যাল কমিউনিটি’ ধারণাদুটোর অর্থ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে চলতি শতকে এসে একাডেমিক ও বাস্তব মাঠের চর্চা এবং উদাহরণ অভিজ্ঞতায়ও এখন তা অনেক স্বচ্ছ হয়েছে। কিন্তু তবু তা ডোমিনেটিং হয়েছে একথা বলা যায় না। এগুলো চিন্তার দিক থেকে মূলত ‘পলিটিকস’, ‘পলিটিক্যাল কমিউনিটি’ ইত্যাদি ধারণাগুলোর অর্থ তাৎপর্য কী তা বোঝা অনুসন্ধানের পথে না চেয়ে বরং ইউরোপ বা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের নকল করতে গিয়ে সেসব অস্বচ্ছতার আবর্জনা তৈরি হয়েছে তা থেকে জাত সমস্যা। তবে সবকিছুই আবার চিন্তার সীমাবদ্ধতার সমস্যা নয়। বৈষয়িক স্বার্থও সমস্যার উৎস হয়। আর একটু স্পষ্ট করে বললে এগুলো পশ্চিমের এনলাইটমেন্ট ধারণায় রামমোহন বা বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তা, তাদের চিন্তার আমলের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা।
ওদিকে ভুতুড়ে এক ‘হিন্দুত্ব’ ধারণার ভিত্তিতে ভারতকে এক রাখার সমস্যাগুলো ভারতের সব রাজনৈতিক, ইনটেলেকচুয়াল সদস্য সবার জানা। কিন্তু নতুন করে নতুন চিন্তায়, নতুন ভারত পুনর্গঠনের কাজটা এতই পর্বত প্রমাণ ও ঝুঁকিপূর্ণ যে এই ভারত নিজ গুণে ভেঙে পড়ে অচল না হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউই এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা না তুলে বরং ‘হিন্দুত্বের’ ভেতরেই মাথা গুঁজে যত দিন টিকে থাকা যায়, সমস্যা নেই মনে করা যায় সেটাকেই শ্রেয় মনে করে।
গান্ধীর সাথে মোদির কথা তুলেছিলাম মূলত প্রজন্মের দিকটা ভেবে। অর্থাৎ মোদি কি সেই প্রজন্ম হতে পেরেছেন যিনি অন্তত গান্ধী-নেহরুর জমানার বাইরে নতুন চিন্তা করার মতো চিন্তার মুরোদ-সামর্থ্য ও সাহস রাখেন? এই প্রশ্নটার জবাব খোঁজার বা পাঠককে সাথে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করব।
ওপরে চিন্তার ভিত্তি প্রসঙ্গে স্বল্প কিছু যে পরিচিতি বিজেপির দিয়েছি সে দিক থেকে মোদিকে বিজেপি থেকে আলাদা করা যায় না। অর্থাৎ চিন্তার ভিত্তির দিক থেকে মোদি বিজেপি থেকে কিছুই আলাদা নন অবশ্যই। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় প্রধানমন্ত্রী মোদির স্বপ্ন চিত্রকল্পের আগামী ভারতের ছবির মধ্যে এমন কিছু আছে যা তাকে আলাদা করে আগামীতে তিনি আলাদা হয়ে উঠতেও পারেন। তবে অবশ্যই এটা সম্ভাবনা, এটা হতে যাচ্ছে বা হবেই এমন দাবি করছি না। কি সেটা? প্রধানমন্ত্রী মোদি আর বিজেপির মোদি এই দুইয়ের মধ্যে একটা ফারাক আছে। এভাবে এই বাক্য লিখে তার প্রাথমিক ধারণা হাজির করা যায়।
প্রথমত, মোদি হিন্দুত্বের ভিত্তিতে যে ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি বদলানো ও পুনর্গঠন কাজ করতে চান তা মনে করে তিনি হাঁটছেন না। কিন্তু তিনি যে ‘বিকাশের স্বপ্ন’ দিকে তাকিয়ে একাগ্র হয়ে হাঁটছেন তাতে ভারত রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি বদল ও পুনর্গঠনের দিকে রওনা হয়ে যেতে পারে।
অন্য যেকোনো হিন্দুত্বভিত্তিক আর পাঁচটা নেতার মতোই হলেও অন্যদের চেয়ে মোদির ফারাক এখানেই, তিনি নতুন মাত্রার এক ‘বিকশিত’ ভারত কল্পনা করেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখ্য স্লোগান ‘সবকা বিকাশ সবকা সাথ’। হিন্দিতে বিকাশ শব্দের অর্থ আমাদের কাছে প্রচলিত ‘উন্নয়ন’ বা ‘ডেভেলপমেন্ট’ ধারণাটাই। কিন্তু বিকাশ, ‘উন্নয়ন’ বা ডেভেলপমেন্ট শব্দগুলোর আসল অর্থ তাৎপর্য কী? এককথায় বললে নানা বাধা পেয়ে বামন হয়ে থাকা ক্যাপিটালিজমের বাধাগুলো দূর করে ভালো ধরনের বিকাশ। অর্থাৎ কার বিকাশ, উন্নয়ন বা ডেভেলপমেন্ট এই প্রশ্ন করলে জবাব আসবে, ক্যাপিটালিজমের বিকাশ। ক্যাপিটালিজমের বিকাশ সম্ভব এই অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার মজা মোদি হাতে-কলমে পেয়েছেন গুজরাটের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে। এটাই হিন্দুত্বের বিজেপির মোদির কাছেই নতুন বিস্ময়। নতুন আলো। মোদির নতুন প্রেম তাই ‘বিকাশ’-এর সাথে, তার চিন্তার মৌলিক পরিচয় ভিত্তি বিজেপিরই হওয়া সত্ত্বেও।
এর কারণ কী বা এটাকে অনেক রকম সমাজতাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন অনেকে। যেমন অনেকে বলতে পারেন মোদি রেল স্টেশনে চা বিক্রি করে পেট চালানো মা-বাবার সন্তান। আবার তিনি ছোট থেকেই আরএসএস ও বিজেপির সাথে যুক্ত। ফলে জীবনের স্পিরিচুয়াল দিকটা মানসিক ভিত্তি হিসেবে তিনি হয়তো তাদের কাছ থেকে পেয়েছেন। কিন্তু বৈষয়িকভাবে জীবন নির্বাহ, বাঁচিয়ে রাখার কষ্ট এই বাস্তব অভিজ্ঞতার দিকটা তিনি কখনই উপেক্ষা করেননি। ভুলে যাননি, বাদ দেননি। গত ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রচার চলার সময়ই অবলীলায় তিনি সেসব দিনের কাহিনী অকপটে পাবলিক মিডিয়ায় বলেছেন। তার মায়ের প্রতি সবিশেষ অনুরাগ তিনি এখনো লুকাননি। কারণ মা তাকে খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে বড় করেছেন। একমাত্র বসবাসের ঘরে একই সাথে শুকনা গোবরের জ্বালানি রাখতে হতো বলে এর গন্ধে তিনি কেমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সেই খুঁটিনাটি বর্ণনাও তিনি বাদ দেননি। আবার মানুষের জীবনে কাজের সংস্থান না থাকা, শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার অর্থ কী তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানেন।
সম্ভবত সে জন্যই তিনি নিজের ‘বিকাশ’ স্লোগানের অর্থ করছেন নিজে এভাবে ‘সবার টেবিলে খাবার, সব বাচ্চা স্কুলে, সকলের জন্য কাজের সংস্থান, পায়খানাসহ একটা বাসস্থান, প্রত্যেক পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ’ ইত্যাদি। এগুলো সাধারণ মানুষের ভাষায় বলা। যেটা মোদির সরকারের দিক থেকে ‘বিকাশ’ এই অর্থনীতিক নীতি পলিসি। বিজেপির মোদি ছাপিয়ে রক্ত-মাংসের মানুষের জীবন ব্যবহারিক দিক থেকে দেখা অভিজ্ঞতায় এসব মিলিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদি।
আর এক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ বা রাজ্যের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম বা অন্য সবার আগে নিজ ভাষাভাষীর পরিচিত এলাকা ছেড়ে বাইরে বের হয়েছেন কাজের অনুসন্ধানে বা বেটার লাইফের জন্য তারা হলো গুজরাটের বাসিন্দা বা গুজরাটি। তারাই জমিজিরাতি ছেড়ে ভিন্ন পেশার সন্ধানে অভিযাত্রী। ক্রমে তারাই ট্রেডার। বাণিজ্যিক বেণে বা ব্যবসায়ী। ফলে ব্রিটিশ আমলেই তারা ব্রিটিশের হাত ধরে সাউথ আফ্রিকাসহ সারা আফ্রিকাতেই প্রবেশ করেছিল এবং এখনো ছড়িয়ে আছে। ব্যবসায়ী কথার আর এক ইতিবাচক অর্থ উদ্যোক্তা। নতুন কর্মের সংস্থান, নতুন আইডিয়ায় নতুন উৎপাদনের সংগঠন হাজির করতে লেগে থাকার নিরন্তর প্রয়াস। এটাও হয়তো মোদির রাজনৈতিকভাবে ‘বিকাশ’ ধারণা ও মনে এক স্বপ্ন পুশে একটা ভিশনে পৌঁছানোর পেছনের কথা। হয়তো মোদির বেলায় তা ভালোরকম এক অবসেশনও মাখা। প্রতিদ্বন্দ্বীরা গুজরাটিদের নেতিবাচকভাবে দেখাতে, নিজের অক্ষমতা ঢাকতে গুজরাটিদের ‘গুজ্জু’ বলে থাকে।
যাক সেসব কথা। মূলকথা প্রধানমন্ত্রী মোদি নামটা নতুন মাত্রায় হাজির হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। সমাজে ও রাজনীতিতে যেভাবে তিনি ক্ষমতা তৈরি করেছেন ধাপে ধাপে মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ততই তার ‘বিকাশের’ স্বপ্ন প্রধান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পর তিনি সব কিছুর আগে ‘বিকাশের’ স্বপ্নধারণকারী মোদি এরপর অধস্তন তিনি বিজেপির মোদি এমন হয়ে উঠছেন। এটা লুকিয়ে বা অজান্তে বেখেয়ালে করে ফেলা কাজ না। তিনি সরব। বলছেন, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকতে চান না। নিজ দল আর সরকারের মধ্যে তিনি এক পরিষ্কার ভাগ বজায় রাখতে চান। এটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলে কেউ যেন তাকে কেবল গুজরাটের লোক না ভাবেন তা নিয়ে তিনি আগেই সজাগ। তাকে অনেক দূর যেতে হবে, অনেককে নিয়ে পথ চলতে হবে, তাই তিনি আগেভাগেই সতর্ক। আবার এই অবস্থানটাই কেবল তার ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ স্লোগানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারো রাজা নয়, এম্পায়ার বা এক সাম্রাজ্যের শাসক হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হলো তাকে সঙ্কীর্ণ কোনো স্বার্থ নয় বরং সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থের দিকে নজর করে সমন্বয়ে এক কমন স্বার্থ হাজির করে, বাদ বাকিগুলো সামলিয়ে চলতে পারার সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। বড় পরিকল্পনা সফল হওয়ার পূর্বশর্তও এটাই। এটা ঠিক কারো শৌখিনতা বা উদারতার ব্যাপার নয়।
এবার বিপরীত দিকটি আমরা দেখি। এভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদি যতই তার ‘বিকাশের’ স্বপ্নকে সবার ওপরে রেখে চলতে শুরু করবেন, বা বলা যায় বিজেপিকে সেকেন্ডারি করে রাখবেন ততই আস্তে আস্তে একসময় তিনি বিজেপির মোদির বদলে প্রধানমন্ত্রী মোদি হয়ে উঠবেন। এটা কোনো সন্দেহ না রেখে বলা যায়। ব্যাপারটাকে বোঝানোর জন্য নিচে একটা উদাহরণ এনেছি। মোদির এক লিখিত ভাষণ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছি নিজ দায়িত্বে।
সে প্রসঙ্গে প্রবেশের আগে এর পটভূমি প্রেক্ষিত জানিয়ে রাখা দরকার যাতে পাঠকের পড়ে বুঝতে সুবিধা হয়।
১. বিজেপি দলের কাঠামো মোটা দাগে বললে এককেন্দ্রিক নয়, যে অর্থে আমাদের হাসিনা, খালেদা বা ভারতের সোনিয়া। এক ‘নীতিনির্ধারণী কেন্দ্র’ এমন একটা জায়গা বিজেপি তার চর্চায় জারি ও চালু রাখতে সক্ষম হয়েছে। দলের মূল নীতি বা কাজের কৌশল সেখানে ঠিক করার পর তা বাস্তবায়নের প্রধান হবেন খোদ দলের সভাপতি। এই অর্থে বিজেপির সভাপতি কংগ্রেসের সভাপতির সোনিয়ার মতো নন। সোনিয়া একাধারে নীতিনির্ধারক শেষ কথা বলার অধিকারী। তিনি দলের সভাপতি ঠিকই তবে বিজেপির মতো আবার ওই গৃহীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ক প্রধান হিসেবে সভাপতি তিনি নন।
ওদিকে বিজেপির নীতিনির্ধারণী কেন্দ্র আর সভাপতি দুটোই আলাদা। বরং নীতিনির্ধারণী কেন্দ্রের অধীনস্থ হলেন সভাপতি। কিন্তু এর মানে এমন নয় যে, বিজেপির অভ্যন্তরীণ লড়াই নেই। মোদি ২০১৪ নির্বাচনের মাস আটেক আগে যেদিন নিজেকে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে দল থেকে সিদ্ধান্ত পাস করিয়ে আনলেন সেদিন থেকে দলের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে বয়স্ক নেতাদের (আদভানি বা যোশী) পরাস্ত করেই অর্থাৎ নিজে জিতেই নিজেকে হাজির করেছিলেন। সেই থেকে তিনি নিজেকে কেন্দ্রে রেখেই বর্তমান দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা সাজানো হয়ে যায়। কিন্তু তিনি আবার নিজেকে দলের সভাপতিও করেননি। এ ছাড়া ওদিকে আরএসএসের সাথে সমন্বয় এবং বৃদ্ধ পুরনো প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ সমন্বয়ও ঠিকমতো রাখেন। অনুমান করা যায় নিজের ‘বিকাশের’ স্বপ্নকে শেয়ার করেন। তিনি নিজের কাজ সফলতা যোগ্যতা দেখিয়ে সম্মতি আদায় করে নেন।
২. মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিজেপির দলীয় কর্মসূচি আগের নীতিতেই চলছে বরং আরো ব্যাপক এবং সরব হয়েছে। যেমন সবচেয়ে সরব কর্মসূচি ‘ঘর ওয়াপসি’। বাংলায় বললে যেসব হিন্দু চার্চের তৎপরতায় খ্রিশ্চান হয়ে যাচ্ছেন, অথবা কথিত ‘লাভ জিহাদে’ গল্পে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে, মুসলমানের সাথে প্রেম বা বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এমন ক্ষেত্রে তাদের প্রতি সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে আবার হিন্দুতে ফিরিয়ে আনা। তাদের ‘ঘরে ফেরানো’ বা এন্টি কনভারশন কর্মসূচি। সোজা কথায় হিন্দুত্বের উন্মাদনা সৃষ্টি করা, আর বিজেপির ভাষায় এগুলো তাদের সামাজিক কর্মসূচি। এবারের কর্মসূচির বিশেষ দিকটা হলো, এবারের আক্রমণের ঘটনা চার্চ, বা খ্রিশ্চান স্কুলের ওপর বেশি। চার্চে হামলার ঘটনা সামাজিক বা মিডিয়ায় হইচই ফেলেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি এই কর্মসূচির ব্যাপারে শুরু থেকেই নির্বাক। তার ইনার মেসেজটা এমন যে এটা দলীয় কর্মসূচি, দলীয় ব্যাপার। এটা তো তার সরকারের কর্মসূচি নয়। আর তিনি তো দেশের সবার প্রধানমন্ত্রী তাই প্রতিক্রিয়াবিহীন।
এভাবেই এই পরিস্থিতি পাঁচ মাস ধরে চলছিল, গত জানুয়ারিতে ওবামার সফরের আগ পর্যন্ত। ওবামা বিদায় নেয়ার দিন ২৭ জানুয়ারি মিডিয়ায় ওবামা এক সাক্ষাৎকারে মোদি সরকারের প্রতি এক হেদায়েত বাণী রেখে যান। যার সারকথা হলো, মোদির ‘রিলিজিয়াস টলারেন্সের’ (ভিন্ন ধর্মকেও সহাবস্থান করতে দেয়া) ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া উচিত। নইলে এগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। (‘splintered along the lines of religious faith’) । এ ঘটনার পরের দিন এর প্রতিবাদ করে কিন্তু বিজেপি থেকে এক বিবৃতি দেয়া হয়। মোদি তবু নিশ্চুপ। আর প্রায় সব প্রধান মিডিয়ার মূল সুর আগে থেকেই ছিল বিজেপির তৎপরতার বিরুদ্ধে, তখনো তেমনই থাকল। তবে টিভির টক শোগুলোতে মোদি সরকারকে অভিযুক্ত করা শুরু হলো। পরের মাস ফেব্রুয়ারি ১৭ তারিখে মোদি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কেরালাভিত্তিক এক চার্চের বার্ষিক ওরস ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি হন। এখানেই তিনি এ বিষয়ে প্রথম মুখ খোলেন। নিজ সরকারের নীতিগত এক বিস্তারিত লিখিত অবস্থান তুলে ধরেন। যদিও এর আগে সিরিজ ঘটনায় ঘর ওয়াপসি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানী দিল্লির বুকে চার্চ ও খ্রিশ্চান স্কুলে একের পর এক হামলা-ভাঙচুরের পরিপ্রেক্ষিতে খ্রিশ্চান ধর্মীয় নেতাদের একটা দল মোদীর সাথে দেখা করে অভিযোগ জানিয়েছিল। কিন্তু তারপরও মোদি ১৭ ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত একেবারে নিশ্চুপ ছিলেন।
৩. হায়দ্রাবাদের নিজাম অর্থাৎ এখনকার অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী, এই অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের পর আরো নিচে বা দক্ষিণ থেকে ভারতের একেবারে শেষ দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত যেসব রাজ্য আছে এককথায় এই অঞ্চলকে দক্ষিণার্ত বলা হয়। বলা হয় উত্তরের আর্য প্রভাব, দখল শাসন যে অঞ্চলের আগেই আটকে গিয়েছিল, প্রবেশ করতে পারেনি এটা সেই অঞ্চল। এটা দ্রাবিড়ীয় অঞ্চল বলেও ইতিহাসে কথিত আছে। কিন্তু ব্রিটিশ-ভারত আমলে সবচেয়ে বেশি খ্রিশ্চান মিশন ও কনভারসন তৎপরতা ওই অঞ্চলেই ঘটেছে। এখন এ অঞ্চলের কোনো কোনো জনবসতিতে খ্রিশ্চান জনসংখ্যা ওই শহরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের মতো। এর মধ্যে আবার সর্বদক্ষিণের কেরালা রাজ্য অর্থডক্স খ্রিশ্চান বা পর্তুগীজ চার্চসহ সবধরণের ফ্যাকড়ার খ্রীশ্চান চার্চ অধ্যুষিত। সেকালে দুর্গম যোগাযোগের এই রাজ্যে পড়াশোনার বিস্তার খ্রিশ্চান স্কুল মিশনারির মাধ্যমেই ঘটেছিল। কেরালা-ভিত্তিক দিল্লীর ঐ চার্চের ওরস ধরণের অনুষ্ঠানের উপলক্ষ ছিল, সে আমলের দুই বিখ্যাত পাদ্রির মোদির ইংরেজি ভাষ্যে এটা elevation to sainthood বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যার বাংলা করা হয়েছে ‘সাধুসন্তে উত্তরণ’ হওয়ার দিন উদযাপন। অর্থাৎ পাদ্রির অবদান মূল্যায়ন করে চার্চের দেয়া তিনি কত বড় কামেল পীরের ভূমিকা রেখেছেন তার স্বীকৃতি দেয়ার দিন। এরই বার্ষিকী স্মরণ উৎসবের অনুষ্ঠান ছিল সেটা।
৪. কী করে এটা পাঠক পড়বে এর একটা পরামর্শ রাখতে চাই। সেটা হলো, মোদি ‘ধর্মীয় সহনশীলতা’ বিষয়ে তার সরকারের নতুন নীতি ব্যাখ্যা করছেন কিভাবে সেদিকটা বুঝতে মনোযোগী হওয়াটাই সঠিক কাজ হবে। কারণ এখানে কোন মোদিকে বুঝতে হবে? যে মোদির দল বিজেপি জন্ম থেকেই বিশেষত বিগত পাঁচ মাস ‘ঘর ওয়াপসি’ (ঘরে ফেরা) কর্মসূচি চালিয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদি হিসেবে তিনি উল্টো অবস্থান নিচ্ছেন। অনুমান হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মোদি সরকারের এই নীতিমালা বা এর দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে মোদি নির্ধারকভাবে বিজেপির ঘোষিত ও চর্চাকৃত দলের নীতির পুরোপুরি উল্টো দিকে অবস্থান নিলেন। অর্থাৎ সরকারের নীতি আর বিজেপি দলের নীতি পরস্পরের উল্টো অবস্থানে।
ব্যবহারিক দিক থেকে বললে সরকারের এমন মৌলনীতির অধীনতা মেনেই একমাত্র কোনো রাজনৈতিক দল তৎপর থাকতে পারে। মৌলনীতি বলছি কারণ এর সাথে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ও কনস্টিটিউশন যুক্ত হয়ে গেছে, এটা সাদামাটা মোদি সরকারের কোনো নীতি পলিসির ঘোষণা ধরনের নয়। যেমন মোদি আসলে ধর্মীয় সহাবস্থানের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন। বলছেন, ধর্মীয় কারণে (কনভারসনসহ) কেউ কারো ওপর বলপ্রয়োগ করলে মোদি সেটা গ্রহণ করবেন না, ব্যবস্থা নেবেন। বলছেন, ‘আমার সরকার এমন কাজের বিরুদ্ধে শক্তভাবে তৎপর হবে’। অর্থাৎ তার সরকার এমন কৃতকাজের বিরুদ্ধে দমনমূলক অবস্থান নেবেন, আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেয়ার পথে যাবেন।
ওদিকে মোদির এই ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মোদি ইস্যুটাকে সেকুলারিজম বলে কোনো ধারণার দিক থেকে বা সাহায্যে বা কোনো সেকুলার অবস্থান নিয়ে এর ওপর দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করেননি। বরং বলছেন যে, যেটা খুশি ধর্ম পছন্দ করতে পারবেন এবং স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারবেন এর সপক্ষে মোদির সরকার ওই নাগরিককে সুরক্ষা দেয়ার নীতির কথা বলছেন।
[নীচে মোদীর বক্তৃতার পুর্ণ টেক্সট বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।]
আমি কেরালা দুই সাধু সেন্ট কুরুয়াকোস ওরফে চাভারা এবং সেন্ট ইউফ্রাসিয়া তাদের সাধুসন্তে উত্তীর্ণের দিন উদযাপনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে উচ্ছ্বসিত বোধ করছি। তাদের এই স্বীকৃতিতে দেশবাসী গর্বিত। তাদের উত্তরণ কেরালারই আর এক সাধু সেন্ট আলফানসো শুরু করে গিয়েছিলেন। সেন্ট চাভারা এবং সেন্ট ইউফ্রেসিয়া তাদের জীবন ও কর্ম শুধু খ্রিশ্চান কমিউনিটির জন্যই অনুপ্রাণিত হওয়ার উৎসস্থল নয় বরং সামগ্রিক মানবজগতের জন্যও বটে।
সেন্ট চাভারা মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র এবং তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও। সে যুগে যখন শিক্ষাদীক্ষার জগতে প্রবেশ খুবই সীমিত ছিল তখন তিনি সব চার্চেরই একটা করে স্কুল থাকার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এভাবে তিনি সমাজের সব অংশের জন্য শিক্ষার দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন।
কেরালার বাইরে খুব কম লোকই জানে যে, তিনি একটা সংস্কৃত স্কুলও খুলেছিলেন এবং একটা ছাপাখানা প্রেস। নারীর ক্ষমতাপ্রণর পক্ষে তার অবদানও উল্লেখযোগ্য।
সেন্ট ইউফ্রাসিয়া ছিলেন একজন ইন্দ্রীয়-অতীত মিষ্টিক, তার সারা জীবন তিনি অর্চনা ও গডের আনুগত্যে উৎসর্গ করেছিলেন।
অনুসারী সাথীদের খেদমত করে এই উভয় সাধু গডের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। প্রাচীন ভারতীয় প্রবাদ নিজেদের জীবন ব্যাখ্যা করেছে এভাবে : ‘আত্মানো মোক্ষর্থম জগত হিতাযাচা’ মোক্ষ (মুক্তি) লাভের পথ হলো দুনিয়ার কল্যাণের জন্য কাজ করা।
বন্ধুরা,
ভারতের ঐতিহ্যের শেকড় হলো স্পিরিচুয়ালিজম। হাজার হাজার বছর আগে, ভারতের সাধুরা এবং গ্রিক জ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে চিন্তা ও স্পিরিচুয়াল বিনিময় করে গেছেন। নতুন আইডিয়ার প্রতি দরজা খুলে রাখার কথা ঋকবেদে হাজির আছে : ‘আনো ভদ্রা: কৃতও যন্তু বিখত’ নোবেল চিন্তা সব দিক থেকে আমাদের কাছে আসতে দাও। বিস্মরণের কাল থেকে এই দর্শন আমাদের চিন্তা-বুদ্ধির চর্চাকে গাইড করে গেছে। ভারতমাতা এই ভূমিতে অনেক ধর্মীয় ও স্পিরিচুয়াল স্রোতধারার জন্ম দিয়েছে। এগুলোর কিছু আবার এমনকি ভারতের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়েছে।
সব ধর্মবিশ্বাসকে স্বাগত জানানো, সম্মান জানানো এবং শ্রদ্ধা করা ভারতেরই সমবয়সী পুরনো ঐতিহ্য। স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বলেছেন : ‘আমরা সার্বজনীনতাকেই শুধু জায়গা ছেড়ে দেই না, আমরা সব ধর্মকেই সত্য বলে গ্রহণ করি’। শতবর্ষ আগে বিবেকানন্দ সৎ ও শুভইচ্ছা আঁকড়ে ধরেছিলেন চিরদিনের জন্য কেবল আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য নয় বরং আমাদের সরকার এবং এই অর্থে ভারতের যেকোনো রাজনৈতিক দলের সরকারের জন্য। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম-আচরণের এই মৌলিক নীতি হাজার বছরের ভারতের মৌলিক বৈশিষ্ট্যচিহ্নের অংশ হয়ে আছে। আর সে কারণেই তা ভারতের কনস্টিটিউশনের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমাদের কনস্টিটিউশন শূন্য থেকে উদ্ভূত হয়নি। এর মূল ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে প্রোথিত।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক স্বপ্নভূমির কথা বলেছেন, চিত্ত যেথা ভয় শূন্য এবং উচ্চ যেথা শির। এটা সেই মুক্তির স্বর্গ যা আমরা সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করে রাখতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি সব ধর্মেই সত্য আছে। ‘একম সৎ বিপ্র বহুধা বদন্তি’।
বন্ধুরা,
সমকালীন দুনিয়াতে শান্তি ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সহবস্থানের জন্য যা মুখ্য ও ক্রিটিক্যাল ইস্যু সে দিকে আলোকপাত করি। দুনিয়া দিনকে দিন ধর্মীয় ভাগের লাইনে বিভক্ত ও মারমুখী হতে দেখছে। এটা গ্লোবাল উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই পটভূমিতে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবিষয়ক প্রাচীন ভারতের যে নিবেদন প্রস্তাব তা এখন গ্লোবাল চিন্তা বিনিময়ের স্তরে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
পারস্পরিক সম্মানজনক সম্পর্কের এই দীর্ঘ অনুভূত প্রয়োজন ও আকাক্সক্ষা ২০০৮ সালের দশ ডিসেম্বর হেগে অনুষ্ঠিত ‘মানবাধিকারের বিশ্বাস’ এই ‘ইন্টারফেথের’ কনফারেন্সে নিয়ে আমাদের হাজির করেছিল। ঘটনাচক্রে সেটা ছিল জাতিসঙ্ঘের সার্বজনীন মানবাধিকার চার্টার ঘোষণার ৬০তম বর্ষপূর্তিরও বছর।
খ্রিশ্চানিটি, হিন্দুজম, যুদাইজম, বাহাই, বুদ্ধইজম, ইসলাম, তাওইজম এবং লোকায়ত ধর্ম বিশ্বাসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যারা দুনিয়ার প্রধান ধর্মগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন তারা মিলিত হয়েছিলেন, আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং ধর্ম অথবা বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক ঘোষণায় বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত ও এর অর্থ হাজির করেছিলেন এবং কিভাবে তা সুরক্ষা করতে হবে তা বলেছিলেন।
আমরা মনে করি, কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস কারো থাকা, ধরে রাখা, গ্রহণ করা এগুলো নাগরিকের ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়।
দুনিয়া এক পথ পরিক্রমার জংশনে আছে। যদি সঠিকভাবে তা পার হতে না পারি তবে তা আমাদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ফ্যাকড়া, ফ্যানাটিসিজম ও রক্তগঙ্গার অন্ধকারের দিকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে। ধর্মগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যের ঐকতান দুনিয়া এমনকি তিন হাজার বছরে প্রবেশের আগেও অর্জন করতে পারবে না। এখনই সময়। দেখা যাচ্ছে বাকি দুনিয়াও প্রাচীন ভারতের পথেই আবর্তনের পথ গ্রহণ করছে।
ভারতের পক্ষ থেকে, আমার সরকারের পক্ষ থেকে বললে আমি ঘোষণা করছি আমার সরকার ওপরের ঘোষণার প্রতিটা শব্দ ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। আমার সরকার ধর্মবিশ্বাসের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে যে প্রত্যেক নাগরিক সে কোনো ধর্ম ধরে রাখা অথবা গ্রহণ করা তার পছন্দের বিষয় এবং এটা কোনো ধরনের কারো বলপ্রয়োগ অথবা অন্যায্য প্রভাব ছাড়াই সে করবে এটা নাগরিকের অ-অমান্যযোগ্য অধিকার। আমার সরকার কোনো ধর্মীয় গ্রুপ, তা সে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যে ধরনেরই হোক, সঙ্গোপনে অথবা খোলাখুলি অন্যের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো সহ্য করবে না। সব ধর্মকে সমান শ্রদ্ধা ও সম্মান দেবে আমার এই সরকার।
ভারত বুদ্ধ ও গান্ধীর মাটি। সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রতিটি ভারতীয়ের ডিএনএ-তে থাকতে হবে। যেকোনো ওছিলায় কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য এবং আমি এমন সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই। আমার সরকার এমন কাজের বিরুদ্ধে শক্তভাবে তৎপর হবে। এই প্রতিশ্রুতিতে আমি সব ধর্মীয় গ্রুপের প্রতি সংযত হওয়া, পারস্পরিক সম্মান দেখানো ও জায়গা করে দেয়া প্রাচীন জনগোষ্ঠীর এসব সৎ স্পিরিটে দাঁড়াতে বলি যেটা আমাদের কনস্টিটিউশনেও প্রতিভাত এবং যেটা হেগ ঘোষণাতেই অনুলিখিত আছে।
বন্ধুরা,
আধুনিক ভারত গড়ার এক স্বপ্ন আমার আছে। আমার এই স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলতে এই বিরাট মিশনে আমি রওনা হয়েছি। আমার মন্ত্র হলো উন্নয়ন, বিকাশ ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’।
সহজ ভাষায় বললে এর মানে সবার টেবিলে খাবার, সব শিশু স্কুলে, সবার জন্য কাজের সংস্থান, পায়খানাসহ একটা বাসস্থান, প্রত্যেক পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ। সেটা এক গর্বের ভারত হবে। একতাবদ্ধ হয়েই আমরা তা অর্জন করতে পারি। একতা আমাদেরকে শক্তিশালী করবে। বিভক্তি আমাদের দুর্বল করবে। আমি আন্তরিকভাবে সব ভারতীয়ের কাছে এবং সবাই যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাদের কাছে নিবেদন করি এই বিশাল কর্মযজ্ঞে আমাকে সহায়তা করুন।
সেন্ট চাভারা এবং সেন্ট ইউফ্রাশিয়ার সাধুসন্তে উত্তরণ এবং তাদের নোবেল কাজ আমাদের অনুপ্রাণিত করুক :
-আমাদের অন্তরশক্তি বৃদ্ধি করতে।
-অপরের সেবা করার ভেতর দিয়ে আমাদের সমাজের রূপান্তর কাজে সেই শক্তি ব্যবহার করতে।
-আধুনিক ভারত ও উন্নীত ভারত আমাদের এই যৌথ স্বপ্ন পূরণ করতে।
ধন্যবাদ সবাইকে।
______________অনুবাদ এখানে শেষ___________
সবশেষে, এবার মোদী কেন নিজ দলীয় অবস্থানের বিরোধী নিজের এই সরকারি অবস্থান নিলেন। এর তাৎপর্য কী সে প্রসঙ্গে কিছু কথা।
১. প্রধানমন্ত্রী মোদি তার ‘বিকাশের স্বপ্নকে’ নিজ দলের পুরনো নীতির ওপরে প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করেছেন। অর্থাৎ এখন দলের নীতি সরকারের নীতির লাইনে খাপ খাইয়ে চলতে, সাজিয়ে নিতে বাধ্য হবে। কার্যত সরকারি অবস্থানটাই ইতোমধ্যে আধিপত্যের জায়গা নিয়ে ফেলেছে।
২. মোদির স্বপ্ন এর আসল অর্থ তিনি একটা ভারতীয় ক্যাপিটালিজম গড়ার পথে সিরিয়াস। ফলে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের স্বার্থের সাথে নিজের স্বপ্নকে এলাইন করার দিকটা তিনি বেছে নিতে ভুল করলেন না।
৩. চলতি গত দশ বছরের আলকায়েদা বা ইসলামি খলিফা স্টেট ধরনের দুনিয়াব্যাপী ফেনোমেনা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের জন্য হুমকি মনে করে। তাই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম সিস্টেম বা ব্যবস্থার দিক থেকে প্রতিক্রিয়াটা হলো ‘ইন্টারফেথ’ নামের পালটা কর্মসূচির পথে যাওয়া। মোদি নিজেকে ইন্টারফেথ কর্মসূচির সাথে নিজেকে এলাইন করলেন। আবার অন্য দিকে এর ওপর বাড়তি নিজ দলের ‘হিন্দুত্ব’ কর্মসূচি বা নিজ স্থানীয় এজেন্ডা থেকে সরে আসা সঠিক মনে করলেন।
৪. যদি ধরা যাক আগামী বছরর জুন মাসের দিকে মোদি সরকারের অর্থনীতিক কর্মসূচি (‘বিকাশের স্বপ্ন’ দুই বছর পার করবে তখন) ফল দেখাতে শুরু করে। অর্থাৎ অর্থনীতিক পরিসংখ্যানগুলোতে কাঙ্খিতভাবে হাজির হতে শুরু করে, জিডিপি বাড়ে, নতুন কাজ সৃষ্টির হার ভালো হয়। এককথায় অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে এক ভাইব্রেন্ট অর্থনীতি হিসেবে হাজির হতে শুরু করে তবে বিজেপি দলের রাজনীতির মুখ্য ফোকাস তখন সব ছেড়ে হয়ে যাবে এই ‘বিকাশ’ আর এর সাফল্য প্রচার এমন হতে বাধ্য হয়ে যাবে। এমনটা যতই হবে ততই ‘হিন্দুত্ব’ ভিত্তিতে বিজেপির রাজনীতি ভিত্তি বদল করে ফেলবে। ‘বিকাশ’ ধরনের বক্তব্য আর এর সাফল্য প্রচার এটা বিজেপির রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হতে থাকবে। ফলাফলে উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রচলিত ইস্যুর মধ্যে এক বড় ধরনের রূপান্তর দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা হাজির হবে। নিঃসন্দেহে এর একটা ইতিবাচক বেনিফিট বাংলাদেশ রাষ্ট্র পাওয়ার কথা। কারণ বর্তমানে ভারত নিজের ‘নিরাপত্তা’ যার ভেতর যেভাবে দেখে এই ভিত্তিমূলক দিক বদলে যাবে। যদিও মোদি সরকারের ‘বিকাশের’ পথে আরো অনেক বাধা আছে যেগুলোর অনেক যদি কিন্তু আছে। তবুও এই আলোচনার সীমার বাইরে বলে তা এখানে আনা হয়নি। তা পরে কোথাও আনা যাবে। আপাতত এতটুকুই।
________সমাপ্ত______
[এই লেখাটা আজকে পোস্ট করেছি কিন্তু এটা লেখা হয়েছিল প্রায় মাস খানেক আগে অর্থাৎ এপ্রিলের শুরুতে এখানে তবে ভিন্ন শিরোনামে। ইতোমধ্যে বিজেপি দলের রাজনীতি থেকে আলাদা করে কিছুকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অবস্থান বলে চিহ্নিত করা আরও বেশি অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গরু জবেহ করা যাবে না বলে সারা ভারতে নয় কেবল মহারাষ্ট্র রাজ্যে আইন পাস করা হয়েছে – এই ফালতু অজুহাতে বিপদজনক বিভক্তির রাজনীতির ইস্যুতে মোদীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশ সীমান্তে এসে বিএসএফের সাথে মিলে এই দলীয় কর্মসুচীর পক্ষে প্রচার চালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম বেশি হবে আর প্রাপ্যতা কমতিতে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিবে এমন বক্তব্যও রেখেছেন। ফলে পরবর্তি এই পরিস্থিতি নিয়ে আরও আপডেটেড লেখা আলাদা করে লিখতে হবে। তার আগে এই লেখা পড়ার সময় পাঠক যেন মাস খানেক আগে লেখা পড়ছি একথা মনে রেখে পড়েন – এই অনুরোধ করছি।]