AIIB সিরিজ
চীনের বিশ্বব্যাংক : গঠন কাঠামো, আর্টিকেল স্বাক্ষরিত
গৌতম দাস
ছোট লিঙ্কঃ http://wp.me/p1sCvy-aB
চীনের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংক, ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ বা সংক্ষেপে AIIB এর গঠন প্রক্রিয়া চলছে, আগামী বছর থেকেে এর কর্মতৎপরতা শুরুর কথা জানিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে উদ্যোক্তা-স্বাক্ষরদাতা সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে পরবর্তী কাজ ‘আর্টিকেলস অব অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা ব্যাংকের গঠনতন্ত্রের মুসাবিদা করার যে কাজ চলছিল তা শেষ হয়েছে এবং তা প্রণয়ন শেষে তাতে সম্মতি স্বাক্ষরের দিন ছিল ২৯ জুন ২০১৫। ‘আর্টিকেলস অব অ্যাগ্রিমেন্ট’ দলিলে কী কী বিষয়ে একমত হওয়া গেছে, এর তাতপর্য কি সে আপডেট হলো এবারের লেখার প্রসঙ্গ।
প্রথমতঃ ২৯ জুন ২০১৫, স্বাক্ষর শেষে কারা কারা সদস্য রাষ্ট্র হল, তা বলা এখন সহজ হয়ে গেছে। আমেরিকা ও জাপান তাদের প্রভাবাধীন রাষ্ট্রগুলো যাতে AIIB ব্যাংকের সদস্য না হয় সেজন্য গত এক বছর ধরে এই দুই রাষ্ট্র প্রবল কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিল। কিন্তু ২৯ জুনের পর দেখা যাচ্ছে আমেরিকা ও জাপান এরা নিজেরা বাদে এদের প্রভাবাধীন সব রাষ্ট্রই AIIB এর ‘আর্টিকেলস অব অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা ব্যাংকের গঠনতন্ত্রে সম্মতি স্বাক্ষর দিয়েছে। এখন মোট সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা ৫৭, যার ৫০ জন এরই মধ্যে স্বাক্ষর করে ফেলেছে আর বাকি ৭ জন নিজ নিজ রাষ্ট্রের সম্মতি স্বাক্ষরের পক্ষে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পথে আছে।
বিগত ২৫ বছর ধরে গ্লোবাল অর্থনীতিতে চীন ক্রমেই আমেরিকার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে আর আমেরিকান প্রভাবকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এদিক থেকে বিচারে চীনের AIIB উদ্যোগে দুনিয়ার পাঁচ মহাদেশকেই AIIB ব্যাংক গঠনে শামিল করা – এটাকে গ্লোবাল কূটনৈতিক তৎপরতায় চীনের সর্বোচ্চ সাফল্য ও সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ একদিকে আমেরিকা ও জাপানের সক্রিয় বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে চীন, অন্যদিকে ইউরোপের প্রভাবশালী প্রায় সব রাষ্ট্রকে ব্যাংক গঠন উদ্যোগে শামিল করতে পেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি লগ্নে বিশ্বব্যাংকের জন্ম হয়েছিল, সেই থেকে ইউরোপের অর্থনৈতিক ভাগ্য আমেরিকার সাথে গাঁটছাড়ায় বাধা পড়েছিল। সেই গাটছাড়া এই প্রথম অস্বীকার উপেক্ষা করে ইউরোপ এক তাতপর্যপুর্ণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিল।
যদিও পাঁচ মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব রাষ্ট্রই এর সদস্য, তবু গঠনতন্ত্রে এ ধারণা পরিষ্কার রাখা হয়েছে যে, এই ব্যাংক এশিয়ান রাষ্ট্রগুলোর প্রাধান্যের ব্যাংক। যেমন বলা হয়েছে, শুধু এশিয়া অঞ্চলের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সবাই মিলে এ ব্যাংকের কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ ভোটের মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করবে। আর ব্যাংকের মোট মালিকানার এই ৭৫ ভাগের মধ্যে চীন একা ২৬ দশমিক ০৬ শতাংশ ভোট শেয়ার মালিকানা নিবে। এটি সর্বোচ্চ একক মালিকানা। অর্থাৎ চীন বিনিয়োগের যোগানদার হবে। (২৬ দশমিক ০৬ শতাংশ ভোট শেয়ার মানে এটা মালিকানা বোর্ডের ভোট শেয়ারের অনুপাত। চীনের বিনিয়োজিত অর্থের অনুপাত নয়। সংখ্যা হিসাবে সমতুল্য অর্থের অনুপাত একটু বেশি। ২৬ দশমিক ০৬ শতাংশ ভোট শেয়ার এর সমতুল্য অর্থের মালিকানা শেয়ার হল ৩০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক পরিচালনা সিদ্ধান্ত গ্রহণে চীনের মোট ভোট ২৬ দশমিক ০৬ শতাংশ।
চীনের এ মালিকানা বা ভোটের ক্ষমতার তাৎপর্য কী?
তাৎপর্য : এক
ব্যাংকের (এখন থেকে AIIB ব্যাংককে সংক্ষেপে এখানে ব্যাংক বলব) প্রণীত গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত দেয়া হয়েছে যে, শুধু ৭৫ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তা অনুমোদিত হতে হবে। অর্থাৎ ৭৫ ভাগ ভোট ওই সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকতে হবে। এমন বিষয়গুলো হল যেমন, ব্যাংকের সভাপতি নির্বাচন অথবা কোনো সদস্য রাষ্ট্রের সদস্যপদ স্থগিত করে রাখার সিদ্ধান্ত। আর এছাড়া খোদ গঠনতন্ত্রেই কোনো পরিবর্তন বা সংশোধনী আনতে চাওয়ার মতো মৌলিক কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে এ পূর্বশর্ত প্রযোজ্য হবে। এর সোজা অর্থ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইলে চীনের সম্মতিকে সঙ্গে না নিতে পারলে তা সফল করা যাবে না। কারণ চীন ছাড়া সব সদস্য রাষ্ট্র একজোট হলেও মোট ভোটের পরিমাণ ৭৫ শতাংশের কমই থাকবে, যেহেতু একা চীনের হাতে ২৬ শতাংশের চেয়েও বেশি ভোট ক্ষমতা আছে, তাই। যেমন চেয়ারম্যান এমন ব্যক্তি নির্বাচিত বা বেছে নিতে হবে, যার ওপর চীনের আশীর্বাদ আছে।
তাৎপর্য : দুই
ব্যাংকের মালিকানা শেয়ার বিতরণে চীনের একার হাতে সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ০৬ শতাংশ শেয়ার ভোট রাখা হয়েছে তা আগেই বলেছি। কিন্তু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট হলো ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, আর এ ভোটধারী রাষ্ট্র হলো ভারত। একইভাবে তৃতীয় হলো, ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোটের অধিকারী রাষ্ট্র রাশিয়া। এমন ধারাবাহিকতায় এশিয়ার বাইরের রাষ্ট্র হিসেবে ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী জার্মানির ভাগে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, ফ্রান্স ৩ দশমিক ৪ শতাংশ আর লাতিন আমেরিকার ব্রাজিলের ভাগে ৩ দশমিক ২ শতাংশ শেয়ার ভোট। অর্থাৎ এসবের সোজা অর্থ হলো, এ ব্যাংক পরিচালনে চীনের প্রধান সহযোগী হবে ভারত ও রাশিয়া। এসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি (এশিয়ান ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক) প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, বিশ্বব্যাংক যেমন আমেরিকান কর্তৃত্বে আর ইউরোপ ও জাপানের সহযোগী ভূমিকায় চলে, আর, এডিবি তেমনি জাপানের কর্তৃত্বের প্রতি আমেরিকান সমর্থনে পরিচালিত হয়। ঠিক তেমনি, AIIB ব্যাংকের বেলায় এটি চীনের নেতৃত্বে ভারত ও রাশিয়ার সহযোগী ভূমিকায় পরিচালিত হবে। অর্থাৎ পুরনো বা চলতি গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডারের কোনো মাতবর বা মাতবরের সহযোগী এমন কেউই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী অবকাঠামো ব্যাংকের পরিচালন মাতব্বরিতে নেই, রাখা হয়নি। নতুন উত্থিত মাতবর চীন আর তার প্রধান সহযোগী ভারত ও রাশিয়া, যারা কেউই পুরনো অর্ডারের মধ্যকার প্রভাবধারী কেউ নয়। ফলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, পুরনো বা চলতি গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডারের বদলে এর প্রভাব কমে আগামীতে নতুন এক গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডারে আসার ক্ষেত্রে সে প্রতিযোগিতায় জিতার এক হাতিয়ার গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান হয়ে হাজির হচ্ছে AIIB ব্যাংক। ব্যাংকের মালিকানা শেয়ারবিন্যাস আমাদের সে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ বিষয়গুলো ইউরোপের প্রধান প্লেয়ার সদস্য রাষ্ট্র জর্মান, ফ্রান্স বা বৃটেন বুঝেনি তা মনে করা ভুল হবে। অবশ্যই বুঝেছে, তবে বাস্তবতা হলো, গ্লোবাল অর্থনীতির মূলকেন্দ্র হয়ে গেছে এশিয়া (ইউরোপ বা আমেরিকা নয়) বলে এ বাস্তবতা তারা মেনে নিয়েছে। এই ফাকে একটা তুলনামূলক তথ্য দিয়ে রাখি। বিশ্বব্যাংকের মালিকানা-বিন্যাসেও জার্মানির মালিকানা শেয়ার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ আর আমেরিকার একক সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ। আমেরিকার নেতৃত্বে পুরনো বা চলতি গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডারের বদলে চীনের নেতৃত্বে নতুন কোনো গ্লোবাল অর্ডার চালু হলে আমেরিকার বদলে চীনের সহযোগী হতে ইউরোপের লিডিং অর্থনীতিগুলোর আপত্তি থাকবে না, এ ব্যাপারে তারা মনস্থির করে ফেলেছে – AIIB ব্যাংকের গঠন কাঠামো খুব সম্ভবত এমন ধারণার পক্ষে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তাৎপর্য : তিন
ভারতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শেয়ার মালিকানা দেয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আমি বহুবার বলে এসেছি, দুনিয়ায় গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শৃঙ্খলায় আমেরিকান নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে, পরিবর্তন নিশ্চিতভাবে আসন্ন হয়ে উঠছে। চারদিকে সেসবের আলামত ফুটে উঠছে। পুরনো বা চলতি আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডারের জন্ম বা কায়েম হওয়ার প্রস্তুতিপর্ব অর্থে সময়কাল ছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের ২৫ বছর। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৪৪ সালের আশপাশে যেটা পরিণতি পায়। আমাদের এখনকার সময়টাও মানে বিগত মোটামুটি ১০ বছর ধরে আমরাও এবার আমেরিকার বদলে চীনের নেতৃত্বে নতুন কোনো গ্লোবাল অর্ডার চালু হওয়া আসন্ন হয়ে ওঠার কালে যেন আছি। এ পর্যায়ে চীনের পরে চীনের মতোই (চীনের গতিতে না হলেও) রাইজিং অর্থনীতির দেশ হলো ভারত। এভাবে বিচার টানার পেছনে বড় কারণ ও উপাদান হলো, নিজ অভ্যন্তরীণ বাজার হিসেবে ভারত চীনের মতোই বড় ও প্রবল সম্ভাবনাময়। যদিও এখনও অনেক পথ ভারতকে ঠিক ঠিক বুদ্ধিমানের মতো ঈর্ষা ত্যাগ করে হাঁটতে হবে। এ বিচারে চীন ও ভারত যদি রাইজিং ইকোনমি হয়, তবে আমেরিকার বেলায় বলতে হবে ডাউনিং ইকোনমি। ফলে স্বভাবতই ডাউনিং বা নিম্নগামী অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চীন ও ভারতের নতুন অর্ডার কায়েমের কাজ করণীয় অনেক – একথা মনে রাখলে মানতেই হবে যে, ঢলে পড়া আমেরিকান নেতৃত্বের অর্ডারের বিরুদ্ধে চীন ও ভারত এরা দুজন পরস্পর ‘ন্যাচারাল এলি’। কারণ তাদের লক্ষ্য করণীয় কাজ এক আর কমন প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা। কিন্তু এটি শুধু পুরনো অর্ডারের বিরুদ্ধে লড়ে এক নতুন অর্ডারের জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে। বাকি বিশেষত এই দুই রাষ্ট্রের নিজ নিজ নিরাপত্তা বা সামরিক স্বার্থের বিষয়ে এদের পরস্পরিক রেষারেষি, সন্দেহ, অচিহ্নিত সীমান্ত এবং সবার উপরে চীনের তুলনায় ভারতের খুবই অসম সামরিক সক্ষমতা – এগুলোও সমান বাস্তবতা। আর এ রেষারেষি, সন্দেহকে নিয়মিত আমেরিকান নানান থিঙ্কট্যাঙ্কের মাধ্যমে আমেরিকা ভারতের ইন্টেলিজেন্সিয়া, মিডিয়া ও জনগণের কাছে আরও ভীতিকরভাবে উপস্থাপনের প্রোপাগান্ডা করে যাচ্ছে আমেরিকা। আবার চীন-ভারত সম্ভাব্য কোনো সামরিক বিরোধ যদি দেখা দেয়, তবে সেক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে ভারত শুধু আমেরিকাকেই ভাবতে পারে। এটিও বাস্তবতা। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি, ‘ন্যাচারাল এলি’ কথাটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত বলে নিতে হবে, চীন-ভারত সম্পর্কের ভেতর সামগ্রিক অর্থে যেন আমরা ভেবে না বসি। ফলে বুঝতেই পারা যায়, চীন-ভারত কুটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি সাদা-কালোর মতো সরল নয়, বরং যথেষ্ট জটিল ও ক্রিটিক্যাল।
সম্ভবত এসব গুরুত্বপূর্ণ দিক চীন-ভারত ঠান্ডা মাথায় আমল করতে পেরেছে, অন্তত কিছু গুরুত্বপুর্ণ ক্ষেত্রে; যে কারণে চীনের পরই ভারতের ভোট শেয়ার মালিকানা প্রদান। এছাড়া, চীনের দিক থেকে পরিপক্ক চিন্তা যে ইউরোপের চেয়েও ভারতের অগ্রাধিকারের ও উপযুক্ত গুরুত্বের স্বীকৃতি দেয়া। পুঁজির অর্থের পরিমাণের দিক এটি প্রায় ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ; (সমতুল্য ভোটের শেয়ার অর্থে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ) এভাবে শেয়ার মালিকানা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ তারা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। মোদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পরে, মোদি-ওবামা প্রথম দেখা হয়েছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। সে সময় থেকেই আমেরিকা AIIB ব্যাংক উদ্যোগ থেকে ভারতকে দূরে রাখতে সব ধরণের কূটনৈতিক লবিং করে গেছে। যদিও শেষে শুধু ভারত নয়, এশিয়ায় আমেরিকার আরও দুই বিশেষ ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক বন্ধু – অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াকেও AIIB উদ্যোগ থেকে দূরে রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে। কিন্তু সবার বেলায় নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রচুর গড়িমসির পর আজ দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া AIIB ব্যাংকে যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ বড় শেয়ারহোল্ডার মালিক।
তাৎপর্য : চার
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না বিশ্বব্যাংকের গঠনতন্ত্র অনুসারে, সেখানে আমেরিকার একক সর্বোচ্চ মালিকানা শেয়ার ছাড়াও প্রত্যক্ষভাবে আমেরিকাকে ভেটো ক্ষমতা দেয়া আছে। জন্ম থেকেই এ ক্ষমতা দেয়া। ২০১০ সালে ইউরোপের জার্মানি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে আমেরিকাকে এ ভেটো ক্ষমতা ত্যাগ করতে আহ্বান জানিয়েছিল।
এসব সূত্রে AIIB ব্যাংক উদ্যোগের কালেও কানাঘুষা উঠে যে, চীন সম্ভবত ব্যাংকের গঠনতন্ত্র প্রণয়নকালে নিজের জন্য ভেটো ক্ষমতা দাবি করবে। না তা হয় নাই। জল্পনা-কল্পনা মিথ্যা প্রমাণ করেছে, চীন তেমন কিছু করেনি। তবে ২৬ শতাংশ শেয়ার মালিকানা নিজের জন্য রেখে দেয়ার বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেছে। চীনের ভাইস অর্থমন্ত্রী মিডিয়াকে জানিয়েছে, “চীন উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো ভেটো ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার দরকার বোধ করে না। তবে যাত্রার শুরুতে এই ব্যাংককে ফাংশনাল করতে গিয়ে চীনকে বেশি বিনিয়োগ দিতে হয়েছে, ফলে ‘ন্যাচারাল আউটকাম’ হিসেবে চীনের মালিকানা বেশি হয়েছে। আগামীতে এশিয়ার অন্য শেয়ারহোল্ডাররা যখন তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াবে, তখন চীনের এমন মালিকানা আর থাকবে না, কমে আসবে। চীন বিশ্বাস করে, ভবিষ্যতে যে কোনো সিদ্ধান্তে চীন তার শরিকদের বুঝিয়ে বলে তাদেরকে একমতে আনতে চীন সক্ষম হবে”।
কিছু খুচরা তথ্য : ব্যাংকের হেড অফিস কোথায় হবে এ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া শুরু থেকেই তা নিজের দেশে স্থাপনের অফার দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, হেড অফিস চীনেই হবে, তবে সাব-অফিস অন্যান্য দেশে হতে পারে।
ব্যাংকের অফিসিয়াল ভাষা কী হবে- এ প্রশ্নে ইংরেজি সাব্যস্ত হয়েছে। এছাড়া কে ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হবেন এ প্রশ্নে আর্টিকেলে লিখে বলা হয়েছে, “এক উন্মুক্ত, স্বচ্ছ ও উন্নতমানের নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এশিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্য থেকে কোনো নাগরিককে বেছে নেয়া হবে”। এছাড়া আপাতত অফিসিয়াল মুদ্রা হবে আমেরিকান ডলার।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও উচু মাত্রার প্রফেশনালিজমের ব্যাপারে চীনের পক্ষ থেকে এসব প্রসঙ্গে যেচে কথা বলার কারণ, শুরুর দিকে আমেরিকা প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলেছিল যে এই ব্যাংক উদ্যোগ বিশ্বব্যাংক বা এডিবির পর্যায়ের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও উচু মাত্রার প্রফেশনালিজম দেখাতে পারবে না; এই বলে উদ্যোগকে তুচ্ছ করতে চেয়েছিল। এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে যোগ না দিতে উতসাহিত করতে বিভ্রান্তিতে ফেলা ও চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। আমেরিকার সে প্রপাগান্ডার জবাব দিতেই চীনের এমন যেচে কথা বলা।
[এই লেখাটা লিখেছিলাম গত ১১ জুলাই, এরপর তা ছাপা হয়েছিল ১৩ জুলাই, ২০১৫ তারিখের দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশে। ছাপা হবার পর এটা আবার আরও আপডেট ও সম্পাদনা করে এখানে ছাপা হল। ]
গৌতম দাস : রাজনৈতিক বিশ্লেষক