জয়া চ্যাটার্জির ভিলেনঃ বাঙলার ‘হিন্দু ভদ্রলোক এলিটদের’ নিয়ে তাঁর বিপদ


জয়া চ্যাটার্জির ভিলেনঃ বাঙলার ‘হিন্দু ভদ্রলোক এলিটদের’ নিয়ে তাঁর বিপদ

গৌতম দাস
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
http://wp.me/p1sCvy-b1

দেশভাগের ১৯৪৭ সাল। এ অঞ্চলের ইতিহাসকে দেখার ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যেকোন প্রশ্ন এখনও ঘুরেফিরে ভারত ভাগকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তবে সেটা এই কারণে নয় যে, এর মধ্যদিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছে। বরং পরিণতিতে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম আর অন্যসব কিছুকে ছাপিয়ে, এখানে আলোচনার প্রধান জায়গা হয়ে উঠে, “ভারত ভাগ”। এবিষয়ে প্রচলিত ব্যাখ্যা বা বয়ানের অভাব না থাকলেও সেসব জড়াজীর্ণতায় ক্লিশে হয়ে আছে। তবে এসবের বাইরে গিয়ে যারা ইতিহাস চর্চা করেছেন বলে একাডেমিক জগতে পরিচিতি আছে তাদের মধ্যে একজন হলেন ভারতের জয়া চ্যাটার্জি। তার পিএইচডি গবেষণার ফলাফল যেটা পরবর্তিতে বই আকারে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস লন্ডন থেকে প্রকাশিত, এর নাম “বেঙ্গল ডিভাইডেড” (১৯৯৪)। পরে বাংলাদেশ থেকে ঐ একই ইংরাজী বই বাংলায় অনুবাদ করে বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয় এর নাম “বাংলা ভাগ হল” (২০০৩)। এই বইয়ে জয়া চ্যাটার্জির বাংলা ভাগের জন্য প্রচলিত ক্লিশে ধারণায় মুসলিম লীগ বা কায়েদে আজম জিন্নাহকে নয় দায়ী করেন নাই, দায়ী করেছেন বাংলার “হিন্দু ভদ্রলোক এলিট” শ্রেণীকে।

বলা বাহুল্য এর ভিতর দিয়ে জয়া চ্যাটার্জি সরাসরি কোন রাজনৈতিক বয়ান নয়, ইতিহাসের এক একাডেমিক বয়ান হাজির করেছেন। ফলে পশ্চিম বাংলায় সামাজিক মিথ ও ইতিহাস হিসাবে ধরে নেয়া চলতি অনেক কিছুকেই জয়া ভিন্নভাবে দেখে এবং জবরদস্তিগুলোকে অস্বীকার করেই “বাংলা ভাগের” নতুন ইতিহাস বয়ান করে গেছেন। তবু জয়া লিখছেন বাংলা দুবার ভাগ হল। ওপার পশ্চিম বাংলার দৃষ্টিতে (১৯০৫ ও ১৯৪৭) দুবারই বাংলা ভাগ হওয়ার ঘটনা দুঃখ ও বিরহের। কিন্তু ফ্যাক্টস হল, দুবারের একবারও পুর্ববঙ্গের প্রজা কৃষক ও মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গীটা এমন নয়, বরং এর উলটা, তারা খুশি হয়েছিল, আশা দেখেছিল। তাদের চোখে এটা ছিল আনন্দের ও নতুন সম্ভাবনার। এই খুশি হওয়া ঠিক কি বেঠিক হয়েছে, পন্ডিতেরা কি বলেন তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ ঐতিহাসিক সত্য গ্রহণ করা না করা দিয়ে বদলানো চলে না। বরং কেন সেটা সত্য হল বড় জোর তা বুঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। তাসত্ত্বেও পুর্ববঙ্গের অবস্থান দৃষ্টিভঙ্গী যেন ভুল ছিল এমন ইতিহাসের বয়ান খাড়া করার চেষ্টার অন্ত নাই। তবে পুর্ববঙ্গ থেকে দেশান্তরী হিন্দুদের মনোভাব এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, তাদের দুঃখ পাবারই কথা। কে নিজ ঘরবাড়ী ছেড়ে দেশান্তরী হতে চায়, দেশ ছাড়াকে সঠিক মনে করতে পারে। অতএব সার করে বললে কঠিন সত্যিটা হল, বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে দুবাংলার মানুষ সবাই একই চোখে ব্যাপারটাকে দেখে নাই। আর দুবারই এমন ঘটেছে। ইতিহাসে সততা চাইলে এসত্য আমরা সবাই মেনে নিতে বাধ্য। ফলে আসলে যা একই চোখে দেখা হয় নাই, সেটা দেখানোর চেষ্টা করতে হবে, জবরদস্তি করতে হবে অথবা মুসলমানদের দেখাটাকে “কারেক্ট” করে দেখাতে হবে এমন চিন্তা ও ততপরতা অর্থহীন। এগুলো ব্যর্থ এবং মতলবি চেষ্টা। তবুও ফ্যাক্টস বা মাঠের সত্য যেটা তা সরাসরি না বলে এর বদলে “কিভাবে দেখা ঠিক এবং বেঠিক” তা দিয়ে ইতিহাসে ঘটনাটাকে দেখতে দেখাতে চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষিতজনদের ভিতরই কেবল এটা প্রবল এবং করা সম্ভব হয়েছে। এমনটা সম্ভব হবার পিছনের সম্ভাব্য একটা বড় কারণ ইতিহাস লেখকেরা খোদ পশ্চিমবঙ্গের অথবা ইতিহাস লেখক পুর্ববঙ্গের হলেও তাঁর চিন্তার উপর পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব প্রবল। প্রগতিশীলতার নামে, “অসাম্প্রদায়িকতার” নামে এরাও এগুলো করেছে। সেসব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে, চাপা পড়া সত্য সেসব কথার অনেক কিছুই এখন জয়া চাটার্জির মুখ থেকে আসছে।

বাংলা বইয়ের শুরুতে “বাংলা সংস্করণের মুখবন্ধে” জয়া বলছেন, “১৯৮০ সালে আমি যখন এ গ্রন্থের জন্য গবেষণা শুরু করি তখন একটা সাধারণ ও অনুকুল ধারণা প্রচলিত ছিল যে, ভারত বা বাংলার বিভক্তি মুসলমানদের কাজ – হিন্দুরা তাদের মাতৃভুমির অখন্ডতাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে কোন কিছুই করেনি। ঐ সময়ের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণায় প্রকাশ পায় যে, স্বাভাবিক ও ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট হল সহনশীল এবং বহুত্ববাদী। তাই হিন্দুত্বে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ নেই। তবে আমার গবেষণায় প্রচলিত ঐ সাধারণ ও তৃপ্তিদায়ক ধারণা তো নয়ই, বরং ভিন্ন তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। ঐ গবেষণায় প্রকাশ পায় যে, বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (এলিটদের) ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় তাঁরা সামাজিক অবস্থান অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে কূটকৌশল অবলম্বন করে এবং নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসাবে বিভিন্ন ভাবাদর্শকে (ideologies) ব্যবহার করে। সত্যিকার অর্থে ঐ কূটকৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। আত্মরক্ষায় যুযুধান ঐ সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু ভদ্রলোকদের প্রদেশ ভাগের দাবীর পেছনে যুক্তি ছিল যে, এতে তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে। আসলে ত্রিশ চল্লিশের দশকে বাঙলায় যা ঘটে এবং উনিশ শতকের শেষ দিকে যুক্ত প্রদেশের উর্দুভাষী ভদ্রলোকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মুসলমান রাজনীতির যে উন্মেষ ঘটে তা একই দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবেচনা করা যেতে পারে। এত আমরা উপলব্দি করতে পারি যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক কৌশল হিসাবে বিভিন্ন গোষ্ঠি বিভিন্ন সময় তাদের চলমান প্রাধান্যের প্রতিকুল হুমকির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেছে”।
উপরের পুরা প্যারাটাই জয়ার লেখা থেকে তুলে আনা লম্বা উদ্ধৃতি, তবে এতে আন্ডারলাইন ও বোল্ড করা আমার। জয়ার চোখে লেখা উপরের বক্তব্যের সারকথা হল – পুরা ঘটনায় ভিলেন হলেন বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকেরা (এলিট)। কিন্তু এর চেয়ে তাতপর্যপুর্ণ হল, জয়া যেভাবে এই এলিটদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। প্রথমে “ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা” – এই তিন বৈশিষ্টায়িত শব্দ ব্যবহার করে তিনি বলছেন, “বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (এলিটদের) ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন…” হয়েছিল। অর্থাৎ এলিটদেরকে তিনি বুঝতে বলছেন প্রায় দেড়শ বছর ধরে তাদের ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদার রুস্তমি চালিয়ে যাওয়া লোক হিসাবে। এরপর তাদের এগুলো যখন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ল ফলে একে তিনি বলছেন, “ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু” থেকে আত্মরক্ষার চাতুরি, কূটকৌশল হিসাবে যে মতাদর্শকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিল সেটাকে তিনি বলছেন “সাম্প্রদায়িকতা”।

সাম্প্রদায়িকতা শব্দটা বেশ অদ্ভুত। বিশেষ ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশির ভাগ সময় এই শব্দ ব্যবহার করা হয় মুসলমান, মুসলিম লীগ বা কায়েদে আজম জিন্নাহর বিরুদ্ধে, এদের গায়ে কালি লাগিয়ে দিতে। উপনিবেশী কলোনী শাসনের প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরা সময় ধরে হিন্দু বাঙালীর আধিপত্য – সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম ছিল। সেকালে বাঙালী বলতে তারা কেবল হিন্দু বাঙালী বুঝত, বুঝাত। ক্ষমতা আধিপত্যের এই সৌধের বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিবাদ, চ্যালেঞ্জকে তারা এতদিনের হিন্দু ডোমেনকে ‘অস্থিতিশীল’ করা, নিজেদের শান্তি নষ্ট  হিসাবে দেখত আর প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে পালটা অভিযোগ করত। এই লজিকের অব্যক্ত দিকটা এরকম যে বাঙালী ধারণার ভিতর মুসলমান বলে তো কিছু নাই। ফলে এরা তো গোনায় না ধরা এক প্রজাতি। আন-হার্ড – যাদের কথা শোনার যোগ্য নয়, পাত্তা দেবার কিছু নাই অন্তজ চাষা এমন মুসলমানেরা হিন্দুদের “বাঙালী” ধারণার মধ্যে অস্বীকৃতই তো থাকবে।  মুসলমানদের চিৎকার, প্রতিবাদ, চ্যালেঞ্জকে  বাঙালী (হিন্দুরা) বাঙালী ধারণাকে বিভক্ত করবার চ্যালেঞ্জ হিসাবে মনে করবেই। হিন্দুদের শৌর্যবীর্যে আঘাত মনে করবে। সাজানো বাগান হস্তক্ষেপ মনে করবে। এই অর্থে অতএব এটা সেক্টোরিয়ান বা বিভক্তিসূচক খারাপ কাজ  – “সাম্প্রদায়িক“।

জয়া এই ততপরতাকে এলিটদের সামাজিক অবস্থান অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে কূটকৌশল অবলম্বন করা এবং নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসাবে এক ভাবাদর্শকে (ideologies) ব্যবহার করার কথা বলছেন। বলছেন, “সত্যিকার অর্থে ঐ কূটকৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়”। এক্ষেত্রে জয়ার সাম্প্রদায়িক শব্দটার আসল অর্থ উপরে ব্যাখ্যার মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।

বইয়ে পরবর্তিতে “ভুমিকার” তৃতীয় পৃষ্ঠা থেকে বাকি অংশ জুড়ে অন্তত দশ বারো দিক থেকে এই “ভদ্রলোক” বলতে  জয়া কাদের বুঝাচ্ছেন তা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হল, জয়া বলছেন, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের প্রথম বার বাংলা ভাগের সময়ও এই ভদ্রলোকেরাই বাধা দিয়েছিলেন। মুল ইংরাজি এবং বাংলা অনুবাদেও বইয়ের ভুমিকায় জয়া বলছেন, “১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশ ভাগ করতে সেই শ্রেণীর লোকেরাই নেতৃত্বে দেয় যারা বাংলার প্রথম ভাগের সময় থেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিল, যাদের পরিচিতি ছিল তথাকথিত ভদ্রলোক বা ‘সম্মানিত’ লোক”। [ভুমিকা, পৃষ্ঠা ১]

তার মানে হল জয়া দাবি করছেন, এই “হিন্দু ভদ্রলোকেরা” ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ মানে বাংলা ভাগ করতে বাধা দেয়ার পক্ষে কাজ করেছেন এবং কাজটা ঠিক করেন নাই। তিনি তাঁর লেখায় ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগ হওয়ার ব্যাপারটাকে বিষাদময় ঘটনা হিসাবেই দেখার চেষ্টা করছেন? আবার ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগটাকেও জয়া বিষাদময় ব্যাপার হিসাবে দেখেন। যেমন বইয়ের ভুমিকায় শুরুতে তিনি লিখছেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে ১৯৪৭ সালে বাঙলা আবার ভাগ হয়। কিন্তু এসময় প্রায় কারও কন্ঠেই প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হল না………”। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে কারও কন্ঠে অন্তত প্রতিবাদ আশা করছিলেন জয়া। এটাকে প্রতিবাদ করার মত ঘটনা হিসাবে দেখছেন জয়া। সোজা কথায় দেশভাগ বা বাংলা ভাগ ভাল নয় – জয়ার দাবি এটাই। এই চিন্তা প্রস্তাবের উপর দাঁড়িয়ে পুরা বইটা লেখা হয়েছে। তাঁর এই দেখা সঠিক অথবা বেঠিক তা নিয়ে তর্ক না তুলেও বলতে হয়, দেখার এই দৃষ্টিটা কোনভাবেই ওপার বাংলার, পূর্ববঙ্গের নয়। আর সঠিক-বেঠিক ছেড়ে ঘটনার সত্য দিকটা হল, সে সময় “পাকিস্তান আন্দোলনের” পক্ষের মানুষেরা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চলগুলোকে নিয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন। ফলে তাদের চোখে বাংলা ভাগ সবসময়ই কাম্য ছিল। আমরা পছন্দ করি আর নাই করি, ইতিহাসের সত্য হল, পুর্ববঙ্গের আপামর মুসলমান ১৯০৫ এবং ১৯৪৭ দুবারই বাংলা ভাগকে তাদের জন্য কাম্য হিসাবেই দেখেছিল। এই নিরেট বাস্তবতার খবর জয়া এই বই লেখার সময়  বিবেচনায় নিয়েছেন এর প্রমাণ মিলে না।

তাহলে জয়া যে আশা আকাঙ্ক্ষার উপর দাঁড়াচ্ছেন, দেশভাগ ব্যাপারটাকে দেখতে চাইছেন – সেটা “পাকিস্তান আন্দোলনের” মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গী নয়। আবার সে দৃষ্টিভঙ্গীটা দেশ ভাগের ভিলেন জয়ার ভাষায় “হিন্দু ভদ্রলোকেদেরও” নয়। তাহলে কাদের আশা আকাঙ্খার উপর জয়া দাঁড়াতে চাইছেন? দেশভাগ হওয়া সঠিক মনে করেন না এরা কারা?

সারকথায় বললে, অখন্ড ভারতের বা অখন্ড বাংলার পক্ষে থাকা এক “ভারতীয় জাতীয়তাবাদের” জন্য আকাঙ্ক্ষা ও পক্ষপাতিত্ব জয়া চাটার্জির আছে। কিন্তু এটা একেবারেই কল্পিত, অবাস্তব কল্পনা এজন্য যে বাস্তবে এটা নাই, তবে জয়ার কাছে এটা এমন কাল্পনিক হলেও কামনার বিষয়। এক কল্পিত আদর্শও। এই রাজনৈতিক অবস্থানের উপর দাঁড়িয়ে জয়া চ্যাটার্জি তাঁর বই লিখেছেন। বাস্তবে না থাকলেও তবু মনে মনে এমন একটা খাসা সমাধানের আকাঙ্ক্ষা জয়া এখনও মনে পুঁষে রাখেন এবং এটাই তার চোখে আদর্শ সমাধান হত। জয়ার বই পড়তে গিয়ে তাঁর কল্পিত এই আদর্শ সমাধান বা “আদর্শ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে” (যেটা বাস্তবে আছে সেটা নয়) কল্পনায় আমাদের সবসময় পাশে রাখা দরকার। যদি রাখি তাহলে সহজে জয়াকে বুঝব। জয়া বাস্তবে পাওয়া সবকিছুকে কোন কল্পিত আদর্শর প্রেক্ষিতে বিচার করছেন এবং সবকিছুর ভিতরে খুঁত দেখছেন, প্রত্যাখ্যান করছেন তা বুঝব। যেমন বাস্তবে দেখতে পাওয়া বঙ্কিম-অরবিন্দ বা কংগ্রসের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জয়ার চোখে কাঙ্খিত আদর্শ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নয়, মানদন্ড সম্মত নয়। জয়ার চোখে সম্ভবত এর একটা কারণ প্রথমবার (১৯০৫-১১) বাংলা ভাগের সময় থেকেই “এই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিল “হিন্দু ভদ্রলোকেরা”। জয়ার পুরা বইয়ে এই “হিন্দু ভদ্রলোকেরাই” দেশভাগের ভিলেন। “হিন্দু ভদ্রলোকেদের” হিন্দু কারবারই জয়ার চোখে তাঁর কল্পিত ও কাম্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিচ্যুতি। দুধের মধ্যে চোনা। জয়ার বইয়ের সারকথা এটাই। কিন্তু আগেই বলেছি, জয়ার সারকথার (কোন অর্থেই) খাতক ততকালীন পুর্ববঙ্গ বা এখনকার বাংলাদেশ নয়। কারণ বাংলা ভাগ করেই কেবল পুর্ববঙ্গের চাষা প্রজারা নিজের মত শান্ত ও সন্তুষ্ট হয়েছে। অন্যথায় পুর্ববঙ্গের চাষা প্রজা কৃষকেরা হয়ত বিগত দুশ বছরের জমিদারি অত্যাচার উসুল করতে জয়ার ভিলেন বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোক এলিটদের  কলকাতা থেকেও তাদের উতখাত করত। অর্থাৎ বাংলা ভাগ না করার আর এক অর্থ হল, কলোনি ঔরসে বেড়ে চলা জমিদারির রুস্তমদের কলকাতা থেকেও উতখাত করে পুরা বাংলাকেই প্রজা কৃষকের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নেয়া।

কিন্তু তবু জয়া স্ববিরোধী। জয়া অন্তত একটা বড় স্ববিরোধ এড়াতে পারেন নাই। যেমন বইয়ের ভুমিকার প্রথম পৃষ্ঠাতেই জয়া লিখছেন,
“আদর্শ ও রাজনৈতিক আচরণের দিক থেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যকার সম্পর্ক জটিল এবং দুই বিপরীতধর্মী শক্তির একটি সংশ্লেষিত রূপ। সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন দাবি করা হয় যে ভারতের জাতীয়তাবাদকে সাম্প্রদায়িকতার ভিন্নরূপ গণ্য করা যায় না। সাম্প্রদায়িকতার বিপরীত ধারণা হল ধর্মনিরপেক্ষতা, যা ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করে দেয়। অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, এই অর্থে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অনেক কিছুই ধর্মনিরপেক্ষ নয়। জনসমর্থন পাওয়ার জন্য ধর্মীয় কল্পমূর্তি ও ইস্যুকে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনার সময় কৌশলে ব্যবহার করা হয়। …… এই জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করে যে, ভারতীয় সমাজের গোড়াতে রয়েছে ধর্মীয়ভাবে সংজ্ঞায়িত সম্প্রদায়”।

এখানে প্রথম বাক্যেই তিনি আবার তাঁর কল্পিত আদর্শের বিশুদ্ধ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নয় বরং তাকে ছেড়ে বাস্তবের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলছেন। বাস্তবের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর সহানুভুতি লক্ষ্যণীয়। অর্থাৎ এখানে তিনি আর তাঁর কল্পিত আদর্শের সাথে বাস্তবের দুরত্ব বা খুঁত মাপছেন না। এছাড়া এখানে এক নতুন ক্যাটাগরি সাম্প্রদায়িকতা ধারণার সুচনা ঘটাচ্ছেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না এই ক্যাটাগরি তাঁর বিচারের দিক থেকে এক নেগেটিভ ক্যাটাগরি। যার পজিটিভ ক্যাটাগরি করতে দেখা যায়, অসাম্প্রদায়িকতা । সাম্প্রদায়িকতা বলে একটা ক্যাটাগরি সুচনা করা এবং তা দিয়ে ফেনোমেনা ব্যাখ্যা করার পরিণতি সবসময় নতুন বিভ্রান্তি তৈরি করে। কারণ এই ক্যাটাগরির পিছনের ধারণা এবং ধারণার পিছনের অনুমানগুলোতে বিরাট অস্পষ্টতা আছে। সময়ে তা নিয়ে কথা তুলা যাবে। কিন্ত এখানে বাক্য রচনার গাথুনিতে এটা বুঝা যাচ্ছে যে, বাস্তব ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং ধরে নেয়া চরম নেগেটিভ ক্যাটাগরি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ – এই দুইয়ের “সংশ্লেষিত রূপ” জয়ার কাছে খুব একটা অনাকাঙ্খিত নয়। পরের বাক্যে সেটা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বলছেন, “ভারতের জাতীয়তাবাদকে সাম্প্রদায়িকতার ভিন্নরূপ গণ্য করা যায় না”। অর্থাৎ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতারই আর এক রূপ নয়। কথাটা সোজা করে বললে, জয়া এখানে এসে দাবি করছেন, বাস্তবের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তার চোখে কোন সাম্প্রদায়িকতা নয়। এই স্ববিরোধিতা কেন? একদিকে নিজেই বলছেন এটা জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সংশ্লেষিত রূপ। অন্যদিকে আবার সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কোন সাম্প্রদায়িকতা নয়।
এছাড়া এরপরের বাক্য আরও মারাত্মক – “সাম্প্রদায়িকতার বিপরীত ধারণা হল ধর্মনিরপেক্ষতা, যা ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করে দেয়”। মারাত্মক বলছি বাক্যের প্রথম অংশের জন্য নয়। ভুতুড়ে ক্লিশে “সাম্প্রদায়িকতা” এই ক্যাটাগরির পরে আর এক ভুতুড়ে ক্যাটাগরি তিনি এনেছেন – ধর্মনিরপেক্ষতা । এনে দুটোকে এক সাথে ইকুয়েট তিনি করেছেন সেটাও বড় বিষয় নয়। একালে কেউ নিজের ধর্মবিদ্বেষ, ইসলাম বিদ্বেষ ও ফোবিয়া লুকাতে নিজেকে “অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ” বলে আড়াল করছেন – এটা আজকাল আর বড় বিষয় নয়। বেখবর থেকে অবলীলায় করে এসব।   ইসলাম কারও পছন্দের বিষয় নাই হতে পারে। নিজের চায়ের কাপ তিনি নাও মনে করতেই পারেন। এটা ফেয়ার এনাফ। এটা কোন দোষেরও নয়। কিন্তু তাঁকে সতর্ক থাকতে হবে এই অপছন্দ তিনি ইসলামের বা এর অনুসারির বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে প্রকাশ করছেন কিনা। আর এক কিসিমের বর্ণবাদি হয়ে উঠছেন কি না। যাই হোক, তিনি দাবি করছেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যা নাকি ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করে দেয়”। এটা ধর্ম ও রাজনীতি যে কোনটাই বুঝে না এমন কারও বক্তব্য জয়া এখানে এনেছেন। তবে এটা বলার পর জয়া টের পেয়েছেন এই ফিল্টার মোতাবেক তাঁর প্রিয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদী দল কংগ্রেসও সাম্প্রদায়িক দল বলে চিহ্নিত ও আটকা পড়ে যাচ্ছে। তাঁর প্রিয় বললাম এজন্য যে ভুমিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় এসে জয়া পরিপুর্ণভাবে প্রকাশ্য স্ববিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েছেন। এবার তিনি প্রায় গায়ের জোরে কংগ্রেসকে তকমা দিচ্ছেন “অসাম্প্রদায়িক” দল বলে। আর মুসলিম লীগকে সাম্প্রদায়িক দল বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। যেমন ভুমিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠার শুরুতে লিখছেন,
“অধিকাংশ জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ জাতীয় পরিচিতির বর্ণনাকালে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী ব্যবহার করেছেন – যে দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন ভারতীয় মানে একজন হিন্দু। এ বিষয়টি বাঙলা প্রদেশের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ ও স্বামী বিবেকানন্দের রচনায় এবং তাদের অনুপ্রাণিত বিশেষ ধরণের “চরম” জাতীয়তাবাদে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এ জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা সত্যিকার অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না, ‘সাম্প্রদায়িক’ ছিল না”
পাঠকেরা শেষের বাক্য আর ঠিক এর আগের বাক্য লক্ষ্য করবেন। এখানে জয়া কেন কোন জাতীয়তাবাদকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে তকমা এটে দিচ্ছেন আর কাকে ‘সাম্প্রদায়িক’নয় বলে তকমা দিচ্ছেন এর নির্ণায়ক নিরপেক্ষ নয়। ফলে বুঝা মুসকিল।
আবার এর পরের বাক্যঃ
“জাতীয় আন্দোলনের মুলধারা পরিচালিত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। ঐ আন্দোলনে ধর্মকে ব্যবহার করা হয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের অনুভুতিকে জাগ্রত করার জন্য। অন্য দিকে, সাম্প্রদায়িক দল ও আদর্শসমুহ একটি সম্প্রদায়কে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ইউনিট হিসাবে অভিহিত করে, অন্য সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে এর ছিল চিরবৈরি সম্পর্ক”।
এখানে, প্রথম দুই বাক্যে বঙ্গভঙ্গ বা ১৯০৫ সালে বাংলার প্রথম ভাগ হওয়া ঠেকাতে হিন্দুদের “অনুশীলন” ও “যুগান্তর” নামে দুই সশস্ত্র জঙ্গিধারার আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে। জয়া তুলেছেন। ঐ “জঙ্গিধারা” এদের বক্তব্যের সারকথা ছিল, দেশকে মা কালী (দেশমাতৃকা) কল্পনা করে দেশের জন্য জীবন বলি দিতে অনুপ্রাণিত করা। আইডিয়াটা বাংলার হিন্দুদের “মা-কালীর” বা শক্তির পুজারী “শাক্ত ধারার” বয়ানের সারকথা থেকে নেয়া। অর্থাৎ হিন্দুদের “অনুশীলন” ও “যুগান্তর” নামে দুই সশস্ত্র জঙ্গিধারার এই আন্দোলনে “রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার” জয়া স্বীকার করছেন। ধর্মের ব্যবহার হওয়ায় জয়ার ক্রাইটিরিয়া অনুসারেই এটা সাম্প্রদায়িক আন্দোলন হয়, “ধর্মনিরপেক্ষ” আন্দোলন হয় না। কিন্তু তার পরেও আমরা দেখি জয়া এটাকে বরং “মানুষের অনুভুতি” জাগানো বলে ন্যায্যতার সাফাই দিচ্ছেন। কিন্তু পরক্ষণেই পরের বাক্যে মুসলিম লীগকে উদ্দেশ্য করে বলছেন – এরা সাম্প্রদায়িক দল।
১৯০৫ সালের বাংলা ভাগকে কেন্দ্র করে জয়ার বর্ণিত তিন লাইন দেখলাম। এখন এই পুরা ঘটনাটার ফ্যাক্টস হল, ঢাকাকে রাজধানী করে বাংলা-আসাম মিলিয়ে কার্জন সাহেবের নতুন ভাগ বিভাগকে পুর্ববঙ্গ নিজেদের পক্ষের সুযোগ হিসাবে দেখেছিল। এটাকে বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (এলিটদের) ক্ষমতা কর্তৃত্ব আর দাপট থেকে নিজেদের জন্য তুলনামূলক মুক্তির উপায় হিসাবে দেখেছিল। এজন্যই তারা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে। এখন কলোনি ঔরসের কলকাতায় বেড়ে উঠা জমিদারি ক্ষমতা কর্তৃত্ব আর দাপটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে যদি জয়া হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক কাজ মনে করেন এটা জয়ার ভুল এবং স্ববিরোধীতা অবশ্যই। জয়া নিজেই যে “হিন্দু ভদ্রলোকদেরকে” ভিলেন বানিয়েছেন, জয়া বলছেন এরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিল সে সময় থেকে। জয়া নিজেই বলেছেন, বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (এলিটদের) ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় তাঁরা সামাজিক অবস্থান অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে কূটকৌশল অবলম্বন করে এবং নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসাবে বিভিন্ন ভাবাদর্শকে (ideologies) ব্যবহার করে। সত্যিকার অর্থে ঐ কূটকৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়”।
তার মানে জয়া এবার নিজেই নিজের বিরোধিতা করছেন। আগে বলেছিলেন, দুবারই বাংলা ভাগের ফলে বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (এলিটদের) এতদিনের ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির মুখে পড়েছিল ফলে তাদের প্রতিক্রিয়াকে “সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়” বলেছিলেন জয়া। পুর্ববঙ্গের মুসলমানেরা তো এই এলিট ক্ষমতাকেই ভাঙ্গতে চাইছিলেন। ফলে বঙ্গভঙ্গকে নিজেদের পক্ষের সুযোগ হিসাবে দেখেছিলেন। এর মধ্যে ভুল কোথায়? অথচ বাংলা ভাগ শুনলেই জয়া একে “সাম্প্রদায়িক” কাজ বলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

জয়া চ্যাটার্জির সংকট হল, একদিকে তিনি বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (এলিটদের) ভিলেন ভুমিকা গবেষণায় আবিস্কার করেছেন। কিন্তু সমস্যা বেধেছে, আগে থেকে মাথায় থাকা আগাম এক চিন্তা ফ্রেমে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এসব বর্গ বা ক্যাটাগরিগুলোর ভিতর দিয়ে তিনি ভিলেন ভুমিকাকে ধরতে চাইছেন, ব্যাখ্যা করতে চাইছেন। অথচ এই চিন্তা ফ্রেম বহু আগে থেকেই বর্ণবাদী ফলে প্রশ্নবিদ্ধ। আবার কলোনি শাসন মানেই বিপরীতে কিছু করলে সেটা জাতীয়তাবাদ এমন আগাম মুখস্ত অনুমানের বদলে আগে জনগোষ্ঠির রাজনৈতিকতা বোধ, রাজনৈতিক কমিউনিটি, রাজনীতি ইত্যাদি ধারণাগুলোকে এক্সপ্লোর করা দরকার। এর আগে “জাতীয়তাবাদের” নামে কোন ধারণার পক্ষে ঝাপিয়ে পড়া অর্থহীন। এছাড়া মনে রাখতে হবে সব ধরণের জাতীয়তাবাদই সেকটোরিয়ান অর্থে সাম্প্রদায়িক এবং ভিন্ন জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ঘৃণা বিদ্বেষ অন্তরে পুষে রাখে।

[এই লেখাটার প্রথম ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের ঈদুল ফিতর জুলাই ২০১৫ সংখ্যায়। এখানে আরও সংযোজন ও এডিট করে আবার ছাপা হল। ঈদ সংখ্যাটার কোন অনলাইন ভার্সন ছিল না, কেবল প্রিন্ট ভার্সন। তাই প্রিন্ট ভার্সানের স্ক্যান কপি আগ্রহীরা এখানে দেখতে পারেন। এলেখার এডিট গত মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু নানান ব্যস্ততার ভিড়ে শেষ করতে পারি নাই। আজ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ শেষ করা হল। একারণে শিরোনামের লীংক এড্রেসের তারিখ “আগস্ট” দেখাচ্ছে।]

4 thoughts on “জয়া চ্যাটার্জির ভিলেনঃ বাঙলার ‘হিন্দু ভদ্রলোক এলিটদের’ নিয়ে তাঁর বিপদ

  1. আপনার অবজেক্টিভ দৃষ্টিভঙ্গি সপ্রশংস মনে লক্ষ করছি। সব বিষয়ে নিখুঁতভাবে (সেটা অন্যকারো লেখার প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য) একমত না হলেও, আপনার বিস্তৃত জ্ঞান, বিশ্লেষণ, ও যুক্তির কাছে সন্মান জানাতেই হয়।

    জয়া চ্যাটার্জি প্রসঙ্গে আপনার একটা মন্তব্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বলেছেন:

    “তার মানে হল জয়া দাবি করছেন, এই “হিন্দু ভদ্রলোকেরা” ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ মানে বাংলা ভাগ করতে বাধা দেয়ার পক্ষে কাজ করেছেন এবং কাজটা ঠিক করেন নাই। তিনি তাঁর লেখায় ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগ হওয়ার ব্যাপারটাকে বিষাদময় ঘটনা হিসাবেই দেখার চেষ্টা করছেন? আবার ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগটাকেও জয়া বিষাদময় ব্যাপার হিসাবে দেখেন। যেমন বইয়ের ভুমিকায় শুরুতে তিনি লিখছেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে ১৯৪৭ সালে বাঙলা আবার ভাগ হয়। কিন্তু এসময় প্রায় কারও কন্ঠেই প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হল না………”। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে কারও কন্ঠে অন্তত প্রতিবাদ আশা করছিলেন জয়া। এটাকে প্রতিবাদ করার মত ঘটনা হিসাবে দেখছেন জয়া। সোজা কথায় দেশভাগ বা বাংলা ভাগ ভাল নয় – জয়ার দাবি এটাই। এই চিন্তা প্রস্তাবের উপর দাঁড়িয়ে পুরা বইটা লেখা হয়েছে। তাঁর এই দেখা সঠিক অথবা বেঠিক তা নিয়ে তর্ক না তুলেও বলতে হয়, দেখার এই দৃষ্টিটা কোনভাবেই ওপার বাংলার, পূর্ববঙ্গের নয়। আর সঠিক-বেঠিক ছেড়ে ঘটনার সত্য দিকটা হল, সে সময় “পাকিস্তান আন্দোলনের” পক্ষের মানুষেরা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চলগুলোকে নিয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন। ফলে তাদের চোখে বাংলা ভাগ সবসময়ই কাম্য ছিল। আমরা পছন্দ করি আর নাই করি, ইতিহাসের সত্য হল, পুর্ববঙ্গের আপামর মুসলমান ১৯০৫ এবং ১৯৪৭ দুবারই বাংলা ভাগকে তাদের জন্য কাম্য হিসাবেই দেখেছিল। এই নিরেট বাস্তবতার খবর জয়া এই বই লেখার সময় বিবেচনায় নিয়েছেন এর প্রমাণ মিলে না।

    তাহলে জয়া যে আশা আকাঙ্ক্ষার উপর দাঁড়াচ্ছেন, দেশভাগ ব্যাপারটাকে দেখতে চাইছেন – সেটা “পাকিস্তান আন্দোলনের” মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গী নয়। আবার সে দৃষ্টিভঙ্গীটা দেশ ভাগের ভিলেন জয়ার ভাষায় “হিন্দু ভদ্রলোকেদেরও” নয়। তাহলে কাদের আশা আকাঙ্খার উপর জয়া দাঁড়াতে চাইছেন? দেশভাগ হওয়া সঠিক মনে করেন না এরা কারা?…”

    এ প্রসঙ্গে আমি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নীচের লেখা উল্লেখ করতে চাই।

    “… দেশভাগ না হলে আমরা কে কি হতাম সেটা অনুমাননির্ভর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে সময়ে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। কলকাতাতেও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, সেখানে না পারি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষক হতে পারতাম না এটা নিশ্চিত করে কে বলবে? অবিভক্ত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও অনেক বাড়তো। কে জানে তার কোনো একটাতে ঢুকে পড়তে পারতাম কি না। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হতে পারলেই যে জীবন ব্যর্থ হয়ে যেতো এটাই বা কেমন কথা?

    সাতচল্লিশের কাছাকাছি সময়ে প্রতিযোগিতায় আমরা কিন্তু খারাপ করছিলাম না। বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতায় সে সময়ে মুসলমানরাই ছিল; প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে মিলিত হয়ে যদি মন্ত্রিসভা গঠন করা হতো – সোহরাওয়ার্দী সে উদ্যোগ নিযেছিলেন, এমনকি ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গার পরেও’ – তাহলে দেশভাগ করাটা হয়তো অতোটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়াতো না। চাকরির ক্ষেত্রে এক ধরণের সংখ্যাসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছিল, আমাদের পিতারা আলোচনা করতেন যে একজন হিন্দু পদোন্নতি পেলে একজন মুসলমানকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছিল, আমার পিতার কলকাতায় আসার পেছনেও এই রকমের একটা ব্যাপার ছিল। আমাদের স্কুলেও তো দেখেছি, রাজশাহীতে তো বটেই, কলকাতাতেও বা হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমরা পাল্লা দেবার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছিলাম।

    … বাঙালি মুসলমান ছেচল্লিশে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই ভোট যে দেশভাগের পক্ষে চলে যাবে সেটা তো তারা ভাবেনি। দেশভাগের প্রশ্নে গণভোট হয়নি, হলে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যে বাংলাকে এক রাখার পক্ষে ভোট দিতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশভাগ না হলে আমরা প্রতিযোগিতায়, প্রতিদ্বন্ধিতায়, মেলামেশায় বড় হয়ে উঠতে পারতাম। আরও একটা বিষয় এই যে, পূর্ববঙ্গে এসে দেখা গেলো মাথার ওপর বসে গেছে অবাঙালি শাসক। কৃষকের ভাগ্য তো ফেরেইনি, মধ্যবিত্ত দেখলো যে এমনকি তার নিজের মুখের ভাষাটাও বিপন্ন। ঢাকায় ভ্রমণে এসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রথম বক্তৃতা, ১৯৪৮-এর মার্চে, পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলো যে, এই রাষ্ট্রে তার ভবিষ্যৎ মোটেই উজ্জল নয়; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সূত্রপাত তখন থেকেই। মধ্যবিত্তই তো প্রধান, পাকিস্তান আন্দোলন তো তারাই করেছে। তারা টের পেলো কলকাতা চলে গেছে, পশ্চিম বাংলা সঙ্গে নেই; এবার বাংলা ভাষাকেও হারাতে হবে, লাভের আশাটা মনে হলো খুবই অল্প। এই বোধটি ই জন্ম দিলো স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের, যে আন্দোলন পরে পরিণত হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনে॥”

    – সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী / দুই যাত্রায় এক যাত্রী ॥ [ জাগৃতি প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারী, ২০০৮ । পৃ: ৯৮-৯৯ ]

    Like

    1. প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও অন্য আরও অনেকের মত ভুল করছেন। তিনি বলছেন বলে আপনি কোট করেছেন,
      “সাতচল্লিশের কাছাকাছি সময়ে প্রতিযোগিতায় আমরা কিন্তু খারাপ করছিলাম না। বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতায় সে সময়ে মুসলমানরাই ছিল; প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে মিলিত হয়ে যদি মন্ত্রিসভা গঠন করা হতো – সোহরাওয়ার্দী সে উদ্যোগ নিযেছিলেন, এমনকি ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গার পরেও’ – তাহলে দেশভাগ করাটা হয়তো অতোটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়াতো না।” এই অনুমান ভুল। তিনিও দেশভাগ বা দেশভাগ পুর্ব সময়ের মূল বিতর্কটাই বুঝেন নাই। মূল বিতর্ক ছিল জমিদারির কী হবে? উচ্ছেদ হবে কীনা? জমিদার-প্রজা সম্পর্কের উচ্ছেদ হবে কী না। এখানে হন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ একমত হবে কী না? অথচ খোদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও এই দিকটা এড়িয়ে বাদ দিয়ে, অনুল্লেখ রেখে – এরপর হিন্দু মুসলমান এক হতে পারবে কীনা এর সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন।

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s