আসলে সে গ্রহীতা অথচ দাতার গুরুত্ব পাওয়ার জিদ ধরেছে
গৌতম দাস
২৩ আগস্ট ২০১৫
http://wp.me/p1sCvy-bb
ব্রিকস (BRICS) ব্যাংক উদ্যোক্তাদের এবছরের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত মাস ২০১৫ জুলাইয়ের ৯ ও ১০ তারিখে রাশিয়ার উফা শহরে। আমেরিকার নেতৃত্বে চলতি গ্লোবাল অর্থনীতি বা বিশ্বব্যাপী সক্রিয় পুঁজিতান্ত্রিক গ্লোবাল ব্যবস্থার ওপর ব্রিকস সদস্য অর্থে নিজেদের কর্তৃত্ব বাড়ানোর ও পালটা নেতৃত্ব কায়েমের লক্ষ্যে পাঁচ ‘রাইজিং ইকোনমি’র উদ্যোগে গঠিত সংগঠনের নাম ব্রিকস। ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা এভাবে প্রত্যেক রাষ্ট্রের ইংরেজি নামের আদ্যক্ষর থেকে এ নামকরণ। কিন্তু এর লক্ষ্য অনুসারে এপর্যন্ত কাজে তেমন অগ্রগতি ঘটেনি; বরং প্রয়োজনীয় মাত্রার সক্রিয়তার অভাবে বিরাট গ্যাপ আছে সত্য; কিন্তু জন্মের (২০০৯) পর থেকে ব্রিকস প্রতি বছর নিয়মিত তাদের বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন করে যাচ্ছে। ব্রিকস এবার সাত বছরে পড়ল। সে তুলনায় চীনের নেতৃত্বে পালটা বিশ্বব্যাংকের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ (AIIB, এআইআইবি) উদ্যোগ আইডিয়া হাজির করার পরে মাত্র ২ বছরেই প্রায় কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাজির হয়ে গেছে। আগামী বছর থেকে এ ব্যাংক পুরোদমে অপারেশনাল হয়ে যাবে। এআইআইবি (AIIB) ব্যাংক অবকাঠামো খাতে ঋণ দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান।
বলা যায়, ৭ বছর ধরে ব্রিকস নিয়ে চীনের নানান চেষ্টা চরিত্রের পরও অগ্রগতি কাঙ্খিত পর্যায়ে না পৌঁছানোর কারণে চীন হঠাৎ ব্রিকসের বাইরের বন্ধুদের সামনে আলাদা করে এআইআইবি ব্যাংক গড়ার প্রস্তাব হাজির করেছিল; এবং ২ বছর শেষ হওয়ার আগেই বাস্তবায়নের দিকে চলে যায়। ব্রিকস নিয়ে নানা বাধা তৈরি ও ওজর-আপত্তি তুলে ব্যাংকটিকে কার্যকর করার কাজ ধীরগতি করার পেছনে ভারতের অবদান বেশি। এর পিছনে ভারতের নীতি নির্ধারক দ্বিধা ও থিঙ্ক-ট্যাংক জাতীয় পরামর্শকদের ভুল পরামর্শ ও বিভ্রান্তি এবং সর্বপরি ভারতের নিজের সম্পর্কে অতি-মুল্যায়ন এবং আমেরিকান-পো ধরার চেষ্টা, আমেরিকান প্রভাব ইত্যাদি দায়ী। এ প্রসঙ্গে দুইটি প্রশ্ন নিয়ে এখানে আলোচনা করব। এক. ভারতের ওজর-আপত্তির অজুহাতগুলো কী ধরনের এবং কেন? ভারত কেন ব্রিকসের প্রশ্নে ওজর-আপত্তির পথে হাঁটছে কিংবা ব্যাংকটিকে এখনও নিজের জন্য প্রয়োজনীয় ও সঠিক মনে করছে না- এসব নিয়ে আলোচনা করা। কথাগুলো ব্রিকস বাস্তবায়নের পথের সমস্যা শিরোনাম দিয়েও আলোচনা করা। দুই. এআইআইবি ব্যাংক অপারেশনাল করার জন্য গঠন কাঠামো, আর্টিকেল অনুমোদন সম্পন্ন হয়ে গেছে; অর্থাৎ এআইআইবি ব্যাংক অবকাঠামো খাতে ঋণ দেয়ার ব্যাংক হিসেবে চালু করার পর্যায়ে চলে যাওয়ার পরও এবারের ব্রিকস সম্মেলন আরেক অবকাঠামো ব্যাংক, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা সংক্ষেপে এনডিবি (NDB) চালু করার সিদ্ধান্ত নিল কেন? অর্থাৎ একসাথে দুদুটো অবকাঠামো ব্যাংক উদ্যোগ কেন?
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থার ৭০ বছর
দুনিয়ায় পুঁজিতন্ত্রের বয়স প্রায় ৫০০ বছর। এ সময়ের মধ্যেই এর উত্থান, আন্তঃসম্পর্কিতভাবে দুনিয়াব্যাপী বিস্তার এবং পুঁজির অন্তর্নিহিত লজিক অনুযায়ী বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বর্তমানে এটা গ্লোবাল ফেনোমেনা হয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই ৫০০ বছরের মধ্যে চলতি শেষ পর্যায়ের মাত্র ৭০ বছর বাদ দিলে বাকি আগের পুরো সময়টাতে (১৯৪৪ সালের আগের প্রায় ৪৩০ বছর কাল পর্যন্ত) ব্যাংক বা টাকার ব্যবসার উত্থান ও বিকাশ ঘটেছে তথাকথিত প্রাইভেট সেক্টরে, রাষ্ট্রের মালিকানার বাইরে। অর্থাৎ জন্মের শুরু থেকে ক্যাপিটালিজম কলোনি যুগের বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ বা সহায়তা ছাড়া চলতে সক্ষম হয়েছিল। ক্যাপিটালিজমের কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও ছিল না। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৪ সালে প্রথম দুইটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় বা মাল্টিল্যাটারাল প্রতিষ্ঠান আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক গড়ে তোলা হয়। এটাই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রথম রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বা বলা যায়, আমেরিকার নেতৃত্বে রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপ। আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়া, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম গড়ে তোলা। যদিও এর মূল উদ্দেশ্য বা তাগিদ ছিল দুনিয়াব্যাপী সবার জন্য এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা কায়েম করা। যে কোনো বাণিজ্য বিনিময় ঘটার পূর্বশর্ত হলো সকল রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য এক মুদ্রা চালু থাকা এবং ওই মুদ্রার মান নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির মাধ্যমে ঐ আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা হাজির থাকা। ফলে আন্তর্জাতিক এক বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থা কায়েম চাওয়া মানেই সেটা আসলে আগে এক আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা কায়েম করার কাজ হাতে নেয়া। তৎকালে বাণিজ্যের দিক থেকে একমাত্র উদ্বৃত্ত অর্থনীতির রাষ্ট্র ছিল আমেরিকা। ফলে আমেরিকার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে তার জাতীয় মুদ্রা ডলারকে একইসঙ্গে সব রাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেরও মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক গড়ে তোলা হয়। দুনিয়ায় এ প্রথম সংগঠিতভাবে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থা কায়েম করে।
পুরানার বিশ্বব্যবস্থার গর্ভে নতুন ব্যবস্থার আগমন
মোটা দাগে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসে রাষ্ট্রের সঙ্গে এ ব্যবস্থার সম্পর্কের বিচারে তিনটি পর্যায় আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত, মধ্যযুগ থেকে ১৯৪৪ সালের আগ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই আজকের তুলনায় হয়তো সীমিতভাবে বিকশিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এটাকে “কলোনি ক্যাপিটালিজমের” হাতে বিকশিত বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থাও বলা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ১৯৪৪ সাল থেকে চলতি সাল পর্যন্ত আমেরিকান রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে কায়েম করে গড়ে তোলা (সেকালে) নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা- পণ্য গ্লোবাল বাণিজ্য বিনিময়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলা যায়। আমেরিকান প্রভাবের এই ব্যবস্থাটা যেটা এখনও চলতি তবে পড়তি অবস্থা, তা এখন ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। আর তৃতীয়ত, মোটামুটি চলতি শতকের শুরু থেকে আমেরিকান নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জায়গায় চীনের নেতৃত্বে পুরনো ব্যবস্থাটার পুনর্গঠন করে নেয়ার উদ্যোগ – আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো নতুন ধরনের পালটা প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব। চলতি সময়টায় একটা গেম চেঞ্জিংয়ের কাল পার হচ্ছি আমরা। একালে এতে ভারতের গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে, পুরনো নেতা আমেরিকা কিংবা হবু নেতা চীন- উভয়ের কাছেই। গুরুত্বটা হলো, ভারত আমেরিকার কোলে বসে পুরনো ব্যবস্থার ভাঙন ঠেকিয়ে আরও কিছু দিন চলতি ব্যবস্থার আয়ু বৃদ্ধি করতে সহায়তা করা হতে পারে, একে আরও যতদিন আয়ু দেয়া যায় আমেরিকার প্রভাব তত বেশি দিন বাড়ে। আর এর বিনিময়ে আমেরিকার কাছ থেকে সুবিধা শুষে নেয়ার কাজে লাগা। তবে মনে রাখতে হবে, এ কম্ম সাময়িক লাভালাভের জন্য এবং এটা নিজের আগামীর বিরুদ্ধে কুড়াল মারাও হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে এর বিপরীত পথ হচ্ছে, চীনের পাশে দাঁড়িয়ে ভারত নিজের জন্য নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়তে ত্বরান্বিত হয়ে কাজে লেগে পড়তে পারে। তবে উভয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারতের এমন গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে মূল কারণ ভারতের বিশাল জনসংখ্যা। অর্থনীতির দৃষ্টির ভাষায় বলতে হবে, যত জনসংখ্যা তত জোড়া মুখ এবং হাত; এবং ততই বড় অভ্যন্তরীণ বাজার এবং শ্রম।
এটা এখন নির্ধারিত যে, চীন ও ভারতের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গন্তব্য এক সূত্রে বাঁধা হয়ে গেছে- এখানে তারা উভয়ে ন্যাচারাল অ্যালায়েন্সের অ্যালাই। পুরনো গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নতুন ব্যবস্থা খাড়া করতে পারার মধ্যেই তাদের আগামী নির্ভরশীল। কিন্তু নতুন ব্যবস্থার ভেতরে চীন কতটা গুরুত্ব দিয়ে ভারতকে জায়গা ছেড়ে দেবে তা সবটা ভারতের দাবি জানিয়ে আদায় করার বিষয় নয়। নতুন ব্যবস্থায় ভারত চীনের কাছে কী কী দাবি করবে সেসবের সঙ্গে ভারতের অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সঞ্চয় ও অর্জিত সক্ষমতার সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে হবে।
ব্রিকসঃ একের ভিতর দুই কাজের ভুমিকায়
একই ব্রিকস উদ্যোগের মধ্যে আসলে দুইটা পালটা প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ আছে – একটি আইএমএফের সমতুল্য পাল্টা প্রতিষ্ঠান, অন্যটি বিশ্বব্যাংকের। ভারতের মূল যে প্রস্তাবের কারণে ব্রিকস অগ্রগতি আটকে বাধাগ্রস্ত বা শ্লথ হয়ে আছে তা হল, এখানে পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রের সকলের সমান পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়েই শুধু প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অসম সক্ষমতার বাস্তবতায় থাকলেও কাউকে বেশি বিনিয়োগ করতে দিয়ে প্রতিষ্ঠান খাড়া করা যাবে না। ভারতের এ ওজর-আপত্তিতে পড়ে পরিশেষে ব্রিকস উদ্যোগের বিশ্বব্যাংকের সমতুল্য অবকাঠামো ব্যাংক নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা সংক্ষেপে NDB (এনডিবি) কার্যকর হতে যাচ্ছে পাঁচ সদস্যের প্রত্যেকের সমান ১০ বিলিয়ন করে মোট ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে। অনেকের মনে হতে পারে, সদস্যদের সমান বিনিয়োগ থাকাই সঠিক। কিন্তু আসলে এমন চিন্তা অহেতুক ও অর্থহীন। ঈর্ষাকাতর সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা বলা যেতে পারে। এগুলো দিয়ে কারও প্রভাবশালী উত্থান আসন্ন হলে তা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। যেমন আজ চীনের উত্থান কি আমেরিকা ঠেকিয়ে রাখতে পারছে, না রাখা সম্ভব হয়েছে। ভারতের অর্থনীতি নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ওই ১০ বিলিয়ন ডলার কাউকে না দিয়ে নিজ নিজ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করলেই তো পারত। তা না করে NDB প্রতিষ্ঠানের নামে তা জড়ো করার কারণ এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার একটি কমন স্বার্থ ওই পাঁচ রাষ্ট্রের সবার আছে। সেটা হল, ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরনো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বা বাইরে নিজেদের কর্তৃত্ব বাড়ানো। এখন ‘বিনিয়োগে সবার সমান ভাগ থাকতে হবে’ এই নীতি মানতে গেলে নতুন অর্জিত ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র থেকে যাবেই। অবকাঠামো ব্যাংক হিসাবে এই পুঁজি খুবই অল্প। আর এমন থেকে যাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাংকের চেয়ে বড় প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান এর হওয়া সম্ভব নয়। অথচ সেটাই ছিল নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গড়ার প্রধান তাগিদ।
যেমন বিশ্বব্যাংকের বর্তমানে মোট বিনিয়োগ সক্ষমতা ৩০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, এডিবির ১৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর তুলনায় “সবার সমান বিনিয়োগ হতে হবে” এ জেদাজেদিতে সবার ১০ বিলিয়ন ডলার করে ৫০ বিলিয়ন ডলারের ব্রিকসের এনডিবি ব্যাংক কতটা প্রভাবশালী হবে বলাই বাহুল্য এবং তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এছাড়া মূলকথা, ভারত অন্য রাষ্ট্রকে অবকাঠামো বিনিয়োগ দাতা এখনও নয়, বরং নিজেই গ্রহীতার দেশ। ফলে এ পর্যায়ে ভারতের ‘সমান বিনিয়োগ’ তত্ত্ব ও অবস্থানের সারার্থ হচ্ছে, ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতার মাপে নামিয়ে সবার সমান বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান গড়া। মানে এনডিবি ব্যাংককে বামন করে রাখা। ফলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী কিছুই এটা হতে না দেয়া।
ভারতের ‘সমান বিনিয়োগ’ অবস্থানঃ এক ভুয়া ও অর্থহীন তত্ত্ব
ওদিকে ভারতের ‘সমান বিনিয়োগ’ অবস্থান যে ভুয়া ও অর্থহীন এর আর এক বড় প্রমাণ হলো ব্রিকস উদ্যোগের অপর কম্পোনেন্ট, যেটা আইএমএফের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে তৎপরতা বলেছি সেদিকে তাকালে। [এখনও এটা পুরা আকার নেয় নাই ফলে নাম এখনও নাই। ব্রিকস উদ্যোগের ভিতরে আপাতত ভ্রুন প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক গাঠনিক পর্যায়ে আছে বাড়ছে যার আপাত নাম “নয়া আইএমএফ” মনে করে নেয়া যেতে পারে।] ব্রিকসের ‘সমান বিনিয়োগের’ এনডিবি ব্যাংক ছাড়াও হবু “নয়া আইএমএফ” এর জন্য আর একটি ফান্ড তৈরি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্যে কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে তার নিজের বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি পরিস্থিতিতে তা মেটাতে সহায়তা করা। এত দিন দুনিয়ায় এ ধরনের সহায়তা বিতরণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল আইএমএফ। ব্রিকস উদ্যোগে এমন ফান্ড মোট ১০০ বিলিয়ন ডলারের। কিন্তু এক্ষেত্রে সদস্যরা চাঁদা দেবে অসমভাবে। চীন একাই ৪১ বিলিয়ন, সাউথ আফ্রিকা সবচেয়ে কম মাত্র ৫ বিলিয়ন আর ভারতসহ বাকি তিন সদস্য রাষ্ট্র প্রত্যেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার করে- এভাবে মোট ১০০ বিলিয়ন ডলার। তাহলে স্বভাবতই এখানে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এই ফান্ড সংগ্রহের বেলায় তা অসম রাখার ন্যায্যতা কী? কেন এখানেও ভারত চীনের সমান অবদান চাঁদা দিচ্ছে না? অর্থাৎ ভারত এখানে নিজেরই ‘সমান মালিকানা তত্ত্বের’ পক্ষে নিজেই দাঁড়াচ্ছে না কেন?
নীতি কথার মানে হল, যে অবস্থানটা সবখানে ইউনিফর্মভাবে প্রয়োগ করা হবে। দেখা যাচ্ছে ভারতের কোন সুনির্দিষ্ট নীতি অবস্থান নাই, ফলে প্রয়োগে ইউনিফর্মিটি নাই। এই অবস্থা কে বলা যায় ভারতের সিরিয়াসনেসের ঘাটতি আছে, ঘাটতিজাত সমস্যা আছে। ভারতের নীতি নির্ধারকেরা এটা বুদ্ধিমানের অবস্থান মনে করে। কারণ এটা অজান্তে দোদুল্যমানতা নয়। জেনেশুনে দোদুল্যমান থাকা। ব্রিকসের ভিতরেই থাকা ছেড়ে না যাওয়া। কারণ একমাত্র এভাবে সে ব্রিকস উদ্যোগকে আটকে শ্লথ করে রাখতে পারে। আর এই সার্ভিসটা আমেরিকান রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে লাগে বলে আমেরিকার সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিতর সেখান থেকে বিনিময়ে বাড়তি সুবিধা আদায় করা। ভারতের এই দ্বৈত ঝোঁকের কারণেই চীন হঠাত করে নিজের ঝুলি থেকে আচমকা ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ (AIIB, এআইআইবি) এর প্রস্তাব হাজির করে ২০১৪ সালে আর আগামি বছর ২০১৬ থেকে কার্যকর করে ফেলতে যাচ্ছে। ব্যাপারটা হয়েছে এমনভাবে যে চীন একাই প্রস্তাব করেছে আর ইউরোপসহ [এবং বলা বাহুল্য ভারতও] সকলে ঐ প্রস্তাবের পিছনে পিছনে ছুটেছে হা বলার জন্য। অর্থাৎ এটা প্রমানিত হয়েছে যে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তা ও প্রস্তাব করার ব্যাপারে চীন যেভাবে আগাতে চায় তা ঠেকানোর ক্ষমতা ভারত কেন ইউরোপেরও নাই। নাই এজন্য যে বিষয়টা চীনা নেতৃত্বের কোন খামখেয়ালিপনার ইচ্ছা নয়, বিষয়টা হল এক অবজেকটিভ বাস্তবতা – চীনের অর্জিত অর্থনৈতিক সক্ষমতা।
ভারতের সিদ্ধান্তের অর্থ তাতপর্য
আর ভারতের দিক থেকে দেখলে এটা তার শর্ট সাইটনেস, সংকীর্ণ দৃষ্টি অর্থাৎ আপাত নগদ লাভের দিকে প্রলুব্ধ হয়ে চলা, আর সেই সাথে নিজের আগামি লংটার্ম স্বার্থের পায়ে কুড়াল মারা। চীনের সাথে ইতিবাচক নয়, আগামির এলাই নয়, ঈর্ষাবাচক প্রতিযোগিতার চোখে পরিস্থিতিকে দেখা। অথচ বাস্তব ফ্যাকটস হলো, চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা হল ১৭ ট্রিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের ওপর দাঁড়ানো এক অর্থনীতি। এটা এখন দুনিয়ার সর্বোচ্চ। সেজন্য চীন যে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে এর প্রতি ঈর্ষামূলক অবস্থান নেয়া অর্থহীন, কারণ বিষয়টা ঈর্ষা করা নয়। বরং প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই নিজের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেয়াটাই উপযুক্ত পথ, ঈর্ষা নয়। এছাড়া নিজের ওপর আস্থা রাখা উচিত যে, কালক্রমে ভারত রাষ্ট্রের যেটুক অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জিত হচ্ছে, হয়েছে; কিন্তু তা অর্জনের পরও আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো ফোরামে সমতুল্য গুরুত্ব ও জায়গা যদি অন্যরা তাকে না দেয় তবে পালটা আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান, ব্রিকস বা AIIB হাজির হবে- ভারত তৈরি করবেই। সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। বাস্তব অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জিত হলে অন্যেরা কেউ চাইলেই ভারতকে বঞ্চিত রাখতে পারবে না। কাজেই ঈর্ষা, সন্দেহ এগুলো কোনো পথ বা কাজের কথা নয়। তবে সংকীর্ণ দৃষ্টির ভারতের নীতিনির্ধারকদের ধারণা যেহেতু নিজের ন্যাচারাল ভবিষ্যতের পথে চীনের সঙ্গে নতুন উদ্যোগে শামিল হতে ঢিলেঢালা, গড়িমসি দেখালে আমেরিকার দিকে ঝুঁকার ভয় দেখিয়ে চীনকে চাপে রাখার সুযোগ আছে, তাই সেটা নেয়া উচিত। এর অর্থ নিজের যেটুকু গুরুত্ব মূল্য পাওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি যেন সে পেতে পারে এমন আবদারে তা পাওয়ার জন্য অযথা ঝুলাঝুলি করা। এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে তা ভারতের জন্য আত্মঘাতী ফল বয়ে আনতে পারে। ব্রিকস উদ্যোগ এত দিন কার্যকর প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি ভারতের এসব ওজর-আপত্তির কারণে।
ভারত-চীনের সামরিক স্বার্থ বিষয়ক টেনশন আছে এটা বাস্তবতা। এর বড় কারণ মার্ক করা বা চিহ্নিত করা হয় নাই এমন বিস্তৃর্ণ কমন রাষ্ট্র সীমান্ত তাদের আছে। বিগত ১৯৬২ সালে চীনের কাছে যুদ্ধে হেরে যাবার খারাপবোধ, ট্রমা আছে। এছাড়া চলতি সময়ে অসম সামরিক সক্ষমতার বাস্তবতা এখানে আছে। এরপরেও এগুলোই একমাত্র বাস্তবতা নয়। কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকে আবার উলটা চীনের থেকে সহযোগিতা পাবার (অবকাঠামো ঋণ, আমদানি ব্যবসার বাজার পণ্য ও কাঁচামাল) নেবার স্বার্থ ভারতের আছে। অথচ সবকিছু মিলিয়ে দেখলে অন্তত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অহেতুক চীনভীতি ছড়ানোর চেষ্টা ভারতের মানায় না, কারণ এটা কাউন্টার প্রডাকটিভ। যেমন ব্রিকস উদ্যোগের NDB ব্যাংক গড়ার ক্ষেত্রে ভারত শর্ত দেয় প্রথম ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট ভারতের হতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এভাবে শর্ত রাখা হয়েছে যে, রোটেশনে চীনের সুযোগ আসবে সবার শেষে, মানে ২০ বছর পর। ফলে আগামী দুই দশক চীন এই এনডিবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই চীনভীতি অহেতুক। তবু চীন তাতেই রাজি হয়েছে। আর ভারতের প্রস্তাবিত ও মনোনীত ব্যক্তি কে ভি কামাথ এনডিবি ব্যাংকের প্রথম প্রেসিডেন্ট করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে চীনের আরও কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা-ও জানা যাচ্ছে।
ব্রিকস উদ্যোগের মূল আইডিয়ার মধ্যে চীন বিশ্বব্যাংক সমতুল্য প্রতিষ্ঠান গড়ার আইডিয়াকে আপাতত ব্রিকসের ভেতরে সীমিতভাবে এবং ব্রিকসের বাইরেও পূর্ণভাবে- দুই জায়গাতেই বাস্তবায়ন করার পথে রওনা হয়েছে। দৃশ্যত তাই দেখা যাচ্ছে। ব্রিকসের ভেতরের অবকাঠামো ব্যাংকের নাম এনডিবি ব্যাংক। আর এউদ্যোগের বাইরের আরও পূর্ণভাবে ব্যাপক পরিসরে অবকাঠামো ব্যাংকের নাম এআইআইবি (AIIB) ব্যাংক। ভারতের খায়েশ ও চীনের প্রতি অর্থহীন সন্দেহ অনুসরণ করে ব্রিকসকে সে নিজের অর্থনৈতিক সক্ষমতার মাপে বামন রাখতে চায়। অথচ ব্রিকস উদ্যোগের মূল লক্ষ্যই হল, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পালটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে গ্লোবাল অর্থনীতির ওপর আমেরিকার বদলে নিজেদের নতুন কর্তৃত্ব লাভ করা। অর্থাৎ এ দুই অবস্থান স্ববিরোধী। আর ভারত এই স্ববিরোধী অবস্থানের উদ্গাতা। এ স্ববিরোধিতা কাটতে পারে একমাত্র, ভারত যদি ব্রিকস উদ্যোগের সাফল্যের ভেতর নিজেকে গ্লোবাল নতুন কর্তৃত্বে চীনের সঙ্গে বড় অংশীদারিত্বে নিজেকে দেখতে চায় তবে, তা সম্ভব একমাত্র চীনের বড় ভূমিকা এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই।
এখান থেকে ভারতের জন্য শিক্ষা হল,
১। বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী একটা অবকাঠামো ব্যাংক গড়ার উদ্যোগ যেটা শেষে AIIB নামে বাস্তবায়িত হল – শেষ পর্যন্ত এমন ঘটনাগুলো ঠেকানোর ক্ষমতা ভারতের নাই, সম্ভব হয় নাই। কারণ এটা সম্ভব নয়। ঠেকানোর চেষ্টাটাও আসলে ভারতের স্বার্থে যায় নাই। ২। গত সাত বছর ধরে এটা ঠেকিয়ে রেখে কি ভারতের লাভ হয়েছিল না কি এখন AIIB হাজির হওয়াতে ভারতের স্বার্থ বেশি আছে তাতে? AIIB ব্যাংক আগে বাস্তবায়িত হলে কি ভারতের জন্য তা বেশি ভাল হত না! আবার চীনের সাথে পক্ষে সক্রিয় থাকলে ব্রিকস উদ্যোগের অধীনেই AIIB ব্যাংক হাজির হত। তাতে বর্তমানের চেয়েও AIIB এর উপর ভারত ব্রিকসের মাধ্যমে বেশি কর্তৃত্ব লাভ করতে পারত। সেটা সে এখন হারাল। তাহলে ভারত আমেরিকার প্ররোচনায় এতদিন কার পক্ষে কাজ করল? কি লাভ করল? এসব নিয়ে তার অবিলম্বে মুল্যায়নে বসা উচিত।
বিরোধে না জড়ানো বুদ্ধিমান চীন
তবে মজার দিকটা হল, ভারতের এ স্ববিরোধিতার মুখেও চীন তাকে ত্যাগ করেনি। অথবা ব্রিকস উদ্যোগকে চীন স্থবির বা গুটিয়ে ফেলেনি। বুদ্ধিমান ও ইতিবাচকভাবে ভারতকে নাড়াচাড়া মোকাবিলা করেছে। তবে দেখিয়েছে, চীন একা নিজ উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী মূল অবকাঠামো ব্যাংক গড়তে সমর্থ। তাই মাত্র ২ বছরের মধ্যে এআইআইবি ব্যাংক কার্যকর হতে যাচ্ছে। কিন্তু ভারতের স্ববিরোধী ও দোদুল্যমানতার কারণে চীন আর ব্রিকস উদ্যোগের ভেতরে রেখে এআইআইবি ব্যাংক কার্যকর করার পথে যায়নি আপাতত। এর অর্থ হলো, ভারতের নির্বুদ্ধিতার জন্য চীন এআইআইবি ব্যাংক আপাতত ব্রিকস উদ্যোগের বাইরে নিয়ে রাখল। স্বভাবতই এতে ভারতের ক্ষতি ছাড়া কোনোই লাভ হয়নি। বরং এভাবে হওয়াতে এআইআইবি ব্যাংকের বাস্তবায়নের উপর চীনের একার বক্তব্যের ওজন সবচেয়ে বেশি। এমনকি ব্রিকস উদ্যোগের ভেতরের এনডিবি ব্যাংকের উপর নিজের প্রভাবের চেয়ে তা বেশি। ফলে সমান বিনিয়োগের গোঁ ধরে ভারতেরই ক্ষতি হল। যদিও এনডিবি ব্যাংকের প্রথম প্রেসিডেন্ট কামাথ বলছেন, এআইআইবি ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় এনডিবি ব্যাংক রেখে কাজ করবে।
এনডিবি ব্যাংক চেয়ারম্যান আরও বলছেন, তারা শুরুতে শুধু পাঁচ ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখবে। এটাও কথার কথা। কারণ ব্রিকসের ভিতরে বাস্তবে অবকাঠামো ঋণ পাওয়ার দরকার আছে, প্রথমত ভারত আর ব্রাজিলের। বাকিরা দাতা অথবা ঋণ কাজে লাগানোর উপযোগী অর্থনীতির রাষ্ট্র নয়। এর মানে দাঁড়াল, আপাতত যেন ভারত শুধু নিজের জন্য ব্যবহার করবে এনডিবি ব্যাংককে। অর্থাৎ ভারত কী চাচ্ছে আর তা পেয়ে ভারতের কী লাভ হচ্ছে – এসবের কোনো ঠায়ঠিকানা ভারত মিলাতে দেখাতে পারছে না। তবু নানান ওজর-আপত্তি তুলতে দেখছি আমরা ভারতকে।
আসলে মূল স্ববিরোধী কঠিন বাস্তবতা হল, ভারত মূলত ঋণগ্রহীতা; কিন্তু সে ঋণদাতার ভূমিকা ও গুরুত্ব পাওয়ার জন্য জিদ ধরেছে।
[এই লেখাটা এর আগে আগষ্ট ২, ২০১৫ তারিখে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় কিছুটা সংক্ষিপ্তভাবে ছাপা হয়েছিল। পরে সে লেখাটাই আরও বিস্তার করে এবং সম্পাদনা করে এখানে এখন ছাপা হল।]