“মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং জামাত-মুক্ত বিএনপির” রাজনীতি


“মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং জামাত-মুক্ত বিএনপির” রাজনীতি
গৌতম দাস
২৬ আগষ্ট ২০১৫
http://wp.me/p1sCvy-bf

গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে সফরের পর দেশের সরকার বা বিরোধী দল অথবা কোন বিদেশী কূটনীতিক কেউ দায়িত্ব নিয়ে বলেনি নরেন্দ্র মোদি কী মেসেজ রেখে গেলেন। কিন্তু কানাঘুষা,আর অনুষঙ্গী ঘটনাবলিতে ক্ষমতাসীনদের আচরণ বক্তব্য থেকে দিনে দিনে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, মোদি-হাসিনা এবং মোদি-খালেদা আলোচনায় একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয় ইস্যু হিসাবে উঠেছিল। অনুমানে ধরে নেয়া এই আলোচনার পক্ষে সাক্ষ্য দেয় এমন দু’টি শব্দ এরপর থেকে রাজনৈতিক মহলে প্রচলিত হয়ে উঠতে দেখা যায় – “মধ্যবর্তী নির্বাচন” এবং “জামায়াতমুক্ত বিএনপি”। এই ব্যাপারটাকে উল্টো করে বলা যায় যে, “মধ্যবর্তী নির্বাচন” এবং “জামায়াতমুক্ত বিএনপি” এই দু’টি বাক্য চালু হওয়া থেকে বোঝা যায় মোদির সফরে নির্বাচন বিষয়ে একটা ইস্যু সেখানে উঠেছিল। আর একটু স্পষ্ট করে বলা যায়, নির্বাচন বিষয়ে অনুমান করা ঐ আলাপের সারকথা সম্ভবত এরকম যে, “সকলকে নিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা দরকার কারণ রাজনৈতিক সঙ্কট এভাবে ফেলে রাখাটা আমাদের সবার জন্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে”। মোদির সফর- উত্তরকালে মোদির এই মেসেজের অর্থ কী অথবা কেমনে কী অর্থ দাঁড়িয়ে যায় সেসব সম্ভাবনার আগেই সম্ভবত শেখ হাসিনার সরকার এবং ভারতের আমলা-গোয়েন্দারা নিজেই এর অর্থ নিজের মত করে সাজানো শুরু করে দেয়। সে অর্থটাই সম্ভবত “মধ্যবর্তী নির্বাচন” এবং “জামায়াতমুক্ত বিএনপি” এই দু’টি বাক্য চালু করেছে। তবে এথেকে “মধ্যবর্তী নির্বাচন” কথাটার অর্থ কমবেশি সহজে বোঝা যায় কিন্তু “জামায়াতমুক্ত বিএনপি” কথাগুলোর অর্থ তাৎপর্য কী?

এখানে তামাশার দিকটা হল, বিএনপির রাজনীতি কেমন হবে জামায়াত ছাড়া না জামায়াত সহ এই শর্ত আওয়ামী লীগের মুখ থেকে আসছে। এক্ষেত্রে এমন একটা ভাব তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে যেন এখানে আওয়ামী লীগ দাতা আর বিএনপি গ্রহীতা। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপির ক্ষমতাদাতা নয়। আওয়ামি লীগ নিজে বড়জোর নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে আবার নিজের মত করে একটা নির্বাচন দিতে পারে, তাই নয় কি? কারণ এটা কারো না বুঝতে পারার কারণ নেই যে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অনেক কিছু হয়ত দিতে পারে কিন্তু এর পরেও যা কখনই দিতে পারে না তা হল ক্ষমতা। আর যাই হোক, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ক্ষমতাদাতা হতে পারে না। হওয়ার কথাও নয়।
তবু এই সরল কথাটা আড়াল করে একটা ভাব ছড়ানো হয়েছে যেন এক শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমতাসীন সরকার বিএনপির ক্ষমতাদাতা হতেও পারে। কি শর্তে? যে, বিএনপি যদি জামাতমুক্ত হয় তবে যেন সে লীগের কাছে থেকে ক্ষমতাও পেয়ে যেতে পারে! তাই আওয়ামি লীগ এখান থেকেই বিএনপিকে নির্দেশদাতা হবার ভান ধরেছে, বলছে যে জামাতমুক্ত হয়ে যাও তুমি!

এ’এক সত্যি বিরাট তামশা। শুধু তাই না। এছারা এখানে এভাবে আর একটা ইঙ্গিত তৈরি করা হয়েছে যেন ৫ জানুয়ারিতে কোনো নির্বাচন না করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এর পক্ষে সাফাই দিচ্ছে এমন যেন নেহায়ত বাধ্য হয়ে ৫ জানুয়ারিতে কোনো নির্বাচন না করা সত্ত্বেও আওয়ামি লীগ নিজেকে বৈধ সরকার বলে দাবি করেছে। যেমন, লীগের হস্তক্ষেপ ছাড়া একটা ফেয়ার নির্বাচন হলে তাতে বিএনপি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসে পড়লেও যেন আওয়ামী লীগের আপত্তি ছিল না,থাকত না। কিন্তু লীগের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে এজন্য যে, ওই নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতযুক্ত থেকে যাবার কারণে সহযোগী জামায়াত ক্ষমতায় চলে আসবে আর কেবল ঠিক এখানেই আওয়ামী লীগের আপত্তি। জামাত ঠেকানোর মহান কর্তব্য সম্পন্ন করার জন্যই যেনবা জবরদস্তিতে আওয়ামি লীগ নির্বাচন না হতে দিয়েও নিজেকে নির্বাচিত দাবি করছে! তাই কী? আওয়ামী লীগের এমন সাফাই, এমন ইঙ্গিত অবশ্য কেউই বিশ্বাস করে না, এমনকি তারা নিজেরাও না। এটা যে ছলনামূলক মিথ্যা কথা, কেউ বিশ্বাস করবে না জেনেও মুখরক্ষার জন্য বলা কথা তা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সবাই জানে, মানে। তবু তাদের এই কথা বলা ছাড়া মুখরক্ষার সাফাই হিসেবে আর কিছু বলার নেই। এই হল, “জামাতমুক্ত বিএনপি দেখতে চাওয়া” আওয়ামি লীগের আবদারের সারকথা।
তবে এ বিষয়ে আরও করুণ অবস্থা ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের। গত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের আগের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেখানেও হবু নির্বাচনের পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়ানো এবং এরশাদকেও হবু নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য যে যুক্তি তিনি এরশাদকে দিয়েছিলেন এরশাদের সাথে সুজাতার মিটিং শেষে তা গরম থাকতে থাকতেই এরশাদ নিজেই মিডিয়াকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন। সুজাতা সিং বলেছিলেন জামায়াত ক্ষমতায় এসে যাবে তা ঠেকানোটা এরশাদের আসল কাজ। মহান দায়িত্ত্ব। আর জামায়াত ঠেকাতে হবে সে জন্য এরশাদকে হাসিনার সাথে নির্বাচনে যেতে হবে। আর এই মহৎ কাজের জন্যই বিএনপি-জামায়াতকে বাইরে রাখার যে সুযোগ পাওয়া গেছে তা ব্যবহার করতে এরশাদের নির্বাচনে যেতে যেন দ্বিধা না করেন। সুজাতার যুক্তির সারকথা ছিল বাংলাদেশের ক্ষমতাকে “জামাতমুক্ত” দেখতে যাওয়ার খায়েশ। বুঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামি লীগকে ভোট না দিলেও জবরদস্তিতে লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চাওয়ার ভারতের ব্যকুলতা কত তীব্র ছিল যে একটা ভাল সাফাই যুক্তি যোগাড় করতে না পারলেও বাংলাদেশে এমন ন্যাংটা হস্তক্ষেপের পক্ষে কথা বলতে সুজাতা কত ডেসপারেট ছিলেন।
সুজাতা সিং সেসময়ের ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের মধ্যে শীর্ষ কূটনীতিক। এই শীর্ষ কূটনীতিকের এটা নিঃসন্দেহে তার করুণ দুর্দশার চিত্র। তিনি তার হস্তক্ষেপের কাজকে,এরশাদের সাথে মিটিংয়ের বক্তব্যের স্বপক্ষে পাবলিকলি কোন সাফাই হাজির করতে পারেন নাই। এর ফলে তাঁর কথা হয়ে গেছে এমন যে, বাংলাদেশের মানুষ যদি চায়ও বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেবে, নিজেদের প্রতিনিধি বলে নির্বাচন করবে তবু সুজাতার ভারত তা হতে দিতে পারে না। আচ্ছা, এটা কি কোনো অতিথি পররাষ্ট্র সচিব বলতে পারেন? সেটা কি বাংলাদেশের জনগণ কাকে নির্বাচন করবে, নেতা প্রতিনিধি মানবে এর বিরুদ্ধে সুজাতার সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং বাধা দেয়ার সফর ছিলো না? সম্ভবত সে জন্য এর পর থেকে তিনি আর কখনো বাংলাদেশে মিডিয়ার মুখোমুখি হননি।
সেই থেকে এবারও ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের একই দুর্দশা দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে এবারও র‍্যাশানালিটি বা যুক্তি-বুদ্ধি হাজির করতে পারছে না। তাদের সব যুক্তির প্রধান কথা সবসময় যা থাকে তা হচ্ছে, বাংলাদেশের “ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বা তাদের উত্থান” – এই বিষয়ে তারা উদ্বিগ্ন। খুবই ভালো কথা। ফ্যাকটস হিসেবে ভারতের এমন উদ্বিগ্নতার পক্ষে সত্যতা আছে কি না সে তর্ক না তুলেই ভারতের উদ্বিগ্নতা স্বীকার করে নেয়া যাক।
কিন্তু সে জন্য তারা বাংলাদেশের জনগণ কাকে ভোট দেবে তা কি ঠিক করে দিতে পারে? একটা হস্তক্ষেপের নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়াতে পারে? জনগণ কোন দলকে কোন নেতাকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দারা তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে? ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের পছন্দের দল ও নেতার পক্ষে যদি জনমত না থাকে,তাদের পছন্দের নেত্রীর পাবলিক রেটিং যদি না থাকে তারপরও কি তাদের জিতিয়ে আনার পক্ষে কিছু করার সুযোগ থাকে?
আমরা এখানে খুবই সাধারণ একটা প্রশ্ন তুলেছি। প্রশ্নটা হলো, ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের পছন্দের দল ও নেতার পক্ষে যদি জনমত না থাকে, নেত্রীর নিজ গুণেই যদি নিজেদের পাবলিক রেটিং ধরে রাখতে না পারেন, না থাকে তাহলে কি তারা বাংলাদেশে একটা হস্তক্ষেপবিহীন নির্বাচন হতে দেবে না? এসব বিষয় মোটেও কোনো বিশাল কিছু নয়। এসব প্রশ্ন তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৪১ সালে রুজভেল্ট-চার্চিলের বিখ্যাত আটলান্টা চার্টারে সমাধা হয়ে গেছে, সেকালেই। এটা এখনও যারা মানতে পারে না তারা নিশ্চয় এখনো কলোনি শাসনের পক্ষের লোক। অথচ সে সময়ই এটা দুনিয়াতে সমাধা হয়ে গেছিল যে, জনগণকে পছন্দের নেতা প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না দেয়া, নেতা বেছে নিতে না দেয়া মারাত্মক অপরাধ। অন্য রাষ্ট্রের এমন কাজের কোনো অধিকারই নেই। ভিন রাষ্ট্র বা পড়শি রাষ্ট্র প্রতিবেশী দেশের নির্বাচিত কোনো নেতাকে বড় জোর প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু কোন নেতাকে নির্বাচিত হতে,বেছে নিতে জনগণকে কোনোক্রমেই বাধা দিতে পারে না। ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের একালে এমন অধপতিত দশায় পড়তে হয়েছে যে তারা প্রত্যক্ষ বাধা দিচ্ছেন। আবার তাদের কাজের পক্ষে যুক্তিবুদ্ধি সাজিয়েও দাঁড়াতে পারছেন না। খোলাখুলি হাসিনার গায়ের জোরের পক্ষে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে।
তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোড়ার সঙ্কট হলো, হাসিনার আওয়ামী লীগ পাবলিক রেটিং নেই। অথচ ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দারা সেই হাসিনার ওপর সব বাজি ধরে বসতে চান। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন একটা করিয়ে নিয়েছেন,কিন্তু শান্তি নেই। নতুন নির্বাচনের প্রয়োজন এটা এখন স্বীকার না করে পারছেন না। রা নির্বাচন না দিলে আরো বড় বিপদে পড়ার সম্ভাবনা। ঘটনা পরিস্থিতি সেক্ষেত্রে হাতছুট হয়ে যেতে পারে সে সম্ভাবনার রিস্ক নিতে হবে।
তাই লজ্জার মাথা খেয়ে আওয়ামী লীগ নিজেকেই মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং জামায়াতমুক্ত বিএনপির কথা পাড়তে হচ্ছে। অথচ বুঝতে চাইছেন না যে আওয়ামী লীগের মুখ দিয়ে ‘জামায়াতমুক্ত বিএনপির’ শর্ত আওড়ানোর কোনো মানে হয় না। কারণ এর মানে কী বিএনপি জামায়াতমুক্ত হলে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ক্ষমতা দেবে? ক্ষমতায় এনে দিবে? আর বিএনপি যদি জামাতমুক্ত না হয় তাহলে লীগ কোন ফেয়ার বা হস্তক্ষেপহীন নির্বাচন হতে দিবে না? এটাই কী ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের অবস্থান বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি? ‘জামায়াতমুক্ত বিএনপি’ কথাটার পক্ষে সাফাই?

অন্য আর একদিক থেকে বললে, জামায়াতমুক্ত বিএনপির বাসনা অবশ্য আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের থাকতেই পারে – যদি সেটা তাদের বাসনা মাত্র হয়। কারণ আইনগতভাবে ‘জামায়াতমুক্ত বিএনপি’র শর্ত আরোপ করতে পারে জনগণ অনুসমর্থিত কনস্টিটিউশনাল একটা রেফারেন্ডাম। দেশের ভিতর কে কেমন পার্টি হবে এটা বিএনপির আওয়ামী লীগের উপর কিংবা আওয়ামী লীগের বিএনপির উপর আরোপ করার বিষয় নয়। ঠিক যেমন বিএনপি আওয়ামী লীগকে বা ভাইসভারসা কেউ কাউকে ক্ষমতায় আনতে পারে না,এমনটা অবাস্তব ঠিক তেমনই শর্ত দিতে কিংবা শর্ত পূরণ করলে তবেই অন্যকে ক্ষমতায় আনব এটাও অবাস্তব। অর্থহীন কথাবার্তা। এ ছাড়াও মনে রাখতে হবে এ বিষয়ে কথা বলার দিক থেকে ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দারা কেউ না, কোনো পার্টিই নয়।
এ কারণে বিএনপির কোনো নেতা অথবা কোনো সুশীল বুদ্ধিজীবী অথবা প্রথম আলোর উপসম্পাদকের মতো কোনো মিডিয়া কর্মী যখন এমন কথা ছড়ায় যে ‘জামায়াতমুক্ত বিএনপি’ হতে হবে এটা হাস্যকর। অবাস্তব। এক্ষেত্রে তারা অবশ্যই আদতে আওয়ামী কর্মী না হলে ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দার স্বার্থ পালনকারী।

এখানে বলে রাখা ভাল, আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দারা “জামায়াতমুক্ত” অথবা “জামায়াত বিরোধিতা” এমন কথা বলে বা লিখে কেবল জামায়াত রাজনৈতিক দলকে বুঝায় না। তারা আসলে বুঝাতে চায় যেকোনো ইসলামি রাজনীতি বা রাজনীতির সমর্থক; এক কথায় বললে ইসলামি ফেনোমেনা বা পুরা ইসলামি কনস্টিটুয়েন্সি। এখন আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দারা তারা সবাই আসলে বুঝাতে চায় তারা বাংলাদেশে কোনো ইসলামিক রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ, রাজনীতিতে কোনো ইসলামি ফেনোমেনা তারা দেখতে চায় না। যদি তাদের চাওয়াটা ন্যায্য বলে ধরেও নেই তবু এটা বাস্তবায়ন করার উপায় লীগ-বিএনপির এক দল অপর দলকে শর্ত দেয়া নয় বরং জনসমর্থিত (রেফারেন্ডাম বা তুল্য কোনো কিছুর মাধ্যমে) এমন একটা কনস্টিটিউশন হাজির করে তা নিশ্চিত করা। কারণ এক দল অন্য দলকে ক্ষমতায় আনার কেউ নয়। কোন রাজনীতি কে করতে পারবে তা একে অপরকে ডিকটেক্ট করার তারা পরস্পরকে বলার কেউ নয়।
আবার বাংলাদেশে কোনো “সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বা রাজনীতি থাকতে পারবে না” আর বাংলাদেশে কোনো “ইসলামিক রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ,রাজনীতিতে কোনো ইসলামি ফেনোমেনা থাকতে পারবে না” বলা এক কথা নয়। প্রথম বক্তব্যটা কনস্টিটিউশনে বলার পরও দেশে সাংবিধানিক ইসলামি রাজনৈতিক দল থাকতে পারে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বক্তব্যটার বেলায় ইসলামি নাম নিয়ে আইনত কিছুই থাকতে পারবে না। তবে অবশ্যই নাম না নিয়েও তা থেকে যাবে। কারণ আইন করে একটা রাজনৈতিক চিন্তাকে স্তব্ধ করা যায় না। আবার প্রথম কথাটা পড়শি ভারতসহ যেকোনো বিদেশী আশা করতে পারবে। মানে “সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বা রাজনীতির” বিরুদ্ধে বলতে পারবে, আশা করতে পারবে। কিন্তু এরপরও দেশে সাংবিধানিক ইসলামি রাজনৈতিক দল থাকলে তা নিয়ে বলার ক্ষেত্রে বিদেশীরা কিছু বলার কেউ নয়।
আমাদের এখানকার প্রসঙ্গের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ওপরের শেষ বাক্যটা। অর্থাৎ ‘জামায়াতমুক্ত বিএনপি’ বলে কিছু হবে কি না এ নিয়ে ভারতের কিছু বলার নেই। ভারত বলার কেউ নয়। ‘সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বা রাজনীতি থাকতে পারবে না’ এমন ধরনের কথা বাংলাদেশের কনস্টিটিউশনে বলার পরও দেশে সাংবিধানিক ইসলামি রাজনৈতিক দল থাকতে পারে কোনো অসুবিধা নেই। আর এ নিয়ে ভারতের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু এসব আইনি সাংবিধানিক কাজের দিক দিয়ে না এগিয়ে আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের মুখ দিয়ে ‘জামায়াতমুক্ত বিএনপির’ কথা বলানো খুবই বিপজ্জনক। কারণ একটা কথা মনে রাখতে হবে, বাস্তবতা হলো, “সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বা রাজনীতির” বিরুদ্ধে মেজরিটি মানুষের একটা কনসেনসাস জনমত আছে। জনমত জরিপেও সেটা প্রতিফলিত হবে। কিন্তু যদি বলা যায় “কোনো ইসলামি রাজনৈতিক দলই বা ফেনোমেনাই বাংলাদেশে থাকতে পারবে না” সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে এই একই জনগোষ্ঠী বা জনমতের মেজরিটি উল্টো রায় দেবে। শুধু তাই নয়,চাপাচাপি করতে যাওয়ার জন্য নিজের দেশ ভূমি জমিতে ‘সন্ত্রাসবাদ’ দেখতে চায় না এর সপক্ষের মেজরিটির ঐকমত্যের জনমতটাও এরপর আর থাকবে না। হত্যা করা হবে।
এ ছাড়া একটা কথা সুনির্দিষ্ট করে বলার সময় হয়েছে যে বাংলাদেশে ‘সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বা রাজনীতির’ হতে পারে বা থাকতে পারে এটা ভারতের স্বার্থের বা উদ্বিগ্নতার বিষয় নয়। ভারত বরং এসব বিষয়ে তত সিরিয়াস নয়। বিষয়টাও তত সিরিয়াস নয়। রাষ্ট্রের রুটিন তৎপরতাতে সেসব দিক নিয়ন্ত্রণ করে রাখা সম্ভব এবং তাই হচ্ছেই। বরং ভারতের সিরিয়াস প্রসঙ্গ হলো, ক. বিনা শুল্কে, বিনা বিনিয়োগে, বিনিয়োগের দায় না নিয়ে ট্রানজিট হাসিল করা খ. বাংলাদেশ চীনের সাথে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সম্পর্কে কতটা পক্ষে বা দূরে থাকবে তা বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থে নির্ধারণ করার বদলে ভারতের স্বার্থে নির্ধারণ করতে বাধ্য করা। ভারত তার নিরাপত্তার উদ্বিগ্নতার কথা বলে এর আড়ালে এসব অর্থনৈতিক রাজনৈতিক স্বার্থ বাংলাদেশ থেকে হাসিল করতে জবরদস্তি করে চলছে। এ কাজে কোনো পাবলিক রেটিংয়ে দুর্বল রাজনৈতিক দলই তার জন্য বেশি উপযুক্ত। কারণ যত জনসমর্থন বেশি ভারতের কথা তত সে শুনবে না।

দুই.
গত এক সপ্তাহে খালেদা জিয়ার কথিত এক মন্তব্যকে নিয়ে দু’টি প্রপাগান্ডা রিপোর্ট বের হয়েছে। প্রথমটি ভারতের ‘দি হিন্দু’ (THE HINDU) পত্রিকার খোদ সম্পাদকীয়। দ্বিতীয়টি স্টাটফোর (STRATFOR) নামে আমেরিকান গোয়েন্দা ইনটেলিজেন্স পত্রিকার এনালাইসিস রিপোর্ট। দু’টি রিপোর্টের প্রসঙ্গ একই এবং এটা পরিষ্কার যে, ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের প্রভাবে এই রিপোর্ট দু’টি তৈরি। বাংলাদেশে তারা যে অবস্থান বা নীতিতে পরিচালিত সেই নীতির পক্ষে এ দুটোই প্রপাগান্ডা রিপোর্ট। হিন্দু সম্পাদকীয় বের হয়েছে ২৮ জুলাই আর স্টাটফোরেরটা বের হয়েছে ৩০ জুলাই। দু’টি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ‘খালেদা জিয়া নাকি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছেন। ফলে তাতে নাকি বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’

হিন্দু দাবি করছে, ‘BNP’s decision to drop its demand for the formation of a caretaker government। আর স্টাটফোর দাবি করছে, Khaleda Zia has indicated that parts of the opposition might be willing to drop some of their demands — such as imposing a neutral caretaker government to oversee elections.
প্রথমত তথ্য হিসেবে এটা মিথ্যা যে, খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছেড়ে দিয়েছেন, বা সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত ২৫ জুলাই খালেদা জিয়া তার গুলশানের অফিসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাতের সময় নাকি এ কথা বলেছেন। বিডিনিউজ২৪ পত্রিকার রাজনৈতিক লাইন বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক লাইনের সবচেয়ে কাছাকাছি। ফলে এখানে পর্যবেক্ষণ হল, সরকার আর ভারতীয় আমলা-গোয়েন্দাদের কমন অবস্থানটাই সবচেয়ে ভালো প্রতিফলিত হয় এই পত্রিকার রিপোর্টে। সেই বিডিনিউজ ঐদিনের প্রসঙ্গে খালেদার কথা কী বুঝেছে তা দেখা যাক। বিডিনিউজ২৪ ইংরাজী শিরোনাম করেছে, Khaleda says fairness is the key, caretaker or no caretaker’। আর ভেতরে কোট আনকোট লিখছে, ‘It is not necessary that elections should be under a caretaker government. Whatever it is called, we want a neutral government to ensure free and fair elections’। এতটুকু পড়ে যে কারো নিশ্চিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট যে, খালেদা কেয়ারটেকারের দাবি ত্যাগ করেছেন এমন বুঝ এখান থেকে বের করার সুযোগ নেই। কারণ সারকথা হলো, খালেদা জিয়া ‘কেয়ারটেকার’ শব্দ নিয়ে আঁকড়ে বসে থেকে ঝোলাঝুলি না করে ‘হস্তক্ষেপবিহীন নির্বাচন’ দাবি তার মূল কথা এটাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ বিডিনিউজ অন্তত ভুল বা উল্টো বোঝেনি। তবু হিন্দু আর স্টাটফোর বুঝেছে।
তবু কি আর করা যাবে এবার তাদের বোঝার যুক্তিবুদ্ধি বা লজিকটা কী তা পরখ করা যাক।

খালেদা জিয়া কেয়ারটেকার দাবিটা যদি ত্যাগ করেই থাকেন তো সেটা ইতিবাচক বা তার মধ্যে আশার আলো দেখার কি আছে?
গত দু-তিন বছরে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনগুলোর ন্যূনতম ফেয়ারনেস বা গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে যদি এই দুই মিডিয়া রিপোর্টারের ধারণা না থাকে তবে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের এমন সম্পাদকীয় বা বিশেষণ লেখার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সুতরাং ধরে নিতে হবে শেখ হাসিনার অধীনে যেকোনো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার গুরুতর সঙ্কট যে আছে এটা তারা জানেন। আর কে না জানে হাসিনার অধীনে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নেই এ জন্য নয় যে বিরোধীরা তাতে অংশগ্রহণ করেনি। অংশগ্রহণ করলেও সেখানে আরো মারাত্মক সঙ্কট আছে। সর্বশেষ ঢাকা সিটি নির্বাচন এর সাক্ষী যেখানে খোদ খালেদার গাড়িতে নিয়মিত আক্রমণ করতেও শেখ হাসিনা দ্বিধা করেনি। ভোট কারচুপির ডেস্পারেটনেস দেখার মতো। তাহলে এ অবস্থায় খালেদা কেয়ারটেকারের দাবি ছেড়ে দিয়েছে সুতরাং এটা ভালো খবর হিসেবে উদযাপন করা উচিত, তাই কী? তার মানে এই পত্রিকা দু’টি একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হওয়াটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না, গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন খালেদার কথিত কেয়ারটেকারের দাবি ছেড়ে দেয়া, এটাকে আবার তাদের ভালো এক ‘আপসরফাও’ মনে হয়।

পত্রিকায় রিপোর্ট লিখতে গেলে ন্যূনতম কিছু এথিকসের ওপর দাঁড়াতেই হয়। একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে সব পত্রিকা দাঁড়াবে এটাও তো স্বাভাবিক। আমরা এখানে দেখছি পত্রিকা দুটো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়ানো দরকার মনে করছে না। এর চেয়ে বরং না করে কথিত আপসরফা করে ফেললে আমাদেরকে খুশি হতে তাগিদ দিচ্ছে। পত্রিকা দুটো নিজেরাও দেখা যাচ্ছে এ খবরে খুশি হয়েছে। নির্বাচনটা এখন বিশ্বাসযোগ্য না হলেই বরং এই দুই পত্রিকা খুশি দেখা যাচ্ছে। এ কেমন খুশি? কেমন এথিকসবোধ?

স্টাটফোরের নামে সম্প্রতিকালে দাগ লেগেছে। সম্প্রতি উইকিলিকস সিআইএর সাথে তাদের অনৈতিক যোগাযোগের ফাইল ফাঁস করে দিয়েছে। নইলে এর আগে এটা যথেষ্ট সম্মানজনক পত্রিকা ছিল। কিন্তু ‘হি্ন্দু’ (১৮৭৮ থেকে প্রকাশিত) মাদ্রাজ থেকে বের হওয়া প্রায় দেড় শ’ বছরের পুরানো ইংরেজি পত্রিকা। যেকোনো পত্রিকা তার দেশে-বিদেশের রিপোর্ট করতে গিয়ে তার সরকারের অবস্থান তাকে কাঁধে করে ঘুরতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যদি না মনিকাঞ্চন বা অনুগ্রহ লাভের কোনো ব্যাপার না থাকে। এ ছাড়া এটা সম্ভবও নয়। কারণ সরকার অনেক সময় অনেক অবস্থান নেয় অনেক কারণে, অনেক স্বার্থে। এর সবগুলো সবসময় ওই পত্রিকারও স্বার্থ হবে এমন কোনো কারণ নেই। বরং না হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন নিজের দেড় শ’ বছরের ইমেজ রাখার স্বার্থ আর আমলা-গোয়েন্দা বাহিনীর প্রপাগান্ডা রিপোর্ট এই দুই স্বার্থ স্ববিরোধী হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে তা আত্মঘাতী হয়েছে।

এক বিচারে ভারতের আমলা-গোয়েন্দারা সফল যে তারা দুটো পত্রিকাকে তাদের প্রপাগান্ডায় শামিল করতে পেরেছে। এতে পত্রিকা দুটো যে এথিক্যাল সঙ্কটে জড়িয়ে গেছে এর দায় ক্ষতি তাদের নিজেদেরই বহন করতে হবে। তবে স্টাটফোর আবার হিন্দুর থেকে এককাঠি সরেস। স্টাটফোর দাবি করছে শেখ হাসিনা নাকি গত দু-তিন বছরে যা করেছেন এটা নাকি বিরোধী দল দমন নয়, সন্ত্রাসবাদ দমন। তাই যদি হয় তাহলে আবার খালেদার সাথে আলোচনা, কম্প্রোমাইজ এসবের মানে কি? যে সন্ত্রাসী তার সাথে আবার আলোচনা নিগোশিয়েশন কম্প্রোমাইজ কি হতে পারে? তাকে তো দমন ও নির্মূল করারই কথা। এই প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে স্টাটফোরের মাথায় আসেনি। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে একটা স্পেস ভাড়া দেয়ার রিপোর্ট তারা করছে এটা তাদের কাছেও পরিষ্কার।

তাহলে, ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং জামায়াতমুক্ত বিএনপি’র রাজনীতির অর্থ হলো এক আকাক্সক্ষা যে আশা করছে বিএনপি যেমন-তেমন এক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে আওয়ামী লীগকে পুনর্বার যেভাবে হোক বিজয়ী ঘোষণা করে দেয়ার জন্য। মানুষের আকাঙ্খার রকমফেরের আসলে কোনো শেষ নেই।

[লেখাটার প্রথম ভার্সান সংক্ষিপ্ত আকারে আগে ছাপা হয়েছিল গত ০৯ আগষ্ট ২০১৫, মাসিক অন্যদিগন্ত পত্রিকায়। এখানে আবার নতুন করে লিখে, এডিট করে ছাপা হল।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s