চীনের বিশ্বব্যাংকঃ ঋণ বিতরণ শর্ত কেমন হতে যাচ্ছে
গৌতম দাস
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
http://wp.me/p1sCvy-bO
চীনের বিশ্বব্যাংক মানে “এশিয়ান ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক” (সংক্ষেপে এআইআইবি) এর কথা বলছি। আগামি বছর ২০১৬ এর শুরু থেকে এই ব্যাংক অফিস খুলে পাবলিকলি কার্যকর হবে বলে আমাদের জানাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ধরণের ব্যাংক মানে অবকাঠামো খাতে ঋণ দেয়ার এমন ব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্রিটিক যারা তাদের প্রধান অভিযোগ হল এই ব্যাংক বিশাল বিশাল শর্তের জাল বিছায়,অহেতুক শর্ত দেয়,শর্তে বেধে ফেলে ইত্যাদি। এই ক্রিটিকদের একটা বড় অংশ হল, বাম এক্টিভিস্ট। তবে শর্ত দেয় বলেই এরা খারাপ এতটুকু বুঝ নেয়া ভুল হবে। কারণ যেকোন ধরণের ঋণদাতা তা সে পাড়ার মাহাজন হোক কিংবা কোন ব্যাংক অথবা বিশ্বব্যাংক যেই হোক শর্ত দেয় না এমন ঋণদাতা কেউ নাই। ফলে প্রশ্নটা কেবল শর্ত দেয় এখানে না। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম বা বিশ্বপুজিবাদের বাজার নিরন্তর করতে রাখতে অথবা অন্য ভাষায় বললে, বিশ্বপুঁজির বাজারে পুঁজির চাহিদাকে জিইয়ে রাখতেই বিশ্বব্যাংকের জন্ম, তার প্রতিটা সিদ্ধান্তের পিছনের কারণ। এদিকগুলো আমরা যত গভীরে বুঝব ততই সমস্ত সমালোচনা কেবল “শর্ত দেয়” – এর মধ্যে সীমিত করব না। কেন শর্ত গুলো এমন তা বুঝব। আর এসম্পর্কে বুঝ পরিস্কার থাকলে আমরা আমাদের স্বার্থ বুঝে শর্ত নিয়ে নিগোশিয়েশনের টেবিলে কথা বলতে শিখব। প্রাকটিক্যাল করণীয় প্রস্তাব করতে শিখব। যাই হোক, বিশ্বব্যাংকের ৭০ বছর শেষে এবার ইতোমধ্যে চীনের বিশ্বব্যাংকের যুগে আমরা পড়েছি। ফলে স্বাভাবিক প্রশ্ন, এসব বিষয়ে এআইআইবি ব্যাংক কী বিশ্বব্যাংকের চেয়ে আলাদা কিছু হবে? কথাটা অন্যভাবে গুছিয়ে আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, এআইআইবি ব্যাংক এর অপারেশনাল ম্যানুয়াল বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কতটা আলাদা হবে? অপারেশনাল ম্যানুয়ালের ড্রাফট নিয়ে কাজ চলছে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবিতে আগে কাজ করতেন এমন প্রাক্তন কিছু কর্মীদেরকে নিয়োগ দিয়ে একটা দল গঠন করা হয়েছে যারা বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ম্যানুয়ালগুলোর পুনর্মুল্যায়ন করতে বসেছেন, বিশেষ করে এর নিয়মের বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলো মাথায় রেখে। উদ্দেশ্য পুরানা সমতুল্য প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক বা এডিবি এর চেয়ে এআইআইবি এর অপারেশনাল ম্যানুয়াল যেন তুলনামূলকভাবে কম সমালোচনার হয়। এটা খুব স্বাভাবিক যে এআইআইবি এর হবু ম্যানুয়াল কেমন হতে যাচ্ছে এনিয়ে বাজারে প্রচুর কৌতুহল তৈরি আছে। এপরিস্থিতিতে, এই কৌতুহল পূরণে আন্তর্জাতিক নিউজ এজেন্সী “রয়টার” গত পয়লা সেপ্টেম্বর এক এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট ছেপেছে। রিপোর্টটা এক্সক্লুসিভ অর্থাৎ কেবল তাঁরা একাই ছেপেছে এবং একই সঙ্গে এটা মুলত এক আনফিসিয়াল রিপোর্ট – অর্থাৎ এআইআইবি ব্যাংকের তরফে পাওয়া কোন অফিশিয়াল তথ্য এগুলো নয়। বরং অপারেশনাল ম্যানুয়াল খাড়া করার কাজের সঙ্গে জড়িত এমন চারজন গুরুত্বপুর্ণ সোর্সের বরাতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লেখা। কিন্তু স্বভাবতই এসব সোর্স লোকেরা অফিসিয়ালি তাদের কাজের বিষয় নিয়ে মিডিয়াতে কথা বলার জন্য অনুমোদিত ব্যক্তি নয়।এই অর্থেও তাদের পরিচয় জনসমক্ষে লুকানো বলে তা আনফিসিয়াল। ঐ রিপোর্টে হবু ম্যানুয়ালের কিছু প্রসঙ্গে প্রকাশিত তথ্য নিয়ে এখন এখানে কথা বলব।
শুরু করার আগে,একটা কথা মনে করিয়ে দেয়া ভাল যে, এআইআইবি ব্যাংকের উদ্যোক্তা সদস্যরাষ্ট্র হবার জন্য যখন স্বাক্ষর দেবার শেষ দিন এগিয়ে আসছিল সেসময় ঐ পুরা মাস জুড়ে আমেরিকা একরকম প্রকাশ্যেই ইচ্ছুক উদ্যোক্তা সদস্যরাষ্ট্রগুলোর উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল যাতে তারা এই উদ্যোগে সামিল না হয়। যেমন এই চাপ, কুটনৈতিক লবিইং গুরুত্বপুর্ণ সদস্য অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদির মত হবু সদস্যদেরকে বিভ্রান্ত ও থমকে দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্থ করতে পেরেছিল। যদিও ইউরোপের বৃটেন ও জর্মানি লীড নিয়ে এআইআইবি ব্যাংকের উদ্যোক্তা সদস্য হয়ে তাতে তাদের যোগদানের সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর সব দ্বিধা বাধা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে বিলীন হয়ে যায়। নিসন্দেহে এটা আমেরিকার জন্য বিশাল কূটনৈতিক পরাজয়। আর এই পরাজয়ের পরেই কেবল আমেরিকা নিজের বাজে অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করে নিজের মুখ রক্ষার চেষ্টা করেছিল। সেই ব্যাখ্যায় বলেছিল, হবু নতুন ব্যাংকের স্বচ্ছতা, ষ্টান্ডার্ড, পেশাদারীত্ব ও জবাবদিহিতায় এআইআইবি ব্যাংক আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে পারবে কি না তা নিয়ে আমেরিকার সংশয় আছে। তাই এমন আগাম কানকথা ছড়িয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দেবার আচরণে আমেরিকা নাকি লিপ্ত হয়েছিল। আমেরিকার এই সাফাই এসব কথা চীন মনে রেখেছে,তা আমরা ধরে নিতে পারি। ফলে ম্যানুয়াল তৈরির এখনকার সময়ে এতে তা প্রতিফলিত হয় এমন এক জবাব চীন দিবে তাও আমরা ধরে নিতে পারি। এতে সমতুল্য দুই অবকাঠামো ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক প্রতিদ্বন্দ্বীতার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের মত দেশের দিক থেকে বিচারে যা সম্ভবত ইতিবাচক হবার কথা।
রয়টারের রিপোর্টে সম্ভাব্য ম্যানুয়ালে কি থাকবে সেবিষয়ে বলা হয়েছে, প্রথমত, ঋণদানের ক্ষেত্রে এআইআইবির বেলায় এখানে নাকি সমতুল্য প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কম শর্ত সংশ্লিষ্ট থাকবে। দ্বিতীয়ত, আইনগত দিক থেকে এআইআইবি এর নেয়া প্রজেক্ট স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং যেকোন প্রজেক্টের সামাজিক ও পরিবেশতগত বিরূপ প্রভাব যেন সৃষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে সেগুলো নিশ্চিত করার পরই কেবল গ্রহণ করবে। তৃতীয়ত, অনেক সময় দেখা যায় যে ঋণ দেবার ক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে, কিছু প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণ করতে হবে অথবা ওসব প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে হবে। অথবা অনেক সময় দেখা যায় “মুক্তবাজার নীতি” বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের আগে থেকে তৈরি এক সাধারণ ম্যানুয়াল আছে – শর্ত হিসাবে তা মানতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। রয়টারের ঐ রিপোর্ট বলছে এআইআইবির বেলায় ‘বেসরকারিকরণ করতে হবে’ ধরনের শর্ত থাকবে না। এছাড়া সরকারের কর্তৃত্ব শিথিল করার শর্তও সম্ভবত থাকবে না। এছাড়া এমনিতেই মুক্তবাজার নীতি বলে সুনির্দিষ্ট কিছু আছে কিনা এর ব্যাপারে খোদ চীনেরই সন্দেহ আছে ফলে ম্যানুয়ালে এমন কথা প্রতিফলিত হবে না। বরং মুক্তবাজার নীতি বলে কিছু থাকবেনা বলে এসব প্রজেক্ট পরিচালনা তুলনামুলক সহজ হবে বলে এখানে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন। এবিষয়ে বিস্তার করতে রিপোর্টে এক উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, যেমন দেখা যায় কোন পানি সরবরাহ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে গিয়ে পানির দাম বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকে, বিশেষত অনেক সময় স্থানীয় পরিস্থিতি দাম বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত কি না সে বিবেচনার দিকটা উপেক্ষা করেই তা করা হয়। এআইআইবির বেলায় তারা এসব দিক গভীর বিবেচনায় নিয়ে সতর্ক থাকবে, দরকার হলে ভিন্ন উৎস থেকে অর্থের সংস্থান,ভর্তুকি দেয়া ইত্যাদি বিকল্প বের করার চেষ্টা করবে, ইনোভেটিভ হবে। চতুর্থত, এআইআইবির বেলায় কয়েকটা ব্যাপারে নীতিগত অবস্থান তারা স্থির করেছে। যেমন, প্রজেক্ট দেরি করিয়ে দেওয়া বা মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা, লাল ফিতায় আটকে রাখা তাঁরা অবশ্যই এড়িয়ে চলবে। একাজের সক্ষমতার জন্য তারা নিজস্ব “সহজ আভ্যন্তরীণ মুল্যায়ন” ও “আগাম রিস্ক অনুমানের ব্যবস্থার” বিষয়ক মেকানিজমের উপর নির্ভর করবে। পঞ্চমত, এআইআইবির বেলায় নিজ প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ একটা সীমার মধ্যে বেধে রাখার কথা তারা ভাবছে। সে জন্য ফিল্ড অফিস ছোট রাখা, মোট স্টাফ ৫০০-৬০০ জনের মধ্যে সীমিত রাখার পরিকল্পনা তারা করছে। আর সে মোতাবেক আকারের দিক থেকে এডিবির ছয়ভাগের একভাগ তারা কমাবে এবং বিশ্বব্যাংক পরিচালনা খরচের চেয়ে অন্তত ৫ পারসেন্ট কমাবে। স্বভাবতই এগুলো শুনতে ভালই লাগছে। তবে কতদুর কী বাস্তবে হবে দাঁড়াবে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এগুলো কোনটাই অফিশিয়াল নয়।
এআইআইবি ব্যাংক কী বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার যোগ্য ভাবতে পারবে
অবকাঠামো খাতে ঋণে সুদের হার একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। সেপ্রসঙ্গে বিস্তারে যাবার আগে, ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক নাকি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক – এই দুই ধরণের ব্যাংকের মধ্যে ফারাক কী? এনিয়ে কিছু কথা তুলব। এখানে অন্তত নামের ভিতর দিয়ে আপাত একটা ফারাক করতে দেখা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ডেভেলবমেন্ট বা উন্নয়ন শব্দটা একালে সমাজের সব স্তরেই বিশাল পরিচিত এক শব্দ হয়ে গেছে। অবস্থা এমন যে ডেভেলবমেন্ট নিজেই যেন বাংলা শব্দ হয়ে গেছে। কিন্তু শব্দটার অর্থ কি? কোথা থেকে কোন সুত্রে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটা গ্লোবাল অর্থনীতি বিষয়ের সাথে জড়িয়ে যাওয়া একটা শব্দ হয়েছে। সংক্ষেপে সারকথায় বললে, অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত্ব বা সঞ্চয় বলা হয় যেটাকে আর একদিক থেকে দেখলে এটাই নতুন বিনিয়োগ অর্থাৎ বিনিয়োগ সক্ষমতা। আর এই সক্ষমতাকে বাস্তব করে তুলতে গেলে প্রয়োজন বিনিয়োগের বাজা্রের ক্রেতা। শুধু তাই না প্রয়োজন হয় বিনিয়োগের বাজারকে যেন নিরন্তর বড় থেকে বড় দেখতে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, গ্লোবাল পুঁজি বাজারে নিরন্তর ক্রেতার চাহিদা হাজির দেখতে পাবার এক সহজ উপায় বের করা হয়েছিল। তা হল বিনিয়োগ সক্ষম পুঁজির কিছু অংশ খুবই কম সুদে, পারলে ব্রেক-ইভেনে বড় বড় প্রজেক্টে বিনিয়োগ করা। এটাই নতুন নতুন বিরাট পুঁজির চাহিদার বাজার তৈরি করবে। এভাবে সেই তৈরি বাজারের পুঁজির চাহিদা মিটানো মানে মুল পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবসা – সুদ মুনাফার ব্যবসাটা আরামে করা সম্ভব।
তো মোট বিনিয়োগ সক্ষমতার যে অংশ বাজার আরও বড় করে তৈরি বা হাজিরের উদ্দেশ্যে খুবই কম সুদে বড় প্রজেক্টে বিনিয়োগ করা হয় সেটাকে বলা হয় অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ। এই “অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ” লম্বা কথাটাকে ছেটে সংক্ষেপে বলা হয় ডেভেলবমেন্ট বা উন্নয়ন বলা হয়। তাহলে উপরের কথাগুলো সার করে আর একবার সংক্ষেপে কিছু বৈশিষ্ট আকারে চিহ্নিত করে বলা যাক।
১। সাধারণভাবে গ্লোবাল পুঁজির বিনিয়োগ বিষয়টা দুভাবে ঘটতে পারে বা ঘটে – ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অথবা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এর মাধ্যমে। ২। প্রথম ধরণের ব্যাংকের উদ্দেশ্য দ্বিতীয় ধরণের ব্যাংকের জন্য ক্রেতা চাহিদা তৈরি। যেন গ্লোবাল পুঁজি বাজারে নিরন্তর পুঁজি গ্রাহক পাওয়া যায় এমন পুঁজিবাজার তৈরি। অর্থাৎ প্রথমটা হল অবকাঠামো খাতে ঋণ দেবার ব্যাংক বা উন্নয়ন ব্যাংক। এই ব্যাংক খোলা মানে এর উদ্দেশ্য গ্লোবাল পুঁজিবাজারে পুঁজির চাহিদা বৃদ্ধির বা ক্রেতা বৃদ্ধির শর্ত তৈরির পক্ষে কাজ করা। ৩। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অবকাঠামো ব্যাংক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে জন্ম দেওয়া ব্যাংক নয়। এটা তাই মুনাফার মোটিভ থেকে পরিচালন করা হয় না। তবে সর্বোচ্চ কম সুদে বা না-লাভ-না-ক্ষতি ভিত্তিতে ব্রেক ইভেনে এটা পরিচালনা করা হয়। কেবল অফিস পরিচালনা খরচটা তুলে আনার জন্য সার্ভিস চার্জ নেয়া হয়। অনেক সময় কিছু বিনিয়োগ লিল্লাহ বা অনুদানেও একে দিতেই হয়। কারণ অনেক সময় অবকাঠামো ঋণ নেবারও যোগ্য করে তুলতে তা দিতে হয়। এতে সবমিলিয়ে গড়ে মুনাফা না হোক কিন্তু আসল পুঁজি যেন কমে না যায় কেবল সেদিকে লক্ষ্য রাখলেই চলে। ৪। মুনাফা অর্জনের আসল জায়গা হল, গ্লোবাল পুঁজি বাজার – অর্থাৎ বিনিয়োগ ব্যাংক বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক নামে যেখানে প্রতিষ্ঠান খুলে রাখা আছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়েই পুঁজি বাজার। আর গ্লোবাল পুঁজি বাজার মাত্রই তা বাণিজ্যিক এবং মুনাফা এর উদ্দেশ্য। এর অধীনস্ত থাকে সমস্ত আরও নানান বাণিজ্যিক কায়কারবারি প্রতিষ্ঠান। ৫। আবার দেখা গেছে পোর্ট, ব্রীজ-রাস্তাঘাট, এনার্জি প্লান্ট, পানি সরবরাহ ও নিস্কাষণ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে অবকাঠামো ধরণের বিনিয়োগ করলে সে দেশের অর্থনীতিতে গতি আসে, অর্থনীতির সাইজ বড় হয় অর্থাৎ সে অর্থনীতিতে আরও পুঁজি পাওয়ার চাহিদা তৈরি হয়। এথেকে দুটা কথা আছে। পোর্ট, ব্রীজ-রাস্তাঘাট, এনার্জি প্লান্ট, পানি সরবরাহ ও নিস্কাষণ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে অবকাঠামো ধরণের বিনিয়োগ করে এসব ফল পাওয়া যায় বলে উলটা করে এসব খাতকেই অবকাঠামো খাত বলা হয়। আর দ্বিতীয়ত, ফলাফলে কার্যকরভাবে পুঁজি বিনিয়োগের চাহিদা তৈরি হয় কিন্তু সে বিনিয়োগ বাজারের ক্রেতা চাহিদা মিটায় (এবার এটা আর অবকাঠামো ব্যাংক নয়) বাণিজ্যিক বিনিয়োগ (ইনভেস্টমেন্ট) ব্যাংক। ঐ অর্থনীতি হয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এর ঋণখাতক বা ক্রেতা। সামগ্রিকভাবে গ্লোবাল পুঁজির ততপরতার দিক থেকে দেখলে কার্যকর মুনাফা কামানোর বিষয়টা কেবল এই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক অংশে ঘটে।
৬। এই উদ্দেশ্যেই বাণিজ্যিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের থেকে আলাদা করে ১৯৪৪ সালে বিশ্বব্যাংক নামে অবকাঠামো খাতে ব্যাংক খোলা হয়। আর প্রায় বিনা সুদে খোদ বিশ্বব্যাংককে এর আদি পুঁজি সরবরাহ করা হয়েছিল ওয়াল স্ট্রীট বা গ্লোবাল পুঁজি বাজার থেকে। ৭। ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক আর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এর মধ্যে আর এক উল্লেখযোগ্য ফারাক হল, ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক মাত্রই তা রাষ্ট্রের মালিকানা ব্যাংক, সাধারণত একাধিক ফলে মাল্টি-ষ্ট্রেট বা বহু পক্ষীয়। কোন এক মুরুব্বিয়ানা রাষ্ট্রের নেতৃত্বে তবে বাকি সবাইকে অবশ্যই রাষ্ট্র হতে হয়। মাল্টি-রাষ্ট্রের বাইরে এর মালিকানা নাই। বিপরীতে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক মাত্রই তা বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ব্যাংক -এক বা একাধিক ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংক।
৮। এই পয়েন্ট এটা সতর্কতামূলক, বিভ্রান্তি কাটানোর জন্য বলা পয়েন্ট । পোর্ট, ব্রীজ-রাস্তাঘাট, এনার্জি প্লান্ট, পানি সরবরাহ ও নিস্কাষণ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করতে দেখা মানেই এসব খাতে হলেও এগুলো অবকাঠামো বিনিয়োগ নাও হতে পারে। অথবা সেজন্য এগুলোকে অবকাঠামো খাত বলে বুঝতে হবে অথবা এগুলো কেবল বিশ্বব্যাংকেরই খাতক খাত – এভাবে কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে এমনটা সত্যি নাও হতে পারে। তাই অবকাঠামো বিনিয়োগ নাকি বাণিজ্যিক বিনিয়োগ তা বুঝাবুঝিতে বিভ্রান্তি এড়ানোর বেস্ট উপায় হল সুদের হারের দিকে লক্ষ্য করা; যে কোন বিনিয়োগ ঋণকে অবকাঠামো না বাণিজ্যিক বলে বুঝব এর মূল নির্ধারক হল সুদের হার। যদি দেখা যায় প্রায় বিনা-সুদ, এর মানে সেটা অবকাঠামো বিনিয়োগ অর্থাৎ অবকাঠামো ধরণের ব্যাংকের বিনিয়োগ। কোন খাতে বিনিয়োগ তা দেখে সেটা অবকাঠামো বিনিয়োগ বলে বুঝলে ভুল হতে পারে।
তত্ত্বগত তথ্য দেয়া শেষ। চলতি গ্লোবাল পুঁজি বাজারের দুনিয়াতেই চীন এশিয়ান ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক নিয়ে হাজির হয়েছে। বলা হচ্ছে এই ব্যাংক বিশ্বব্যাংক ধরণের ব্যাংক; মানে অবকাঠামো বা ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ধরণের ব্যাংক। কিন্তু চীনের ব্যাংকের নামের দিকে যদি তাকাই এর নামের মধ্যে দেখতে পাই “ইনফ্রাষ্ট্রাকচার” এবং “ইনভেস্টমেন্ট” দুটা শব্দই আছে। তবু আমরা বিভ্রান্ত না হয়ে এটাকে ‘ইনফ্রাষ্ট্রাকচার’ ব্যাংক বলেই বুঝব। অন্তত একটা কারণ যে, বলা হচ্ছে এটা বিশ্বব্যাংকের সমতুল্য বা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংক।
কিন্তু রয়টারের রিপোর্টে এআইআইবি ব্যাংকের সুদের হার কি হতে যাচ্ছে সে প্রসঙ্গে দ্বৈত-অর্থ হয় এমন কথা লেখা হয়েছে। ওর গুমোর পাঠকের কাছে পরিস্কার করতেই উপরের লম্বা তত্ত্বগত তথ্য দিয়ে নিতে হল।
“মাত্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যাংক বলে এটা শিশু অবস্থায় গ্রাহকের ক্রেডিং রেটিং কেমন সেদিকে বেশি চোখ রেখে আগ্রহ ততপরতা দেখাবে। এর অর্থ খুব সতর্ক এপ্রোচে সে আগাবে। এর আরও অর্থ এটা বিনিয়োগ (ইনভেস্টমেন্ট) ব্যাংকের স্টাইলে আগাবে, কেবল বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক দেখা গেলেই সেসব প্রজেক্টে বিনিয়োগে আগাবে, যেখানে সম্ভব প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশীপে, তবে বাজারের সুদ হার চার্জ করবে যেটা সম্ভবত সমতুল্য বিশ্বব্যাংকের সুদহারের চেয়ে বেশি হবে”। এই বাক্যগুলো সরাসরি রয়টারের রিপোর্ট থেকে অনুবাদ করলাম।
এখানে দুটা প্রসঙ্গ। বলা হয়েছে “বিনিয়োগ(ইনভেস্টমেন্ট) ব্যাংকের স্টাইলে আগাবে” আর “বাজারের সুদ হারে চার্জ করবে” কথা দুটোর মিলিত ইঙ্গিত আর সবশেষে স্পষ্ট করে বলা “সমতুল্য বিশ্বব্যাংকের সুদহারের চেয়ে বেশি” একথা থেকে একটা জিনিষ পরিস্কার – সেটা হল চীনের এআইআইবি ব্যাংক বিশ্বব্যাংকের কনসেশনাল সুদ হারে (০.৭৫%) ঋণ গ্রহিতা যেসব সদস্য রাষ্ট্র আছে (যেমন বাংলাদেশ) তাদের জন্য অবকাঠামো ব্যাংক হতে পারছে না। সম্ভবত ঋণদাতা হতে পারছে না। অর্থাৎ এই সুদ হারের গ্রাহক স্তরে (মানে বাংলাদেশের মত গ্রাহক স্তরে) এআইআইবি ব্যাংক বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হবে না। যেমন ফিলিপাইন, এই রাষ্ট্র বহু আগেই বিশ্বব্যাংকের কনসেশনাল সুদ হারে (০.৭৫%) ঋণ পাবার যোগ্য নয়। কারণ তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল। ফলে কনসেশনাল ক্যাটাগরির উর্ধে। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়েও বেটার ক্যাটাগরির অর্থনীতির। এই স্তরের গ্রাহক রাষ্ট্রের সুদ হার সাধারণত ৪% বা এর বেশি হয়। এই বিচারে যেসব রাষ্ট্রের অর্থনীতি কনসেশনাল ক্যাটাগরির উর্ধে (৪% সুদ দেওয়ার যোগ্য) শুরুতে তাদের দিকে মনোযোগ দিয়ে এআইআইবি ব্যাংক নিজের কার্যকারিতা শুরু করতে পারে।
সারকথায় রয়টারের (আনঅফিসিয়াল) রিপোর্টের ভাষ্য সত্যি হলে শুরুর পর্যায়ে বাংলাদেশ এআইআইবি ব্যাংক থেকে কোন ঋণ পাবার যোগ্য সম্ভবত বিবেচিত হবে না। তবে অবশ্যই পুরা অফিসিয়াল ভাষ্য না আসা পর্যন্ত আপাতত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।