ভারতের গরু মুসলমানেরা খেলে অস্বস্তি লাগার মানসিক অসুস্থতা


ভারতের গরু মুসলমানেরা খেলে অস্বস্তি লাগার প্যাথলজি

গৌতম দাস
০৩ অক্টোবর ২০১৫

http://wp.me/p1sCvy-c8

বাংলাদেশের এবারের কোরবানি এক বিশেষ ধরণের নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। ভারতীয় গরু ছাড়া বাংলাদেশের কোরবানির ঈদ কাটানো কি সম্ভব নয়! ব্যাপারটা সাহসের সাথে এর আগে পরীক্ষা করে দেখা হয় নাই কখনও। সুযোগ হয় নাই তাই। এবার সে সুযোগ পাওয়া গেছে; এবং ভারতীয় গরুর তেমন সরবরাহ ছাড়াই এবার আমাদের কোরবানির ঈদ ভালভাবেই কেটে গেল। বাজারে অন্তত গরুর সরবরাহে কোন সঙ্কট দেখা যায় নাই। ফলে সবার এবারই এ’এক প্রথম অভিজ্ঞতা। প্রমাণ হয়েছে এটা কঠিন কিছু নয়। বরং ভারতের “গরু অবরোধ” শাপে বর হয়েছে বলতে হবে। এমনটাই হওয়ারই কথা ছিল।

গত ৪ মার্চ ২০১৫, ভারতে গরু জবাইবিরোধী এক আইন জারি করা হয়েছে। কথাটা বললাম বটে, পাবলিক পারসেপশনও অনেকটা এরকম। তবু কথাটা ঠিকঠাক শুদ্ধভাবে বলা হয় নাই। আইনটা সারা ভারতের উপর বলবৎ হওয়া কোন আইন নয়। মানে কেন্দ্রীয় মোদীর সরকার বা ভারতের জাতীয় সংসদ এমন কোনও আইন পাস করেনি। আইনটা পাস করেছে শুধু মহারাষ্ট্র রাজ্যের প্রাদেশিক সরকার (মুম্বাই যার রাজধানী)। ফলে আইনত তা ভারত জুড়ে নয়, শুধু মহারাষ্ট্র রাজ্য সীমানার মধ্যে এর আইনি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হয়েছে। এতে (ছোঁড়া, বুড়া, বকনা, বাছুর, ষাড়, বলদ, গাভী ইত্যাদি) সব ধরণের গরু জবাই করা, জবাইয়ের জন্য বহন করা, মাংস দখলে রাখা, জবাইয়ের জন্য অন্য রাজ্যে বহন করে নেয়া অথবা জবাই করে নিয়ে আসা ইত্যাদি সবই ক্রিমিনাল অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; যার শাস্তি ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের জেল অথবা ১ থেকে ১০ হাজার রুপি জরিমানা। এছাড়া এ অপরাধে মামলা হলে সেটা অজামিনযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।

মহারাষ্ট্রে জারি ঐ আইনের নাম “মহারাষ্ট্র এনিমেল প্রিজারভেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৯৫”। অ্যামেন্ডমেন্ট অর্থাৎ এটা আগের কোনো আইনেরই একটা সংশোধিত রূপের আইন। হ্যাঁ তাই। সর্ব প্রথম এমন আইনটা করা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। কংগ্রেস দলের শঙ্কর রাও চৌহানের সরকারের সময়, যেসময় কেন্দ্রে কংগ্রেসের জরুরি আইন জারি করে ইন্দিরা গান্ধীর শাসন চলছিল। তবে রাজ্যে কংগ্রেসের হাতে আইনটা পাস করার কার্যক্রম কখনোই শেষ হয়নি। এরপরে ১৯৯৫ সালে, ওই আইনটিই আবার তবে এবার বিজেপি-শিবসেনা সরকারের হাতে সংশোধিত করে হাজির করা হয়। সে আইনটিই “মহারাষ্ট্র অ্যানিমেল প্রিজারভেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৯৫”। কিন্তু ভারতের প্রাদেশিক সংসদে মানে, রাজ্য সংসদে কোন আইন পাস হওয়ার পর তার উপর আবার  ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুস্বাক্ষর লাগে,যার পরই সেটা শুধু ওই রাজ্য সীমানায় বলবৎযোগ্য আইন বলে গৃহীত হয়। তাই নানা আইনি টেকনিক্যাল দিক পূরণ করে ভারতের রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে অনুমোদিত হয়ে আসতে আসতে পরের প্রায় ২০ বছর লেগে যায়। বিজেপির নরেন্দ্র মোদি এবার ক্ষমতায় এসেছে গত মে ২০১৪ সালে। আর ওই একই বছরের পাঁচ মাস পরের নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে বিজেপির সরকার আসীন হয়, অক্টোবর ২০১৪ সালে।  এরপর এবারের মহারাষ্ট্র বিজেপির রাজ্য সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতির অনুস্বাক্ষর লাগিয়ে আইনের ফাইল ফেরত আসে মহারাষ্ট্রে। এরপর এই আইনের গেজেট হওয়ার দিনকে মেনে এ আইন ৪ মার্চ ২০১৫ থেকে বলবৎ হয়। তবে দেরি হওয়ার সবটাই টেকনিক্যাল কারণ নয়। টেকনিক্যাল কারণ কথাটা মুখরক্ষার জন্য বলা।

স্পষ্ট করে সরাসরি বললে এ আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়েছে সস্তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে, যেটাকে বলা যায় – কংগ্রেস নাকি বিজেপি, কে কত বড় “হিন্দুত্বের রাজনীতির” দাবিদার এমন দুই খেদমতগারের প্রতিযোগিতা থেকে। এ নিয়েই কংগ্রেস ও বিজেপির বিপদজ্জনক এবং আত্মঘাতী প্রতিযোগিতা। তবে এ্ঘটনার সাধারণ দিকটা হলো, দল দুইটি মুখে যাই বলুক তারা উভয় দলই আসলে “হিন্দুত্বের রাজনীতি” করে, তাই তাদের মূল প্রতিযোগিতা “হিন্দুত্বের রাজনীতি” নিয়ে, কে কত বড় হিন্দুত্বের খেদমতগার তা প্রদর্শন করার প্রতিযোগিতা।  এ আইনটাকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রস্তাব থেকে চূড়ান্তভাবে পাস ও প্রয়োগে যাওয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ এরই এক ভালো প্রমাণ। মনে রাখা দরকার, কংগ্রেসের সরকারের হাত দিয়ে এ আইনের প্রস্তাবনার শুরু। আর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার কর্তৃত্ব প্রেসিডেন্টের, ঘটনাচক্রে তিনিও কংগ্রেসেরই। আর বলা বাহুল্য,এ দুইয়ের মাঝখানের কাজগুলো সে ঘটনাবলি সক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করার ভূমিকায় ছিল বিজেপি। ফলে কেউ কম যায়নি,অন্যের থেকে পিছে পড়েনি, অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছে ও নিয়েছে। তবে রেষারেষিতে প্রতিযোগিতা যেমন থাকে, তেমনি সময়ে ঢিল দিয়ে ফেলে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচিত হয়। দেরি হওয়ার মূল কারণ এখানে। এছাড়া দেরি হওয়ার আর এক মূল কারণ হিন্দু ভোটারদের সহজে মন জয় করার উপায় ব্যবহারে কংগ্রেস বিজেপির চেয়ে পিছিয়ে থাকতে চায় নাই। ফলে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য দল দুটোর হয়ত এ আইন প্রয়োজন; কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের সাথে এর কোনো ভূমিকা নেই। ফলে গণতাগিদ নেই। ফলে কোন তাড়া নাই।

সংসদে কোনো আইন প্রণয়ন করার সময় আইনটা কেন করা দরকার “উদ্দেশ্য কী” তা স্পষ্ট উল্লেখ করতে হয়। এটা বাধ্যতামূলক। বলা বাহুল্য এ আইনটা পাস হয়ে যাবার পরে এখন আইনটি সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে এর সঙ্গে আগে “লিখিত স্পষ্ট উল্লেখ করা” উদ্দেশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। না কংগ্রেস,না বিজেপি যার যার সময়ে আইনটাতে হাত লাগানোর সুযোগ পেয়েছিল; কিন্তু কেউ উল্লেখ করেনি যে, হিন্দুত্বের সুড়সুড়ি দিতে “পবিত্র পূজনীয় গোমাতা রক্ষার প্রয়োজনে” তারা এ আইনটি চাচ্ছেন। যেমনটা এখন ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বরং উভয় দলই উদ্দেশ্যের ঘরে লিখেছিল, “……and preservation of cows, bulls and bullocks useful for milch, breeding, draught or agricultural purpose and for restriction on slaughter for the preservation of certain other animal suitable for said purposes”। সারকথা বাংলায় বললে, গোদুধ পাওয়ার জন্য, চাষাবাদ ও মাল টানাতে বলদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গরু, বলদ, বাছুরসহ সব ধরনের গরুর সংরক্ষণ, সুরক্ষা এ আইনের উদ্দেশ্য। এককথায় কৃষিকাজ, ফলে মানুষের জীবনযাপন সহজ করার জন্য গোসম্পদ রক্ষা এখানে উদ্দেশ্য। আপাত চোখে মনে হতে পারে ভালোই তো “গোমাতা রক্ষার্থের মতলব” এই আসল উদ্দেশ্য তো ভালোভাবেই লুকিয়ে একটা মিথ্যা উদ্দেশ্য দেখাতে পেরেছিল। না,আসলে তা পারেনি। যদি কৃষির প্রয়োজন উদ্দেশ্য হিসাবে দেখানো হয়ে থাকত তবে আইনের মুসাবিদা ভিন্ন রকম হতে হত। যেমন, সব ধরনের গরুর ওপর ঢালাওভাবে এ আইন জারি করা হয়েছে। কিন্তু এমন গরুও তো থাকবে জন্মাবে যে দুধও দেয় না,মালামালও টানে না, আবার বাছুরও না, ফলে মাংসের উৎস হিসেবে ব্যবহার হতে পারে – জন্ম থেকেই এমন মাংসের ক্যাটাগরির গরু তো না চাইলেও কিছু জন্ম নেবে। এছাড়া পরিকল্পিতভাবেই মাংসের উদ্দেশ্যে এমন গরুপালন করলেই বা অসুবিধা কী? এটা তো কোথাও প্রমাণ হয় নাই যে মাংসের জন্য গরু পাললে সে দেশে কৃষিকাজে গরুর অভাব দেখা দিবে। কাগজ কলমে আকার-ইঙ্গিতে এখানে মানে রাখা হয়েছে যেন ভারতের দুই হিন্দুত্বের দলই কৃষিকাজের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে খুবই উদ্বেগ থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আচ্ছা ভারতের কৃষিতে গরুর বড় অভাব চলছে ব্যাপারটা কি সেরকম? কোনো সাপোর্টিং গবেষণা বা তথ্য কী আছে যা এমন অনুমান সমর্থন করে? জানা যায় না। বরং ভারতের কৃষি অর্থনীতির কাছে নিজ দেশে গরু পালন ও বড় করে এরপর সে গরু  বিক্রির জন্য নিকট বিদেশ হিসাবে বাংলাদেশ হল এক বিরাট লোভনীয় বাজার। চাহিদা-যোগানের বাজার অর্থনীতি এই ফেনোমেনায় প্রকাশিত ঘটনা প্রমাণ করে ভারতের কৃষিকাজে গরুর অভাবের কথা দূরে থাক উল্টাটাই প্রমান করে। চাহিদা-বাজার-অর্থনীতিবিষয়ক এ তথ্য মহারাষ্ট্রের জবাই নিষিদ্ধ আইনে “লিখে রাখা” উদ্দেশ্যকে সমর্থন করে না। এছাড়া এমন গরু কি হবে না যার আর দুধ হয় না, হবে না আবার মালামালও তেমন টানতে পারে না; কিন্তু এখনও কয়েক বছর আয়ু আছে সে্সব গরুকে কী করা হবে? যেহেতু মাংসের জন্যও এই গরু বিক্রি নিষেধ ফলে এর মালিক এমন গরুকে হয় কাজকর্ম ছাড়া বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে হবে, নইলে না খাইয়ে মেরে ফেলতে হবে। এটা কেন করতে হবে এসব প্রশ্নের জবাব আইনে প্রদত্ত উদ্দেশ্যের মধ্যে নেই, লুকানো হয়েছে। অর্থাৎ যে ক্যাটাগরির পালিত গরু মাংসের জন্য ব্যবহার হতে পারে সে ক্যাটাগরির গরু প্রসঙ্গে কিছুই না বলে উহ্য রেখে দেয়া হয়েছে। আবার ওদিকে কৌশলে কথার মার প্যাচে “সব ধরনের গরুর উপরে” নির্বিচারে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়েছে- এর ভেতর দিয়ে আইনটির উদ্দেশ্য লুকানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এছাড়া মোদি সরকারের নেতা, মন্ত্রী তো গোমাতা রক্ষার উদ্দেশ্যে এ আইন করা হয়েছে তা খোলাখুলিই দাবি করছে।

ভারতের বিচার ব্যবস্থা বিশেষ করে উচ্চ আদালতে বিচারমান তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক উচুতে, গুণে মানসম্পন্ন। ফলে “পবিত্র পূজনীয় গোমাতা রক্ষার্থে” কথাটা আইনের উদ্দেশ্যের মধ্যে কংগ্রেস বা বিজেপি যে কেউ যদি লিখত তবে ঐ আইন পাস হলেও আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে তা নাল অ্যান্ড ভয়েড মানে বাতিল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অনুমান করা যায়, এ কারণেই দুই দলের নেতাদের সাহসে কুলায়নি আইনটির প্রকৃত উদ্দেশ্যই স্পষ্ট প্রকাশ করে।

কংগ্রেস ও বিজেপিসহ ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা ভারতে গরু জবাইবিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তাঁরা আসলে কি চান এর আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায়। ভারত এক গরুর মাংস রফতানিকারক দেশ – এই তথ্য অনেকের শুনে হয়তো অবাক লাগতে পারে। কিন্তু এটা ফ্যাক্টস। বলা হচ্ছে, ভারত মোট গোমাংস উৎপাদন করে ৩.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন,যার প্রায় ২ মিলিয়ন মেট্রিক টন অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ্য হয়, আর বাকি ১.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন বিদেশে রফতানি হয়। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক অর্ধেক, এটা ২০১২ সালের তথ্য। এ সংখ্যাতেই ভারত বিফ উৎপাদক হিসেবে পঞ্চম আর রফতানিকারক হিসেবে প্রথম স্থান দখলকারী। আবার এই কথাগুলোই দামের অঙ্কে বললে, ২০১৩ সালে বিফ থেকে পাওয়া রফতানির মোট আয় ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিল-নভেম্বর ২০১৪ সালের এ আট মাসে এর আগের বছর ঠিক ওই আট মাসের তুলনায় রফতানি ১৬.৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে,এখানে বিফ বললেও রফতানির অফিসিয়াল ডকুমেন্টে এগুলো “বাফেলো মিট” দেখিয়ে আইনত বৈধ করে নেয়া হয়েছে। কারণ মহিষের মাংসের বেলায় জবাই,বহন,দখলে রাখা সবই বৈধ, কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখন কাগজপত্রে গরুর জায়গায় কেটে মহিষ লিখে রাখা কোনো বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রায় ৪ মিলিয়ন টনের মাংস সমাজ কমিউনিটি থেকে বের করে আনতে গরুর রক্তের নদী না হোক, ড্রেন বা ছোটখাটো অন্তত ডোবা না তৈরি করে তা করা সম্ভব নয়। এছাড়া বলাই বাহুল্য, সমাজের এক বড় অংশকে খোলাখুলি না জানিয়ে এটা করা সম্ভব নয়, অন্তত শহরের কষাই কমিউনিটি আর তাদের মাধ্যমে অন্যরা তো জানবেই। এছাড়া এই বিশাল গোমাংসের রফতানিকারক ভারত, একথা প্রমাণ করে যে,”কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে গোসম্পদ সংরক্ষণ” এটা সাদা মিথ্যা কথা। দেশে গোমাংস ভোগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় পালটা এরই মধ্যে গোমাংসের রফতানির ফিগার বেড়ে যাওয়াতে তা উল্লেখ করে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং মোদির সরকারকে খোঁচা দিয়েছেন।

ভারতের গরুমাংস রপ্তানীর ফেনোমেনাটা বেশ তামাশার। বিশেষ তাতপর্যপুর্ণ। কথাগুলো বলছি কারণ, ভারত গরুর মাংস রপ্তানী করে। এই বাক্যের অর্থ কি? ভেঙ্গে দেখা যাক।  কথাটার অর্থ হল, ভারতের রাষ্ট্র সরকার জনগণ এমনকি মোদীসহ বিজেপি আরএসএস সকলে বলছে বিদেশী মানে যারা আমার রাষ্ট্র সীমানার বাইরে আছেন এমন সকলের খাওয়ার জন্য নিজ হাতে আমার দেশের গরু জবেহ দিতে আমি রাজি। আমি আপনাদের গোমাংস ভক্ষণের আকাঙ্খা লোভ পুরণ করতে চাই। গো-মাংস সরবরাহকারি হতে চাই।  বিদেশের মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য অজানা লোকেদের জন্য আমি মাংস পাঠাতে রাজি। মজার কথা হল, প্রায় ভারতে প্রতিদিন গোমাংস বিষয়ক এক একটা তামাশা আমরা দেখছি। বিজেপি আরএসএস মোদীর মন্ত্রী তামাশা রচনা করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিনই ভারতের গোমাংস রপ্তানী হলেও এনিয়ে এরা সবাই একদম চুপ। এর অর্থ তাতে ভারতের কোন অংশের অস্বস্তি বা খারাপবোধ নাই তাতে, কোন ধর্মীয় বাধা অনুভব নাই। কিন্তু এই মাংস যদি ভারতের মুসলমানেরা খেতে চায় তাহলেই আকাশ ভেঙ্গে পড়বে মনে করা হবে। নিজেদের ধর্ম নষ্ট হচ্ছে মনে করা হবে। হুঙ্কার দেয়া হবে। মুসলমান গোমাংস খেয়েছে এই অভিযোগে খুন হবে। বেশ ইন্টারেটিং। একইভাবে দেখা যাচ্ছে, বিদেশে এই মাংস রপ্তানীতে বিজেপির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এরও কোন আপত্তি নাই। কিন্তু বিদেশ বলতে বাংলাদেশ বুঝান যাবে না। বাংলাদেশে বুঝা গেলে তাঁর ভীষণ আপত্তি। বাংলাদেশে ভারতের গরু আসতে পারবে না। বাংলাদেশের উপর এই আপত্তি কারণ, এই মাংস বাংলাদেশের মুসলমানেরা খাবে তাই। সব আপত্তি কেবল মুসলমান খেলে। এটা কি? এতো দেখি এক প্যাথোলজিক্যাল কেস! মানসিক অসুখ?  অসুস্থ মানুষের চিন্তায় ঘোরতর সমস্যা!
সোজা ভাষায় বললে, এটাই ঘোরতর বর্ণবাদ। এমন মুসলমান বিদ্বেষ এটা জলাতঙ্কের চেয়েও ভয়াবহ, ইসলামোফোবিয়া। আপনারা রপ্তানী করছেন মানে সকলের জন্য নির্বিশেষ নিজ হাতে আপনার গরুমাতা জবেহ করতে দ্বিধা করছেন না। কিন্তু সে গরু মুসলমানে খেতে পারবে না। এই আবদার প্রমাণ করে মুসলমান বিদ্বেষ এই মানুষগুলোকে মানসিক অসুস্থতার কোথায় নিয়ে গেছে! তাই বলছিলাম, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস ও বিজেপির উদ্যোগে গরু জবাইবিরোধী আইনটা খোলাখুলি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া এর আর কোন উদ্দেশ্য কাজ নাই।

পাঠককে আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গোমাংস জবাই, বিক্রি, বহন, দখল ইত্যাদি নিষিদ্ধ আইনটি কেবল রাজ্যের বিষয়, ভারতের সব রাজ্যে বলবৎ হয়েছে এমন নয় বা কেন্দ্রীয় সরকারের আইন নয়। অর্থাৎ মোদি সরকারের আইন নয় এটা। মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বহু লেখায় বলে আসছি যে,  মোদির দল বিজেপির মুসলমান বিদ্বেষী এবং প্রায়শই বর্ণবাদী হয়ে ওঠা বক্তব্য দিলেও মোদীর সরকারের এসব দায় না নিয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। মোদী বিজেপি দলের কর্মসূচিগুলো যেমন ‘ঘর ওয়াপসি’ সঙ্গে তাঁর সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই এমন যোগাযোগহীন অবস্থা দেখিয়ে রাখতে চেয়েছে, প্রায়শ সফল হয়েছে। এক সময়ে বিশেষত ক্রিশ্চিয়ান স্থাপনা বা চার্চে আক্রমণ, ঘর ওয়াপসি কর্মসূচির নামে দলের মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও ফোবিয়া ছড়ানোর বিরুদ্ধে মোদিকে প্রকাশ্যে দাঁড়াতে দেখা গেছে। নিজের দলের কর্মসূচি, দলের নেতা, এমনকি আরএসএসের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুশিয়ারি দিতেও আমরা দেখেছি। কিন্তু এরপরেও স্পষ্ট করে বলা দরকার, গরু নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে এসে নরেন্দ্র মোদি পুরোপুরি পরাজিত হয়েছেন ও সারেন্ডার করেছেন। তিনি অবলীলায় এখানে রাজ্য সরকারের গরু জবাই নিষিদ্ধ আইনের পক্ষে খোদ নিজ কেন্দ্রীয় সরকারকে দাঁড় করিয়েছেন। ফলে এবার যেন আর তিনি শুধু বিজেপি নয় একেবারে আরএসএসেরই প্রধানমন্ত্রী মোদি হিসেবে হাজির হয়েছেন।

এর ফলে প্রথমত মোদির কাছে যে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তা হল, এক. তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং কেন সামান্য এক রাজ্য সরকারের গো-জবাই নিষিদ্ধ আইন ও কর্মসূচি ফেরি করতে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের কাছে এলেন? অথচ রাজ্য সরকারের কোনো কাজ, আইন বা নীতির দায় কোনোভাবেই কেন্দ্রের সরকারের নেই, কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। ফলে মোদি সরকার মনে করলেও বা দাবি করলেও আইনত তার কোনো গো-জবাই নিষিদ্ধ আইন বলে কিছুই নেই। অথচ অনুমানে ধরে নেয়া হয়েছে যেন কেন্দ্রীয় সরকারের এমন এক কল্পিত আইন আছে। ফলে কল্পিত গো-জবাই নিষিদ্ধ কর্মসূচি অনুযায়ী বিএসএফকে পরিচালিত হতে তিনি নির্দেশমূলক বক্তৃতা দিয়েছেন। অথচ এমন আইন তার বাস্তবে সরকারের নয় বলে তার সরকারের এ বিষয়ে বাংলাদেশকে জানানোরও কিছু নেই, তিনি কখনোই জানাননি। অথচ সীমান্তে এসে রাজনাথ বাংলাদেশের মানুষকে কীভাবে গরুর মাংস না খাইয়ে মারবেন, মুসলমান বিদ্বেষমূলক দামামা তিনি বাজালেন। তিনি বললেন, “বাংলাদেশে গরুর দাম যেন এত বেড়ে যায় যে, বাংলাদেশের মুসলমানরা গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়। এমন ব্যবস্থার পক্ষে বিএসএফকে তৎপর হতে হবে”। মানবজমিন বলছে, ভারতের এক সচিব নাকি বলেছে তাদের সিদ্ধান্ত বদলাবার কোন সম্ভাবনা নাই।

শকুনের বদদোয়ায় গরু মরে না। তাহলে তো শকুনের খাদ্য হতে মৃত গরুতে ভাগাড় ভরে উঠত। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের তামাশার গরু অবরোধের মধ্যে বাংলাদেশের এবার প্রথম এক কোরবানির ঈদ কাটল। নিঃসন্দেহে এক নতুন অভিজ্ঞতা। শুধু অর্থনীতির চোখে দেখলে আমাদের এ ঈদটা হল, মূলত শহুরে ক্রেতা বনাম গরুর ব্যবসায়ী এ দুইয়ের পরস্পর পরস্পরের ওপর সুবিধা নেয়ার জন্য বাজারের খেলা। শেষের দিনগুলোতে এটা এমনকি ঘণ্টায় ঘণ্টায় সিচুয়েশন কার পক্ষে যাবে কে কার ওপর কিছুক্ষণ সুবিধা পাবে এরই লড়াই। ফলে এটা এক বাজার এবং দরকষাকষি। কারণ, একমাত্র বাজারই সাব্যস্ত করে দিতে পারে ব্যবসায়ীর জন্য গরুটার সর্বোচ্চ দাম সে কত পেতে পারে। আবার ক্রেতার দিক থেকে সবচেয়ে কত কম দামে সে গরুটা কিনে বাসায় যেতে পারে। অতএব ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য সাম্যবস্থার সেই অপটিমাম পয়েন্টটা কোথায় এরই খোঁজাখুঁজি চলে সেখানে। এটাকেই আমরা বাজার ও দরকষাকষি বলি। আর দরকষাকষি ছাড়া তা জানার আপাতত আর সহজ উপায় কই? তবে বাজারটা একপেশে যাতে না হয়ে যায় সেজন্য এমন পর্যাপ্ত ক্রেতা এবং বিক্রেতা যেন হাজির থাকে এটা নিশ্চিত করার এক ভূমিকা সরকারের আছে।

তাহলে মূল জিনিসটা হলো বাজার। রাজনাথসহ বিজেপির বন্ধুদের রাজনীতির সারকথা মুসলমান-বিদ্বেষ এছাড়া আর কিছু নয়। এরা যদি বাজারবিষয়ক কিছু কথা শিখে রাখতে পারতেন তাহলে হয়তো নিজেরা বেঁচে যেতেও পারেন। আমাদেরও উদ্ধার করতেন। বাজারই ঠিক করবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং নয় যে আমাদের গরু খাওয়া বন্ধ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু কত দামে খাব। নিশ্চিত করে বলা যায় আমরা খুব সফল ভাবেই কোরবানী কেন্দ্রীক গরু পালা, বিক্রি, কোয়ালিটি নিশ্চিত, বাজারেরও লোভনীয় দাম পাওয়া এবং কমপক্ষে চামড়া শিল্প পর্যন্ত এই অর্থনীতির সবল বিস্তৃতি ঘটবেই।

বাংলাদেশ ভারতের জন্য গরু বিক্রির বাজার এ কথাটার অর্থ হল, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে গরুর উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম, যদিও কোয়ালিটির প্রশ্ন আছে তবুও সাধারণভাবে বলছি। বাংলাদেশে গরুর সমতুল্য ভিন্ন জিনিস উৎপাদনের বেলায় আবার সেগুলো গরুর চেয়ে লাভ বেশি। তাই দেশে এখাতে বিনিয়োগ উদ্যোগ সবই গরুর দিকে যায় নাই বা বড় অংশটা গরুমুখী না। এখন ভারত যদি তার পড়ে পাওয়া বাজার হেলায় হারাতে চায় তবে সেটার ফল আমাদের জন্য আখেরাতে ভালো ছাড়া খারাপ হবার কোনই কারণ নাই। কী অর্থে? ভারতের সস্তা গরু আসে বলেই  দেশে গরু পালন তেমন লাভজনক হয় না। ভারতীয় গরু আসেনি, এবার আসবে না, নাও আসতে পারে ইত্যাদি মেসেজের মধ্যে এবারের কোরবানী বাজার-অনিশ্চয়তায় আমরা পার করেছি। এমন মেসেজের ফলে বাজারে এভারেজ গরুর দামের থেকে এবার দাম একটু চড়া গেছে। কিন্তু এতে বাড়তি যে মুনাফাটা এসেছে এটাই বাংলাদেশে গরু পালন-উৎপাদন ব্যবসাকে আকর্ষণীয় করবে। প্রণোদনা হিসাবে কাজ করবে। সেইসঙ্গে জানবাজি রেখে ভারতীয় গরু চোরাচালানে বাংলাদেশে আনার বিপদের দিকগুলো যদি ভারত জারি রাখে তবে এসবের সম্মিলিত ফলাফলে আগামী বছরেই দেশি বাজার বাংলাদেশের গরু আবার দখল করে নেবে। ফলে তা ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দেশের বাজার উদ্ধার করে আনতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা।

যে পর্যায়টা পেরোনো সবচেয়ে কঠিন ছিল তা হল, এবার বাজারটা কী একটু চড়া থাকবে কীনা। থাকলে সামগ্রিক বিচারে তা ইতিবাচক হবে। এবং আমরা তা সফল্ভাবে পেরোতে পেরেছি। বাজার এবারও একটু চড়া গিয়েছে। এটা না হলে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যহীন হয়ে ক্রেতার মর্জির বাজারে হয়ে গেলে সব ক্ষতির ঝড় ব্যবসায়ীর ওপর দিয়ে যেত। তাই বাজার একটু চড়া যাবে এটা কাম্য ছিল। তাই হয়েছে। মিডিয়ার রিপোর্ট হচ্ছে, শেষ দিনের দিকে হাটে গরুর অভাব বোঝা যাচ্ছিল, ফলে বাজার বিক্রেতার পক্ষে সরে গিয়েছিল। এ ফেনোমেনাটা দেশি গরুপালক ও ব্যবসায়ীদের জন্য আগামীতে বিরাট প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে তথা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

[এই প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা আগের দুটা আলাদা ভার্সন ছাপা হয়েছিল দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় গত ০২ অক্টোবর এবং দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় ০৪ অক্টোবর সংখ্যায়।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s