১. ল্যাণ্ড-লকড নেপালঃ অতীত ও বর্তমানের ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা


১. ল্যাণ্ড-লকড নেপালঃ অতীত ও বর্তমানের ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা
 গৌতম দাস

 [এখানে তুলে আনা আমারই লেখা  আগে ১১ অক্টোবর ২০১৫ ছাপা হয়েছিল চিন্তা ওয়েব পত্রিকায়। এখানে হুবহু কাট পেস্ট করে তুলে আনা হয়েছে – কপি সংরক্ষণের জন্য আর আমার এখানের পাঠকদেরকেও জানানোর জন্য। ]

নেপালি জনগণের নতুন গঠতন্ত্র প্রণয়ন এবং গঠনতান্ত্রিক সভায় তা অনুমোদন ও গ্রহণ নেপালের প্রতি বাংলাদেশে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। নেপালের জনগণ সম্পর্কে জানা এবং বোঝা বাংলাদেশের জন্য জরুরী। লেখা কোথা থেকে শুরু করতে হবে সে এক জটিল বিষয়। নেপাল প্রসঙ্গের ডাইমেনশন অনেক। অনেক দিক থেকে প্রসঙ্গ তুলে কথা বলতে হবে। আবার সব মিলিয়ে এক সামগ্রিক অর্থপুর্ণ চিত্র সাজিয়ে তোলা দরকার। কোন বিষয়ের পরে কোন বিষয় কতোটুকু আসবে সেটাও গুরুত্বপুর্ণ। সেসব নিয়ে তথ্য জোগাড় করা, চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে আসা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সর্বোপরি কিভাবে আনলে তা সহজে বাংলাদেশের পাঠকের বোধগম্যতায় আনা যাবে সেই বিষয়েও ভাবনার দরকার আছে। নেপাল নিয়ে বিভিন্ন বিষয় ধরে ধরে আলোচনা এখানে আলাদা আলাদা কিস্তি হিসাবে পেশ করা হচ্ছে।

নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সরাসরি তার ভূগোল অর্থাৎ ল্যান্ডলক হবার সঙ্গে জড়িত। ল্যান্ড-লকড হবার কারনেই নেপাল পড়শি রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে এক প্রকার অদৃশ্য অথচ ব্যবহারিক-বাস্তবিক অর্থেই কলোনী বা ঔপনিবেশিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। নেপালের জনগণের লড়াই সে কারণে নেপালের ভৌগলিক অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত ঔপনিবেশিক সম্পর্ক থেকে মুক্তির লড়াই — অসম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে মুক্ত হতে চাওয়ার আদর্শ উদাহরণ।

জাতিসংঘের অধীনে এমন রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষার পক্ষে আন্তর্জাতিক আইন কনভেনশন প্রণয়ন ও কর্মসুচী গ্রহণের উদ্যোগ চলছে। জাতিসংঘের আঙ্কটার্ড এর অধীনে নিবন্ধিত এমন ল্যান্ডলক রাষ্ট্রের সংখ্যা ৩১ টা। আঙ্কটার্ডের অধীনে ২০১৪-২৪ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে এমন কিছু প্রোগ্রাম আছে। নেপাল ইতোমধ্যেই ঐ কর্মসুচী নেপালে বাস্তবায়নের দাবী তুলেছে, আন্তর্জাতিক সংগঠনের দৃষ্ট আকর্ষণ করেছে।

নেপাল ও ভারতের বিরোধ বৃটিশ কলোনী মাস্টার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল থেকে। আর এর উৎস হচ্ছে নেপাল ‘ল্যান্ডলক’। ভূমিবেষ্টিত। ফলে অন্য দেশের ভিতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া সরাসরি সমুদ্রে বা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের কোন উপায় তার নাই। তাই ল্যান্ড লক কথাটার সহজ অর্থ হচ্ছে যে দেশের সমুদ্র বন্দর নাই। এই বাস্তবতায় থেকে মুক্তি চাওয়া থেকেই ভারতের সঙ্গে নেপালের সংঘাতের সূত্রপাত। ভূগোল কিভাবে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে নেপাল তার ভাল একটি নজির। ফলে ভারত যতই অসংখ্য রাজার রাষ্ট্রের বদলে সংগঠিত একক কোন কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে বড় রাষ্ট্র হয়ে হাজির হয়েছে ততই সেই একক ভারত নেপালকে ল্যান্ডলক দেশ হিসাবে হাজির করেছে। আর নেপালকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেবার বিনিময়ে নিজের ‘করদ’ রাজ্যে পরিণত করে রাখার সুযোগ বেড়েছে, বা রাখা সহজ হয়েছে। মোগল আমলে অবশ্য এমন সমস্যার কথা জানা যায় না।

ভারত ১৭৫৭ সালে বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে দখল ও গোলাম হয়ে যাবার পর থেকে এর প্রভাব নেপালের উপর হয় মারাত্মক। নেপাল ও বৃটিশদের (ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর) যুদ্ধ যা এংলো-নেপালিজ যুদ্ধ নামে খ্যাত তা চলেছিল ১৮১৪-১৬ সাল, দুবছর ধরে। যুদ্ধের ফলাফল কোম্পানীর পক্ষে যায়। ফলে এই যুদ্ধ শেষে বাস্তবে করদ রাজ্যের মত বৃটিশদের সাথে চুক্তির কিছু শর্ত সাপেক্ষে নেপালকে সীমিত স্বাধীনতা মেনে নিতে হয়। এই চুক্তির নাম সুগৌলি চুক্তি ১৮১৬ (Treaty of Sugauli)। এটা নেপালকে “ভাগ করে নেয়ার চুক্তি” বলেও পরিচিত। কারণ ঐ চুক্তি অনুসারে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নেপালের ভুমি — বিশেষত যেগুলো কোম্পানীর চোখে ষ্ট্রাট্রজিক গুরুত্বসম্পন্ন বলে মনে করা হয়েছিল সে ভুমিগুলো বৃটিশ-ভারতের সাথে রেখে দেওয়া হয়। যেমন দার্জিলিং, সিকিম, পুরানা কুমাউন রাজত্ব, গোড়য়াল রাজত্ব, আজকের উত্তর ভারতের মিথিলা, নৈনিতাল এবং আজকের নেপালের হটস্পট দক্ষিণে সমতলী তরাই এলাকার বেশীর ভাগ অংশ – নেপালের এইসব এলাকা।

Sanguli

এছাড়া নেপালের গোর্খা অঞ্চল থেকে কোম্পানী নিজের সেনাবাহিনীর জন্য অবাধে জনবল সংগ্রহ করতে পারবে, কোম্পানী ছাড়া আর কোন পশ্চিমা নাগরিকের নেপালে আনাগোনা্র উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় – এগুলো শর্তও ছিল।

বৃটিশ কোম্পানীর প্রবল ক্ষমতা ও আধিপত্যের মুখে নেপালের রাজা তোষামোদীর ছলে বৃটিশ নীতি সমর্থন করে তাদের খুশি করার বিনিময়ে নিজের কাজ উদ্ধার করার রাস্তা ধরেছিল। ফলে পরবর্তিতে ১৮৫৭ সালে বৃটিশ-ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের সময় নেপালের রাজা কোম্পানীর পক্ষে অবস্থান নেয়। বিদ্রোহ দমন শেষে এতে খুশি হয়ে বৃটিশ কোম্পানী (ততদিনেবৃটিশ-রাজ শাসক সরাসরি কোম্পানী অধিগ্রহণ করে নেয়) নেপালের পুরা এক তৃতীয়াংশ ফেরত নেয়, তবে ব্যাঙ্কে, বারদিয়া, কাইলালি, কাঞ্চনপুর এসব আগের নেপালের জেলা ও এভাবে তড়াই সহ কিছু অঞ্চল নেপালী রাজাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তা সত্ত্বেও সিকিম এতে অন্তর্ভুক্ত নয়।

এভাবে পরবর্তিতে ১৯২১ সালে আরও কিছু ছাড় আদায়ের পরিস্থিতির উদয় হয়। মূলত সেটা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ সরকারকে নেপালের রাজার দেয়া সমর্থন ও সার্ভিসের কারণে। ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালে “নেপাল-ভারত চুক্তি ১৯২৩” স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি আগের সুগৌলি চুক্তিকে প্রতিস্থাপিত অর্থে বাতিল করছে বলে লেখা হয়েছিল। সাত দফার এই চুক্তিতে প্রথমেই নেপালকে স্বাধীন দেশ বলে মেনে নেওয়া হয়। বৃটিশদের সাথে আগের সমস্ত চুক্তির বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। অর্থাৎ এখন থেকে একমাত্র চুক্তির বাঁধন ১৯২৩ সালের চুক্তি। এর দ্বিতীয় দফা বলছে, বৃটিশ-ভারতের স্বার্থহানি ঘটে এমন অবস্থা দেখা দিলে তা আগাম বৃটিশদেরকে নেপাল জানাবে যাতে এথেকে কোন সংঘাত বা ভুল বুঝাবুঝি তৈরি না হয়। একে অপরের নিরাপত্তার দিক খেয়াল রেখে অন্যের ভুমি ব্যবহার করবে। অর্থাৎ নেপালের আলাদা স্বাধীন কোন নিরাপত্তা নীতি থাকতে পারবে না। নেপাল ভারতের ভিতর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ যে কোন মালামাল আমদানী করতে পারবে – যতক্ষণ বৃটিশ-ভারত মনে করবে নেপালের আচরণ বন্ধুত্বপুর্ণ এবং ভারতের জন্য তা হুমকি নয়। মালামাল আমদানিতে ভারতের বন্দর ব্যবহারের সময় ভারত সরকার আবার এর উপর কোন শুল্ক আরোপ করবে না, অবাধে কেবল বন্দর ফি দিয়ে নেপাল যে কোন পণ্য আমদানি করতে পারবে। এই ছিল চুক্তির সারকথামূলক দিক।

অর্থাৎ ১৯২৩ সালের এই চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে ইতোমধ্যে বৃটিশ স্বার্থের পক্ষে সবসময় নেপালের রাজার অবস্থান নেয়া এবং সার্ভিস খেদমতে সন্তুষ্টি হবার পরই এবার ল্যান্ডলক নেপালের স্বার্থের ব্যাপারে কি করা যায় এটা এখানে এবারের চুক্তিতে মুখ্য হয়ে ভেসে উঠতে পেরেছে। এই চুক্তির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল – আগের দিনের করদ রাজ্য বা প্রিন্সলি ষ্ট্রেটের ধরণটা হত – প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় দুটাকেই বৃটিশ কলোনী মাস্টারের হাতে ছেড়ে দেওয়া; আর সাথে কিছু রাজস্ব শেয়ার করা। এই দুটো করলে তবেই বৃটিশ আমলে করদ রাজ্যের রাজা হয়ে থেকে যাওয়া যেত। কিন্তু ল্যান্ডলক নেপালের রাজার বেলায় বৃটিশরা যে ফর্মুলা অনুসরণ করেছিল তা হল, সাধারণভাবে “মাস্টারের সন্তুষ্টি” সাপেক্ষে রাজার দেশ সবই করতে পারবে। এভাবে বলার সুবিধা হল, অসন্তুষ্টির [এই আবছা অস্পষ্ট গ্রে এরিয়ার সুযোগে] কথা বলে যে কোন প্রদত্ত সুবিধাই যে কোন সময় প্রত্যাহার করে নেয়া যায়।

সামগ্রিকভাবে এভাবেই নেপাল বৃটিশ মুখাপেক্ষি থেকে যায়। অন্যদিকে আবার বৃটিশ-ভারতের ভুমি ব্যবহার করে নেপালের বাইরের সাথে সব ধরণের যোগাযোগের অধিকার বৃটিশ কলোনী মাস্টার নিজে একেবারে যেচে না চাইতেই চুক্তিতে উন্মুক্ত করে রেখেছিল। বৃটিশদের এতে সুবিধা হল, বিনিময়ে নেপালের সর্বত্র ভারতের বিচরণের সুযোগ অবধারিত হয়ে যায়। অথচ নেপালের দিক থেকে দেখলে ভারতে প্রবেশ এবং ব্যবহারের সব সুবিধা থাকা নেপালের রাষ্ট্রস্বার্থ হিসাবে জরুরি না হলেও এবং নিজের পক্ষে তা কাজে লাগাতে অক্ষম হলেও তা তাকে নিয়েছি বলতে হচ্ছে। কিন্তু সমতুল্য সুযোগ ভারতকে দিতে হচ্ছে। এই সুযোগে ভারতের একচেটিয়া বাজারে পরিণত হওয়া ছাড়া নেপালের আর কোন গতি থাকছে না।

দুনিয়ায় এখন জাতিসংঘ আছে, এই কালে কোন রাষ্ট্রকে কলোনী করে রাখা কোন দখলদারের পক্ষে খুব আরামের বা সুখকর অনুভুতি নয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্যাপারটা এমনকি ন্যায্য বলেও এক ধরণের সম্মতি পেতে দেখা যেত। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কলোনী যুগের বিচারে ১৯২৩ সালের চুক্তিটা নেপালের আগের যে কোন চুক্তির চেয়ে্ তুলনায় কাম্য ছিল। কিন্তু এখনকার বিচারে এটা একেবারেই কাম্য নয়।

ঐ চুক্তিতে কবে এর কার্যকারিতা শেষ হবে এমন তারিখ উল্লেখ করা ছিল ৩১ জুলাই ১৯৫০। বৃটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে চলে গেলে স্বভাবতই চুক্তির আইনী দায় এবং দায়িত্বের মালিক হয় নেহেরুর ভারত। কিন্তু নেহেরুর গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত নিজের জন্য কলোনীতন্ত্র উৎখাত হয়ে যাবার ষোল আনা সুবিধা নিলেন। কিন্তু নেপালের বেলায় সেটা হতে দিলেন না। নেপালের কলোনী মাস্টার হিসাবে বৃটিশের জায়গায় নেহেরুর ভারতকে বসিয়ে নিলেন। ফলে বৃটিশ কলোনী নেপালের সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে যে নীতিগত দিক অনুসরণ করেছিল সবজায়গায় সেটাই হুবহু নীতি নেহেরুর ভারত অনুসরণ করেছিল। নেপালকে গণপ্রজাতন্ত্রী-ভারতের কলোনী করে রাখার কোন সুযোগ নেহেরু হারাতে চান নাই। তাই পুরাণ চুক্তির নীতিগত আদলে নতুন করে “১৯৫০ জুলাইতে ভারত-নেপাল তথাকথিত মৈত্রী ও বন্ধুত্ব চুক্তি” করা হয়। এবার চুক্তিতে দশটা পয়েন্ট। কিন্তু সার কথা হল একই – সন্তুষ্টি বা ভারতের নিরাপত্তার কথা তুলে নেপালকে ভারতের মুখাপেক্ষি করে রাখা। যেদিকটা মাথায় রেখে চুক্তির খসড়া করা হয়েছে তা হল, নেপালের কোন স্বাধীন পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা বা অর্থনীতি – এককথায় কোন স্বাধীন নীতিই যেন সম্ভব না হয়। নেপাল যেন ভারতের মুঠো থেকে বেরিয়ে না যায় – যেটা কলোনি আমলে করদ রাজ্যের বেলায় অনুসরণ করা হত। মোটাদাগে বললে, ১৯৫০ সালের চুক্তি পুরানা ১৯২৩ সালের চুক্তিরই প্রতিচ্ছবি। কেবল “বৃটিশ” এই শব্দের জায়গায় যেন ভারত বসানো। প্রথম পাঁচ দফাও প্রায় হুবহু এক। নেপাল বাইরে থেকে অস্ত্র ও যুদ্ধের মালামালসহ যেকোন মালামাল আনার অনুমতি প্রসঙ্গে পুরান চুক্তিতে বৃটিশ “সন্তুষ্টির” কথা বলা হয়েছিল। এখানে কায়দা করে বলা হয়েছে সবই আনতে পারবে। কিন্তু কি ব্যবস্থাপনায় তা আনতে পারবে তা চুক্তিতে স্পষ্ট বলা নাই। সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে সেটা চুক্তির বাইরে প্রত্যেক কেস ভিত্তিতে দুই দেশ বসে ঠিক করবে। অর্থাৎ এখানে এটা আরও অনিশ্চিত করে রাখা হয়েছে। কোন সাধারণ নীতি এখানে লিখিত না থাকায় সাধারণভাবে অনুসরণযোগ্য কোন নীতি না লিখে রাখার সুযোগ এখানে নেওয়া হয়েছে; ভারতের সঙ্গে নতুন চুক্তি আগের চুক্তির বৃটিশ “সন্তুষ্টির” চেয়েও বড় বাপ হয়ে আছে।

অথচ মূল কথা হল, নেপালের মূলত দরকার সমুদ্র বন্দরে প্রবেশাধিকার এবং সে বন্দর থেকে নিজের ভুসীমান্ত পর্যন্ত সে মালামাল নিয়ে আসা বা পাঠানোর অধিকার। অথচ চুক্তিতে তাকে দেয়া হয়েছে – ভারতে বসবাস, সেখানে সম্পত্তি কেনা, ব্যবসা করা ইত্যাদির অবাধ অধিকার – এগুলো নেপাল চায় নাই, তার জন্য জরুরিও নয়। এগুলো নেপাল কাজে লাগাতে না পারলেও বা কাজে না লাগলেও নেপালকে দেয়া হয়েছে। ভ্রত চেয়েছে এগুলো চুক্তির কাগজে লেখা থাকুক। তাহলে পালটা বিনিময় অধিকার হিসাবে নেপালকে ভারতীয়দের জন্যও এসব সুবিধাগুলো উন্মুক্ত অবারিত করে দিতে হবে। আর কে না জানে ভারতের অর্থনীতির সাইজ সক্ষমতা অগ্রগতির তুলনায় নেপালের অর্থনীতি নস্যি। ফলে উন্মুক্ত নেপালে পাওয়া সুযোগ ভারতীয়দের নেয়ার সক্ষমতা নেপালকে সমান সুযোগ ভারতে দিলেও এর সুবিধার নেপালীরা নিতে সক্ষম নয়, পারবে না। পাল্লা ভারতের দিকেই যাবে। ফলে ভারতের অর্থনীতির অধিনস্ত হয়ে ভারতের অনুগ্রহের অর্থনীতি হওয়াই নিবার্য ভাবেই নেপালের ভাগ্য হবে।

এছাড়া ওদিকে দফা নম্বর ছয় নেপালের জন্য ভয়ঙ্কর। বলা হচ্ছে ভারতীয়দেরকে নেপালে ব্যবসা করার জন্য নেপালীদের মতই সমান “ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট” দিতে হবে। যেমন কোন ব্যবসায় ব্যাংক নেপালী ব্যবসায়ীকে ঋণ দিলে একই সুবিধা ভারতীয় ব্যবসায়ীকেও দিতে হবে। স্বভাবতই এর পালটা নেপালীরা একই সুবিধা ভারতে পেলেও এই বিনিময় সুবিধা নেপালীরা কাজে লাগাতে সক্ষমই নয় এখনও। ফলে সমান “ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট” বিষয়টা নেপালীদের বিরুদ্ধেই যাবে। এছাড়া সবচেয়ে বড় কথা এই “ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট” বিনিময় করা তো নেপালের উদ্দেশ্য বা দরকার ছিল না। নেপালের দরকার নিজেকে ল্যান্ডলক মুক্ত করা।

ভারতের ভিতর দিয়ে নেপালের সমুদ্র বন্দরে প্রবেশাধিকারের সমতুল্য সুবিধার বিপরীত হতে পারে নেপালের ভিতর দিয়ে ভারত কোথায় যেতে চাইলে একই সুযোগ। কেবল ততটুকু। যদিও স্বভাবতই ভারত তখন প্রশ্ন তুলবে ঐ সুবিধা ভারতের জন্য জরুরি নয়। তবে ভারত যদি এই যুক্তি দিতে চায় যে নেপালকে অবাধে প্রবেশ ও যাতায়াতের সুবিধা দিবার মোট বিনিময়মুল্য হল সারা নেপালকে ভারতের কাছে বন্ধক থাকতে হবে – এটাও খারাপ হয় না। কারণ নেপালকে প্রবেশাধিকার দিলে ভারত এখানে নেপালে নিজের ব্যবসায়িক সুবিধা হারায়। তাই এসব কিছু এর কাফফারা। এটা খুবই ভাল কথা। তাহলে স্বভাবতই বাংলাদেশের কাছে থেকে ট্রানজিট আদায়ের সময়ও তো ভারতের এই নীতিই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। ভারত কি সেক্ষেত্রে রাজি হবে? অর্থাৎ নেপালকে চাপে ফেলে নিজের আজ্ঞাবহ রাজ্যই বানিয়ে রাখতে চায় ভারত – ঠিক তেমন?

হাসিনার আমলে ভারতের সাথে চুক্তিতে যেমন ট্রানজিটের বেলায় অহেতুক ভারতকে দেয়া সুবিধার বিপরীতে রেসিপ্রোকাল সাম্যের উছিলায় বাংলাদেশকেও সুবিধা দেয়ার কথা লেখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কাছে সেসব সুবিধা নিজের কাজে লাগানোর সুবিধা নয় মোটেও।

এসব বিষয়গুলো নিয়েই মাওবাদীদের ৪০ দফায় প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে যে ৪০ দফা দাবিতে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল সেখানে এসব প্রশ্ন তুলে ১৯৫০ সালের চুক্তি বাতিলের কথা লেখা আছে। এছাড়া মাওবাদীরা ভারতকে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের বিরুদ্ধে প্রধান শত্রু মনে করে। ভারতকে সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের দোসর বলে আখ্যায়িত করেছিল।

এদিক থেকে দেখলে নেপালের জনগণের সব সংগ্রামের সারকথা ল্যান্ডলক দেশ হবার অভিশাপের কারণে ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্তির উপায় খুজে ফেরা। অমীমাংসিত সেই লড়াইয়ের ছায়াতেই নেপালের উপর ভারতের চলতি অবরোধ আরোপ এবং তা নেপালের জনগণের মেনে না নেওয়ার সংগ্রাম। ফলে একদিক থেকে যেটাকে রাজতন্ত্র উৎখাতের সংগ্রাম বলে মনে হয় সেটাই আবার অন্যদিক থেকে ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্তির সংগ্রাম।

মাওবাদীরা ২০০৮ সালে প্রথম সরকার গঠন করার পরে এবিষয়ে একই মুল্যায়নে ও অবস্থানে থাকতে পারে নাই। দল তিনভাগ হয়ে গিয়েছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

২. নেপালি মাওবাদ ও গণরাজনৈতিক পরিসর নির্মানের চ্যালেঞ্জ
গৌতম দাস

[এখানে তুলে আনা আমারই লেখা  আগে ১১ অক্টোবর ২০১৫ ছাপা হয়েছিল চিন্তা ওয়েব পত্রিকায়। এখানে হুবহু কাট পেস্ট করে তুলে আনা হয়েছে – কপি সংরক্ষণের জন্য আর আমার এখানের পাঠকদেরকেও জানানোর জন্য। ]

নেপালে রাজতন্ত্রের পতন ও উৎখাতের ঘটনা ২০০৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু। প্রথম চোটে রাষ্ট্রের  সেনাবাহিনী ও পুলিশকে রাজার অধীনস্থতা ও নির্দেশে পরিচালিত হবার আইন বাতিল করে তাদেরকে জাতীয় সংসদ, অর্থাৎ জনগণের অধীনে আনা হয়। এটা ছিল এর আগে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলা ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (UCPN) বা যারা পপুলারলি মাওবাদী (Maoist) বলে পরিচিত তাদের সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল।

নেপালের মাওবাদীরা  ১৯৯৬ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে নেপালের তৎকালীন সরকারের কাছে ৪০ দফা দাবীনামা পেশ করে। সরকারকে তারা জানিয়েছিল, যদি এই দাবি মেনে না নেওয়া হয়, অর্থাৎ  আগামি দুসপ্তাহের মধ্যে  দাবি না মেনে নেবার  ইঙ্গিত দেখলে  সেক্ষেত্রে উপস্থিত রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে আমরা বাধ্য হব”। লিখিত এই পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন মাওবাদী পার্টির দ্বিতীয় নেতা বাবুরাম ভট্টরায়। তিনি ছিলেন মূলত  মাওবাদী সহ কয়েকটি ছোট দলের জোট “ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট” এর তৎকালীন চেয়ারম্যান। আর তখন মাওবাদী পার্টির চেয়ারম্যান হলেন পুস্পকমল দাহাল, দলে যার পরিচিতি  নাম ‘প্রচণ্ড’।

সুতরাং নেপালে রাজতন্ত্রের উৎখাত এক সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিণতি। লেনিনের ধ্রুপদি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণার আলোকে  নেপালের রাজনীতিতে কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলি – অর্থাৎ রাষ্ট্রগঠনের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সভায় নেপালের জন্য একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের ধারণা নিয়ে আসেন মাওবাদীরা। সশস্ত্র সংগ্রামের সফলতার এক পর্যায়ে কিভাবে বিপ্লবী অর্জনকে রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের রাজনীতিতে রূপান্তর করতে হয় নেপালের মাওবাদ সেই দিক থেকে বিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নজির। এখানেই নেপালের মাওবাদের বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও সঠিক সময়ে কৌশলে আগু-পিছু করে নেয়ার দিক থেকেও মাওবাদীরা বিভিন্ন সময় খুব ফলপ্রসূ নীতি পদক্ষেপ নিতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। 

যেমন ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে “আর্মড পুলিশ ফোর্সের” আইজিকে এক মাওবাদী অপারেশনে হত্যা করা হয়। নেপালের আর্মড পুলিশ ফোর্স আমাদের র‍্যাব এর সমগোত্রীয়। মাওবাদীদের দমনে এটা আলাদা করে গঠন করা হয়েছিল ২০০১ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু এর পরেও পরিস্থিতির উপর মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ বহাল ছিল। দেখা যায় এঘটনা সত্ত্বেও পরে মে মাসে সরকারের সাথে সাময়িক অস্ত্রবিরতিতে তারা আসতে পারছে। অস্ত্রবিরতির কোড অব কনডাক্ট সম্পন্ন করতে পারছে। আবার খুব সফলতার সাথে তারা ঠিক সময়ে একতরফাভাবে অস্ত্রবিরতি ভেঙেও দিয়েছে, অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের শক্তি প্রদর্শন ও সমঝোতার দুই নীতিই কাংখিত রাজনৈতিক ফলাফল আদায় করে নেবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছে। সমরক্ষেত্র ও রাজনীতির ক্ষেত্র দুই ক্ষেত্রেই লড়াই চালিয়েযেতে পেরেছে।  তারপরও নেপালের মাওবাদ সম্পর্কে বিস্তর সমালোচনা-পর্যালোচনা হতে পারে। তাদের সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান নেওয়া দরকার। তবে এখানে আমরা তার সফলতার মধ্য দিয়ে যে বৈশিষ্ট্যসূচক দিক ফুটে উঠেছে সেই দিকেই নজর দেবো। এর কারণ নেপালের জনগণের লড়াই সংগ্রাম থেকে শিক্ষণীয় সারবস্তু বের করে আনাই আমাদের প্রাথমিক কাজ।

মাওবাদীদের দাবিনামার মূল সুর ছিল নেপালের রাজনৈতিক সংকটে নেপালের করণীয় নির্ধারণ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি নেপালের সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে একমতে আনা। রাজতন্ত্র উৎখাতের জন্য করণীয় নির্ধারণের ব্যাপারে সকল পক্ষকে একটি সর্ব সম্মত সাধারণ অবস্থানে নিয়ে আসা। বলাবাহুল্য বিপ্লব ও উদার গণতন্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে মাওবাদীদের মধ্যে তর্ক ছিল না তা নয়, এছাড়া দিল্লীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নেও বিরোধ ছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের ধারণাই শেষাবধি প্রাধান্য পেয়েছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করবার কৃতিত্ব মাওবাদীদের। তাই নতুন কনস্টিটিউশান বা গঠনতন্ত্র  প্রণয়নের প্রসঙ্গ শুরু হয়েছিল রাজতন্ত্র উৎখাতের সঙ্গে সঙ্গেই। আবার নেপালে প্রথম কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলি বা  নির্বাচিত গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা (বা সংবিধান সভা) গঠিত হয় ২০০৮ সালে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সভা একটা কনস্টিটিউশন বা রাষ্ট্রগঠনের প্রশ্নকে কোন গঠনতান্ত্রিক দলিলে রূপ দিতে পারে নি।  সকলকে নিয়ে এমন কোন ঐক্যের স্তরে পৌছাতে পারে নি, যাতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে নেপালের শক্তিশালী আবির্ভাব ঘটতে পারে।  কিন্তু খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে নেপাল আবার  দ্বিতীয়বার নতুন করে সংবিধান সভার নির্বাচন করতে সক্ষম হয় ২০১৪ সালে। এই হিসাবে  ইতিহাসের সাত বছর পর দ্বিতীয় গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভায়  নেপালে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং গঠনতান্ত্রিক সভায় তা অনুমোদন ও গ্রহণের ঘোষণা এসেছে।

বিগত ২০০৬ সালে রাজতন্ত্রকে নড়বড়ে করে দেবার পর থেকে পুরানা  রাজতন্ত্রের খুঁটি বর্গা ভেঙ্গে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু  নতুন করে নেপাল রাষ্ট্র গঠন সম্পন্ন হচ্ছিল না। ফলে দেশে স্থিতিশীলতা আসছিল না, এখন অন্তত কনস্টিটিউশনাল রাষ্ট্র বলে ঘোষণা ও দাবি করার জায়গায় নেপাল পৌঁছাতে পারল। যদিও অমীমাংসিত কিছু বিষয় নতুন চেহারা ধারণ করে হাজির রয়েছে এবং ভারত সীমান্ত সংলগ্ন ত্বরাই  অঞ্চলের মাধেসি ও থারুদের নিয়ে সংকট রয়েছে।  তবু গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ নেপালের  গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভায় নতুন গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়েছে বলে যে প্রোক্লেমেশন জারি হয়েছে তা নিঃসন্দেহে নেপালের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

নেপাল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘কনস্টিটিউশন’, ‘গঠনতন্ত্র’, ‘রাষ্ট্র গঠন’, ‘কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলি’ বা‘রাষ্ট্রগঠন’  ইত্যাদি শব্দগুলো বারে বারে এসেছে। বিপ্লবী রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা হচ্ছে বিপ্লব একান্তই সশস্ত্র বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের ব্যাপার মাত্র। ফলে মাওবাদী কমিউনিস্টরা সশস্ত্র সংগ্রামের এক পর্যায়ে সমাজের অন্যান্য ক্ষমতাশালী শ্রেণি ও শক্তির সঙ্গে মৈত্রী রচনায় মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ার শুরু করবে, সেটা বাংলাদেশে আমরা সাধারণত চিন্তা করতে পারি না। এর ফলে বাংলাদেশের বহু বিপ্লবী তরুণে জীবন বিসর্জন দেবার পরেও বাস্তবিক রাজনীতি দূরের কথা ধারণাগত ক্ষেত্রগুলোতেও আমরা অগ্রসর হতে পারি নি। অথচ বিপ্লবের স্তর অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ভাবে কী ধরনের রাষ্ট্র গঠন কর্তব্য তা সবসময়ই ধ্রুপদী  বিপ্লবী রাজনীতির নীতি ও কৌশলগত তর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বাংলাদেশে ‘বিপ্লব’ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যে ধরণের অনুমান কাজ করে সেই বুঝের জায়গা থেকে নেপালে মাওবাদীদের কৃতিত্বের দিকটি বোঝা যাবে না। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অন্যান্য শ্রেণি ও শক্তির সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মৈত্রী রচনায় সাফল্য দক্ষিণ এশিয়ার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মাওবাদীদের সম্পর্কে ভিন্ন সমালোচনা বা পর্যালোচনা থাকলেও এই দিকটার প্রতি আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশে  বিপ্লবী চিন্তায় রেওয়াজে ‘কনস্টিটিউশান’ বিষয়টা যেন বা “বুর্জোয়াদের” বিষয় এমনই মনে করা হয়।  এনিয়ে কোন আলোচনাই প্রায় হয় না।  যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা নয়াচীনের বিপ্লব নিয়ে সারা দুনিয়ার বিপ্লবীদের উচ্ছ্বাস থাকলেও এই দুই বিপ্লবে ক্ষমতা দখলের পরে “কনস্টিটিউশন” বা “রাষ্ট্রগঠন” বলে কোন পর্যায় তাদের ছিল কি না আমরা তা খুব কমই খুঁজতে যাই। পুরানা  ট্রাডিশনাল  বিপ্লবী চিন্তায় কোন বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা দখলের পরে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র তৈরির বিষয়ের উপর জোর দেয়া, গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ প্রক্রিয়া সফল ভাবে  সম্পন্ন করার কর্তব্য গুরুত্ব পায় না। এককথায় পুরানা রাজতন্ত্র বা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জায়গায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন গুরুত্বপুর্ণ কর্তব্য ও করণীয় হয়ে ওঠে না।  বরং এগুলোকে সবসময়ই খুবই অপ্রয়োজনীয় “বুর্জোয়া” কাজ মনে করা হয়েছে। একারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা নয়াচীন রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশান তৈরির বিষয় ইতিহাসের তেমন কোন গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায় বলে বাংলাদেশের বিপ্লদের কাছে বিবেচিত ছিল না। একারণে আমরা আশির দশকে বিপ্লবী বয়সে রাশিয়া বা চীনের অনেক বিপ্লবের ইতিহাস পড়েছি; মুখস্থ না করলেও অনেক কিছু নাড়াচাড়া করেছি, কিন্তু এই দুই বিপ্লবী রাষ্ট্রের “কনস্টিটিউশন মেকিং প্রসেস”  বলে আদৌ কিছু ছিল কিনা আমরা তা খতিয়ে দেখি নি। কোন তাগিদও বোধ করি নি। বা থাকলেও নিষ্ঠার সঙ্গে তা জানবার বা বুঝবার অধ্যবসায় চর্চা করি নি।

গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উল্লেখযোগ্য কোন ইতিহাস বা ঘটনা বলেও মনে করা হয় না, কোন সামাজিক অথবা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের ভিতর দিয়েও গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির মুর্ত ভাবে হাজির হবার প্রশ্ন জড়িত সেটাও বাংলাদেরশের বিপ্লবী রাজনীতির ডিসকোর্সে দেখা যায় না।  বরং কনস্টটিউশনালিজম বা গঠনতন্ত্রকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিষয়টাকে নিছকই “বুর্জোয়া” বা আজাইরা কচকচানি বলে নাক সিটকানোর চর্চা বাংলাদেশে আশির দশক অবধি প্রবল ও প্রকট ভাবেই ছিল। এখনও আমরা অনেক এভাবেই  ভাবতে অভ্যস্ত রয়ে গিয়েছি।  তবে পরবর্তিতে রাষ্ট্র বিষয়ক ধারণা গুলো আরও পরিস্কার  ও পুষ্ট হওয়াতে আগে সেসব যে ভুল হয়েছিল তা একালে বিপ্লবী চিন্তা ও চর্চায় অনেক পরিষ্কার হয়েছে। ফলে একালে সশস্ত্র গণযুদ্ধ এবং সেই সংগ্রামের একটি পর্যায়ে সমাজের অন্যন্য গণতান্ত্রিক শ্রেণি ও শক্তির সঙ্গে মৈত্রী ও গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে পুরানা রাষ্ট্রের পতন ঘটিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য গঠনতন্ত্র সভা আহ্বান এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্য দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন – এই ধাপগুলোর প্রয়জনীয়তা ও অনিবার্যতা অনেক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক রূপান্তর কথাটার ব্যবহারিক অর্থ আগের তুলনায় বিপ্লবীদের কাছে অনেক স্বচ্ছ। গণ-অভুত্থানের মধ্য দিয়ে কোন বিপ্লবী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে তার পরের পদক্ষেপ হিসাবে ‘কনস্টিটিউশন মেকিং প্রসেস’ বা গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করার গুরুত্ব অপরিসীম ।  নেপাল তাই নতুন দিনের বিপ্লবের উদাহরণ। এই দিক থেকে বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির ভবিষ্যতের দিক থেকে আমাদের হাতের কাছের নেপাল নতুন, কিন্তু খুবই ভাল  উদাহরণ হয়ে উঠেছে,  যা আরও  খুঁটিয়ে দেখা, বোঝা ও বিচার করার সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে।  

নেপালের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে ২০০৬ সালের ৬ এপ্রিল খুবই তাৎপর্যপুর্ণ। এদিন রাজার ক্ষমতার বিরুদ্ধে মাওবাদীরা সহ সব রাজনৈতিক দল  সারা নেপালবাসীর এক গ্রান্ড এলায়েন্স গঠন ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয়। বলাবাহুল্য পরিণতিতে সেটাই রাজার পরাজয়ের কাল হয়ে ওঠে।

কিন্তু এমন মৈত্রী গঠিত হবার পিছনের পটভুমির খবর আমাদের নিতে হবে। মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন নেপালের রাজনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠতে এবং  নির্ধারক ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে অনেক সময় লাগে। আগেই বলেছি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। নেপালে ২০০২ সালের অক্টোবরের আগে নেপালে ক্ষমতার ভাগিদার বা স্টেক হোল্ডাররা হল এরকমঃ  এক. রাজতন্ত্রী রাজনীতির সমর্থকরা সহ খোদ রাজা। দুই. রাজতন্ত্রী কিন্তু কনস্টিটিউশন মেনে চলা আইনী দলগুলো (মাওবাদীরা বাদে মূলত নেপালি কংগ্রেস, ওর ভাঙা দলছুট অংশ এবং সিপিএন(ইউএমএল – যারা ভারতের সিপিআই, সিপিএমের নেপাল ভার্সন) ও ছোটখাট নানান কমিউনিস্ট বা লিবারেল দল। সবমিলিয়ে এমন মোট ৭টা দল । তিন. কস্টিটিউশানাল রাজতন্ত্র উচ্ছেদের লক্ষ্যে সশস্ত্র মাওবাদী দল; চার. ল্যান্ডলকড নেপালের উপর ছড়ি ঘুরানো ভারত। আর ৫. আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমাস্বার্থ। – এভাবে পাঁচটা পক্ষ।

দেখা যায় ২০০৫ সালের প্রথমার্ধের আগে পর্যন্ত এই পাঁচ পক্ষের চার পক্ষই একদিকে এবং মাওবাদীর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ থাকতে পেরেছিল।  উপযুক্ত কৌশল ব্যবহার করে ঐ চার  পক্ষীয় জোটে ভাঙন আনা, তাদের একসাথে কাজ করা অসম্ভব করে তোলা এবং মাওবাদী  রণকৌশলের মধ্য দিয়ে সফল ভাবে মৈত্রী স্থাপনের রাজনৈতিক শর্ত তৈরি করা সেই সময় সহজ ছিল না। সর্বোপরি একমাত্র দায়িত্ববান সম্ভাবনার যে রাস্তা মাওবাদীরা খুঁজে নিতে সক্ষম হয়। সে রাস্তার কথা যে মাওবাদীরা প্রস্তাব করতে পারে এবং দায়িত্ব নিয়ে তারা করেছেও বটে তা প্রশংসার যোগ্য। মাওবাদীদের রাজনৈতিক কৌশলের কারনে রাজার পক্ষের বাকী  তিন পক্ষই রাজার হাত ছেড়ে দিয়ে মাওবাদীদের সাথে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়েছিল। বা বলা যায়, মাওবাদীদের সঙ্গে থাকাটাই রাজনোইতিক দিক থেকে ব্যাটার অপশান মনে করেছিল।  ২০০৫ সালের প্রথমার্ধের পরে অনানুষ্ঠানিকভাবে, পরে ডিসেম্বর ২০০৫ সালে  ১২ দফা ঐক্যমতের দাবীনামা — যেটা পরবর্তিতে ২০০৬ সালের এপ্রিলে রাজার বিরুদ্ধে গ্রান্ড এলায়েন্সের পিছনের পটভুমি হিসাবে কাজ করেছে – মাওবাদীদের ক্রম বিজয় সুস্পষ্ট হতে শুরু করে।  দেখা যায় মোট পাঁচ পক্ষের রাজা ও মাওবাদী ছাড়া মোট তিন পক্ষ ২০০৫ সালের আগে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে রাজার পক্ষেই থেকেছিল। আর ২০০৫ সালের পরে মাওবাদীদের পক্ষে আর রাজার বিপক্ষে চলে যেতে বাধ্য হয়। কথিত এই তিন পক্ষ হল, ভারত, আমেরিকা এবং রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলো (নেপাল কংগ্রেস ও ভা্রতের সিপিআই, সিপিএমের মত নেপালী কমিউনিস্ট)। এদেরকে মাওবাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতি আস্থায় আনতে সক্ষম হল কেন? এই প্রশ্নটি ব্যাখ্যা করা যাক।

সশস্ত্র মাওবাদী বলতে প্রচলিত ধারণা বা ছবিটা হল ১. যারা কবে সশস্ত্রতা শেষ করবে তার কোন দিন ঠিকানা তাদের নিজেরই জানা নাই। চিন্তাও করে না; ২. সশস্ত্রতার কৌশল  কাজ করুক, ফল দিক আর নাই দেক,  কৌশল আগে পিছে করার কোন ইচ্ছা যাদের নাই, কিম্বা থাকলেও কিভাবে সেটা সম্ভব যা তাদের জানা নাই; ৩. রাজনৈতিক লড়াই শেষে কোন স্থিতিশীল রাষ্ট্রগঠন, দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করে আনার লক্ষ্যে বাস্তব কৌশল নিতে যারা জানে না;  ৪. “বুর্জোয়া, পুজিবাদী” নির্বিশেষে সকলের সাথে রাজনৈতি পরিসর নির্মাণের খাতিরে কথা বলতে ও ডায়লগ করতে জানে না, ইচ্ছুক নয় এবং দরকারিও মনে করে না;  ৫.  তাদের রাজনীতির ভিতর সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়েও সবচেয়ে ভাল ভাবে অন্তর্ভূক্ত এবং একমাত্র তাদের নেতৃত্বেই সেই স্বার্থ  রক্ষিত হতে পারে বলে যারা দেখাতে পারে না; ৬. সর্বোপরি সকলকে সাথে নিয়ে  রাষ্ট্রগঠন, কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন এবং বহুবিধ দলের সাথে ইনক্লুসিভভাবে কাজ করার পরিকল্পনা এবং মানুষের মন জয় করে মানুষকে বদলানোর কাজ করতে যারা জানে না। সশস্ত্র মাওবাদী কিম্বা যে কোন সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাসী রাজনীতি সম্পর্কে এটাই মানুষের বদ্ধমূল ধারণা। মাওবাদীরা নেপালে এই ছকবাঁধা বদ্ধমূল  ধারণা ভেঙ্গে ইতিবাচক সম্ভাবনার দল হিসাবে নিজেদের হাজির করতে সক্ষম হয়েছিল।

নেপালের রাজনীতিতে মাওবাদীদের প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত, আমেরিকা এবং রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলো  দিনকে দিন রাজার সাথে একসাথে ঐক্য বজায় রেখে টিকে থাকা অসম্ভব দেখছিল। এই তিন পক্ষের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক দূরবর্তী হয়ে উঠছিল। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপুর্ণ হোল যখন তারা টের পেল মাওবাদী হলেও  নেপালের মাওবাদী ভিন্ন রকম। সশস্ত্র রাজনৈতিক দল সম্পর্কে যে প্রথাগত ধারণা রয়েছে নেপালি মাওবাদীরা সেই রকম নয়। বিশেষ করে সশস্ত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান হল এই যে, তারা বাধ্য হয়ে সশস্ত্র হয়েছে, রাজতন্ত্রের বদলে রিপাবলিক বা জনরাষ্ট্র গড়তে রাজি হলেই তারা স্থিতিশীল রাষ্ট্রগঠন, দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করে আনা, সশস্ত্রতা শেষ করে নিজেদেরকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনা –  সব কিছুতেই তারা আগ্রহী। তারা যে জনরাষ্ট্রীয় বা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের জন্য একনিষ্ঠভাবে লড়ছে এবং বহুদলের ইনক্লুসিভ রাজনীতিতে  তাদের কোন আপত্তি নাই — এসব জানার পর ভারত, আমেরিকা ও রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলোর কাছে মাওবাদীরা নমস্য না হোক –কথা না বলা বা সংলাপ  না করবার কোন কারণ থাকে নি। আমেরিকার দিক থেকে ২০০৫-৬ সালে ওয়ার অন টেররে ব্যতিব্যস্ত থাকার সময় এটা ছিল হাতে চাঁদ পাবার মত। নইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে  ইসলামি ছাড়াও এই অঞ্চলে মাওবাদীদের দমন করবার জন্য আরেকটি ফ্রন্ট খুলবার ঝুঁকি নিতে হত।

মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন নেপালের রাজনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারক ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে সময় লেগেছিল ।  ২০০২ সালের অক্টোবরের আগে মাওবাদী এমন ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে নাই যে তাদের বাদে বাকী ভাগীদারেরা একজোট হয়ে কাজ করার সক্ষমতাকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। অবশ্য সেসময় এক সুবিধা ছিল যে আর্মিকে মাওবাদী মোকাবোলায় নামানো হয় নাই। রেগুলার পুলিশ আর নতুন বানিয়ে নেয়া রক্ষীবাহিনীর মত প্যারামিলিটারি ‘আর্মড পুলিশ ফোর্স’ দিয়ে মাওবাদীদের মোকাবেলা করা হত। ভারত আর আমেরিকার সহযোগিতা ও উৎসাহে, আর রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলের সহযোগিতায় রাজা সহজেই চলতে পেরেছিল। কিন্তু দিনকে দিন মাওবাদীদের আক্রমণের সক্ষমতা বাড়তে থাকায়  ক্ষমতাসীনদের প্রত্যেক পক্ষই  মনে করতে থাকে যে সুনির্দিষ্ট ভাবে তাদের পরামর্শ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে মেনে না চলার কারণে  ব্যার্থতা বাড়ছে। ফলে প্রত্যেকেই অপরের উপর অধৈর্য হয়ে উঠেছিল।

২০০১ সালের জুন ১ তারিখে রাজপরিবারে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পারস্পরিক খুনাখুনি শেষে রাজা জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা দখল করেন। তিনি নেপালী কংগ্রেসের কৈরালার বদলে একই দলের শের বাহাদুর দুবেকে প্রধানমন্ত্রী করেন। ২০০১ সালের ২৬ নভেম্বর, নতুন রাজা জ্ঞানেন্দ্র দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন আর মাওবাদী মোকাবোলায় সারা দেশে আর্মি নামিয়ে দেন। ২০০২সালের শুরুতে আমেরিকা ১২ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয় সেনা ট্রেনিং ও অস্ত্র সাহায্যের জন্য। মে মাসে আর্মি প্রথমবারের মত মাওবাদী চেয়ারম্যান পুস্পকমল দাহালসহ চার নেতার ছবি প্রচার করে। ২২ মে তারিখে নতুন প্রধানমন্ত্রী দুবে সংসদ ভেঙ্গে দেন যাতে বিরোধীরা সেখানে রাজার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় না তুলতে পারেন। এককথায় বললে, এই প্রথম নতুন রাজার সাথে রাজতন্ত্রী কনষ্টিটিউশনাল দলগুলোর বিরোধ শুরু হয়। রাজা একেকবার একেক সেটকে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বানিয়ে অপরের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে থাকেন। এভাবে পরের দুবছর দুমাসে ৪টা সরকার গঠন করেন আর ভেঙ্গে দেন। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল ২০০২ সালের ৪ অক্টোবর। রাজা এদিন প্রথম রাষ্ট্রের নির্বাহি ক্ষমতাও নিজের হাতে নেন। ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে মাওবাদীদের দিক থেকে বিরাট সাফল্যের ঘটনা হল,  আর্মড পুলিশ ফোর্স এর আইজিকে হত্যা করা। মাঝের বছরগুলোতে প্রায় সময়ই মাওবাদীরা ডাক দিয়ে একক যুদ্ধবিরতি পালন করেছে, এক বা তিন মাসের জন্য। মূলত এগুলো তারা করেছে কৌশলের আগাপিছু করা, কি কারণে তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম সেকথা জনগণকে মনে করিয়ে দেয়া, পপুলার করা। সার কথায় মনে করিয়ে দেয়া যে তারা অস্ত্র-পাগল কেউ নয়, তাদের হাতে অস্ত্র শেষ উপায় মাত্র। রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং রিপাবলিকান জনগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র  প্রণয়নের ঘোষণা দিলেই তারা অস্ত্র ত্যাগের ঘোষণা দিবে। তেমনই এক যুদ্ধবিরিতি ঐ ২০০২ সালের  আর্মড পুলিশ ফোর্স এর আইজিকে হত্যা করার পরও দেয়া হয়েছিল। কি করে যুদ্ধবিরতি পালিত হবে এর কিছু আচরণবিধিও নির্ধারিত ও স্বাক্ষর হয়েছিল মে মাসে। কিন্তু আগস্ট মাসে এসে মাওবাদী হুমকি দিয়ে জানায় যে তাদের দাবীর ব্যাপারে কোন সাড়া শব্দ না পাওয়াতে তারা একশনে ফিরে যাবে।  ২০০৩ সালের শেষাশেষি এসে দেখা যায়, ততদিনে রাজার সাথে  রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলোর বিরোধ চরমে উঠেছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছেন না। আমেরিকান সেক্রেটারি অব ষ্টেট ক্রিস্টিনা রাকা নেপালে এসেছিলেন  ২০ ডিসেম্বর ২০০৩, বিরোধ মিটাতে কিছু করা যায় কিনা শেষ চেষ্টা করতে। নেপালের ইংরাজী দৈনিক কাটমান্ডু পোষ্টের ২১ ডিসেম্বর সংখ্যার চারটা রিপোর্টের শিরোনাম হল,

১। Anti-king remarks intolerable: Lohani, ২। Rocca mum over US support to parties, ৩। Crisis resolution need of hour: Nepal, ৪। Exchange of intelligence required to hook Maoist leaders: Indian envoy,

প্রথমটার লোহানী হলেন রাজার আজ্ঞাবহ এক্টিং প্রধানমন্ত্রী, প্রকাশ লোহানী। তিনি একাধারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। তিনি একথা বলছেন কারণ ততদিনে রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোও রাজাকে হাসি তামাশার পাত্র বানানো শুরু করে দিয়েছে। দ্বিতীয় খবরটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ, আমেরিকান এসিট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ক্রিশ্চিনা রাকা এসে বিরোধ মিটাতে গিয়ে হয়রান হয়ে গেছেন। পত্রিকার রিপোর্ট বলছে এই সত্যিকার দিকটা লুকিয়ে নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন(ইউএমএল) মুখে বলছেন,“পরাশক্তিগুলো রাজা ও তাদের দলগুলোর ইউনিটি দেখতে চায়, গণতন্ত্রের ব্যাপারে আমেরিকা ইতিবাচক”। ওদিকে আসলে এই দল দুটো রাকাকে চেপে ধরেছে রাজার বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগের বাক্স খুলে। আর জবাবে হয়রান হয়ে রাকা বলছে বিশ্বাস করেন আমি মনে করি রাজা ইতিবাচক, কিন্তু সব কথা ডিপলোমেটিক কারণে আমি বলতে পারছি না। এই জবাবটা রাকা দিচ্ছেন সিপিএন(ইউএমএল) উপনেতা এন অলিকে। অলি বর্তমানে এই নেপালি সিপিএম দলের প্রধান নেতা।

আসলে পরবর্তিকালে দেখা যাচ্ছে রাকার এই সফরটা ছিল মাওবাদী বিরোধী রাজতন্ত্রীর পক্ষে ভারত-আমেরিকাসহ চার  স্টেক হোল্ডারের সর্বশেষ জোটবদ্ধ অবস্থান। কিন্তু এরপরেই পাশার দান উলটে যায়। প্রত্যেকে এরপর রাজার হাত ছেড়ে দিয়ে,  রাজাকে ত্যাগ করে, কত দ্রুত মাওবাদীদের  হাত ধরা যায়, সেই এলায়েন্স খুজতে শুরু করেছিল। রাকা ঐ সফরে এরপর পালটা রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলোকে আক্রমণ করে বলেছিল আপনাদের মধ্যে ঐক্য নাই বলেই তো  সব সমস্যা। শুধু তাই নয় উলটা রাকার  চলে যাবার পরে  রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলো যেন রাজার সাথে বিরোধে জড়িয়ে না পড়ে সেটা নিশ্চিত করবার শেষ চেষ্টা রাকা করেছিলেন। তাই রাকা মনে করিয়ে দিতে বলেছিলেন, “কারণ, তাদের বিরোধ তো আসলে কমন শত্রু মাওবাদী  বিরুদ্ধে”।    রাকার এই সফরের পর থেকেই ক্রমশ  আমেরিকার উলটা দিকে অবস্থান নেয়া শুরু হয়।

সেসময়ের ভারতীয় অবস্থান নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। ভারত সেসময় আমেরিকার সাথে রাজার পক্ষে। দিল্লি সরাসরি চেয়ারম্যান পুস্পদাহাল  ও দ্বিতীয় নেতা বাবুরাম ভট্টরায়কে গ্রেফতার করার প্রয়োজনের কথা তুলে নেপালি ইনটেলিজেন্সের উপর নিজেদের প্রভাব বাড়াবার চেষ্টা করছে। পত্রিকা রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রদুত শ্যামশরণ বলেছেন, চেয়ারম্যান পুস্পদাহাল  ও দ্বিতীয় নেতা বাবুরাম ভট্টরায়কে ধরার জন্য ইনটেলিজেন্স তথ্য বিনিময় দরকার। বলছেন সেজন্য দুদেশের মধ্যে গোপন তথ্য বিনিময় ও আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা দরকার। মাওবাদীদেরকে তিনি দুদেশের শত্রু হিসাবে উল্লেখ করেন। তরুণ জার্নালিস্টদের এক সভায় তিনি এসব কথা বলছিলেন।  ২১ ডিসেম্বর ২০০৩ এই দিনের পত্রিকার খবর বিস্তারিত  বললাম কারণ এরপরের ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারীর আগে পর্যন্ত প্রায় এক বছরে রাজার পক্ষে ধামাধরা রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে একেকবার একএকজনকে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী করে কাজে লাগানোর সব সুযোগ নিঃশেষ করে ফেলে। এরপর পয়লা ফেব্রুয়ারী ২০০৫ সালে রাজা নিজেই নিজেকে  নির্বাহি ক্ষমতায় বসান। এবং জরুরি অবস্থা জারি করেন। এতে একটা জিনিষ পরিস্কার হয়, তাহল নেপালী কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট সিপিএন-ইউএমএলের মত রাজতন্ত্রী দলগুলোর পক্ষে রাজা জ্ঞানেন্দ্রের চামচা হয়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী হবার যে শেষ সুযোগ ছিল সেটাও আর থাকল না। কারণ রাজা নিজেই এবার প্রধান নির্বাহী হয়ে গেছেন। অন্যদিক থেকে বললে, রাজার এই সিদ্ধান্ত রাজতন্ত্রী দলগুলোকে কনস্টিটিউশনাল নিয়মতান্ত্রিক দল হিসাবে ফাংশনাল  থাকার শর্ত ও সুযোগ নাই করে দিলেন। ফলে রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। ফলে ভারত এবং আমেরিকার পক্ষে আর রাজার পক্ষে সমর্থন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তুলনায় মাওবাদীরা নিজেদেরকে সকলের কাছে ব্যবহারিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে অবস্থান পরিস্কার করে ফেলে। এতে মাওবাদীদের সাথে রাজতন্ত্রী কনস্টিটিউশনাল দলগুলোর এলায়েন্সের কমন পয়েন্টগুলো কি হতে পারে তা স্পস্ট হয়ে যায়। এই দুই ধরণের রাজনীতির মধ্যে পুরা নিগোশিয়েশনটা কোথায় কোন পয়েন্টে হয়েছে এর সবচেয়ে প্রামাণ্য দলিল হল, এদের পারস্পরিক বুঝাবুঝির কমন দলিল – ১২ পয়েন্ট মতৈক্য। বিশেষত ওর দ্বিতীয় পয়েন্ট পড়লেই জানা যায়। সেখানে বলা হয়েছে —

“মাঠে সক্রিয় সাত বিরোধী দলীয় জোট [মাওবাদী বাদে এতদিন যারা রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক আইনী রাজনৈতিক দল হিসাবে কাজ করত] সর্বশেষ পার্লামেন্টকে যাকে রাজা বাতিল বলে ঘোষণা করেছে তাকে আবার কার্যকর করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং এই সিদ্ধান্ত অর্থাৎ পার্লামেন্ট চালু হলে তা যেসব কাজ করবে তা হল, সর্বদলীয় সরকার গঠন, মাওবাদীদের সাথে ডায়লগ করে তাআদের সাথে নিয়ে একটা কনষ্টিটুয়েন্ট এসেম্বলির (রাষ্ট্র গঠন সভা) নির্বাচনের পথে অগ্রসর হওয়া। তারা মনে করে এটাই বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত শেষ করে বেরিয়ে আসা এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একমাত্র পথ। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি কথা দিয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে নিয়ে এক জাতীয় রাজনৈতিক কনভেনশন আয়োজন করবে।  সেই সভা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিভাবে হবে সে  বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে, কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলির (রাষ্ট্র গঠন সভার) সদস্য কারা হবেন তা নির্ধারণের নির্বাচন আয়োজন করবে যাতে আমাদের সকলের সম্মতিতে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা যায়। সাত দলীয় জোট এবং সিপিএন-মাওবাদী দল এক ডায়লগে বসবে এবং পদ্ধতিগত দিকগুলো নিয়ে ঐক্যমতের পথ খুঁজে বের করবে। এই লক্ষ্য অর্জনে জনগণের ক্ষমতাই একমাত্র বিকল্প – বলে সকলে একমত হয়েছে”। [১২ দফা ঐক্যমতের দ্বিতীয় দফার হুবহু অনুবাদ]

সারমর্মে আমরা বলতে পারি নেপালের মাওবাদ থেকে শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম বিপ্লবী রাজনীতির নীতিগত দিক নয়, কৌশলগত দিক, তা নেপালের মাওবাদীরা দেখাতে পেরেছে। অর্থাৎ যা শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে অর্জন সম্ভব সেই ভাবে তা অর্জনের কৌশল অবলম্বনে তাদের যেমন সায় আছে, আবার সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে সশস্ত্র যুদ্ধে তা আদায় করে নিতে মাওবাদীরা পিছপা নয়। তারা দেখাতে পেরেছে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে রাজতন্ত্র বিরোধী সমাজের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার এবং নেপালি জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম করবার পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি জনপরিসর বা গণ মানুষের রাজনৈতিক ক্ষেত্র গড়ে তোলা যার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের দাবি দাওয়া প্রকাশ ও রাজনৈতিক বিষয়ে জানাজানির ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পায়। নেপালের বাস্তবতায় যতোটুকু সাফল্য অর্জন সম্ভব, বলা যায় তার চেয়ে অধিক সাফল্যই তারা অর্জন করেছে। আগামি দিনে নেপালের রাজনীতিতে মাওবাদীরা প্রধান দল হিসাবে থাকবে কিনা কিম্বা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কিনা তা দিয়ে মাওবাদীদের সফলতা ব্যর্থতার খতিয়ান টানা যাবে না। আজ নেপাল যেখানে এসেছে – ১. রাজতন্ত্র থেকে নেপালকে জনরাষ্ট্রে (Republic) রূপান্তরের সাফল্য, ২.স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নেপালি জনগণের মধ্যে ঐক্য, ৩. ল্যাণ্ড-লকড হবার কারনে ভারত যে ঔপনিবেশিক সুবিধা পাচ্ছে ও আদায় করে নিচ্ছে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং সর্বোপরি জনগণের মধ্যে বিপ্লবী দীক্ষা ও চেতনার সম্প্রসারণ – ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে মাওবাদিরা নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে। এব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।

2 thoughts on “১. ল্যাণ্ড-লকড নেপালঃ অতীত ও বর্তমানের ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা

  1. *Sir,, being an muslim, i want to ask your honour one question,,is it relatable to hinduphobia if i defy hindutva???*

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s