বিহারে মোদির বিজেপির পরাজয় কী টার্নিং পয়েন্ট হবে


বিহারে মোদির পরাজয় কী ভারতের রাজনীতিতে টার্নিং পয়েন্ট হবে
গৌতম দাস
১১ নভেম্বর ২০১৫

https://wp.me/p1sCvy-cU

ভারতের বিহারে মোদির বিজেপি শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়েছে। বিহারের প্রাদেশিক নির্বাচন যেটাকে ভারতের কনস্টিটিউশনের ভাষায় বিধানসভা বলা হয়, সেই রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে পাঁচ পর্বে নেয়া এ ভোটের ফল ০৮ নভেম্বর সকাল থেকে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছিল। ফলাফলের খুঁটিনাটি বিস্তার আসতে সারা দিন লেগে যায়। সেসব বাদ দিয়ে মোটা দাগে কোন দল কতটা আসন পেয়েছে, এরই মধ্যে সে তথ্য এসে গেছে। মোট আসন সংখ্যা ২৪৩ বলে সরকার গঠনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় আসন সংখ্যা ১২২। আর ভোটের ফল হলো বিজেপি- বিরোধীদের মহাজোট পেয়েছে ১৭৮ আসন, বিজেপি পেয়েছে ৫৮ এবং অন্যরা ৭ আসন। ফল দেখে এরই মধ্যে পরাজয় স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী মোদি বিরোধী জোটের নেতা নীতিশ কুমারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিরোধী মহাজোট মূলত তিন দলের জোট, এর মধ্যে আছে দুই আঞ্চলিক দল লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (এ নির্বাচনে যার প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ৮০) এবং চলতি মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড (আসনসংখ্যা ৭১), আর এদের সঙ্গে সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস দল (আসনসংখ্যা ২৭)। আমাদের লেখার প্রসঙ্গ এই হারের ফলে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রতিফলন প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। ফলে এ লেখার জন্য নির্বাচন বিষয়ক আপাতত এতটুকু তথ্যই যথেষ্ট। এখন থেকে মোদি সরকারের নতুন অভিমুখে কী হওয়ার সম্ভাবনা, তা নিয়ে কথা বলব। কী সে সম্ভাবনা?
মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন যে নির্বাচন থেকে, ভারতের ভাষায় লোকসভার সে নির্বাচন শেষে ওর ফল হয়েছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। ওই নির্বাচনে মোদির দল হিন্দুত্ববাদী বিজেপি হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুত্ব নয়, মোদির মুখ্য শ্লোগান ছিল “বিকাশ”, মানে উন্নয়ন। উন্নয়ন কথাটা ভেঙে বললে ওর মানে হল অর্থনীতিতে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন। মূলত উন্নয়ন খাতে মূলত বিদেশি (তবে সরকারিও) বিপুল বিনিয়োগ ঘটানো হবে – এটাই বলতে চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতেই বা কী হবে? সে বর্ধিত অর্থ হল,  বিকশিত অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে, সুবিধা নিতে প্রলুব্ধ হয়ে কারখানা-ইন্ডাস্ট্রি খাতে এবার প্রাইভেট, পাবলিক এবং দেশি-বিদেশি ব্যাপক বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ঘটবে। আর এসব কিছুর নিট ফল গরিব মানুষের জন্য বিপুল পরিমাণ কাজ সৃষ্টি, কাজ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এক কথায় ব্যাপারটা হল, দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ ঘাটতিতে ধুঁকে মরা ভারতের অর্থনীতিকে দুনিয়ার মধ্যে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগের লোভনীয় স্থান করে সাজানো। এ পুরো বিষয় বা প্রক্রিয়াটাকে এককথায় প্রতীকীভাবে উন্নয়ন শব্দে বা হিন্দিতে বিকাশ শব্দের ভেতর ধরা হয়েছে।
কিন্তু বিজেপির মতো এক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক দলের প্রধানমন্ত্রীর মুখে মুখ্য শ্লোগান “বিকাশ” হওয়ার তাৎপর্য ব্যাপক। কেন? প্রথমত, মোদির “বিকাশ” শ্লোগান নেহাত কথার কথা নয়। বরং ব্যক্তি হিসেবে এ পর্যন্ত দেখা ভারতের রাজনীতিকদের মধ্যে সত্যি সত্যিই তিনি এটা মিন করেন এবং সবচেয়ে অর্থপূর্ণভাবে এ কথা বলছেন।  এবং এরই মধ্যে গুজরাট রাজ্যে তিনবার মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় এমনটা করে দেখিয়েছেন তিনিই। এমন রেকর্ড একমাত্র তাঁরই আছে। এছাড়া এরই মধ্যে মোদির ১৮ মাসের প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে এরই মধ্যে অনেক অর্থনৈতিক নীতি-সংস্কার তিনি করেছেন, উদ্যোগের ঝড় তুলেছেন, তা উল্লেখযোগ্য এবং সাহসী। দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। জিডিপির বাড়ার বিচারেও তা যথেষ্ট ভাল, গেল বছর সাড়ে সাত ভাগের পর এখন অবশ্য সাত ভাগ। বিগত কংগ্রেস সরকারের শেষ সময়ে যা সাড়ে ছয়ে বা কখনও পাঁচে নেমে গিয়েছিল।
এখন একটা ইমাজিনড চোখে কিছু বলা যাক। ধরা যাক “বিকাশ” শ্লোগানের মোদির ভারত সরকার ৫ বছর সমাপ্তিতে উল্লেখযোগ্য সফলতা নিয়ে হাজির হল এবং তা এমনভাবে যে, বাস্তবে এটা যে কাজ করেছে, ফল দেখানো শুরু করছে তা সাধারণ মানুষের নজরে এবং দেশি-বিদেশি এক্সপার্টের চোখেও স্বীকৃতি পেতে শুরু করল। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায়, মোদির সামগ্রিক রাজনীতির ভিত্তি এর পর আর বিজেপি-হিন্দুত্ব না থেকে এর বদলে ‘বিকাশ’ হয়ে যেতে বাধ্য। মূল কারণ হিন্দুত্বের জিগিরের চেয়ে “বিকাশ” বেশি জনপ্রিয় হয়ে গেলে দল “বিকাশ” মুখ্য শ্লোগান করে রাজনীতি করবে।  পরের নির্বাচনে মোদি আরও জোর দিয়ে বিকাশের কথা বলে ভোট চাইবেন। আর দলের হিন্দুত্ত্বের বয়ান ঠিক ততটাই অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিজেপি মুসলমান বা ‘অ-হিন্দু’ বিদ্বেষী রাজনীতিকে অন্তত সেকেন্ডারি করে পেছনে ফেলে বিকাশের সাফল্যকে প্রধান ও একমাত্রভাবে হাজির করতে বাধ্য হবে। এমনিতেই ক্যাপিটালিজমের এক কমন স্বভাব হল, ক্যাপিটালিজম যেন এক বিরাট মেল্টিং পট, সবকিছু গালিয়ে ঘুটা দেয়ার পাত্র। এই পাত্র যে পড়ে এর আগের তার কোন বৈশিষ্ঠ আর অবশিষ্ট থাকে না, লোপ পায়। নানা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পদার্থকে এক পাত্রে নিয়ে একটা ঘুটা দেয়ায় এরা এরপর সবাই পুরনো আলাদা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলা এক নতুন বস্তুর ঘুটা। তবে এর পর হয়তো নতুন বৈশিষ্ট্যের কোন দ্বন্দ্ব তাতে হাজির হতে পারে। কিন্তু পুরনো ধরনের ভিন্নতা ভেদ-বিভক্তি আর কারও মধ্যে থাকে না। ফলে সফল “বিকাশ” রাজনীতির সাফল্যের মানে সার কথায় বললে ‘অ-হিন্দু’বিদ্বেষী, হিন্দুত্বের রাজনীতি করার বাস্তব পরিস্থিতি বাস্তবতা নিজে নিজেই লোপাট হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এটা বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করা নয়; বরং বিকাশের রাজনীতিতে সাফল্যের সামনে পড়ে অনিচ্ছায় হিন্দুত্বের রাজনীতির বাস্তবতা শুকিয়ে যাওয়া; ফোকাস হারিয়ে নিদেনপক্ষে সেকেন্ডারি দুর্বল হয়ে যাওয়া; কথার কথা হয়ে থাকা এক দশা।
এটাই হলো বিকাশের সাফল্যে পড়ে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি টিকে থাকার সম্ভাবনা্কে নিজেই নাকচ করা এবং রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা।
ইমাজিনেশন ছেড়ে এবার বাস্তব মূল্যায়ন আসা যাক। মুল্যায়ন করলে দেখা যায় বিকাশের রাজনীতির দিক থেকে মোদির সরকারের প্রথম বছর খুবই সফল। এমনকি প্রথম পাঁচ মাসের মধ্যে দুনিয়ার মুখ্য ইকোনমিক প্লেয়ার হিসেবে চীন, জাপান ও আমেরিকার সঙ্গে বিনিয়োগ বিষয়ক চুক্তি এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে ডিল সম্পন্ন করা দ্রুততম সময়ের দিক থেকে উদাহরণ। এজন্য হোমওয়ার্ক, নীতি পরিকল্পনা, হার্ড ওয়ার্ক ও কমিটমেন্ট এসবই ‘বিকাশ’ এর ব্যাপারে মোদি সিরিয়াসনেসের প্রকাশ ঘটিয়ে দেখানোর প্রমাণ। যদিও বছর শেষের আগেই মতাদর্শিক গুরু সংগঠন আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ধরনের প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা “ঘর ওয়াপসি” বা চার্চে হামলা ইত্যাদির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থান ও অ্যাকশন মোদিকে দেখাতেই হয়। মোদি পেরেছিলেন। মনে হয়েছিল, মোদি ‘বিকাশ’ রাজনীতি থেকে ফোকাস সরিয়ে নষ্ট হতে পারে অথবা অন্য কিছুর ছায়া এর ওপর পড়তে পারে, এমন কিছু থেকে একে রক্ষা করার ব্যাপারে তখনও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের প্রকাশ্যে সমালোচনাও করেছিলেন। আর যে কোনো নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রক্ষা করতে তার সরকার নীতিগতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ – প্রকাশ্যে তা জানিয়েছিলেন।
কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম বছর পার হতে না হতেই তার আগের দৃঢ়তায় ঢিলা পড়তে দেখা যায়। এবছরের এপ্রিলে শুরুতে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হয়েছিল। ঘটনার শুরু গোমাংস ইস্যুতে।  মহারাষ্ট্র
রাজ্যের বিজেপির সরকার গরু জবাই করার বিরুদ্ধে আইন তৈরি করে প্রয়োগ শুরু করেছিল। এতদিন প্রধানমন্ত্রী মোদি সবসময় কোনো রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে অথবা নিজ বিজেপি বা আরএসএসের কার্যকলাপ থেকে তার কেন্দ্রীয় সরকার ভিন্ন – এ কথা প্রচার করেছেন ও মেনে চলেছেন। আইনত এ কথা সত্যিও বটে। ফলে ওদের সিদ্ধান্ত বা ততপরতার কোনো দায়দায়িত্বও নেননি, পৃষ্ঠপোষকতাও দেননি। “ঘর ওয়াপসি” বা চার্চে হামলার বিরুদ্ধে যে কোন নাগরিক ধর্ম পালনের অধিকার রক্ষার তাঁর সরকারের নীতি ঘোষণা এর প্রমাণ।  মোদির কাছে – দল ও সরকার ভিন্ন – এভাবে মেনে চলা নীতি অনুসারে গরু জবাই তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত নয়। ফলে এর কোনো দায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বা তাঁর সরকারের বা মন্ত্রীর নয়; সংশ্লিষ্টতা থাকার কথাও নয়। কিন্তু আমরা দেখলাম, তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের সীমান্তে এসে বিএসএফের সঙ্গে মিটিংয়ে গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন। বললেন, বাংলাদেশে যাতে গরু পাচার হয়ে না যায়, বাংলাদেশ যেন দামবৃদ্ধির ঠেলায় গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে নাকি হিন্দু ভারতের গরুপ্রীতি রক্ষা করতে হবে। বক্তৃতায় এত দূর গেলেন। অথচ গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে তার কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো আইনই নেই। অর্থাৎ ভারতের সব রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ নয়। মহারাষ্ট্র রাজ্যের সিদ্ধান্ত ও আইন অন্য রাজ্যে বা কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর প্রযোজ্যও নয়। অথচ এ অসামঞ্জস্য ততপরতা প্রকাশ্যে ঘটতে শুরু করল।
কেন এটা হলো? নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম বাধাহীন পালন করার সুযোগকে মোদির যেচে এটা অ-হিন্দু নাগরিকেরও অধিকার বলে স্বীকার করে নেয়া এবং ওই অধিকার রক্ষা নিজ সরকারের নীতি বলে ঘোষণা দেয়ার কথা যেটা আগে বলেছিলাম। মোদির এমন সিদ্ধান্ত পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ও সাহসী ছিল বটে, আমরাও আগে মোদির এমন কঠোর ঘোষণাকে আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ওপর মোদির নিয়ন্ত্রণ বা লাগাম টেনে দেয়া বলে বুঝলেও এখন বুঝা যাচ্ছে সেটা ছিল বাইরের একটা প্রকাশ্য দিক। অন্তরের দিক ঠিক এমন নয়। অন্তরের দিকে খুব সম্ভব মোদির “নাগরিকের ধর্ম পালন রক্ষার দায়িত্ব নেয়া” ঘোষণার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মোদি সরকার আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়ে পড়েন। যার ফলাফল তিনি হেরে যাওয়ায় তাকে আঁতাত সমঝোতায় যেতে হয়। এরই বাইরের পয়লা প্রকাশ্য দিক হলো গরু ইস্যুকে কোন ঘোষণা ছাড়াই উহ্য রেখে নিজের বলে মোদি সরকারের হাতে তুলে নিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, নরেন্দ্র মোদি ছোট বেলা থেকেই আরএসএসের ভেতরেই বড় হয়েছেন এমন কোর সদস্য। ফলে মোদি ও আরএসএস পরস্পর পরস্পর থেকে দূরের কেউ নয়। তাই একসঙ্গে বসে পরস্পরের কনসার্নগুলো পরস্পরের কাছে তুলে ধরে
কমন এক  সিদ্ধান্তে আসার তাগিদবোধ ও সম্ভাবনা দূরের কোনো বিষয় হয়নি। যদিও ২০১৩ সালে মোদির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করাতে মোদি সফল হয়েছিলেন আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে নিজের পক্ষে সমর্থনে নিয়ে। আর বিপরীতে  বিজেপির এলকে আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী, অরুণ সুরী, যশবন্ত সিংসহ ৭০ বছরের বেশি বয়সের বয়স্ক যত নেতা আছে, তাদের কোণঠাসা করে। এদের তিনি (দল নয়) সরকারে অংশগ্রহণে বদলে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়াতে সক্ষম হন। সে সময় এভাবেই  বুড়াদের প্রভাব খর্ব করে মোদি দল বিজেপিকে নিজের একক কর্তৃত্বাধীনে আনেন। একমাত্র কেবল বাজপেয়িকে নিজের পক্ষে মুরব্বি পরামর্শক রেখেছিলেন মোদি। এই হল “কেন এটা হল” এসম্পর্কে পুরানা কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড ফ্যাক্টস। তবে আরও কিছু আছে।
সম্প্রতি দিল্লীতে ৪- ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে আরএসএস ও মোদি সরকারের মধ্যে এক বিশেষ সাক্ষাত-বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সবাইকে পাবলিকলি জানিয়ে তবে একান্তে এই বৈঠক হয়েছে। এনডিটিভি, দ্য হিন্দু ইত্যাদি মিডিয়ার গোপন সোর্সের খবর অনুসারে এটা নাকি ছিল মোদি সরকারের প্রথম বছরের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন বৈঠক। সরকারের শীর্ষ নীতি বিষয়ে মুরব্বি আরএসএসের পরামর্শ নিয়ে তা সমন্বয় করা হয় সেখানে। মাস তিনেক আগে  গুজরাটের এক অখ্যাত হৃদ্দিক প্যাটেল তার নিজের প্যাটেল বা পতিদার সম্প্রদায়কে অবহেলা এবং এর পক্ষে সরকারি সুযোগ-সুবিধার কোটা দিবার দাবিতে গুজরাটের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে সারা ভারতের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন মিডিয়ায় কানাঘুষা চলছে, এর পেছনে ছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি পারভীন তোগোদিয়া এবং বিজেপির সভাপতির দূর থেকে সমর্থনের কথাও সেখানে উঠেছে। সবশেষে বর্তমানে হৃদ্দিক প্যাটেল জেলখানায় ডিটেইন্ড। তাই এমন মনে করার কারণ আছে যে, এটা কি তবে আরএসএস এফিলিয়েটেড সংগঠনের সঙ্গে (হয়ত ঠিক আরএসএসের প্রধান নেতারা নয়) মোদি ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই ছিল, যে কারণেই কি প্রকাশ্যে দিল্লিতেই আরএসএস ও মোদি সরকার মধ্যে সমন্বয় বৈঠক! এখানে মনে রাখতে হবে, ওখানে মোদি ও তার মন্ত্রীরা বৈঠক করেছেন বিজেপির নেতা হিসেবে নয়, খোদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী হিসেবে। তবে এতে সরকারী নীতির গোপনীয়তা যারা রাষ্ট্রের শপথ নেননি, এমন লোকজনের সঙ্গে শেয়ার করার অসাংবিধানিক কাজ করেছে বলে কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছিল।
এতসব কথার সারকথা, মোদি সরকার গঠনের পর থেকে জানিয়ে ও মেনে আসছিলেন যে, সরকার ও বিজেপি দুটি আলাদা সত্তা তিনি মেনে চলবেন। এরই সর্বশেষ প্রকাশ হলো, মোদির যে কোনো নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার রক্ষা তার সরকারের কর্তব্য বলে ঘোষণা করা। কিন্তু এর পর থেকে শুরু হয় আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এবং মোদির হার শুরু হয়। ফলে পরিণতি একেবারে উল্টো। এখন আরএসএসের নির্দেশ-পরামর্শ শুনতে অধীনস্থ হয়েছে এবং জবাবদিহিতা নেয়ার উচ্চ কর্তা হিসাবেও আরএসএস হাজির হয়েছে। এটাই কার্যত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এজন্য গরু জবাই, মাংস খাওয়া ইস্যুটা মোদি সরকারই আরও সবলভাবে সর্বত্র হাজির করেছে। বিজেপি দল আর সরকার বলে কোনো ফারাক সেখানে আর নেই। বিহারের নির্বাচনেও দ্বিধা ঝেড়ে এবং বিচ্ছিন্নভাবে নয়, দলের দায়দায়িত্বে গরুপ্রীতি, গরু জবাই, মাংস খাওয়া ইত্যাদি সরাসরি দলের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় ইস্যু করা হয়েছিল। এমনকি বিহারে গরুপ্রীতি ও ভক্তি দেখিয়েএক পোস্টার ছাপানো হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে,  গরুকে জড়িয়ে ধরে এক মেয়ে আদর করছে। ার ঐ পোস্টারে  বিরোধীরা (যারা বিহার নির্বাচনে সদ্য জিতে গেল) এরা কেন গরু বিষয়ে বিজেপির মতো অবস্থান নিচ্ছে না, জনগণকে এর জন্য জবাবদিহিতা চাইতে বলা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যারাই বিজেপির বিরুদ্ধে ‘অসহিষ্ণুতার’ অভিযোগ তুলছেন, অভিনেতা শাহরুখ খানসহ সবার বিরুদ্ধেই দল ও সরকারের মন্ত্রীরা তাকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে পাল্টা অভিযোগ ও আক্রমণ করেছেন। একই সূত্রে নেপালের কনস্টিটিউশন ইস্যুতে নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়ার দাবি বিহার বিজেপি থেকে করা হয়েছিল। নেপাল-ভারত সীমান্ত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত; ফলে কিছু অংশ সীমান্ত এখানেও শেয়ার হয়েছে।


যে কথা নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, বিকাশের রাজনীতি বনাম বিজেপির হিন্দুত্বঃ যেখানে প্রথম বছর আশাবাদ রেখেছিলাম, ‘বিকাশের’ রাজনীতি মুখ্য ফোকাসে থেকে সাফল্য দেখাতে পারলে হিন্দুত্ব ভুলে বা হিন্দুত্বকে পেছনে ফেলে বা চাপা দিয়ে ভারতের হিন্দুত্ব রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আড়ালে চলে যেতে পারে। কিন্তু ঘটনা আকস্মিক সেদিকে না গিয়ে এর বদলে এক ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে মোদিই কার্যত হেরে গেছেন দেখা যাচ্ছে। ফলে মোদি সরকারের ১৮ মাসেই দেখা যাচ্ছে, কী ভয়াবহভাবে মোদি ক্রমেই হিন্দুত্বের রাজনীতির তলে হারিয়ে যাচ্ছেন।
৮ নভেম্বর নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন শেষে ভারতের মিডিয়ায় প্রধান আলাপ উঠেছে এখন বিহারে বিজেপির হারের পর মোদি নিশ্চয়ই তার নীতিতে ‘কারেকশন’ আনবেন, ‘সহিষ্ণুতায়’ ফিরিয়ে আনবেন ইত্যাদি। উপরের আলোচনা থেকে এটা মনে করাই স্বাভাবিক যে, এমন আশাবাদ ভিত্তিহীন। মোদি, বিজেপি অথবা আরএসএস এখন কি পিছু হটে আসার কথা ভাববেন? মনে হয় না। অন্তত আজকের টিভি টকশো দেখে মনে হয়নি। বরং মোদি সরকারের বাকি সাড়ে ৩ বছর কীভাবে কাটবে, সে শঙ্কাই প্রবল হবে। স্বভাবতই এর আঁচ পড়শিদেরও ভোগাবে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি ও প্রতিক্রিয়াঃ
উপরে বয়স্ক নেতা যাদের কথা বলছিলাম এদের চারজন এলকে আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী, যশবন্ত সিং এবং শান্তা কুমার প্রকাশ্যে সরকারকে চিঠি দিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। মিডিয়ায় সে চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। ওর সারকথা হল, এর আগে দিল্লীতে হেরে যাবার পরও কোন শিক্ষা নেয়া হয় নায়। আর কাদের জন্য এই ব্যর্থতা তা চিহ্নিত ও দায়ী না করে আগের মতই এবারও চেপে যাওয়া হয়েছে। চিঠির পুর্ণ টেক্সট এখানে আগ্রহিরা দেখতে পারেন।

শেষ কথাঃ বিকাশের রাজনীতি বনাম বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি এই লড়াইয়ে শুরু থেকেই বিকাশ বিষয়টা মোদির এক ব্যক্তিগত সাফল্যের শখ বা অবসেশন এর বিষয় যেন এমনই থেকে গেছিল। অপরদিকে হিন্দুত্বের রাজনীতি – এটা জনগোষ্টির উগ্র হিন্দুত্ব-জাতীয়তাবাদের আবেগ তুলে সেই আবেগের উপর ভর করে ক্ষমতা তৈরি এবং এটা ক্ষমতায় যাওয়ার বেশ কাজের বিরাট হাতিয়ার – এই বোধও প্রবল। যেমন মোদি প্রথমবার গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী হবার পরে ২০০২ সালে দাঙ্গাটা করেছিলেন। এতে পরপর আরও দুবার মোট তিনবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু এরপরে আর দাঙ্গার পথে যান নাই। আবার লোকসভা ২০১৪ নির্বাচনে যেখান থেকে মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেন, ঐ নির্বাচনে কেবল উত্তর প্রদেশ রাজ্যে একই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়েছিলেন কিন্তু ফলাফল (মোট আশির মধ্যে বাহাত্তর আসন) নিজের পক্ষে আনতে পেরেছিলেন। ঐ ঘটনায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এক মামলায় প্রধান আসামি, তবে মামলা পেন্ডিং। আবার মোদী সরকার গঠনের পর ১৮ মাসে আরও দাঙ্গার ব্যাপারে চুপচাপ। তবে দলের ভিতর দুই লাইনের লড়াই আছে। এতে ইচ্ছা বা উভয় পক্ষ যেখানে একমত হয় যে দুটাই – বিকাশ ও হিন্দুত্ব – করতে হবে। সম্ভবত “বিকাশ” পক্ষে দ্রুত কাজ ততপরতার করলেও ফল দেখাতে বা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত তাদের চোখে ও মাঠে হাজির হতে সময় লাগতে পারে। তাই হিন্দুত্বের লাইন ততপরতা এই অপশনটা সমান্তরালে রেখে দিচ্ছে। কিন্তু এমন যুক্তি বা ভাবনা ভিত্তিহীন। কারণ ২০১৪ নির্বাচনে মোদির “বিকাশ” শ্লোগানের অর্থ বুঝতে তো গরীব মানুষের কোন অসুবিধা হয় নাই। তাঁরা হয়ত ফিগার ডাটা অথবা তত্ত্ব দিয়ে বুঝে না কিন্তু বুঝে নিজের কায়দায়। নইলে গত ৩০ বছরের নির্বাচনে যেখানে কেন্দ্রে কোন একক সংখ্যাগরিষ্টের সরকার আসে নাই। কংগ্রেস বা বিজেপির মত কোন সর্বভারতীয় দল একক সংখ্যাগরিস্টতা (অর্ধেক আসনের চেয়ে এক বেশি) পায় নাই।  সেই ট্রেন্ড থমকে দাড় করিয়ে মোদির জোটকে না কেবল একা বিজেপিকে জনগণ একক সংখ্যাগরিষ্টের দল হিসাবে ক্ষমতায় আনল। এবং খুব সম্ভবত জনগণকে মোদি ব্যর্থ করে দিলে জনগণ আবার বিগত দিনের ট্রেন্ডে ফিরে যাবে। আর কোন দিন ফিরে আসবে না। যে জনগণ শুধু শ্লোগান শুনেই অর্থ বুঝতে পারে তারা সরকারের সুদ্ধান্ত, ততপরতার অগ্রগিতি বুঝবে না এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

আবার আসলে, বিকাশ বনাম হিন্দুত্ব এর মধ্যে সম্পর্কটাই এমন বিরোধী যে দুটা একসাথে থাকতে চলতে পারে না। কারণ বিকাশ কার্যকর হতে গেলে সেখানে হিন্দুত্ত্বের দাঙ্গা অনিরাপত্তা অথবা ভারতের চলতি হালের ভাষায়, “অসহিষ্ণুতা” থাকতে পারবে না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের মোদিকে  পরামর্শের ভাষায়  “অসহিষ্ণুতা” চললে যেসব বিদেশী পুঁজি, সম্পর্ক, আস্থা তৈরি তিনি করেছেন এগুলো সব ফিরে চলে যাবে। ওবামাও কমবেশি তাকে একই কথা বলেছিলেন। ঘর ওয়াপসি বা চার্চে হামলা দেখে প্রকাশ্যে তবে পরামর্শের ভাষায় সাবধান করেছিলেন বলেই মোদি সময় একেবারে শেষ হবার আগেই নিজের নীতি ঘোষণা করেছিলেন, “নাগরিকের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার করা তাঁর সরকারের প্রতিশ্রুতি” – তা বলতে পেরেছিলেন।  লক্ষণীয় যে আধুনিকতার চিন্তা ফ্রেমে এটা ইউরোপের কোন রাষ্ট্রের ভাষা নয়; আমেরিকার কনষ্টিটিউশনের ভাষা। বলা বাহুল্য উগ্রজাতিয়তাবাদী  হিন্দুত্বের বিজেপির রাজনীতির সাথে “নাগরিকের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি” সামজ্ঞস্যপুর্ণ নয়। তবু মোদি এটাকেই তাঁর সরকারের নীতি বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।  কিন্তু এতে উত্থিত সংঘাত সামলাতে পারেন নাই। যেখান থেকে পরবর্তি নতুন আরও বিরোধ সংঘাতের মুখোমুখি তিনি।

এনডিটিভি এই মিডিয়া প্রশ্ন তুলেছিল বিহারের নির্বাচনে গরু আদর করা মেয়ের ছবির পোস্টার করার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে বলছিলেন, মোদি যদি বিকাশের” কথাই বলবেন রাজনীতি করবেন তাহলে এই পোস্টারের সাথে বিকাশের যোগসুত্র কী?

আসলেই মোদি এদুটোর মধ্যে সম্পর্ক কী তা কখনই দেখাতে পারবেন না। দলের আভ্যন্তরীণ গঠন প্রকৃতির জন্য আগামিতেও নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারবেন – এমন আশা করার সুযোগও খুবই কম। বিশেষ করে গরুর মাংস আর বিহারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপির বয়ানের যে মান হাজির হয়েছে। 

ওদিকে মোদির “বিকাশ” রাজনীতি ব্যর্থ হবার অর্থ হল, ভারতের ভবিষ্যত, ভারতের রাজনীতি অতলে হারিয়ে যাবার এক প্রবল সম্ভাবনা। বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে – “বিকাশের”, মানে এক বিকশিত ভারত আমাদের জন্য কাম্য। না, এটা ভাবভালবাসার উইশ বা ফর্মালিটির কথা নয়। কারণ এর অর্থ হিন্দুত্বের রাজনীতির দিন শেষ হবে। এটা এই অঞ্চলের জন্যও কাম্য।

[এই লেখাটা গতকাল দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় সংক্ষিপ্ত রূপে ছাপা হয়েছিল। এখানে পুরা ভার্সান ছাপা হল। ]

গৌতম দাস : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s