ভারত-চীনের সাথে সম-সম্পর্ক রক্ষার মানে কী


ভারত-চীনের সাথে সম-সম্পর্ক রক্ষার মানে কী
গৌতম দাস
২৩ নভেম্বর ২০১৫
http://wp.me/p1sCvy-d1

বাংলাদেশে যোগ দেয়া শ্রীলঙ্কার নতুন রাষ্ট্রদূত গত ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ডিকাব) সাথে এক মতবিনিময়-বিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে দৈনিক মানবজমিনে এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে পরের দিন, গত ১৩ নভেম্বর। মানবজমিন লিখেছে, “ভারত ও চীনের সঙ্গে সমান সম্পর্ক রক্ষা করে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দুই দেশ বেশি সুফল পেতে পারে” বলে মনে করেন ঢাকায় নিযুক্ত শ্রীলঙ্কান হাইকমিশনার ইয়াসোজা গুনাসেকেরা।
রাষ্ট্রদূতের এই বাক্যের কথা আপাতভাবে খুবই সাদামাটা মনে হতে পারে; কিন্তু আসলে তা নয়। ওই বাক্যে গুরুত্বপুর্ণ শব্দ হলো, সমান বা সমান সম্পর্ক। অর্থাৎ তিনি চীন ও ভারতের সাথে শুধু সম্পর্ক রক্ষা নিয়ে কথা বলেননি, বলেছেন ‘সমান সম্পর্ক’ রাখার কথা। আর সমান সম্পর্ক রাখাটা হবে ‘বেশি সুফলের’, সে কথা তিনি বলছেন। কেন? সেটাই আজকের লেখার প্রসঙ্গ।

গ্লোবাল রাজনৈতিক পরিসরে এক বিস্তর পালাবদলের কালে
এই শতকে দুনিয়াতে গ্লোবাল রাজনৈতিক পরিসরে এক বিস্তর পালাবদল চলছে। আমেরিকার পরাশক্তিগত অবস্থান নড়বড়ে হওয়ার কথা আগেই শুনা গিয়েছিল এখন বাস্তবে ফলতে শুরু করেছে। কোনো রাষ্ট্র পরাশক্তিগত অবস্থান পায় বা দেখাতে পারে, যখন এর আগেই  অর্থনীতি শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে দেশটির অর্থনীতি প্রথম দুই বা বড়জোর তিন রাষ্ট্রের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গিয়ে থাকে। বলা যায়, দুনিয়ায় অর্থনীতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থানের ওপর ভর করে কোনো রাষ্ট্র পরাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। অর্থনীতিগত অবস্থানের দিক থেকে চীন আমেরিকাকে কয়েক বছর ধরে ছাড়িয়েই যাচ্ছে বলেই আমেরিকার পরাশক্তিগত অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দ্বিতীয় আর এক ঘটনা হলো, বিশ্ব অর্থনীতিতে পুঁজিপ্রবাহের অভিমুখ পশ্চিম থেকে পুব দিকে এশিয়ামুখী হয়ে পড়েছে। দুনিয়ায় অর্থনৈতিক তৎপরতার মোকাম বা ভারকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এশিয়া। এসবের মিলিত ফলাফলে এশিয়ায় আরো দুটো ইস্যু তৈরি হয়েছে। একটা আমাদের সাউথ এশিয়া অঞ্চলের ধরাধরি আর অন্যটা সাউথ চায়না সি বা চীনের প্রবেশ পথ দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলের উত্তেজনা। এমন উত্তেজনার মূল কারণ বিশ্বে আমেরিকার পরাশক্তিগত প্রভাব কমে যাওয়া টের পেয়ে আমেরিকা নিজেই এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর কাছে নিজের সামরিক ক্ষমতাজাত সার্ভিস বিক্রির চেষ্টা করছে। সে এই বলে  এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে যে, চীনের নব উত্থান ও এর কোনো সম্ভাব্য খারাপ প্রভাব থেকে বাঁচতে তোমাদের সামরিক সহযোগিতা দরকার হবে। এই বরকন্দাজ হতে সার্ভিস দিতে চাই আমি। বিনিময়ে তোমরা আমার সাথে এক টিপিপি (ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে আমাকে ব্যবসায় দিবে। সাউথ চায়না সিকে কেন্দ্র করে আমেরিকার তৈরি করা দ্বন্দ্ব ও টেনশন ছড়ানোর বৈশিষ্টটা এ রকম।
আর অন্য দ্বিতীয় বিষয়টা হল, আমাদের অঞ্চলে মানে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেরটা আর একটু অন্য রকম। বাড়তি আরো কিছু বৈশিষ্টের কারণে। সেটা হলো, আমেরিকা ভারতকে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে বা পাশে আছে ধরনের ধারণা তৈরি করে  ভারত-চীনের দ্বন্দ্ব উসকে দিতে চাইছে। এটা করার সুযোগ নিতে পারছে কারণ ভারত ও চীনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বন্দ্বের ইস্যু আছে। আর তা মূলত অসম সামরিক সক্ষমতার কারণে। ভারতের সামরিক সক্ষমতার ঘাটতি – যেটা আমেরিকা বিক্রি ও সরবরাহ দিবার উছিলায় সে ভারতের ঘনিষ্টতা চাইছে। আবার ভারতও সম্ভাব্য সামরিক বিরোধের কথা ভেবে আমেরিকাকে অস্ত্রের উৎস এবং বিরোধে অন্তত মধ্যস্থতাকারীর ভুমিকা নিতে পারে – এমন দরকার অনুভব করছে। এছাড়া ১৯৬২ সালের অভিজ্ঞতা ভারতের ভাল নয়। এসব মিলিয়ে সারকথায় চীন নিয়ে ভারতের ভীতি ও সন্দেহ আছে, আর আমেরিকা সেটাকেই ভালোমতো ব্যবহার ও উসকে দিয়ে রাখতে চায়। আবার চীন-ভারতের সম্পর্ক সবটাই বিরোধাত্মকতা নয়। বরং আর বিপরীত দিকে ভারত-চীনের পারস্পরিক ব্যবসায়িক সহযোগিতার প্রয়োজন এবং স্কোপ আছে। এবং সে সুযোগ পরস্পর নিচ্ছে। বাণিজ্য-ব্যবসায়ের দিক থেকে উভয়ের উভয়কে দরকার। কিন্তু আর এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আর এক দিক আছে। আমেরিকার নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে পরিচালিত চলতি অর্থনৈতিক গ্লোবাল অর্ডারটা যেটা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। BRICS ও AIIB ধরণের উদ্যোগের আবির্ভাব এর প্রমাণ। পুরানা অর্ডারটাকে ভেঙে আমেরিকার কর্তৃত্বের বাইরে এক নতুন গ্লোবাল অর্ডার দাঁড় করাতে ভারত ও চীনের একসাথে কাজ করা উভয়ের ভবিষ্যতের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দিকটা খেয়াল করে আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে ভারতের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের দিকগুলো উদোম করে উসকানি দিয়ে প্রধান ও মুখ্য করে তোলার নীতি নিয়েছে। এসবের মিলিত প্রভাব ও ফলাফলে এশিয়া, বিশেষত আমাদের অঞ্চলে মূল তিন শক্তি আমেরিকা, ভারত ও চীন – এশিয়ায় পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে, টানাহিঁচড়া করছে, এশিয়ার বাদবাকি প্রত্যেকটা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার প্রবল চেষ্টা করছে। এ অঞ্চলের প্রতিটা দেশের রাজনীতিতে এই তিন শক্তির প্রভাব তাই আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রবল। অন্য দিকে প্রতিটা দেশের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী মুল দু-তিনটা রাজনৈতিক দল থাকে, সম্পর্কের দিক থেকে এরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও এটাই স্বাভাবিক। তবু অনেক সময় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্ব বিদেশী তিন রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্বের আলোকে সাজানো হয়ে যায়, জড়িয়ে যায়। যা হওয়া উচিত নয়। কারণ যার যার নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের দিক থেকে এমন অবস্থা মারাত্মক আত্মঘাতী।
আমেরিকা, ভারত ও চীন এই তিন রাষ্ট্রের প্রত্যেকের স্বার্থের লড়াই, পারস্পরিক শত্রুতা ইত্যাদি প্রত্যেকেই নিজ রাষ্ট্রস্বার্থে করছে, লড়ছে; এগুলো করারই কথা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবল একটা বিষয় বাদে তা হবার কথা। তা হলো, আমেরিকার নেতৃত্বে-কর্তৃত্বে পরিচালিত চলতি অর্থনৈতিক গ্লোবাল অর্ডারটা ভেঙে নতুন গ্লোবাল অর্ডার দাঁড় করানো – এ বিষয়টায় চীন ও ভারতের কোর স্বার্থ একই।
কিন্তু এতে আমাদের কী? এটা কী শুধুই আমেরিকা, ভারত ও চীন এই তিন রাষ্ট্রের প্রত্যেকের নিজ নিজ স্বার্থের লড়াই যেখানে আমরা দর্শকমাত্র যার কিছুই আসে যায় না? না একেবারেই তা নয়। এটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখা পরাশক্তিগত লড়াইয়ের মত নয়। আমাদের সুনির্দিষ্ট স্বার্থ আছে। এটাতে আমাদের মতো গরিব রাষ্ট্রসহ সবারই এখানে গভীর ও এক  কমন স্বার্থ আছে। গ্লোবাল বাণিজ্য বিনিময়ের চলতি বিশ্বব্যবস্থা যেটা আমেরিকার মত মোড়ল ও তার সাগরেদদের দিকে কান্নি মেরে সাজানো ও দাঁড়ানো ব্যবস্থা বলে যেটাকে আমরা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা বলে অভিযোগ করি – এরই তো ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। অল্প বিস্তর ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। এটা পুরা ভেঙ্গে নতুন আসন্ন ব্যবস্থাটায় আমাদের জন্য কতটুকু কী রিলিফ দিবে তা তো কেউ এমনি দিবে না, আর তা বুঝে নিবার ব্যাপার ও কাজ আছে। সেজন্য আমাদের প্রথম কাজ হল, পরিবর্তনের অভিমুখ রবং কোথায় কী পরিবর্তন হতে পারে কতটুকু তা ঠিকমত বুঝে পদক্ষেপ নেয়া, নিজের অবস্থান নেয়া, দল জোট পাকানো ইত্যাদি। ফলে চীন ও ভারতসহ এই ইস্যুতে যারাই নতুন গ্লোবাল অর্ডার বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বিনিময়ব্যবস্থা দাঁড় করানোর পক্ষে থাকবে তাদের পক্ষে থাকা আমাদের কাজ। এই ইস্যু বাদে অন্য সব বিষয়ে আমেরিকা, ভারত ও চীনের লড়াই আসলে তাদের নিজ নিজ একান্ত স্বার্থে নিজের লড়াই। আমাদের রাষ্ট্রস্বার্থ তাতে নেই। অতএব সাবধান, এসব ধরনের লড়াইয়ে এই তিন শক্তির কোনো একটার পক্ষ নেয়া আমাদের রাষ্ট্রস্বার্থের জন্য বিপজ্জনক। বিশেষত এই তিন রাষ্ট্রের কোনো একটার কোলে ঢুকে অপর দুই অথবা কোনো একটার পক্ষে দাঁড়ানো আরো বিপজ্জনক। যেমন, চীনের কোলে বসে চীন-ভারতের বিরোধকে কাজে লাগিয়ে চীনের পক্ষ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো। অথবা ঠিক একই কাজ কিন্তু উল্টা ভাইস ভারসা – ভারতের পক্ষে জোটবদ্ধ হয়ে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। অর্থাৎ ভারত অথবা চীন কোনো একটার পক্ষ নিয়ে নিজের স্বার্থে অপরটার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো বা খেলার চেষ্টা – এটা অতিবুদ্ধিমানের গলায় দড়ির অবস্থাই তৈরি করবে।
এ ধরনের ঘটনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাধারী দেশ হলো শ্রীলঙ্কা। সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে আমরা খুঁজছি রাষ্ট্রদূতের ‘সমান সম্পর্ক’ কথাটার অর্থ ঠিক কী হতে পারে বা হওয়া উচিত।

কী কী নির্ণায়ক মেনে চললে সেটা ‘সমান সম্পর্ক’ কথাটার অর্থ হবে :
০১. আমেরিকা, ভারত ও চীন – কোনো এক রাষ্ট্র অন্য দুইয়ের যে কারো উপর বাড়তি সামরিক স্ট্র্যাটেজিক সুবিধা পায়, এমন কাজে সহযোগিতা করার বিষয়কে বাংলাদেশের জন্য হারাম জ্ঞান করতে হবে।
০২. তিন রাষ্ট্রের প্রত্যেকের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে অবশ্যই গভীরে নেয়া যাবে। কেবল কাউকে একচেটিয়া, বিশেষ করে অন্যকে বঞ্চিত করে একচেটিয়া বাণিজ্যিক সম্পর্ক করা বা দেয়া যাবে না।
০৩. এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মাপকাঠি হিসেবে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সিদ্ধান্তের মুখ্য বিষয় অবশ্যই নিজ রাষ্ট্রস্বার্থ হতে হবে। এদিক থেকে তাকিয়ে কাজ করলেই তখন আর কোনো সিদ্ধান্তকে ‘কারো বিরুদ্ধে কাউকে বাড়তি সুবিধা’ দেয়ার জন্য করা হচ্ছে এমন হবে না। কেউ আঙুল তুলতেও পারব না।
০৪. এই তিন রাষ্ট্রের কোনো একটার সামরিক স্বার্থকে বাংলাদেশের সাথে করা ওর বাণিজ্যের সম্পর্ক আলাপ ডিলের ভেতর আনা যাবে না। সযত্নে দূরে রাখতে হবে। যেমন গভীর সমুদ্রবন্দর এটা একমাত্র বাণিজ্যিক বিষয়, পারস্পরিক একমাত্র বাণিজ্য সহযোগিতার বিষয় হিসেবে আসতে হবে। এর ভেতর কোনো ধরনের ইস্যু যেমন, সামরিক বিষয় আনা যাবে না। মিলানো যাবে না, হারাম জ্ঞান করতে হবে। বন্দর প্রজেক্টকে পরবর্তিতে কখনও প্রয়োজনে বা সময়েও সামরিক ব্যবহার করা যাবে না এই সুযোগ আগে থেকেই মুখবন্ধেই ঘোষণা দিয়ে নাকচ করে রাখতে হবে।
০৫. তিন রাষ্ট্রের কারো সাথে এমন কোনো সম্পর্কে যাওয়া যাবে না, যেটা দেশের নয় বরং ক্ষমতাসীন নিজ দলকে ক্ষমতা রাখতে সুবিধা পাওয়ার জন্য করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলকে মনে রাখতে হবে – কারণ এর অর্থ হবে, নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী দলকেও একই কাজ করতে উসকানি দেয়া ও আগাম নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়ে রাখা।
০৬. এই তিন রাষ্ট্রের যেকোন কারো কাছ থেকেই যেকোনো সামরিক হার্ডওয়ার অবশ্যই কেনা যাবে; কিন্তু কোনো সামরিক সহযোগিতা চুক্তি, যেটা বিশেষত অন্য দুইয়ের যেকোনো এক অথবা দুটোরই বিরুদ্ধে তৎপরতা মনে হয় এমনটতে জড়ানো যাবে না। যেমন, চীনা সাবমেরিন বা আমেরিকান হার্ডওয়ার বা পুরান নেভি আইটেম কেনা, বা অল্প দামে পাওয়া ঠিক আছে। কিন্তু এর বদলে অন্য দুই যে কোন রাষ্ট্রের সাথে কোন সামরিক সহযোগিতা চুক্তি বিশেষত যেটা এই তিনের অন্য যেকোন রাষ্ট্রস্বার্থের বিরুদ্ধে যায় তা করা যাবে না।
০৭. কোনো “প্রতিহিংসায়” তিনের কোনো এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, পথ চলা বা পরিচালিত হওয়া যাবে না। তাতে অতীতে ওই রাষ্ট্র আমাদের নিজ দেশেরই কোনো এক রাজনৈতিক দলের সাথে বিশেষ খাতিরের সম্পর্ক রক্ষা করে থাকুক না কেন। এর কারণ, আমাদের কোথাও না কোথাও ফুলস্টপ বলতে হবে। কেয়ামত সে কেয়ামত সেটা চলতে দেয়া যাবে না। কারণ প্রতিহিংসার সূত্রে আবার ভবিষ্যতে এই তিনের আর এক রাষ্ট্রকে কোনো বিশেষ ফেবার দেয়া অথবা বঞ্চিত কোনোটাই দিতে করতে শুরু হতে দেয়া যাবে না। যেমন ভারতের এখনকার ভূমিকার জন্য প্রতিহিংসা করা যাবে না। ভারত অথবা চীনকে শাস্তি দেয়ার জন্য আমেরিকার সাথে কোনো সামরিক সহযোগিতায় জড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

ওপরের এই সাতটা পয়েন্ট দিয়ে যা বলতে চাচ্ছি তা হল পুরা বিষয়টা বুঝিয়ে বলার সুবিধার জন্য কেবল। এটা অবশ্যই এই সাত পয়েন্টই সব কথা বা শেষ কথা, তা মনে করে নেয়া ভুল হবে।

ঘটনার ব্যকগ্রাউন্ড শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার পরপর দু’বারের বিগত সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজা পাকসে। তার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগে কয়েক যুগ ধরে চলে আসা শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহকে তাঁর কালে প্রথম বলপ্রয়োগে দমন ও বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপকে সমূলে উৎখাত করে দেয়া হয়েছিল। এ কাজে চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। জাতিসংঘে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ও এসংক্রান্ত চাপ সামলাতে ভূমিকা রেখেছিল দেশটি। ফলে বিদ্রোহ দমন-উত্তর পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার পাকসের সরকারকে চাপ সামলানোর দিক থেকে চীনের খুবই উল্লেখযোগ্য সহযোগিতার ভূমিকা ছিল। এ ছাড়া আবার ঐ আমলে চীনের বিপুল বিনিয়োগও শ্রীলঙ্কায় এসেছিল। আর সর্বশেষ চীনের দুই সাবমেরিনের বহর তিনি শ্রীলঙ্কার বন্দরে নোঙর করতে দিয়েছিলেন। কী বয়ানে কী সম্পর্কে চীনা সাবমেরিন এসেছিল, তা সাধারণ্যে যথেষ্ট স্পষ্ট জানা না গেলেও ভারতের সরকারের ও মিডিয়ায় এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল প্রবল। কারণ টেনশন কমিয়ে দূরে রাখার জন্য অনেক সময় ‘শুভেচ্ছা সফরেও’ নৌজাহাজ আমেরিকারটা চীনে অথবা চীনেরটা আমেরিকায় যায়। এমনকি আবার ‘যৌথ সামরিক মহড়াও’ হতে দেখা যায়।

মুক্তামালায় ঘিরে ধরার গল্প
এছাড়া  এ প্রসঙ্গে আর এক কথা বলা ভালো। বিগত ২০০৫ সালে বুশের আমলে ভারত-আমেরিকার বিশেষ সম্পর্ক শুরু হয়। এমনটা শুরু হওয়ার আগে ভারত সরকারের সামরিক, স্ট্র্যাটেজিক, নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোয় থিংক ট্যাংক বা এমন বিষয়ে গবেষণা খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ভারত সরকারি বিনিয়োগ খুবই কম ছিল। এরই অবসান ঘটেছিল, সামরিকসহ বহুবিধ খাতে ভারত-আমেরিকার সহযোগিতা চুক্তির যুগ ২০০৫ সালে শুরু হলে থিংক ট্যাংক বা গবেষণা খাতেও আমেরিকা সহযোগিতা দেবে এমন চুক্তি হয়। ফলে প্রতিষ্ঠান গড়তে সহযোগিতা দেবে বা আমেরিকান থিংক ট্যাংক বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভারতীয় শাখা খুলবে, আমেরিকান পিএইচডি স্কলারশীপে বা কাজের খরচ যোগাতে স্কলারশিপে যৌথ গবেষণার কাজ করবে,   ইত্যাদি নানা কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। এতে আসল যে ঘটনাটা ঘটে যায় তা হল, আমেরিকান থিংক ট্যাংক-গুলোর বয়ান, দৃষ্টিভঙ্গি এরপর থেকে ভারতীয় ইনটেলেক্টদেরও বয়ান দৃষ্টিভঙ্গি হতে শুরু করে যায়। বিশেষত আমেরিকার চীনবিরোধী বা ক্যাম্পেইনমূলক যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর বয়ান ভারতে ভালোমতো ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেসব বয়ানগুলোই আবার এদের লেখা কলাম বা বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য সুত্রে ভারতীয় মিডিয়াতে ছেয়ে ফেলে। যেমন চীন নাকি গভীর সমুদ্রবন্দর বানিয়ে ভারতকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। অথবা চীন ভারতকে সামরিক দিক থেকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছে। লাফলে ভারতীয় মিডিয়ার কল্যাণে এগুলো অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ও পপুলার প্রপাগান্ডা এবং একচেটিয়া বয়ান হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এই প্রপাগান্ডা বয়ানের দুর্বল দিক হল, যেন গভীর সমুদ্রবন্দর বানানো বিষয়টা সামরিক উদ্দেশ্যেই একমাত্র হয়, এটা ধরে নেয়া হয়েছে। অথচ বন্দর বানানোর প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্যই হতেই হয় বাণিজ্য। বাণিজ্য উদ্দেশ্য সাধিত হবার পরে পড়ে পাওয়া সুবিধা হিসাবে সামরিক কাজে এর ব্যবহার এটা অপ্সহনাল ব্যাপার। কখনই মুল উদ্দেশ্য হয় না। কারণ একমাত্র বাণিজ্যিক আয় দিয়েই কোন বন্দর বানানোর কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিপুল খরচ তুলে আনা সম্ভব। সে জন্য বাণিজ্যই একমাত্র ও  মুখ্য উদ্দেশ্য হতে বাধ্য। যদিও এরপর বন্দর মালিক রাষ্ট্রের অভিপ্রায় থাকলে এর দ্বৈত ব্যবহার হিসেবে সামরিক কাজে তা ব্যবহার হতে পারে। কিন্তু যদি বলা হয় কেবল ভারতকে ঘিরে ফেলার উদ্দেশ্যেই এই গভীর সমুদ্রবন্দরগুলো করা হচ্ছে, তবে তা সত্যের অপলাপ এবং প্রপাগান্ডাই হবে। এ ছাড়া মুক্তোর মালা বা ঘিরে ফেলা বলতে যে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে, সেটাও কতটা সত্যি তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এপর্যন্ত পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় দুটো গভীর সমুদ্রবন্দর হয়েছে, তাতেই মুক্তোর মালা বা ঘিরে ফেলা বয়ান শুরু হয়। বাংলাদেশের সোনাদিয়া তখনো আলাপে আসেনি।বা এখনও বাস্তবায়নের আলাপ নাই। কিন্তু এই প্রপাগান্ডায় যে ফ্যাক্টসকে পরিকল্পিতভাবে আড়াল করা হয় তা হল, চীনের উত্তরপুর্ব দিক ছাড়া বাকি তিন দিকের ভুখন্ড ল্যান্ড লকড – ভুবেষ্টিত। সমুদ্রে বের হবার পথ নাই। বিশেষ করে চীনের পুরা দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পুর্ব দিক পাহাড় পর্বতে অগম্য। তবে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পুর্ব সীমান্ত পুরাপুরিভাবে ল্যান্ড লকড হলেও তা ছুটাবার কিছু সুযোগ আছে। যদিও ওসব দিক দিয়ে কোন সমুদ্রে বের হওয়ার উপায় নেই, কিন্তু চীনের পশ্চিম, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব (কুনমিং) অঞ্চলের মানুষকে পুরা চীনের সাথে সমানতালের বিকাশে আনতে চাইলে চীনকে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে বন্দর বানিয়ে দিয়ে ওই বন্দর নিজেরও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্রেতা হিসেবে হাজির হলে তা উভয় দেশেরই লাভ হতে পারে। যার মূল কারণ চীনও ওসব বন্দরের ব্যবহারকারি হবে বলে এই অর্থে বিনিয়োগ পরিকল্পনার খরচ তুলে আনা ভায়াবল হয়, তাই। অন্য দিকে চীনেরও ল্যান্ড লকড দশা ঘোচে। অর্থাৎ মুক্তোমালার গল্প থুয়েও আমরা এর ভিন্ন ও আর এক বয়ান পেতে পারি। অর্থাৎ পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও সম্ভাব্য বাংলাদেশ এই তিন দেশ যদি বাণিজ্যিক ব্যবহারের সুযোগ চীনকে দেয় তবে সবারই বাণিজ্যিক লাভ হয়। তাই চীনের ল্যান্ড-লকড দশার দিকে নজর না দিয়ে কেবল ভারতকে ঘিরে ধরার জন্য এই বন্দর নির্মাণ করছে এই বয়ান খুবই নিম্নমানের প্রপাগান্ডা। এখন এই তিন দেশ যদি বাণিজ্যিক ব্যবহারের সুযোগের উপরে চীনকে সামরিক ব্যবহারের সুযোগ খুলে তখন ভারতের প্রপাগান্ডা অর্থপুর্ণ হতে পারে। আপাতত এবিষয়ে  কোন সামরিক সহযোগিতা চুক্তির ছায়া চিহ্নও নাই।

গল্পের বিকল্প ও বুদ্ধিমান হওয়া
তবু ভারতের মনে সন্দেহ আছে এটা বাস্তবতা। এই আলোকে ভারত বুদ্ধিমানভাবে ইতিবাচক হতে পারে। যেমন এসব বন্দর ব্যবহারের চুক্তি যেন অ-সামরিক থেকে যায় এই স্বার্থকে লবি বা পারশু করা। বিশেষত ভারতও ওসব বন্দর ব্যবহারকারি হয়ে নাম লিখানো সবচেয়ে ভাল। সেক্ষেত্রে ঐ বন্দর “কেবল বাণিজ্যিক কাজেই” ব্যবহারকারি সকলে ব্যবহার করবে একথা মুখবন্ধ ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া সহজ। যেমন  বাংলাদেশের বেলায় তো এটাই সহজ পথ।
বিশেষ করে যেমন, বাংলাদেশে কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর যদি হয়, তবে বাস্তবতই এর ব্যবহারকারী হবে চীন ও ভারত উভয়েই। কারণ এরা উভয়েই – চীনের বেলায় ওর দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশ (কুনমিং) এবং ভারতের বেলায় ওর পুরা সাতভাই পূর্ব দিক ল্যান্ড লকড। কারণ এখানেও আবার বন্দরের ব্যবহারকারী বেশি হবে বলে বন্দর বানানোর বিনিয়োগ খরচ তুলে আনার সম্ভাব্যতা সম্ভাব্য এই বন্দরের সবচেয়ে ভালো এবং কম সময়ে ঘটবে। আর সে জন্য এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বাংলাদেশকে আগেই ঘোষণা করে বলতে হবে এবং বলা সম্ভব যে বিদেশীদের এই বন্দরের সামরিক ব্যবহার নিষিদ্ধ। কারণ যে বন্দরের সম্ভাব্য ব্যবহারকারী চীন ও ভারত উভয়েই, সেখানে একমাত্র আগেই নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়ে তবেই এই প্রকল্প নেয়ার পথে আগানো সম্ভব।

যা-ই হোক, আমাদের শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গে ফিরে যাই।  শ্রীলঙ্কার হাম্বনটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর এমনিতেই অনেক আগে থেকেই ‘মুক্তামালায় ঘিরে ধরার’ প্রপাগান্ডার শিকার। এর ওপর আবার শ্রীলঙ্কায় চীনা সাবমেরিন আসাটা, বোঝা যায় এটা যথেষ্ট সেনসিটিভিটি বা সতর্কতার সাথে করা হয়নি, তা আজ বলাই বাহুল্য। এর ফলাফল হয়েছিল মারাত্মক। শ্রীলঙ্কার গত নির্বাচনে রাজাপাকসেকে সরাতে ভারতের বিশেষ হস্তক্ষেপ তৎপরতার অভিযোগ পাকসে ক্যাম্প থেকে উঠেছিল। শ্রীলঙ্কায় পরপর দু’বার নির্বাচন ঘটিয়ে পাকসের বিপরীত ক্যাম্প ‘চীনের সে বাড়তি প্রভাব’ দূর করেছে। আপাতত নতুন সরকার থিতু হয়েছে। সেসবের বিস্তারে এখানে না গিয়েও বলা যায়, রাজা পাকসের অতিরিক্ত চীনের দিকে ঢুকে যাওয়ার অভিযোগ কমবেশি সত্য। এই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করেই শ্রীলঙ্কার নতুন রাষ্ট্রদূত সম্ভবত বলেছেন, ‘ভারত ও চীনের সাথে সমান সম্পর্ক রক্ষা করে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দুই দেশ বেশি সুফল পেতে পারে।’
আবার সমান সম্পর্ক বলতে এক ধরণের ভারসাম্যমূলক এক সম্পর্কের কথা তিনি বলছেন। কিন্তু এখানে সমান মানে ‘সমান দূরে’ ঠিক তা নয়। আবার ভারসাম্য বলতেও লাঠির এক দিকে চীনকে, অন্য দিকে ভারতকে বেঁধে কাঁধে নেয়ার ভারসাম্য ঠিক তাও নয়। বরং ওপরে যে সাতটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছি সে আলোকে এটা বোঝা যেতে পারে। যার সারকথা হলো, বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কাকে ভারত-চীনের দ্বন্দ্ব অবিশ্বাস ও সন্দেহের ভেতরে, ওর অংশ হওয়া যাবে না। এটা ভুল হবে। এই অর্থে এটা সমান সম্পর্ক বা ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক।

সতর্কতা
এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, এ কালের যেকোনো দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সম্পর্ক সব সময় বিশেষ। েই অর্থে যে, তা কোনভাবেই আর আগের দিনের (১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগের) মত নয়। কোনোভাবেই তা রাশিয়া-আমেরিকার কোল্ড ওয়ারের কালের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝার চেষ্টা করা যাবে না, গেলে ভুল হবে। স্পষ্টতই কারণ এখানে চীন-ভারতের দ্বন্দ্বের কথা যেমন বলা হচ্ছে ঠিক, তেমনই সেই চীনের সাথেই আবার মোদি সরকারের আমলে ভারতের ২০ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে, কাজ চলছে। চীন-ভারত উভয় পক্ষের বাণিজ্যের বাজার ৭০ বিলিয়ন ডলারের কম নয়। এ দিকগুলো মনে রেখে ভারত-চীন সম্পর্ক বুঝতে হবে।

অস্থির উথালপাথাল সময়ে বুদ্ধিমান প্রুডেন্ট হওয়াই একমাত্র ভরসা।

[এই লেখাটার আগের ভার্সান দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেটা আরও পরিবর্তন, সংযোজন ও এডিট করে ফাইনাল ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s