বাংলাদেশে “আইএস এসেছে, আইএস আসে নাই” মনে হচ্ছে এই ছুপাছুপি খেলার অবসান ঘটতে শুরু করেছে। ২৮ নভেম্বর শুরুর প্রথম প্রহরে চ্যানেল আইয়ের টকশোতে এসেছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত। আলোচনার এক ফাঁকে তিনি সরাসরি উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরীকে বলেই ফেললেন,”দাবিক” ম্যাগাজিনটা দেখেছেন নিশ্চয়! বলা বাহুল্য, দৈনিক মানবজমিনের মালিক সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীই সম্ভবত সবার আগে তাঁর পত্রিকায় দাবিকের ১২তম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘দি রিভাইভাল অব জিহাদ ইন বেঙ্গল’ রিপোর্টের রিপোর্ট ছাপিয়েছিলেন। বলা যায়, “আইএস আছে” দাবির পক্ষে প্রথম স্থানীয় মিডিয়ার স্বীকারোক্তি সেটা।
আইএসের মুখপত্র বলা হয়ে থাকে বা স্বীকৃত মাসিক ম্যাগাজিন হলো দাবিক। বিদেশী গোয়েন্দা ইনটেলিজেন্স জগতে দাবিককে আইএসের মাসিক মুখপত্র মনে করা হয়। আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো থেকেও স্বীকারোক্তি মিলা শুরু হয়েছে। ওদিকে ভারতের অবস্থান বেশ তামাশার। অথবা বলা যায়, ‘দাবিক আইএসের মুখপত্র নয়’এমন উল্টা দাবি কোনো মহল থেকেই এখনো কাউকে করতে দেখা যায়নি। বিশেষত দাবিকের ১২তম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘দি রিভাইভাল অব জিহাদ ইন বেঙ্গল’ রিপোর্ট ছাপা হবার পর। তবে মাস খানেক আগে “আইএস বলে কিছু নাই। সব জামাত এর কাজ।” এই ভাষ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্সীর বরাতে বহু রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। যেমন টাইমস অব ইন্ডিয়া ০৬ অক্টোবর সংখ্যা। বাংলাদেশের ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো এই রিপোর্টের বরাতে নিজ নিজ পত্রিকায় পরের দিন লেখা ছাপিয়েছে। টাইম অব ইন্ডিয়া ভারতের ইন্টেলিজেন্স সুত্রের বরাতে আমাদেরকে ‘নিশ্চিত করছে’ বলে পত্রিকাটা দাবি করেছিল যে দুই বিদেশী হত্যায় আইএসের সংশ্লিষ্টতা নেই। সেই সাথে আমাদের জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের মতোই বরং একাজের জন্য তারা জামায়াতে ইসলামিকে দায়ী মনে করে। ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ আতা হাসনাইন দক্ষিণ এশিয়ায় উগ্রবাদী নেটওয়ার্ক সম্পর্কে একটি উপস্থাপনা দেন। তারপর প্রশ্নোত্তর পর্বে উপস্থিত একজন জানতে চান, বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি আছে কিনা। জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয়, বাংলাদেশে বিস্তৃতভাবে আইএস নেই। ভারত ও পাকিস্তানেও একইভাবে আইএসের বিস্তৃত উপস্থিতি নেই। হাসনাইন সাহেব ন্যদের চেয়ে একটু বুদ্ধিমান দেখা যাচ্ছে। তিনি যেন অস্বীকার করলেন না তবে বিস্তৃত উপস্থিতি নাই। অথচ এক মাসও যায়নি, মনে হচ্ছে এবার কানে পানি ঢুকেছে। হিন্দুস্থান টাইমস ২৮ নভেম্বর লিখছে, বগুড়ায় হামলার ঘটনায় আইএস-সংশ্লিষ্টতা নেই, সরকারি এই দাবিকে সন্দেহের মুখোমুখি করেছে। এছাড়া ভারতের দি হিন্দু পত্রিকা দাবিক পত্রিকায় আইএসের বক্তব্য সিরিয়াসলি নিয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে “বেঙ্গল” নামে ঢাক দেয়াটাকে। এককথায় বললে ভারতে বড় সব প্রিন্টেড মিডিয়া আইএসের উপস্থিতি প্রসঙ্গে আগের অস্বীকার অবস্থান ছেড়ে স্বীকার করে রিপোর্ট করা শুরু করেছে।
ভারতের মিডিয়ার অবস্থান তামশার বলছি আর এক কারণে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার ভারতী জৈন নামের সাংবাদিক ০৬ অক্টোবর (যে নিউজটা প্রথম আলো অনুবাদ করে ছেপেছে পরের দিন ০৭ অক্টোবর) ভারতের জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা লিখছেন, “জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের কার্যক্রম সারা বিশ্বেই আছে। দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চরমপন্থীদের সম্পৃক্ততা আছে—এমনভাবে প্রচার চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী; যেন কাজটি করেছে আইএস। এটি করা হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। জামায়াতে ইসলামীর এর পরের পরিকল্পনা হতে পারে, এটা দেখানো যে ‘হাসিনা সরকার বাংলাদেশে বিদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।” অথচ ঐ একই টাইমস অব ইন্ডিয়া গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় জামাতে ইসলামির আর এক রিপোর্ট ছেপেছে। এম পি প্রশান্ত নামের সাংবাদিক লিখছেন, ভারতের জামাতে ইসলাম আইএসের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামতে যাচ্ছে। “Jamaat-e-Islami to launch campaign against ISIS” – এই হল ঐ রিপোর্টের শিরোনাম। কারণ ভারতীয় জামাত মনে করে আইএস ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। কারণ তারা অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। আর আইএসের খলিফাগিরিও এক নকল কারবার”। তাহলে এই রিপোর্ট থেকে বুঝা যাচ্ছে আইএস কে জামাত কিভাবে মুল্যায়ন জানা যাচ্ছে। তাহলে ভারতের গোয়েন্দা রিপোর্টের বরাতে ঐ একই টাইমস অব ইন্ডিয়ার – “বাংলাদেশে জামাতই আইএস” এই প্রপাগান্ডার মানে কী?
সিরিয়ার উত্তরে আলেপ্পো প্রদেশের এক শহরের নাম দাবিক। এই নামের গুরুত্ব হল, বলা হয়ে থাকে কোনো এক হাদিসে এই শহরের নামের উল্লেখ আছে যে, এই শহরে রোমান অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের সাথে মদিনা থেকে আসা সৈন্যদের শেষ লড়াই হবে। এবং ক্রুসেডাররা পরাজিত হবে। হাদিসের মত ওল্ড স্ক্রিপ্টে এই শহরের নামের রেফারেন্স থেকে সম্ভবত সে কথা স্মরণ করে আইএসের পত্রিকার নাম দাবিক রাখা হয়েছে। এর আগে দাবিকের প্রথম সংখ্যায় তাঁরা নিজেদেরকে পরিচিত করার প্রতীকী স্লোগান হিসেবে লেখা হয়েছিল, ‘আনটিল ইট বার্নস দি ক্রুসেডর আর্মিস ইন দাবিক অর্থাৎ “প্রত্যাদেশ মোতাবেক দাবিক শহরে খ্রিষ্টান ক্রুসেডর সেনাদের পুড়িয়ে শেষ করার আগে পর্যন্ত”।
দাবিক যে কারণেই নাম রাখা হোক না কেন আমাদের প্রসঙ্গের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল এই ১২তম সংখ্যাতেই প্রথম ‘বেঙ্গল’ নাম উল্লিখিত হয়েছে। মোট ৬৫ পৃষ্ঠার এই সংখ্যায় ৩৭ নম্বর পৃষ্ঠায় কোনো এক আবু আব্দির রহমান আল বাঙালির রচিত একটা লেখা ছাপা হয়েছে। আবু আব্দির রহমান আল বাঙালির ওই লেখার শিরোনাম “দি রিভাইভাল অব জিহাদ ইন বেঙ্গল”। ঐ রিপোর্টের লক্ষণীয় ব্যাপার হল, নামের মধ্যে বাঙালি ও বেঙ্গল শব্দের বহুল ব্যবহার। বাংলাদেশকে কেন “বেঙ্গল” নামে তারা ডাকছে এর একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা বা নোট দিয়েছে। বলছে ১৯৭১ এর আগের (সম্ভবত বুঝাতে চেয়েছে বৃটিশ আমলের বাংলা) ন্যাশনালিষ্ট বাংলাকে বুঝাতে তারা “বেঙ্গল” নামটা নিয়েছে। এথেকে আমরা আবার “তাদের আপত্তিটা প্রো-পাকিস্তানি” বলে মিলিয়ে যেন ভুল না বুঝি। তাদের আপত্তিটা প্রো-পাকিস্তানি ধরণের মোটেও নয়। বরং যেকোন ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তাবাদে তাদের আপত্তি সেজন্য।
যাহোক সেটা, শুধু তা-ই নয় বাংলাদেশে আইএসের এফিলিয়েশন বা স্বীকৃতি দেয়া সংগঠন হিসেবে জেএমবির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। আর বিএনপি (ন্যাশনালিস্ট মুরতাদ্দিন) এবং জামায়াতকে (পার্লামেন্টারি মুরতাদ্দিন) সংগঠন আর আওয়ামী লীগকে ‘তাগুতি সরকার’ হিসেবে চিহ্নিত ও ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া জেএমবির মূল নেতা আদালতের রায়ে ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া শায়েখ আব্দুর রহমানকে বীর শহীদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ভাষ্যে দাবিক ম্যাগাজিনের বক্তব্যের সত্যতা বা এর অস্তিত্ব স্বীকার করে এমন বক্তব্য দেখা যায়নি। অর্থাৎ সরকারি ভাষ্য “বাংলাদেশে কোনো আইএস জঙ্গি নেই” এই বয়ান এখনো অটুট আছে। বাংলাদেশে নিরাপত্তাবিষয়ক এক গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব:) মনিরুজ্জামান অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি থাকার পক্ষে সম্ভাবনার কথা বলে গেছেন। এমনকি কাজের ধরন হিসেবে আইএস স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের এফিলিয়েটেড হিসেবে ঘোষণা করে ওই সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে নিজেরা হাজির থাকে সে কথাও বলেছিলেন। দাবিকের ১২তম সংখ্যা সম্পর্কে বাংলা দৈনিক মানবজমিনের রিপোর্টের পর আমেরিকার এনবিসি টিভি নেটওয়ার্কের বরাতে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাও এক রিপোর্ট করেছে। মেজর জেনারেল (অব:) মনিরুজ্জামানের বরাতে প্রথম আলো ওখানেও লিখছে যে তিনি বলেছেন,‘যেহেতু আইএসের নিজস্ব প্রকাশনায় (দাবিক) বাংলাদেশ সম্পর্কে এত বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে। তাই বিষয়টি আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। যদি এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে এদের প্রতিহত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মিথ্যাগুলো অদ্ভুত। সরকার নিজেও জানে এটা মিথ্যা, আমরাও যে জানি সরকার এটা মিথ্যা বলছে, সেটাও সরকার জানে। কিন্তু এর পরেও সরকার নিজের মিথ্যা বয়ানটাকে আঁকড়ে থাকবে। আর আমাদেরকে বলতে থাকবে‘বুঝোই তো আমার বয়ান মিথ্যা, তবু আমাকে মিথ্যা বলতে সুযোগ দাও।’ তেমনই এক বয়ান হলো, ‘এই দেশে আইএস বলে কিছু নোই।’ দাবিকের ১২তম সংখ্যা প্রকাশের পর সরকারের এই মূল বয়ানে কোনো বদল আসেনি। তবে এখন কেবল বাড়তি যে কথাগুলো সরকারি বয়ানে যোগ হয়েছে তা হলো, কখনো বলে জামায়াত বা কখনো বিএনপি এগুলো করছে। কখনো বলে জামায়াত জেএমবির নামে করছে। কখনো বলে জামায়াত আইএস নাম দিয়ে করছে। প্রথম আলোর ওই রিপোর্টেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “এ দেশে আইএস বলে কিছু নেই। ইতালীয় নাগরিক তাবেলাকে বিএনপি নেতা কাইয়ুম তার ভাইকে দিয়ে শুটার ভাড়া করে হত্যা করেছে। তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এসব ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে তারাই আইএসের নামে এসব প্রচার করছে। এসব প্রচারণাকে আমরা গুরুত্ব দিই না”। অর্থাৎ আইএস নেই এখনো সে কথা আঁকড়ে ধরে আছে। তবে বাড়তি স্বীকারোক্তি হল, এক. আইএসের নাম দিয়ে অন্যেরা কেউ করছে। দুই. জামায়াত-বিএনপি এগুলো করেছে। এ কথা ঠিক যে জামায়াত-বিএনপিকে জড়িয়ে মিথ্যা বয়ান দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের আর একধরনের উদ্দেশ্য আছে। তা হলো, সরকারবিরোধী সাংবিধানিক ধারার বিরোধী দল জামায়াত-বিএনপির ওপর দমনপীড়ন বা চলতি গণগ্রেফতারের পক্ষে এক ন্যায্যতার বয়ান খাড়া করা। ফলে “আইএস আছে” স্বীকার করে নিলে জামায়াত-বিএনপির ওপর নিপীড়নের পক্ষে বয়ানের ভিত্তি থাকে না। এমনিতেই এ বয়ান জনগণ বা খোদ সরকার কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই বোঝে এটা সরকারের মুখরক্ষার বয়ান মাত্র।
তবে এ কথাও সত্যি যে, কিছু টেকনিক্যাল সমস্যাও আছে। আইএসের উপস্থিতি ও তৎপরতা বিষয়ে সরকার কোনো স্বীকারোক্তি বয়ান দিয়ে দিলে কতকগুলো অসুবিধা ও জটিলতা সৃষ্টি হবে যেগুলো সরকার এড়াতে চায়। যেমন, কোনো দেশে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তৎপরতা ও উপস্থিতি আছে, এমন অফিসিয়াল স্বীকৃতি থাকলে হয়ত বিদেশী দূতাবাস বা প্রতিষ্ঠানকে কিছু রুটিন নিরাপত্তা বিষয়ক করণীয় এমন পদক্ষেপ নিতেই হবে। যেমন, অতি জরুরি স্টাফ ছাড়া বাকিদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া, ইমারজেন্সি উন্নয়ন কর্মসূচি ছাড়া বাকি সব তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া, স্ব স্ব দেশের যেসব নাগরিক বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্পে নিয়োজিত আছে নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ ও চাপ দিতে হবে ইত্যাদি। আর এরই সার প্রভাবটা পড়বে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে অর্থনীতিতে। তাই সরকার এসব বিপর্যয় হয়ত এড়াতে চায়। তবে অবশ্যই এমন স্বীকারোক্তি না দেয়ার সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলকে দমনের কাজে এই বয়ানকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার মারাত্মক বিপজ্জনক এবং অগ্রহণযোগ্য।
দুই.
ইসলামি রাজনীতির পক্ষে কেউ সশস্ত্র তৎপরতা করলেই কি তাকে জঙ্গি বা টেরর সংগঠন বলা ঠিক হবে? এমনিতেই পশ্চিমের “টেররিজম” – এর সংজ্ঞাও কোন স্পষ্ট ভিত্তি নাই। এককথায় তা সাবজেকটিভ; আমি চাই তাই ধরনের। অনেকটা যেন আমি অমুক সংগঠনকে টেররিস্ট বলতে চাই তাই – এরকম। কিন্তু কেন বলতে চাই – এর কোন জবাব নাই, বলব না, নিরুত্তর। বিভিন্ন দলিলে বলা হয়েছে টেররিস্ট দল কারা এক তালিকা আছে। ঐ তালিকায় যাদের নাম আছে ওরাই টেররিষ্ট। এভাবে আসলে কোন সংজ্ঞা না দিয়েই টেররিজম কোনটা বা টেররিষ্ট কারা এর ছদ্ম ভিত্তি দাঁড় করানো হয়েছে। এটা আমেরিকান কায়দা। আবার ঠিক এই কায়দা অনুসরণ করে জাতিসংঘেরও এক নিজস্ব টেররিস্ট তালিকা ও কায়কারবার।
তো যে কথা বলছিলাম, পশ্চিমা সংজ্ঞার দিক থেকে বিচারেও ব্যাপারটা সম্ভবত ঠিক তা নয় যে কেউ সশস্ত্র তৎপরতা করলেই সে পশ্চিমের চোখে জঙ্গি বা টেরর সংগঠন। বরং সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কার ট্রেনিং গ্রাউন্ড বা হেড কোয়ার্টার কোথায় এই প্রশ্ন বিচারে আমরা ভিন্ন এক ভাগ-বিচার দাঁড় করতে পারি। যেমন, যেগুলো পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন আর যেগুলো তা নয় এমন দুইয়ের ভাগ-বিচারের মধ্যে বড় ফারাক হল, পাকিস্তানের ভূমিতে ট্রেনিং গ্রাউন্ড বা হেড কোয়ার্টার আছে, এমন সংগঠন সম্পর্কে একটা অনুমান আমরা করতে পারি যে এসব সংগঠন নিজেদের এজেন্ডা যা-ই থাক, মাঝে মধ্যে পাকিস্তান সরকার বা এর গোয়েন্দা বাহিনীর দেয়া অ্যাসাইনমেন্টও সম্পন্ন না করে দিলে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ওসব সংগঠনের তৎপরতা পাকিস্তানের চলতে দেয়ার কথা নয়। যেটাকে আমরা বলতে পারি ট্যাক্স দিয়ে চলা। কারণ, সশস্ত্র সংগঠন মানেই যেকোনো রাষ্ট্রের সাংবিধানিক আইনের চোখে তা বেআইনি তৎপরতাই হবে। ফলে সেই বেআইনি দিক উপেক্ষা করে কাজ করতে দিতে পারে একমাত্র সরকার বা এর কোনো এজেন্সি। কথাটা আরেকভাবে বলা যায়, সশস্ত্র ওসব সংগঠনের কোনো তৎপরতা যদি সরাসরি পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইচ্ছার সাথে সংঘাতের বিষয় হয়, তাহলে পাকিস্তান সরকার এসব সশস্ত্র সংগঠনকে নিজ ভূমিতে থেকে তৎপরতা চালাতে দিবে না। দিতে পারে না। এই বিচারে আলকায়েদা ও আইএস ছাড়া বাকি প্রায় সব সংগঠন পাকিস্তানভিত্তিক। ফলে পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন আর পাকিস্তানভিত্তিক নয়, এভাবে দুটো ভাগ আমরা করতে পারি।
আবার পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠনগুলোর আর এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, এরা দুনিয়াব্যাপী তৎপরতার সংগঠন নয়। এমনকি এরা ঠিক আঞ্চলিক সংগঠনও নয়। মানে আমাদের অঞ্চলের সব রাষ্ট্রেই সংগঠনের শাখা ও তৎপরতা আছে তা নয় এবং সব সরকারের বিরুদ্ধে তৎপর এ কথাও সঠিক নয়। এরা মূলত ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে তৎপর এবং এই অর্থে বলা যায়, বেশির ভাগই কাশ্মির ইস্যু কেন্দ্রিক সংগঠন। এটাই তাদের মূল কাজের এলাকা। তবে উপচে পড়া এফেক্ট হিসেবে বাংলাদেশেও এদের তৎপরতা থাকতে পারে। কিন্তু মূল কথা আলকায়েদা বা আইএসের সাথে সম্পর্ক বা এফিলিয়েটেড সংগঠন এরা কেউ নয়।
তাহলে পাকিস্তানভিত্তিক আর আন্তর্জাতিক- এভাবে ভাগ দেখানোর আর এক কারণ হল, পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠনগুলো ৯/১১-এর আগেও হাজির ও তৎপর ছিল। এরা মূলত ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিজ নিজ স্বার্থে পরস্পরের বিরুদ্ধে এবং অপর রাষ্ট্রের ভেতর কাউন্টার ইনটেলিজেন্স বা অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালানোর বহু পুরনো রেওয়াজের ধারাবাহিকতা সংগঠন। পশ্চিমা বা আমেরিকানরা যে অর্থে সন্ত্রাসবাদী বা টেরর সংগঠন বলতে বোঝে, পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠনগুলো এর পুরো অর্থ বহন করে না। অটল বিহারি বাজপেয়ির বিজেপি সরকার ২০০৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে ক্ষমতাসীন ছিল। পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠনগুলোকে এরা সে সময় এক নতুন নামে ডাকত, বলত “সীমাপাড়কে আতঙ্কবাদ”। অর্থাৎ সীমান্তের অপর পাড় থেকে মানে পাকিস্তান থেকে যারা আতঙ্ক বা সন্ত্রাস ছড়াতে এসেছে। এই নাম খুবই অর্থপূর্ণ। পশ্চিম তাঁর সংজ্ঞায় সন্ত্রাসবাদী বলতে যাদেরকে বোঝাতে চায় ‘সীমাপাড়কে আতঙ্কবাদীরা’ ঠিক সে সংগঠন এরা নয়।
এসব বিচারে এবার স্পষ্ট করে বলা যায়, আলকায়েদা বা আইএসের সন্ত্রাসবাদ ভারত অথবা বাংলাদেশ এপর্যন্ত কখনও দেখে নাই। এর আগে কখনোই অভিজ্ঞতা নেয়া বা মোকাবেলা করতে হয়নি। মনে হচ্ছে, এবারই প্রথম করতে হবে। তাহলে এত দিন ভারতের ভোকাবুলারিতে সর্বক্ষণ যে জঙ্গিবাদের কথা শুনে এসেছি সেগুলো কী ছিল? দু’টি পয়েন্টের দিক থেকে তা ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রেওয়াজি অন্তর্ঘাতী তৎপরতা যেগুলো ছিল, আফগান যুদ্ধফেরত যোদ্ধাদের ফেরার কারণে যেটা আরো বড় মাত্রা পেয়েছিল; সেকালে নাইন ইলেভেন আমেরিকায় হামলার পর আমেরিকা ভারতের সমর্থন চাওয়াতে ভারত তার নিজ অভিজ্ঞতার ‘সীমাপাড়কে আতঙ্কবাদকে’ আমেরিকান বুঝের ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বলে চালানোর সুযোগ পেয়েছিল এবং নিয়েছিল। কিন্তু তবু ভারত অভ্যন্তরীণভাবে নিজস্ব মূল্যায়নে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র তৎপরতা আর আন্তর্জাতিকভাবে আলকায়েদা ও আইএসের তৎপরতাকে পরিষ্কার আলাদা ভাগ করেই বুঝে থাকে। তবে এত দিন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সে তৎপরতায় ভারতের নিষ্ঠা আছে, অথবা বাংলাদেশে তার সিকিউরিটি স্বার্থ আছে এসব কথা ছড়িয়ে সে বাংলাদেশে নিজের পছন্দের সরকার রাখাকে জায়েজ করেছে। বিনিময়ে ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থ আদায় করা আর সবচেয়ে বড় স্বার্থ বাংলাদেশ থেকে মাগনা ট্রানজিট আদায় করা এগুলো চালু রেখেছে। আজ সম্ভবত সময় ঘনিয়েছে। কানে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। আইএসের উপস্থিতি ও তৎপরতার বিপক্ষে ভারতের নড়াচড়া প্রস্তুতি নিতেই বা করতেই হচ্ছে তাকে। আইএস তৎপরতার উপস্থিতি, হোক না তা স্থানীয় সংগঠনকে এফিলিয়েশন দেয়া তৎপরতা, এটা ভারতের পক্ষে আর কোনোভাবেই খাটো করে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। এই জায়গায় এসে বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থের পক্ষে ‘আইএস নেই’ সে কথা বলবার অবস্থায় ভারত আর নেই। যদিও সর্বশেষ গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে দুই বিদেশী হত্যার পরেও শেখ হাসিনা সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে ও নিজের গোয়েন্দা তথ্যের সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিল আইএস নেই। একই সাথে এবার ভারতীয় মিডিয়াগুলোর ভোল বদলও লক্ষণীয়। অন্তত নিরাপত্তার প্রশ্নে এই ইস্যুতে হাসিনার বয়ান ও স্বার্থকে ভারত আর নিজের স্বার্থের সাথে মিলিয়ে দেখতে ও চলতে পারছে না।
বলা বাহুল্য, ভারতের নিজ রাষ্ট্রস্বার্থ, নিরাপত্তাবিষয়ক জেনুইন কোনো হুমকি ইত্যাদি – এসবকে অন্য সব কিছুর ওপর তাকে স্থান দিতেই হয়। সবার আগে চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা।
goutamdas1958@hotmail.com
[লেখাটা এর আগে গতকাল ৩০ নভেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এরই ফাইনাল ভার্সান হিসাবে আরও সংযোজন এডিট করে এখানে আজ আবার ছাপা হল।]
সর্বশেষ এডিটঃ ০১ ডিসেম্বর, ভোর ০২ঃ৫২