চীনা ইউয়ানকে আইএমএফের মুদ্রার স্বীকৃতি


চীনা ইউয়ানকে আইএমএফের আন্তর্জাতিক মুদ্রার স্বীকৃতি
গৌতম দাস
০৮ ডিসেম্বর, ২০১৫
http://wp.me/p1sCvy-mF

 

আইএমএফের মালিক শেয়ারহোল্ডার রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি ২৪ সদস্যের নির্বাহী বোর্ড ৩০ অক্টোবরের সভায় চীনের মুদ্রা ইউয়ানকে আইএমএফে রিজার্ভ জমা রাখার মুদ্রা হিসাবে স্বীকৃত চারটি (ডলার,ইউরো,পাউন্ড ও ইয়েন) মুদ্রার পাশাপাশি পঞ্চম মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংক্ষেপে বললে, দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় এমন আগের টপ চারটি মুদ্রার মতোই চীনা মুদ্রা ইউয়ানকেও এবার আইএমএফ তার পঞ্চম মুদ্রা হিসেবে স্বীকার করেছে। এ স্বীকৃতির অর্থ কী? তাৎপর্যই বা কী, সেসব নিয়ে এখানে কথা বলব।

দেশের অর্থনীতি নিয়ে সাধারণ্যে যেসব ধারণা আলোচনা হয় সেখানে পুঁজিতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র বলে ভাসাভাসি কিছু ধারণা থাকলেও সে আলোচনা কখনও মুদ্রা পর্যন্ত যেতে দেখা যায় না। অর্থাৎ মুদ্রার কাজ বা ভূমিকা কী সে সম্পর্কে এর ভালো-মন্দ অলিগলি দিক সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা আরও কম। বলা হয়ে থাকে, কোনো জিনিসকে মুদ্রার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে গেলে ওর তিনটা গুণ থাকা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ মুদ্রা মানে যার ঐ তিন বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন এক. গ্রহণযোগ্যতা : অর্থাৎ যে কেউই ওই মুদ্রার বিনিময়ে পণ্য বেচতে রাজি। শুধু তাই না, পণ্য বেচে ওই মুদ্রা পেতে অথবা পাওয়া মুদ্রা দিয়ে অন্য পণ্য কিনতেও সবাই রাজি। সার কথায়, বিনা দ্বিধায় বাজারের যে কেউ ওই মুদ্রায় কিনতে ও বেচতে রাজি। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, লিকুইডিটি : এটাকে বলা যায় গ্রহণযোগ্যতার মাত্রার কমবেশি। যেমন ব্যাংকের চেকের চেয়ে নগদ মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। অর্থাৎ নগদ মুদ্রার লিকুইডিটি সব সময় অন্য যে কোনো ধরনের মুদ্রার চেয়ে বেশি। আবার একেবারে মফস্বলের হাটে ১ হাজার টাকার নগদ নোট দিয়ে সওদা নিতে চাইলে এত বড় নোটের খুচরা পাওয়া সহজ নয় বলে সেখানে ১০ থেকে ২০ টাকার নোটের গ্রহণযোগ্যতা ১ হাজার টাকার চেয়ে বেশি। এভাবে মুদ্রার এই দুই বৈশিষ্ট্যই আসল বৈশিষ্ট্য মনে করা হয়। কেন?
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য, মুদ্রার বদলে সোনা: ব্যাংকে গিয়ে মুদ্রার বদলে সোনা চাইলে তৎক্ষণাৎ তা পাওয়া যায় এমন হতে হবে। এ গুণটা এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। অর্থাৎ আগেকার দিনে যে কোনো ব্যাংক কাগুজে মুদ্রা ছাপার আগে সমমূল্যের সোনা ভল্টে রিজার্ভ রেখে নিত। এখন তা আর করে না। বিশেষত আইএমএফের ১৯৪৪ সালে জন্মের সময়ের ম্যান্ডেট বা ঘোষণাপত্রে বদল এনে ১৯৭৩ সালে নতুন করে আইএমএফ গঠন করে নেয়ার পর থেকে কাগুজে মুদ্রার বদলে সোনা ফেরত দেয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতাও উঠে গেছে। সারকথায় তাই, এখন মুদ্রা হতে গেলে প্রথম দুই বৈশিষ্ট্যই যথেষ্ট।
উপরের আলোচনায় সাধারণভাবে মুদ্রা নিয়ে কথা তুলা হয়েছে। কিন্তু ওই মুদ্রা কি কোনো একটা রাষ্ট্রের মুদ্রা নাকি একই সঙ্গে তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা, সেটা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। তাই এবার দেশি ও বিদেশি (আন্তর্জাতিক মুদ্রা) এভাবে মুদ্রাকে ভাগ করে, ভাগ মনে রেখে কিছু কথা। একালে দেশি মুদ্রা মানে কাগুজে মুদ্রা যা মূলত রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ মুদ্রা। অর্থাৎ নিজ ভূখন্ডের বাইরে যে মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা নেই। বাংলায় বললে, চলে না। নিজ ভূখন্ডের মধ্যে দেশি মুদ্রায় সব ব্যবসা-বাণিজ্য লেনদেনে একচেটিয়াভাবে চলতে পারে। অন্যভাবে বললে, শুধু নিজ মুদ্রার ওপর নিজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের) একক নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের সীমানা পর্যন্ত কার্যকর ও বিস্তৃত থাকে। রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে হলে আর থাকে না। তাহলে সারকথা দাঁড়াল, প্রথমত মুদ্রা ছাড়া কোনো বাণিজ্য লেনদেন নেই, হবে না। আবার দেশি মুদ্রামাত্রই ওর ভূখন্ডগত সীমাবদ্ধতা থাকবে, নিজ রাষ্ট্র সীমানা পার হলেই ওই মুদ্রা অচল হয়ে যাবেই। তাহলে যেকোনো দুই রাষ্ট্র বাণিজ্য বিনিময় করবে কীভাবে, কোন মুদ্রায়? স্বভাবতই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্য লেনদেন ঘটাতে চায় বলে সব রাষ্ট্রেরই বাকি সব রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য এক মুদ্রা বা আন্তর্জাতিক মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তবে বেশি দিন আগের কথা নয়, আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃত মুদ্রা বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা প্রথম চালু হয়েছিল মাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। আইএমএফ গঠন করার পেছনে ১৯৪৪ সালে প্রধান যেসব তাগিদ কাজ করেছিল তা হল, এর আগে অচল হয়ে ভেঙে পড়ে থাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেন বিনিময়কে নতুন করে এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে এক সিস্টেম ব্যবস্থা হিসেবে হাজির করা। এ আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এককথায় বললে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় চালু থাকার পূর্বশর্ত হল এক আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য মুদ্রা চালু থাকা। এটাই আইএমএফের মুখ্য কাজ। অবশ্য বলা বাহুল্য, আইএমএফের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব বড়লোক রাষ্ট্রের পক্ষে কান্নি মারা। কারণ আইএমএফের মালিকানা শেয়ার যে রাষ্ট্রের ভাগে সবচেয়ে বেশি আইএমএফের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্বের ওপর প্রভাব তার সবচেয়ে বেশি। এই নিয়মে সাজানো আছে ও পরিচালিত হয় আইএমএফ। যেমন সর্বশেষ মালিকানা শেয়ার অনুসারে আমেরিকা (একাই ১৬ শতাংশ) ও ইউরোপে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ আর ছয়টা রাষ্ট্র মিলে ৪৩ শতাংশ মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করে আছে। আমেরিকা আর ঘনিষ্ঠ ছয় রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে নীতি সমন্বয়ের মাধ্যমে বিশেষ করে গরিব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজেদের ঐকমত্য রক্ষা করার এক ক্লাব সংগঠন আছে, যার নাম গ্রুপ অব সেভেন কান্ট্রিস, সংক্ষেপে ‘গ্রুপ সেভেন’ নামে; প্রতি বছর কমপক্ষে একবার ‘গ্রুপ সেভেন’ রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা বসে থাকে, এমন সম্মেলন তারা নিয়মিত করে থাকে। এ গ্রুপ সেভেন আইএমএফের মালিকানার ৪৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এ সাত রাষ্ট্রের মালিকানার বিপরীতে বাংলাদেশের মতো গরিব রাষ্ট্রের মালিকানা সাধারণত এক পার্সেন্টেরও অর্ধেক হয় বলে গ্রুপ সেভেনের পক্ষে ৪৩% মালিকানা দিয়ে পুরা আইএমএফকে নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। কিন্তু তাই বলে আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য ‘আইএমএফ নিপাত যাক’ বলা সঠিক শ্লোগান হবে না। অথবা আইএমএফ আমাদের দরকার নেই সেটাও সঠিক কথা বা দাবি হবে না। কারণ আইএমএফ নিপাত যাওয়া বা নেই এর মানে আমাদের রাষ্ট্রের জন্যও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পণ্য ও পুঁজির বিনিময় লেনদেন এবং মুদ্রাও নাই হয়ে যাবে। অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় ইত্যাদি আমাদের অবশ্যই দরকার। অর্থাৎ মূল পয়েন্ট হল, ব্যবস্থাটার নিপাত যাওয়া নয় বরং এটা আন ফেয়ার, অসাম্য এক ব্যবস্থা হয়ে আছে একদিকে কান্নি মারা হয়ে আছে। এর অবসান দরকার।
একালের একটা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার মালিকরা যেমন ওই ব্যাংকের পরিচালনার নিয়মকানুন সবটা নিজের ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বে এবং দেশের ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালিত হয়ে থাকে, হতে বাধ্য। তবে এ কর্তৃত্বের অধীনে থাকা মেনেও এরপর যতটুকু মালিকানার ইচ্ছা প্রয়োগের সুযোগ থাকে তা অবশ্য করা হয়। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিক মানেই সে-ই মূল নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের অথরিটি নয়। কারণ ব্যাংকের মালিক আর ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অথরিটি আলাদা আলাদা। অথচ আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা ঠিক উল্টো। আইএমএফের মালিক রাষ্ট্রগুলোর এক বড় শেয়ার মালিকানা একটা মালিক-জোটের হাতে এবং ঐ জোটই আবার এর নিয়ন্ত্রণ অথরিটি এবং তা অনেক সরাসরি। এই সমস্যার রেডিকেল সমাধান দরকার। একথাটাকেই আরেক ভাষায় প্রায়ই হালকা সরল করে বলা হয় যে, আইএমএফের পরিচালনা সিদ্ধান্তে গরিব রাষ্ট্রের গলার স্বর আরও বেশি বা উঁচু করা দরকার। সারকথায় বললে, আইএমএফের ওপর কর্তৃত্বের চলতি কাঠামো এটা ভাঙা দরকার কিন্তু তা অবশ্যই এটা আবার ঢেলে সাজিয়ে গড়ার লক্ষ্যে। শুধু নিপাত যাক বলাটা সম্ভবত আগের বাক্যের ভেঙে আবার গড়া ধারণার সমার্থক নয়, তাই।
তাহলে দাঁড়াল, আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেন বিনিময়ের জন্য এক দরকারি প্রতিষ্ঠান। যদিও এর সংস্কারও দরকার। বিশেষত আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজন, শ্রমের দক্ষতা বাড়ানোর দিক থেকে এর আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকেও এটা গুরুত্বপূর্ণ। অতএব এসব অর্জনের পূর্বশর্ত এক আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা থাকা এটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মুদ্রা নেই তো বাণিজ্য বিনিময় নেই। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মুদ্রার মান, যেটাকে আমরা অনেক সময় মুদ্রার বিনিময় হার বা এক্সচেঞ্জ রেট বলি।
নিজের ঘোষণাপত্র অনুসারে আইএমএফের ম্যান্ডেটরি কাজ হচ্ছে মূলত দুইটি। বিভিন্ন সদস্য দেশের মুদ্রার মান নিয়ন্ত্রণ এবং সদস্য রাষ্ট্রের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ এর দিকে নজর রাখা। কোনো রাষ্ট্রের বার্ষিক আমদানি-রফতানিতে আয়-ব্যয়ের চলতি হিসাবের খাতায় আয়ের তুলনায় ব্যয় সেটা ঘাটতি বা বাড়তির দিকে, এটাকেই ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বলা হয়। সেদিকে নজর রাখা এবং সেক্ষেত্রে ঘাটতি হলে তা মোকাবিলার জন্য ওই রাষ্ট্রকে ধার ও পরামর্শ দেয়া ইত্যাদি। এখানে লক্ষণীয় যে, নিজ রাষ্ট্র অর্থনীতি পরিচালনা করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি ফেলালে তবেই ধার নিতে হবে। আর ধার নেয়া মানেই সঙ্গের শর্ত-পরামর্শও শুনতে হবে। নইলে নয়। মানে ঘাটতি নেই তো উটকো পরামর্শও নেই।
আইএমএফ প্রসঙ্গে আর একটা মৌলিক দিক হল, আইএমএফের সদস্যপদ লাভ করতে চাইলে শুরুতেই চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। এটা ঠিক, চাঁদা বলতে যা বুঝি যে, প্রদেয় চাঁদার অর্থ জমা করার পরে তা প্রতিষ্ঠানের আয় বা সম্পত্তি হয়ে যায়। আইএমএফের বেলায় এক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। বরং আইএমএফ প্রতিষ্ঠানে সব সদস্য রাষ্ট্রের নিজ নামে একটা অ্যাকাউন্ট থাকে, প্রদেয় চাঁদা ওই নিজ অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এটা অনেকটা কোনো আমদানিকারকের মাল জেলায় জেলায় বেচার জন্য জেলা পরিবেশক হওয়ার মতই, যেন আমদানিকারকের কাছে আগে প্রদেয় ডিপোজিটেড বা জমা রাখা অর্থ। এর পরিমাণ কত তা ঠিক হবে বছরে কী পরিমাণ মালামাল নিয়ে বিক্রি করতে পারব এ আকারের অনুপাতে। এবং আগাম জমা রাখতে হবে এমন এক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ। এরপর যা মালামাল তুলেছি প্রতি তিন মাস পরপর এর বকেয়া মূল্য পরিশোধ করে দিতে হয়। আইএমএফের সদস্য ফি আগাম জমা দেয়া অনেকটা এরকমই এক ব্যবস্থা। কিন্তু এর সুবিধা কী?
সুবিধা হলো, ওপরে যে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা চলতি হিসাবে ঘাটতি আয়-ব্যয়ের কথা বলছিলাম তেমন কোনো পরিস্থিতিতে ঘাটতি মেটাতে আইএমএফ ওই সদস্য রাষ্ট্রকে কতদূর ধার দেবে, তা হিসাব করা হয় এভাবে যে, আইএমএফে আমার রাষ্ট্রের অ্যাকাউন্টে জমাকৃত অর্থের ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত।

এই ফাঁকে একটা কথা বলার সুযোগ নেই।
আইএমএফের তহবিলে সব সদস্য রাষ্ট্রের অ্যাকাউন্টে জমাকৃত অর্থ হিসাব করা হয় অদ্ভুত নামের এক ভার্চুয়াল (নামে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই) মুদ্রায়। নামটা হল স্পেশাল ড্রয়িং রাইট বা এসডিআর। এজন্য আইএমএফের মুদ্রার নাম বলা হয় এসডিআর। এ মুদ্রার মান মানে, যেমন কয়টা বাংলাদেশী টাকা দিলে তা এক এসডিআরের সমান হবে, তা কীভাবে ঠিক হয়?
প্রতিদিন আইএমএফের ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় দেখা যাবে ওই দিনের এসডিআর রেট দেয়া আছে। যেমন আজ ৬ ডিসেম্বর এক এসডিআর = ০.৭২৯৯৮৮ ডলার। এ হিসাবে এক এসডিআর = ১০৮.৪০ টাকা। এখন প্রতিদিনের এসডিআর রেট এটা কীভাবে হিসাব করা হয় বা সাব্যস্ত করা হয়?
প্রতিদিনে টপ চারটা মুদ্রা আমেরিকান ডলার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড আর জাপানি ইয়েন – এদের বিনিময় হার বাজারে কত ছিল তা থেকে এক গড় বিনিময় হার বের করা হয়। আর সেটাকে ডলারে প্রকাশ করলেই সেটাই ওই দিনের এসডিআর রেট। অর্থাৎ এখন ওই চারটা মুদ্রার গড় বিনিময় হারই ওই দিনের এসডিআর এর মান। আর এসডিআর মান বের করতে শুধু ওই চারটা মুদ্রাকেই বেছে নেয়ার কী কারণ? কারণ, দুনিয়াতে এখন যত ব্যবসা-বাণিজ্যিক লেনদেন হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় এমন শীর্ষ চার মুদ্রা ওগুলো তাই। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের মুদ্রা তালিকায় সবার উপরের চার মুদ্রাগুলো তাই। আর প্রতি পাঁচ বছর পরপর মূল্যায়ন করে দেখা হয় শীর্ষ চার মুদ্রা কারা ছিল? যেমন ২০০০, ২০০৫ ও ২০১০ এভাবে। এবারের ২০১৫ সালের মূল্যায়নে এবং গত ১০ বছরের মূল্যায়নেও দেখা যাচ্ছিল চীনের মুদ্রা ইউয়ানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। এর স্বীকৃতি হিসেবে এবারের আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড সভায় আইএমএফের টেকনিক্যাল কর্মীদের গণনা ফলের সুপারিশ এর পক্ষে শেয়ার মালিকানার নির্বাহী বোর্ড সায় দিয়েছে। তাই পঞ্চম মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানকে গ্রহণ করা হয়। এর ফলে এখন থেকে মিডিয়া রিপোর্টে আর এক টেকনিক্যাল শব্দের দেখা মিলবে ‘কারেন্সি বাস্কেট’ বা ‘বাস্কেট কারেন্সি’। উপরে বলেছিলাম, চারটি টপ আন্তর্জাতিক মুদ্রার গড় বিনিময় হারই হল ওই দিনের এসডিআর মান। তো এজন্য ওই চার আন্তর্জাতিক মুদ্রাকে আইএমএফের ‘বাস্কেট কারেন্সি’ বলে। যার ভাবটা এরকম যে, এসডিআর মুদ্রার মান নির্ধারণের জন্য একটা ঝুড়িতে থাকা টপ চারটা আন্তর্জাতিক মুদ্রাকে ওখান থেকে তুলে আনা হয়েছে। এবার ওই বাস্কেট কারেন্সিতে চীনা ইউয়ানকে অন্তর্ভুক্ত করে মর্যাদা দেয়া হলো। তবে টেকনিক্যাল রুল হল, আগামী বছর ২০১৬ সাল থেকে এটা কার্যকর হবে। অর্থাৎ আগামী বছর ১ অক্টোবর থেকে ইউয়ানসহ পাঁচ টপ মুদ্রার গড় থেকে আইএমএফের এসডিআর মান নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ তখন থেকে প্রতিদিনের এসডিআর মান কত হবে তা সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে চীনা ইউয়ান একটা ফ্যাক্টর হবে।
শুধু কী তাই? না আরও আছে। উপরে আইএমএফের সদস্য রাষ্ট্রের নিজ নামের এক অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা রাখার কথা বলেছিলাম। কত অর্থ সেখানে আগাম জমা রাখতে হবে তা নির্ভর করে আমার অর্থনীতিতে লেনদেনের সাইজ কেমন এরই এক অনুপাতিক পরিমাণ। কিন্তু এতে সাব্যস্ত হওয়া মোট পরিমাণের ৭৫ ভাগ অর্থ জমা রাখতে হয় সোনা অথবা ডলারে। আর বাকি ২৫% নিজ দেশি মুদ্রায়। এটা আইএমএফের জন্মের সময়কার ১৯৪৪ সালের নিয়ম ছিল। কিন্তু দিনকে দিন প্রতিটা সদস্য রাষ্ট্রের অর্থনীতির সাইজ বেড়েই চলেছে ফলে সে অনুপাতে আইএমএফের জমা রাখা সোনা ও ডলারের পরিমাণও। কিন্তু দুনিয়াতে সোনা ও ডলার তো অফুরন্ত নয়। তাই এই সমস্যা সমাধানে ১৯৬৯ সালে বাস্কেট কারেন্সি ধারণা চালু হয়েছিল। এর ফলে নতুন সংযুক্তি আইন হল, ডলার ও সোনা ছাড়াও বাস্কেট কারেন্সিতে থাকা অন্যান্য মুদ্রাতেও আইএমএফের সদস্য চাঁদা সম্পদ রিজার্ভ রাখা যাবে। অতএব কোনো রাষ্ট্র এখন ইউয়ানেও তার জন্য ধার্য আইএমএফের সদস্য চাঁদার সম্পদ রিজার্ভ রাখতে পারবে। এর অর্থ শুধু আইএমএফে নয়, দুনিয়ার নানা রাষ্ট্র ব্যক্তি বা কোম্পানি সবাই নিশ্চিন্তে এখন থেকে স্ব-স্ব সম্পদ চীনা ইউয়ানে রূপান্তরিত করে ধরে রাখতে শুরু করবে। আইএমএফের হিসাবে ইউয়ানকে বাস্কেটে স্বীকৃতি দেয়ার আগে বাস্কেট মুদ্রাগুলো কতটা গ্লোবাল লেনদেনের মুদ্রার দখলে আছে এর হিসাবে ডলারের ভাগে ৪১.৯ শতাংশ, ইউরো ৩৭.৪ শতাংশ, পাউন্ড ১১.৩ শতাংশ আর ইয়েন ৯.৪ শতাংশ। আর আগামী বছর থেকে তা সম্ভবত হবে ডলার ৪১.৭৩ শতাংশ, ইউরো ৩০.৯৩ শতাংশ, ইউয়ান ১০.৯২ শতাংশ, পাউন্ড পাউন্ড ৮.০৯ শতাংশ আর ইয়েন ৮.৩৩ শতাংশ।
এটা গেল কেবল শুরুতে কার কত বাজার শেয়ার দাঁড়াবে এর হিসাব। তবে আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রায় সবাই একযোগে যে কথাগুলো বলছে যেমন, আইএমএফের স্বীকৃতি চীনের দিক থেকে ‘বিরাট রাজনৈতিক অর্জন’ এবং চীনের ওপর আস্থার প্রকাশ ও চীনের জন্য এটা ‘প্রেস্টিজিয়াস বিষয়’। এ ছাড়া মুদ্রা যেহেতু শুধু পণ্য বিনিময়েই কাজে লাগে তাই নয়। সম্পদ ধরে রাখার মুদ্রা হিসেবেও এর কদর আছে। বিশেষত যে আন্তর্জাতিক মুদ্রার মান বা হার স্থিতিশীল, বাজারের উঠতি মুদ্রা এবং আস্থার মুদ্রা সেই মুদ্রায় রূপান্তরিত করে সম্পদ রাখতে মানুষ আগ্রহী হবেই। এই বিচারে ব্লুমবার্গ ম্যাগাজিন আগাম অনুমান করে বলছে, প্রথম বছরেই ইউয়ানে সম্পদ ধরে রাখার জন্য বাজারে এক প্রবল জোয়ার উঠবে। এর ধাক্কায় আবার পণ্য বিনিময় বাজারে ইউয়ানের বাজার-শেয়ার বেড়ে যাবে। আর ততটাই ডলার বাজার হারাবে। এ রকম কিছু চেন রিয়াকশন বা চক্রাকার প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার কিছু মিডিয়ার ঈর্ষা ছড়ানোর প্রপাগান্ডাও আছে। যেমন কেউ কেউ সন্দেহ বাতিকের রিপোর্ট করেছে, আইএমএফ কি আসলেই ঠিক মতো যাচাই করে দেখে বোর্ডের কাছে সুপারিশ করেছে? এ রকম। তবে খোদ আইএমএফ এ দিকটা আগেই আঁচ করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। ইউয়ানকে স্বীকৃতি দেয়ার দিনেই আইএমএফ নিজ ওয়েব সাইটের প্রথম পাতায় ‘সহসাই যেসব প্রশ্ন উঠে’ শিরোনামে নিজেই প্রশ্নোত্তরে এসব সন্দেহ-কৌতূহলেরও বহু আগাম প্রশ্নের বাড়তি জবাব দিয়ে রেখেছে। অনেক বেশি আন্তরিক আর খোলামেলাভাবে সেসব জবাব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আইএমএফের মতো বহুরাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠানের চীন ও আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবস্থান বিরোধের বেলায় সাধারণভাবে ২০০৯ সাল থেকেই আইএমএফের ব্যুরোক্র্যাট নির্বাহীদের ভূমিকা কী হলে সঠিক হবে, সে প্রশ্নে এপর্যন্ত লক্ষ্য করা গেছে যে, তারা একেবারেই প্রফেশনাল অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বা পক্ষ নিতে চাননি। সাধারণভাবে বলা যায়, ব্যক্তিনিরপেক্ষভাবে যা সত্য, যা সঠিকÑ এর পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। যেমন, আইএমএফের সংস্কারের দাবি বিষয়ে তাদের অবস্থান সংস্কারের পক্ষে। আর তাদের সুপারিশের ফাইল আমেরিকান সিনেটে গিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। চীনা ইউয়ানকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নেও আইএমএফের ব্যুরোক্র্যাট নির্বাহীদের একই ধারাবাহিকতার অবস্থান দেখা গিয়েছে। ইউয়ানকে আমলে নিয়ে আইএমএফের সম্পদের ইউনিট গণনা আগামী বছর থেকে শুরু হবে বলা হলেও বিভিন্ন ব্যক্তি কোম্পানির ধরে রাখা সম্পদ ইউয়ানে রূপান্তর করে রাখার ঝোঁক এ বছর থেকেই শুরু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাস্তবে কি দাঁড়ায় সেটি দেখা যাক।

গৌতম দাস : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা এর আগে গত ০৬ ডিসেম্বর দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ এবং একই প্রসঙ্গে ০৭ ডিসেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তে ছাপা হয়েছিল। সে লেখা দুটো একসাথে মিলিয়ে আরও সংযোজন ও আবার এডিট করে ফাইনাল ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s