নিজের হত্যাকারীকে দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনা
গৌতম দাস
http://wp.me/p1sCvy-nD
খবরটা প্রথম প্রচারিত হয় ১৫ ডিসেম্বরের বিদেশি মিডিয়ায়। সৌদি আরব নাকি নিজের নেতৃত্বে ৩৪ ইসলামী দেশের এক সন্ত্রাসবিরোধী জোট গঠন করে ফেলেছে। আমাদের দেশে খবরটা পৌঁছায় পরের দিন। দেশে খবরটা আবার প্রচারিত হয়েছে এককাঠি অতিরিক্ত গুরুত্বে যে, বাংলাদেশ ওই জোটে অংশগ্রহণে সম্মতিও প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের দুইজন মন্ত্রীও এ খবরে সায় দিয়ে জানিয়েছেন, খবর পাকা। ফলে খবরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকেনি। কিন্তু গোল বেঁধেছে মূল খবরটা আসলে কী, কিইবা এর তাৎপর্য এসব বিষয়ে। খবরটা নিয়ে মিডিয়ায় যতই খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, ততই দেখা যাচ্ছে বিভ্রান্তি বাড়ছে; সেটা দেশি এবং বিদেশি মিডিয়া, দুই জায়গাতেই। এই লেখা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে মূল খবরটা আসলে যতটা প্রচারিত হয়েছে বাস্তবে জোটের পুর্ন প্রস্তুতির ব্যাপারটা তখনও ততদুর আগায় নাই। অথচ বড় করে তা অনেক আগেই প্রচার হয়ে গেছে এবং করা হয়েছে। এছাড়া খবরের ভেতরেই শুরু থেকে বড় বড় ফাঁক রয়ে গেছে বা রেখে দেয়া হয়েছে। যেমন বেশিরভাগ খবরের শিরোনাম, “সৌদি আরব ৩৪ দেশের এন্টি-টেররিজম কোয়ালিশন গড়েছে” এটা আল জাজিরা থেকে নেয়া। এমন ধরনের শিরোনাম যতটা ভারি ওজনের ভেতরের খবর ততটা ভারি ও পোক্ত মোটেও নয়। যেমন সরাসরি আইএস বিরোধী না বলে সাধারণভাবে “এন্টি-টেররিজম” জোট বলা হয়েছে। তবু এর অর্থ আইএস বিরোধীতাই হয়েছে। অনেকে সেই কারণেই আইএসের প্রতি ইঙ্গিত থাকে এমন শিরোনাম দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, এটা কী ধরনের জোট? এর ম্যান্ডেট কী? এছাড়া এই জোটের ম্যান্ডেট কী হবে তা নিয়ে কোনো খসড়া কি তৈরি হয়েছে, যা থেকে হবু সদস্যরা পরিষ্কার জানবে কেমন ধরনের জোট হচ্ছে আর ওই জোট ঠিক কী করবে! জোটে সরকার অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা তা স্বীকার করে নেয়াতে এনিয়ে মোটা মোটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক মানবজমিন ‘মিশ্র প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে রিপোর্ট করেছিল। ওই রিপোর্টে লিখেছিল, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, এটি সামরিক জোট নয়”। স্বভাবতই এ আধা-তথ্যে মানুষ বিষয়টা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু উত্তর পাওয়ার চেয়ে নতুন নিরুত্তর প্রশ্নের সংখ্যাই বাড়াবে। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘প্রাথমিক আলোচনায় সৌদি আরব আমাদের যে ধারণা দিয়েছে তা হচ্ছে এটা যুদ্ধ করার সামরিক জোট নয়। এটি মূলত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের একটি কেন্দ্র হবে। এ জোটের সঙ্গে যুদ্ধের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই”। স্পষ্টতই মিডিয়ার খবরগুলো ইতোমধ্যেই যে উচ্ছ্বাস আগ্রহের উত্তাপ বা হাইপ এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে, প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্য তাতে পানি ছিটিয়ে গুরুত্ব লঘু করার চেষ্টা। এ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, সৌদি ফরেন অফিস বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলার সময় জোট কী করবে, ফোকাস কী, কোথায় গিয়ে থামবে, সুনির্দিষ্ট কী উদ্দেশ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ ছিল না। বরং এদিকে হওয়ার চেয়ে যেনবা সৌদি ফরেন অফিস থেকে বাংলাদেশকে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল সৌদি কোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ সমর্থন করবে কিনা এবং সঙ্গে থাকবে কিনা এতটুকুতেই সীমিত ছিল। জোটের সম্ভাব্য কাজ ভুমিকা ম্যান্ডেট ইত্যাদি ছিল খুব গৌণ। কেবল “সৌদি উদ্যোগ” এই প্রেস্টিজিয়াস জিজ্ঞাসার প্রতি আমরা সমর্থন দিচ্ছি কীনা এটাই মুখ্য বিষয় ছিল। ধাবিত ছিল। ওদিকে ১৮ ডিসেম্বরের প্রথম আলো “সৌদি জোটের ভবিষ্যৎ সংশয়ে” এই শিরোনামে এ’বিষয়ে আরও কিছু সংযোজন করেছে। প্রতিমন্ত্রী ওখানে বলেছেন, “এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে সাধারণত আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দলিল সই হয়ে থাকে। কাজেই এখানেও বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি আলোচনা করে চূড়ান্ত করার সুযোগ থাকছে”। প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য আমাদের অনুমানকে পোক্ত করে। এ বিষয়টাকে তাই আমরা বলছি হবু জোটের ‘উদ্দেশ্য লক্ষ্য’ বিষয়ক কোনো খসড়া এখনও চালাচালিই শুরু হয়নি। তবে একথা ঠিক যে, বাংলাদেশের প্রতিমন্ত্রীর ব্রিফিং থেকে বিস্তারিত না জানলেও যা জানা গিয়েছে এসব বিষয়ে ভিন্ন কিছু বক্তব্য ১৫ ডিসেম্বরের রয়টার পরিবেশিত খবর আমাদের আরও কিছু জানাচ্ছে। সেখানে যেমন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়েরকে প্যারিসে সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেছেন “জোটের পক্ষে কোনো সামরিক শক্তি মাঠে নামবে কিনা” এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছেন, “সব সম্ভাবনাই টেবিলে আছে”। অর্থাৎ জোটের সামরিক তৎপরতাও থাকতে পারে। তিনি নাকচ করেননি। আবার ৩৪ দেশের জোট গঠনের বিষয়ে সৌদি রাজধানী রিয়াদে ঘোষণা নিয়ে সাংবাদিকের সামনে প্রথম এসেছিলেন সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুহম্মদ বিন সালমান। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, “সন্ত্রাসবিরোধী বলতে তিনি শুধু আইএস নয়, আইএসসহ সব সন্ত্রাসবাদীকেই বুঝিয়েছেন”। তাহলে আমাদের প্রতিমন্ত্রী এখনও অনেক বিষয় আমাদের ব্রিফ করার সময় হয়নি মনে করলেও সেসব প্রশ্নে সৌদি মন্ত্রীদের মনের অনেক ডিটেইল অবস্থান জানা গেছে। তবে একথা ঠিক যে, পূর্বপ্রস্তুতিমূলক বহু কাজ শেষ না করেই এর আগেই সৌদি কূটনীতিকরা মিডিয়ায় হাজির হয়েছিলেন। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মতো দেশের ওপর সৌদি আরবের যে প্রভাব তাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি কূটনীতিকদের ঘাটতি তারা আপাতত উতরে গেছেন বা সুবিধা নিয়েছেন। তবে পাকিস্তান তার নাম সৌদিদের তালিকায় দেয়ার আগে কেন তাকে আগে জানানো হয়নি এ নিয়ে প্রথমদিন বিস্ময় প্রকাশ করলেও পরের দিন থেকে তা হজম করে মিটিয়ে ফেলেছে। আর বাংলাদেশ প্রথমদিন থেকেই হাফ ব্রিফিংয়েই সম্মতি জানানোর কথাই সরাসরি স্বীকার করেছে।
ওদিকে এই জোট গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রায় সব বিদেশি মিডিয়া যেদিক প্রশ্ন তুলেছে তা জেনুইন। তারা বলছে, সৌদি প্রস্তাবিত এই জোটে কোনো শিয়া-ইসলাম শাসিত সরকার, যেমন ইরান বা ইরাক সরকারের নাম নেই। ফলে বাস্তবত এটা শিয়া-বিরোধী সুন্নিদেরই জোট হয়ে গেছে। এছাড়া ইয়েমেনের হুতি প্রশ্নে কয়েক মাস আগেও সৌদিরা এমনই এক জোট (দুবাই, বাহরাইন, জর্ডান, মিসর ও সৌদিদের) তৈরি করে জোটের ব্যানারে নির্বিচারে ইয়েমেনে আকাশ বোমা হামলা চালিয়েছিল। সেখানেও শিয়াবিরোধী সুন্নিদেরই জোটের ছায়া বজায় ছিল এবং ওই বোমাবাজি ৬ হাজার হুতির জীবননাশ ছাড়া ইয়েমেনের সংঘাতের কোনো রাজনৈতিক সমাধানের কিছুই করতে পারেনি। তবে মনের ঝাল হয়তো মিটেছে। এদিকটাতেই সব মিডিয়া ইঙ্গিত করে সৌদি জোট একপেশে শিয়া-বিরোধী জোট হতে চায় বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ওদিকে এনিয়ে আমেরিকান প্রতিক্রিয়া বেশ মজার ডিপ্লোম্যাটিক। আমেরিকা স্বাগত জানিয়েছে এং আরও বিস্তারিত শোনার জন্য অপেক্ষা করছে বলে জানিয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ-বিরোধী কোনো অবস্থান তারা নিতে চায়নি। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হল, ১৯৭৩ সাল থেকে চলে আসা আমেরিকান মধ্যপ্রাচ্য নীতি এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একালে আর সৌদি স্বার্থের সঙ্গে তালমিল রেখে মন যুগিয়ে চলতে পারছে না। বিশেষত যেদিন থেকে আমেরিকা ইরানের সঙ্গে ‘পারমাণবিক ডিল’ করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল আর শেষে ঐ ডিল স্বাক্ষর হয়েছিল।
মুল বিষয় সৌদি-আমেরিকান সম্পর্কের অবনতি
খুব সংক্ষেপ করে বললে, আমেরিকান ওয়ার অন টেরর ১৪ বছরে পা দিল অথচ এই যুদ্ধে ন্যূনতম কিছু অর্জন হয়েছে অথবা যুদ্ধ সমাপ্তি বা থামার নামগন্ধ আছে এমন কোন ইঙ্গিতও কোথাও নেই। ওদিকে ২০০৭ সালের শেষ দিক থেকেই এই যুদ্ধের প্রভাব বিশেষত যুদ্ধের খরচ বইতে গিয়ে আমেরিকান অর্থনীতিকে তা ক্রমান্বয়ে ভেঙে ফেলেছে। এককথায় বললে, আমেরিকান সামরিক সক্ষমতা এখনও একই রকম বহাল আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমছে বলে তা সামরিক সক্ষমতার অপারেশনাল কস্ট যোগাতে অযোগ্য হওয়াতে কার্যত তা সীমিত হয়ে গেছে, অকেজো করে ফেলছে। এই দশা থেকে মুক্তি পেতেই আমেরিকাকে ইরানের সঙ্গে ডিল করতে যেতে হয়েছে। কারণ ডিল হওয়াতে এখন আইএস বিরোধ ইরানকেও আমেরিকার পক্ষে মাঠে পাওয়া যাবে। নিজের অক্ষমতার কিছুটা হাল হবে। এটাই আমেরিকান স্বার্থ। আর ঠিক এটাই সৌদি স্বার্থবিরোধী। আসলে ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের উতখাতের সময় থেকেই কেবল ইরাক প্রশ্নে কার্যত একটা ঐক্যমত ছিল যে পরবর্তিতে শিয়াদের দিকে কান্নি মারা এমন একটা ইরাক সরকার হবে যেটা একইসাথে আমেরিকা ও ইরানের পছন্দের। কিন্তু এই ঐক্যমত বা ডিল এর কোন প্রকাশ্য স্বীকৃতি ছিল না। কেবল কার্যত তা প্রতিফলিত হতে দেখা যেত। কিন্তু নতুন করে আইএস হাজির হওয়াতে এই অস্বীকৃত এলায়েন্স আর অপ্রকাশ্য রেখে বেশি দূর যাওয়া যাচ্ছিল না। তা থেকেই ইরান-আমেরিকার প্রকাশ্য পারমানবিক ডিল স্বাক্ষর করার বাস্তবতা তৈরি হয়। কিন্তু তাতে আমেরিকার জন্য এক নতুন সমস্যা হাজির হয়। সৌদি সরকার ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর থেকেই কোন ইরান-আমেরিকার এলায়েন্সের ঘোরতর বিরোধী হল। সৌদি রাজতন্ত্র মনে করে খোদ ইরান বিপ্লবসহ ইরানের দুনিয়ায় হাজির থাকাটাই সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি। তবে আগে ইরান-আমেরিকার এলায়েন্সের কোন প্রকাশ্য কিছু না থাকায় এটা সৌদিরা সহ্য করে নিয়েছিল। কিন্তু পারমাণবিক ডিল স্বাক্ষর হয়ে যাবার পর ১৯৭৩ সালের পর থেকে এই প্রথম সৌদি ফরেন পলিসি আমেরিকার থেকে বড় ধরণের ভিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে পরস্থিতি এমন যে আমেরিকার পক্ষে দুই বগলে দুজন সৌদি আর ইরানকে নিয়ে হেঁটে চলতে সক্ষম থাকা একেবারে অসম্ভব। কারণ এমন কোনো কার্যকর কমন ফর্মুলা নেই, আমেরিকা খুঁজে পায়নি, যাতে সৌদি ও ইরান দুই পক্ষই আমেরিকার সঙ্গে একই সঙ্গে থাকে। এজন্য এরপর থেকে আমেরিকার সঙ্গে পরপর তিনটা সৌদি বিরোধের ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথম ঘটনা মিসরে জেনারেল সিসিকে সৌদিদের ক্ষমতায় আনা এবং এর চেয়েও গুরুত্বপুর্ণ হল সেটা আমেরিকাকে উপায়হীনভাবে মেনে নিতে হয়েছে। দ্বিতীয়টা হলো, ইয়েমেনে হুতিদের ওপর সৌদি নেতৃত্বে জোটের বোমা হামলা। এখানেও সৌদি আর আমেরিকান নীতির ভিন্নতা ছিল এবং এখনও আছে। ফলে একা সৌদি ইচ্ছায় ঘটনা গড়িয়েছে। যেটার কোন ফল সৌদিদের পক্ষে আসুক আর নাই আসুক তবে – “আমাদেরটা আমারাই করে নিতে পারি” ধরণের একটা স্বান্ত্বনা সৌদিরা নিজেদের জন্য এনেছে। ইতোমধ্যে সৌদি সরকারের আর এক মরিয়া উদ্যোগ নিয়েছিল যেটা কার্যকর হয় নাই তা হল,আমেরিকার জায়গায় রাশিয়াকে অস্ত্রের সোর্স এবং নিজ ফরেন পলিসি ও রাজস্বার্থের পক্ষে পার্টনার হিসাবে পাবার চেস্টা করে দেখাওপেন দেখা সাক্ষাত আলোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু দুই রাষ্ট্রস্বার্থ এক কমন পয়েন্ট বের করতেে নাই। আর এবারের সৌদি নেতৃত্বে ৩৪ দেশের যে জোট, তা এখনও স্পষ্ট নয় যে, তাদের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য কী, কোথায় ফোকাস করবে। অথচ সৌদি প্রভাব যা মূলত নগদ অর্থের প্রভাব। এছাড়া বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মতো দেশের জন্য সৌদি প্রভাবে সায় না দিলে নিয়োজিত শ্রম চাকরিচ্যুতি ঘটিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে, এই ভয়। যেটাকে আমরা প্রভাব বলছি। অথচ আমাদের বিপরীত স্বার্থ হলো, আমরা কী সৌদিদের পো-ধরার মাধ্যমে আইএসের খামোখা চক্ষুশূল হওয়ার রিস্ক নিচ্ছি না!এভাবে শত্রুকে দাওয়াত দিয়ে আনছি কিনা সে প্রশ্ন উঠবেই।
ওদিকে এখনও আমাদের সরকারি ভাষ্য হলো, বাংলাদেশে আইএস বলে কিছু নেই। সর্বশেষ গত সপ্তাহেও আমেরিকান সচিব প্রতিমন্ত্রী নিশা দেশাইদের সাক্ষাতের সময় এটাই বলা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আরও ভালোভাবে উঠবে যে, সৌদি জোটে আমরা যাব কেন? অর্থাৎ আর পাঁচ জায়গায় সরকার যেমন তার সিদ্ধান্তের পক্ষে কোন ন্যায্যতা দেখাতে বা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও গায়ের জোরে তা বাস্তবায়ন করে যায়। ফলে এখানেও আমাদের সৌদি ইচ্ছাকে কদর করতে হবে। এছাড়া খামোখা শিয়া-সুন্নি কোন সম্ভাব্য গোষ্ঠীদাঙ্গায় বিপজ্জনক সম্প্রদায়গত পক্ষ নিতে হবে।
এখানে আর একটা দিক আছে। গত মাসে প্যারিস হামলার পরের পরিস্থিতিতে সেটা আরও উন্মোচিত। এককথায় বললে, একেবারে মরিয়া বা অস্তিত্ব ঠেকে যাওয়া অবস্থা না হলে সারা পশ্চিমের কোন রাষ্ট্র কারও পক্ষেই আইএসের বিরুদ্ধে শুধু আকাশ বোমা নয়, মাঠে নেমে মোকাবিলার অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই। যুদ্ধের খরচ জোগানোর সামর্থ্য নেই। তাই হামলার পরে ফরাসি প্রেসিডেন্টের মেলা হম্বিতম্বির আইওয়াশ আমরা দেখলাম। আইএসবিরোধী জোট এই হয়ে যাচ্ছে, সর্বাত্মক যুদ্ধ এই তো সামনে যেন। অথচ সব ভুয়া শো-আপ মাত্র। আসলে তারা কেবল আকাশ পথে বোমা হামলার খরচটাই শেয়ার করল। এসব আলাপের শেষের দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির অনুরোধে ওআইসির এক মিটিং ডাকা হয়। কেরির ইচ্ছা ছিল যদি কিছু খরচ শেয়ার করতে সৌদিরা রাজি হয়! কিন্তু আমরা দেখলাম, সৌদিরা আবার স্বমূর্তিতে; ইয়েমেনের হুতি ইস্যুতে অকেজো নীতির মতোই আবার এক নীতি নিয়ে সৌদিরা হাজির। এ নীতি শুনতে অনেক ভালো লাগছে যে, ৩৪ দেশের জোট। কিন্তু সৌদি নেতৃত্বে এটা কতদূর যাবে, যেতে পারে! এতে আমেরিকার অবস্থা বেয়ারা বাচ্চার বাবার মতো। না সে বাচ্চা বাবার কথা শোনে, না বাবা তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে, না শাসন করতে পারে। সেজন্য আমেরিকা সৌদি উদ্যোগকে সরাসরি বিরোধিতা বা উড়িয়ে না দিয়ে কূটনৈতিক কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। সৌদি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এবার বিস্তারে পরিকল্পনা কী তা জানাতে বলছে। আসলে প্রকারান্তরে বলতে চাচ্ছে, সৌদিরা কোনো কার্যকর পরিকল্পনা দিতে পারবে না। ফলে হতাশ হয়ে যদি সে আমেরিকার নীতির কাছে আবার ফিরে যায়!
সর্বশেষ দেখা গেল চীনও সৌদিদের সমর্থন জানিয়েছে। এটাও চীনের কূটনৈতিক কৌশলগত অবস্থান। আমেরিকার কুটনৈতিক দুর্দশার সময়ে সৌদিদেরকে “চালিয়ে যাও” বলে পিঠ চাপড়ে দেয়া।
তবে বাংলাদেশের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্বেগ জানিয়ে যত প্রতিক্রিয়া আমরা প্রকাশিত হতে দেখেছি তা জেনুইন। এই জোট যদি কার্যকর হওয়ার একটু-আধটু চেষ্টা করে তবে তা হবে শত্রুকে একেবারেই দাওয়াত দিয়ে ঘরে ডেকে আনার মতো ঘটনা। এছাড়া আমাদের বাড়তি এক বোনাস মিলবে – শিয়া-বিদ্বেষী এক জনগোষ্ঠী পরিচয়। অন্যের জন্য ভাড়া খাটা।
[লেখাটার প্রথম ভার্সন এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে আরও সংযোজন ও এডিট করে ফাইনাল ভার্সান হিসাবে প্রকাশিত হল।]