ইসলামবিদ্বেষের ছায়ায় দেখা
মাল্টিকালচারালিজম বনাম এসিমিলিয়েশন
গৌতম দাস
http://wp.me/p1sCvy-qH
২০১৫ ডিসেম্বর ২৯
আইএস কারা, কোথা থেকে কোন দেশ থেকে এসেছে; কী ধরণের মানুষ এরা যারা আইএস সংগঠনে এসে যোগ দিচ্ছে ইত্যাদি প্রশ্নে আমরা জানি মূলত এদের এক বিশাল অংশ পশ্চিমা সমাজগুলো থেকে। কিন্তু পশ্চিমা সমাজের কারা কারা কোন ধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পারিবারিক ব্যকগ্রাউন্ডের সন্তানেরা আইএসে যোগ দিচ্ছে এনিয়ে পশ্চিমা সমাজগুলোর অভ্যন্তরে বিশেষত ইউরোপের দেশগুলোতে পরিচালিত সামাজিক গবেষণার শেষ নাই। কী ধরণের মানুষেরা বিশেষ করে আইএস সংগঠনে যোগ দিচ্ছে এবিষয়ে প্রচলিত ধারণাগুলো মিথ্যা দাবি করে – আমেরিকান উচু কদরের দ্বিমাসিক জর্নাল “ফরেন এফেয়ার্স” এর চলতি ডিসেম্বরে প্রকাশিত জানু-ফেব্রু ২০১৬ সংখ্যায় – এক রিপোর্ট করেছে। যারা পশ্চিমা নেতা দেশ- দুনিয়া চালায় ও নীতি নির্ধারক, এমন গুরুত্বপুর্ণ লোকেদের চিন্তা ও পাঠের জন্য জরুরি বলে মনে করা হয় এই জর্নালকে – এই অর্থে এটা প্রেস্টিজিয়াস জর্নাল বলেন কেউ কেউ। যেমন হিলারি ক্লিনটন, ওবামা সরকারের সেক্রেটারি অব স্টেট থাকা অবস্থাতে এখানে লেখা ছেপেছেন। সেই জর্নালে আলোচ্য আর্টিকেলটা লিখেছেন ভারতে জন্ম বৃটিশ নাগরিক কেনান মালিক ( )।
মানুষ কেন সন্ত্রাসবাদী ভাবাদর্শ (র্যাডিক্যালিজম) আপন করে নেয় এবিষয়ে মোটা দাগে প্রচলিত চারটা তত্ত্বের কথা তুলেছেন লেখক কেনান মালিক। সেগুলোর “প্রথম তত্ত্ব বলে – লোকে জঙ্গী হয় কারণ তারা ধর্মীয় অনুমোদন পিছনে আছে এমন কিছু জঙ্গীবাদী ভাবাদর্শ সহজে তাদের নাগালে আসে, তাই। কেনান বলছেন, কিন্তু বৃটিশ আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বিভাগ ২০০৮ সালে MI5 পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে (লিক হয়ে বেরিয়ে পড়া রিপোর্ট) “ধর্মীয় জোশ উন্মাদনায় উজ্জীবিত হওয়া দূরে থাক বরং যোগদানকারীদের বিরাট এক অংশ নিয়মই ধর্মকর্ম পালন করে না”। ( Far from being religious zealots, a large number of those involved in terrorism do not practice their faith regularly. Many lack religious literacy and could actually be regarded as religious novices. ) ওদিকে দ্বিতীয় তত্ত্ব বলে, অন্যান্য জঙ্গীবাদী ভাবাদর্শ সাধারণত যেভাবে মানুষে অর্জন করে তা থেকে ভিন্ন ভাবে এরা ভাবাদর্শ লাভ করে। প্রচলিত ধরে নেয়া ধারণা হল এদের ভাবাদর্শ ঘৃণা-ছড়ানী-প্রচারকদের থেকে এসেছে “ideology comes from hate preachers”, তাই। গবেষণায় এর পক্ষেও সমর্থন মিলেনি। তৃতীয় তত্ত্ব বলে, এটা যেন ভারী কিছুকে যান্ত্রিকভাবে বইবার এক কনভেয়ার বেল্ট এর মত; যার শুরু হয় ক্ষোভ অসন্তোষে মানুষের ঐ বেল্টের উপর উঠে বসা থেকে। এরপর তা এক ধর্মভাবের ভিতর দিয়ে পার হয়ে এমন এক রেডিকেল বিশ্বাসের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় যা পরিণতিতে সন্ত্রাসবাদে পৌছায়। কেনান বলছেন কিন্তু ২০১০ সালের আর এক বৃটিশ গবেষণা রিপোর্টও কনভেয়ার বেল্ট তত্ত্বকে নাকচ করে বলেছে এটা ভাবাদর্শ বিষয়টাকে অযথা ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখিয়েছে। ……conveyor belt thesis “seems to both misread the radicalization process and to give undue weight to ideological factors.”। আর চতুর্থ তত্ত্ব , এরা বারেবারে বলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায় সন্ত্রাসবাদে যোগদানকারীরা হল সমাজের সেই গ্রুপ যারা সামাজিক অসাম্য ও সমাজের সাথে অ-সম্পৃক্ততার সমস্যার শিকার। ফলে মানুষ অমন সন্ত্রাসবাদী ভাবাদর্শকে আপন করে নেয়। কিন্তু কেনান বলছেন, লন্ডনের কুইন মেরী কলেজের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, “সন্ত্রাসবাদীওরা আর যাই হোক এরা সামাজিক অসাম্য ও সমাজের সাথে অ-সম্পৃক্ততার সমস্যার ভুগা ব্যাকগ্রাউন্ডের জনগোষ্ঠী থেকে আসা কেউ নয়। বরং যারা জিহাদী্ গ্রুপে যোগ দিয়েছে এরা বয়সে আঠারো থেকে বিশ বছরের মধ্যে, এরা অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান, বাসায় ইংরাজিতে কথা বলে, হাইস্কুল শিক্ষায় শিক্ষিত; কখন কখনো তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েরও। আসলে তারুণ্য, অর্থসম্পদ ও শিক্ষিত – এ’তিনটাই গুরুত্ত্বপুর্ণ নির্ণায়ক; এমন ক্যটাগরিই সন্তানদের বেশি বিপদজনক”।
কেনান মালিক এভাবে সামাজিক গবেষণার ক্রিটিকগুলো জড়ো করে দাবি করে বলছেন, “পশ্চিমের সমস্যা হল, তারা এইসব পুর্ব-অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে তাদের আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী নীতি সাজিয়েছে; যেগুলোর সবই ভুল”। ইউরোপে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক গবেষণার বরাতে কেনান মালিক এবার নিজ বরাতে এর কারণ বলছেন এভাবেঃ “দেখা গেছে যোগ দেয়া বেশির ভাগ তরুণ টিনএজ বয়সের – এই to little interaction with others in the society. Theirs is a much more existential form of alienation. তরুণেরা জিহাদী সন্ত্রাসে যোগ দিবার কারণ হল কিছু একটা তারা খুঁজে ফেরে যেগুলো খুব বেশি বর্ণনা করা যায় না তবু সেগুলো যেমনঃ পরিচয় খুঁজে ফেরা, অর্থ খোঁজ করা, সামিল বোধ করা, সম্মানবোধ করা। আর এটা মোটেও সত্যি না যে হবু জিহাদীরা মুল সমাজের সাথে দুর্বলভাবে যুক্ত থাকে এই অর্থে যে তারা স্থানীয়ভাষা বলতে পারে না অথবা স্থানীয় আদব-কায়দা রপ্ত নাই অথবা সমাজের অন্যান্যদের সাথে আলাপ আলোচনায় অংশ নিতে পারে না বা নেয় না। কিন্তু তাদের অস্তিত্ত্বমানতাবোধ বিষয়ক এক বিচ্ছিন্নতাবোধ আছে”।
শেষের এই বাক্যটা বলার জন্য লেখক কেনান মালিকের এতক্ষণকার কসরত। “বিচ্ছিন্নতাবোধ”। এই শব্দ ও ধারণা মার্কসবাদীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। বিশেষত সাহিত্যের এস্থেটিকস বা সৌন্দর্যতত্ত্ব চর্চায়। “বিচ্ছিন্নতাবোধ” ধারণাটা সার কথায় বললে, ক্যাপিটালিজম উতপাদন সম্পর্কের মধ্যেকার এক নতুন ফেনোমেনা হল, এখানে শ্রমিক নিজের উতপাদ্য বা প্রডাক্ট থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। নিজ উতপাদ্য, নিজের সৃষ্টির ভিতর নিজে কোথায় সে অস্তিত্ত্বমান আছে তা খুজে পায় না। অন্তত কোনটা তাঁর শ্রমের অংশ বা ক্রেডিট তা চিনতে পারে না। এথেকে অর্থাৎ উতপাদন থেকে উতপাদকের বিচ্ছিন্নতাবোধ, এক বিরহ সৃষ্টি হয়। এই অর্থে যে, উতপাদনের আগে বাজার দরে শ্রমিককে শ্রমমুল্য দিলেও তা উতপাদিত পণ্যে হাজির হবার পর ওর বাজার মুল্য আগের মোট সব খরচের চেয়ে বেশি হবে – যেটাকে আমরা মুনাফা বলে ধরে নেই। অর্থাৎ পণ্যের আসল এডেড ভ্যালু ওর কাঁচামাল, মেশিনারিস ই্ত্যাদির উপর পরিশোধিত শ্রমমুল্য এসবের যোগফলের সমানের চেয়ে বেশি হবে। প্রতিটা উতপাদিত পণ্যের সাথে তৈরি হয় এই বাড়তি মুল্য। এটাই মার্কসের সারপ্লাস ভ্যালু বা “বাড়তি মুল্য তত্ত্ব”। বাড়তি মুল্য থেকে প্রমিক বঞ্চিত হয়ে চলেছে সব সময়। এটাই মুল্য হিসাবে তা না পাবার কারণে তাঁর বিচ্ছিন্নতাবোধ অথবা বলা যায় উতপাদিত পণ্যকে নিজের মনে না করতে পারার বিচ্ছিন্নতাবোধ। এছাড়া, কাঁচামাল থেকে ফিনিশ প্রডাক্ট যত জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসবে ততই প্রডাক্টের কোন অংশটা কোন শ্রমিকের শ্রমে তৈরি তা আলাদা করা মশকিল হয়ে যাবে। সবমিলিয়ে এক বিচ্ছিন্নতা বা বিরহ বোধের সৃষ্টি হবে। অনেকা যেন বাচ্চা জন্ম দিবার পর কোন কারণে মা বাচ্চার সাথে সম্পর্কিত বা টান বোধ না জাগা ধরণের সমস্যা। মানুষের মৌলিক স্বভাব বৈশিষ্ঠগুলোকে মুখ্য করে সিনেমা বানানো বা সিনেমায় সেগুলোকে আনার ক্ষেত্রে Rainer Werner Fassbinder নামের এক জর্মন ফিল্মমেকারের কথা অনেকেই জানেন; যিনি এনিলিয়েশন বা বিচ্ছিন্নতাবোধের উপর সিনেমা বানিয়ে খ্যাত।
বুঝা যাচ্ছে, আমাদের আলোচনার কেনান মালিক আসলে এই বিচ্ছিন্নতাবোধ তত্ত্বের একজন খাতক। সার করে বললে, কেনান মনে করেন পশ্চিমকে রেডিক্যাল ইসলামি বিপ্লবীর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের জিহাদী ভাবাদর্শের জন্য – একথা তিনি মানতে নারাজ। ইসলামি রেডিক্যালিজম এর কোন কারণ নয়। এজন্য নানান গবেষণা ফলাফল হাজির করে তিনি তা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তবে তিনি মানেন এক ধরণের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অপরের প্রতি টান বা আগ্রহ কমে যাবার সমস্যা পশ্চিমা সমাজে আছে, তৈরি হয়ে আছে এটা তিনি মানেন।আসলে তিনি ইউরোপসহ পশ্চিমকে এসবের খাস জবাব বিচ্চিন্নতাবোধ দিয়ে দিতে চান, দেয়া সম্ভব দাবি জানাতেই এই রচনা।
তিনি বলছেন, ইতোমধ্যেই হবু জিহাদীরা প্রধান ধারার সংস্কৃতি, ভাব এবং আচারনিয়ম ইত্যাদিতে ভালভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও তা ত্যাগ করেছে আর এর বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গীর খোঁজে নেমেছে। এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে, জিহাদী হতে ইচ্ছুক অনেকে হয় নতুন করে ইসলামে ধর্মান্তরিত নয়ত, মুসলিম যারা দেরিতে নিজেদের ধর্মের দিকে নজর ফিরিয়েছে এমনও আছে। তবে উভয় ক্ষেত্রে তাদের সমাজ নিরাসক্ততা, বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে সাদা-কালো ভাবে মরাল কোডের চরম ইসলামিজমের দিকে ঝুকিয়ে ফেলেছে। ফলে “এটা ঠিক কোন রেডিক্যাল ভাবাদর্শের বিষাক্ত করে ফেলা নয় বরং এটা অবশ্যই সমাজের প্রচলিত প্রধান ধারার মরাল কাঠামোর প্রতি অনাস্থা এবং একই সাথে এক বিকল্পের খোঁজে লেগে পরা”। কেনন বলছেন, “অতীতে সমাজের প্রধান ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন সহানুভুতিহীন মানুষ রাজনৈতিক রূপান্তরের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, চরম বাম ধারা থেকে শ্রমিক আন্দোলন অথবা কোন রেসিজম- বিরোধী আন্দোলন এমন অনেক কিছুতেই যোগ দিয়েছেন”। ফলে কেনন বলছেন, স্বভাবতই সামিল থাকাহীনতা, সংশ্লিষ্টহীনতা বোধ, “এটা কোন মুসলিম সমস্যা নয়”। মুসলিম সমস্যা বলে ালিয়ে দেয়া যাবে না।
কেননের মুখে মুসলমানেদের দায়ী না করে দেখে – এটা দেখে আমাদের ঠিক খুশি হবার কিছু নাই। আর কেনন কারণ মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কেন পশ্চিমের বিশেষত ইউরোপের শত শত মুলত টিনএজ তরুণ আইএস এর মত সংগঠনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এটা আশির দশকে পপুলার বিচ্ছিন্নতাবোধ বা এলিনিয়েশন বা (মানুষ বা শ্রম তার উৎপাদিত উৎপন্নের ভিতর নিজেকে খুজে পায় না) তত্ব দিয়ে একালে আর ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ এই দৃষ্টিভঙ্গি খুবই সস্তা একপেশে এবং বস্তুবাদী। এটা অর্থনীতিবাদী বা স্টালিনিস্ট ধারণাও বটে। কারণ ‘আধুনিক রাষ্ট্রে’ মানুষ (বা তাঁর শ্রম) যেমন নিজের বস্তুগত সৃষ্টির থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে, এক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় ঠিক একইভাবে মানুষের প্রতি মানুষের স্পিরিচুয়াল টান অনুভব, সকলের সাথে একই তৌহিদে মিলিত হবার আকুতি ও আকাঙ্খাও তাঁর ভিতর কাজ করে। এরও এক অভাব বোধ হয়। কারণ মানুষ শুধু শ্রমের এক আধার, বৈষয়িক অর্থনীতির এলিমেন্ট মাত্র নয়; বরং একই সাথে সে স্পিরিচুয়াল বিয়িং। সকল অপরের সাথে সম্পর্কহীনতা – এই অভাব মানুষের মধ্যে এক হাহাকারের জন্ম দেয়, সে অস্থির হয়ে উঠে, দমবন্ধ লাগে। এটাও আর এক চরম বিচ্ছিন্নতাবোধ। অতএব বিচ্ছিন্নতাবোধ মানেই কেবল বস্তুগত বিচ্ছিন্নতা্বোধ নয়; স্পিরিচুয়াল বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্ভবত প্রভাবে এর দিক থেকে বস্তুগত বিচ্ছিন্নতা্বোধ এর চেয়েও বড়। এদিকটাই কেনান মিস করেছেন। তিনি আশির দশকে পড়ে থাকতে চাইছেন। কেননের এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আমাদের এই সমালোচনা আরো জায়েজ মনে হয় এজন্য যে তিনি এরপরে লিখছেন, “একালের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মধ্যে মানুষের নিরাশক্তবোধ, রাজনৈতিকভাবে স্বরবিহীন থাকা অবস্থা ছেয়ে গেছে। এধরনের উদ্বেগ ও অভাবগুলোকে কোন চার্চ বা ট্রেড ইউনিয়ন বুঝবে না”। অর্থাৎ কেনান একালে ২০১৫ সালে এসে এখনও বস্তবাদ-সর্বস্ব “এলিনিয়েশন বা বিচ্ছিন্নতাবোধ” তত্ত্ব আউড়িয়ে সব রোগ সারানোর ধনন্তরি ওষুধ মনে করতে চাইছেন। বিচ্ছিন্নতা্বোধ চার্চ, মসজিদ মন্দির – বলে নজর আন্দাজ করতে চাইছেন। আমাদের দেশে “বিরহ” বলে গানের ধারা আছে; ময়মনসিংহ থেকে মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া ইত্যাদি। যারা আমাদের এলিনিয়েশন ত্ত্ত্ব বুঝবার নাগাল পাবার অনেক আগে থেকে স্পিরিচুয়াল আবহে “বিরহ” গান করে আসছে।
কেননের এই রচনার ছোট শিরোনাম “ইউরোপের বিপদজনক মাল্টিকালচারালিজম”। অর্থাৎ ভারতীয় অরিজিনের বৃটিশ নাগরিক হলেও তিনি বৃটিশ মাল্টিকালচারালিজম নীতির সমালোচক। আবার এটাই তাঁর একই নিশ্বাসে ইউরোপের ফ্রান্সের ক্ষেত্রে ফরাসি এসিমিলিয়েশন বা ‘সবাইকে একরকম করণ’ নীতির পক্ষে দাঁড়ানো। আসলে মাল্টিকালচারালিজম বনাম এসিমিলিয়েশন – কথা দুটোরই কোন সারবত্তা নাই। তবুও বুঝবার জন্য শব্দদুটোর অর্থ খোলসা করা দরকার। মাল্টিকালচারালিজম বলতে বৃটিশ বুঝটা হল – বৃটিশ সমাজটাকে সে নানান কমিউনিটির মিলিত এক বড় কমিউনিটি হিসাবে রাখতে, দেখতে চায়। বৃটিশ কলোনি মাস্টারের দেশ সমাজে কলোনি প্রজা দেশ থেকে আসা সবাই যে যার ফেলে আসা নৃতাত্বিক জাত, ধর্মীয়, ভৌগলিক ইত্যাদি পরিচয় বজায় রেখেই “উপরি এক বৃহত্তর বৃটিশ সমাজের”নিচে এক বৃটিশ পরিচয়ে বড় হোক; এটাই চায়। বিপরীতে ফরাসী পছন্দের এসিমিলিয়েশন (এক ছাঁচে ঢালাই করার নীতি) শুনতে ভাল লাগলেও কিন্তু আসলে অনেক বেশী বলপ্রয়োগে জবরদস্তি করে নাগরিক সবাইকে একরকম করণের প্রচেষ্টা এটা। অর্থাৎ এখানে আর ফরাসি কলোনি মাস্টারের দেশ সমাজে সবাই যে যার ফেলে আসা নৃতাত্বিক জাত, ধর্মীয়, ভৌগলিক ইত্যাদি পরিচয়ের স্বীকৃতি নাই। বরং সব ভুলে যেতে হবে, বাদ দিতে হবে। বাধ্য করা হবে। কিন্তু এই বাধ্যবাধকতার দিকটা ফরাসীরা আড়ালে রাখতে চায় বা থেকে যায়। সবাইকে “সুন্দর” ইউনিফর্ম একরকম করার নামে (ইংরাজি সিমিলার বা একরকমকরণ থেকে এসিমিলিয়েশন ) জবরদস্তিতে সবাইকে ফরাসি হতে, ফরাসি কালচারই একমাত্র চর্চার কালচার হতে, করতে বাধ্য করা। যতটুকু ও যেভাবে বর্ণনা করলাম তা থেকে মাল্টিকালচারালিজম বনাম এসিমিলিয়েশন এর ভিন্নতা্র সবটা বুঝা বা বুঝানো যাবে না। কারণ এসব ভারি কথার আড়ালে মুল আরও এক বিষয়কে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রথম কথা হল, পশ্চিম মাইগ্রেন্ট শ্রমিকের আমদানি ঘটায় একেবারে একমাত্র নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থে, সস্তা শ্রম পাবার স্বার্থে, সবসময় এটাই সে করে এসেছে। নইলে লো-স্কিল না নো-স্কিল লেবার নিতে হত কেবল নিজ দেশীয় চামড়া থেকে ফলে এর মুল্য কমপক্ষে দ্বিগুণ তাদের যোগাতে হত। ফলে একমাত্র সস্তা মাইগ্রেন্ট শ্রমিক পাবার স্বার্থেই তাকে নিজের সমাজে এসব “মাল্টিকালচারালিজম বা এসিমিলিয়েশন” বলে বকোওয়াজের জন্ম দিতে হয়েছে। এটা প্রথম সত্য। তবে নিজ অর্থনীতি সমৃদ্ধিতে ভাল চলা অথবা মন্দা হয়ে চলার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অন্য চামড়ার শ্রমিক কতজনকে আসতে সে অনুমতি দিবে এটা সময়ে সময়ে তাকে কড়া নিয়ন্ত্রণে করতে যেতে হয়। অর্থনীতি ভাল মানে বেশি শ্রমিক প্রয়োজন নইলে উলটা হলে সব খেদাও – এটাই হল আসল নীতি। সবারই নীতি তবে দোষ দেয়া হয় তথাকথিত ডানপন্থি্র।
এরপর দ্বিতীয় আর এক আজব সত্য হল, কলোনি দখলের ফেলে আসা বছরগুলোতে কপাল গুণে বৃটিশের কলোনির তুলনায় ফরাসি কলোনির বাসিন্দারা বেশির ভাগই মুসলমান বা ইসলাম ধর্মপালনকারী। এরফলে কলোনি প্রজা দেশ থেকে সস্তা শ্রমের মধ্যে মুসলমান প্রজার হার ফ্রান্সের বেলায় বেশি। তাই সস্তা শ্রম ঢুকার অনুমতি দিতে গিয়ে একই ইউরোপে বৃটিশ ও ফরাসী হয়েও তাদের নীতি ও অভিজ্ঞতা একই রকম নয়। এভাবে ফ্রান্সে মুসলমানের সংখ্যা বলা হয় ৫০ লাখ। এসব তথ্যের দিকে নজর করে আগাম ব্যবস্থা হিসাবে ফরাসী সরকার পছন্দ করেছে – এসিমিলিয়েশন নীতি। কারণ এসিমিলিয়েশনের কথা বলে স্কার্ফ হিজাব বা কোন মুসলমান চিহ্ন প্রকাশিত হওয়া ঠেকিয়ে দেয়া যায়। ফেলে আসা নৃতাত্বিক জাত, ধর্মীয়, ভৌগলিক ইত্যাদি যেকোন পরিচয় বা চিহ্ন ভুলে গিয়ে সব কিছু ফরাসি হতেই হবে বলে বাধ্য করা যায়। অতএব “মাল্টিকালচারালিজম বা এসিমিলিয়েশন” – ফরাসি না বৃটিশ কোনটা ভাল – এসব কথা তাই আসল কথা লুকিয়ে বকোওয়াজ।
তাহলে কথা দাড়ালো, সস্তা শ্রম থেকে বেশি মুনাফার লোভে ক্যাপিটালজম কলোনি প্রজা দেশ থেকে শ্রম আনতে বাধ্য। আবার সেই শ্রম কে কীভাবে ম্যানেজ করার সুবিধা দেখে সে ভিত্তিতে “মাল্টিকালচারালিজম বনাম এসিমিলিয়েশন” এর কূটতর্কও সে হাজির করবে। কারণ নইলে আসল কথাগুলো সরাসরি বলতে হবে। কেনান মালিক তবু “মাল্টিকালচারালিজম বনাম এসিমিলিয়েশন” এর ভুয়া তর্কের মধ্যে “মাল্টিকালচারালিজমকে বেশি বিপদজনক বলছেন। কারণ বৃটিশরা নাকি “মাল্টিকালচারালিজমের কথা বলে মুসলমান ধর্মীয় নেতাদেরকে কমিউনিটির প্রতিনিধি মনে করেন ভুল করে, বেশি গুরুত্ব দেন; ইত্যাদি। কেনানের কথা শুনে বৃটিশদেরকে বোকা ভাবার কোন অর্থ নাই। আবার বৃটিশদের নীতিটা বেশি ভাল তাও নয়। ব্যাপারটা হল ম্যানেজমেন্ট। নাগরিকদের বা অপজিশনকে লিবারেল স্পেসের মধ্যে রাখলে তাদের কথা বলতে দেয়া, বিরোধীতা করতে দেয়ার আইনি সুযোগ যতটা সম্ভব বেশি রাখলে তাদের সকলের বিরোধীতা সামলে রাখা তুলনামুলক সহজ হবে বলে মনে করা হয়। বৃটিশ প্রশাসন মনে করে এই লিবারেল নীতি তাদের জন্য বেশি ফলদায়ক হচ্ছে। আর ধর্মীয় নেতার প্রসঙ্গটা হল, ধর্মীয় নেতারা যদি প্রতিদ্বন্দ্বী কোন নেতার চেয়ে বেশি প্রভাবশালি হন তাহলে বৃটিশ প্রশাসন কী তা অস্বীকার করার মত বোকামি করতে পারে? বরং একথা বলাতে কেনানের কথায় ইসলাম বিদ্বেষের ছায়া দেখা যাচ্ছে। কেনান মালিক নিজেই বলেছেন “মাল্টিকালচারালিজম বা এসিমিলিয়েশন” দুটোর মধ্যেই ভাল মন্দ দুটাই আছে। তবু কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই তিনি শিরোনামে “মাল্টিকালচারালিজমকে” বেশি বিপদজনক বললেন। এথেকেও মনে করার কারণ রয়েছে যে তিনি ফরাসিদের মত ইসলাম-বিদ্বেষ জারি রাখার সুযোগটা হারাতে চান না।
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[লেখাটা এর আগে ছাপা হয়েছিল দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ২১ ডিসেম্বর তারিখে। অনেক জায়গায় অপুষ্ট বা সংক্ষিপ্ত রেখেই তা ছাপতে হয়েছিল। এখানে সেসবের অনেক কিছু পরিপূরণ করে, সংযোগ ও সম্পাদনা করে আবার এখানে ছাপা হল। ]