মোদীর পাকিস্তান সফর আচমকা না পরিকল্পিত
মোদির পাকিস্তান সফরের অর্থ কী
গৌতম দাস
http://wp.me/p1sCvy-tV
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চমক দিতে ভালোবাসেন। বিশেষ করে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ ধরনের ফালতু ও অবাস্তব শব্দ ও বাজে ধারণাগুলো বাদ দিয়ে সরিয়ে রাখলে যে কোনো দুইটি রাষ্ট্র মানেই দুইটি আলাদা আলাদা স্বার্থ এবং যে সম্পর্ক আসলে আবার মৌলিকভাবে স্বার্থ-সংঘাতমূলক। কিন্তু তবু এরই ভেতর সাময়িক কোনো কোনো ইস্যুতে এক কমন অবস্থান হাজির করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। তার সুযোগ নিতে হয়, দরকার হয়ে পড়ে। তাই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক মাত্র এক জটিল বিষয়। হয়তো দেখা যাবে, ৯০ ভাগ বিষয়ে দুই রাষ্ট্রের অবস্থান ফাটাফাটি সংঘাতের, কিন্তু বাকি ১০ ভাগের কমননীতি-অবস্থানের (তবে তা সাময়িক) কারণে কোনো উদ্যোগ নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অবস্থায় তাকে আনতে হতে পারে, আনা হয়। তো সারকথা হলো, তাই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কমাত্রই এক জটিল জিনিস। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোদির এ চমক সৃষ্টি করার ঝোঁক সবসময়; মোদির এই ঝোঁক একদিক থেকে যেন পরোক্ষে তাঁর স্বীকার করে নেয়া যে, কূটনৈতিক সম্পর্ক জিনিসটা জটিল বলেই চমক সৃষ্টি করে মোদি একে সহজ করার কিছু সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আবার আরেক দিক থেকে এ জটিল জিনিসটিকে সামলাতেই শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারস্পরিক এক গুড ইম্প্রেশন তৈরির চেষ্টা থাকে। যেটাকে আমরা ব্যক্তিগত ইমোশন শেয়ার বা ভাবের সম্পর্ক তৈরি ইত্যাদি বলি, মোদি বলতে চান এগুলো জটিল কূটনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। কথা সত্যি, জটিল স্বার্থ-সংঘাতের ইস্যুকে নরম করতে, অন্তত ডায়ালগ শুরু করার দিক থেকে পারস্পরিক বোঝাবুঝি ভালো থাকলে তা একটা ইতিবাচক ভূমিকা অবশ্যই রাখে। অতএব এ কথাটাকেই আমরা ভিন্নভাবে বলি যে, মোদি চমক তৈরি করতে ভালোবাসেন।
মোদি আসলে গিয়েছিলেন পুতিনের রাশিয়া সফরে। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি হঠাৎ পাকিস্তানে থেমেছিলেন। দুই দিনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সফরে গত বুধবার ২৩ ডিসেম্বর তিনি রাশিয়া পৌঁছেছিলেন। কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, সেই ’৫০-এর দশক থেকেই রাশিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতে ভারী অস্ত্র, যুদ্ধ টেকনোলজির সরবরাহকারী। তবে মাঝে ২০০৫ সাল থেকে প্রথম আমেরিকান অস্ত্র; বিশেষত পারমাণবিক টেকনোলজি পাওয়াসহ ভারী অস্ত্র কেনা, একসাথে যৌথ উদ্যোগে নানানভাবে ভারতে এর স্থানীয় উৎপাদন ইত্যাদি অনেক বিষয়ে সম্পর্কের দুয়ার খুলেছে। কিন্তু তা খুললেও এখনো অস্ত্রবিষয়ক সম্পর্ক ও যৌথ উদ্যোগে উৎপাদন ও সরবরাহের বিষয়ে অর্থসহ সব ধরনের অঙ্ক বা ফিগারের দিক থেকে এখনো রাশিয়া সবার চেয়ে আগে এবং একমাত্র।
ফলে গুরুত্বপূর্ণ এবার যৌথভাবে লাইট কার্গো হেলিকপ্টার উৎপাদন, যৌথভাবে ট্যাংক তৈরি, যৌথভাবে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান উৎপাদন, পারমাণবিক ক্ষমতায় চলা অ্যাটাক সাবমেরিন লিজ বা ভাড়া নেয়া এবং শত্রুর ছোড়া মিসাইল আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাশিয়ান মিসাইল শিল্ড কেনা ইত্যাদি বিষয়ে চুক্তি শেষ করে দিল্লি ফেরার পথে শুক্রবার কয়েক ঘণ্টার জন্য মোদির আফগানিস্তানের কাবুল যাওয়ার কথা ছিল। আবার আফগানিস্তান কেন? অনেকেই জানেন, আফগানিস্তান সরকারের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পাশাপাশি ভারতের সাথেও প্রায় একই ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক আফগানিস্তানের আছে। এ দিকটা জানতে আগ্রহীরা ছাড়া এর বাইরের লোকেরা খুব কমই জানেন। আফগানিস্তানে আমেরিকান স্বার্থ ও প্রভাবের কারণে এর ফায়দা যেন শুধু পাকিস্তান না তোলে, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বাড়তি সুবিধা হিসাবে না হাজির হয়ে যায়, ভারতের ভাষায় তা যেন ভারসাম্যহীন না হয়, তা ঠেকাতে এর বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে ভারতের এমন সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করেছে আমেরিকা। আফগানিস্তানের সঙ্গে এসব রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক সূত্রে মান রাখার জন্য ভারত ৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান হিসেবে খরচ করে আফগানিস্তানের জন্য এক নতুন পার্লামেন্ট ভবন তৈরি করে দিয়েছে। ওই ভবন উদ্বোধন করতেই মোদির সংক্ষিপ্ত কাবুল সফর। এই সফরের খবর নিরাপত্তার কারণে খুব সীমিত বা লো-প্রোফাইল রাখাতে অনেকেই জানতেন না মোদি আসবেন। আর কাবুলে কর্মসূচির শেষে ওই দিনই বিকেলে তার দিল্লি ফিরে যাওয়ার কথা।
কিন্তু চমক ঘটল কাবুল কর্মসূচি সমাপ্তিতে। মোদি এ ধরনের চমকের খবর সবার আগে নিজেই টুইট করে ঘোষণা বা প্রকাশ করতে ভালোবাসেন। ফেরার পথে তিনি টুইট করলেন যে, ভারতে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সাথে দেখা করতে লাহোর যাচ্ছেন। শুক্রবার নওয়াজ শরিফের জন্মদিন, তাই তিনি শুভেচ্ছা জানাতে যাচ্ছেন আর একই সাথে শরিফের নাতির বিয়ে, ফলে শরিফের লাহোরের বাসায় তিনি যাবেন।
ব্যাপারটাকে মানুষের শরীরের সাথে তুলনা করা যায় যে, এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন মানুষ তৎক্ষণাৎ সেই কাজ করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে, যেন সেই ব্যাথা যা তাকে তাড়িত করছে তা রিলিজ বা উপশমের জন্য। ভারত-পাকিস্তান এ দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ককে নিয়ে কেচ্ছা-কাহিনীর শেষ নেই। বেশির ভাগ সময় সেটা ঝগড়া-বিবাদের, চরম ও গরমের। তবুও ভারত-পাকিস্তান এখন এমনই এক পরিস্থিতিতে পড়েছে; কোনো এক ব্যথা তাদের এমন তাড়িত করছে যে, তারা পরস্পরের কাছাকাছি আসতে, পুরনো কিছু বিবাদ প্রসঙ্গে মারমুখী হওয়ার বদলে তা লঘু করতে দিল্লি তৎপর হওয়া খুবই জরুরি মনে করছে। অতএব ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাবুল সফর থেকে দিল্লি ফেরার পথে আচমকা পাকিস্তানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। অন্তত তার মুখে বলা উদ্দেশ্য হলো, ২৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিন ছিল। ফলে মোদি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য পথে শরিফের লাহোরের বাসায় এক ঘণ্টা কাটিয়ে (পাকিস্তানে মোট ব্যয়িত সময় আড়াই ঘণ্টা) দিল্লি ফিরে গেলেন। কিন্তু এমন কী সেখানে ঘটেছে, যা এ দুই শীর্ষ নেতাকে এমন বেচাইন করছে? ভারতের মোদীকে বেচাইন করেছে আইএস। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক রিপোর্টের শিরোনাম থেকে ধার করা ভাষায়, “ঘাড়ে নিশ্বাস এবার, আইএস এখানে অপারেশনে নামছে”।
সেটা আজকের প্রসঙ্গ!
এতক্ষণ চমকের দিক থেকে ধারাবর্ণনা করলেও আসলে মোদির পাকিস্তান ইস্যু নিয়ে তাগিদবোধ অনেক আগে থেকেই। সুনির্দিষ্ট করে বললে, আইএসের প্যারিস হামলা বা আক্রমণের পর প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে শরিফের সাথে দেখা হওয়াকে পরিকল্পিতভাবে মোদি নতুন করে মিলিত হয়ে কথা বলার কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন ও লাগিয়েছিলেন।
আসল টেররিজম এর পানি কানে ঢুকছে
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে পরস্পরের আপত্তি ও মতবিরোধের শেষ নেই। এবং এর প্রায় প্রতিটি ইস্যু আজন্ম। ফলে পুরানা সেসব দিকে না গিয়ে একালের বিরোধের মূল ইস্যু নিয়ে কথা তুললে বলতে হয়, ভারত মনে করে, ভারতে আইএসের উপস্থিতি ও তৎপরতা ইতোমধ্যেই ঘটেছে, অ্যাকশন প্রস্তুতি চলছে ধরনের অবস্থায় আছে। এ বিষয়টা মোদীর কাছে পাকিস্তানের সাথে দ্রুত ডায়লগ শুরু করতে নগদ তাগিদ হিসেবে হাজির হয়। অর্থাৎ ২০০১ সাল আলকায়েদা ফেনোমেনা উত্থানের পর থেকে ভারতে এরা সরাসরি হাজির ও তৎপর না হলেও কাশ্মির-কেন্দ্রিক সশস্ত্র ইসলামি বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক তৎপরতাগুলোকেই ভারত আলকায়েদার ‘টেররিজম’ বলে চালিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন এই প্রথম ভারতকে আলকায়েদা বা একালের আইএস বিষয়ে মানে প্রকৃত “টেররিজম” মোকাবিলার জন্য তৈরি হতে হচ্ছে। ভার্তের দাবি করা এতদিন যাকে সে ছলনা করে টেরিজম বলে এসেছে তা অন্ততপক্ষে সেটা “গ্লোবাল টেররিজম” ছিল না,অথবা আমেরিকার ভাষায় যা “টেররিজম” তা এটা ছিল না। এবার আইএসের টেররিজম, “গ্লোবাল টেররিজম” – একে মোকাবেলার জন্য মোদী ভারতকে উপযুক্ত করে সাজাতে তৎপর হয়েছেন। সম্ভবত মোদি সরকারের ইচ্ছা ও অনুভব হলো, এত দিন ধরে টেররিজম বলে চালিয়ে দেয়া বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন আর আইএসের ‘টেররিজম’এ দুইয়ের সাথে একসাথে লড়তে গেলে ভারতের সক্ষমতা ও রিসোর্সে টান পড়তে পারে, তাতে উপযুক্তভাবে মোকাবিলার কাজে নাও করা যেতে পারে। এর বদলে প্রথমটার বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে বা পাকিস্তানের মাধ্যমে কোনো রফা করতে পারলে অথবা কমপক্ষে একে তুলনামূলক কম ভয়ঙ্কর হিসেবে হাজির রাখতে পারলেও তা ভারত সরকার ও রাষ্ট্রের সুবিধা হয়। হয়ত এটাই মোদির জন্য স্বাভাবিক ও সঠিক অনুমান। কিন্তু গোল বেধেছে তাহলে কাশ্মির ইস্যুকে সুরাহা করতে ভারতকে কোনো একটা ফর্মুলা প্রস্তাব করতেই হবে এমনকি তা কেবল নিজ পছন্দমত কান্নি মারা করে হলেও। সেটা ভারত চায় না বলে মনে করার কারণ আছে। ফলে ভারতের ইচ্ছা কাশ্মির ইস্যু পাশ কাটিয়ে আইএসের টেররিজম মোকাবেলার ইস্যুতে পাকিস্তানকে যতটা সম্ভব পাশে পাওয়া চেষ্টা করে যাওয়া। পাকিস্তানের সাথে মোদীর প্রবল তাগিদের উৎস এখানে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান পাল্টা বলতে চায়, ডায়লগ সেও অবশ্যই করতে চায় কিন্তু কাশ্মির ইস্যু পাশ কাটিয়ে শুধু টেররিজম নিয়ে ডায়লগ সে চায় না। এটাই ছিল এতদিন ভারত-পাকিস্তানের একালের মতবিরোধের মূল বিষয়। তাহলে সার বিতর্ক হলো, “টেররিজম বিষয়ে আলাপ হবে” না “কাশ্মীর ইস্যুসহ টেররিজম নিয়ে আলাপ হবে”।
এই বিরোধে দীর্ঘ দিন এভাবে নন-ডায়লগ হয়ে পড়ে থাকার পর মোদি এবার পাকিস্তানের সাথে মতবিরোধের স্থবিরতা কাটাতে উদগ্রীব হয়েছেন। এ বিষয়ে, গত ২৫ ডিসেম্বরের নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখছে, মোদি বুঝেছেন, “তিনি যে পাকিস্তানের সাথে ডায়লগে যুক্ত হচ্ছেন, এটা দেখানো তার দরকার, কারণ তিনি আমেরিকা ও সৌদিদের চাপে আছেন”। টাইমস এ কথাগুলো লিখছে এক ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক অশোক মালিকের বরাতে। মালিক অবশ্য আরেক কথা বলেছেন যে, “পাকিস্তানের আগের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সম্প্রতি বদল করে সেখানে সেনাপ্রধানের পছন্দের লোক আনা হয়েছে। কিন্তু মোদি এটাকে তার জন্য সুবিধা হিসেবে দেখেছেন, কারণ তিনি সরাসরি পাকিস্তান সেনাদের সাথে কাজ করতে চান”। অনেকে খোঁচা দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের প্রকৃত ক্ষমতা সেনাদের হাতে। নওয়াজের ভুল পদক্ষেপের কারণে নিজের আগের সরকারের আমলে তাঁর সেনাদের সাথে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না; যেটা জেনারেল মোশাররফের বিমান আকাশে আটকে রাখা আর পাল্টা তাদের ক্যু-এর ক্ষমতা দখল পর্যন্ত গিয়েছিল। তাই এবারো এমন কোনো জটিলতা যেন না সৃষ্টি হয়, সেজন্য নওয়াজের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নেয়ার আগের সময়ের ইনফরমাল ডিল হলো, কেবল সামরিক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেনাদের অবস্থান বেশি গুরুত্ব পাবে, বাকি অন্য সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের। এ বিষয়টাকে অনেকে খোঁচা দেয়ার কাজে ব্যবহার করে। তবে মোদী জানেন, পাকিস্তান থেকে তিনি যা চান তা পেতে গেলে তার জন্য সরাসরি সেনাদের সাথে ডিল করা ভাল, কারণ শেষ বিচারে তারাই তা দিতে পারে।
এসব পটভূমি মাথায় রেখে মোদি প্যারিস জলবায়ু মিটিংয়ে নওয়াজ শরিফের সাথে সমঝোতা করে ডায়লগ ওপেন করেন যে, দুই দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা টেররিজম ইস্যুতে সহযোগিতা নিয়ে ডায়লগ করবে। আর পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে একই সাথে কাশ্মির ইস্যুতে ডায়লগ চলবে। যদিও এটা মনে করার কোন কারণ নাই যে সব আলাপ প্যারিসের ঐ সাইড-টকে শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদুতের মাধ্যমে পুর্বপ্রস্তুতিমূলক আলাপ অনেক আগে থেকেই চলছিল। নওয়াজের সাথে মুখোমুখি আলাপের মাধ্যমে দুই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতে তা একধরণের ফরমাল বা চুড়ান্ত আকার পেয়েছিল। সেই রফা অনুযায়ী ৬ ডিসেম্বর ব্যাংককে দুই দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ে টেররিজম ইস্যুতে ডায়লগ হয়। আর এর দুই দিন পর ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানে সুষমা স্বরাজের সফরে কাশ্মির ইস্যুতে ডায়লগ হয়।
বলা যায়, মোদি ভারতে আইএস তৎপরতা ছড়ানোর সম্ভাবনা ও তা মোকাবেলাকে মাথায় রেখে, এটাকে সব বিবেচনার মূল কেন্দ্রে রাখার কারণে তিনি পাকিস্তানের সাথে আলোচনা করতে সিরিয়াস হয়েছিলেন। যদিও ভারতে কাশ্মির ইস্যুতে কিন্তু পাকিস্তান-কেন্দ্রিক যেসব সশস্ত্র ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা আছে, এগুলো ২০০১ সালে আলকায়েদা ফেনোমেনা হাজির হওয়ার আগে থেকেই আছে বা ছিল।
ফলে আভ্যন্তরীণ মুল্যায়নে ভারতের কখনই ধরে নিবার কারণ নাই যে, এরা আর আলকায়েদা ফেনোমেনা এক। কিন্তু তবুও ভারত কাশ্মীর-কেন্দ্রিক ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকেই কল্পিত জঙ্গিবাদ ও টেররিজম বলে, নিজের ভূমিতে অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কথার প্রচার চালিয়ে গেছে। উদ্দেশ্য, কল্পিত টেররিজমের সরবরাহকারীর অজুহাতে বাংলাদেশকে কব্জার মধ্যে রাখা, ভারতের জন্য বাংলাদেশের ওপরে বাণিজ্য সুবিধা আদায় করা আর ট্রানজিট করিডোর আদায় করে নেয়ার কাজে ব্যবহার করে নেওয়া। সম্প্রতি আইএস ভারত ও বাংলাদেশে উপস্থিত হয়ে থাকতে পারে, এটা তারা স্বীকার করছে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্যের সাথে ভারতের রাষ্ট্রের ভাষ্যের এ প্রথম অমিল দেখা গেছে। এমনকি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ অমিল-গরমিলকে স্বীকার করে নিয়ে গত সপ্তাহে বলেছেন, তারা ভারতের পাওয়া তথ্যের সাথে নিজের বোঝাবুঝি ও অমিলের কারণ খুঁজছে। তাহলে এ কথা মনে করার কারণ আছে যে, মোদির পাকিস্তান সফর কোনো চমক বা কারিশমা দেখানো নয়। নিউইয়র্ক টাইমসের ২৫ ডিসেম্বরের রিপোর্টে ভারতের ইংরেজি একটি দৈনিকের ডব্লিউআইআরই (WIRE)-এর সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারাদ্বারজনের এক মন্তব্য তুলে এনেছে। “In a way, he is sending a signal to everyone that there will be no more U-turns,” said Siddharth Varadarajan, a founding editor at The Wire, an Indian news site. “He is putting his personal political brand on this process. He can’t walk away that easily now.”
মোদী সম্পর্কে ভারাদ্বারজন বলছেন, “একভাবে দেখলে চমকের পাকিস্তান গমন করে মোদি আসলে সবার কাছে এক বার্তা দিয়ে ফেলেছেন, যা থেকে তিনি আর সরে আসতে পারবেন না। তিনি আসলে নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ইমেজ এই প্রক্রিয়ার মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছেন। ফলে তিনি এখন আর সহজে এখান থেকে সরে যেতে পারবেন না”।
“সমালোচকদের পাকিস্তা্ন পাঠিয়ে দিবার রাজনীতি” – ভারত আর বাংলাদেশে একই
বিজেপি তার সমালোচককে বাংলাদেশের মতই কিছু হলেই পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়। বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়েই যে যখন যেভাবে সুবিধা মনে করেছে পাকিস্তান ইস্যুকে অ্যান্টি-পাকিস্তানি হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদ – এক উগ্র বর্ণবাদ প্রচার করে থাকে ভোটের বাক্স ভরার দিকের নজর থেকে। কিন্তু রাষ্ট্র সরকার চালাতে গেলে তার তো একটা পাকিস্তান নীতি, পাকিস্তানের সাথে সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো কিভাবে ডিল করবে তা থাকতেই হবে। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নির্বাচনী বক্তৃতায় ভোট পাবার জন্য পাকিস্তান-বিরোধী উস্কানি, সুড়সুড়ি জাগিয়ে ভোটের বাক্স ভড়তে যা বলা হয় তার সাথে বৈদেশিক পাকিস্তান নীতির কোন সম্পর্ক নাই। ফলে সবসময় তাদের যার যার সরকারের পাকিস্তান নীতিতে আর তাদের স্ব স্ব কালে যেকোনো নির্বাচনে পাকিস্তানবিরোধী ঝড় তুলে ভোটের বাক্স ভরার রাজনীতির মধ্যে কখনো মিল-সামঞ্জস্য রাখতে পারেনি। বরং সময়ে স্থানীয় নির্বাচনে জেতার বিষয়টিকে মুখ্য বিবেচ্য রাখতে গিয়ে বেশির ভাগ সময়ে সরকারের পাকিস্তান নীতিতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। এসব সমস্যার কথা খেয়াল করে ভারাদ্বারজন ওই মন্তব্য করেছেন।
কম-বেশি প্রায় এই একই সমস্যা আমাদের দেশেও হয়ে আছে। সরকারের সক্ষমতা ও মনোযোগ এরই মধ্যে (নকলভাবে) জঙ্গি বলে সাংবিধানিক রাজনীতির জামায়াত-বিএনপি দমনের কাজে সরকার ব্যবহার করে চলেছে। আবার সাম্প্রতিককালে আসল ‘টেররিজম’ আইএস বা জেএমবি দমনের কাজেও এটা ব্যবহার করছে। অর্থাৎ সরকারের মোট সক্ষমতাটা তাদেরকে দুইভাবে ভাগ করে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এভাবে কত দিন চলতে পারবে, সক্ষম থাকবে কি না জানি না। তবে কেবল জেএমবি দমনের কাজে মনোযোগী থাকার জন্য সক্ষমতা কেবল সেদিকে নিবদ্ধ রাখতে আপাতত সাংবিধানিক রাজনীতিতে বিরোধীদের সাথে কোনো ডায়লগ, আঁতাত, বোঝাবুঝি কোনো কিছুর আলামত দেখা যাচ্ছে না, যাতে সরকার সব রিসোর্স সক্ষমতা একমুখী করতে পারে।
মোদির পাকিস্তান সফরে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া
মোদির সফরে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিক্রিয়া হয়েছে অদ্ভুত ও মারাত্মক; তবে এককথায় এবং দূরে সেভ জায়গায় দাঁড়িয়ে বললে বলতে হবে, মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তো এমন প্রতিক্রিয়াগুলোকে কয়েকটা খোপে ভাগ করে বললে, প্রথম খোপ হল তারা যারা সরাসরি শুধু ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় লাভালাভের দিক চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। এরা হলো খোদ কংগ্রেস, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও তার জনতা দল ইউনাইটেড। খোপ দুই, যারা জম্মু ও কাশ্মীর অথবা পাকিস্তান-ভারতের জন্মের সময় থেকেই লম্বা বিবাদে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন এককথায় বললে, ভারতীয় কাশ্মীরকেন্দ্রিক সব ধরনের দল মোদির পাকিস্তান সফরকে ইতিবাচক বলেছেন। এছাড়া এদের সবার একই কথা “ডায়ালগ”; নিরবচ্ছিন্ন ডায়ালগই প্রধান কার্যকর করণীয় মনে করেন সবাই। এমনকি যারা কাশ্মীড় ইস্যুতে বিচ্ছিন্নতাবাদী লাইন অনুসরণ করে তারাও মোদিকে স্বাগত জানিয়েছেন। শ্রীনগরের মডারেট দল হুরিয়াত এটাকে সরকারের নেয়া “ইতিবাচক সঠিক পদক্ষেপ” বলেছে। আর হার্ডলাইনের আলী শাহ জিলানি বলছেন, “ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টার বিরুদ্ধে তাদের কোনো আপত্তির কিছু নেই”। বর্তমানে ভারতীয় কাশ্মীর রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে চলতি জোট সরকার গঠনের পার্টনার স্থানীয় মডারেট দল পিডিপির নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাঈদও খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে এটাকে ‘সঠিক দিকে পদক্ষেপ’ বলেছেন। ওদিকে হায়দ্রাবাদকেন্দ্রিক এমআইএম দলের নেতা ও কেন্দ্রীয় লোকসভার সদস্য ব্যারিস্টার আসাদুদ্দিন ওয়ার্সীও মোদির সফরের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ডায়ালগ চালিয়ে যাওয়ার কথা তুলেছেন। কাশ্মীরের স্থানীয় দল ন্যাশনাল কংগ্রেসের শেখ আবদুল্লাহর নাতি ওমর আবদুল্লাহও স্বাগত জানিয়েছেন; তবে এমন পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয় না, ছুটে যায় বলেও আক্ষেপ করেছেন। ওদিকে বাম কমিউনিস্টদেরও (সিপিএম, আরএসপি) এই খোপে ফেলা যায়, একই ধরনের স্বাগত জানানোর কারণে। তবে এদের বাড়তি কিছু শব্দ আছে। যেমন তারা ‘টেররিজমও নিপাত যাক’ সঙ্গে যোগ করে তাদের কথা বলেছেন।
এই সফরের খবর ভারতীয় মিডিয়ায় আসার পর কংগ্রেস প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, “এই সফরের কোন তালমিল প্রটোকল রাখা হয়নাই। ফলে এটা একটা ফালতু তামশা ব্যাপার হয়েছে। এর খারাপ পরিণতি হবে। এর আগে বাজপেয়ির এমন সফরের পরে কারগিল যুদ্ধ এসেছিল”। যেমন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এনডিটিভি, দি হিন্দু,। কংগ্রেস এমন মন্তব্য করার সময় ধরেই নিয়েছে যেন আগে কোন ইনফরমাল আলাপ ছাড়াই মোদী পাকিস্থান সফরে গিয়েছেন। এর আর এক অর্থ আইএস ইস্যুতে মোদীর সরকার কী করে তাতে তাদের কোন মাথাব্যাথা নাই। আভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নিজ দলের সুবিধাই আসল কথা। সোনিয়ার কংগ্রেসকে কেবল ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় বক্তব্য অবস্থান নেয়া ও প্রকাশের দলে বা খোপে ফেলাতে অনেকে বিস্মিত হতে পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা ইদানীং এমন অবস্থাতেই ঠেকেছে। বিশেষ করে লোকসভা ২০১৪-এর নির্বাচনে কংগ্রেস শোচনীয়ভাবে হেরে মোট আসনের মাত্র ১০ ভাগেরও নিচে আসন সংখ্যা হয়ে যাওয়ার পর। যেমন মোদি সরকারের ‘ল্যান্ড বিল’ বা জমি অধিগ্রহণ আইন নামে একটি আইনের প্রস্তাব করেও বিরোধীদের বিরোধীতায় তা শেষ পর্যন্ত পাস করাতে পারেনি, পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেছে। শেষে মোদী বিলটা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বা বলা যায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাস হয়নি বলে এমনিতেই এটা প্রত্যাহার হয়ে গেছে ধরতে হবে। ওই বিলের সারকথা ছিল একদিকে চাষাবাদের জন্য জমি, অন্যদিকে অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বা শিল্প-কারখানার জন্য জমি এ দুই ধরনের প্রয়োজনের মধ্যে ভারসাম্যের লাইনটা কোথায় টানা হলে সঠিক হবে, সব কুল রক্ষা পাবে। এ বিলের ইস্যুতে কংগ্রেসের অবস্থান খুবই সঙ্কীর্ণ বিরোধিতার। সিদ্ধান্তের পেছনে তাদের মূল বিবেচনা ছিল, কোনো চটকদার পপুলার কথা বললে তাতে দল চাঙা হবে। অথচ বিষয়টা একালের সব রাষ্ট্রের জন্যই খুব নির্ধারক এক নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। পার্লামেন্টে আলোচনার সময় রাহুল গান্ধী দলের মূল অবস্থান-বক্তব্য রেখেছিলেন। রাহুলের বক্তৃতার পর মিডিয়াসহ কংগ্রেসের নিজের দলের আলোচনার বিষয় ছিল, ‘রাহুলের পারফরম্যান্স’। রাহুল ‘কী বলেছেন’ সেটা নয়, ‘কোন অভিনয়ে’ বলেছেন সেটাই বিবেচ্য ও চর্চার বিষয় হয়েছিল। দল কি অবস্থান নিয়েছে, সেদিক নিয়ে কারও কোনো আগ্রহ ছিল না। কথাগুলো তুলে আনলাম, ভারতের এখনকার বিরোধী দল কংগ্রেসের রাজনীতির কোয়ালিটি বোঝানোর জন্য। তবে একথাও ঠিক, বিজেপি যখন বিরোধী অবস্থানে ছিল, তখনও কমবেশি এসব সমস্যা একই ছিল। সরকার ও বিরোধী দল এভাবে ভাগ করে দেখা ছাড়াও যদি একই ক্ষমতাসীন বিজেপির নির্বাচনীর রাজনীতির অবস্থান আর সরকারের নীতি বা সংসদে আনা বিলের বেলায় অবস্থান এভাবে ভাগ করে দেখি তো সেখানেও বিশাল ফারাক আর ছলচাতুরিতে ভরা অবস্থান দেখতে পাব। নভেম্বরের বিহার নির্বাচনে বিজেপির মধ্যে পাকিস্তান-বিরোধী ঘৃণা ছড়ানো কাড়াকাড়ি ছড়াছড়ি গেছে। এছাড়া ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘বিজয় দিবসে’ প্রচারণায় নামতে ভারতীয় বাহিনীকে খোদ মোদির টুইট বার্তার আহ্বান জানিয়েছিল। বিজেপির এগুলো সবই ভোটের রাজনীতি। সস্তা ইসলামবিদ্বেষ ছড়ালে ভোটের বাক্স ভরে উঠবে এ বিশ্বাসে কাজে নেমেছিল। আবার সেই মোদিই এখন পাকিস্তান সফরের মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করার চেষ্টা থাকলেও এক সিরিয়াস বিজনেসে পাকিস্তানের সঙ্গে জড়াতে চান, একথা শতভাগ সত্যি।
সারকথায় দেখা যাচ্ছে, ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই আইএস ইস্যুটা এখনও মুখ্য ইস্যু হতে এবং যথাযথ গুরুত্ব পাবার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বিরোধী কোনঠাসার আভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
[এই একই প্রসঙ্গে আমার দুটো লেখা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে এবং ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্ট তুলে দুটি দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। প্রথমটা ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় আর দ্বিতীয়টা ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে ঐ লেখা দুটোর পয়েন্টগুলোকে একসাথে করে এরপর নতুন করে পরিবর্ধন ও এডিট করে এখানে আবার ফাইনাল ভার্সান হিসাবে ছাপা হল। ]
goutamdas1958@hotmail.com