আমেরিকার মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
গৌতম দাস
২৬ জানুয়ারি ২০১৬,মঙ্গলবার
http://wp.me/p1sCvy-D3
আধুনিক রাষ্ট্রের জমানায় বাণিজ্য চুক্তি করার রেওয়াজ উঠেছিল আশির দশকের শুরু থেকে। অর্থাৎ যারা গরিব দেশ বা ছোট অর্থনীতির রাষ্ট্র বলা হয়, এদের সাথেও বাণিজ্য চুক্তি করার দরকার-বোধের শুরু তখন থেকে। বাণিজ্য চুক্তি বলে এটিকে বাড়িয়ে বলার অর্থ হয় না। সারকথায় বললে আমেরিকা তার নিজ বাজারে নিজ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় গরিব দেশগুলোকে পণ্য রফতানি করতে দেয়া শুরু করেছিল। কথাটিকে আরেকভাবে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক পর মূলত ইউরোপের বাজার বিনিয়োগ-পুঁজিতে পরিপূর্ণ সয়লাব হয়ে গেলে উন্নত অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলো মনে করা শুরু করেছিল, তাদের কেবল গরিব দেশে নিজ পণ্য রফতানিকারকের এত দিনের একক ভূমিকায় থাকা বোকামি হচ্ছে। ইউরোপের বাজার স্যাচুরেটেড হওয়ার এর পরে কে? তাই এশিয়ায় আসতে সময় লেগেছিল। অন্তত গ্লোবাল বিনিয়োগ-পুঁজির খাতক হতে পুঁজিবাজারের ক্রেতা বা ঋণগ্রহীতা আরো বাড়াতে চাওয়া- এ দরকারি দিক থেকে দেখে মূলত আমেরিকা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলে বিশ্বব্যাংকের মুখ্য স্লোগান হয়েছিল- গরিব দেশকে “রফতানিমুখী অর্থনীতি” করে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশে সে সময়ের এ’বিষয়টার দুটো ঘটনায় চিহ্নিত করা আছে।
বাংলাদেশে ‘রফতানিমুখী অর্থনীতি’ করতে বিশ্বব্যাংক ১৯৮২ সালে এরশাদ দিয়ে ক্ষমতা দখল করিয়ে বিশ্বব্যাংকের সংস্কার কর্মসূচি চালু করে দিয়েছিল। এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন বা সংক্ষেপে ইপিজেড ধারণা সাথে আসে সেই থেকে। অন্যদিকে সে ঘটনা-সময়ের দ্বিতীয় চিহ্নটি সামাজিক সাংস্কৃতিক ধরনের। কবি ফরহাদ মজহারের এক কবিতার বই আছে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় বেরিয়েছিল, বইটার নামই “অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারী মেশিন”। বইয়ের তাতপর্যপুর্ণ এ’নামটাই অনেক কিছুর নির্দেশক। কলোনি আমল থেকেই আমাদের প্রচলিত রফতানি পণ্য ছিল পাট, কাঁচা পাট অথবা পাটজাত পণ্য। সে আমলে যাকে বলা হত অর্থকরি ফসল। বিশ্বব্যাংকের ওই সংস্কার কর্মসূচিতে এই প্রথম আমাদের সেখান থেকে সরিয়ে এনে মুখ্য রফতানি পণ্য করা হয় রেডিমেড গার্মেন্টস, আর আমাদের পরিচিতি দাঁড়ায় এরই রফতানিকারক দেশ। গার্মেন্ট রফতানির অর্থনীতিতে রূপান্তর করে দেয়া হয়।
এখানে একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিকে রফতানিমুখী করে সাজানো শুরুর আগে আমরা আমেরিকায় কোনো পণ্য রফতানি করতে চাইলে তাতে আইনগত কোনো বাধা ছিল তা নয়। তাহলে রফতানিমুখী করে সাজানো – এই পরিস্থিতিতে নতুন যে বিষয়টি তা হলো, আমেরিকাতে কোন কোন পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ কর মওকুফ বা ছাড় পাবে, এমন কিছু পণ্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য সেই পণ্যই রেডিমেড গার্মেন্ট। আর এর সাথে কর মওকুফের এক কোটা ব্যবস্থা। এই হল আমাদের মতো দেশের সাথে প্রথমবারের মতো আমেরিকায় রফতানিকারকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বাণিজ্য চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট হওয়া। আমাদের মতো দেশের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি করার ইতিহাসের শুরু। এর মূল বৈশিষ্ট্য হল, আমাদের মতো দেশকে আমেরিকা কতটা এবং কী কী পণ্য নিয়ে প্রবেশ করতে দেবে, এমন একপক্ষীয় করে নেয়া ব্যাপারের উপর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ।
তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইস্যুতে ১৯৪৭ সাল থেকেই জাতিসঙ্ঘের ব্যানারে নানান বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ শুরুল হয়েছিল। জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস এন্ড ট্রেড, গ্যাট (GATT) থেকে শুরু হয়ে ১৯৯৪ সালে ডব্লিউটিও-তে এসে যা শেষ হয়। এতে আমাদের দিক থেকে পড়ে পাওয়া কিছু সুবিধার রাস্তা তো অবশ্যই খুলেছিল। যেমন আমরা উন্নত দেশের তৈরি সব ধরনের পণ্যের ক্রেতা হওয়া সত্ত্বেও উল্টো খোদ আমেরিকায় কিছু পণ্যের রফতানিকারক হয়ে গিয়েছিলাম। স্বভাবতই তা শুধু সেসব রফতানি পণ্য, তুলনামূলকভাবে যা টেকনোলজির দিক থেকে কম জটিল আর একেবারেই কম দক্ষ শ্রম লাগে আর তা প্রচুর গা-গতরের শ্রম, এমন। কিন্তু সেটাও এমনি আসেনি। অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল, যেন তারা আমাদের তাদের বাজারে মহান প্রবেশদাতা হিসেবে হাজির হয়। অর্থাৎ বাজারে আমাদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ যেন আমেরিকার হাতে থাকে। কথাটা বলার কারণ বিষয়টি রেসিপ্রোকাল নয় বা পাল্টাপাল্টি ধরনের নয়। যেমন আমাদের বাজারে আমেরিকার প্রবেশের ক্ষেত্রে তো এটা খাটে না। আমরা সেখানে কোনো দাতা হিসেবে হাজির নই। আমাদের বাজারে প্রবেশে আমেরিকার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই। যা হোক, এসবের ভেতর দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে সেই থেকে প্রবল কথাবার্তার জোয়ার উঠেছিল। ‘গ্রুপ-৭৭’ বা ‘উরুগুয়ে রাউন্ড’, ‘দোহা রাউন্ড’ ইত্যাদিতে সাতটি রাউন্ড বিস্তর আলোচনা দরকষাকষির পরে নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও হিসেবে হাজির হয়েছিল। কিন্তু এভাবে হাজির হতে হতে আমেরিকা আবার এ ধরনের গ্লোবাল বাণিজ্য সংস্থায় আস্থা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। এর মূল কারণ মনে করা হয়, ডব্লিউটিও’র কার্যকারিতা যত বাড়ছিল ততই অর্থনৈতিকভাবে গরিব এলডিসি বা লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজসহ নানা ক্যাটাগরির জোটবদ্ধতা শুরু হতে দেখা যায়। আমেরিকার বিরুদ্ধে সবার জোটবদ্ধ হয়ে যাওয়া- এটাই আমেরিকার নিরুৎসাহিত হয়ে যাওয়ার কারণ। আর এর বদলে সেই সাথে আমেরিকার নতুন উৎসাহের বিষয় হয়ে ওঠে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি- বাই-লেটারাল ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট। এর ভেতরে মুক্ত শব্দটি যত জ্বলজ্বল করে, ততটাই এটা বন্দিত্বের ফাঁদ।
আমেরিকার ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টে নতুন উৎসাহের ফলে ডব্লিউটিও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেনি ঠিকই; তবে আমেরিকার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে বিভিন্ন রাষ্ট্রের আমেরিকার সাথে বাই-লেটারাল ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট। দ্বিপক্ষীয় ধরনের চুক্তি আমেরিকার দিক থেকে সবচেয়ে উপযুক্ত বলে ধারণা প্রবল হতে থাকে। এর কারণ ভিন্ন এক পরিস্থিতি। যেকোনো বাণিজ্য চুক্তি আসলে আইডিয়ালি ‘উচিত অর্থে’- রাষ্ট্রস্বার্থের ভিত্তিতেই হওয়ার কথা। কিন্তু একটা চুক্তির মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রস্বার্থে বাণিজ্য’ ঘটানো ব্যাপারটা বাস্তবে অলীক না বললেও খুবই কঠিন। ফলে গণস্বার্থের বদলে নামেই এখানে একটা কোটারি স্বার্থ তৈরির সম্ভাবনা থাকে সব সময়। মূলত পুঁজিমালিক বা ব্যবসায়ীর স্বার্থটাই জনস্বার্থের নামে হাজির হয়ে যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আরেক বিপদ দেখা যায়।
যেমন- বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধরা যাক। এখানে সরকারের স্বার্থ মানে আসলে সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ অথবা যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকার স্বার্থ। জনস্বার্থের সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে আমেরিকা বাংলাদেশের সাথে কোনো বাণিজ্য চুক্তির বেলায় ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগায়। বিশেষ করে জনগণের রাজনৈতিক মানবিক মৌলিক অধিকার রক্ষা না করা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার রক্ষা না করার মতো ব্যাপার থাকলে তা আড়াল, উপেক্ষা অথবা ন্যায্যতা আমেরিকার দেয়া অথবা না দেয়াকে ব্যবহার করে যেকোনো বাই-লেটারাল ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করে নেয়া সম্ভব। কারণ, এখানে ক্ষমতাসীন সরকার নিজের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে অথবা নিজের ক্ষমতাসীন থাকার স্বার্থে খোদ রাষ্ট্রস্বার্থ বা গণস্বার্থকে বিক্রি করে দেয়া সম্ভব। কারণ আমাদের মত দেশের রাজনৈতিক সাংবিধানিক ব্যবস্থা, পাবলিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আর এটাই আমেরিকার জন্য সুযোগ। অথচ আমেরিকাকে একই বিষয়ে চুক্তি ডব্লিউটিও’র ভেতর জোটবদ্ধ এলডিসি রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে করতে হলে, সেখানে কোনো একটা রাষ্ট্রের ‘সরকারের দুর্বলতা’কে ব্যবহার করা যেত না। কারণ সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর সাধারণ স্বার্থের সাথে সমঝোতা চুক্তি, ফলে শুধু একটা রাষ্ট্রের ও শাসকের দুর্বলতাকে পুঁজি করার সুযোগ সেখানে নেই। তাহলে দাঁড়াল, আমেরিকার পছন্দ দ্বিপক্ষীয় ধরনের ফ্রি বাণিজ্য চুক্তি। এটা হলো এমনই ফ্রি বা স্বাধীন যে, নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে, দলবাজির স্বার্থে স্বাধীনভাবে দেশ বা গণস্বার্থ বেচে দেয়া যায়।
এখানে দ্বিপক্ষীয় ধরনের ফ্রি বাণিজ্য চুক্তি বলতে তা শুধু দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যেই এটা হতে হবে এমন বোঝা ভুল হবে। এর আরেক রূপও আছে, যেটা প্রায় যেন একটা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি- ওই ফরম্যাটই কয়েক রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার – এভাবে একসাথে করা হয়ে থাকে। সাধারণত একই স্তর বা মানের অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলোর সাথে আমেরিকা এমন দ্বিপক্ষীয় ধরনের ফ্রি বাণিজ্য চুক্তি জোট করে থাকে। অথবা অনেক সময় ভৌগোলিক এলাকা বা অঞ্চলের কয়েকটা রাষ্ট্রের সাথে এমন বাণিজ্য চুক্তি করেছে আমেরিকা। যেমন ল্যাটিন আমেরিকার এমন দু’টি বাণিজ্য চুক্তি হল- উত্তর আমেরিকা ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট ১৯৯১ (নাফটা) এবং সেন্ট্রাল আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট ২০০৬ (সাফটা)। আমেরিকার করা এ ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তিগুলোকেও তারা বাই-লেটারেল ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা দ্বিপক্ষীয় এফটিএ বলে ক্যাটাগরি, নামকরণ করে ফেলেছে।
এ ছাড়া একই ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট ধরনেরই ইদানীং আরেক সর্বশেষ ধাপ হলো, যেমন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা সংক্ষেপে টিপিপি এবং ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ বা টিটিআইপি। তবে এখানে এবার ‘পার্টনারশিপ’ শব্দটি নামের শেষে রাখার একটা রেওয়াজ চালু হয়েছে।
পার্টনারশিপ
শব্দটির প্রতীকী কিন্তু এর গুপ্ত বা অনুচ্চারিত দিক হল, রাইজিং ইকোনমির চীন বা আগামী দিনের নতুন গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডারের নেতা চীনের বিরুদ্ধের রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একসাথে আমেরিকার করা দ্বিপক্ষীয় ধরনের ফ্রি বাণিজ্য চুক্তি- এরই জোট এটা। এর আগে সাধারণভাবে আমেরিকা দ্বিপক্ষীয় ধরনের যেসব বাণিজ্য চুক্তি করে চলছিল, এমনকি চলতি শতকে এসেও সে একই কাজ করছিল; তবে একই ধরনের এবারের চুক্তিগুলোতে চীনবিরোধী এক বাড়তি বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়েছে। যেমন- টিপিপি, এটা করা হয়েছে মূলত চীনে সমুদ্রপথে প্রবেশের চার পাশের পড়শি কাছে-দূরের রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে। মূলত এমন রাষ্ট্রগুলো হল- অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, জাপান, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম আর স্বাগতিক আমেরিকা। তবে ব্যতিক্রমভাবে এখানে কানাডা আর কিছু ল্যাটিন আমেরিকান দেশ, যেমন- চিলি, মেক্সিকো ও পেরুও আছে। এ ছাড়া অন্য যে দ্বিতীয় বাণিজ্য চুক্তি ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ বা টিটিআইপি – এটা হলো আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার হবু বাণিজ্য চুক্তি।
টিপিপি আর টিটিআইপি এ দুই চুক্তির মধ্যে নামের শেষ পার্টনার শব্দ যোগ হয়ে আছে সে কথা ছাড়াও এ দুই চুক্তির বড় মিলের দিক হল, এটা চীনবিরোধী বৈশিষ্ট্যের জোট। এ ছাড়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মিলের দিক হল বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেমন- এ দুই চুক্তিরই প্রস্তুত প্রক্রিয়া চলছে অত্যন্ত সঙ্গোপনে। নিজ জনগণকে দূরে রেখে। লন্ডনের ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার ভাষায়, ‘এ গোপনীয় ধরনের অগণতান্ত্রিক চুক্তি প্রক্রিয়া এখনো চলছে এবং এ রিপোর্টে তুলে ধরা চুক্তিবিষয়ক প্রায় সব তথ্যই লিকেজ হয়ে আসা তথ্য অথবা তথ্য পাওয়ার অধিকার- ‘রাইট টু ইনফরমেশন’ আইনে অনুরোধ পাঠিয়ে সংগ্রহ করা তথ্য’। অন্য দিকে এ চুক্তির বিরুদ্ধে ব্রিটেনে জনমত সংগঠিত করার সংগঠন ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর নির্বাহী পরিচালকের ভাষায়, তিনি মনে করেন এ হবু চুক্তি ইউরোপ ও আমেরিকান সমাজের সাধারণ মানুষের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির আক্রমণ।
এই হলো সংক্ষেপে আমেরিকার করা ধারাবাহিক বাণিজ্য চুক্তির ইতিহাস। সাধারণভাবে বললে, আমেরিকার ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করার উদ্দেশ্য হল, বড় বড় বিজনেস হাউজ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে যেসব রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন-রীতি মেনে চলতে বাধ্য হয় এমন নিয়ন্ত্রণ আইনগুলোর যে আইনি বাধা আছে, সেগুলো আলগা করে দেয়া। চুক্তি করার আগে প্রায়ই আমেরিকার ‘পার্টনার’ রাষ্ট্র ওই চুক্তি করার খাতিরে নিজ আইনের নিয়ন্ত্রণ আলগা করে ফেলে থাকে। যেমন নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক নিয়ন্ত্রণ আইন, পরিবেশবিষয়ক নিয়ন্ত্রণ আইন, ব্যাংকবিষয়ক নিয়ন্ত্রণ আইন অথবা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা বিষয়ক আইন- এগুলোকে পাশ কাটিয়ে ইচ্ছামতো ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুবিধা নেয়া এসব চুক্তির সাধারণ উদ্দেশ্য। আর এই মূল উদ্দেশ্যের অধীনে অন্যান্য উপ-উদ্দেশ্যে যেমন চীনবিরোধী বাণিজ্য চুক্তি জোট অথবা আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে আমাদের মতো রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য চুক্তি (জিএসপি’র মতো) করা হয়ে থাকে।
নতুন ফেনোমেনা : মানবাধিকার
প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে আমেরিকা এমন বাণিজ্য চুক্তি করে যাচ্ছিল, কোনো সমস্যা বা আপত্তি দেখা যায়নি। কিন্তু এবারই প্রথম এসবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলার এক পাল্টা প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। এই প্রথম টিপিপি এবং টিটিআইপি- এ দুই চুক্তির বিরুদ্ধেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে সাবধান করেছেন জাতিসঙ্ঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের (ইউএন-এইচআরসি) হেডকোয়ার্টার জেনেভা থেকে এর র্যাপোটিয়ারেরা বা র্যাপোরচারেরা। ফরাসি শব্দ ‘র্যাপোটিয়ার’-এর তুল্য ইংরেজি শব্দ ইনভেস্টিগেটর। অর্থাৎ নিরপেক্ষ তদন্ত অনুসন্ধান করে রিপোর্টদাতা। বিভিন্ন দেশের হিউম্যান রাইটস লঙ্ঘনের ঘটনায় অথবা কোনো সদস্য রাষ্ট্রের হিউম্যান রাইটসের দশা পরিস্থিতি বিষয়ক ঘটনাকে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ ও রিপোর্ট করার জন্য জাতিসঙ্ঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের নিয়োগ দেয়া বিভিন্ন বিষয়ের র্যাপোটিয়ার আছেন। কাউন্সিল থেকে এরা এক ধরনের নিয়োগ নেন বটে, কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক নেন না বা পান না। তবে কোনো ব্যক্তি সহকারী বা বস্তুগত লজিস্টিক সাপোর্ট লাগলে তা কাউন্সিল থেকে নিতে পারেন। সে জন্য এদের নিরপেক্ষ র্যাপোটিয়ার বলা হয়। যেকোনো ইস্যুতে এই র্যাপোটিয়ারদের সরজমিনে সংগ্রহ ও পেশ করা রিপোর্টকে মাঠের ফ্যাক্টস বা ভিত্তি মেনে এর ওপর এরপর সদস্যদের আলোচনা শুরু হয় ও সিদ্ধান্ত রেজুলেশনে পৌছানো হয়। এমন কাজ করে সুনাম কামিয়েছেন, এমন নামকরা ১০ জন র্যাপোটিয়ার উদ্বেগ জানিয়ে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন গত ২০১৫ সালের জুন মাসে। ওই বিবৃতিতে সবার আগে তারা স্পষ্ট করে নিয়েছেন যে, তারা যেকোনো বাণিজ্য চুক্তির প্রয়োজন বোঝেন। ফলে তাদের ইস্যু কোন বাণিজ্য চুক্তির বিরোধীতা করা নয় বরং ওই চুক্তি করতে গিয়ে করা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
এ ছাড়া শুধু উদ্বেগ জানানো নয়, ওই বিবৃতিতে সবশেষে কী করা উচিত সে বিষয়েও কিছু পরামর্শ তাঁরা দিয়েছেন। যেমন- কাজ গোপনে না করে কাজে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা আনা, জনপ্রতিনিধিদের সামনে সব কিছু উন্মুক্ত রাখা, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে-পরে মানবাধিকারের ওপর এর প্রভাব কী হতে পারে তা বিবেচনায় নেয়া, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা কী থাকছে সেদিকে নজর দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া ইত্যাদি।
ওই বিবৃতির প্রায় ছয় মাস পরে গত ১২ জানুয়ারি ২০১৬ আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় হিউম্যান রাইটসবিষয়ক দাতব্য সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বা সংক্ষেপে এইচআরডব্লিউ একই ইস্যুতে নিজেরই তৈরি আটটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ছলে টিপিপি’র কার্যক্রমকে প্রশ্ন করেছে। টিপিপি চুক্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো জানিয়ে নিজের অবস্থান প্রকাশ করেছে সেখানে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যদিও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং আমেরিকান কোনো সরকারি দান তারা গ্রহণ করে না বলে জানিয়েছে। এছাড়া এরা নিজ সরকারি নীতি অনুসরণ করে কাজ করে সিদ্ধান্ত নেয় এমন নয়। যেমন- মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নিপীড়ন ইস্যুতে এইচআরডব্লিউ শক্ত সমালোচনামূলক অবস্থান নিয়েছিল। বিশেষত যেখানে ওবামা প্রশাসনসহ সারা পশ্চিম জগৎ ব্যবসার লকলকে লোভে এই ইস্যুতে চুপচাপ ছিল। পরবর্তীকালে ওবামা দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জেতার পরের সপ্তাহে প্রথম মিয়ানমার সফরে এসে মানবাধিকার বিষয়ে নিজ সরকারের অবস্থানের বদল ঘটিয়েছিলেন। তবে স্বভাবতই এই সংগঠন প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাতের ভাষায় না বললেও স্পষ্ট আপত্তির ভাষায় টিপিপি ইস্যুতে নিজের আলাদা অবস্থান ব্যক্ত করেছে। ফলে সুযোগ রেখেছে যেন চাইলে ওবামা সরকার নীতি বদলিয়ে নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারে। যেমন- দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরের শুরুতে এইচআরডব্লিউ বলছে, আমেরিকার ফ্রি টেড অ্যাগ্রিমেন্ট ভালো না মন্দ- এ বিষয়ে তাদের কোনো অবস্থান নেই। কিন্তু টিপিপি চুক্তিতে কিছু মারাত্মক হিউম্যান রাইটস লঙ্ঘনের ইস্যু উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বলে তারা মনে করে। বিশেষত “শ্রমিকের অধিকার, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, সুস্বাস্থ্য থাকার অধিকার, মুক্তভাবে নিজেকে প্রকাশ এবং ইন্টারনেটে প্রাইভেসির অধিকার” বিষয়ে। তবে তাদের অবস্থান হল, টিপিপিতে হিউম্যান রাইটস বিষয়ক যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে, তা সংশোধনযোগ্য। এছাড়া একটা হিউম্যান রাইটস ফ্রেন্ডলি টিপিপি কেমন হতে পারে এর একটা ধারণাও তারা রেখেছে। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার স্বভাবতই। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট রাজনীতির শক্তিতে সংগঠিত না করে কেবল মানবাধিকার সংগঠনের মুখ চেয়ে থাকা পরিস্থিতি তৈরি করে রাখলে তা আমেরিকার জন্য এমন আরো টিপিপি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া সহজ হয়ে যেতে পারে।
goutamdas1958@hotmail.com
[লেখাটা এর আগে দৈনিক আলোকিত বাংলাদশ পত্রিকা ২৪ জানুয়ারি ২০১৬ প্রিন্টেড সংখ্যায় এবং দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকা ২৫ জানুয়ারি ২০১৬ প্রিন্টেড সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। তা এখানে আরও সংযোজন ও এডিট করে ফাইনাল ভার্সান আকারে আবার ছাপা হল। ]