চীন-ভারতের কোর সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বীর নয়, সহযোগীর
গৌতম দাস
১৪ মার্চ ২০১৬, সোমবার
http://wp.me/p1sCvy-RW
শিরোনাম দেখে ভুল পড়ছি মনে হতে পারে কিন্তু আসলে ঠিকই পড়েছেন। ভারত ও চীনের সম্পর্ক কেমন, এ প্রসঙ্গে কোনো এভারেজ বা আম ভারতীয়কে বলতে বললে তার মুখ থেকে খুবই তিক্ত বক্তব্য শুনতে পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বক্তব্য এমন তিক্ত-বিষাক্ত হওয়ার পেছনে দায়ী ভারতের উপস্থিত মিডিয়ার ব্রিফিং। ভারতের সামরিক ও ইন্টেলিজেন্স প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া ব্রিফিং সম্ভবত এর কারণ আর তা এমন শক্তই। ভারতের সামরিক ও ইন্টেলিজেন্স এর ব্যাপারে ভারতের মিডিয়া খুবই অনুগত, যেটাকে একেবারেই বাছবিচারহীন আনক্রিটিক্যাল বলে অনেকের ধারণা। এটা ঠিক-বেঠিকের প্রশ্ন নয়, ফ্যাক্টস। এই সূত্রে অনুমান করা যায়, ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের কৌশলগত অবস্থান সম্মত মিডিয়া ব্রিফিং সম্ভবত এর কারণ। ফলে আমরা সর্বক্ষণ শুনতে পাই ভারতের প্রায় সব মিডিয়াই প্রপাগান্ডা করে বলছে- “চীন তাদের চার দিক থেকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করছে”। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কি একেবারে ঠিক এ রকমই? সেটা এবার পরীক্ষা করে দেখব।
কয়েক মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর অবস্থা ভয় পাওয়া পথিকের মত; যে চলতি পথে নিজেকেই সাহস যোগানোর জন্য উঁচুস্বরে গান ধরে থাকে। কারণ এভাবে গান ধরলে নিজেকেই দুজন মনে হয়। “চীন আমাদের ভারতকে এভাবে অথবা সেভাবে ঘিরে ফেলছে” এই নিয়মিত প্রচারের সাথে এই পত্রিকা সম্প্রতি এবার আরো খবর ছড়াচ্ছে- ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন বা মিয়ানমার- এই রাষ্ট্রগুলো ভারতের সাথে নৌ-সামরিক নানান তৎপরতা বা চুক্তিতে যুক্ত হচ্ছে ইত্যাদি। খবরগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ জনগোষ্ঠীকে আস্থার প্রপাগান্ডায় নেয়ার মতো করে সাজানো, সন্দেহ নেই। তবে উপরে যে দেশগুলোর নাম নিলাম, এদের মধ্যে কমন দিকটি হল, এরা বেশির ভাগই চীনের পড়শি রাষ্ট্র। সমুদ্রপথে চীনে প্রবেশের এবং চীন থেকে সমুদ্রপথে বাইরের দুনিয়ায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে চীনের একমাত্র প্রবেশদ্বার দক্ষিণ চীন সাগর। প্রবেশমুখের চারপাশের প্রায় সব পড়শি-রাষ্ট্রের সাথে চীনের সমুদ্রসীমা বিতর্ক বিরোধ শুরু হয়ে আছে, চলছে দু-তিন বছর ধরে। এর ফলে চীনের পড়শি-রাষ্ট্রগুলোর ক্ষোভ-অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নেতা হয়ে সার্ভিস দিতে চায়, এমন ধারণা হাজির করলে অর্থনীতিতে উঠতি চীনের বিপরীতে পড়তি আমেরিকার এ অঞ্চলে কৌশলগত দাম-গুরুত্ব বাড়বে বলে মনে করে সে। ফলে দক্ষিণ চীন সাগরে এটা একটা টেনশন জাগানোর কারণ। এছাড়াও এমন টেনশন জেগে ওঠার পেছনের আরও কারণ এই সাগরে এমন সাতটি দ্বীপ আছে, যেগুলো জেগে ওঠার পথে বা উঠেই গেছে; চীন যার সবগুলোই নিজের বলে দাবি করে আসছে এবং ইতোমধ্যেই সব দ্বীপে কম-বেশি স্থাপনা গেড়েছে। এ ছাড়াও এই সাগরের নিচে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। অপর দিকে আবার জ্বালানি তেলের উৎস মধ্যপ্রাচ্য এলাকা আরব সাগর থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত চীনে প্রবেশের এই অঞ্চল প্রসঙ্গে পরিসংখ্যান বলছে, এখানে বছরে সব মিলিয়ে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বা পণ্য জাহাজের চলাচল হয়ে থাকে। তাই চীন চায় এই এলাকাকে নিজের মুক্তাঞ্চল হিসেবে দেখতে। চীনের চোখে ভারত বা আমেরিকা- এদের নিজ রাষ্ট্রীয় সীমানার আশপাশের অঞ্চল এটা নয়। ফলে এই অঞ্চল এ দুই রাষ্ট্রের সরাসরি নিজেদের প্রত্যক্ষ স্বার্থসংশ্লিষ্ট, এমন নয়। তবুও আমেরিকা ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ নামের এক তত্ত্ব আউড়িয়ে এ এলাকার সবখানেই নিজের অবাধ চলাচলের অধিকার ফলাতে চায়। এর বিপরীতে চীনের স্পষ্ট আপত্তি ও অবস্থান হল, নিজ সমুদ্রসীমানার ১২ মাইলের মধ্যে কেউ প্রবেশ করলে বা উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করলে তাকে চীন সামরিকভাবে প্রতিরোধ করবেই। কারণ চীনের যুক্তি, এই ১২ মাইল নিজের ‘একান্ত অঞ্চল’ বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এ ছাড়া চীনের ব্যাখ্যায় এটা খুবই সেনসেটিভ এলাকা এ জন্য যে, নিজ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে এখানে ফ্রিডম অব নেভিগেশন যুক্তিতে প্রবেশ করে আমেরিকার ফ্রিডম টেস্ট করতে চাওয়া খুবই বিপজ্জনক। কারণ, আমেরিকা ভুলচুকে ও অনিচ্ছায় ১২ মাইলের ভেতরে প্রবেশ করে ফেললে প্রতিক্রিয়ায় চীনের আমেরিকাকে আক্রমণ করে বসতে হতে পারে। কারণ, এখানে স্থাপিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অনেক ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন আর তুলনায় দূরত্ব মাত্র ১২ মাইল।
ওইদিকে আমেরিকা শুধু চীনের পড়শিদের নেতা হতে চায় তাই নয়, সে চায় ভারতও এ কাজে একইভাবে আমেরিকার পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিক।
কথা শুরু করেছিলাম দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে ভারত-চীন সম্পর্কের চেয়েও পেছনের আরো বড় ক্যানভাস ভারত-চীন সম্পর্কের মধ্যকার সামরিক টেনশন কেমন, তা নিয়ে। এ কথা দুনিয়ার কেউ অস্বীকার করবেন না যে, এমন সামরিক টেনশনের কোনোই বাস্তবতা নেই, তা নয়। ভারত ও চীনের মধ্যে যদি কখনো কোনো অছিলায় সামরিক সঙ্ঘাত লেগেই যায়, তবে সম্ভাব্য সেই বাস্তবতা হবে ভারত-চীনের সীমান্তে অচিহ্নিত থেকে যাওয়া বেশ কিছু অংশের কারণে। যদিও ভারত-চীন দু’পক্ষই বিষয়টি নিয়ে কোনো টেনশন যেন না বাড়ে, সে লক্ষ্যে যৌথ মাপামাপি আর ডায়লগের ভেতর দিয়ে তা মিটিয়ে ফেলতে চায়। এমন যৌথ ইচ্ছা প্রকাশ করে বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলে ২০১৩ সালের অক্টোবরে ইতোমধ্যেই একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং দু’পক্ষের নির্বাহী প্রধানের ঘোষিত স্থায়ী প্রতিনিধি পর্যায়ে সরাসরি এ নিয়ে নিয়মিত বৈঠক আয়োজনের কাজ চলছে। এ ছাড়াও কখনো আকস্মিক কোনো ঘটনায় এবং অনিচ্ছায়ও কোনো সামরিক টেনশন যেন ছড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষে মাঠপর্যায়ে হটলাইন টেলিফোন যোগাযোগ সুবিধা চালু করা হয়েছে ওই চুক্তির ফলে। স্বভাবতই এসবের অর্থ উভয় পক্ষ এ ধরনের এক সীমান্ত সমঝোতা চুক্তি করতে আগ্রহবোধ করেছিল আগে থেকেই। এই আগ্রহবোধের তাগিদ অনুভবকে কেবল একটা দিক থেকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব; সেটা হল উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিরাট সম্ভাবনা আছে, যেটা দু’পক্ষই স্বীকার করে ও কাজে লাগাতে চায়। বিগত ১২ বছরে বিশাল পণ্য লেনদেন বিনিময়, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে, যার মোট পরিমাণ এখন ৭০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
আগ্রহবোধ বিষয়টিকে আরেকটু বিস্তার করে বলা যায়। যেমন প্রথমত, দু’টি রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে সামরিক-অসামরিক কোনো টেনশন থাকলেই তা আমাদের মনে পুরনো ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় ছেয়ে থাকা আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ঠাণ্ডাযুদ্ধ’ বা ‘কোল্ডওয়ার’ দিয়ে তা বুঝতে হবে এই অভ্যাস একেবারে বাদ দিতে হবে। বরং পরামর্শ থাকবে, ঠাণ্ডাযুদ্ধ দিয়ে কোন কিছুকে বুঝার মানসিকতা আমরা জীবনেও চিরতরে যেন ত্যাগ করি, এদিয়ে আর যেন কোনো কিছুকে বুঝার চেষ্টা না করি। কারণ, ইতোমধ্যেই এমন এক বড় ফারাক এখানে ঘটে গেছে, যাতে কোল্ডওয়ার ধরনের শর্ত-পরিস্থিতি দুনিয়ায় আর কখনো কোথাও ফিরে আসবে না। বরং আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করতে পারি যে, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো একই কমন গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডারের মধ্যকার সম্পর্কিত দুই অর্থনীতি ছিল না। আরো সোজা ভাষায় বললে সে সময়ে এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পারস্পরিক পণ্য বিনিময় বাণিজ্য লেনদেন সম্পর্কই ছিল না, বরং প্যারালাল এমন দুটো জোটের অর্থনীতি হয়ে তারা তখন চালু ছিল, যাদের মধ্যে আবার কোনো বিনিময় বাণিজ্য লেনদেন নাই। ফলে পরস্পরের মধ্যে সহজেই এমন শত্রুতা কল্পনা করা খুবই সম্ভব ছিল যে, পরস্পর পরস্পরকে অবলীলায় দুনিয়া থেকে নির্মূল করার কথা ভাবতে পারে এবং তাতে একজন অপরজনকে নাই করে দিলেও পারস্পরিক কোনো পণ্য বিনিময় বাণিজ্য লেনদেন সম্পর্ক নেই বলে এতে বেঁচে থাকা অপর রাষ্ট্রপক্ষের অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রস্বার্থ বিরোধে বিরোধীকে নির্মূল করার মতো যেকোনো চরম পর্যায়ে নেয়ার বাস্তবতা ও সুযোগ তখনো ছিল। কিছু আজ সারা দুনিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রের সাথে যতই স্বার্থবিরোধ থাক, তারা আবার সবাই একই গ্লোবাল অর্থনীতির অংশ হয়ে পরস্পরের সাথে পণ্য বিনিময় বাণিজ্য লেনদেন সম্পর্কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত সম্পর্কিত হয়ে আছে। এটাই সবচেয়ে প্রভাবশালী বাস্তবতা। ফলে এখানে রাষ্ট্রস্বার্থ বিরোধ প্রবল আছে এবং তা থাকলেও কিন্তু সে বিরোধকে কোনো চরম দিকে নেয়ার সুযোগ নেই। ফলে বিরোধকে বরং নির্মূল বা চরমে না নিয়ে, এই পথ ছাড়া অন্য আর যেকোনো পথ অবলম্বন করে বিরোধ লড়াইয়ের মীমাংসা খুঁজে নেয়াই মঙ্গল। কারণ, এখন অন্যের নির্মূল মানে নিজেরও বিরাট ক্ষতি। অতএব, একদম সারকথায় ভারতের মিডিয়া যতই তারস্বরে চিৎকার করুক যে ‘চীন ভারতকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলল’ তা সত্ত্বেও চীন-ভারতের মধ্যে এমন সীমান্ত সমঝোতা চুক্তির পক্ষে উভয় রাষ্ট্র আগ্রহ দেখাতে পারা সম্ভব। এবং সেটাই হয়েছে।
কিন্তু ২০১৩ সালের শেষে ওই চুক্তির পরও এখন “চীন ভারতকে মুক্তামালার মত চার দিক থেকে ঘিরে ফেলছে” ভারতের এই প্রপাগান্ডায় কোনো ভাটা পড়েনি। এটাকে ভারতের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের মিডিয়া প্রসঙ্গে কৌশলগত অবস্থান বলে মনে করা যেতে পারে। এছাড়াও এর পেছনে আর দু’টি কারণকে চিহ্নিত করা যেতে পারে: এক. সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে তুলনায় চীনের থেকে ভারত পিছিয়ে আছে। অস্ত্রের ও বাহিনীর সক্ষমতা বিষয়টি যেকোনো রাষ্ট্রের অর্থনীতির সক্ষমতার বা মুরোদের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কারণ, সামরিক ব্যয় জোগানোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকলে তবেই তা ওই রাষ্ট্রের অস্ত্র ও বাহিনী মজুদের সক্ষমতা হিসেবে হাজির হতে পারে। এই বিচারে ভারত চীনের চেয়ে পিছিয়ে আছে; ভারত তুলনায় ছোট অর্থনীতির বলে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও যেটুকু ব্যয় জোগানোর সামর্থ্য ভারতের হাতে আছে, তার সমতুল্য অস্ত্রশস্ত্র কেনা বা উৎপাদন করতে পারার সক্ষমতার দেখানোর ক্ষেত্রে ‘ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক’ বেশ কিছু ঘাটতি ভারতের আছে। এসব সমস্যা ঢেলে সাজানোর জন্য সময়ে ভারতের মিডিয়ায় তা খোলাখুলি আলোচনাও হতে দেখা গেছে। এসব সমস্যা ভারত দ্রুত আপ্রাণ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ফলে এই অবস্থায় প্রপাগান্ডা দিয়ে অভ্যন্তরীণ জনগোষ্ঠীকে ধরে রাখার উদ্যোগ এটা হতে পারে। আর পয়েন্ট দুই. ১৯৬২ সালে নেহরু আমলে চীন-ভারত এক প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হয়েছিল, যে যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় হার ভারতের কাছে ট্রমার মতো এখনো মানসিক বিষয় হয়ে আছে বলে মনে করা হয়। যেটা একালে সামরিক সক্ষমতা এখন অর্জনে থাকলে বা তৈরি হলেও নিজের ওপর আস্থা বিষয়ক এক খচখচি থেকেই যায় ধরনের। এ ছাড়া সবার উপরে, মিডিয়ার সব কিছুকেই উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দেখার এক প্রপাগান্ডা তো আছেই। যার পরিণতিতে সব আলোচনায় হয়ে যায় যেন দুই ছাপোষা কেরানির রাস্তার ধারে বসে টংয়ের চা দোকানের আলাপ; যারা জাহাজের খবরাখবর নিয়েও আলাপ করছে, রাজা-উজির মারছে এসব। আনন্দবাজার পত্রিকার খবর উপস্থাপনে এই ভাষা ও ইঙ্গিত দিয়ে লেখা হয়। সম্ভবত তারা মনে করে, এটাই সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ভাষা, তরল করে লেখার ভাষা। নিজের পক্ষে ন্যায্যতা টানার উপায় হিসেবে তারা হয়তো এমন বলবে, কিন্তু তবু এটা অন্যায্য যুক্তি তাই তা অপ্রতিষ্ঠিতই থেকে যাবে।
আমেরিকা চায় ভারতও আমেরিকার মতো ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ এর অধিকার টেস্ট করতে আমেরিকার সাথে যৌথভাবে এ অঞ্চলে টহল দিতে এগিয়ে আসুক। এ কাজে আমেরিকা ভারতকে উসকানিমূলক প্রস্তাব দিয়েছিল। সম্প্রতি গত ১০ ফেব্রুয়ারি বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক এক্সক্লুসিভ রিপোর্টে এ কথাই ছেপেছে। রয়টার্স বলছে, ‘আমেরিকা চায় তার আঞ্চলিক বন্ধুরা সবাই চীনের বিরুদ্ধে এমন জোট অবস্থান নিক। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।’ ভারতীয় নেভাল মুখপাত্র রয়টার্সকে এ প্রসঙ্গে জানিয়েছে, ‘ভারতের নীতি হলো অন্য রাষ্ট্রের সাথে একই ফ্ল্যাগ-কমান্ডের অধীনে কোনো যৌথ টহলে ভারতের অংশ না নেয়া। ভারত এখন পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘ ছাড়া অন্য কোথাও কোনো ভিনরাষ্ট্রের সাথে যৌথ টহলে অংশ নেয়নি; না নেয়ার ভারতের এই নীতিতেই সে এখনো অটল আছে।’ এখানে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার মনের গোপন খায়েশ প্রকাশিত হয়েছে- এটাই চীনের বক্তব্য। এ নিয়ে চীনের সরকারি নীতিনির্ধারণী বিষয়ক পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ বেশ কয়েকটা লেখা ছেপেছে। ভারত-আমেরিকা-চীন এই ট্রয়কার পারস্পরিক সম্পর্কের দিক নিয়ে আরো কিছু বক্তব্যও সেখানে হাজির করেছে। চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে নামাতে রাজি করানোর আমেরিকান খায়েশ মার খাওয়াতেই চীনের মুখে এই বোল ফুটেছে এমন মনে করা অসঙ্গত হবে না। গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, ‘নিজের অর্থনীতিক বিকাশ-উন্নতির স্বার্থ এবং চীনের সাথে মিলে ব্রিক ব্যাংক উদ্যোগে ভারতের স্বার্থের দিক থেকে ভাবলে ভারতের কাছে চীন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার সাথে যৌথ টহলের আমেরিকান প্রস্তাবের পাল্লায় পড়ার বিলাসিতা করতে গিয়ে ভারত চীনা সহযোগিতা হারাতে পারে না।’ কথা সত্যি। ভারতের দিক থেকে কথাটির মূল বিষয়- ভারতের কাছে প্রায়রিটি কোনটি। ভারত সঠিকভাবেই ধরেছে, সময়টা এখন পুরনো গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার ভেঙে আমেরিকার বদলে চীনা নেতৃত্বের সাথে মিলে নতুন এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার সাজিয়ে তোলা। দুনিয়াকে নতুন করে নেতৃত্ব দেয়া। সাজিয়ে ওঠার এই কাজে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ স্পষ্টতই নতুন অর্ডার, নতুন নেতৃত্বের সাথেই। ফলে পুরনো অর্ডারে নয়, ভারতের ভবিষ্যৎ চীনের সাথে নতুন অর্থনৈতিক অর্ডার গড়ার কাজেই। এ প্রসঙ্গে আমার আগের লেখায় অনেক সময় এই অবস্থানই ব্যক্ত করেছি বটে বিষয়টি নিয়ে এর আগে কখনোই ভারত, আমেরিকা বা চীন কেউ কখনো স্পষ্ট করে মুখফুটে কিছু বলেনি। ভারতও স্পষ্ট না করে বরং আমেরিকাকে এক মিথ্যা ভানের মধ্যে রেখে ফায়দা নেবার চেষ্টা করে গেছে। যেমন আমেরিকান নেতৃত্বের বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্টের ব্যাংক গড়তে গিয়ে এর গঠনকাঠামো রচনা করার সময় চীনের পরে দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার ভারতের হওয়ার ক্ষেত্রে চীনের সম্মতি পেতে ভারতের কোনো অসুবিধাই হয়নি। এবং সম্ভবত সেজন্য এই প্রথম চীনের দিক থেকে গ্লোবাল টাইমস ব্যাপারটিকে পরিষ্কার বাক্য লিখে বলেছে, ‘… ভারত চীনের সহযোগিতা-সম্পর্ক, সমর্থন হারানোর কথা ভাবতেই পারে না।’ বিষয়টির গুরুত্ব লক্ষ করে ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাও ১ মার্চ সংখ্যায় চীনের গ্লোবাল টাইমসকে উদ্ধৃত করে এক রিপোর্ট ছেপেছে। এর প্রথম বাক্য হলো, ‘বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার সাথে যৌথ টহলে অংশ নিয়ে চীনের সমর্থন হারানো ভারতের পোষাবে না।’
[লেখাটা এর আগে ৭ মার্চ ২০১৬ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে এখন আপডেট করে ছাপান হল। ]
goutamdas1958@hotmail.com