ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ : ভাঙন মানেই ভাঙাগড়া
গৌতম দাস
২৯ জুন ২০১৬, বুধবার
আজ প্রথম পর্বঃ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র বৃটেন বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে এক গণভোটে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত এখনও আভ্যন্তরীণ। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ কে এখনও জানায় নাই। ইতোমধ্যে গ্লোবাল অর্থনীতিতে এর উল্টাপাকল্টা প্রভাব পড়া শুরু করেছে। বৃটেনের গণভোটের এই সিদ্ধান্তে গ্লোবাল প্রভাবশালী শেয়ার বাজারগুলোতে টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়রছে। এই প্রেক্ষিত মাথায় রেখে বর্তমান লেখাটা শুরু করেছিলাম গত ২৩ জুন গণভোট অনুষ্ঠানের আগে। চলতি পর্ব সেটাই। এছাড়া গণভোটের পরেও এলেখা শেষ অংশ লেখা হয়েছে যা পরবর্তিতে দ্বিতীয় বা শেষ পর্ব আকারে এখানে প্রকাশিত হবে।
ব্রেক্সিট, একটা নতুন শব্দ। নতুন পরিস্থিতিতে পড়ে জন্ম নেয়া একটা নতুন শব্দ এটা। দু’টি শব্দ – ব্রিটেন আর এক্সিট, এদুইয়ের সংমিশ্রণ করা হয়েছে। পুরনো শব্দ দু’টি মিলিয়ে পয়দা করা হয়ে হয়েছে নতুন শব্দ ব্রেক্সিট। কেন? বিগত ১৯৭৩ সাল থেকে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য। ব্রিটেন ইইউ ছেড়ে যাবে কি না তা জানতে গণভোট ডাকা হয়েছে। ব্রিটেন ইউরোপের পুরনো ও বড় মাতবর । কলোনি ইতিহাস সাথে ধরে নিলে দেশটা কলোনি সাম্রাজ্যকালের মাস্টার রাষ্ট্রগুলোরও শিরোমণি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বৃটিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগীজ বা স্পানিশ ইত্যাদি সবার কলোনি সাম্রাজ্যের মাস্টারি পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। কিন্তু তা গেলেও এর পরবর্তীকালে আমেরিকার নেতৃত্বের নতুন করে সাজানো দুনিয়াতে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্রিটেন ইউরোপের সবার উপরে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে জায়গা দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আজ যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে আর আলাদা আলাদা না থেকে ক্রমশ ধাপে ধাপে এক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবার পরিকল্পনা সেই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল ১৯৫১ সালে। ইতোমধ্যে ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ প্রায় প্রতিবছর নতুন নতু কমন আইনের অনুমোদনে রাষ্ট্রগুলো এক ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হবার পথে অনেক দূর এগিয়ে যায়। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হলেও এরমধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন রাষ্ট্র হয়ে থাকে – বৃটেন ও বাকি দু’টি ফ্রান্স ও জার্মানি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য দেশগুলো একই কারেন্সি হিসেবে ইউরোকে গ্রহণ করে ১৯৯৯ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে। যদিও ব্রিটেন এর পরও বিশেষ বিবেচনায় তার নিজ মুদ্রা পাউন্ড নিয়েই ইউরো জোনের বাইরে থেকে যায়। ব্রিটেনকে ইইউ’র সদস্য হয়ে থেকেও বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে ইউরোর বাইরে থাকতে জায়গা করে দেয়া হয়েছিল। চলতি মাসেই ২৩ জুন ব্রিটেনে এক গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে নাগরিকেরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে থাকবে না বের হয়ে যাবে এই প্রশ্নে গণভোটে মতামত দেয়। অর্থাৎ গণভোটের ফলাফলে ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় এসেছে বলে ব্রিটেন এখন আর “ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকবে না”। এর প্রাথমিক শর্ত পুরণ হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউকে জানানোর পরে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই আনুষ্ঠানিকতা ও নিগোশিয়েশন শেষ হতে কমপক্ষে দুই বছর লাগবে।
গণভোটের ঘটনাটাকে মনে হতে পারে সাধারণ যেকোনো একটা রাষ্ট্রের গণভোটের ইস্যু। আইনি আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে এটা তাইও। কিন্তু এটা শুধু বৃটেন নয় খোদ গ্লোবাল ইকোনমিতেই ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এক কথায় বললে, এর প্রধান কারণ দুনিয়াতে এখন একটাই অর্থনীতি, পরস্পর পরস্পরের সাথে আষ্টপৃষ্টে জড়িয়ে যাওয়া নির্ভরশীল হয়ে পড়া একক অর্থনীতি। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের অর্থনীতিই সেই একক গ্লোবাল অর্থনীতির একেকটা অংশ মাত্র। যারা পরস্পর পরস্পরের সাথে পণ্য, বিনিয়োগ, বাজার কাঁচামাল ইত্যাদি মাখামাখি একাকার হয়ে শেয়ার করে চলে। পরস্পর বিনিময় লেনদেনে জড়িয়ে আছে, ফলে তাদের সব কিছুই গভীরভাবে আবদ্ধ ও পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ও সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। কথাগুলো গ্লোবাল অর্থনীতি অর্থেও সত্য, এমনকি আবার ইইউ’র সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক অর্থেও সত্যি।
নেদারল্যান্ডের মাসট্রিক্ট শহরে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ১৯৯২-৩ সালের স্বাক্ষরিত চুক্তির ভেতর দিয়ে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ এক রাষ্ট্র জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যে এই জোট বাধা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে ভিন্নভাবে কেবল ইউরোপীয় উৎপাদক কোম্পানিগুলো কিছু পণ্যের কমন বাজার জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশে। বিগত ১৯৫১ সালে জন্ম নেয়া ঐ প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত কমিউনিটি’। পরবর্তীকালে এটা আর কয়েকটি পণ্য থেকে শুধু সব পণ্যই বিক্রির কমন বাজারের জোট নয় – কমন মুদ্রা, কমন শ্রমবাজার ও কমন পণ্যবাজার ইত্যাদি বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রের জন্য এক কমন মার্কেট কায়েম করে ফেলেছিল। এটাই আরো এগিয়ে কমন আদালত, কমন পার্লামেন্ট, বিভিন্ন ইস্যুতে যেমন পরিবেশ বিষয়ে এক কমন নীতি ইত্যাদি শেষ করে এগিয়ে যাচ্ছিল যার লক্ষ্য ছিল কমন এক রাষ্ট্রে পৌঁছানো। এ সব কিছুর মূল তাৎপর্য ছিল নিজেদের বিশাল কমন বাজার। যেকোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্রের কোন পণ্য উৎপাদক কোম্পানী কমন ইউরোপীয় বাজারের আয়তনের কথা চিন্তা করে নিজ উৎপাদন পরিকল্পনা, প্রতিযোগিতা সাজাতে পারে। কমন ইউরোপীয় একজোটের শক্তি হয়ে এবার গ্লোবাল বাজার শেয়ার কতটা নিজের জোটের পক্ষে আনা যায় এজন্য লড়তে পারে। আবার চাকরিজীবী বা শ্রম অবাধে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রের যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো জায়গায় ভ্রমণ করতে ও অবাধে চাকরি নিতে পারে। মূলত এই দিকগুলোর সুবিধার কথা ভেবে সব সদস্য রাষ্ট্রের ভোটাররা এক ইইউ’র পক্ষে থাকার ভোট দিয়ে থেকেছে। অর্থাৎ ইইউ’র পক্ষে থাকলে বিরাট কমন বাজারের সুবিধা পাবে এটা কোম্পানীগুলো যার যার জায়গা থেকেই দেখতে পায়। আর যেকোনো শ্রমজীবী চাকরি খোঁজার বিরাট বাজার পাবে, এই লোভে ইইউ’র পক্ষে থাকে।
এগুলো গেল ইইউ’র অভ্যন্তরীণ দিকের সুবিধা। আবার বাইরের দিক হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের কলোনি মালিকদের কলোনি ক্যাপিটালিজমের রুস্তমির দিন শেষ হয়ে যায়। শুরু হয় আমেরিকান ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগ কোম্পানির ক্যাপিটালিজমের যুগ। এখানে আমেরিকার সাথে তুলনায় ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রই আর প্রতিযোগী হিসেবে হাজির হওয়া দূরে থাক, আমেরিকান অর্থনীতির ধারে-কাছে গোনায় ধরার মতো কেউ ছিল না। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনে বাজার, শ্রম ও মুদ্রার কমন ব্যবস্থা তৈরির পেছনে প্রধান প্রণোদনা ছিল যে এই নতুন উদ্যোগের পরিণতিতে তারা আমেরিকার প্রতিযোগী না হতে পারলেও অন্তত গোনায় ধরার মত অবস্থায় পৌছাবে আর গ্লোবাল পণ্য বাজার শেয়ারের এক উল্লেখযোগ্য অংশ যেন ইইউ’র দখলে আসে। এই লক্ষ্যে তাই তাদের মূল চালিকাশক্তির মৌলিক অবস্থান ছিলঃ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা করে শক্তি ক্ষয় না করা, বরং আপন সক্ষমতাগুলোর সমন্বয় করা। আর সেই মিলিত সম্মিলিত ক্ষমতা দিতে ইইউ’র বাইরের সবার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা করা। এভাবে গ্লোবাল বাজার শেয়ার নিজেদের পক্ষে বাড়ানো। তবে ব্রিটেন শুরু থেকেই অমনোযোগী ছাত্রের মত আচরণ করে গেছে। ১৯৫১ সালের ইইউ উদ্যোগে যোগ দিয়েছে ১৯৭৩ সালে। এভাবে ইইউ’র একই মুদ্রা ইউরো তো ঢুকেই নাই এ’বাদে প্রায় সব কিছুতে ইইউ’র সাথে নানান স্পেশাল খাতিরের শর্তে। ফলে এভাবে এক কথায় বললে বিগত প্রায় ষাট বছরের বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে। আর এখন এক দিনের গণভোটের ফলাফলে ইইউ ভেঙে ব্রিটেন বেরিয়ে চলে যাওয়ার পথে।
গণভোটে ইইউ ত্যাগের পক্ষ যে জিতেছে সেটা মূলত কার ওপর নির্ভর করে? সমাজের কোন অংশ? বলা বাহুল্য সাধারণ ভোটার, চাকরি বা শ্রমজীবী এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ ইইউ ত্যাগের পক্ষে গেলে ব্রিটেনবাসী আমজনতার চাকরি পাওয়ার সুবিধা বাড়বে এই বিবেচনা এটা এখানে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। চাকরির সুবিধা বাড়বে কি না সেটা তো এখন বোঝা যাবে না। বাস্তবে কী দাঁড়াবে তা তো বোঝা যাবে বাস্তবে ইইউ ত্যাগ করে যাওয়া কার্যকর হবার পরে। তাহলে এখন কিসের ওপর নির্ভর করবে? নির্ভর করবে কাজ-চাকরির সুবিধা বাড়বে কি না এ নিয়ে যে পারসেপশন, মানুষের যে ধারণা অনুমান (অনুমান মানে শ্রেফ আন্দাজে অনুমান, যা সত্যি নাও হতে পারে) তার ওপর। এই পারসেপশন তৈরি করছে কী কী ফ্যাক্টর তা খুঁজে দেখতে হবে। তবে তা বলার আগে আমাদের কাছে এ বিষয়ে একটা আগের উদাহরণ হলো গ্রিস। গ্লোবাল মহামন্দা (২০০৮)-এর ধাক্কা দুনিয়ার সবাইকে কম-বেশি সবাইকে সহ্য করতে হলেও তা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় গ্রিসে। বাস্তবতা হলো রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যায় এতে। আর তা থেকে ছুটে বের হতে গ্রিস শেষে ইইউ’র কাছে আগামি ত্রিশ বছর ঋণগ্রস্ত গোলাম হয়ে থাকার পথ বেছে নেয়। আর এর অন্যথা অন্য একটা ছিল – ইইউ থেকে মানে ইউরো মুদ্রার জোন থেকে বেরিয়ে গ্রিসের নিজ পুরানা মুদ্রায় ফিরে যাওয়া, যার সার কথা নতুন মুদ্রার মূল্য ইউরোর প্রায় অর্ধেক বলে ঘোষণা দেয়া বা ডিভ্যালুয়েশন। কিন্তু গ্রীসে এ নিয়ে কয়েকবার গণভোট বা সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পরও দেখা গেল গ্রিসে তবু ইইউ এ থেকে যাওয়ার পক্ষ জয় লাভ করেছে। এর সম্ভাব্য কারণ মনে করা হয় যে, কেবল গ্রিসের বদলে সারা ইউরোপে কাজ খোঁজা ও পাওয়ার সুবিধা পাওয়া যাবে, সাধারণ ভোটার চাকরিজীবী, শ্রমজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই লোভ ত্যাগ করতে পারল না বা কাজ পাওয়ার দিক থেকে ইইউ ত্যাগ সেটা বেশি বড় বিপদের মনে করল।
গ্রিস ইইউ থেকে বের হয়ে আসবে কীনা তা নিয়ে উঠা তখনকার সামাজিক রাজনৈতিক উত্তাপ এখনকার ব্রিটেনের চেয়ে কয়েক গুণে উত্তপ্ত ও সরব ছিল। কিন্তু গ্রীসে বারবার ভোটের ফলাফল দেখা যায়, ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষ জিতেছে। ব্রিটেনের পরিস্থিতিতে জনমত জরিপ অবশ্য আগে থেকেই ইঙ্গিতে বলছিল যে ইইউ-ত্যাগের পক্ষ জয় লাভ করবে। অনেকে যদিও বলছে ইদানীং জরিপের ফল বাস্তবের উল্টা দিচ্ছে। সে কথাও ঠিক।
তবে সাধারণ ভোটার বলতে চাকরিজীবী বা শ্রমজীবীদের সবাইকে এক কাতারে সাধারণ করে দেখিয়েছি বটে, কিন্তু ভোটের প্যাটার্নের দিক থেকে এরা সবাই একমুখী নয়। যেমন বাংলাদেশী অরিজিন, যারা হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত তারা ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছে বলা হচ্ছে। তাদের কাছে সারা ইউরোপ কাজ চাকরি পাওয়ার দিকটি ততটা লোভনীয় নয়। এর চেয়ে ত্যাগ-পক্ষ জিতলে তাহলে তাদের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনকার প্রতিদ্বন্দ্বী রোমানীয়রা ব্রিটেন ছেড়ে বিদায় নেবে। এতেই তারা তাদের ফায়দা দেখে নাকি ভোট দিয়েছে। আপাতত এটাই তাদের মুখ্য লক্ষ্য। ফলে তাদের ধরনের কাজ ব্রিটেনেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বলে তারা আশা করছে।
এত গেল শ্রমের কাজ পাওয়া না পাওয়ার পারসেপশন। কিন্তু ত্যাগ পক্ষের জিতে যাওয়ার অর্থ হবে ভয়াবহ; এর অর্থ হবে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, টাক্স বেড়ে যাওয়া, বাজেট কাটছাঁট করা, হাউজিংয়ের মতো খাত ধসে পড়া এটাই একলা চলতে চাওয়া ব্রিটেনের অর্থ। সাধারণভাবে এর মূল কারণ হল, ইইউতে অন্তর্ভুক্ত থাকা মানে বাজার বড় বলে অনেক খরচই ভাগাভাগি হয়ে কমে যায়, একই অবকাঠামো সবাই শেয়ার করা যায় বলেও খরচ কমে আসে। বহু অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতায় পরস্পরের সক্ষমতা খোয়ানো তাতে এড়িয়ে যাওয়া যায়। তাই ইইউ ত্যাগ করলে এই খরচগুলো এবার চেপে বসবে। এ কারণে ইইউ ত্যাগ না করার পক্ষে ব্যবসায়ী, ট্রেডার ব্যাংকার বা বিনিয়োগকারী ধরণের সবাই সোরগোল তুলেছে। যদিও এটা ঠিক কেবল ব্যবসায়ী, ট্রেডার ব্যাংকার বা বিনিয়োগকারী ধরনের লোকদের স্বার্থের বিষয় নয়। আবার যদিও টপ সাত শিল্পায়িত রাষ্ট্রপ্রধানের ক্লাব জি-৭ বা গ্রুপ সেভেন বহু আগে থেকেই রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে সুপারিশ করে যাচ্ছিল, যাতে গণভোটে ব্রিটেন ইইউ ত্যাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত না নেয়। ইতোমধ্যে আইএমএফও ত্যাগের বিপক্ষে বিরাট বিরাট বিপদের হুঁশিয়ারির কথা বলে গিয়েছিল। এর প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চান লাগার্ডে বলেছিলেন, শেয়ার মার্কেট ক্রাশ করতে পারে। ইতোমধ্যে তা হওয়ার আলামত শুরু হয়ে গেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, অর্থনৈতিক মহামন্দা চেপে বসতে পারে। ইতোমধ্যে চীনের শেয়ারবাজার শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। বড় কারণ ব্রিটেন হল, চীনা ইউয়ান মুদ্রা বিনিময়ের বাজার, ইউয়ান ভাঙ্গিয়ে অন্য গ্লোবাল মুদ্রায় নিয়ে যাওয়ার মূল মার্কেট। ব্যাংকার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জর্মানির দুটো ব্যাংক, যারা ব্রিটেনে ব্যবসা করে এরাও প্রায় একই রকম বিপদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে নিজের অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি প্যারিস সফরে গেলে প্যারিসের প্রধানমন্ত্রীও তাকে ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে থাকতে বলেছিলেন। ত্যাগ-পক্ষ জিতলে ফ্রান্সে আশ্রয় নেয়া রিফিউজিরা ব্রিটেনে চলে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে, সীমান্তে ভিড় করতে পারে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তবে এগুলো পড়ার সময় মনে রাখতে হবে এসব মন্তব্যগুলো তখন কেবল ব্রিটেনের ক্ষতির কথা ভেবে বলা হয় নাই। কারণ ব্রিটেন বের হয়ে গেলে ইইউও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা বিখ্যাত পত্রিকা লল্ডন ইকোনমিস্টের অবস্থান। ফলে চেইন রিয়াকশনে সারা গ্লোবাল ইকোনমিতে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এসব ভেবে এই হুঁশিয়ারি।
এবার শেষ করব, আরেক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার কথা বলে। আমেরিকার একটি পত্রিকাটির নাম ‘ফাইনান্সিয়াল সেন্স’। নাম শুনে কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন অনেকে যে, এটা ওয়াল স্ট্রিট বা বিশাল বিনিয়োগ পুঁজি বা পুঁজিবাজার কোম্পানির আড়ত মোকাম আছে ওয়াল স্ট্রিট নামে ঐ জগতের পত্রিকা। এই আর্টিকেলের লেখক ড্যানিয়েল পার্ক পুঁজিবাজারের বিশেষজ্ঞ পরামর্শক, তাদেরই মন্তব্যের পত্রিকা এটা। ঐ রিপোর্টের শিরোনাম হল, ‘ব্রেক্সিট গণভোট তো শুরু কেবল’। কিন্তু কিসের শুরু? কিসের কথা বলছেন তিনি? তার কথাগুলো সার করে এখানে বলব।
তিনি বলছেন মূল সমস্যা হলো, “একবার যদি মানুষের হাতের সঞ্চয় ফুরিয়ে যায়, আয় বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় আর সেই সাথে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার স্থবির পালা হয়ে চলাচলহীন জমে ওঠে ফলে যা আবার ধার দিবার জন্য উদ্গ্রীব – খুবই নিচু শূন্যের কাছাকাছি অথবা শূন্য সুদে ধার দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে, কিন্তু বিতরণ করতে পারছে না কারণ বাজারে ধার গ্রহণের লোক নেই, ঋণ গ্রহিতা ক্রেতা নাই, ক্রেতার বাজার নেই বা ক্রেতারা বাজারে নাই”। এবার তিনি এক বিজ্ঞাপন সাথে এনেছেন তার কথাটা প্রমাণ করার জন্য।নিচে বিজ্ঞাপনটা কপি করে দেয়া হল। DODGE – এটা আমেরিকান এক গাড়ী প্রস্তুতকারক কোম্পানীর নাম।
তিনি বলছেন, আজকের গাড়ি বিক্রির বাজারে ঠিক এই বাস্তবতাই আমরা দেখছি। ডজ গাড়ি বিক্রির এক বিজ্ঞাপন দেখিয়ে তিনি বলছেন, “এরা শূন্য সুদে তিন, পাঁচ বা সাত বছরের (৮৪ মাস) জন্য ঋণ দিতে চাচ্ছে। এর উপর আবার প্রথম ৯০ দিন কোনো কিস্তি দিতে হবে না বলছে। এছাড়া পরবর্তিতে নতুন নতুন মডেলের গাড়িতে আপগ্রেড করে নেয়ার সুযোগের অফার দিচ্ছে”। ‘ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এমন যে, আমার ক্রেতা খুবই কম অথবা নেই। তাই আমি আমার সম্ভাব্য ক্রেতার হাতে অর্থ তুলে দিয়ে হলেও আমার ব্যবসার সার্কুলেশন চক্র চালু রাখতে চাচ্ছি। দেনার ওপর দেনা বাড়িয়ে হলেও টিকে থাকতে চাচ্ছি। ঋণ-গ্রহীতার বাজারের এমনই দুরবস্থায় পৌঁছেছে।” তাহলে কিসে তিনি এ থেকে সমাধান দেখছেন?
তিনি বলছেন রেডি হওয়ার জন্য। কিসের জন্য রেডি? তিন দশক ধরে যে দম ধরা অবস্থা চলছে এর ভেঙেচুরে পড়া বা ছেদ সমাপ্তি দরকার, তিনি চান। সব দেউলিয়া হয়ে ভেঙ্গে পড়ুক, এরপর পুনর্গঠন করে নিবার সুযোগ আসবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আসুক – ইত্যাদি সব এগুলো দেখার জন্য তৈরি হতে হবে। দুনিয়া এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এর পরিশুদ্ধতা ( খ্রিষ্ট ধর্মীয় এক শব্দ ও ধারণা -‘ক্যাথরেসিস’ ব্যবহার করেছেন তিনি) দরকার। এ জন্য প্রবল উদ্যমী একটা ‘সৃষ্টিশীল ধবংসের’ (ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন) কথা তিনি প্রস্তাব করেছেন, যা পরিশেষ আমাদের বাসাবাড়িগুলোতে বসবাসকারিদের হাতে সঞ্চয়ের ঢল নামাবে। এটা ঘটার আগে ‘ব্রেক্সিট মেক্সিট বহু কিছু বিপর্যয় আমরা দেখব। এভাবে আমরা বহু ভাঙন আর পুনর্গঠন দেখতে পাবো, কিন্তু তাতে আমরা যেন আঁতকে না উঠি।’
[আগামিকাল দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত হবে।]