যখন ভয়ে মানুষ যেচে সত্য কথা বলে
গৌতম দাস
১৪ জুলাই ২০১৬, বৃহস্পতিবার
http://wp.me/p1sCvy-1uG
গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান কাফের ঘটনা দেশি-বিদেশি সকলকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। সিএনএন, বিবিসি আর আল-জাজিরা এই তিন আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল পুরা দশ ঘন্টা জুড়ে সমানে কভার করাতে, এছাড়া সময়ে লাইভ ব্রডকাস্ট করাতে সারা দুনিয়ায় খবরটা এত ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এতদিন যে যা নিয়ম-নীতি মেনে অথবা কোন কিছুই না মেনে বেপরোয়াভাবে পরিচালিত হচ্ছিল এই ঘটনা এবার এমন সবাইকে অভিমুখ বদলাতে, বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। এর মূল কারণ সম্ভবত এটা আলকায়েদা বা আইএস ধরণের ততপরতায় ভারতীয় উপমহাদেশের কোন দেশের উপর প্রথম হামলার ঘটনা। যা এর আগে দেখা যায় নাই। ভারতীয় মিডিয়া এই হামলার ঘটনাকে গত ২০০৮ সালের তাদের বোম্বাই হামলার সাথে বার বার মিলিয়ে দেখাতে চেয়েছে। প্যারালাল টানার চেষ্টাও করছিল। ভারতের মিডিয়ার এই অক্ষম প্রচেষ্টা ২০০১ সালের ৯/১১ এ টুইন টাওয়ারে হামলার সময় থেকে করে আসছে। অথচ বোম্বাই হামলা – হামলার ঘটনা হিসাবে অনেক ঘটনার সাথে মিললেও আমাদের মনে রাখতে হবে ভারতের ক্ষেত্রে এই ধরণের ঘটনাগুলোর উৎস কাশ্মীর কেন্দ্রিক যা কোন আন্তর্জাতিক ঘটনা না, বড় জোর হয়ত তা আঞ্চলিক ঘটনা বলে দাবি করা যায়। আর তার চেয়েও বড় কথা কাশ্মীর ইস্যু বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ধরণের ক্যাটাগরির ঘটনা। নিশ্চয় আমাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আর গ্লোবাল ইসলামি ফেনোমেনা যা পশ্চিমের চোখে “আন্তর্জাতিক টেরর মুভমেন্ট” – এর তো ফারাক টানতেই হবে। আসলে দুই ধরণের ঘটনাকে মিলিয়ে গুলিয়ে মিডিয়ায় দেখানোর চেষ্টা ভারতের পররাষ্ট্র নীতির কৌশল মাত্র। এটা দোষের নয় হয়ত, নিজের বয়ান খাড়া করার জন্য অনেক রাষ্ট্রই এমন করে থাকে। তবে স্বভাবতই এমন বয়ানের খাতক সবাই হবে এমন আশা ভারতের মিডিয়ার না থাকাই ভাল। সবাইকে এটা মেনে নিতেই হবে তাও নয়। অন্যদিকে যারা আইএসের উপস্থিতির বিষয়টা যে কোন উদ্দেশ্যে অস্বীকার করে যাচ্ছিল, বলা যায় এরা সবাই এর পরিণতির দিকটা উপেক্ষা করে এক ধরণের বেপরোয়া চলছিলেন একথা সত্যি হলেও তাদের কাছে সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারটা অজানা ছিল তা নয়। অথচ সকলেই একটা ভান কর গেছে যেন তারা এমন একটা কিছু ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে জানতেনই না। অথবা অবস্থান হল যে দেখি না আগে বাস্তবে ঘটুক, ততদিনে আর একটু বেশিক্ষণ সুবিধাদি খেয়ে নেই। এজন্য এরাই হামলার ঘটনা ঘটবার পরেপরেই একেবারে উলটা গান ধরেছে, সব ছেড়ে ভদ্র সভ্য হবার চেষ্টা করছে,সেই সুবিধা খাওয়া শক্তি। হামলার ঘটনার শুরু পয়লা জুলাই রাত প্রায় পোনে নয়টা। তবে বাংলাদেশে এই প্রথম জিম্মি করার ঘটনা বলে ঘটনার ব্যাপকতা ও গভীরতার দিকটা বুঝতে সকলের সময় লেগেছিল। প্রায় রাত দশটার আগে কেউই ঘটনার মাত্রা ঠাহর করে বুঝতে সক্ষম হন নাই। এরপর সারারাত ধরে উতকন্ঠা শেষে জিম্মি উদ্ধার একশন অভিযান শুরু হয় সকালে অর্থাৎ ২ জুলাই সকাল সাতটা চল্লিশ মিনিটে। তাতে কী ঘটল সকালে, ফলাফল কী দাড়াল – সকাল দশটার আগে এর নিউজ মিডিয়ায় আসে নাই। তবে এরপর থেকে দিনভর ক্রমশ পরিস্কার হতে থাকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ।
পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা ইদানিং মানে, গত কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেছে। আগেকার দিনে দৈনিক পত্রিকা বলতে আমরা প্রিন্ট পত্রিকাই বুঝতাম। কিন্তু সেগুলো সবই এখন একই সাথে অনলাইনও হয়ে উঠেছে। অনলাইন মানে আগে যেমন ছিল, প্রতিদিনের খবর পরেরদিন সকালে একসাথে প্রিন্ট হয়ে বের হওয়া সে নিয়ম-ছন্দ এখানে ভেঙ্গে ফেলা। দিনের ঘটনা দিনেই যখন ঘটছে প্রায় তখনই প্রকাশিত করে ফেলা হল অনলাইনের বিশেষ বৈশিষ্ঠ। এমনকি ঘটনা উদ্ভাসিত হয়ে ঘটা শেষ পর্যন্ত ডেভেলপিং স্টোরি হিসাবে ক্ষণে ক্ষণে একাধিক রিপোর্ট বের করে ফেলা যায় ও হয় এখানে। এটাও অনলাইন পত্রিকার আর এক বিশেষ বৈশিষ্ঠ। আনন্দবাজার অনলাইন শুধু হয় নাই, নিয়মিত সম্পাদকের বাইরে অনলাইন সম্পাদক বলে আলাদা লোক নিয়োগ দিয়েছে। বাংলাদেশের পাঠক টানার জন্য আনন্দবাজার দিনের শুরুতে সরাসরি পাঠকের মেলবক্সে অনলাইন পত্রিকার লিঙ্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। আরও আছে। পত্রিকায় আগে যে সাব-ক্যাটাগরি হেডিং করা খবর পরিবেশন করত যেমন – কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের জেলা, রাজ্য, কেন্দ্র এরপর বিদেশ এভাবে মোটা দাগের ক্যাটাগরিতে ভাগ করে। এবার এর পাশাপাশি –কেন্দ্র আর বিদেশের মাঝখানে ‘বাংলাদেশ’ বলে নতুন ক্যাটাগরি যোগ করা হয়েছে। প্রতিদিন অন্তত এক বা একাধিক বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবর সেখানে তোলা হয়ে থাকে। আর থাকে নতুন নিয়োগ পাওয়া– সম্ভবত বাংলাদেশ পাতার ভার যার উপর সেই “অমিত বসুর” একটা রিপোর্ট। যদিও এটা রিপোর্ট না কলাম, তা নিশ্চিত কর বলা মুশকিল। তবে যেটা নিশ্চিত তা হল অমিত বসুর রিপোর্ট মানেই – প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে, উন্নতি হচ্ছে, পাকিস্তানের চেয়ে আগে যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যে ভাল বিনিয়োগ হচ্ছে, ইত্যাদির ঢেডা পিটানো প্রশংসাসুচক রিপোর্ট। আর বলা বাহুল্য এসবের বিপরীতে ‘বিএনপি-জামাত’ এর নানান নেতিবাচক ফেনোমেনায় তাদেরকে ভিলেন বানানো থাকে। সবমিলিয়ে এই হল অনলাইন সম্পাদক অঞ্জন বন্দোপাধ্যায়ের লেখা তাঁর আলাদা সম্পাদকীয়সহ সাজানো অনলাইন আনন্দবাজার, বাংলাদেশ যার বিশেষ ফোকাস।
শুরুতে যেকথা বলছিলাম, ০২ জুলাই সকাল দশটার পর থেকে জিম্মি উদ্ধার কাহিনী নিউজ হয়ে প্রচারিত হওয়া শুরু করেছিল। দুপুর তিনটা চল্লিশ মিনিটে আনন্দবাজার অনলাইনের বাংলাদেশ নিউজ সেকশনে একটা রিপোর্ট আপলোড করা হয়। শিরোনাম “মধ্য এশিয়ার অর্থই অনর্থ ঘটাচ্ছে বাংলাদেশে!” – যার লেখক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী। লেখাটা মন্তব্য প্রতিবেদন ধরণের বলা যেতে পারে। লেখার প্রসঙ্গ বিচার করলে বুঝা যায়, বাংলাদেশের জিম্মি ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা কী হতে পারে সে সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেয়া এর উদ্দেশ্য। অথবা হয়ত লেখককে সম্পাদকের অনুরোধটা হয়ত এমনই ছিল।
হোলি আর্টিজানের ঘটনায় ভারতের সংশ্লিষ্ট ইন্টারেষ্ট বা কনসার্ণ গ্রুপের কিছু সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এর মধ্যে প্রধান কমন প্রতিক্রিয়া হল, স্বভাবতই ভয়ভীতি। এছাড়া এথেকে উতসারিত পরের প্রতিক্রিয়া হল – যতটা সম্ভব দুরত্ত্ব তৈরি করে দাঁড়ানো যাতে তা ভারত ‘অ-সংশ্লিষ্ট’ এই ভাব তৈরি করে। ভারত এসব ছুয়ে নাই তা দেখান। এর মূল উদ্দেশ্য ভারত এসবে সংশ্লিষ্ট না ফলে ভারত যেন বাংলাদেশের সাথে টার্গেট না হয়। হামলা যেন না ছড়িয়ে ভারতে প্রবেশ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা পদক্ষেপ। যেমন এব্যাপারটা সবচেয়ে প্রতীকী প্রতিক্রিয়ার রূপ হল, কোন স্পষ্ট ঘোষণা না দিয়ে অনির্দিষ্ট ও হঠাত করে ঢাকা-কলকাতা ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ ট্রেন বন্ধ করে দেয়া। সাদা চোখে এসব পদক্ষেপ হয়ত অস্বাভাবিক না। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে জায়গায় আজ এসে পৌছছে তা সে জায়গায় আনতে ভারতের বাংলাদেশ নীতির দায় আছে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে ভারতের নীতি অবস্থানকে সাথে নিয়ে দেখলে তা বুঝা যাবে। সেক্ষেত্রে বলা যায় এটা বাংলাদেশকে বিপদে ফেলে এখন পালিয়ে যাওয়া, সম্পর্ক ও দায়–হীন বলে হাত ধুয়ে ফেলা – এভাবে ভারতের নিজেকে হাজির করার চেষ্টা।
উপরে ভারতের সাধারণ প্রতিক্রিয়া বুঝাতে প্রথম শব্দটা লিখেছে ‘ভয়ভীতি’। মানুষ ভয় পেলে বয়ান ১৮০ ডিগ্রী বদলে ফেলতে পারে তাই যেন বুঝা গেল সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরীর এই লেখায়। মোট ৬৭৬ শব্দের এই লেখার প্রথম ৫৩৮ শব্দ তিনি ব্যয় করেছেন ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদ ব্যাখ্যা করতে বা বলা যায় দায়ী করতে। বলা বাহুল্য সেটা এক অর্থনীতিবাদী ঝোকের ব্যাখ্যা। দুনিয়ার সব অঘটনের জন্য ‘পুঁজিবাদ দায়ী’ করা ধরণের। এছাড়া এই ব্যাখ্যা-ধারা বলতে চায় – দুনিয়ার ঘটনাবলী ঘটে নৈব্যক্তিকভাবে, বা ঘটবেই ধরণের। ফলে যেন মানুষ দায়ী না, ঘটনার কর্তাও সে নয়। অথবা কর্তা কেউ নয় ও নাই। এই ব্যাখ্যার ঝোক, ঘটনার কর্তা দেখতে পায় না বা চায় না। তবে লেখক সব্যসাচীর লেখায় ‘পুঁজিবাদ’ মূল প্রসঙ্গ নয়, বরং যা তিনি বলবেন এর পটভুমি রচনার উপাদান বলা যায়। কী তিনি বলবেন?
এককথায় বললে তাঁর বক্তব্য ইসলাম-ফোবিক বা ইসলাম-বিদ্বেষী। ইংরাজী শব্দ ‘ফোবিয়া’ বা বিদ্বেষী হওয়া ব্যাপারটা ভেঙ্গে বলা দরকার। আপনি কুকুর পছন্দ করেন না বলে কুকুর পালেন না – এটা হতেই পারে। অর্থাৎ আপনি কুকুর নিয়ে মাতেন না। ফলে এটা কোন ফোবিয়া সমস্যা না। তবে ‘কুকুর ফোবিয়া’ যাকে আমরা জলাতঙ্ক বলি সেটা আলাদা জিনিষ। এটা বিদ্বেষের স্টেজ। এটা কিন্তু এক ধরণের রোগ, অসুস্থতা। ইসলাম আপনার চায়ের কাপ না – এটা হতে পারে। কোন সমস্যাই নয় সেটা । কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী হলে তা বিপদের কথা। এটা আর একটা ধাপ পেরোনো স্টেজ। হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের এর হামলাকারিরা কোন কিসিমের মাদ্রাসা ছাত্র নয়। বরং একেবারে দেশ-বিদেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তাঁরা উচু সমাজের সন্তান। এসব প্রকাশ হয়ে পড়ার পর অনেকেই ব্যাপক অস্বস্তিতে ভুগছেন। কারণ এতে ‘সন্ত্রাস’ বিষয়ে তাঁদের সব গালগল্প আর গরীব-ঘৃণা উদোম হয়ে গেছে। লেখক সব্যসাচীও তাদের একজন তবে একটু ভিন্নভাবে। সারকথায় বললে, তিনি বলতে চাইছেন, পুঁজিবাদের কারণে, মধ্যপ্রাচ্যে মাইগ্রেটেড লেবার গিয়েছে। সেই লেবাররাই বাংলাদেশের “জঙ্গীবাদ” সমস্যার জন্য দায়ী। সব্যসাচীর নিজের ভাষায় পড়েন, “……পাঠানো অর্থে তাঁদের পরিবারদের সমৃদ্ধ করে তুলছেন, তাঁরা কিন্তু নিজেরা দ্রুত আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন ওই দেশগুলোর স্বাভাবিক ‘আফিমের নেশা’ ধর্মীয় উন্মাদনায়, বাড়াবাড়িতে। দারিদ্র্য,অশিক্ষা বা অল্প শিক্ষার জন্যই এটা হচ্ছে। তাঁরা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর কড়া ‘ডোজ’-এর মৌলবাদে আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর যে বাংলাদেশিরা রুটি-রুজির টানে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে যাচ্ছেন, শিক্ষা, বংশ পরিচয়, সামাজিক কৌলিন্য তাঁদের তেমন নেই বলে (যাকে ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ বলা হয়) তাঁরা চট করে ওই ‘সোনার হরিণ’-এর টানে মজে গিয়ে ওই ধর্মীয় ‘আফিম’-এর নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে ওই ‘আফিমের নেশা’ (মৌলবাদ) আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে”।
প্রথমত, সব্যসাচীর ভুগোল-বোধে সমস্যা আছে। তিনি আসলে বলতে চাইছেন মিডল-ইষ্ট বা মধ্যপ্রাচ্যের কথা। কিন্তু শব্দে সেটাকে বলছেন, “মধ্য এশিয়া”। কিন্তু ইষ্ট মানে তো এশিয়া নয়, প্রাচ্য। যে অর্থে ওয়েষ্ট বলতে যেভাবে পাশ্চাত্য বুঝি। আবার সেন্ট্রাল এশিয়া বলে আলাদা রিজিয়ন আছে। বৃটিশ-ইন্ডিয়া কলোনি সাম্রাজ্যের যুগে যা আফগানিস্তান ও ইরান সীমান্তের রুশ জার সাম্রাজ্য অঞ্চল। ফলে তিনি মধ্য এশিয়া বলতে সেন্ট্রাল এশিয়া বুঝাচ্ছেন কিনা পাঠক বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত সব্যসাচীর আর বাকী দিকটা হল, ইসলাম-বিদ্বেষ। আবার শুধু তাই না, বরং সাথে আছে শ্রেণী ঘৃণা। একেবারে “শিক্ষা,বংশ পরিচয়,সামাজিক কৌলিন্য” কথা তুলে তিনি ঘৃণা ছড়িয়েছেন। কিন্তু এতকিছু করেও সব্যসাচীর কোন লাভ হয় নাই। সব পানিতে পড়ছে। কেন? এই লেখা তিনি লিখছেন ২ জুলাই দুপুরে। আর্টজানের হামলাকারিদের “শিক্ষা, বংশ পরিচয়, সামাজিক কৌলিন্য” তখনও প্রকাশ হয় নাই। পরে পরিচয় প্রকাশিত হলে দেখা গেছে “হামলাকারি জঙ্গীদের” “শিক্ষা, বংশ পরিচয়, সামাজিক কৌলিন্য” অর্থাৎ হামলাকারিদের পারিবারিক পরিচয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগত পরিচয় সব্যসাচীরা নিজের জন্য যেমন কাম্য মনে করেন সেই একই শ্রেণীর অথবা সম্ভবত আরও উচু শ্রেণীর। অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না সব্যসাচীর ঘৃণাতত্ত্ব বুমেরাং হয়ে ‘ধরা খেয়েছে’। ইংরাজিতে কথা বলা, স্বচ্ছল ঢাকার এলিটদের সন্তান, দামি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া যারা সম্ভবত সব্যসাচীর চেয়ে আপাদমস্তক আধুনিক তারাই আর্টিজান হামলাকারি। ফলে স্পষ্টত সব্যসাচীর গরীব ও মুসলমান-বিদ্বেষী অবস্থান এখানে সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে।
ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো প্রথম ৫৩৮ শব্দের পরে সব্যসাচীর লেখার শেষ ১৩৮ শব্দ। এটাও ভীষণ কৌতুক কর। ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাইনি – ধরণের। মানুষ অনেক সময় প্রচন্ড ভয় পেলে আগাম ও যেচে অনেক সত্য কথা বলা শুরু করে। এটা যেন তেমনই এক ঘটনা। সরাসরি সব্যসাচীর বক্তব্য উঠিয়ে আনছি, বলেছেন, “৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে যে ভাবে আদালতের নির্দেশের মাধ্যমে একের পর এক যুদ্ধাপরাধীকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হচ্ছে আর সে সব দ্রুত কার্যকর করা হচ্ছে, তাতে আমার মনে হয়, বাংলাদেশি যুব সমাজের কাছে এই বার্তা যাচ্ছে যে, হাসিনা সরকার প্রতিশোধস্পৃহায় ভুগছেন। তাঁরা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন যদি কোনও আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হত বা বাংলাদেশি আদালতে ওই মামলাগুলোয় যদি অন্তত এক জন বিদেশি বিচারপতি রাখা যেত”।
তার মানে সব্যসাচী একটা হামলা খেয়েই সাথে সাথে স্বীকার করছেন যে সরকার প্রতিশোধস্পৃহায় ভুগছে। এটা সত্যিই এক দেখার মত তামাশা। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে কথা সত্য, যা আইনী ভাষায় বললে, এটা আদালতে প্রমাণ করলে তা শাস্তিযোগ্য বিষয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে অবিচার আর বেইনসাফি করা হয়েছে। তবে সেটাও তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র বিষয়। এর তুলনায় এঘটনার ভিতর দিয়ে খোদ রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, রাষ্ট্র আজ অন্যের দাস হয়েছে। রাষ্ট্র আজ ভেঙ্গে পড়ার দশায়। এটা আমার কথা নয়, প্রকারন্তরে এটাই আসলে সব্যসাচীই স্বীকার করছেন। তিনি এটাকে “সরকারের প্রতিশোধস্পৃহায়” করা কাজ বলছেন। তার মানে এখানে কোন বিচার হয় নাই, ‘প্রতিশোধস্পৃহায়’ করা কাজ হয়েছে। কিন্তু এঘটনাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ আউলিয়ে সব ধবংস হয়ে যাবার পর এখন সব্যসাচী এর কারেকশন খুজছেন। আদালতের স্টান্ডার্ড নিয়ে কথা তুলছেন। অর্থাৎ সাব-স্টান্ডার্ড আদালত ব্যবহার করা হয়েছে প্রকারন্তরে তা বুঝিয়েছেন। বলছেন, যদি “আন্তর্জাতিক আদালতে” বিচার করা হত এবং “বিদেশি বিচারপতি রাখা যেত” – এসব কথা বলছেন। তাহলে স্বভাবতই এখানে যে প্রশ্নটা নিরুত্তর থেকে যায় যে, এটা এতদিন তিনি আমাদের বলেন নাই কেন? এখন বলে তিনি কী হামলাকারিদের এক্টকে ন্যায্যতা দিলেন না? তবে এখানে একটা ফ্যাক্টস বলে রাখা ভাল। আর্টজানে হামলাকারিরা জামাত রাজনীতির খাতক না, এটা বলা যায়। কারণ আইএস খোদ তাদের মাসিক প্রকাশনাতে জামাতকে “মুরতাদ” মনে করে বলে জানিয়েছে।
কিন্তু অবাক কান্ড যে আনন্দবাজার সব্যসাচীকে দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করা ধরণের আর্টিকেলে কারেকশনের কথা বলে সেই আনন্দবাজারই আবার গত ৮ জুলাই এই অবস্থানের ঠিক উলটা কয়েকটা “পেজ ফর সেল” রিপোর্ট ছেপেছে। গত ৮ জুলাইয়ের বাংলাদেশ নিয়ে ছয়টার বেশি রিপোট ছেপেছে যার সবগুলাই “পেজ ফর সেল” ধরণের রিপোর্ট। অর্থাৎ আনন্দবাজার তার পত্রিকার পাতা বা জায়গা কোন বিশেষ গ্রাহককে বিক্রি করেছে। আর ঐ গ্রাহক ঐ পাতায় যা মনে চায় তাই লিখে ভরিয়েছে। এরপর আনন্দবাজার আবার তা ছাপলেও কিন্তু নিজে মনে করে গ্রাহক ঐ পেজে যা লিখেছে তার দায়দায়িত্ত্ব আনন্দবাজারের নাই। এই হল ‘পেজ ফর সেল’।
গত ৮ জুলাই প্রকাশিত সেসব রিপোর্টের মধ্যে দুই দুখানা হল জমিদারি-রুস্তমি আমলের কিশোরগঞ্জের জমিদারদের জমিদারি চলে যাবার হাহুতাশ ও হাহাকার বিষয়ক। প্রথমত কিশোরগঞ্জ কেন? কারণ এবার ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদের জামাতকে টার্গেট করে সেই মাঠে পৌছানোর রাস্তায় পুলিশ চেকপোস্টে সশস্ত্র হামলা করা হয়েছিল। ফলে সেই সুত্রে কিশোরগঞ্জ এখানে বিষয়। কিন্তু কাদের দিয়ে আনন্দবাজার কিশোরগঞ্জ নিয়ে আর্টকেল লিখে ছাপাচ্ছে? কিশোরগঞ্জের জমিদারের দুই উত্তরাধিকারী। এটাই হল ইন্টারেস্টিং রগড়ের দিক। আমাদের অনেকের পরিচিত The Autobiography of an Unknown Indian বইয়ের লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর পিতা ছিলেন কিশোরগঞ্জের নবগ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান। সেই নীরদ চন্দ্র চৌধুরী আবার এই শতকে বসেও পুর্ববঙ্গের মানে একালের বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে বাঙালী বলে স্বীকার করেন না। এটা অবশ্য উনি একা নন, বৃটিশ কলকাতা হল জমিদারির আয় পয়সায় বেড়ে ঊঠা শহর। ভেঙ্গে বললে, বাংলার জমিদার-প্রজা সম্পর্কের কৃষি থেকে পাওয়া উদ্বৃত্ত লুটেরা সম্পদ পুঞ্জিভুত হয়ে যে শহর গড়ে উঠেছিল তার নাম কলকাতা। আর কলকাতায় এতে যে ধরণের চিন্তা, রাজনীতি, সাহিত্য সংস্কৃতি বা লাইফ ষ্টাইল যা গড়ে উঠেছিল এককথায় এটার প্রতীকী শব্দই “বাঙালী”। সেজন্য শব্দ হিসাবে কলকাতা ও বাঙালী প্রায় সমার্থক শব্দ। তবে এই বাঙালী ধারণাতে অবশ্যই আমরা পুর্ববঙ্গের কেউ অন্তর্ভুক্ত নই, গণ্য নই। আর ঐ কলকাতা বা বাঙালী – এটা জমিদার ঔরসের বাঙালি, বা সংক্ষেপে “জমিদার বাঙালি”। পুর্ববঙ্গের আমরা, আমাদের দুটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার, এক. বাংলার জমিদার প্রজা সম্পর্কের কৃষির সেসময়ের শোষিত প্রজাদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ট অংশ ছিল মুসলমান। আর দুই, ‘কলকাতা’ বা ‘বাঙালী’ প্রকল্প প্রজা মুসলমানদের বাঙালি মনে করতে না, স্বীকৃতি ছিল না। ফলে বলা যায় ‘জমিদার বাঙালি’ প্রকল্প খুবই ‘ক্লাস কনশাস’ প্রকল্প ছিল।
সেই সুত্রে এজন্য নীরদ চন্দ্র চৌধুরি (১৮৯৭-১৯৯৯) নিজ জীবদ্দশায় গত আশির দশকেও আনন্দবাজার পত্রিকায় পুর্ব্বঙ্গের মুসলমানদের সম্পর্কে লিখেছিলেন “তথাকথিত বাঙালী”। সেই নীরদ চৌধুরির সন্তান হলেন ধ্রুবনারায়ণ চৌধুরী। আর নীরদ চৌধুরিরই আপন বড় ভাইয়ের মেয়ে হলেন কৃষ্ণা বসু। (কৃষ্ণা বসু নিজেই তার আর এক পরিচয় জানিয়ে বলেছেন তিনি, ভারতের প্রাক্তন লোকসভা সাংসদ এবং সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবারের সদস্যা।) ধ্রুবনারায়ণ চৌধুরী এবং কৃষ্ণা বসু এরা দুজন আনন্দবাজার পত্রিকায় দুটো আর্টিকেল ছাপিয়েছেন গত ৮ জুলাই। তাদের বাপ-দাদাদের জমিদারি আমলে কিশোরগঞ্জে কত দুধ-ননীর নহর বয়ে যেত এরই বর্ণনা দিয়ে। এবারের ঈদের শোলাকিয়ায় হামলার বিরুদ্ধে তাদের মনে পড়ছে বাপ-দাদার কিশোরগঞ্জের কথা। তারা তুলনা করছেন বাপ-দাদাদের জমিদারির কিশোরগঞ্জ কত ভাল ও আদর্শ ছিল। যদিও দুজন মানছেন কিশোরগঞ্জ তারা দুজনই প্রায় কখনও যান নাই। আনন্দবাজারের এই প্রজেক্টটাই আসলে ইন্টারেস্টিং। যেন “জঙ্গীবাদ” খেদিয়ে আনন্দবাজার বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে আবার জমিদারি ফেরত আনার স্বপ্ন দেখছে! আমরা আজ জঙ্গীবাদের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি এর মানে কী পরিত্যক্ত পরাজিত জমিদারি ব্যবস্থা আমরা এখন ভাল মনে করব? আনন্দবাজারের ধারণা এটাই জমিদার নীরদ চৌধুরির উত্তরাধিকারদের দিয়ে হাহুতাশ ছড়ানোর ভাল সময়। তাই জঙ্গীবাদের চেয়ে জমিদারি শোষণ নিষ্পেষণ ব্যবস্থা ভাল ছিল এমন তুলনা ইঙ্গিত টানছে। অথচ আনন্দবাজারের কী খেয়াল রাখা উচিত ছিল না যে “জমিদারি” শব্দটা কলকাতায় না-বুঝা গৌরবের ভাবতে পারে। ওর বনেদিয়ানাকে কুর্নিস জানাতে পারে এমনকি তা কারো পেয়ারের হলেও বাংলাদেশ “জমিদারি” খুবই ঘৃণিত একটা শব্দ। আর কোন প্রজারই জমিদারের দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের কথা না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আনন্দবাজারের চেষ্টা হচ্ছে পরাজিত জমিদারের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা কিশোরগঞ্জের বর্ণনা একালে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেয়া। বাংলাদেশ মূলত মুসলমান প্রজাদের আবাসভুমি। বৃটিশ উপনিবেশ মাস্টারের কোলে বসে কিশোরগঞ্জের জমিদার নীরদচন্দ্র চৌধুরীরা কী মৌতাতে হুকায় টান দিতেন,ইংলিশ নাটক মঞ্চস্থ করতেন কী না এসব গল্পগুলো এপার বাংলাদেশ খাবে না। খাবার কোন কারণ নাই। বরং ক্রোধ হবার সম্ভাবনা।
সবশেষে মুরোদ তত্ত্ব দিয়ে শেষ করব। দানব সরকারের বিরুদ্ধে যখন নিজের গুম খুন হয়ে যাওয়া অথবা সরকারের দাবরানির চোটে নিজের জান বাঁচাতে যখন নুন্যতম সরকার বিরোধীরা সবাই ব্যস্ত ঠিক সেই সময়টাই হল সবচেয়ে বিপদজনক। কেন? কারণ সেই সময় জনগণ মুরোদ ওয়ালাদের খুঁজে,তাদের মর্দানি দেখতে পছন্দ করে ফেলতে পারে। মানে দানব সরকারের বিরুদ্ধে যে কেউ সশস্ত্র সবল প্রতিরোধ করতে মুরোদ রাখে তাদের দেখতে পছন্দ করে ফেলতে পারে। অর্থাৎ ফাঁকা রাজনীতির কথা না “মুরোদ”। তাই এটা আমাদের সবার জন্য ভীষণ বিপদজনক সময়। অন্যভাষায় এটা তাই “জঙ্গীবাদ” জন্মাবার জাগবার সবচেয়ে ফেবারেবল সময়। এভাবে জঙ্গীবাদ জনগণের মৌন সমর্থন পেয়ে যায় ‘যদি’ সেটাই সবার জন্য সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক হবে। অনেকে এধরণের সময়কে নকশাল যুগ বলে। এটাই মুরোদ তত্ত্ব। আশা করি আমরা মুরোদ তত্ত্ব মনে রাখব।
[এই লেখাটা এর আগে গত ১০ জুলাই দৈনিক নয়াদিগন্তের অনলাইনে (১১ জুলাই প্রিন্টে)ছাপা হয়েছিল। এখানে তা আরও পরিবর্ধিত ও এডিট করে ফাইনাম ভার্সান হিসাবে ছাপা হল।]
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক