শতাব্দী পুরানা ইউরোপের আত্মঘাতী কাণ্ডের কাফফারা


শতাব্দী পুরানা ইউরোপের আত্মঘাতী কাণ্ডের কাফফারা
গৌতম দাস
০২ আগষ্ট  ২০১৬, মঙ্গলবার

http://wp.me/p1sCvy-1lk

তুরস্কের সামরিক ক্যু নিয়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে তর্কবিতর্ক চার দিকে চলছে,মোটামুটি তা দুনিয়াজুড়েই। তবে তুরস্ককে ইউরোপের সাথে জড়িয়ে দেখলে মানতে হবে এই বিতর্কের শুরু আজকের নয়,অনেক পুরনো। বলা চলে অন্তত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) অথবা তারও আগের সময় থেকে এই ঝগড়া বা বিতর্ক। তবে একেবারে মূল সংশ্লিষ্ট যে ঘটনা যা থেকে এই তর্কবিতর্ক উৎসারিত তা হল, দুনিয়ায় যখন সাম্রাজ্যের যুগ চলছিল সেখান থেকে। সাম্রাজ্যের যুগ মানে সারা দুনিয়া যখন ৫-৭ টা সাম্রাজ্য শাসকের হাতে ভাগ হয়ে শাসিত ছিল। সেকালে এমন প্রায় সব সাম্রাজ্যই ছিল খ্রিষ্টান সমাজ সভ্যতার ভেতর বড় হওয়া দুনিয়ায়। আর এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল অটোমান এম্পায়ার, যা ইসলামি সমাজ সভ্যতার ভেতর দিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতার অংশ। নিঃসন্দেহে এই অংশটা ছিল এক গুরুত্বপুর্ণ ব্যতিক্রম যা খ্রিষ্টান সমাজ সভ্যতার ভেতর দিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতার বাইরে। যদিও বয়সকাল বিচারের দিক থেকেও অটোমান সুলতান এম্পায়ার বা সাম্রাজ্যের অভিজ্ঞতা ইউরোপের ক্রিশ্চান অভিজ্ঞতার সাম্রাজ্যের দিক থেকে অনেক দীর্ঘ।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারে থাকার কাল ধরা হয় ১৪৯৭ সাল থেকে,আয়ারল্যান্ডে কলোনি বসানো বা ‘প্লানটেশন অব আয়ারল্যান্ড’ থেকে। আর এটা টিকেছিল এর পরের ৪৫০ বছর বা কিছু বেশি কাল অবধি। এককথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের (১৯৪৫) সাথে বৃটিশ সাম্রাজ্য যুগেরও সমাপ্তি। সে তুলনায় অটোমান সুলতানের এম্পায়ার আনুষ্ঠানিকভাবে ১২৯৯ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এর পরাজয়ের (১৯১৮) আগে পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়শ’ বছর টিকে ছিল। আজকের তর্কবিতর্কের শুরু সেই এম্পায়ার বা সাম্রাজ্য যুগ থেকে। প্রবল পরাক্রমী অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান ইউরোপের সব সাম্রাজ্য শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিযোগিতা করে নিজ যোগ্যতা ও সফলতায় টিকে ছিল। আর একটা কথা বলা দরকার। দুনিয়া এম্পায়ার বা সাম্রাজ্যে ভাগ হয়ে শাসিত হওয়া,শাসনের সেই কালে ইউরোপের প্রথম পাঁচটি সাম্রাজ্য শাসক ছিল- ব্রিটিশ,ফরাসি,স্প্যানিশ,পর্তুগিজ ও ডাচ-ওলন্দাজ। এরা সবই খ্রিষ্টীয় সমাজ সভ্যতার অভিজ্ঞতার ভিতরে বড় হওয়া অংশ। আগে বলেছি যার বিপরীতে ছিল একমাত্র সুলতানের এম্পায়ার। ফলে পাঁচ সাম্রাজ্য শাসকের পরস্পরের মধ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিযোগিতা থাকলেও সুলতানের এম্পায়ারের সাথে প্রত্যেক এম্পায়ারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সবার রেষারেষিতে অতিরিক্ত এক ভিন্ন মাত্রা ছিল। তবে মনে রাখতে হবে এটা মূলত এম্পায়ারের লড়াই। এই লড়াইকে কোনো ‘সভ্যতার সঙ্ঘাতের’ বা সিভিলাইজেশনের লড়াই বলে ইঙ্গিত করা হচ্ছে না, করছি না। এটা এম্পায়ার টিকানোর লড়াই – ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শাসকগুলোর সাথে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করে নিজ সাম্রাজ্য টিকিয়ে ছিলেন পরাক্রমী অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানেরা। সভ্যতার লড়াই বড় জোর এমন এম্পায়ার টিকানোর অধীনস্ত কিছু একটা।
কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানেরা এত কিছু করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। কিছুটা কপাল খারাপ ছিল বলা যায় সে কারণে,আর কিছুটা নিজের পক্ষে কাজটা ফল দেয়নি- তাদের নেয়া এমন কিছু সিদ্ধান্ত। যেমন প্রথমত,সেকালের ইউরোপে উল্লেখযোগ্য একমাত্র জার্মানির সাথে দীর্ঘ ও পুরনো অ্যালায়েন্স ছিল সুলতানদের। সেসব সূত্রে,প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ-ফরাসি জোটের বিরুদ্ধে জার্মানির পক্ষ নিয়েছিল তুরস্ক। ফলে যুদ্ধে জার্মানির হারের সাথে তুরস্কের এম্পায়ারেরও পরাজয় ঘটে। যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা পুরো অটোমান এম্পায়ার নিজেদের মধ্যে ভাগ বন্টন করে নেয়। তবে প্রথম কারণ যেটা বলেছি,জার্মানির সাথে মৈত্রী – এটা অটোমান সুলতানেরা এড়াতে পারতেন বলে মনে হয় না। আর দ্বিতীয় কারণ যুদ্ধে জার্মানির পক্ষ নেয়া ও যুদ্ধ করা – এটা কষ্ট করে হলেও এড়াতে পারলে হয়ত ইতিহাস আজ অন্য দিকে যেত। তবে ইতিহাস যদি বা কিন্তু দিয়ে চলে না।
খেয়াল রাখতে হবে,তুরস্কের সুলতানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইউরোপের যে পাঁচ ‘কুতুব’ – সাম্রাজ্য শাসকের কথা বলেছি তাদের মধ্যে কিন্তু জার্মানি নেই। এটাই ইউরোপের মধ্যে কেবল জার্মানির সাথে অটোমান তুরস্কের অ্যালায়েন্সের কারণ। ঘনিষ্ঠ লেনদেন,পণ্য বিনিময় আর বিশেষ করে জার্মান টেকনোলজি ও ম্যানেজমেন্ট জ্ঞান শেয়ার করত অটোমান তুরস্ক। অন্যভাবে বললে, ইউরোপের সাম্রাজ্য বা এম্পায়ার শক্তি হিসাবে জার্মানির আবির্ভাবকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, জর্মানরা লেট কামার; মানে সবার শেষে আসা। জার্মান ক্যাপিটালিজমের এক দারুণ পূর্ণতা আসা ও এরপর কলোনি মালিক হয়ে ওঠার দিক থেকে – ইউরোপের মধ্যে জার্মানিতে ক্যাপিটালিজম এসেছে, পুষ্ট হয়েছে সবার চেয়ে দেরিতে।
বলা হয়ে থাকে, ইউরোপে – আধুনিক রাষ্ট্র কায়েম, ক্যাপিটালিজম গড়ে তোলা ও কলোনি সাম্রাজ্য গড়া – এই তিন বৈশিষ্ট্যের নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা উঠে আসার ব্যাপারটা তিন রকমভাবে তিন কালে ঘটেছে। প্রথমে অর্থনৈতিক দিকটা মুখ্য অবদান করে আধুনিক বিপ্লব ঘটেছিল ব্রিটেনে,এর পরে রাজনৈতিক দিকটা মুখ্য অবদান করে তা ঘটেছিল ফ্রান্সে আর সবশেষে এবং দেরিতে দর্শনগত দিকটা মুখ্য অবদান করে তা ঘটেছিল জার্মানিতে। তবে দেরিতে হলেও জার্মানি টেকনোলজি ও ম্যানেজমেন্টের দিক থেকে দ্রুত তারা শীর্ষে আসতে পেরেছিল। জার্মানির কখনও এম্পায়ার হয়ে উঠা হয় নাই,তবে হয়ে ওঠার পথে ছিল বলে অটোমানের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মুখ্য ছিল না। আর ঠিক এ কারণেই অটোমান সুলতানের তুরস্কের সাথে জার্মানির গভীর সখ্য হয়েছিল। আর এই দুই সখা তাদের কমন শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বী যারা ছিল এরা হল – ব্রিটিশ,ফরাসি,স্প্যানিশ,পর্তুগিজ ও ডাচ। এই পাঁচ কুতুবের মধ্যে আবার ব্রিটিশদের সাথেই সুলতানের তুরস্কের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রেষারেষি ছিল। কিন্তু পরাক্রমী সুলতানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পেরে না ওঠে ব্রিটিশসহ সবাইকেই সুলতানের ক্ষমতাকে সালাম করে চলতে হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর প্রথম চোটে তাই ব্রিটিশ-ফরাসি গোপন আঁতাতে তারা আর দেরি করেনি- পুরো অটোমান সাম্রাজ্যই নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছিল।

শুধু তাই নয়, ছোট বড় মিলিয়ে যে আটটি ক্রুসেডে ইউরোপ এতদিন বারবার হেরে যাওয়ার ভেতরে ছিল, সর্বশেষ ১২৮৯ সালে (আজকের লিবিয়া) ত্রিপোলী জয়ের মধ্য দিয়ে শেষ ক্রুসেডেও পরাজয় ঘটেছিল ইউরোপের। সেই পটভূমিতেই অটোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে ১৯১৮ সালে এর প্রতিশোধ নেয় ব্রিটেন। জেরুসালেমসহ আজকের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল ভূখণ্ড পুরোটাই ব্রিটেন নিজের ভাগ দখলে নিয়েছিল। আর আরেক বড় তামাশা হল, যুদ্ধে পরাজয়ের পর তুরস্ক কার্যত ব্রিটিশদের ভাগ দখলে চলে যায়। অথচ সামরিক অফিসার মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে দিয়ে ব্রিটিশরা তাদের দখলি-তুরস্কতেই একটা ক্যু করিয়েছিল। উদ্দেশ্য,তাকে দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘোষণা করানো। কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা,তখন থেকে ‘বিশেষ সেকুলারিজমে’ তুরস্ককে এক আধুনিক রাষ্ট্রের আদলের ক্ষমতা বলে ঘোষণা দেয়ানো হয়। এটা ইউরোপের ইতিহাসের যে সেকুলারিজম ধারণা, সেটা নয়। এটা একেবারে খাঁটি ইসলামবিদ্বেষ।
আরেক দিক থেকে,এটা চেঙ্গিস খানের দোস্ত ইউরোপীয়দের অক্ষম খ্রিষ্টীয় ক্রুসেডারের স্বপ্ন পূরণ। সেই থেকে ‘ইউরোপের ইচ্ছা’ কথাটা ট্রান্সেলেট করলে ওর একনাম হবে ‘তুরস্কের সেকুলারিজম’। এই সেকুলারিজম শব্দ তুরস্কের জনগণের মুখে সেটে দেয়া হয়। এরপর থেকে “সেকুলার নামের আড়ালে” ইউরোপের শাসন -এই শাসন সবসময় গণ-ম্যান্ডেটের বদলে ক্যুর ওপর ভর করে চলেছে। আজ আবার এরদোগান ও তুরস্কের জনগণ সেই একই পথ- ক্যুর মুখোমুখি।

না, এখানে ইতিহাস বলতে বসিনি। এতক্ষণ পুরানো এসব কথা তুলে আনার কারণ ভিন্ন। জার্মানির স্থানীয় ভাষার এক পত্রিকায় (বাংলায় বললে যার নাম ফ্রাঙ্কফুর্টের সাময়িক পত্রিকা) তুরস্কের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এক আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। এর লেখক জনাথন লরেন্স। তিনি ‘টেররিজমের ওপর ইসলামের প্রভাব আছে’ শিরোনামে এক কলামের প্রতিক্রিয়ায় পালটা বিতর্ক তুলেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন,একালে ইউরোপের ইসলাম নিয়ে যে প্যাথলজি বা রোগগ্রস্ততায় পেরেশানি – এটা আসলে ইউরোপের শতাব্দী পুরনো এক আত্মঘাতী কাণ্ডের কাফফারা- যেন এক ভূমিকম্পের পরবর্তী ঝাঁকুনি-ঝটকা। এটাকে এক ‘সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে নেয়া এক পলিসিও বলা যায়’।

মজার ব্যাপার হল,স্থানীয় ভাষায় লেখা বলে এটা আমরা পাঠকদের নজরে আসার কথা নয়, পড়েও নাই। কিন্তু সেই আর্টিকেলটাকে আমাদের নজরে এনেছে লন্ডনের সাপ্তাহিক ‘ইকোনমিস্ট’, ২৬ জুলাই সংখ্যায়। ইকোনমিস্ট জনাথনের বক্তব্যকে ‘টনক নড়ার মত করে’ খুবই গুরুত্ব দিয়েছে। ইকোনমিস্ট লিখছে, “১৯১৬ সালের বসন্তকাল (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, তবে শেষ হওয়ার দুই বছর আগে) থেকে ব্রিটিশ সরকার অটোমান সুলতানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও বিশেষ করে স্পিরিচুয়াল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একটি আরব বিদ্রোহ ঘটানোর জন্য উসকানি দিয়েছে। এ থেকেই শেষে ব্রিটিশদের নেতৃত্বে জেরুসালেম দখল ঘটেছিল এবং লেভান্ট অথবা সৌদি আরবে ইসলামের পবিত্রতম স্থানগুলোর ওপর অটোমানের যে দেখভাল নিয়ন্ত্রণ ছিল,তা ভেঙে দিয়েছিল। এরাই আরবদের ওপর অটোমানের শাসনের বিকল্প হিসেবে শুরুতে হাশেমি রাজতন্ত্রকে প্রশ্রয় ও সমর্থন দিয়ে খাড়া করেছিল, যা এখনো জর্ডান শাসন করে যাচ্ছে। অবশ্য এর শেষ সুবিধাভোগী হচ্ছে সৌদ রাজপরিবার,যারা ১৯২৪ সালে মক্কা ও মদিনা দখল করেছিলেন”।

[এখানে ফুটনোটের মত করে বলে রাখি, লেভান্ট মানে হল – প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে পরাজিত হওয়া অটোমান সাম্রাজ্য ব্রিটিশ ও ফরাসিরা আগে থেকে করা গোপন চুক্তির শর্তে নিজেদের মধ্যে ভাগ করাতে এতে ফরাসিদের ভাগে পড়েছিল ভুমধ্যসাগরের পুর্ব উপকুলীয় অঞ্চল এলাকা। এই অঞ্চলকে লেভান্ট বলা হত। লেভান্ট শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল, যেখানে সুর্য সবার আগে উদয় হয়। এছাড়া আইএস বা আজকের ইসলামি স্টেট – এর আগের নেয়া সাংগঠনিক নাম হল ইসলামি স্টেট অব ইরাক এন্ড লেভান্ট, সংক্ষেপে আইএসআইএল। অর্থাৎ বৃটিশ-ফরাসির ভাগ করে নিবার আগের একক অটোমান সাম্রাজ্য – তার ইরাক ও লেভান্ট অঞ্চল পুনরুদ্ধার প্রকল্প ]

লেখক জনাথন লরেন্স বোস্টন কলেজের একজন প্রফেসর। জনাথন আসলে বলতে চাইছেন,সাম্রাজ্য চালানোর দিক থেকে সুলতান ইউরোপের সবার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ এবং সুলতানের ৭০০ বছরের (ইউরোপের চেয়ে আড়াইশ বছর বেশি) পুরনো তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্য সৌদি রাজতন্ত্রের চেয়ে মুসলমানদের নেতা ও শাসক হিসেবে অনেক পরিপক্ব অগ্রসর ও যোগ্য ছিল। অথচ সুলতানের সেই তুরস্ক সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দুনিয়ায় ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে তুরস্কের ভুমিকার বদলে ব্রিটিশরা সৌদি রাজপরিবারকে খাড়া করেছিল। অথচ আগের তুরস্ক সাম্রাজ্য ছিল ইসলামের প্রায় সব ধারার মিলনস্থল; সুলতান ইসলামের কোনো সুনির্দিষ্ট ফেকড়াকে প্রশ্রয় দিতেন, সমর্থন করতেন তা বলা যায় না। ফলে সুলতানের তুরস্কের হাতে ইসলাম একটা ধারাবাহিক ও স্বাভাবিক ও ইনক্লুসিভ বিকাশের পথ চলার যে সম্ভাবনা ছিল সৌদি আরবের হাতে গিয়ে,পরে সে গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। এটা ইউরোপের পক্ষে যায় নাই। শুধু তাই নয়, সুলতানের পতনের পর সেকুলারিজমের নামে ইউরোপের ইসলামবিদ্বেষের মোহর তুরস্কের জনগণের কপালে সেঁটে দেয়া হয়। এক দমবন্ধ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হল। এতে ক্রুসেডে হারার জিঘাংসা হয়ত মিটেছে কিন্তু তাতে পরের ঘটনাবলি ইউরোপের পক্ষে বা স্বার্থে গিয়েছে এমন দুরদৃষ্টির সিদ্ধান্ত এটা ছিল না। তুরস্ককে যুদ্ধে হারানো এক জিনিষ আর পরাজয়ের পর ধর্মীয় প্রতিশোধের নামে যা কিছু করা হয়েছে তাতে মনে জিঘাংসার শান্তি এনেছে হয়ত সেকুলারিজমের নামে এরপর থেকে ইউরোপের ইসলামবিদ্বেষ আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে, পুরা পরিস্থিতি আজ ইউরোপের বিরুদ্ধে খাড়া হয়ে গেছে। এটাকেই জনাথন লরেন্স এক শ’ বছর আগের পুরনো ভুল,আত্মঘাতী কাণ্ডের কুকর্ম মনে করছেন।

সবশেষে জনাথন এক মারাত্মক মন্তব্য করেছেন। জনাথনের বরাতে সে কথা ইকোনমিস্ট লিখেছে এভাবে, “মিস্টার লরেন্স যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখেছেন, আসলে সবচেয়ে প্রাচীন খলিফাকে উৎখাত করে একটা শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এরপর শতকজুড়ে সে শূন্যতা পূরণ করা হয় আরো কালো বিকল্প দিয়ে এবং তাতে অন্তর্ভুক্ত আছে সর্বশেষ নিজেকে ইসলামি স্টেটের নতুন খলিফা দাবিকারী আবু বকর আল-বাগদাদি পর্যন্ত।’

এই ভুলের মাশুল এখন পশ্চিমকে গুনতে হচ্ছে। তবে হয়ত এটা কিছু ভালো দিক যে,কোথাও অন্তত এই ভুলের উপলব্ধি দেখা দিতে শুরু করেছে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

[লেখাটা এর আগে প্রথম ভার্সন হিসাবে দৈনিক নয়াদিগন্ত অনলাইনে ৩০ জুলাই (প্রিন্টে ৩১ জুলাই ২০১৬) ছাপা হয়েছিল। এবার তা আরও সংযোজন ও এডিট করে নতুন ওয়ার্ডপ্রেস ভার্সন হিসাবে আবার এখানে ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s