হাজী শরীয়তুল্লাহ ও গণ-প্রতিরোধ


হাজী শরীয়তুল্লাহ ও গণ-প্রতিরোধ
গৌতম দাস
আগস্ট ১২, ২০১৬

http://wp.me/p1sCvy-1EO

 

 

ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার সময়কালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে (১৭৫৭-১৯৪৭) বাংলা ভূখণ্ডে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও নির্ধারক ভূমিকা যিনি রেখেছিলেন, তিনি হাজী শরীয়তুল্লাহ। তাঁর ভূমিকা প্রভাবশালী ও নির্ধারক বলছি এই অর্থে যে, ব্রিটিশ শাসন-উত্তরকালে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য কী রূপ ধারণ করতে পারে, তা নির্ধারণে এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা তিনি রেখেছেন। এমনকি আজকের বাংলাদেশেও আমাদের যা কিছু ‘বিশেষ বৈশিষ্ট্য’ তাকে বুঝতে হলে হাজী শরীয়তুল্লাহ যে বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ইসলামচর্চা করেছেন, সেদিকে নজর না ফিরিয়ে উপায় নেই। অনেকে কখন কীভাবে এ দেশে ইসলামের আগমন ঘটেছে, সেই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস অনুসন্ধান করছেন। বিশেষত তলোয়ারের দ্বারাই যদি এ অঞ্চলে ইসলাম কায়েম হয়ে থাকে, তাহলে দিল্লির আশপাশের চেয়েও দিল্লি থেকে বহুদূরে কীভাবে তা সম্ভব হল, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক করছেন। এ দেশের জনগণের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ কিংবা সেই স্বরূপ নিয়ে বিতর্ক বোঝার জন্য ইসলামের আগমনকেই নির্ধারক মনে করা হয়। কিন্তু ইসলাম কীভাবে এই ভূখণ্ডের ইহলৌকিক বাস্তব লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে মূর্ত করেছে, সে হদিস আমরা বিশেষ নিতে চাই না। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাজী শরীয়তুল্লাহ আমাদের জন্য নতুন ঐতিহাসিক প্রশ্ন হিসেবে হাজির হন। হাজী শরীয়তুল্লাহর সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ইসলামের এক বিশেষ ঐতিহাসিক পর্বের দিকে আমাদের নজর ফেরাতে বাধ্য করে। যাকে শুধু ইসলামের আগমন দিয়ে বোঝা যাবে না। এমনকি শুধু ধর্ম দিয়েও নয়। বরং আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ইসলাম গণমানুষের লড়াই-সংগ্রামে কী ভূমিকা রেখেছে, সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার তাগিদ তৈরি করে। হাজী শরীয়তুল্লাহর ভূমিকা প্রভাবশালী ও নির্ধারক এ অর্থেই।

হাজী শরীয়তুল্লাহর জীবনকাল ১৭৮১ থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি ধর্মীয় সংস্কারক এবং ব্রিটিশ-ভারতের বাংলায় সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা। তার জন্ম হয়েছিল ফরিদপুরে; মানে, সেকালের ফরিদপুরের এক মহকুমা, যা একালের মাদারীপুর জেলা, এরই শামাইল (বাহাদুরপুর) গ্রামে। বেশির ভাগ লিপিকার তাঁর সম্পর্কে পরিচিতি দেয়া এভাবে শুরু করেন যে, “তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, বরং কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন”।

হাজী শরীয়তুল্লাহর জন্ম এক ‘তালুকদার’ পরিবারে বলে জানা যায়। তিনি হজ করতে মক্কা শরিফে যান ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে। হজ শেষে ১৮১৮ সালে বাংলায় আসেন। দেশে ফিরে তিনি ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। শরীয়তুল্লাহর নামানুসারেই বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে।

‘ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া’ নামে একটি কথা চালু আছে। যারা আমাদেরকে কলোনি বানিয়ে আমাদের ওপর এক দখল শাসন কায়েম করেছিল। সেকালের অবিভক্ত ভারতবর্ষ ব্রিটিশ কলোনির শাসনাধীন থাকার সময়কালকে বোঝাতে সাধারণত ব্রিটিশ- ইন্ডিয়া লেখা হয়। যদিও ব্রিটিশ কলোনির শাসনাধীন বলতে বাস্তবে সরাসরি ব্রিটিশ সরকার নয়, বরং শুরুতে ছিল এক ব্রিটিশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানির শাসন, যে কোম্পানির নাম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া (সংক্ষেপে এখন থেকে শুধু ‘কোম্পানি’ বলা হবে)। আমাদের অতি পরিচিত ১৭৫৭ সালের পলাশি যুদ্ধেও ব্রিটিশ দখলদারীর আগের অনেক কিছুরই তখন শেষ হয়নি, চূডান্ত ফয়সালা হয়নি।

সেদিক থেকে পরবর্তীতে নির্ধারক আরেক ঘটনা হল, ১৭৬৪ সালের ‘বক্সারের যুদ্ধ’ (বক্সার বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত)। ওই যুদ্ধে মোগল সম্রাট, অযোধ্যার নবাব ও বাংলার নবাব এই ত্রয় ছিল কোম্পানির বিপক্ষের ক্যাম্পে। এদের পরাজয়ের পরই বাস্তবে বাংলায় কোম্পানির শাসন বা ব্রিটিশ কলোনির পত্তন ঘটেছিল। যদিও আমাদের পপুলার ধারণা হল, বাংলার পলাশীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয় হওয়া থেকেই বাংলায় কোম্পানির শাসন শুরু হয়ে যায়। ব্যাপারটা ঠিক তা না হলেও পপুলারলি আমরা তা বলে থাকি এই অর্থে যে, আমরা বোঝাতে চাই পলাশির পরাজয়ের পর কোম্পানি শাসন সঙ্গে সঙ্গে না এলেও কোম্পানি শাসন আসার বীজ বপন করা হয়ে গিয়েছিল। পলাশিতে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে নবাব সিরাজের পরাজয়ের পর আসলে কোম্পানির সহায়তায় পাপেট নবাব হয়েছিলেন মীরজাফর। কিন্তু মীরজাফর কোম্পানির পক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল কোম্পানির ভারতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে ট্যাক্স না দেয়ার সুবিধাদি ও নগদ অর্থ কোম্পানিকে দেয়ার আঁতাতের শর্তের বিনিময়ে। এতে সে নিজে নবাবও হয়েছিল, কিন্তু ওসব দেনা-পাওনার শর্ত পরে বাস্তবে কাজ করেনি। দুপক্ষই শর্ত ভেঙেছিল। ফলে কিছুই থিতু হতে পারেনি। এরই মধ্যে মীরজাফরের মৃত্যুর পর ১৭৬০ সালে তাঁর জামাই মীর কাশেম বাংলার নবাব হন। আর কোম্পানির সঙ্গে পুরানা অসন্তোষের বিষয় আরো প্রকট হতে থাকে। মীর কাশেম নিজের কৌশলগত নিরাপত্তা সুবিধা পাওয়ার স্বার্থে নদীপথের ব্রিটিশদের কর্তৃত্বের নাগাল থেকে দূরে থাকতে তারা রাজধানী নিয়ে যান বিহারের মুঙ্গেড়ে। ফলে সব পক্ষের অসন্তোষের ফয়সালার যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বিহারের বক্সারের যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে কোম্পানির হাতে পরাজয়ের পর বিজয়ী হিসেবে কোম্পানির দেয়া শর্ত হিসেবে এই প্রথম আইনগত ভিত্তিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। অষ্টাদশ মোগল সম্রাট শাহ আলম (দ্বিতীয়), যুদ্ধে হারার খেসারত বা শর্ত হিসাবে কোম্পানিকে বাংলার দেওয়ানি লিখে দিয়েছিলেন। যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় আরও যেসব শর্তে নবাব ও সম্রাটরা কোম্পানীর সাথে চুক্তি করেছিলেন তাই বিখ্যাত ‘এলাহাবাদ চুক্তি’, যার অংশ ছিল এই দেওয়ানি লিখে দেওয়া।  দেওয়ানি মানে খাজনা-রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক দেখভালের কর্তৃত্ব। বাংলার দেওয়ানি লাভ কোম্পানির দিক থেকে এক গুরুত্বপুর্ণ মাইলস্টোন অর্জন। কারণ দেওয়ানি লাভের পর ভূমি খাজনা আদায় ব্যবস্থায় কোম্পানি এক আমূল বদল আনে। আগের মোগল আমলের ভূমি মালিকানা ব্যবস্থায় দেওয়ান বা দেওয়ানের প্রতিনিধিকে জমির খাজনা দেয়ার বিনিময়ে জমির ভোগদখল করত আবাদি কৃষক যাদের ‘রায়ত’ বলা হত। কিন্তু এবার দেওয়ানি অধিকারপ্রাপ্ত কোম্পানি আর খাজনাদাতা জমির ভোগদখলকারী কৃষকের মাঝে তৃতীয়পক্ষ এক জমিদারকে এনে এক ‘জমিদারি ব্যবস্থা’ চালু করা হয়। জমিদার কোম্পানিকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে আগাম ও স্থায়ীভাবে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা দেবে এ শর্তে স্থায়ীভাবে জমিদারকে জমিদারিস্বত্ব দেয়ার রেওয়াজ শুরু হয় এই ‘জমিদারী আইন’ থেকে। এর পর জমিদার ইচ্ছামত পরিমাণ খাজনা আদায় করে প্রজাদেরকে জমি বন্দোবস্ত বা পাট্টা দিত। ভূমি মালিকানা ও চাষাবাদ ব্যবস্থায় এভাবে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটায় জমিদারি আইন। জমিদারি আইন কথাটা প্রচলিত ভাষায় বলা, আর তা আনুষ্ঠানিক নামে বলা হয় – চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন ১৭৯৩ (বা পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট অ্যাক্ট, ১৭৯৩)।

মোগল আমল থেকেই পুরো ভূমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থাপনাটা দাঁড়িয়ে ছিল মূলত দুটো পক্ষ দেওয়ান ও আবাদি কৃষক, এদের সম্পর্কের উপরে। যেখানে ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে দেওয়ানের পক্ষে কালেক্টর বা তালুকদার বা কানুনগো ইত্যাদি নানা নামের আর এক পক্ষকে দেখা যেত। কিন্তু যারা কোনোমতেই দেওয়ানের ঠিকাদার নয়, বরং অবশ্যই তাঁর বেতনভোগী বা কমিশনভোগী কর্মচারী। এবং তারা আগাম কোনো অর্থ দিয়ে দেওয়ানের কাছ খাজনা তোলার অধিকার লাভ করা কোনো ঠিকাদারও নয়। পুরানা মোগল ভূমি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এ অঞ্চলের কৃষিকাজ একেবারেই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। এতে ফসলের ভালো-মন্দ বা কম-বেশি হওয়াটা একেবারেই প্রকৃতি নির্ভরতার তালে এগিয়ে চলত। ফলে জমি থেকে ফসল বা আয় প্রাপ্তির ব্যাপারটা বা এই প্রকৃতি নির্ভর থাকার অনিশ্চয়তাটার দায়ক্ষতি মোগল শাসকরা রায়তের সঙ্গে শেয়ার করত। কিন্তু ব্রিটিশরা এসে সেটা আর করতে চাইল না। এছাড়া তারা নতুন বলে, নিজেদের ব্রিটিশ রাষ্ট্র চালিয়ে আসা লোক বলে মনে করেছিল তারা বাংলাকে আগের চেয়ে ভাল, আরো বেশি প্রফিট আদায় অর্থে ভাল এক ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। আর তা করতে গিয়েই নতুন ব্যবস্থা – জমিদারি আইন। তবে এখানে ব্রিটিশ শাসকরা জমিদারকেই নিশ্চিত ও স্থায়ী পরিমাণ খাজনা জমা দিতে বাধ্য করার পুরা দায় ও এজেন্ট হিসেবে হাজির করাতে গিয়ে তাকে এক স্বৈরাচারী দানব বানিয়ে দিবার সব শর্ত পুরণ করেছিল। ফলে এবার ভূমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থাপনাটা পরিষ্কার তিনপক্ষ ব্রিটিশ দেওয়ানি, বাংলার নতুন শ্রেণী জমিদার আর আবাদি কৃষক – এভাবে করে সাজানোতে প্রথম দুপক্ষই তাদের স্ব স্ব স্বার্থটা নিংড়ে বের করে নিতে পেরেছিল ঠিকই, আর তা করা গিয়েছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আবাদি কৃষক ঘাড়ে চড়ে, তাদেরকে চুষে শুষে নিয়ে। অর্থাৎ আবাদী কৃষকের স্বার্থ দেখার কেউ সেখানে ছিল না। নতুন জমিদারি ব্যবস্থায় আবাদি কৃষকরা তাই হয়েছিল সব হারানো, কেবল জমিদারের প্রজা। মোগল আমলে  রায়ত হিসাবে জমির টাইটেল ছিল খাজনাদাতা আবাদি কৃষকের নামে। জমিদারি আইনে জমির ঐ টাইটেল রায়তের থেকে কেড়ে নিয়ে তা দিয়ে দেওয়া হয় জমিদারকে।

এ জমিদারি ব্যবস্থার ভেতর আরো এক অত্যাচার হাজির ছিল। বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলায় জমিদারকেন্দ্রিক ভূমি ব্যবস্থা পছন্দ করেছিলেন। সেটা নাকি এই যুক্তিতে যে, এভাবেই ব্রিটেনের মত বাংলার কৃষিতেও একটা ক্যাপিটালিজম সম্ভব হবে। যদিও এটা প্রমাণের জন্য তাদের বক্তব্যকে আপসে মেনে নেবার মতো কোনো যুক্তি দেখা যায় না। বরং বৃটিশ কলোনি মাস্টারের সাথে বাংলাসহ সারা বৃটিশ-ভারতের সম্পর্ক তো কলোনির  – কেন এটাকে কলোনিয়াল বলছি – এই প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে উহ্য রেখেই বরং জমিদারি ব্যবস্থাপনা নিয়ে পণ্ডিতদেরকে কথা বলতে দেখা যায়। কেন প্রকৃতি-নির্ভরতার কৃষিতে ফসল না হওয়া বা কম হওয়ার দায় শাসক বা রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনাও শেয়ার করবে না, দায় সবাই শেয়ার করে উন্নত কোনো ব্যবস্থাপনার উদ্যোগই যেখানে সমাধান, সেখানে এ নিয়ে এটা যেন কোনো প্রশ্নই নয়, এমন মনে করা হয়েছে। শাসকের এ দায় শেয়ার না করে কেবল শাসক হওয়ার চেষ্টা— এ স্বভাবটাই তো ‘ফরেন’ এবং ‘কলোনিয়াল’। ইউরোপ থেকে এসেছে ওরা তাই ‘ফরেন’ ঠিক তা নয়। ফলে সেকালে কৃষিতে ‘অর্থকরী ফসল’ বলে একটা ধারণা ছিল। ব্রিটিশ শাসকের হাতে পড়ে তা কেবল শুধু পাট চাষ নয়, বরং আরো ভয়ঙ্করভাবে তুতগাছের চাষ বা নীলচাষ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আর শুরু থেকেই কোম্পানি এ্তে এতই উত্সাহী ছিল যে, জমিদার ব্যবস্থার পাশাপাশি সরাসরি বহু ব্রিটিশ ব্যবসায়ীকে নীলচাষের জন্য জমি দেয়া হয়েছিল। ওই ব্যবসায়ীরা এতই মরিয়া ছিলেন যে, নির্মম অত্যাচারের ভূমিদাস ব্যবস্থা (বন্ডেড লেবার বা ফোর্সড লেবার) চালু করে হলেও তারা এ কাজে সফলতা পাওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। এটাই ইতিহাসে নৃশংসতায় নীলকরের নীলচাষ।

সিনেমা উপন্যাসের স্ক্রিপ্টে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো ভিলেন। অনেকের মনে হতে পারে, না, এর উত্তর হবে নায়ক। আসলে ভিলেন মানে হল নেগেটিভ নায়ক। সামাজিক দ্বন্দ্বের বা গল্পে দ্বন্দ্বের নেগেটিভ দিকটা, যার মাধ্যমে প্রকাশ করার সুযোগ নেয়া হয়। ভিলেন যত নেগেটিভ করে ফুটিয়ে তোলা যাবে, ততই স্পষ্ট বোঝা যাবে ওখানে নায়কের ভূমিকা কত ইতিবাচক, কেন সে নায়ক। ঠিক সেরকম, এতক্ষণ বাংলার কলোনিয়াল ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ভিলেনের দিক থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। এবার এতে নায়কের প্রবেশ ঘটবে। অথবা আরেক দিক থেকে বললে, এতক্ষণ বাংলার কলোনিয়াল ভূমি ব্যবস্থাপনাকে যেন নৈব্যক্তিক দিক থেকে তুলে ধরা হয়েছে। এবার এতে সাবজেক্টিভ অ্যাক্টর বা কর্তাস্বত্বা হাজির হবে।

গণ-প্রতিরোধ শব্দটা একালের, বিশেষত ‘রাজনীতি’ বলে আমাদের ভু-অঞ্চলে কোনো ফেনোমেনা হাজির হওয়ার পরের। এমনকি জনগণ, বা ইংরেজি mass শব্দটাও ‘রাজনীতি’ বলে শব্দ হাজির হওয়ার পর, ওরই অনুষঙ্গ শব্দ হয়ে এসেছে। আগে নয়; রাজনীতি শব্দটা ফুটিয়ে তোলার দরকারে। কারণ রাজা, সম্রাট বা বাদশা-নায়েব নবাবের আমলে আবার জনগণ কী জিনিস!, জনগণ বলে কিছু ছিল না।  এ বিচারে বলা যায়, বাংলায় ব্রিটিশ কলোনি শাসনের সবচেয়ে বড় চিহ্ন ‘জমিদারি ব্যবস্থা’। এর বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত প্রতিরোধ এবং গণ-প্রতিরোধের ঘটনাটা ঘটেছিল হাজী শরীয়তুল্লাহর হাতে।

আগেই বলেছি, তিনি হজ করে দেশে ফিরে আসেন ১৮১৮ সালে। ফিরে তার প্রধান কাজ হয়েছিল ধর্ম সংস্কারের কাজে মনোযোগ  দেয়া। বলা হয়, সেই ৮০০ বছর আগে ভারতবর্ষে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু ১৭৯৯ সালে দেশ ছেড়ে হজে যাওয়ার আগেও তিনি দেখে গেছেন, ফলে জানেন যে ন্যূনতম ইসলামের রিচুয়াল বা ফরজ কাজ যেগুলো, তাও করতে অভ্যস্ত ছিল না সে সময়ের বাংলার আম-মুসলমানরা। সেজন্যই ফিরে এসে তাঁর ধর্ম সংস্কারের কাজে নামা। সবাই একালে তাই হাজী শরীয়তুল্লাহ পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই তাঁর ধর্ম সংস্কারের প্রসঙ্গ আনেন। কিন্তু ধর্ম সংস্কার কথাটা এই অর্থে যে, মুসলমানদের ন্যূনতম ফরজ কাজগুলো করতে উদ্যোগী করার দিকটা জোর দিয়ে তিনি কাজে নেমেছিলেন। যেজন্য তাঁর ধর্ম ও সামাজিক সংস্কারের আন্দোলনকে ‘ফরায়েজি’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি ধর্মীয় সংস্কারের আন্দোলনকে জীবনের বৈষয়িক দিকের সঙ্গে সম্পর্কহীন মনে করেননি। ফলে উপরে যে জমিদারকেন্দ্রিক কলোনি ভূমি ব্যবস্থার কথা বলেছিলাম, যেটা তিনি হজের পর দেশে এসে পেলেন, এটা তার চোখ এড়ায়নি। কারণ বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থা তত দিনে ১৭৯৩ সালে জন্মের পর থেকে ২৫ বছর পার করে ভিত পুঁতে ফেলেছে। জমিদার ও কলোনি শাসকরা মিলে প্রজাদের ওপর তাদের অত্যাচার, শোষণ নির্মমতাগুলোও স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। তাই এখানে আমরা যে মুসলমান ফেনোমেনার কথা বলছি, তা ঠিক কলেমা পড়লেই যাকে মুসলমান বলি এতটুকু অর্থে নয়।

ব্রিটিশ-ভারতের আইন অনুযায়ী জমিদারদের খাজনা আদায় বৈধ। বলা হয়, জমিদারদের ৯০ ভাগ ছিল হিন্দু। এর ওপর আবার তাদের বারো মাসের তেরো পূজা পার্বণের চাঁদা/খাজনা থেকে শুরু করে সন্তানের অন্নপ্রাশন, বিয়ে বা  ‘জামাই খরচা’ ইত্যাদি নানা নামে জমিদারদের বাড়তি খাজনার দাবি লেগেই থাকত। ফলে শরীয়তুল্লাহ মূল খাজনার ব্যাপারে আপত্তি না তুলে (কারণ সেক্ষেত্রে জমিদারদের ম্যাজিস্ট্রেটসি ক্ষমতা দেয়া ছিল, যা সীমিতভাবে হলেও পেয়াদা দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রজাকে নিজের জেলে রেখে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা জমিদারদের ছিল) বরং বাড়তি খাজনাগুলো না দেয়ার ছলে জমিদারের সর্বময় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা শিখিয়েছিলেন শরীয়তুল্লাহ। এই হলো বিশেষ ‘মুসলমান’ ফেনোমেনা। তিনি প্রজার আপত্তি-যুক্তিকে আরো জোরদারে হাজির করতে দাবি করতেন প্রজারা ‘মুসলমান’। ফলে কেন তাঁরা পূজার চাঁদা দেবে? সেকালে জমিদার মানে প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী, যার স্বার্থ আর কলোনি শাসকের স্বার্থ এক সুতায় গাঁথা, জমিদারের ক্ষমতা দুর্বল হওয়া মানে তা কলোনি শাসকেরও। এদিক থেকে দেখলে জমিদারের সর্বময় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার তাত্পর্যটা বোঝা যাবে। আবার অনেকের মনে হতে পারে, এখানে শুধু জমিদারের ক্ষমতা বিষয়টা সবকিছুর কেন্দ্র ভাবা হচ্ছে, এটা কি ঠিক?

বলা হয় সব সমাজেই মানুষের সঙ্গে মানুষের মাঝে অসংখ্য কিসিমের স্বার্থের বিরোধ, ছোট-বড় সংঘাত কাজ করে থাকে। কিন্তু তাসত্ত্বেও এর ভেতর প্রধান কিছু একটা বিরোধ থাকে, যেটা বাকি সব বিরোধের ওপর প্রধান, মাও সে তুংয়ের ভাষায় যেটাকে সমাজের ‘প্রধান দ্বন্দ্ব’ বলে। এই দ্বন্দ্বে সমাজের সবচেয়ে বেশি মানুষ অ্যাফেক্টেড থাকে, আর এ বিরোধ ক্রমে সবার আগে তাই মানুষ সমাধান চায়। পুরা ব্রিটিশ শাসনকালটাই অন্তত বাংলার সমাজজুড়ে প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে থেকেছিল, জমিদার-প্রজা সম্পর্কের দ্বন্দ্ব বা ভূমি মালিকানা বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব। আবার সেকালের সমাজের অর্থনীতিক জীবন বলতে পঁচানব্বই ভাগজুড়েই বোঝাত কৃষির অর্থনীতি। এ কারণে ভূমি মালিকানা বন্দোবস্ত ব্যবস্থার দ্বন্দ্বকে বলা যায়, – প্রধান দ্বন্দ্ব – যা সমাজের প্রায় সবাইকে অ্যাফেক্টেড করে রেখেছিল। অর্থাৎ প্রত্যন্ত মাঠেও ব্রিটিশ ক্ষমতার প্রভাব উপস্থিতি টের পাওয়া যেত জমিদারি শাসনের উপস্থিতি থেকে। সারা বাংলার কৃষির প্রত্যন্ত মাঠ থেকে কৃষির উদ্বৃত্ত পুঞ্জীভূত সেই সারপ্লাস এটাই ছিল ব্রিটিশ কলোনির রুস্তমি আর নিজ দেশ বৃটেনে উদ্বৃত্ত পাচার এমন সবকিছুর রসদ। আর একদিকে এই কৃষি-উদ্বৃত্ত আবার এর স্থানীয় দিক ‘কলকাতা’, এর প্রাণশক্তি। এভাবে কলকাতা মূলত কলোনি মাস্টার আর জমিদারের শহর, তাদের পোষ্য কিংবা তাদেরও পোষ্য শ্রেণীর কায়কারবারের শহর।

অতএব, সবকিছুর কেন্দ্র এ জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নায়ক হিসাবে কাউকে না কাউকে উঠে দাঁড়াতেই হত। হাজী শরীয়তুল্লাহ সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলার সবার হয়ে কাজটা করেছিলেন। সেটা শ্রেণী-সংগ্রাম বা রাজনীতি বুঝি, তা বলার কাল ছিল না। কারণ ১৮৩২ সাল, যাকে মনে রেখে কথাগুলো বলছি, যেটা ছিল তাঁর সক্রিয়তা ও প্রভাবের তুঙ্গ বছর। তিনি বলেছিলেন, জমিদারের কালচার বা আচার যেটা, সেটা তো প্রজার নয়, হতে পারে না। ফলে কলোনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রত্যক্ষ শোষক জমিদারের বিরুদ্ধে তিনি কালচারাল শ্রেণী সেপারেশনের দিক থেকে কথা তুলেছিলেন। এজন্য তিনি বরং তার মত করে মুসলমান প্রজাদের নতুন লাইফ স্টাইলের কথা বলেছিলেন। না লাইফ স্টাইল বলে একালের কোন ফ্যাশন শো- এর মেয়েদের ক্যাটস ওয়ার্ক বুঝাই নাই। এমন বুঝাটাও ডাহা ভুল।  লাইফ স্টাইল কথার মূল অর্থ , মানুষ জীবন সম্পর্কে স্পিরিচুয়ালি বা মেটারিয়ালি যা বুঝে সেটাই প্রকাশিত হয়ে পড়ে তার বাস্তব জীবনে। তাই মানুষ যেভাবে তাঁর স্পিরিচুয়ালি বা মেটারিয়ালি জীবন প্রকাশ করে তাই লাইফ স্টাইল। হাজী শরীয়তুল্লাহ যে লাইফ স্টাইল আমাদের শিখিয়েছিলেন সেই চিহ্ন বা trait তা আজও বাংলার মুসলমানদের মৌলিক বৈশিষ্ট হয়ে আছে। তবে এ কথা বুঝলে ভুল হবে যে, তিনি ছাড়া আর কেউ জমিদারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা বলেননি বা করেন নি। অবশ্যই বলেছেন। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ও সংগঠিত ভাবে বলেছেন এবং টিকে থেকেছেন বাংলায় মুসলমান মানুষের স্পিরিচুয়াল ও বৈষয়িক জীবন এক গ্রন্থিতে একসঙ্গে প্রভাবিত করে গেছেন, এমন ঘটাতে পেরেছেন একমাত্র তিনি। এখানেই তিনি অদ্বিতীয়। ১৮৪০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ফরায়েজি আন্দোলনের হাল ধরেন তার ছেলে মোহসেন উদ্দিন দুদু মিয়া। এই আমলেই আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কার রূপের দিকের চেয়ে কলোনি-জমিদারি ক্ষমতার বিরুদ্ধে ফরায়েজিদের সাংগঠনিক ক্ষমতা বিস্তারের দিকের রূপটা সবচেয়ে ভারী হয়ে উঠেছিল। স্থানীয়ভাবে এক সরকার অর্থে পাল্টা এক সরকারের মতো কাঠামোতে নিজ কমিউনিটিতে ধর্ম নির্বিশেষে বিচার-আচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। পরে ১৮৬২ সালে দুদু মিয়ার মৃত্যুর পরও তার সাংগঠনিক কাঠামো কার্যকর ছিল। তবে ধর্ম সংস্কারের দিকটা আবার প্রাধান্যে আসে।

ফরায়েজি আন্দোলন সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো প্রামাণিক গ্রন্থটা হল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান স্যারের ‘বাংলায় ফরায়েযী আন্দোলনের ইতিহাস’ বইটা। এ বইটা আসলে উনার পিএইচডি থিসিস ও গবেষণা গ্রন্থ। ১৯৬১ সালে তিনি এ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শরীয়তুল্লাহ সম্পর্কে একটা কথা অনেকে দাবি করে থাকেন যে, তাঁর ফরায়েজি আন্দোলন আসলে ওহায়েবি আন্দোলন। এ বিষয়টা নাকচ করেছেন মুঈন উদ-দীন আহমদ খান। যদিও হাজী শরীয়তুল্লাহ  ওহায়েবি ছিলেন কিনা, সে তর্কে তাঁর সম্পর্কে আমাদের উপরের মূল্যায়নের হেরফের হয় না। হাজী শরীয়তুল্লাহ সবচেয়ে কার্যকরভাবে ‘মুসলমান’ নাম ধারণ বা মুসলমান পরিচয়েই সবচেয়ে ভালোভাবে কলোনি-জমিদার কোটারি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়বার পথ দেখিয়েছেন। তিনি আমাদের শরীয়তুল্লাহ। মুঈন উদ-দীন খান তার বইয়ে শরীয়তুল্লাহর সমসাময়িক অন্তত আরো তিনটা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তাদের মধ্যে তুলনা করেছেন। ফরায়েজিদের প্রতিযোগী মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর ‘তাইউনী’ ধারার সঙ্গে বাহাসের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন সত্যিকারের একজন গবেষকের ভূমিকায়। সেখানেই তিনি দেখিয়েছেন, কেউ তাকে ওহায়েবি বলেননি। আবার শরীয়তুল্লাহ ওহায়েবি ধারার অনুসারি হলেই সেটা দোষের, তাও আমরা বলতে পারি না। বরং তার ফরায়েজি ধারার সমান্তরাল লড়াকু  হয়ে জমিদার ফেনোমেনাকেই প্রধান আক্রমণের কেন্দ্র বিবেচনা করে লড়াই প্রতিরোধ সাজাতে আমরা আর কাউকে দেখিনি। তাই বাংলায় ‘মুসলমানেরা’ কেন নিজেকে ভিন্ন আত্মপরিচয়ে হাজির করেছিল এবং সেটা করতে গিয়ে সমাজের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য কীভাবে বদলে গেল, সেটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিপ্রেক্ষিতে হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে গণ-মানুষের লড়াই সংগ্রামের অর্থনৈতিক মর্মের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই। ‘মুসলমান’ এ নাম নিয়ে কার্যকর গণ-প্রতিরোধের পথপ্রদর্শক তিনি।

ইতিহাসের পদ্ধতিগত দিক থেকে বিচার করলে আমরা এটুকু দাবি পেশ করে শেষ করতে চাই যে, বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মের ইতিহাস আলোচনা, কিন্তু ইতিহাস থেকে ধর্মের ইতিহাস বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাসের বিচার সম্ভব নয়। এতে কিছুই বোঝা যাবে না। ‘মুসলমান’ ইতিহাসের বিচারে নিছকই একটি ধর্মীয় পরিচয় নয়। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ‘মুসলমান’ আত্মপরিচয় নিছকই ধর্মীয় পরিচয় মাত্র নয়। ঔপনিবেশিক দখলদারি এবং তাদের আরোপিত ভূমি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঐতিহ্যের মধ্যে ‘মুসলমান’ পরিচয়ের ঐতিহাসিক তাত্পর্য নিহিত।

এ’পরিচয়ের চাবিকাঠি উন্মোচনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সময়ের বহু সমস্যাকে নতুনভাবে চিহ্নিত ও মীমাংসা করতে পারব বলে আশা করি।

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[লেখাটা এর আগে প্রথম ছাপা হয়েছিল দৈনিক বণিকবার্তা ১১ আগষ্ট প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় । তা এখানে আবার আরও সংযোজন ও এডিট করে ছাপানো হল।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s