কমিউনিটিতে মৃত মানুষের প্রতি জীবিতদের দায়
গৌতম দাস
১৮ আগস্ট ২০১৬
সম্প্রতিকালের বাংলাদেশ ‘জঙ্গী’ হামলার ব্যাপকতা দেখার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। গত এক-দেড় বছর ধরে কিছু বিশেষ ধরণের সশস্ত্র হামলা, গলা কেটে দেওয়া বা বোমা হামলার মত ঘটনাগুলো আমরা দেখছিলাম। হামলার বৈশিষ্ঠের দিক থেকে এগুলোর কোনটাই ঠিক হামলাকারির আত্মঘাতি ধরণের তৎপরতা ছিল না। এর পরবর্তিতে আমরা বড় ব্যতিক্রম দেখলাম গুলশানের ‘হলি আর্টজান বেকারি’ নামের রেস্টুরেন্টে ‘সন্ত্রাসী’ হামলার ঘটনা। এটাকে ব্যতিক্রম বলছি এজন্য যে এই ঘটনাটা প্রথমে জিম্মি করা আর পরে সকলকে হত্যা করা ধরণের। যদিও এরপর সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জিম্মি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা কালে পাঁচজন হামলাকারির মৃত্যু ঘটে। এই অর্থে হামলাকারিরা মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েই বা আত্মঘাতি প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়েই এই হামলা চালিয়েছিল বলা যায়। এর আগে কখনও এমন বৈশিষ্ঠের হামলা আমরা দেখি নাই। আগে হামলাকারিরা কখনও আক্রমণস্থলে নিহতও হন নাই। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হামলাকারি গ্রেফতারও না হয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পেরেছে। এসব দিক থেকে বিবেচনায় গুলশানের হামলার ধরনটা ভিন্ন – জিম্মি করে হত্যা করা আর শেষে নিজেরাও নিহত হওয়া – এটা একেবারে নতুন।
এই নতুনত্ব শুধু হামলার ধরণেই নয় আরও অনেক জায়গায় নতুনত্ব এনেছে। যেমন আগে সমাজে ‘জঙ্গিবিষয়ক’ নানা আলাপ হতে দেখা যেত, যেখানে সত্য-মিথ্যা প্রচারণা করতে দেখা যেত। যার বিবেচনা যে তাঁর শত্রু সে আসলে জঙ্গি হোক আর নাই হোক তাঁর বিরুদ্ধে ‘জঙ্গি’ প্রচারণায় নামতে আমরা দেখেছিলাম। অথবা, কারা জঙ্গী হয় এই প্রশ্নে একচেটিয়া বাছবিচার ছাড়া মাদ্রাসাগুলোকে দায়ী করে প্রচারণা ইত্যাদি এসবও আমরা দেখে আসছি গত প্রায় ১৫ বছর ধরে। কিন্তু এবার বড় ব্যতিক্রম। স্পষ্ট হাতেনাতে প্রমাণে জানা গেল হামলাকারিরা সমাজেরই উচু ঘরের। একেবারে রাজধানী শহরের সবচেয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য। তাদের শিক্ষালাভ দেশের মর্ডান ইংলিশ স্কুলের ও দেশি বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এককথায় বললে তা মাদ্রাসা তো নয়ই, বরং তারা একেবারে আধুনিক উচ্চস্তরের শিক্ষা, মর্ডান কারিকুলামের ভিতরে থেকে তাদের পড়াশুনা করছিলেন। ফলে হামলাকারিদেরকে ‘পশ্চাদপদ’ বলে নাক সিটকানো, গরীব মাদ্রাসার তুচ্ছ ও দায়ী করা অথবা লজিক্যাল র্যাশনাল মন থাকলে সবকিছুর সমাধান পাওয়া যেত ইত্যাদিতে আধুনিকতার শ্রেষ্ঠত্ব ধারণা যা এতদিন করে খাচ্ছিল সেই ভ্যানিটি আর মিথ্যা গৌরব সবকিছুই এবার তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছিল। এটাও একটা বিশাল ব্যতিক্রমি ঘটনা মানতে হয়। এরকম করে হয়ত আরও অনেক ব্যতিক্রমী দিক আমরা খুঁজলে বের করতে পারব। কিন্তু আসল উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম যা এখানে লেখার মুল প্রসঙ্গ তা হল, হামলাকারি ‘জঙ্গিদের’ মৃত্যু পরবর্তি জটিলতা। অর্থাৎ মৃত ‘জঙ্গিদের’ মাটি পাওয়া বা দেওয়া। যতদুর মিডিয়া দেখে জানা গেছে তাতে মৃত ‘জঙ্গিদেরকে’ মাটি দেওয়া বা সৎকারের কাজ করার ব্যাপারে খোদ নিজ পরিবারের প্রধানদেরকে প্রকাশ্য অনীহা প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে এমনকি লাশ গ্রহণ না করার পক্ষেই প্রকাশ্যে ঘোষণা বা অনীহা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
মানুষ মারা গেলে সে তখন লাশ মাত্র – একে সৎকার করতে হবে। এটা মৃত মানুষের প্রতি তাঁর রেখে যাওয়া আত্মীয় স্বজন পড়শির কমিউনিটি-দায়। গোত্র বা ধর্মীয় নানান রীতিনীতি অনুশাসন অনুসরণে করে দুনিয়ার সব সমাজ কমিউনিটিই তা পালন করে থেকে। আমাদের যার যার ধর্ম ও সমাজ সভ্যতার রীতিনীতি সম্পর্কে যত প্রাচীন অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় সব ধরণের কমিউনিটিতে লাশের সৎকার করার বাধ্যবাধকতা সব সমাজেই আছে থাকে দেখা যায়। এছাড়া আর একটা দিক হল, জীবিত অবস্থায় মানুষ কারও কাছে অথবা অনেক মানুষের কাছে বন্ধু হয়,আবার শত্রুও হয়। একারণে মানূষের কাজ ততপরতার মুল্যায়নে জীবিত অবস্থাতেই সে খুবই ঘৃণিতও হয়, হতেই পারে। প্রচন্ড অন্যায়কারি বা অত্যাচারিও হতে পারে। আবার মানুষের যা কিছু স্বভাব বা বদস্বভাব এর মুল্যায়ন শুধু তার জীবতকালে এবং মারা যাবার পরও চলে, চলতে থাকে। তবে মারা যাবার পর কেবল একটা জায়গায় তফাত হয়। মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে নানান মূল্যায়ন তখনও জারি থাকে। যেটা থাকে না তা হল মুল্যায়ন-উত্তর করণীয় একশন – অর্থাৎ মুল্যায়নে যদি দোষ পাওয়া যায় তবুও ওখানেই তার সমাপ্তি টানা হয়। দোষের জন্য আমরা কোন বিচার বা শাস্তির পদক্ষেপ আর থাকে না। মানে আমাদের মুল্যায়নে যদি দেখা যায় যে উনি জীবিত অবস্থায় খারাপ ছিলেন, ধরা যাক অত্যাচারি ছিলেন – তবুও মারা যাবার পর এর জন্য তাকে কোন শাস্তি দেওয়া, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা ইত্যাদি থেকে আমরা বিরত থাকি। কারণ তখন এগুলো অর্থহীন। কিন্তু পরিস্কার রাখার জন্য মনে করিয়ে দেই, মৃত মানুষের মুল্যায়ন মৃতের-বাসায় না হোক সমাজে বন্ধ হয় না। কিন্তু তবু মুল্যায়ন করার পর সেটা আর বিচার শাস্তি বা অভিযোগের পদক্ষেপের দিকে যায় না, আমরা নেই না। কারণ বাস্তবে সে তখন শাস্তির উর্ধে। এধারণাটাই অনুসরণ করে আধুনিক রাষ্ট্রের আদালতেও মৃত ব্যক্তির পক্ষে তাঁর ডেথ সার্টিফিকেট দাখিল করলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কিন্তু মৃত অপরাধীকেও আদালত ঐ ব্যক্তির নামে আনা সব অভিযোগ থেকে তাকে রেহাই ও মুক্ত করার রায় দেন।
মুল্যায়ন বিচার কথাটা ব্যাপক দিক থেকে দেখলে, মানুষের বিচার দুই দুনিয়াতেই হয় বলে মনে করা হয়। এই দুনিয়ার বিচার মানে রাষ্ট্রের আইন আদালত। রাষ্ট্রের আদালত কোন মৃত মানুষের বেলায় দুনিয়ায় তাঁর কৃতকাজের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ থেকে তিনি মুক্ত বলে রায় দেয়। আর অন্য দুনিয়া বেলায়, সেখানে আবার বিচারের এক্তিয়ার আর আমাদের নয়, একমাত্র আল্লাহর। এই পরেরটার ব্যাপারে আমরা কেউ জানি না সেই বিচারে কার কী হবে, কে কীসে দোষী না বেকসুর বলে সাব্যস্ত হবে। আমাদের মানুষের এক্তিয়ারের বাইরে সেটা। তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষ মারা যাবার পর মুল্যায়ন তখনও চলে কিন্তু বিচার বা মুল্যায়ন-পরবর্তি কোন একশন আর চলে না। মানুষের সাধ্য নাগালের বাইরে এটা। তাহলে দাঁড়াল, দুনিয়ার আদালত তাকে মুক্ত করেই দেয়। আর আল্লাহর এক্তিয়ার তো আমাদের নয়। এটা আল্লাহর উপরই ছেড়ে রাখতে হয় আর সেটাই বিধানও বটে।
এই অর্থে সারকথাটা হল,মানুষ মারা গেলে সে সব বিচার-শাস্তির উর্ধে চলে যায়। কারণ সব অভিযোগ তখন অর্থহীন হয়ে যায়।
গুলশান ঘটনার পর সরকারের দিক থেকে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার তাগিদ অনুভব খুবই স্বাভাবিক এক ঘটনা। সরকার জনগণের সাথে বন্ধুমুলক মানে যাকে ফ্রেন্ডলি বা পপুলার বলি – তা হোক আর নাই হোক সব সরকারই এমন ঘটনার পর হামলা ঘটনার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টাই করে থাকে। এদিক থেকে তা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তুই কতদুর এটা স্বাভাবিক? যতদুর তা মাটি দেওয়ার বিরুদ্ধেও জনমত তৈরির ব্যাপার পর্যন্ত প্রসারিত না হয়।
তাহলে অভিভাবক পিতারা কেন অনীহা দেখাচ্ছেন,কেন প্রকাশ্যে লাশ নিতে চাচ্ছেন না? মনে হচ্ছে তারা বাবা হিসাবে নিজ মৃত সন্তানের সৎকারের দায় আর ব্যক্তি বা সমাজের একজন হিসাবে দায় – এই দুইয়ের মধ্যে গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।
ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে আমাদের এমন গন্ডগোলে পড়ার কথা না। সমাজে একই মানুষের একই সাথে নানান রকমের ভুমিকা পালন করতে হয়, থাকে। মুল ব্যাপারটা হল, নিজ সন্তান ‘জঙ্গি’ হবার পথে গিয়েছে অথবা কাউকে হত্যা করে শেষে নিজেও নিহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এখানে প্রথম কথা হল, যেভাবে যাই ঘটুক, শেষ বিচারে সাবালক সন্তানের কৃতকর্মের দায় ঐ সন্তানের। লিগাল দায় সন্তানের, পিতা বা অভিভাবকের নয়। রাষ্ট্রীয় আইন আদালতের ক্ষেত্রেও এটা এমনই। এমনকি শুধু সন্তান কেন, যে কোন একজনের দায়ে অন্য জনকে শাস্তি দেওয়া যায় না। আর ওদিকে ধর্মীয় বা আখিরাতের বিচারেও দুনিয়ায় যার যার কৃতকর্মের দায় তাঁর নিজের। এমনকি, চুরি ডাকাতি করে সংসার চালানো পিতার ঐ সংসার থেকে ভরণপোষণ পাওয়া পোষ্য সদস্যদের কারও উপর কোন চুরি ডাকাতির দায় বর্তায় না। না এই দুনিয়া না সেই দুনিয়ার বিচারে। যদিও সন্তান ‘জঙ্গী’ বলে পিতা বা অভিভাবকের মনে অস্বস্তি থাকতে পারে, সন্তাহ হারানোর বেদনাও সেখানে থাকে, এমনকি সন্তান যাকে হত্যা করেছে তার বা তাঁর পরিবারের প্রতিও সমবেদনা থাকে – সেগুলো আলাদা জিনিষ।
অতএব ‘সন্ত্রাসী’ হামলার ততপরতার বিরুদ্ধে সমাজ বা রাষ্ট্র জনমত তৈরি করলে সেখানেও কোন মৃত ‘জঙ্গির’ পিতাও সমাজের একজন হিসাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তিনি একইসাথে কোন মৃত সন্তানের পিতা হন আর নাই হন। স্বাভাবিক অংশগ্রহণই তিনি করবেন। এমনকি ‘সন্ত্রাসী’ রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি যদি নিন্দা জানাতে মনস্থ করেন সক্রিয় অথবা নিষ্ক্রিয়ভাবে – তবে তাও করবেন, একদম স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু তাই বলে সেই একই পিতা সন্তানের সৎকারের প্রসঙ্গে তার করণীয় যা, সৎকারে আয়োজনের ক্ষেত্রে পিতার যা ভুমিকা হয় তাও পালন করবেন, তাকে করতে হবে। কেননা এটা শুধু পিতা বলে নয়। মনে রাখতে হবে, এটা মৃত মানুষের প্রতি তাঁর রেখে যাওয়া আত্মীয় স্বজন পড়শির কমিউনিটি-দায়ও।
আমরা আশা করব অভিভাবক পিতারা ‘জঙ্গী’ ততপরতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরির ব্যাপারের অংশগ্রহণের সাথে সাথে, মৃত সন্তানের লাশ গ্রহণ ও সৎকারের প্রসঙ্গে পিতা হিসাবে তার যা কিছু দায় তারও প্রতিটা তিনি পালন করবেন। এই দুইয়ের মধ্যে কোন স্ববিরোধ নাই।
আচ্ছা, কোন পিতা বা অভিভাবক যদি লাশ না নেন, অস্বীকার করেন তাহলে সেক্ষেত্রে লাশের কী হবে? এখান একটা কথা মনে রাখতে হবে – ধর্মীয় রীতিনীতি যাই থাক, জীবিত মানুষ নিজের ব্যবহারিক স্বার্থেই মৃত মানুষকে কবরস্ত করে। পাশে রেখে ঘুমায় না। এটাও জীবন বাস্তবতার আর এক দিক। কারণ লাশ পাশে রেখে বা পচিয়ে ঘর সংসার পরিবার করা চলে না। পচনশীলতার ম্যানেজমেন্ট দিক থেকে সে হিসাবেও লাশ সম্মানের সাথে কবরস্তই সঠিক ও বাস্তব বিধান। একাজ মৃতের পিতা বা অভিভাবক না করলেও সমাজ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কাউকে না কাউকে তা করতেই হবে। এবং সেটা করতে হবে একেবারে সম্মানের সাথে। কারণ মৃত মানুষের ভিতরে আমরা জীবিতরা প্রত্যেকেই নিজেকে দেখতে পাই। আমার মৃত্যুর পর যেহেতু আমিও আমার অসম্মান দেখতে চাইতে পারি না। তাই আমার মৃত্যুর আগেই সমাজে সৎকার ব্যবস্থা – এটা সমাজের রেওয়াজ হিসাবে গড়ে উঠুক, আমরা সবাই তা চাই। তাই আমরা দুনিয়ার সব লাশ এমনকি একেবারে অচেনা অজানা লাশকেও অজান্তে মনের গভীর থেকে সম্মান করি। তবুও কেউ কেউ, কাউকে হত্যা করে সেই লাশের উপর নৃত্য করার রেফারেন্স দিতে চাইতে পারেন। হা পারেন তবে সেটাকে আমরা জিঘাংসা বলি। জিঘাংসা এক মানসিক রোগ যা থেকে বের হয়ে আসার উপায় বা পাথেয় হল মনোরোগের চিকিৎসা। কী আর করা, জিঘাংসা মানুষের মৌলিক স্বভাব না হলেও আমরা অনেক মানুষকে জিঘাংসার ভিতর সুখ খুজতে দেখি।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com