ভারতে এবার ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে ফেলার কথা উঠেছিল কেন


 ভারতে এবার ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে ফেলার কথা উঠেছিল কেন

গৌতম দাস

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

http://wp.me/p1sCvy-1Rl

বাংলাদেশে খবরটা সবাই পড়েছেন বেশ উতসুক হয়ে আগ্রহের সাথে। কারণ বিষয়টা  জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে ভাটির দেশ হিসাবে পাওনা পানি থেকে বঞ্চিত করার ভারতের জুলুম ও অত্যাচারের কাহিনীর অংশ। জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করা বাংলাদেশে বিষয়টা উস্কে তোলার মত খবরটা হল, ভারতের বিহার রাজ্যের চলতি মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাথে দেখা করে ফরাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দিতে দাবী করেছেন। এই ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে গঙ্গা নদীর পানির উপর ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেশের যা ন্যায্য হিস্যা সেই পানি জবরদস্তি করে ভারত আটকে নিয়ে রেখেছে। এতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিয়ে রেখেছে শুধু তাই না, সেই পানি খাল কেটে পশ্চিমবঙ্গের অন্য নদীতে নিয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের সকলের চোখে, এটা বাংলাদেশের চরম স্বার্থহানিকর ঘটনা। ফলে  ভারতের দুষমনির প্রতীক হল ফারাক্কা বাঁধ। এবার সেই ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দেবার কথা তুলেছেন ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ২২ আগষ্ট ২০১৬ প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাথে দেখা করেন। আনন্দবাজার পত্রিকার ২৪ আগষ্টের রিপোর্ট বলছে – নিতীশ কুমারের অভিযোগ, “বিহারে গঙ্গা অববাহিকায় বন্যার জন্য ফরাক্কা বাঁধ দায়ী। বক্সার থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত গঙ্গার নাব্যতা অনেকটাই কমেছে। ফলে জল জমে তা দু’পার ছাপিয়ে যাচ্ছে। ফলে বন্যা কবলিত এলাকা বাড়ছে। তাই ফরাক্কা বাঁধের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। ফরাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন নীতীশ”। এই খবর বাংলাদেশের কাছে যেন আল্লার দুনিয়ার ন্যায়-ইনসাফের ঘন্টা আপন উদ্যোগে বেজে উঠার ইঙ্গিত ইশারা এটা। যদিও মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এই দাবি করেছেন বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে নয়, বিহারের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে। কারণ বিহার এখন গঙ্গা নদী প্রবাহের উপচানো পানিতে বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। উতপত্তিগত দিক থেকে গঙ্গা নদী ভারতের যেসব প্রদেশ আগে ডিঙ্গিয়ে এরপর বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ক্রমানুসারে ভারতের সেসব প্রদেশ বা রাজ্যগুলো হল – সবার আগে উত্তরপ্রদেশ এরপর বিহার, এরপর পশ্চিমবঙ্গ হয়ে শেষে বাংলাদেশের চাপাই-নবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলা। তো নীতিশ কুমারের দাবি কী আমাদের জন্য ইনসাফের ইশারা? এটা বুঝবার জন্য আমাদের সবার কান খাড়া হয়েছিল, সন্দেহ নাই।

ঐ সাক্ষাত ছিল এক মুখ্যমন্ত্রীকে দেয়া এক প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক এপয়েন্টমেন্ট করে দেয়া সাক্ষাত। অতএব এতে অনুমান করা ভুল হবে না যে তা অনেক আগেই ঠিক করা হয়েছিল। তবে এটা নেহায়েতই এক মুখ্যমন্ত্রীকে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত ছিল না। এর আরও বহু গভীর মাত্রা আছে। প্রথমত নীতিশ বিহারের এক আঞ্চলিক দল জনতা দল (ইউনাইটেড)এর সভাপতি ও মুখ্যমন্ত্রী। না এতটুকুই নয়। গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির মোদী নিরঙ্কুশভাবে জিতে আসার পর ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে যে মোদী ঝড় উঠেছিল সে ঝড় ঐ নির্বাচনের পরেও অন্যান্য রাজ্য নির্বাচনেও থামছিলই না। শেষে গত নভেম্বর ২০১৫ বিহারের প্রাদেশিক (বিধানসভা) নির্বাচনে প্রথম সবচেয়ে শক্তভাবে থেমে উলটা দিকে তা ঘুরেছিল। বিজেপি শোচনীয়ভাবে হেরেছিল। আর নীতিশ কুমারের নেতৃত্বের বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়েছিল। ঐ জোটে বিহারের আর এক বড় আঞ্চলিক দল, লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর ছিল সোনিয়া গান্ধীর খোদ কংগ্রেস পার্টিও। এককথায় বললে বিজেপি বিরোধী শক্ত জোট ছিল সেটা। ফলে সেই শক্ত জোটের সবার প্রতিনিধি ও নেতা ছিলেন নীতিশ কুমার । নীতিশের পরিচয়-বৈশিষ্ঠের আরও কিছু বাকী আছে। আগামি বছর ২০১৭ ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঐ নির্বাচনেও যদি বিজেপির হার হয় তবে তা ভারতের রাজনীতিতে আর এক নতুন দিকে মোড় ঘুরানো ঘটনা হবে সেটা। ঐ হারকে পুজি করে ভারতের পরবর্তি লোকসভা (২০১৯) নির্বাচনে বিজেপির মোদীকে হারানোর লক্ষ্যে বিজেপি-বিরোধী জোট গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। কারণ আগামি নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী দল কংগ্রেস হবে না। আঞ্চলিক দলগুলোর গঠিত জোট হবে মোদীর বিজেপির প্রধান বিরোধী, প্রধান চ্যালেঞ্জ।  এই লক্ষ্যে সম্ভাব্য ঐ জোট গড়ে তোলার খুবই তাতপর্যপুর্ণ ঘটনা। সম্ভাব্য ঐ আঞ্চলিক দলের জোট গঠনের মূল নেতা ও উদ্যোক্তা হবেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।  এই জোটের মূল লক্ষ্য হবে বিজেপি ও মোদীর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল। গত কেন্দ্রীয় নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে কংগ্রেস ক্রমশ শুকিয়ে ছোট হতে হতে অনেক আগেই কোন এক আঞ্চলিক দলের সমান প্রভাবের দল হয়ে গেছে। ফলে নীতিশ-মমতাসহ নানান আঞ্চলিক দলের মিলিত জোট বনাম বিজেপির মোদী – এই হবে ঐ নির্বাচনে মূল ক্ষমতার লড়াই।

ভারত রাষ্ট্রের জন্মগত সুত্রে দুর্বলতা বা ত্রুটি হল ওখানে কেন্দ্র কে, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কোথায় কিভাবে তৈরি হয় তা রাজ্যে বসে টের পাওয়া যায় না। ফলে ভুতুড়ে কেন্দ্র বনাম রাজ্য এর বিবাদ জন্ম থেকেই। ফলে বিজেপি বনাম আঞ্চলিক দলের জোট এর লড়াই  এর তাতপর্য  এবার পুরানা ‘কেন্দ্র-রাজ্য’ ক্ষমতার লড়াইকে আবার মুখ্য হয়ে তুলতে যাচ্ছে। অতএব মোদী সেই বিশেষ নীতিশ কুমারকে সাক্ষাতের এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন।

ফসলের মাঠ ও শহরও ডুবে যাওয়া বিহারের এবারের বন্যার প্রভাব হয়েছিল মারাত্মক। টানাটানিতে চলা রাজ্য আর তুলনামূলক উদ্বৃত্তে চলা রাজ্য এই ভিত্তিতে যদি ভারতের রাজ্যগুলোকে ভাগ করি তবে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার টানাটানিতে চলা রাজ্যের অন্তর্গত। ফলে বন্যায় ব্যাপক ত্রাণের আয়োজন করার সীমাবদ্ধতা এখানে আছে। আর এই সীমাবদ্ধতা সমস্যাটা ব্যক্তি নীতিশ কুমার অথবা তার দল-জোটের কারণে নয়।  ওদিকে এই বন্যায় মানুষের যা ক্ষয়ক্ষতি এককথায় বিহার রাজ্য সরকারের পক্ষে তা পুরণ অসম্ভব। ফলে যেটা সম্ভব তা হল তাতক্ষণিক কিছু ত্রাণ বিতরণ। সারকথায় বিহারের জনগণের ক্ষোভ মোকাবিলা আসলেই কঠিন। ফলে৪ জনগণের ক্ষোভকে কেন্দ্রের উপর ঠেলে দেয়ার তাগিদ নীতিশের আছে। ওদিকে এই বন্যা কেন হল, এর সাথে কী ফারাক্কায় বাঁধ দেওয়ার কোন সম্পর্ক নাই? অবশ্যই আছে। গঙ্গার মত প্রবল বিপুল পলিমাটিবাহী নদীর ক্ষেত্রে এর উপর বাঁধ দিলে সে প্রভাব আরও জটিল ও মারাত্মক হওয়ার কথা, হয়েছেও। অতএব সবমিলিয়ে এর দায় কার কেন্দ্রে না রাজ্যের এই বলে দায় ঠেলাঠেলির এক বিরাট ক্ষেত্র হল বন্যা ও বাঁধ ইস্যু। বিশেষত যখন বাঁধ দেয়া ও মেন্টেনেন্স ব্যবস্থাপনার প্রশাসন চলে সরাসরি কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত – তাই এই দায় কেন্দ্রের; ওদিকে বন্যা হলে তা মোকাবিলা ও ত্রাণ বিতরণ রাজ্যের দায়। এসব কথা সাক্ষাতের আগেই আগাম ভেবে নিয়েছিলেন নীতিশ ও মোদী দুজনেই। কারণ, ঐ সাক্ষাত থেকে দায় ঠেলাঠেলি শুরুর এক বিরাট সম্ভাবনা আছে তা দুজনেই জানতেন। নীতিশ মোদীর কাছে এসে নিজ বিহার জনগণকে বুঝাতে ও দেখাতে চেয়েছিলেন মুল সমস্যা ফারাক্কা বাঁধ। অর্থাৎ দায় কেন্দ্রের। মোদীর কাছে বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার কথা তুলে, দাবি জানিয়ে তিনি সে অর্থ করতে চেয়েছিলেন যে দায় কেন্দ্রের। আর মোদী সেকথা টের পেয়ে সাথে সাথে বাঁধ কর্তৃপক্ষকে  বাঁধের সব গেট খুলে দেবার নির্দেশ জারি করেন। এভাবে তিনিও বুঝাতে চাইলেন রাজ্য যা চেয়েছে তিনি ততক্ষণাত তাই দিয়ে দিয়েছেন, সুতরাং কেন্দ্রের দায় নাই।  বন্যায় কারণে  বিহারের জনগণের যদি কোন কষ্ট-ক্ষোভ থেকে থাকে তবে এর দায় ত্রাণের পরিমাণ কম  অথবা বিতরণে রাজ্য সরকারের সমস্যাজাত। ফলে ২৩ আগষ্ট নীতিশ-মোদীর সাক্ষাত ছিল আসলে আগামি ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কার ইমেজ ক্রেডিট ভাল তা এখন থেকেই ঠিকঠাক রাখার প্রতিযোগিতা। ফলে ঐদিনের প্রথমার্ধে ঘটনাবলী ছিল নীতিশের বাঁধ ভেঙ্গে দিবার দাবী জানান আর মোদীর ততক্ষণাৎ সবগুলো গেট খুলে দিবার নির্দেশের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল।

কিন্তু কেবল নীতিশ আর মোদী নন গঙ্গার ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে ভারতেই আরও পক্ষ আছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান হল ফারাক্কা বাঁধ থাকা তার স্বার্থের পক্ষে। কারণ গঙ্গার পানি শেষে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌছানোর বদলে সেই পানি বাংলাদেশে ঢুকবার আগেই তা কেটে গতিপথ বদলে আলাদা খাল খুড়ে টেনে ভাগীরথী-হুগলী নদীতে ফেলা হয়েছে। এভাবে হুগলী নদী ধরে শেষে ঐ বাড়তি পানি কলকাতা বন্দরে নিয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলা হয়েছে। মমতার মুল উদ্বেগ হুগলী নদীতে পড়া পলিমাটির চরের কারণে কলকাতার ডায়মন্ডহারবার বন্দরের নাব্যতা সঙ্কটে পড়েছে, এথেকে বন্দরকে রক্ষা করা, বন্দরকে সচল রাখা। ফারাক্কা বাঁধ তৈরির আগে মনে করা হয়েছিল যে খাল কেটে আনা অতিরিক্ত বা বাড়তি পানির চাপের তোড়ে হুগলী নদীতে পড়া পলিমাটি অপসারণ হয়ে যাবে যাতে এভাবে কলকাতার ডায়মন্ডহারবার বন্দরের নাব্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। কিন্তু এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে পানি টেনে আনার পরও তা দিয়ে পলিমাটি পর্যাপ্ত বা কাম্য মাফিক কিছুই সরানো যায় নাই। ফলে  বন্দরের এই নাব্যতা সংকট খুব মিটে নাই তো বটেই উলটা নাব্যতা রক্ষা যতটুকু হচ্ছে তা বজায় রাখতে গিয়ে প্রত্যেক বর্ষা মৌসুমে ঐ সংযোগ খাল (৪০ কিমি লম্বা) ও নদীর দুই পাড় উপচে পড়া পানিতে এলাকায় বন্যা হচ্ছে। ফলে বিহার ছাড়াও নাব্যতা রক্ষার কাফফারা হিসাবে পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিবছর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও নীতিশের বাঁধ ভেঙ্গে দিবার দাবির কয়েক ঘন্টা পরে ঐদিনই ভারতের এনডিটিভি মমতাকে প্রতিক্রিয়া জিজ্ঞাসা করেছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল যে নীতিশের ঐ দাবীর পর মমতার প্রতিক্রিয়া কী? ক্লিপে দেখা যাচ্ছে, মমতা এর কোন জবাব না দিয়ে এড়িয়ে চলে যান।   এতে এনডিটিভির রিপোর্টার মন্তব্য করে এটা মমতার কৌশলগত নিশ্চুপ থাকা। পরে কলকাতার নদী ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ক্যামেরার সামনে (ঐ একই ক্লিপে দেখুন শেষ ভাগে) দাবি করেন ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দিলে নাকি এখন ২০০ কিমি নদী শুকিয়ে যাবে। তাই তাঁর মতে নীতিশের দাবী আজিব রিডিকুলাস, তিনি বলেন। পরে ঐ রিপোর্টের অন্য অংশ থেকে জানা যায় মমতা বলছেন, বিহারে বন্যার কারণ মনুষ্য-সৃষ্ট। কারণ সঠিক সময়ে বাঁধের পানি ছাড়া হয় নাই। ফলে পুরা ব্যাপারটায় কেন্দ্রের দায়।

মমতার এই বক্তব্যের পরে ঐদিনই (২৩ আগষ্ট পরের দ্বিতীয়ার্ধে) বিজেপি শিবিরে টনক নড়ে। তারা আবার ভেবে মুল্যায়ন করে দেখে যে ভোটের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য রেখে রাজনীতিকদের কথা সাজানো ও পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপের লড়াইয়ে তারা পিছিয়ে পড়ে গেছে। কারণ নীতিশ আর মমতার ভাষ্যে ভিন্নতা আছে। অথচ এর সুবিধা বিজেপির পক্ষে কাজে লাগানো হয় নাই। তাই আবার নতুন করে দোষারোপ সাজানোর উদ্যোগ নেয় তারা। বিহারের রাজনীতিতে নীতিশ কুমারের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব হলেন বিজেপি নেতা হলেন সুশীল কমার মোদী। তিনি একদিন পরে অর্থাৎ ২৫ আগষ্ট মিডিয়ায় এক বিবৃতি পাঠিয়ে তাই এবার তিনি দাবি করলেন, নীতিশের ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দিবার দাবীর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। তিনি আরও ব্যাখ্যা দিতে থাকলেন, “বরং যেহেতু নীতিশের বিহার সরকার বন্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি নেয় নাই, ত্রাণ ঠিক মত বিতরণ করতে পারে নাই – সেই খামতি আড়াল করতে সে এখন বাঁধ ভেঙ্গে দিবার দাবী তুলেছে”। অর্থাৎ  তিনি মমতার পক্ষে ছদ্মভাবে দাঁড়িয়ে মমতা-নীতিশের বক্তব্য বা অবস্থানের বিরোধ বড় করে দিতে চাইলেন। এছাড়াও বন্যার কারণ ফারাক্কা বাঁধ নয় – বলে বাঁধকে দায়ী হওয়ার হাত থেকে বাচিয়ে দিতে চাইলেন তিনি। আর এর চেয়েও বড় কথা তিনি ইচ্ছা করে এক বিভ্রান্ত তৈরি করলেন। বন্যা হওয়া না হওয়ার জন্য বাঁধ দায়ী কীনা এটা এক জিনিষ। কিন্তু তিনি দাবী করলেন ফারাক্কা বাঁধ নয়, রাজ্য সরকারের ত্রাণ ঠিকমত বিতরণ ব্যবস্থাপনা না করতে পারাটাই যেন বন্যার কারণ। যেন ত্রাণ পরিমানে প্রচুর আর  ঠিকমত বিতরণ করতে পারলে তাহলে আর বিহারে বন্যা হত না।  এই হল ভারতের আগামি কেন্দ্র-রাজ্য লড়াই প্রকট হয়ে উঠার আগেই পরস্পরের দোষারোপ করে দায় ঠেলাঠেলির – ভোটের রাজনীতি।

ঘটনার এখানেই শেষ না। কারণ গঙ্গা ও ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার সাথে যুক্ত পক্ষ শুধু ভারতে না, ভারতের বাইরেও বাংলাদেশ আছে। তাই এবার বাংলাদেশ অংশ। এখানে দুই মন্ত্রীর পরস্পর বিরোধী দুই বক্তব্য নিয়ে এক রিপোর্ট করেছে সরকার ঘনিষ্ট বিডিনিউজ২৪ গত ২৮ আগষ্ট।  তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নির্বাচনী এলাকা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, যেটা এবারের ফারাক্কা বাধের গেট খুলে দিবার কারণে বন্যায় অন্যতম ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা। রোববার ভেড়ামারা উপজেলার চর গোলাপনগরে পদ্মা নদীর পাড়ে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে  ত্রাণ বিতরণের সময় ফারাক্কা ব্যারেজের প্রভাব নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানাচ্ছেন। তিনি লিখছেন তথ্যমন্ত্রী ইনু বলেন, “অভিন্ন নদীর উপর একতরফা গেইট খুলে দেওয়াটা সঠিক কাজ নয়। এ বিষয়ে আমাদের যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আর্কষণ করব।” একই সময়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যববস্থাপনামন্ত্রী মায়া চাঁদপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় ফারাক্কা ব্যারেজ নিয়ে কথা বলেন। আওয়ামী লীগ নেতা মায়াকে উদ্ধৃত করে বিডিনিউজ২৪ লিখেছে,“এক সময় আমরা বলেছি ফারাক্কার বাঁধ আমাদের জন্য মরণ ফাঁদ। কিন্তু এখন তা ভারতের জন্য মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ফারাক্কার পুরো বাঁধ ছেড়ে দিলে কিংবা ভেঙে দিলে আমাদের দেশে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। পদ্মার পানি এখনও বিপদসীমার নিচে আছে। ফারাক্কার পানি আমাদের কোনো ধরনের সমস্যা হবে না বলে আমরা মনে করি”। অর্থাৎ সংকীর্ণ চোখে যার যার নির্বাচনী এলাকার মানুষকে বুঝ দিবার বক্তৃতা এগুলো। ঠিক সামগ্রিক দেশ ও জনগণের স্বার্থের দিক থেকে দেয়া অবস্থান নয়।

নিতীশ-মমতার অবস্থানের বিরোধকে বড় করে দেখানোর সুযো নিবার জন্য এবার এগিয়ে আসেন ভারতের রঞ্জন বসু। তার সে তৎপরতা আমরা পাই গত ০২ সেপ্টেম্বর কলকাতার সাংবাদিক রঞ্জন বসুর লেখা বাংলা ট্রিবিউনে “ফারাক্কার গেট খোলা নিয়ে অপপ্রচারে ‘বিরক্ত’ বাংলাদেশ” শিরোনামে। ঐ লেখায় দাবী করা হয়েছে, নতুন করে ফারাক্কা বাধের গেট খোলার কোন ঘটনাই আসলে ঘটে নাই। কারণ বর্যার সময় সবগেট খোলাই থাকে। ফলে নতুন করে গেট না খুললেও মিডিয়ার তা প্রচার হয়েছে। হয়ত রঞ্জন বসুর এই দাবী সত্য। কিন্তু ঐ লেখায় দাবী করা হয়েছে আমাদের দিল্লী দুতাবাস নাকি দাবি করেছে রাজশাহী বা অন্য কোথায় কোন বন্যা হয় নাই। রঞ্জন বসু লিখেছেন, “……পদ্মায় বাড়তি পানির স্রোতে রাজশাহী বা অন্য কোথাও কি বন্যা হয়েছে বলে খবর এসেছে?” পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। অর্থাৎ দেখা যাছে, রঞ্জন বসুর লেখার এই অংশ আবার আর এক চরমপ্রান্ত বা সবকিছু অস্বীকারের চেষ্টা। উপরের দুই মন্ত্রীর বক্তব্যসহ বিডিনিউজের রিপোর্ট এর প্রমাণ। জানিয়ে রাখা ভাল গত ২৮ আগষ্ট খোদ ঐ  বিডিনিউজ২৪ এর ১.৪৬ মিনিটের এক ভিডিও ক্লিপ রিপোর্টের শিরোনাম হল “রাজশাহীর শহর রক্ষা বাঁধে ফাটল”। ফলে রঞ্জন বসু এবং দিল্লীর বাংলাদেশ দুতাবাসের নামে তার দাবি একশ ভাগ মিথ্যা। এটা বড় জোড় মমতা-নীতিশের বিরুদ্ধে মোদীর পক্ষে রঞ্জন বসুর এক মিথ্যা প্রচারণা মাত্র।

সারকথায় বললে,এই লেখায় ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত সব পক্ষের বক্তব্যগুলোকে একসাথে পাখির একটা চোখ দিয়ে দেখলে যেমন হয় তেমনই এক সঙ্কলন। এককথায় বললে, বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে এসব কথোপকথন গুলো একটাও নয়। ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লড়াইয়ে ফারাক্কা ইস্যু হয়েছিল মাত্র।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[লেখাটা এর আগে  মাসিক অন্যদিগন্তের চলতি প্রিন্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে তা আবার সংযোজন ও এডিট করে ফাইলান ভার্সান হিসাবে ছাপা হল। ]

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s