নির্বাচনী সুবিধা নিবার স্বার্থে মোদীর কথিত অপারেশন


 নির্বাচনী সুবিধা নিবার স্বার্থে মোদীর কথিত অপারেশন

গৌতম দাস
০৪ অক্টোবর ২০১৬, মঙ্গলবার

http://wp.me/p1sCvy-1RL

গত সপ্তাহে লিখেছিলাম মোদি যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর কেরালার কোঝিকোড়ে শহরে জনসভায় জানিয়েছেন যে তিনি সামরিক যুদ্ধ বা যুদ্ধের কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা করতে চান না। বরং কোন দেশ কত বেশি উন্নয়ন করতে পারে, এর প্রতিযোগিতা করতে চান। ফলে সেই প্রতিযোগিতার আহ্বান জানাতে জনসভা থেকে তিনি পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশ্য করে নাম ধরে বক্তব্য রেখেছিলেন। অর্থাৎ যুদ্ধ বিষয়ে যেন তা লেগেই যাচ্ছে এইভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গরম কথা বলে মোদি নিজ জনগণকে আগে তাতিয়েছিলেন, শেষে কোঝিকোড়ে শহরের বক্তৃতায় সব উত্তেজনায় নিজেই ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়েছিলেন। স্পষ্ট করে বলেছিলেন যুদ্ধ নয়, তিনি উন্নয়ন চান। আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘কূটনৈতিক ব্যবস্থা’ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর দিকে তিনি যাবেন না। ‘কূটনৈতিক ব্যবস্থা’ কথার অর্থ কী, সেটাও তিনি স্পষ্ট করেছিলেন। বলেছিলেন, পাকিস্তানকে তিনি ‘টেরোরিজমের’ অভিযোগে বড় প্রভাবশালী বা ছোট রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন এবং আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে প্রচার চালিয়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন। এখন আমরা দেখছি “সার্জিক্যাল অপারেশনএর” নামে আবার এক বুঝরুকি। মোদীর প্রপাগান্ডার লড়াই, যা এখন উভয় পক্ষের দিক থেকেই প্রপাগান্ডার লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়েছে।  অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে মোদী সবশেষে কোন সিরিয়াস যুদ্ধের দিকে যদি না-ই যাবেন, তিনি তা হলে গরম কথায় যুদ্ধের মত হুমকি দিয়েছিলেন কেন?
আমাদের ভুললে চলবে না, মূল ইস্যু ছিল ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের গণ-আন্দোলন। যেটা এখন প্রায় ৮০ দিনের বেশি টানা কারফিউ এর সত্ত্বেও চলছে। ওদিকে কাশ্মিরে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। ইসলামি ঐক্য সংস্থা গত মাসে ২১ আগষ্ট ২০১৬ শক্ত ভাষায় ভারতের সমালোচনা করেছিলেন । (OIC Secretary General Iyad Ameen Madani Monday expressed concern over the situation in Kashmir and called for an immediate cessation of atrocities by India, urging the Indian government for peaceful settlement of the dispute ‘in accordance with wishes of Kashmiri people and the UNSC resolutions’.।) বিগত ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নেয়া এক প্রস্তাব হল কাশ্মীরবাসী ভারতে থাকতে চায় কি না তা জানতে গণভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। ওআইসি সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবি জানায়েছিল।  ওআইসি কাশ্মীরের প্রতিরোধ লড়াইকে তাদের “আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য লড়াই” মনে করে, তাও জানিয়েছিলেন। কাশ্মীরের নিরস্ত্র গ-আন্দোলনের ধারার রাজনৈতিক দল হুরিয়াত কনফারেন্স। ওআইসির বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়ে তাদের বিবৃতির ভাষা ছিল আরও কড়া। তারা তুরস্ক সরকারের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশন পাঠাবার সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানিয়েছিল।  ওদিকে এ বিষয়ে জাতিসংঘে ভারত ও পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি পরস্পরের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস সংগঠন হিউম্যান রাইট কাউন্সিল  দুই রাষ্ট্রের দুই কাশ্মির অংশেই সরেজমিন গিয়ে তদন্ত ও প্রত্যক্ষ দেখে যাচাই করে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তান ও ভারত উভয় সরকারের কাছে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে অনুমতি চেয়েছিল। জবাবে পাকিস্তান তৎক্ষণাৎ রাজি বলে জানালেও ভারত এখনো এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। ওদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং তা মিডিয়ায় আসা শুরু করেছিল এই বলে যে, ক্রসফায়ারের নামে গ্রাম ঘিরে তরুণ নেতা বুরহান ওয়ানিকে খুঁজে বের করে হত্যা করলে যে জনগণ কার্ফু ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে যাবে – এ’সম্পর্কে ভারতের গোয়েন্দা বাহিনী কিছুই আগাম জানাতে পারে নাই। এখানেই এবং এ’ঘটনা থেকেই ভারতের কাশ্মিরে কেন্দ্রীয় সরকারের এক মারাত্মক গোয়েন্দা ব্যর্থতা ঘটেছে। এই ব্যর্থতার কারণেই কাশ্মিরের বহু জেলা শহর এখন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিয়মিত আনন্দবাজারের মতো পত্রিকা মোদি সরকারের কাছে এসব বিপদের দিক তুলে ধরেছিল। আর প্রতিদিন ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী মিডিয়া এই ব্যর্থতা নিয়ে সোচ্চার হচ্ছিল। ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠার আগে জনগণের দৃষ্টিকে ও মিডিয়াকে কাশ্মির থেকে সরানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেছিলেন মোদি। তাই ভারতের সীমান্ত শহর উরির ব্যারাকে হামলায় ১৮ সেনা হত্যা – তা সে যেই ঘটাক, একে ইস্যু করে মোদি দৃষ্টি সরানোর কাজ করতে সফল হন। মিডিয়া ও জনগণ থেকে কাশ্মিরের গণ-আন্দোলন বা লাগাতর কারফিউ কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার উল্লেখ এতে হাওয়া হয়ে যায়। নতুন প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ আসন্ন কি না’, আর ‘পাকিস্তান থেকে আসা কথিত জঙ্গি’ এসব হয়ে যায় মিডিয়ার মূল প্রসঙ্গ। এগুলোই যেনবা সব সমস্যার কারণ। এই দৃষ্টি ঘুরাতেই মরিয়া হয়ে যুদ্ধের হুমকির গরম বক্তৃতার আশ্রয় নিতে হয়েছিল মোদিকে।
কিন্তু তাতে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায়  – ম্যালেরিয়া হওয়াতে রোগীকে কুইনাইন খাওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু এখন কুইনাইনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া শরীরে ছেয়ে মারাত্মক হয়ে গেছে, ফলে তা কমানো হবে কী দিয়ে? নিজেরই বাজানো ও ঝড় তোলা যুদ্ধের দামামা এখন কমাবে কী দিয়ে? অবস্থা দেখে খোদ বিজেপি-আরএসএসের কর্মীরাই নাখোশ, হতাশ হয়ে পড়েছিল। সব দিক বিবেচনা শেষে গত ২৪ সেপ্টেম্বরে নেতাকর্মীদের হতাশার মধ্যেই সবার আগে পাবলিক বক্তৃতায় ‘যুদ্ধ নয়, উন্নয়ন চাই’ আর ‘কেবল কূটনীতি হবে চরম পদক্ষেপ’ বলে নিজের মূল অবস্থান পরিষ্কার ও প্রচার করে নেন মোদী।

আর এর সাথে পরদিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ মোদি নিয়েছিলেন। এক হল, সর্বদলীয় মানে সংসদের সব দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে ডাকা সভা থেকে নিজের ‘যুদ্ধ না, উন্নয়ন আর কূটনীতি’ নীতির পক্ষে উপস্থিত সবার সমর্থন নিয়ে নেন তিনি। দুই. তিনি সব মিডিয়ার কাছে ওই নীতির পক্ষে সমর্থন চান। স্বভাবতই তা অন্তরালে। এটি এক কমন ফেনোমেনা এবং চর্চা যে ভারতের জাতীয় ইস্যুতে বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ ইস্যুতে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো আর সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনা বা বিরোধিতা করে না। এবং সেই সাথে সব মিডিয়াও সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষে প্রোপাগান্ডায় মেতে ওঠে। ফলে পরের দিন ২৫ সেপ্টেম্বর কেউ কেউ মোদির বক্তৃতার নেতি রিপোর্ট ও সমালোচনা করলেও ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ভারতীয় মিডিয়া মোদির ‘যুদ্ধ না, উন্নয়ন আর কূটনীতি’ নীতির পক্ষে অবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি একযোগে মোদী সরকারের পক্ষে সামলে নিয়ে আসতে শুরু করে। বলা যায়, দুই দিনের মাথায় পরিস্থিতি মোদির পক্ষে ঘুরে যায়। এ কাজে মিডিয়াও আবার সাহায্য নিয়েছিল কয়েকটি ইস্যুর। যেমন এক. আগামী সার্ক সম্মেলনে একসাথে চার সদস্য দেশের যোগদানের অনীহা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। চার দেশের যোগ না দিতে অনীহার কারণ আলাদা আলাদা ছিল। কিন্তু তা ভারতের কূটনৈতিক লবির কারণে একসাথে প্রকাশ হওয়াতে ভারতের অভ্যন্তরীণ ভোটার কনস্টিটোয়েন্সির কাছে ব্যাপারটাকে ‘মোদির প্রতিশ্রুতি কাজ করছে’ এটা সাফল্য হিসেবে হাজির করতে সক্ষম হয় ভারতীয় মিডিয়া। এ ছাড়া দ্বিতীয় ইস্যু ছিল, ভারত-পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সিন্ধু নদীর পানিবণ্টনের চুক্তি বাতিলের হুমকি। গত ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় নদীর পানিবণ্টন বিরোধ মিটিয়ে এই চুক্তিতে উপনীত হতে পেরেছিল এই দুই রাষ্ট্র। আসলে ভারত-পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী মোট ছয়টি। ওই চুক্তিতে প্রতিটি রাষ্ট্র তিনটি করে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ভাগ করে নেয়, যাতে প্রতি তিন নদীর পানিপ্রবাহের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব এক এক রাষ্ট্রের। এভাবে ওই চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছিল। উভয় পক্ষই এতে এত দিন খুশি ছিল, এখনো পানির পরিমাণ ও ভাগের দিক দিয়ে উভয়ই খুশি। কিন্তু একটি টেকনিক্যাল দিক আছে। তা হল, ওই ছয়টি নদীরই উজানের দেশ হল ভারত। অর্থাৎ ভাটির দেশ হল পাকিস্তান। সোজা কথায় প্রথমে ভারত হয়ে, এরপর ওইসব নদী পাকিস্তানে প্রবেশ করে। ঠিক বাংলাদেশের মত। ফলে নদীর পানিপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ করার ভূ-অবস্থানগত সুবিধাগুলো ভারতের পক্ষে। যদিও আন্তর্জাতিক নদী আইনে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে ভাটির দেশকে প্রাপ্য পানিবঞ্চিত করা সম্পুর্ণ বেআইনি। কিন্তু মোদি ব্যাপারটিকে অন্তত প্রোপাগান্ডায় নেয়ার জন্য ওই চুক্তিকে রিভিউ বা পুনর্মূল্যায়ন করে দেখার জন্য সরকারি আমলা ও টেকনিক্যাল লোকদের প্রতি নির্দেশ জারি করেছেন। বাস্তবে ভারত এই চুক্তি ভঙ্গ ও অমান্য করবে কি না, বাঁধ অথবা কোনো বাধা তৈরি করবে কি না সেটা অনেক পরের ব্যাপার; কিন্তু ইতোমধ্যে মোদির ওই নির্দেশ ভারতীয় মিডিয়া ব্যাপক প্রচারে নিয়ে গেছে। মোদী হুশিয়ারী দিয়ে বলছেন, “রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না, হুঁশিয়ারি মোদীর”। ফলে সাধারণ ভারতীয়দের মনে মোদী যুদ্ধ করার উসকানি যতটা তাতিয়েছিল, তা অনেকটাই এবার প্রশমিত হয়েছে এতে। যদিও মিডিয়ার এক কোণে ভারতীয় টেকনিক্যাল লোক বা প্রকৌশলীরা মন্তব্য করেছেন, এই পানি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব, কারণ এটি প্রবল খরস্রোতা ও খাড়া প্রবাহিত পাহাড়ি নদী। আবার পাকিস্তান থেকেও ওখানকার মিডিয়ায় পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে বলা হয়েছে, বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করা হলে তা বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। তবে সুবিধা হল, ভারতীয় মিডিয়া এই খবরটাকে নিজ দেশে তেমন প্রচারে নেয়নি। অবশ্য প্রথম দিন রাশিয়া-পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পূর্বনির্ধারিত এক যৌথ মহড়া এ সময়ে শুরু হওয়ার কথা ছিল, আর তা যথাসময়েই শুরু হয় বলে এটাকে ভারতের জনগণের মন খারাপ করা খবর ও ভারতের কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবে ফুটে উঠেছিল। কিন্তু ভারতের মিডিয়া সেটাও সফলভাবেই সামলে নেয়।

অপর দিকে পাকিস্তানের ডন পত্রিকা আরেক খবর ছাপে যে, লাহোরে চীনা অ্যাম্বাসির কনসাল জেনারেল পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের (প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই) সাথে দেখা করার সময় ভারত-পাকিস্তান বিরোধে চীন পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে বলে জানিয়েছে। শাহবাজের তরফ থেকে বিবৃতির সূত্রে খবরটি ছাপা হয়। এই খবরটি পাক্কা দুই দিন টিকে থাকতে পেরেছিল। দুই দিন পরে চীনের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের রেগুলার ব্রিফিংয়ে এমন খবর তাদের জানা নেই বলে জানায়। তবে এ বিষয়ে চীনের অবস্থান প্রকাশ করে। তা হল, উভয় দেশ যেন সামরিক বিরোধে না জড়িয়ে বসে ডায়ালগে সমাধান খোঁজে, চীন এর আহ্বান জানায়। ভারতীয় মিডিয়া এ খবরটি ব্যাপক প্রচারে নিয়ে যাওয়াতে এটিও মোদির পক্ষে জনগণের সমর্থন আনতে সাহায্য করে মিডিয়া। শুধু তাই নয়, ভারতের মিডিয়ায় প্রচার শুরু করে যে, আমেরিকা ভারতের পক্ষে আছে। যেমন- আনন্দবাজারের এক খবরের শিরোনাম হলো, ‘চাপের মুখেও পাক তর্জন, মার্কিন প্রশাসন পাশে আছে ভারতের।’ কিন্তু এটাকে প্রোপাগান্ডা বলছি কেন? অথবা আসলেই চীন ও আমেরিকার ভারত-পাকিস্তান বিরোধে অবস্থান কী, কেন? আর সেটাই বা কত দিন থাকবে বা জেনুইন কি না? পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার সমস্যা হিসেবে কংগ্রেস নেতা, সাবেক কূটনীতিক, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, কেরালার এমপি শশী থারুর তাকে উদ্ধৃত করে হংকংয়ের এক মিডিয়া জানাচ্ছে, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা খুবই চ্যালেঞ্জের কাজ। কারণ, বিভিন্ন রাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ এর মধ্যে জড়িয়ে আছে। আমেরিকার আফগানিস্তানের কারণে পাকিস্তানকে দরকার। চীন পাকিস্তানে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের এক একক বড় প্রকল্প নিয়েছে। যেটা দক্ষিণে বেলুচ সমুদ্রসীমায় এক গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে সেখান থেকে দক্ষিণ থেকে উত্তর অবধি পাকিস্তানের বুক চিরে এরপর চীনের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে, এমন সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা হচ্ছে। এ বছর শেষে তা প্রথম পর্যায় শেষ করা হবে। উদ্দেশ্য, এই সড়ক চীনের একমাত্র মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশ জিনজিয়াংয়ের কাশগড় পর্যন্ত যাবে। এভাবে পিছিয়ে পড়া এবং ভূমিবেষ্টিত এই প্রদেশকে সমুদ্র পর্যন্ত এক্সেস দেয়া, যাতে পণ্য আনা-নেয়া সহজ হয়ে যায়। এটা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর নামে পরিচিত। ফলে এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে চীন থেকে আলাদা করা সত্যিই কঠিন।

এ তো গেল দ্বিপক্ষীয় কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ আছে- গ্লোবাল অর্থনীতি অর্থাৎ গ্লোবাল ক্যাপিটালের স্বার্থ। গত মাসে চীনে জি-২০ এর সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। জি-২০ মানে হল, অর্থনীতির সাইজের দিক থেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় উপরের দিকের রাষ্ট্র যারা – এমন টপ ২০টি বড় অর্থনীতির দেশের সম্মেলন। উদ্দেশ্য গ্লোবাল অর্থনীতিতে কিছু কমন সাধারণ স্বার্থের দিক নিয়ে একমত হওয়া ও সিদ্ধান্ত নেয়া। যেমন এবারের মূল ঐকমত্য হল, গ্লোবাল মন্দা বিষয়ে। দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়ায় ১৯৩০ সালে প্রথম মহামন্দা আসে। মহামন্দার সারার্থ হলো, সব রাষ্ট্রের নিজ মুদ্রার মান-দাম কমিয়ে অন্যের ওপর বাজার সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে অন্যকে ডুবিয়ে নিজে টিকে থাকার চেষ্টা। এই ঘটনার লেজ ধরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসেছিল, যা থেকে প্রতিকার হিসেবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্ম। এ প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হলো আবার যাতে মন্দা না হয় তা ঠেকানো। তবুও ২০০৭-০৮ সালে আবার মন্দা দেখা দিয়েছিল। আফগানিস্তান-ইরাকে যুদ্ধে গিয়ে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের বিপুল যুদ্ধ খরচের এই ভারসাম্যহীনতা থেকে এর জন্ম বলে মনে করা হয়। আমেরিকাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বিপুল অর্থ ঢেলে ব্যক্তি-কোম্পানিগুলোর ধস ঠেকায়। অথচ পশ্চিমের বাইরে চীন তখনো ডাবল ডিজিটের অর্থনীতি টেকাতে পেরেছিল, কারণ সে যুদ্ধের বাইরে। ফলে পশ্চিমাদের চোখে গ্লোবাল মন্দা ঠেকানোর ক্ষেত্রে চীনকে এক ত্রাতা হিসেবে দেখা হয়েছিল। চীন টিকলে তার ছোঁয়া ও প্রভাবে পশ্চিম তার সঙ্কট কাটাতে সুবিধা পাবে তাই। মন্দা দুনিয়াজুড়ে ছেয়ে যেতে বাধা হবে চীন তাই। পশ্চিম সেই থেকে মন্দা একেবারে কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ওদিকে গত দুই বছর চীনের অর্থনীতি নিচের দিকে; কিন্তু ইতোমধ্যে ভারতে আগের কংগ্রেস আমলে ডুবে যাওয়া ভারতের অর্থনীতি এবার মোদির আমলে এখনো উঠতির দিকে। গ্লোবাল অর্থনীতিতে যে রাষ্ট্রের অর্থনীতিই উঠতির দিকে পশ্চিমের চোখে সে আকর্ষণীয় ও আদরের। অতএব কোনোভাবেই ২০০৭-০৮ সালের মহামন্দা আবার ফিরে আসুক তা ঠেকাতে সবার মিলিত প্রচেষ্টাই এবারের জি-২০ এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল। ফলে এবার জি-২০ এর সর্ব সম্মতিতে, সবাই মিলে প্রতিশ্রুতি ও সিদ্ধান্ত নেয়, সঙ্কটের মুখে নিজ মুদ্রার মান-দাম কমানো এমন পদক্ষেপের পথে কেউ যাবে না। এ কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ফলাফলে তা গ্লোবাল অর্থনীতিকে ডুবিয়ে মন্দার দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। অতএব এই বৈশ্বিক সাধারণ স্বার্থের কারণে বড় অর্থনীতির কোনো রাষ্ট্রই সম্ভাব্য এই যুদ্ধকে নিজের স্বার্থের বিপক্ষে, নিজের জন্য বিপদ হিসেবে দেখে। যেন বলতে চায়, যুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন দেয়ার বা পাওয়ার এটা সময় নয়।
গ্লোবাল উদ্বেগ ও ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থের এ দিকটি সম্পর্কে মোদির জানা, সবাই তাকে সতর্ক করেছে; কিন্তু তবুও মোদির কিছু একান্ত স্বার্থ আছে। একালে দলের সঙ্কীর্ণ স্বার্থকে রাষ্ট্রের স্বার্থ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চল শুরু হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সবচেয়ে বড় উত্তর প্রদেশে (সাথে পাঞ্জাবসহ আরো কয়েকটি) রাজ্য সরকারের নির্বাচন। এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মোদি বা বিজেপি এখানে হেরে গেলে এখান থেকেই নীতিশ-মমতার নেতৃত্বে আগামী ২০১৯ সালের কেন্দ্রের নির্বাচনের লক্ষ্যে আঞ্চলিক দলগুলোর জোট গঠনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পাকিস্তান ইস্যু হওয়ার সম্ভাবনা।
ওপরে লিখেছিলাম, মিডিয়াসহ মোদি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর তৃতীয়টি হল, খুবই সীমিত পর্যায়ে সামরিক অ্যাকশন, যাতে আগামি ভোটে মোদির মুখ রক্ষা হয়। ভোটের বাক্স ভরে উঠে। এক কথায় বললে, “যুদ্ধ না উন্নয়ন আর কূটনীতি” এই নীতির পক্ষে ভারতের মিডিয়া একযোগে দাঁড়িয়েছিল খুবই সফলভাবে। মানুষের মন থেকে যুদ্ধে না যাওয়ার পক্ষে আগের তাতানো ক্ষোভ প্রায় সবটাই প্রশমিত করে আনতে পেরেছিল; কিন্তু সম্ভবত সামরিকবাহিনীকে আগেই প্রধানমন্ত্রী মোদী সীমিত হামলার কোনো পরিকল্পনা তৈরি করে আনতে বলেছিলেন, যা তারা হাজির করেছিল একা মিডিয়াই তাতানো ক্ষোভ প্রায় সবটাই প্রশমিত করতে পারার পরে। সেই অর্থে আবার এই সামরিক এডভেঞ্চার তা ছোটখাট বলা হলেও মোদীর সেদিকে না গেলেও চলত।  কিন্তু সম্ভবত লোভে পড়ে, বাড়তি লাভের আশায় মোদী এই সামরিক অ্যাকশনের পক্ষে সম্মতি দিয়ে দেন। এই পরিকল্পনা মোতেও ছট খাটও নয়, রিস্কবিহীনও নয়। বরং মোদীর ভারতের জন্য আগুন নিয়ে খেলার মত রিস্কি। কিন্তু মোদী আগামি ফেব্রুয়ারির গুরুত্বপুর্ণ রাজ্য নির্বাচনে ভাল করার লোভে এই আগুন নিয়ে খেলা খেলতে গিয়েছেন। এর অর্থ এখন মূল্যায়ন বসলে পরিস্কার দেখা যাবে, আগামী নির্বাচনে ভোটে সুবিধা দেয়ার কাজেই সামরিক বাহিনী ও এর ঐ পরিকল্পনা দেশের নয় দলের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে গেছে। বিশেষত সামরিক হামলা তা যত ছোট দিয়ে শুরু হোক না কেন, এখন পাল্টাপাল্টি বড় থেকে আরো বড় হামলার দিকে দুই দেশ জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠবে। এ সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। শেষে এটা পুর্ণ যুদ্ধে না পরিণত হয়। যেটা তারা উভয়ে কেউ চায় না; কিন্তু সেখানেই গিয়ে পৌঁছবে। বিশেষ করে ভারত “সার্জিক্যাল অপারেশন” এই গালভরা নামের হামলা করতে গিয়ে যে কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, ইচ্ছা না থাকলেও ভারতকে এরপর আরেক দফা হামলায় যেতে হবে। কারণ ভারতের ঐ গালভরা নামের হামলায় এক ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের হাতে ধরা পরে আছে। ভারত প্রথম হামলা করার পর  মিডিয়াকে বীরদর্পে জানিয়েছিল, নিজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই তারা নাকি পাকিস্তানের ‘অনেক’ ক্ষয়ক্ষতি করে দিয়ে এসেছে। যেন বলা হচ্ছিল, এখন ভারতের মিডিয়া মোদীর পক্ষে নির্বাচনী ক্রেডিট বিতরণ করতে নেমে পড়তে পারে। কিন্তু সন্ধ্যা লাগতেই জানা গেল, এক ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের হাতে আটকা পড়ে আছে। অথচ এটা আগে থেকেই এটা জানা সত্ত্বেও ভারতীয় বাহিনীর নেতারা তা লুকিয়ে অস্বীকার করে রেখেছিলেন। এটা ছাড়া যেটা এখন আর এক সবচেয়ে বড় সমস্যা তা হল – দুই দেশের বাহিনীই এখন প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে ঢুকে গেছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতির নিরপেক্ষ সত্যতা জানা প্রায় অসম্ভব। তবে কি পূর্ণ যুদ্ধের (পারমাণবিক বোমা পকেটে রেখে) দিকেই যাবে বা যাচ্ছে পরিস্থিতি? সেই সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। দুই পক্ষই তা না চাইলেও নিজ নিজ জনগণের কাছে বীরত্ত্ব আর  ‘ইজ্জত রক্ষার স্বার্থ’ দেখাতে গিয়ে পূর্ণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ভাল সম্ভাবনা আছে।  এই সম্ভাবনা প্রবলতর হবে যদি না মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন-আমেরিকা যৌথভাবে এগিয়ে আসে ও মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায় । পুরনো ইতিহাস বলছে, মধ্যস্থতাকারীর কিছু ভূমিকা আছে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

[লেখাটা এর আগে গত ০২ অক্টোবর ২০১৬ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার অনলাইনে (প্রিন্টে ০৩ অক্টোবর) ছাপা হয়েছিল। এখানে তা আরও সংযোজন ও এডিট করে আবার ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s