লিবারেল স্পেস ও ক্ষমতা
গৌতম দাস
২৫ অক্টোবর ২০১৬,সোমবার
http://wp.me/p1sCvy-1S5
আধুনিক রাষ্ট্রধারণার গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গী ধারণা হল ‘লিবারেল স্পেস’। রাষ্ট্রধারণার সাথে জড়াজড়ি করে আছে এই ধারণা। ইংরেজি স্পেস শব্দের সাধারণ বা আক্ষরিক অর্থ জায়গা। তবে সুনির্দিষ্ট পটভূমিতে বললে এর অর্থ জায়গা দেয়া। ‘জায়গা’ কী অর্থে? রাষ্ট্র তার নিয়মকানুন, আইন ও ক্ষমতার কারণে ও প্রয়োজনে জনগণকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে না। একটু ঢিলেঢালা রাখবে, এই অর্থে জায়গা। মানে হল, রাষ্ট্র, আমি তোমার নিয়মকানুনের মধ্যেই আছি। কিন্তু আমাকে একটু জায়গা দাও খোলামেলা শ্বাস নেয়ার জন্য, ভালোভাবে দাঁড়ানোর জন্য কিংবা মুক্ত অনুভব করার জন্য, যাতে করে আরামে দাঁড়াতে ও নড়াচড়া করতে পারি। তবে এর সাথে অব্যক্ত ও অনুল্লেখ থাকে আর এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা অংশ। তা হল – তাতে আমি তোমার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করব না, করছি না। অথবা উল্টো করে বলা যায়, তোমার ক্ষমতা যাতে চ্যালেঞ্জ না হয়ে পড়ে ওই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগের মাত্রা পর্যন্ত আমাকে একটু মুক্ত জায়গা দাও। সারকথায়, এটা এক রিলেটিভ মানে তুলনামূলক বা সাপেক্ষ অবস্থা; ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করা হবে না এই ‘সাপেক্ষে মুক্ত’ থাকতে চাই, এটাই এর সূক্ষ্মতর ও অনুল্লেখিত দিক। ওদিক স্পেস এর আগের শব্দ লিবারেল, ইংরেজি ‘লিবারেল’ কথাটার অর্থ মুক্ত। ‘লিবার্টি’ শব্দ থেকে এসেছে এটা।
তাহলে পুরো কথা দাঁড়াল, লিবারেল স্পেস কথার ভেতর লিবারেল শব্দটি ঠিক অবাধ অর্থে ‘মুক্ত’, এমন ধারণা বহন করে না, বরং ‘সাপেক্ষে মুক্ত’- এই ধারণা ও অর্থ বহন করে। যেমন কোনো স্বামী-স্ত্রীর বেলায় আমরা প্রায়ই এমন শুনি, এদের কোনো একজন অপরজনের বিরুদ্ধে অনুযোগ করছেন, সে স্পেস দেয় না। অর্থাৎ এখানে অনুযোগ করে বলা ‘স্পেস’ শব্দের আদর্শ অর্থ হল, প্রথমজন বলতে চাচ্ছেন তার আকাঙ্খা হল, তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব না পড়ে অথবা দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য কোনো ক্ষতিকর না হয় ইত্যাদি দিক খেয়াল রেখে বা এই সাপেক্ষে সে তৃতীয় লোকজনের সাথে ওঠাবসা, মেশামিশি ও চলাফেরা করতে চায়। এতে অন্যজন সেটা অনুমোদন করছে না। এই অর্থে এখানে স্পেস কথার মানে, ‘সাপেক্ষে মুক্ত’ থাকতে চাওয়ার এক আকাঙ্ক্ষা।
রাজনীতিতে লিবারেল স্পেস
আমরা সমাজ বা পরিবারের মধ্যে ‘লিবারেল স্পেস’ শব্দের অর্থের দিক আলোচনা করলাম। রাজনীতিতে লিবারেল স্পেস ধারণা পরিবারের ভেতরের মতো সরল নয়। রাজনীতির একটা অর্থ হল, আইডিয়া বা মতাদর্শ। অন্য আর এক অর্থ হল, ক্ষমতা। এই ক্ষমতা সম্পর্কিত ধারণা লিবারেল স্পেস কথার সাথে আরো স্পষ্ট করে সম্পৃক্ত ও ঘনিষ্ঠ। আমরা অনেকে ‘লিবারেল ধারার’ রাজনীতি বলে একধরনের রাজনীতির কথা শুনে থাকি। এ ছাড়া, পশ্চিমা জগতের রাষ্ট্র এবং ওই জগতের প্রায় সব রাজনৈতিক ধারা প্রত্যেকেই নিজেকে লিবারেল রাজনীতিক ধারার রাজনীতি, এমন নাম-পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যে চেনাতে পছন্দ করে। যদিও পশ্চিমের ট্র্যাডিশনাল বা যারা চিন্তাভাবনা সহজে বদলাতে চায় না, এমন অর্থ ও বৈশিষ্ট্যের রাজনৈতিক দল বুঝতে বলা হয়, রক্ষণশীল (ইংরেজিতে কনজারভেটিভ, যেমন ইংল্যান্ডের টোরি দল, যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরন) দল বলা হয়। আর এই দলের বিপরীত বুঝাতে ‘লিবারেল’ শব্দ ব্যবহার করে লিবারেল দল বলার রেওয়াজও আছে। তবে এগুলো দাবি করা অর্থে। মূলত উভয় ধারাই মোটা দাগে লিবারেল ধারার রাজনীতি করে। সোজা কথায়, রাজনৈতিক দলকে লিবারেল বলার ভেতরেও একধরনের বাড়াবাড়ি দাবি সেখানে থাকে। যেমন পশ্চিমের লিবারেল ধারা মুখে যা-ই বলুক, আসলে সে যে ক্ষমতায় আছে, এটা অটুট থাকা সত্ত্বেও সে একটা মিথ্যা ভাব বজায় রাখতে চায় যে, তার ‘অপর’ বা বিরোধী যারা- এরা ঠিক যেন ‘তার ক্ষমতাসাপেক্ষে শুধু মুক্তই’ না, তার সমাজ-রাষ্ট্রে যেন সবাই পুরোপুরি ও অবাধভাবেই মুক্ত। ফলে যেন দাবি করা হয়, ঐ সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষমতা ও বলপ্রয়োগ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। ফলে যেন কোনো ক্ষমতার সাপেক্ষে লিবারেল স্পেস নয়, অথবা যেন কোনো বলপ্রয়োগ সেখানে অনুপস্থিত। অতএব ওই সমাজে সবাই মুক্ত এবং সবাই কোনো বাধাহীন অর্থে এক লিবারেল স্পেসে বসবাস করে। অর্থাৎ সমাজে জলজ্যান্ত ক্ষমতা ও বলপ্রয়োগের উপস্থিতি সত্ত্বেও তাকে আড়াল করে দাবি করা যে, সবাই পুরো স্বাধীন বা মুক্ত। এটাই সেই বাড়াবাড়ি মিথ্যা দাবি। এই অর্থে, এটাকে পশ্চিমের ছলনা বলছি। তাহলে সারকথা হল, লিবারেল ধারার রাজনীতি যত লিবার্টি বা মুক্তসমাজের কথার প্রপাগান্ডা চালাক, অথবা এমন ছলনা করুক না কেন- সব সময় মনে রাখতে হবে, আসলে এখানে মুক্ত মানে অটুট একটা ক্ষমতার সাপেক্ষে মুক্ত, যদি আপনি ওই ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ না করেন, এই সাপেক্ষে এই শর্তে ও সীমায় আপনি অবশ্যই মুক্ত। যতক্ষণ না ক্ষমতাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেন ততক্ষণ আপনি মুক্ত। পশ্চিমের লিবারেল ধারার এমন রাজনীতিরই ব্রান্ড নাম ‘গণতন্ত্র’- এই ব্র্যান্ডেই এটা প্যাকেটজাত হয়ে আমাদের দেশেও হাজির আছে।
রাজনৈতিক আইডিয়া বা মতাদর্শে লিবারেল স্পেস
সব সমাজেই রাজনীতিতে নানা আদর্শ বা আইডিওলজি সদর্পে আছে ও থাকে। এভাবেই এটা কাজ করে এবং থাকবেই। এমন নানান রাজনৈতিক আইডিয়ার ধারাগুলোকে মোটা দাগে তিনটি ভাগ বা প্রকরণে ফেলতে পারি – কমিউনিস্ট, গণতান্ত্রিক (পশ্চিমা অথবা লিবারেল) আর ইসলামি। লিবারেল স্পেস ধারণাটির প্রতি এই তিন ধারারই মনোভাব কেমন অথবা কিভাবে এরা দেখে, সেদিক থেকে এখন কথা তুলব। যেকোনো রাজনৈতিক আইডিয়ায় কোনো লিবারেল স্পেস ধারণা আছে কি না, কেমন করে আছে আর থাকলে কিভাবে কতটুকু কী অর্থে আছে, তাই পরখ করব। এ কাজটি করার একটা সহজ উপায় নিব তা হল, তিন রাজনৈতিক ধারারই প্রত্যেক প্রবক্তাকে জিজ্ঞেস করা, তার রাজনৈতিক ধারার বিরোধীদের প্রতি তার মনোভাব কী? যারা তার বিরোধী বা ‘অপর’, তাদের তিনি কিভাবে দেখেন? যারা তার আইডিয়া বা বয়ানের সাথে একমত হবে না, একমত নয় বলে জানাবে, তাদেরকে তিনি কী করবেন? কোথায় রাখবেন?
প্রথমে কমিউনিস্ট ধারা- দেখা যাক এ ক্ষেত্রে কী বের হয়। এরা বলবে, লিবারেল স্পেস, সেটা আবার কী? সমাজ মাত্রই শ্রেণী বিভক্ত সমাজ। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে, শ্রমিক-কৃষক শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে আমরা এখন ক্ষমতায় আছি (অথবা যাব)। আমার বিরোধী ‘অপর’ মানে, সে তো আমার শ্রেণী-শত্রু। তাকে আবার ‘লিবারেল স্পেস’ দেয়ার কী আছে? বরং শত্রু-শ্রেণীকে দাবড়ের উপর তটস্থ রাখাই তো আমার কাজ। সঠিক শ্রেণী সংগ্রাম। অর্থাৎ লিবারেল স্পেস বলে ছোটখাটো ছলনা অথবা অবাধ ও লিবার্টিতে মুক্ত দাবি করে বড় কোনো ছলনা – কমিউনিস্টরা এমন কোনটারই ধার ধারতে চায় না। এ জন্য এদেরকে ঘোষিত ‘নো লিবারেল স্পেস’ ধারা গোত্রের বলা যায়।
এবার পশ্চিমা লিবারেল গণতন্ত্রের ধারা- এর ক্ষেত্রে দেখা যাক। প্রথমত এরা বলবে মানে ভুয়া হলেও দাবি করবে, আমার সব ‘অপরই’ মুক্ত। ওরা মুক্ত থাকবে; আমাকে সমালোচনা ও প্রতিবাদ করবে, মানি না বলে স্লোগান দেবে, আমার বিরুদ্ধে আর্টিকেল লিখবে- কোনো অসুবিধা নেই। কেবল একটা খালি ‘কিন্তু’ আছে। সেটা হল, খালি আমি যদি বুঝি যে, ওরা আমার ক্ষমতার জন্য বিপদ, আমাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বা করছে, তাহলে কিন্তু রাষ্ট্রের আইনে থাকুক আর না-ই থাকুক, আইন ছাড়াই অথবা নতুন আইন বানিয়ে নিয়ে (আমেরিকায় যেমন প্যাট্রিয়ট ল, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইত্যাদি এবং বাংলাদেশে বিশেষ ক্ষমতা আইন) অথবা নানান নিবর্তনমূলক নির্যাতনের আইনের মাধ্যমে আমি তাদের কোনো ধরনের খাতির না করে, একেবারে নির্বিশেষে সরাসরি নির্মূল করব। দেখা যাচ্ছে, এরা প্রকৃতপক্ষে লিবারেল না, বরং কিছু শর্তসাপেক্ষে লিবারেল। অবশ্য মুখে এরা দাবি করে যাবে, তারা অবাধ ও লিবারেল।
এবার পরের ধারার যাবার আগে বর্তমান সরকারকে একটু মূল্যায়ন করা যাক। উপরের দুই ক্যাটাগরি অনুসারে বর্তমান সরকারকে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলব? অবশ্যই প্রথমটা। তবে একটা জায়গায় একটু বদল হবে। কমিউনিস্টদের বেলায় তারা বলে তারা শ্রমিক-কৃষক শ্রেণীর ক্ষমতা। এখানে সে জায়গায় হবে – মুক্তিযোদ্ধা-শ্রেণী অথবা চেতনা-শ্রেণীর ক্ষমতা। যেমন সরকার বলছে এই সরকারের চেতনার মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। ফলে এই শ্রেণীর অথবা সরকারের বিরোধী বা শত্রু যারা, তারা তাহলে রাজাকার। ক্ষমতাসীন সরকারের দৃষ্টিতে এই সরকারের বিরোধী বা ‘অপর’ যারা তারা যেহেতু রাজাকার অতএব তাদের তাদের দমন ও দাবড়ে রাখাই তো সরকারের কাজ। অতএব তাদের জন্য আবার স্পেস কী?
এবার ইসলামি ধারার ক্ষেত্রে দেখা যাক- বাংলাদেশে হয়ত অনেককে পাওয়া যাবে, যাদের এমন ধারার ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। কিন্তু সবার আগে একটা কথা বলে নেয়া দরকার। এই রচনার পুরো অংশজুড়ে এটা ধরে নেয়া হয়েছে যে, এখানে ক্ষমতা বলতে, গণ-আন্দোলনের পথে বা কনষ্টিটিউশন মেনে নির্বাচিত হতে – এভাবে ক্ষমতা পেতে যারা আগ্রহী তাদেরকেই ধরে নেয়া হয়েছে। যেসব ক্ষমতা কনষ্টিটিউশন মেনে নির্বাচিত নয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই রচনার বাইরে। তাই নির্বাচিত ক্ষমতাগুলোর ক্ষেত্রে সবার সাধারণ দিকটি আমল করে কথা বলব। এদের অনেকে হতে পারে যারা নিজের রাজনীতি ইসলামি বলে মনে করে ও দাবি করে। এখন তারা যদি নির্বাচিত হয় তবে নিজেদের ক্ষমতাকে তাদের কেউ কেউ ইসলামি ক্ষমতা বা ইসলামি শাসন বলে দাবি করবে। অবশ্য কেউ কেউ নাও করতে পারে। তবে যারা তাদের ক্ষমতাকে আল্লাহর শাসন বা কুরআনের শাসন বলে দাবি করবে, তাদের কথা বলছি। নির্বাচিত নিজের ক্ষমতাকে আল্লাহর শাসন অথবা ইসলামি রাজনীতির শাসন বলার বা দাবি করার ক্ষেত্রে নতুন জটিলতা আছে। কারণ, যেকোনো ক্ষমতা মাত্রই কেউ না কেউ এর বিরোধিতাকারীও হবে, থাকবেই এবং এটা স্বাভাবিক। জটিলতা দেখা দেবে সে ক্ষেত্রে। এ জন্য যে, ওই নির্বাচিত ক্ষমতার বিরোধিতা করলে সেটা আল্লাহর শাসন বা কুরআনের শাসনের বিরোধিতা করা হচ্ছে কি না, এই প্রশ্ন উঠতে পারে। অথচ যে বিরোধিতা করছে, তার এমন কোনো সচেতন ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য না-ও থাকতে পারে। ফলে একটা জটিলতা দেখা দেবে। তাই এ দিকটি নিয়ে ভাবার দরকার আছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পুর্ব-পাকিস্তানের বৈষম্য-বিরোধী যে কোন বক্তব্য বয়ানকে নিজেদের শাসনের বিরোধী ফলে তা ইসলামি রাজনীতির বিরোধী বলে পাল্টা প্রপাগান্ডা হাজির করত। স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি ইসলামি শাসনের বিরোধীতা বলে চিনানোর চেষ্টা করত। এটা কনষ্টিটিউশনে কী লেখা আছে বা ছিল সে মামলা নয়। যেমন বর্তমানে কনষ্টিটিউশনে যাই লেখা থাক ফ্যাক্টস হল, বাস্তবে এই ক্ষমতার বিরোধী হবার সুযোগ খুবই সীমিত। একইভাবে নিজেকে ইসলামি ক্ষমতা বলে দাবি করতে চায় যারা তারা নিজেদের সম্ভাব্য ক্ষমতার বিরোধী বা সমালোচককে কিভাবে দেখা হবে, এই প্রশ্নেও চিন্তা করার দরকার আছে। ইসলামি রাজনীতিতে লিবারেল স্পেস ধারণা নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করা হয়নি। এটা করা উচিত। পুরনো উদাহরণ যেগুলো আছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ‘নো লিবারেল স্পেস’ ক্যাটাগরির।
পাবলিক পারসেপশনে রাজনৈতিক দল
রাজনৈতিক দল কেমন হবে? একালের পাবলিক পারসেপশনে মানে – ঠিক বাস্তবের কথা নয়, বাস্তবে সেটা কী ঠিক তা নয় তবে পাবলিক সেটা সম্পর্কে কী মনে করে ধারণা করে। আবার পাবলিকের মনে আঁকা ছবিতে থাকা আকাঙ্খা বা গণ-অনুমিত আকাঙ্খাটা কেমন? সেটা বোঝার চেষ্টা করব। কিন্তু ‘একালের’ কেন? বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পর থেকে রাজনৈতিক শাসনে এক বিশেষ ধারার বৈশিষ্ট্যের শাসন যুক্ত হয়েছে। অবশ্য মাঝের দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসন- এই ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে পপুলার ভাষায় বললে, একটা দ্বিদলীয় রাজনীতির শাসন শুরু হয়েছিল। আর এই দ্বিদল স্বীকার করে নিয়েছিল, লিবারেল স্পেস আছে বা রাখতে হবে। সেটা যেমন চেহারার বা ছলনার হোক না কেন, একটা লিবারেল স্পেসের ধারণার অন্তত মৌখিক স্বীকৃতি সেখানে ছিল।অবশ্য এটা হওয়া সম্ভব হয়েছিল, এর মূল কারণ হল সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সোভিয়েত ব্লকের পতন। েই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত করেই কেউ দেখতে পারে। তবুও ১৯৯১ সাল থেকে পরের তিন টার্মের বেশি আমরাও ক্ষমতার বিরোধীদের লিবারেল স্পেস আর দিতে পারিনি।
মাঝের দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনে তো বটেই এবং এরপর থেকে যে শাসন খাড়া হল, তা যেন পরিকল্পনা করেই নিজেকে লিবারেল ‘স্পেস রাখার দরকার কী’ বলে সাজিয়েছে। “এর কোন দরকার নেই”- এই ধারার ক্ষমতা হিসেবে নিজেকে হাজির করেছে। বিশেষত ২০১৪ সাল থেকে তৈরি করা ক্ষমতা। আগেই বলেছি এটা কমিউনিস্ট উদাহরণের ‘নো লিবারেল স্পেস’ ধারণাটিকে অনুসরণ করে বেড়ে উঠেছে। যার ভয়ানক জায়গা হল, যারা ‘চেতনার বিরোধী’, তাদের জন্য আবার সরকার বিরোধিতার অধিকার বা ‘লিবারেল স্পেস কী’- এই ধারণার ওপর দাঁড়ানো।
অনেকের মনে হতে পারে আমি ১৯৯১ সাল কেন রেফারেন্স হিসাবে টানছি? এরশাদের পতন আর এরপর পরপর তিনি নির্বাচিত সরকার গঠন হয়েছিল – সেজন্য। এককথায় বললে শুধু সেজন্য তা একেবারেই না। আরও বড় গ্লোবাল পটভুমি একটা আছে। পুরান সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৯০ সাল থেকেই নিজেই ভেঙে যাওয়ার এক প্রক্রিয়া শুরুর ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। যা আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায় ১৯৯২ সালে। ফলে শুরু থেকেই এর আর আগের নিজ প্রভাবিত দুনিয়া অংশকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় এর মুঠি আলগা হতে শুরু করেছিল। আর এর ফলে আমেরিকা এক মেরুর এক দুনিয়া পেয়ে যায়। ফলে এটাই আমেরিকার পক্ষে এবার দুনিয়ায় নতুন করে (সামরিক শাসন দিয়ে সরকার চালানোর বদলে ) “লিবারেল দ্বিদলীয় শাসনের” সূত্রপাত করার মতো নতুন শর্ত হিসেবে উপস্থিত হয়। আমেরিকা সেটাকে আমল করে কাজে লাগিয়ে বাস্তব করে তুলেছিল। আমাদের মতো দেশে এরই মধ্যে আবার এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত জনগণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখান থেকেই একালে রাজনীতি সম্পর্কে পাবলিক পারসেপশনে বা গণ-অনুমিত আকাঙ্ক্ষাটা হলো রাজনৈতিক দলমাত্রই সেটা তো এক ‘লিবারেল’ দলই হবে। আমাদের পপুলার ভাষায় ভোটের রাজনীতির দল।
অন্য আর একটা বিষয়, কনষ্টিটিউশনাল রাজনৈতিক দল, বা আইনী রাজনৈতিক দল কথার মানে আসলে কী? কথাটাকে বুঝতে হবে মোটা দাগে রাজনৈতিক দল দুই ধরণের হয়। মানে তার ঘোষিত লক্ষ্য হাসিলের জন্য শুরু থেকেই সশস্ত্র অথবা নিরস্ত্র পথের দল হতে হয়। নিরস্ত্র পথের দল মানেই ‘মাস লাইন’ বা গণ-আন্দোলনের দল। এই ‘মাস লাইন’ বা গণ-আন্দোলনের দলকেই কনষ্টিটিউশনাল রাজনৈতিক দল, বা আইনী রাজনৈতিক দল বলা যায়। কারণ সে সশস্ত্র নয় বলে অন্তত কৌশল্গত কারণে আর দলের লিখিত দলিলে সে ঐ দেশের কনষ্টিটিউশন মেনে চলে। সম্ভব হয়। তাই এটাকে আইনি দল বলা যেতে পারে। সশস্ত্র দল মানেই তা কনষ্টিটিউশনের চোখে বেআইনি দল হবেই। সে হিসাবে যেমন, সর্বশেষ ৮০’র দশকেও কমিউনিস্টদের মধ্যে রাজনৈতিক তর্কের এক বড় ইস্যু ছিল পার্টি কেমন হবে ‘মাস লাইনের’ না ‘সশস্ত্র লাইনের’। একালের ভোকাবুলারিতে ‘মাস লাইন’ কথাটাও পরিচিতি হারিয়ে ফেলেছে। এখন অচল, হারিয়ে যাওয়া ধারণা। ইংরেজি রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘মাস’ মানে, জনগণ বা ‘গণ’ বলতে যা বুঝি তাই। তাই মাস লাইন মানে হল, দলকে আগানোর জন্য দলের তৎপরতা ‘গণ-আন্দোলনে’ সংগঠিত করে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে আগাবে। সবকিছুই হবে প্রকাশ্য তৎপরতার মাধ্যমে; জনগণকে আকৃষ্ট করে সরাসরি অংশগ্রহণ করানোর এক প্রকাশ্য ‘পপুলার উইল’, ‘রাজনৈতিক পরিসর’ ‘কমিউনিটি’ তৈরি করার মাধ্যমে। এমন দলকে কনস্টিটিউশনাল দলও বলা হয়। কারণ অন্তত মুখে ও পার্টির প্রকাশ্য কাগজপত্র দল দেশের কনস্টিটিউশন মানে বলে স্বীকার করে সে তৎপর থাকে। এছাড়া মনে বা রাজনৈতিক চিন্তায় যাই থাক, সে ভাব ধরে যে, উপস্থিত রাজনৈতিক শাসন ক্ষমতাকে সে চ্যালেঞ্জ করছে না। ফলে লিবারেল স্পেসে নড়াচড়া তৎপরতার সুযোগ সে চায় এবং পায়। এমনকি নির্বাচন কমিশনে দলের নাম রেজিস্ট্রেশন নেয়ার সুযোগও নিয়ে থাকতে পারে। তবে চলতি হাসিনা সরকারের আমলে এ লিবারেল স্পেস ক্রমেই নাই হতে চলেছে।
তবে একালের পাবলিক পারসেপশন বা গণ-আকাঙ্ক্ষায় এটা এখন স্পষ্ট- জনগণের আকাঙ্খা হল, আপনি যে ধারার রাজনীতি নিয়ে আসেন না কেন – একটা লিবারেল স্পেস দেওয়ার বিষয়টা আপনার রাজনৈতিক চিন্তার প্যাকেজে থাকতেই হবে। লিবারেল স্পেস থাকা বিষয়ে জনগণের আকাঙ্খা এবং পারসেপশন আপনাকে পুরণ করেই একমাত্র আপনি হাজির হতে পারেন। চিন্তার একটা লিবারেল স্পেস থাকতেই হবে। লিবারেল স্পেসে নড়াচড়া, তৎপরতার সুযোগ থাকতেই হবে, এ আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠছে ক্রমেই।
আসলে আপনি আপনার ক্ষমতার বিরোধীকে কী করতে চান, বিরোধী অপরের বিরোধিতা কীভাবে মোকাবিলা বা হ্যান্ডেল করতে চান সেকথা আপনাকে আগাম বলতেই হবে। আর এর ভিতর দিয়েই আপনার চিন্তা-রাজনীতি কেমন – তা ধরা পড়ে যাবে। আপনাকে চিনা যাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Goutamdas1958@hotmail.com
[লেখাটা এর আগে গত ০৮ অক্টোবর ২০১৬ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। এখানে তা আবার নতুন কিছু সংযোজন ও এডিট করে আবার ছাপা হল। লেখাটা এরও আগে একেবারেই ভিন্ন কোণ থেকে গত বছর দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশেও ছাপা হয়েছিল। ]