সার্ক ভুলিয়ে দেওয়া যায় নাই
গৌতম দাস
১৪ নভেম্বর ২০১৬,সোমবার,
গত সেপ্টেম্বর মাসে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার “বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক দিনব্যাপী এক আলোচনার আয়োজন করেছিল যার আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন সুহাসিনী হায়দার। তিনি দক্ষিণী ভারতের প্রাচীন এক ইংরেজি দৈনিক ‘দি হিন্দু’ পত্রিকার ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর বা পররাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক। দেশে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেটা গত ১৪ অক্টোবর “দি হিন্দু” পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
সেই সাক্ষাৎকারটা নেওয়া হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন এ’বছরের পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলন বাংলাদেশসহ কিছু দেশের বয়কট এবং বাতিল ঘোষণা হয়েছিল, এর পরপরই। প্রফেশনাল সাংবাদিক সুহাসিনীর একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড হল, তিনি আমেরিকার বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে ব্রডকাস্টিং জার্নালিজম বিষয়ে এমএ করেছেন। এরপর প্রায় ২০ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায়। এর আগে তিনি ভারতীয় সিএনএন-আইবিএন টিভির এঙ্কর ও পররাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ফলে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড আর কেরিয়ার দেখে এটা বলার সুযোগ নেই যে তিনি অভিজ্ঞ নন। তাই, প্রধানমন্ত্রীকে করা তার প্রশ্ন কোনো নাদানের প্রশ্ন তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু লক্ষণীয় দিকটি হল, তার করা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও বিরক্ত হয়েছেন। আমার ধারণা, যারা এই সরকারের বিরোধী, বাংলাদেশের এমন যে কেউও সুহাসিনীর প্রশ্নে বিরক্ত হবেন এবং অপছন্দ করবেন।
কিন্তু কী ছিল সে সাক্ষাতকারে? বাংলাদেশে গত সংসদ নির্বাচনের (২০১৪ জানুয়ারি) আগে-পরের সময় থেকে হাসিনা সরকারের নির্বাচনী বৈধতার ব্যাপারটি বিতর্কিত হয়ে আছে। ঐ নির্বাচনের আগের মাসে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তখনকার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে স্পষ্ট প্রকাশ করে দিয়ে যান যে, এক “অনির্বাচিত নির্বাচনই” তাদের পছন্দ ও সমর্থনের। এভাবেই তারা আওয়ামী লীগ সরকারকেই “নির্বাচিত” দেখতে চান। আর সেই থেকে বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অগ্রহণযোগ্য হয়ে আছে; যদিও বাংলাদেশ সরকারের সাথে ব্যবহারিক কাজের সম্পর্ক তারা রেখেছেন। তবে নির্বাচনী বৈধতার ব্যাপারটি বিতর্কিত হয়ে আছে, সেটা জানাতেও ভোলেন না। এরপর থেকে “ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থে” বাংলাদেশ চলে, এমন বয়ান অনেকেই রাখেন। বাংলাদেশ একটা Vassal State বলে জাপানভিত্তিক ‘ডিপ্লোম্যাট’ পত্রিকা এক আর্টিকেল ছেপেছিল। সারকথায়, এটা ভারতের দয়ায় চলা ভারতের দিকে ঝুঁকে থাকা সরকার, এমন অভিযোগ মাথায় নিয়েই এই সরকার চলছে। অনেক সময় মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে এমন অভিযোগের অনুকূলে কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই হলো পটভূমিগত পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতির কথা সুহাসিনী হায়দারের অজানা থাকার কোনো কারণ নেই। এসব বিষয়ে তার নিজেরই অনেক রিপোর্ট আমরা দেখেছি। অথচ ঐ সাক্ষাতকারে ঠিক এর বিপরীত – সুহাসিনীর প্রায় সব প্রশ্নের পেছন এক ধরে নেয়া অনুমান থেকেছে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কেন যথেষ্টভাবে ভারতের তল্পিবাহক হচ্ছেন না অথবা তার আরো হওয়া উচিত, এ ধরনের। এ ছাড়া তার প্রায় সব প্রশ্নই ভিতরেই একধরনের বোকামি বা নাদানিতে ভরপুর উপাদান রয়েছে। যেমন সব রাষ্ট্রেরই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে তার নিজস্ব কিছু বয়ান-অবস্থান থাকে, যা একান্তই তার বয়ান। আর সেটা অন্য রাষ্ট্র বা ভিন নাগরিককেও মানতে হবে, এটা সে আশা করে না বা সেদিকে তাকিয়ে ঐ বয়ান অবস্থান নেয় না। কিন্তু এর পরও সে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে পারস্পরিক স্বার্থে বিভিন্ন মাত্রায় সম্পর্কে জড়ায়। অর্থাৎ নিজের অবস্থানের সাথে অপর রাষ্ট্র একমত না হয়েও সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আগায়। সেখানে অপর রাষ্ট্রকে নিজ রাষ্ট্রের সাথে একমত হতে হবে এমন কোন পূর্বশর্ত থাকে না বা সেটা জরুরিও নয়। এসব বিষয়গুলো ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর হিসেবে সুহাসিনীর জানা না থাকার কিছু নেই। কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নে সুহাসিনী বলতে চেয়েছেন, হাসিনা কেন বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের বয়ান-অবস্থানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন না? কখনও কখনও এটা এমন জায়গায় গেছে যে মনে হয়েছে হাসিনা কেন ভারতীয় অবস্থান নিচ্ছেন না সে প্রশ্ন তুলে হাসিনাকে অভিযুক্ত করতে বা জবাবদিহিতা চাইতেই যেন এই সাংবাদিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং বাংলাদেশে এসেছেন। অর্থাৎ তিনি পেশাদার সাংবাদিক কম বরং জাতীয়তাবাদী সৈনিক বেশি হয়ে উঠা বেশি – হয়ে পড়েছিলেন।
তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, এবারের পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলন বাতিল হওয়া এবং বাংলাদেশের তাতে না যাওয়া প্রসঙ্গে। তিনি প্রশ্ন করছেন- এর ফলে সার্ক কি শেষ হয়ে গেল?
এখানে আগে এই প্রশ্নের পিছনের কিছু তথ্য বলে নেয়া ভাল। ভারতের উরি সামরিক ঘাঁটিতে কথিত হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মোদি সরকার জনমতকে ক্ষিপ্ত করে তুলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষে যুদ্ধে না গিয়ে ‘বিদেশের সাথে সম্পর্কের দিক থেকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করব’ এটাই মোদির চরম অ্যাকশন হবে বলে তিনি কথা শেষ করেছিলেন। আর পরদিন থেকে ভারতের সব মিডিয়া ‘জাতীয়তাবাদী জোশে’ বাস্তবতা ভুলে মোদির কথা সফল করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ফলে সুহাসিনীর প্রশ্নের ভেতর সেই সস্তা জোশই আমরা দেখেছিলাম। যেন সাংবাদিকতায় অবজেক্টিভ থাকার বিষয়টা তিনি ‘জাতীয়তাবাদী’ থাকা দিয়ে বদলে নেয়েছেন। অথচ সস্তা জাতীয়তাবাদ কোনো পেশাদার সাংবাদিকের সাথে কোনোভাবেই মানানসই নয়। আসলে ভারতের মিডিয়ার এক রেওয়াজ হল, পাকিস্তানের সাথে যে কোন যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে (সত্য-মিথ্যা অথবা সরকারের সংকীর্ণ নিজ দলের পক্ষে ভোট পাবার স্বার্থের কারনে যুদ্ধের হুঙ্কার বা পরিস্থতি তৈরি করলেও) বিচার-বিবেচনা শুণ্য উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে সরকারের পক্ষে দল বেধে দাঁড়িয়ে যাওয়াটাই সাংবাদিকতা হয়ে যায় তখন। সেই রেওয়াজে এবারও ভারতের প্রায় সব মিডিয়া চিন্তাশূন্য হয়ে বেকুবের মতো বিশ্বাস করে নিয়েছিল, মোদির হুঙ্কার সত্যি জেনুইন। অথচ জোশ কিছু ঢিলা হবার পরে এই মিডিয়াই লিখেছিল যে আসন্ন ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ভাল রেটিং পাবার সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে মোদী সরকার পাকিস্থানের সাথে যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। অর্থাৎ পেশাদারিত্ব ভুলে ভারতের মিডিয়া এভাবেই বাস্তবতার বিচার-বিবেচনা শুণ্য হয়ে যাওয়া কোন ব্যাপারই না। যেমন মোদীর যুদ্ধের দামামা বা পাশা উল্টে যাবার পরে, (সুহাসিনীর ঐ প্রশ্ন প্রকাশের ছয় দিন পরে) ২০ অক্টোবর আনন্দবাজার লিখেছিল, “পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের জন্মদাত্রী হিসেবে তুলে ধরতে মোদির আহ্বানে সাড়া দেয়নি বেইজিং। …ব্রিকসে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু আগবাড়িয়ে খেলার সেই রণকৌশল নিয়ে আখেরে যে কোনো লাভ হয়নি, বারবার তা সামনে চলে আসছে। চীন, আমেরিকার পরে ব্রিটেনও জানিয়ে দিলো, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের জন্মদাত্রী আখ্যা দিয়ে মোদির সুরে সুর মেলাতে রাজি নয় তারা। এমনকি বেইজিংয়ের সুরেই লন্ডনের ব্যাখ্যা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ত্যাগ স্বীকার করেছে ইসলামাবাদ”। অর্থাৎ এবার খোদ আনন্দবাজারই নিজ দেশের সরকারের সমালোচনা করা ছাড়া উপায় দেখে নাই।
ওদিকে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করবেনই – মোদীর এমন প্রতিজ্ঞার প্রকাশের পর এটা নিয়েও ভারতের মিডিয়া – ‘রাজা যত বলেন পারিষদ বলে তার ততগুণ’ – অবস্থা করে ছেড়েছিল। যেন মোদী তা করেই ফেলেছেন। ব্রিকস – রাইজিং ইকোনমির পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক জোটের এবারের সামিট সম্মেলন ডাকা হয়ে ছিল ভারতের গোয়ায়। সাথে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল যে ব্রিকসের শেষদিনে আর এক দক্ষিণ এশিয়া জোট (BIMSTEC) (The Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation) এর সাথে মিলে যৌথ বৈঠক হবে। বিমসটেক ((BIMSTEC)) আসলে সার্কের পাঁচ রাষ্ট্র আর সাথে বার্মা ও থাইল্যান্ডকে সাথে নিয়ে তৈরি। আর ওদিকে ভারতের কূটনৈতিক খায়েশ ছিল (খায়েশ বলতে হচ্ছে কারণ এটা ভারতের এক এবসার্ড মুরোদধীন কল্পনা। নিজের বাস্তব মুরোদে না, অন্যের ঘাড়ে চড়ে স্বপ্ন-জাল বুনা) যে বিমসটেককে এমনভাবে সামনে আনা যাতে সার্কের প্রয়োজন বা অস্তিত্বের কথা আর মনে না পড়ে। তা সার্কের বিকল্প হয়ে উঠে। ফলে পাকিস্তান বাদ পড়ে। বাস্তবে থাকুক আর নাই, কথার ফুলঝুড়ি তুলতে ওস্তাদ কলকাতার আনন্দবাজার, ০৪ অক্টোবর এক রিপোর্ট লিখেছিল যার শিরোনাম হল, “পাকিস্তানকে এড়িয়ে ‘সার্ক-টু’ করতে চায় নয়াদিল্লি” । আর তাতে প্রথম বাক্য লিখেছিল, “পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্ক সম্মেলন!”। আসলে স্বপ্ন দেখাটা সমস্যা নয়। সমস্যা হল কেন সেই স্বপ্ন বাস্তব হবে না তা ভেবে দেখা ত্যাগ করাটাই সমস্যা। আর সাথে তো আছেই ‘মুই কী হনু রে’ ভাব নেয়া। ব্যাপারটা যেন সবচেয়ে বেশি লেপ্টে গেছে বাংলাদেশে ভারতের এক প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত (২০০৭-০৮ সালে) পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীকে ঘিরে। তিনি বর্তমানে আমেরিকান সাপোর্টে চলা একটি ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ওআরএফের (Observer Research Foundation (ORF)) ফেলো। তার ঢাকায় পোস্টেড থাকার সময়ও তিনি ‘মুই কী হনু রে’ ভাব রেখে গেছেন। প্রায় একই ঐসময়ে বাংলাদেশের কিছু বিশেষ সাংবাদিক ভারতে গিয়েছিলেন। গত ৪ অক্টোবর যুগান্তর সেকথা ছেপেছিল এক রিপোর্ট। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর জবানে যুগান্তর লিখছিল, তিনি বলেন, “এখন সার্কের কথা ভুলে যান। বিমসটেকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে আমি বাংলাদেশকে আহ্বান জানাই”। কথাগুলো পিনাক বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় বলেছেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পিনাক চক্রবর্তীও মোদির কথা সত্যি হয়ে গেছে বা আছে বলে বিশ্বাস করেছিলেন।
ব্যাপারটা কীভাবে শেষ হল? আমাদের প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৬ অক্টোবর এক রিপোর্টের শিরোনাম হল, “সার্কের বিকল্প হচ্ছে না বিমসটেক”। আসলে কোন কিছু বিশ্বাস করার ভিত্তি কী এরা কী করে তা চিন্তা করে আল্লায় জানে। যেন “ভারত চাইছে” – এটুকুই যথেষ্ট সেকথা বিশ্বাস করা জন্য। আসলে গ্লোবাল অর্থনীতির বিকাশ ও এর সাথে ছড়িয়ে পড়া জটিল সম্পর্কের কারণে চীন ও আমেরিকার (আমেরিকাসহ সারা পশ্চিমাস্বার্থের ওয়ার অন টেররের লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় স্প্রিংবোর্ড রাষ্ট্র হল পাকিস্তান) পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের গভীরতা ও নির্ভরশীলতা ভারত পড়তে অক্ষম – এটা তাই প্রমাণ করে। যেন ভারত এমনই এক আদুরে সন্তান যার খেয়ালকে চীনসহ পশ্চিমারাষ্ট্রগুলোকে নিজ স্বার্থ ভুলে গুরুত্ব দিতেই হবে। এবং এটা সম্ভব। এসবের নিট ফয়াফল হল এমন এবসার্ড স্বপ্ন-জাল বুনা। আর এদের চক্কড়ে পড়েছে চিন্তাভাবনা ত্যাগ করা বাংলাদেশেরও কিছু মিডিয়া ও সাংবাদিক। প্রথম আলোর রিপোর্টার রাহীদ এজাজ লিখেছেন, ‘গত মাসে নাটকীয়ভাবে স্থগিত হয়ে যায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। এরপর থেকেই গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোটের নতুন মেরুকরণ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। পাকিস্তানকে ছাড়া সার্ক, এমন একটি ভাবনা সামনে এলেও শেষ পর্যন্ত সেটি ফলপ্রসূ হয়নি। বিশেষ করে সার্কের বিকল্প জোট হিসেবে বিমসটেক যে যথেষ্ট কার্যকর হবে না, সেটি স্পষ্ট হয়েছে গোয়ায় ১৬ অক্টোবর শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের পর”। এখন কথা হল যে ভারতের মিডিয়া এসব গ্লপগাথা বিশ্বাস করছে করুক কিন্তু প্রথম আলো বা রাহিদ এজাজ এরাও এটা বিশ্বাস করেছিল। কেন? কোন টানে বা সুত্রে?
মূলত এমন ঘটনাগুলো ঘটবার পিছনের আর কিছু সমস্যা হল, এটা ঠিক যে চীন ঠেকাতে মরিয়া হয়ে আমেরিকা ভারতকে পাশে চায়। আর তাতে ভারতকে হিতাহিত জ্ঞান ও বাস্তবতা ভুলে অসম্ভব বায়না ধরা বালকের মতো আচরণ করতে হবে কেন? বাস্তবতার মধ্যে বিচরণ করলে তো কোন সমস্যা নাই। তাও হয়তো এটা তেমন সমস্যা মনে হতো না। কারণ আমেরিকার দুর্দশা থেকে ভারত ফায়দা লুটতে চাইলে বলার কী আছে? আর ভারতের তা না নিবার কিছু নাই। কিন্তু বড়ভাই পিঠে হাত রেখেছে বলে, ভারত নিজেই আপনা আপনি এক অর্থনৈতিক বা স্ট্রাটেজিক পরাশক্তি হয়ে গেছে, এই ‘মুই কী হনু রে’-এমন ভাবনাই ভারতের ইন্টেলিজেন্সিয়ার আসল সমস্যা। পিনাকি বা সুহাসিনী এর নমুনা। অথচ মূল সূত্র হল, সবার আগে রাষ্ট্রকে নিজ মুরোদে অর্থনৈতিক অর্থে পরাশক্তি হয়ে উঠতে হয়। সেটাও কেউ বিপদে পড়ে ঘুষ দিয়েছে বা পিঠে হাত রেখেছে- এভাবে অর্জনের জিনিস নয়। দুনিয়ার প্রথম সারির উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের অর্থনীতির দেশ হতে হয় আগে। এটা অর্জনের বিষয়। কারও দান অনুগ্রহে বা বিপদে পড়ে দেয়া ফেবার থেকে এটা অর্জন করা যায় না।
আর এক মজার দিক হল, সার্কের ম্যান্ডেট যেভাবে লেখা আছে সেই ম্যান্ডেট হিসেবে সার্ক বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নিয়ে কথা ওঠার কথাই নয়। ফলে সার্ক বৈঠকে বসতেতে না চাওয়ার পক্ষে কোন শক্ত যুক্তি নাই। তবুও এটাই সত্য যে ভারতের কূটনৈতিক লবির ‘সাফল্য হিসেবে’ বাংলাদেশ ও ভারত এবং আরো দুই রাষ্ট্র সার্ক বর্জন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই বর্জনের আসল কারণ প্রকাশ্যে স্বীকার করতে হবে, ব্যাপারটা এমন একেবারেই নয়। কিন্তু সুহাসিনী জিদ ধরেছেন, হাসিনাকে প্রশ্নের চাপে ফেলে এটা স্বীকার করাবেনই। তাই তাঁর প্রশ্ন, “পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানো দেশ। এটা কি আপনার সার্ক বর্জনের প্রধান কারণ নয়? সার্ক পরিত্যাগ কি পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নয়?”। মহা সমস্যা, এই সুহাসিনীকে কে বুঝাবে যে এই ব্যাখ্যা বয়ান একান্তই ভারতের। এটা ভারতের আভ্যন্তরীণ কনজাম্পশনের জন্য। ভারতের পক্ষে কাজ করতে চাইলেও হাসিনা এই বয়ান তারও বয়ান-অবস্থান বলে স্বীকার করে নেয়া জরুরি না। কিন্তু সুহাসিনীরা মনে করেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভারতের পক্ষে সার্ভিস ও কূটনৈতিক সাড়া’ সুহাসিনী যেভাবে দেখতে চাইছেন ঠিক সেভাবে দিতেই হবে। অন্য কোনভাবে হলে এতেও তার মন ভরবে না। তবুও শেখ হাসিনা ধৈর্য ধরে ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দিয়ে বলেছেন, “পাকিস্তানের ভেতরের কিছু কারণে (অর্থাৎ পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের জন্য বা ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে ভারতের পক্ষে থাকার জন্য নয়) আমরা সার্কে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ভারত-পাকিস্তানেরও দ্বিপক্ষীয় বিরোধ আছে। কিন্তু আমি এটা নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। ভারত উরির জন্য সার্কে যায়নি, আর বাংলাদেশের কারণ এ থেকে ভিন্ন”। অর্থাৎ “মন্তব্য করতে না চাওয়ার কথা” বলে হাসিনা ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাকে চাপাচাপি করা সুহাসিনীর ঠিক হচ্ছে না। তবু এমন জবাব পেয়েও সুহাসিনী সন্তুষ্ট নন। তিনি আবার প্রশ্ন করছেন, “আপনি কি কাশ্মিরের সীমান্তরেখা এলওসি পার হয়ে পাকিস্তানে ঢুকে সন্ত্রাসী মারতে ভারতের যাওয়া সমর্থন করেন না?”। হাসিনা আবারো মাথা ঠাণ্ডা রেখে জবাব দিচ্ছেন, “আমার মনে হয়, এলওসি বরাবর উভয় পক্ষের নীরবতা বজায় রাখা উচিত, যাতে তা শান্তি আনে”। কিন্তু সুহাসিনী হাসিনার মুখ দিয়ে যেন ভারতের বয়ান-অবস্থানের ভাষায় কথা বলাবেনই বলে জিদ ধরেছেন। তাই তিনি আবার প্রশ্ন করেছেন, “আপনি কি এর নীতিগতভাবে সমর্থক নন? গত বছর সরকার ঘোষণা করেছিল, তারা সীমানা পেরিয়ে মিয়ানমারে সন্ত্রাসবাদীর সন্ধানে যাবে। আপনি কি বাংলাদেশের এমন অ্যাকশন করা সমর্থন করবেন?”।
এবার হাসিনার পক্ষে আর ধৈর্য রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, “শোনেন, এই প্রশ্ন আপনি আপনার সরকার আর প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে করুন। আমি মনে করি, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তরেখা, এই এলওসি মান্য করতে হবে”।
এতে সুহাসিনীর কী শিক্ষা হয়েছিল, তিনি কী বুঝেছিলেন আমরা বলতে পারব না। তবে তার দ্বিতীয় ধারার প্রশ্ন এবারঃ “আপনি কিছু দিন আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বলেছিলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নেবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তৎপর হতে এত সময় লাগল কেন, বিশেষত যেখানে অনেক মৌলবাদী গ্রুপ এর আগে অনেক হিন্দু আর ব্লগারকে মেরে ফেলেছে?”।
জবাবে অনুমান করি প্রধানমন্ত্রী আবার ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “কথা সত্য নয়। বাংলাদেশই প্রথম সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গেছে। তদন্ত করতে সময় লাগে, শুধু আমার দেশে নয়, সব দেশেই। তাই বলে এটা বলা ঠিক নয় যে, আমরা তৎপর হচ্ছি ধীরগতিতে”।
এবার সুহাসিনীর রাস্তা ভিন্ন, যা দিয়ে প্রশ্ন করলে শেখ হাসিনা ‘জব্দ’ হবেন আর সুহাসিনীর ক্রেডিট বাড়বে, এমন লাইনের প্রশ্ন।
“মানবাধিকার গ্রুপগুলো অভিযোগ করছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতে থাকা আসামিকে হত্যা, গুম অথবা হাঁটুতে গুলি করছে…”। সুনির্দিষ্ট করে হাটুতে গুলির কথা এসেছে এজন্য যে এর আগের সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘হাঁটুতে গুলি’ করা নিয়ে এক লম্বা রিপোর্ট করেছিল, সেই বরাতের প্রশ্ন। ফলে এইবার শেখ হাসিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে জবাব দিয়েছেন, ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যের যে, মানবাধিকার গ্রুপগুলো আজকাল ভিক্টিমের মানবাধিকারের বদলে ক্রিমিনালের মানবাধিকার নিয়ে বেশি সোচ্চার। আমেরিকায় কী হচ্ছে? তাদের স্কুলে বা কোথাও যখন টেরর আক্রমণ হয়, তখন তাদের বাহিনীগুলো কী করে? তারা কি আক্রমণকারীদের মেরে মানুষকে উদ্ধার করে না? আমাদের বাহিনী কি সন্ত্রাসীদের মারবে? না, যারা আক্রমণ করেছে, তাদের মারবে?’। মনে হচ্ছে এতে সুহাসিনী কিছু ঠান্ডা হয়েছেন।
এরপর সুহাসিনীর সেই পুরান প্রশ্ন, আইএস আছে, আইএস নেই। “আইএস নিজেই বলছে, প্রধান সন্দেহভাজনদের তারাই ট্রেনিং দিয়েছে। আপনি অস্বীকার করছেন- এই অভিযোগ করলে আপনার জবাব কী?”।
হাসিনা এখানে এসে আগের এতদিনের অস্বীকারের জায়গা থেকে একটু হেলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হতে পারে আইএস ওদের কাউকে কাউকে আকর্ষণ করে। কিন্তু আমাদের এখানে আইএসের ঘাঁটি নেই। কেউ যদি দাবি করে, তাহলে আগে প্রমাণ দিক। আমরা আক্রমণকারীদের চিহ্নিত করেছি। আমরা জানি, তারা কোথা থেকে এসেছে এবং এরা সবাই স্থানীয়”।
সুহাসিনী বলছেন, “আপনি বলছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার জনগণের দাবি। কিন্তু নির্বাচিত জামায়াত নেতারা ফাঁসিতে ঝুলছেন, না হলে জেলে। অনেক বিএনপি নেতা গ্রেফতার না হলেও বিদেশে পালিয়েছেন। আপনি কি আপনার রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনকে যুদ্ধাপরাধের বিচার বলে চালিয়ে দিচ্ছেন না?”।
“না, এটা আমার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিষয় নয়। আপনি যদি একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনি স্বাধীনতাবিরোধীদের কিভাবে সমর্থন করেন? বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। বিএনপি নেতাদের নিয়ে মামলার বিষয়গুলো আলাদা, এগুলো হয় দুর্নীতি, না হয় অপরাধের মামলা। যদি এসব নেতা মনে করেন তারা নির্দোষ, তারা বিচারপ্রক্রিয়া মোকাবেলা করুন। আমি যখন বিরোধী দলে ছিলাম, তারা আমার বিরুদ্ধেও ডজন ডজন মামলা দিয়েছিল”। (এই শেষের বাক্যটি বলে হাসিনা কিন্তু অজান্তে প্রকারান্তরে অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছেন।)
প্রসঙ্গ আপাতত এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। এই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা স্বস্তিকর নয়। আমরা জানি না, পরে আর কখনো এই মহিলাকে সাক্ষাৎ দেয়া যাবে না, এমন সিদ্ধান্ত সেখানে হয়েছে কি না!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com