ট্রাম্পের তাইওয়ান ফোনালাপ, কেন তা সম্ভাব্য সংঘাতের ইঙ্গিত
গৌতম দাস
২১ ডিসেম্বর ২০১৬ বুধবার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী মাসে ২০ জানুয়ারি পরবর্তি চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। এই চার বছর পৃথিবীর ইতিহাস রুটিন ইতিহাস না হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। বরং মনে হচ্ছে, বিরাট উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলিতে পরিপূর্ণ হতে চলেছে। সে সম্ভাবনা এতই প্রবলতর হচ্ছে যে, যদি না মাঝপথে প্রেসিডেন্টকে ইমপিচের মতো কোনো ঘটনাতে সব কিছু থামিয়ে পথ বদলে যায়, তবে আমাদের পরিচিত দুনিয়া ও দুনিয়ার পরিবর্তন যেভাবে ও ধাপে ঘটে বলে আমাদের ধারণা বা অনুমান আছে, তা এবার ভেঙে যাবে। দুনিয়া অপরিচিত হয়ে উঠবে। এসব সম্ভাবনা বাড়ছে তো বাড়ছেই। ট্রাম্পের উত্থানের ফলে এমন উদাহরণ ও প্রমাণ হিসেবে অনেক ঘটনাই উল্লেখ করা যায়। আজ এখানে তেমনই এক বিষয় বা ইস্যু – ট্রাম্প ও তাইওয়ানের চলতি প্রেসিডেন্টের (Tsai Ing-wen) ফোনালাপ নিয়ে আলোচনা করব।
প্রথমত যে পদ্ধতিতে এই ফোনালাপ করিয়ে দেয়া হয় সেই দালালির প্রসঙ্গ। হা আপনারা ঠিকই শুনছেন, দালালি মানে ব্রোকারেজ যার আরও ভদ্র আধুনিক নাম লবিইস্ট গ্রুপ এর মাধ্যমে লবি করা। এই দালালি করেছেন একজন প্রাক্তন সিনেটর নাম – Bob Dole । যিনি ফোনে কথা বলানোর ব্যবস্থা করে দিবার বিনিময়ে ১৪০ হাজার ইউ এস ডলার লবি ফি বা ঘুষ নিয়েছেন। এই লবি ফি নেবার কথাটা প্রমাণ-অযোগ্য কোন কান কথা বা মন গড়া কথা নয়। এব্যাপারে আমেরিকার জুডিশিয়াল ব্যবস্থা খুবই ভাল। লবি ফি নিলে তা আগেই আইন বিভাগে রাখা নির্ধারিত ফর্ম ফিলাপ করে ঘোষণা করে বলে রাখতে হয়। এবং তা গোপনীয় না, পাবলিক ডকুমেন্ট। মানে যে কেউ এটা খুলে দেখতে পারে, কপি করে অন্যকে জানাতে পারে প্রকাশ্যে। আগ্রহিরা উপরে দেয়া লিঙ্ক যেটা নিউ ইয়র্ক টাইমসের লিঙ্ক সেখান থেকে দেখে নিতে পারে। লবি বা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির দিক থাক আমরা মূল বিষয়ের দিকে ফিরি।
রাজনৈতিকভাবে কমিউনিস্ট চীন আর কমিউনিস্টবিরোধী দুনিয়ার নেতা আমেরিকা (অন্তত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে) আইডিওলজির দিক দিয়ে পরস্পর ঘোর বিরোধী। তাহলে একালে চীন-আমেরিকার মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক দেয়া-নেয়া, লেনদেন বিনিময়ে পরস্পরের সাথে সম্পর্কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া কবে থেকে, কিভাবে শুরু, কী এর ভিত্তি? এসব বিষয় আমাদের অনেকের তেমন জানা হয় নাই। বিশেষ করে যাদের বয়স ত্রিশের নিচে। কারণ তারা কেবল চীনের অর্থনৈতিক পরাশক্তিগত উত্থান দিকটা দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন। এর পেছনের দিক জানা হয়নি। চীন-আমেরিকার সম্পর্ক এমন সিমেন্ট-বাঁধানো সম্পর্ক এটা দেখতে দেখতে আমরা প্রায় সবাই এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, এমন সম্পর্কের আগে কী ছিল তা আমরা জানার তাগিদই হারিয়ে ফেলেছি। এমন পটভূমিতেি এবারের আমেরিকান নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত হিসেবে ট্রাম্পের মঞ্চে প্রবেশ ঘটেছে। মনে হচ্ছে তিনি আমাদের পরিচিত অনেক কিছুই ভেঙে ফেলবেন, সে সবের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং শুরুর ঘটনা হবে চীন-আমেরিকার সম্পর্ক। এমনকি এটা ঠিকমতো ও দায়দায়িত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া এবং মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে আর এক বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা যদি এড়িয়েও যাই, তবু তা এক যুদ্ধ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বসতে পারে। তবে আপাতত ও আজ আমাদের বিষয় চীন-আমেরিকা সম্পর্ক কবে থেকে এবং কী ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো সে দিক দিয়ে পর্যালোচনায় বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে, জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখাও হয়েছে। যদিও আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নেয়ার আগ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো আমেরিকার একজন আম-নাগরিক ছাড়া অন্য কিছু নন। তাইওয়ানের চলতি প্রেসিডেন্ট ‘চাই ইং-ওয়েন’ ট্রাম্পকে ফোন করে ভোটে জয়লাভের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আর ট্রাম্পও সেই ফোনে সাড়া দিয়ে কয়েক মিনিট কথা বলেছেন। এটি একটি ছোট ঘটনা। কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনার দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে।
একজন প্রেসিডেন্ট আর একজন হবু প্রেসিডেন্ট -এদু’জনের মধ্যে কথা বলাতে সমস্যা হবে কেন? আর কী সেই সমস্যা? না, সমস্যাটা অন্য রাষ্ট্রপ্রধানের বেলায় নয়, তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট বলেই সমস্যা। কিন্তু কেন এমন বিশেষ? কারণ, চীন-আমেরিকার সম্পর্ক পাতানোর আগে সম্পর্ক শুরু করার পূর্বশর্ত ছিল যে, চীন একটাই এবং তাইওয়ান যার অংশ। আর বেইজিংয়ের সরকার একমাত্র বৈধ চীন সরকার। আমেরিকাকে এটা স্বীকার করতে হবে। এবং আমেরিকা তা করেছিল এবং লিখিতভাবে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা এমওইউ স্বাক্ষর করেছিল। যেকোনো দুই রাষ্ট্রপ্রধানের রাষ্ট্রীয় সফরে সাক্ষাত হলে যেমন এমওইউ স্বাক্ষর হয়, এটা তেমনই। এটাকে অনেক সময় ‘জয়েন্ট কমিউনিকে’ (ফরাসি উচ্চারণ থেকে শব্দটা communique, ইংরেজিতে তা ‘কমিউনিকেট’ বললে যা অর্থ হয় তাই)। এটা আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথভাবে স্বাক্ষরিত দলিল বা যৌথ ঘোষণাও বলে অনেক সময়।
তবে চীন-আমেরিকার সম্পর্কের বেলায় ব্যাপারটা এত সহজভাবে ঘটেনি। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ‘তিনটি কমিউনিকে’ লেগেছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীন আমাদের পক্ষে থাকেনি, পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। সোভিয়েত প্রোপাগান্ডার ভাষ্য আর ভারত-বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীলদের’ চাপাবাজির ঠেলায় এ প্রসঙ্গে আমরা কোনো ফ্যাক্টসের দিকে চোখ ফেরাতে পারিনি।
দ্রুত এক লাইনে বলা তেমন কিছু ফ্যাক্টস হলো-
১। ১৯৪৯ সালে চীনে মাও-এর কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকে চীনের সাথে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। অর্থাৎ আমেরিকা মাওয়ের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নাই। এ ছাড়া মাও-এর চীনের বিপ্লবের পর থেকে আর জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদও ছিল না।
২। ইতোমধ্যে বিপ্লবের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর বিপ্লবের বুঝ বাস্তবে করে দেখতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতা লাভ ঘটে যায়। যে অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না।
৩। ফলে প্রতিক্রিয়ায় যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জোয়ার আসে ১৯৫৮ সালে একে চীনে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ বলে ডাকা শুরু হয়। নামের দিক থেকে এটা শুনে যাই লাগুক, সার কথায় তা হলো- আজকের চীনের অর্থনৈতিক পরাশক্তিগত উত্থান ঘটেছে এরই প্রথম মোচড়। কিন্তু ক্যাপিটালিজমের এই পথে দলকে আনতে সে সময়ে একে উপযুক্ত করে নিতে দলের আগাপাছতলা ঢেলে সাজানোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-লড়াই শুরু হয়ে যায়। সে লড়াইয়ে জিতে দলকে পুনর্গঠন করার তৎপরতার প্রথম পর্যায় ছিল সেটা। সে কাজে বিতর্কের একটা মূল বিষয় ছিল- চীন বিদেশী বিনিয়োগ। আর কান টানলে মাথার মতো এরই আরেক অংশ হল – বিদেশী বিনিয়োগ আনার অর্থ গ্লোবাল বাণিজ্য ট্রেডের বাজারে পণ্য দেয়া-নেয়া লেনদেন বিনিময়ের সম্পর্কে যুক্ত হয়ে পড়া। কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বে এক ধরণের ক্যাপিটালিজম। এটাই বিজয়ীদের রাজনৈতিক পথ।
৪। কিন্তু কী শর্তে? বিদেশী বিনিয়োগসহ গ্লোবাল বিনিময়-পণ্য বাণিজ্যে প্রবেশ করার বিষয়ে ডিল করার সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিনিধি হল গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অর্থনীতির মোড়ল নেতা, শীর্ষদেশ আমেরিকা।
৫। কিন্তু আমেরিকার সাথে চীনের পারস্পরিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই ছিল না। তাই স্বীকৃতি পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে পারস্পরিক মনোভাব বোঝা, কে কিভাবে, কী শর্তে সম্পর্ক চায় ইত্যাদি নেগোসিয়েট করার জন্যও পরোক্ষ একধরনের আলাপ শুরু করা দরকার। আবার যদি তা ব্যর্থ হয়, তবে অনেকের কাছে তা ব্যাখ্যা করার ঝামেলা পোহাতে হতে পারে সে সম্ভাবনা ছিল। বিশেষ করে সেটা ছিল কোল্ড ওয়্যারের কূটনীতির যুগ, ফলে দুনিয়া আইডিওলজিতে বিভক্ত। তাই পরোক্ষ প্রাক-আলাপের প্রয়োজন মেটাতে গোপনে কাজ করা আর সে কাজে আইয়ুব খানের পাকিস্তানের মাধ্যমে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করতে চীন-আমেরিকা উভয়ই সম্মত হয়েছিল।
৬। পাকিস্তানকেই বেছে নেয়ার পেছনে মূল কারণ চীন-আমেরিকা উভয়ের পাকিস্তানের সাথে আগে থেকেই নিজ নিজ নানা কৌশলগত কারণে ভাল সম্পর্ক ছিল। আইয়ুব খান নাম ধরে বলার কারণ- তার সময়ে ১৯৬৮ সাল থেকেই চীন-আমেরিকার প্রাথমিক আলোচনা চালাচালি শুরু হয়েছিল। চীন ও আমেরিকায় পাকিস্তানের এমবেসি চীন ও আমেরিকার মধ্যে যোগাযোগের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। আমেরিকার দিক থেকে এ যোগাযোগ নেগোসিয়েশনের গুরু ছিলেন কিসিঞ্জার, যিনি ১৯৭১ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। সাম্প্রতিককালে আমেরিকার এক মাসিক পত্রিকা আটলান্টিক ম্যাগাজিনে সাক্ষাতকারে তিনি এসবের বিস্তারিত বলেছেন। কিসিঞ্জার চীনের সাথে নেগোসিয়েশনের পর্দার আড়াল পর্ব শেষ করে পরবর্তি প্রকাশ্য দিক চূড়ান্ত করতে গোপনে চীন সফর করেন ২১ জুলাই ১৯৭১।
৭। আমাদের জনগণের এক বড় অংশ যখন ভারতে উদ্বাস্তু, পাকিস্তান ভ্রমণের নাম করে কিসিঞ্জার পাকিস্তানে এসে গায়েব হয়ে দু’দিনের জন্য বেইজিং সফরে যান। সেখানেই মাও সে তুংয়ের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন এবং চৌ এন লাইয়ের সাথে সব কার্যকর ডিল ফাইনাল করেন। বিশেষ করে পরের বছর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে খোদ প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফরে আসবেন সে প্রস্তুতি প্রসঙ্গে।
৮। চীনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল- এক চীন নীতি, তাইওয়ান চীনের অংশ – এটা আমেরিকাকে স্বীকার করিয়ে নেয়া। এটাই ‘সাংহাই কমিউনিকে ১৯৭২’ নামে ডিপ্লোমেটিক জগতে খ্যাত।
৯। আসলে আমেরিকা যেন বেইজিংয়ের চীন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এটা ছিল লক্ষ্য। কিন্তু কথাটা ঘুরিয়ে বলা হয় – তাইওয়ান চীনের অংশ, এই এক চীন নীতি মেনে নিতে হবে। কারণ জাতিসংঘে জন্ম থেকেই চীন নামে এক রাষ্ট্র রেজিষ্টার্ড হয়েই আছে। এবং সে ভেটো ক্ষমতাধারী। কিন্তু সেই চীন কোনটা এই হল তর্কের বিষয়। আমেরিকা মনে করে তাইওয়ানের সরকার সেই চীনের আসল প্রতিনিধি। ফলে মাওয়ের বেইজিং এর চীন সরকারের কোথাও স্বীকৃতি ছিল না – না জাতিসংঘে না আমেরিকার কাছে। ফলে এক চীন নীতি মানার কথা বলা মানেই মাওয়ের চীন বলতে চায়, তাইওয়ানকে খেদিয়ে ভেটো ক্ষমতার জাতিসংঘ সদস্যপদটা মাওয়ের চীনকে দেয়া হোক।
১০। কিসিঞ্জারের গোপন বেইজিং সফর আর পরের বছর ১৯৭২ ফেব্রুয়ারিতে নিক্সন চীন সফরে যাবেন একথা ঘোষণা হবার পর থেকেই চীন প্রবলভাবে জাতিসংঘ সদস্যপদ পাবার জন্য কূটনৈতিক মহলে ততপর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু চীন যতই ততপর ততই আমেরিকা একদিকে তা মানে চীনে বিনিয়োগ সুবিধা পেতে প্রচন্ড লোভী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কীভাবে তাইওয়ানকে ত্যাগ করার কথা বলবে তা ঠিক করে উঠছিল না।
১১। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কিসিঞ্জারের সফরের পরের ঐ বছরের সেপ্টেম্বরের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় (প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে জেনারেল এসেম্বলি বা সব সদস্যের মিটিং ডাকা হয় নিয়মিত) মাওয়ের চীনকেই আসল চীন হিসাবে স্বীকৃতি দিবার প্রস্তাব আনে। আর এর জবাবে আমেরিকা নিমরাজীর মত – বিরোধীও না পক্ষেও না – এভাবে করে সমর্থন দেওয়াতে ঐ প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। ফলে পরের মাস অক্টোবর ১৯৭১ আনুষ্ঠানিকভাবে চীন তাইওয়ানের বদলে ঐ স্থানে ভেটো ক্ষমতা ওয়ালা সদস্য হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে মাওয়ের বিপ্লবের পর এই প্রথম মাওয়ের চীন এমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।
১২। চীন এবং আমেরিকা নিজেদের এতবড় প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে স্বভাবতই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে থাকতে পারে নাই। বরং ঐ প্রাপ্তির মধ্যস্থতাকারি পাকিস্তানের পক্ষে থেকেছিল।
১৩। জাতিসংঘের ভেটোসহ সদস্যপদ চীন পেয়েছিল বটে তবু আমেরিকার পক্ষে চীনকে মানে চীন-আমেরিকা পরস্পরকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব হয় নাই। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিক্সনের প্রকাশ্যে চীন সফরের পরেও না। কারণ ওখানে যৌথ ঘোষণা “সাংহাই কমিউনিকে ১৯৭২” – নিক্সন এতে স্বাক্ষর করেছিলেন বটে, কিন্তু সবার জানাশোনায় এতে একটা ফাঁক রেখে দেন। আসলে এক চীন নীতি অনুসারে তাইওয়ান-চীন মিলে যদি চীন একটাই হয়, তাহলে তাইওয়ান তো চীনের অংশ হবেই। কিন্তু ‘সাংহাই কমিউনিকে ১৯৭২’-এ স্পষ্ট বলা হয়নি যে, কোনটা সেই ‘এক চীন’ -এর সরকার। বেইজিংয়েরটা নাকি তাইপেরটা? এটাই সে কথার ফাঁক। এভাবে ১৯৭২ সাল পার করলেও ফাইনালি আমেরিকা আপস করতে রাজি হয় ১৯৭৮ সালে। ফলে আর এক কমিউনিকে স্বাক্ষরিত হয় ‘উভয়ে উভয় রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার কমিউনিকে ১৯৭৯’ এই নামে তা পরিচিত। ১৯৭৮ ডিসেম্বর ১৫ তারিখে এটা স্বাক্ষরিত হলেও এর কার্যকারিতা দেয়া হয় পরের বছর ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে । এখানেই আমেরিকা বেইজিং সরকারকে মেনে নিয়ে উভয়ে উভয়কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর তাইপে থেকে আমেরিকান অ্যাম্বেসি গুটিয়ে ফেলার ঘোষণা দেয়া হয়। ঐ কমিউনিকে তে আরও পরিষ্কার বলা হয়েছিল- এখন থেকে তাইওয়ানের সাথে আমেরিকার সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকবে, তবে সেটা আন-অফিসিয়াল বা অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক।
১৪। ওই কমিউনিকে-তে আর এক গুরুত্বপূর্ণ পারস্পরিক বোঝাপড়ার কথা ছিল যে, তাইওয়ানের সাথে চীনের একত্রীকরণ করতে হবে শান্তিপূর্ণভাবে, সামরিক বল প্রয়োগে নয়। এই হলো চীনের দিক থেকে আমেরিকার কাছে চাওয়া এবং পাওয়া মূল শর্ত, যেটা তাইওয়ান ইস্যু বা ‘এক চীন নীতি মেনে নেয়া’ বলা হয়।
১৫। বিপরীতে আমেরিকার দিক থেকে পাওয়ার দিক ছিল আরো বিশাল। আগের কোনো এক লেখায় বলেছিলাম, আমেরিকার কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল দুনিয়া থেকে কলোনি শাসনের সমাপ্তি টানা, যাতে প্রতিটি কলোনিমুক্ত দেশ বিপুল বিনিয়োগ গ্রহীতা হিসেবে আমেরিকান ওয়ালস্ট্রিটের পুঁজির খরিদদার হিসেবে হাজির হয়। প্রকারান্তরে গ্লোবাল বিনিয়োগ পুঁজি, পণ্যবাণিজ্য বাজার আরো ব্যাপক হয়ে উঠে। এতদিন কলোনি সম্পর্কের মধ্যে যা সীমিত লেনদেন বাণিজ্যে আটকা পড়েছিল, তাই চীনের সাথে আমেরিকার এই সম্পর্ক ছিল যেন আর একবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জিতে নেয়া। কারণ চীনের বিপুল-বিশাল জনসংখ্যা, অর্থাৎ ক্রেতা বাজার আর ততধিক বিনিয়োগ-শুষ্ক হয়ে থাকা চীনের গোটা অর্থনীতি, এটি ওয়ালস্ট্রিটের জন্য এক বিশাল আশীর্বাদ। যেখানে মনে রাখতে হবে, ক্যাপিটালিজমের সবচেয়ে বড় স্ববিরোধ হলো- বিনিয়োগ পুঁজির বাজারে ক্রেতার অভাব, যে সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে সে নিজেই এর কারণ। ফলে চীনের সাথে আমেরিকার সে সময়ের সম্পর্ক পাতানোর তাৎপর্য ছিল দুনিয়ার বিনিয়োগ পুঁজির গ্লোবাল বাজার- ওয়ালস্ট্রিটকে আয়ুদান। কিন্তু স্ববিরোধের ওখানেই সমাপ্তি ঘটেনি, ঘটার কথাও নয়। ১৯৭৯ সাল থেকে ধরলে পরের ৩৭ বছর। ইতোমধ্যে চীনের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে উত্থান ঘটেছে, যা আমেরিকার অর্থনীতিসহ সামগ্রিক পরাশক্তিগত নেতা অবস্থানের জন্য চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ বাজার শুকিয়েছে, বাজার বা কাজ সৃষ্টির সঙ্কটসহ সব ধরনের সঙ্কটে আমেরিকা জর্জরিত। এই পটভূমিতেই ট্রাম্পের বিজয়। কে সে অথবা কী তার বিজয়ের তাৎপর্য? ব্যক্তি হিসেবে সে আধাপাগলা, আনপ্রেডিক্টেবল বলছেন অনেকে। ওবামার নেতৃত্বে আমেরিকার আট বছর আসলে এই ধারা হলো- যেন ব্যবসা পড়ে যাওয়ায় আয় কমা বাপের সন্তানদের মা (ওবামা হলো সেই মা) বোঝাচ্ছে যে, বাবা সোনারা এখন থেকে কম খরচে চলতে শেখো, মেনে নাও। কারণ তোমাদের বাবার ব্যবসা আর কোনো দিন ভালো হবে না। আর এর বিপরীতে ট্রাম্প হলো সেই সন্তানদের বেয়ারা একজন, যে কিছু বোঝার চেয়ে বিদ্রোহ করতে চায়। তার কথা হলো- নানার আমলে ঘি খেতাম, আমরা এখন কেন সয়াবিনও পাবো না। ফলে সে যা আছে অবশেষ, তা হারানো বা ভেঙেচুরে দিয়ে হলেও একবার শেষ চেষ্টা করতে চায়। ট্রাম্প এদেরই প্রতীক একজন। যার পেছনে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান নির্বিশেষে অনেকেই আছে। এ জন্য আরো আছে এক সস্তা জাতীয়তাবাদও।
এখন একালে আসা যাক
চীন-আমেরিকান সম্পর্কের যৌথ ঘোষণার ভিত্তি ‘এক চীন’ স্বীকার করা। অতএব একে ট্রাম্পের মানতে না চাওয়া, তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলা, চীনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ইত্যাদি এগুলো করার কথা না। আবার এগুলো কোন আধাপাগলা লোকের কাজ না অবশ্যই। চীন যদিও তাকে যতই ‘পররাষ্ট্র নীতি বোঝার বিষয়ে অজ্ঞ’ বলে গালাগালি করুক। এমন কথাও বাজারে চালু আছে যে, চীনের কাছ থেকে আমেরিকানদের জন্য কিছু বাজার আর চাকরি-কাজের সুবিধা পাওয়ার জন্য এটা ট্রাম্পের লোক দেখানো হুঙ্কার।
তাইওয়ানকে আমেরিকার ১৯৮২ সালে অস্ত্র বিক্রিকে কেন্দ্র করে চীন-আমেরিকা বিরোধে চীন এমনই উঠে দাঁড়িয়েছিল। ফলে ১৯৮২ সালের অক্টোবরে তৃতীয় এক যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সার কথা ছিল- ‘আর অস্ত্র বিক্রি করবে না’। ট্রাম্পের এমন কোনো অভিপ্রায় থাকতে পারে, এমন অনুমান করে চীন আগাম পরিষ্কার করে বলছে, এক চীন নীতি নিয়ে আর কোনো নেগোসিয়েশন হবে না। কঠিন সত্যটা হলো- আমেরিকার অর্থনীতি, দুনিয়ার নেতৃত্বসহ সব কিছুর যৌবন ঢলে পড়া শুরু হয়েছে, আরো পড়বে। আমেরিকান সরকারি গবেষণা সার্ভে বলছে, এটা আর কখনো উল্টা দিকে ফিরবে না। তা সত্ত্বেও যা আমরা জানি না তা হলো- দুনিয়ার আসন্ন নতুন নেতা ও ব্যবস্থা এটা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আসবে? নাকি টেবিলে বসে নেগোসিয়েশন, কিছু উত্তেজনা, ছোটখাটো যুদ্ধই যথেষ্ট হবে। ট্রাম্পের বিজয়ের পর চীন বলেছিল, পাগলামি না করতে, কথা বলতে। সেটা ট্রাম্পের তাইওয়ান পাগলামিরও আগের কথা। প্রেসিডেন্ট শি-এর কারণ হিসেবে বলেছিলেন, চীন-আমেরিকার ভাগ্য (ডেসটিনি) একসাথে বাঁধা হয়ে গেছে, তাই। ট্রাম্পের পাগলামিরও পরিষ্কার অর্থ পেতে আমাদের আপাতত আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[লেখাটা এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। এখানে তা আবার অনেক ঘষামাজা ও এডিট করে নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আবার ছাপা হল। ]