ট্রাম্পের টুইট – তাঁর নিউক্লিয়ার জ্ঞান
গৌতম দাস
০৫ জানুয়ারি ২০১৭, বৃহষ্পতিবার
রাজনীতিবিদ অথবা সরকারপ্রধান বা মন্ত্রীদের আজকাল সোস্যাল মিডিয়াতে পাওয়া খুবই সহজ বিষয় হয়ে গেছে। বিশেষ করে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অনেক খ্যাতিমানেরা প্রায়ই টুইটার ব্যবহার করেন। তুলনায় তারা অবশ্য ফেসবুকে কমই আসেন। তাদের টুইটার ব্যবহারে বেশি আগ্রহের মূল কারণ সম্ভবত টুইটারের ১৪০ অক্ষরের সীমা। এমন কোন সীমা ফেসবুকে নাই। টুইটারে অক্ষরের সীমা থাকার কারণে ফেসবুক থেকে এর বৈশিষ্ট অনেক দিক থেকে আলাদা হয়ে গেছে। যেমন- প্রথমত, এটাকে ব্লগ থেকে পৃথক ক্যাটাগরি ‘মাইক্রো-ব্লগ’ বা ছোট ব্লগ বলে আলাদা করা যায়। দ্বিতীয়ত, যে কথা লিখা হবে তা আগে চিন্তা করে গুছিয়ে এরপর লিখতে হবে। তবেই অল্পে কথা হবে। ফলে টুইটারের লেখা সাধারণত কম্প্যাক্ট হয়। তৃতীয়ত, টুইটার ইন্টারেকটিভ নয়, মানে মন্তব্য কথোপকথন এর মত করে সে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে তৈরি করা হয়নি। এই অর্থে টুইটারকে আসলে ওয়ান ওয়ে বা একপক্ষীয় মিডিয়া বলা যায়। টিভির মতো যে একাধারে নিজে বলেই যায়, শ্রোতাকে বলতে দেয় না। এ দিকে অবশ্য এটাও ঠিক, সেলিব্রিটি বা খ্যাতিমানেরা কাউকে বলতে দিতে চান না, কেবল শোনাতে চান। আর তাদের শোনার সে সময় কই?
এভাবে টুইটারের বৈশিষ্ট নিয়ে আরো অনেক পয়েন্ট লেখা যায় হয়ত। থাক সে কথা। আসল কথা হল – ১৪০ অক্ষর। ফলে এখানে অল্প লিখে ফাঁকি দেয়াও যায়। কিন্তু টুইটারের বিষয়ে আলাপ তুললাম কেন? আর তার সাথে ফাঁকির কী সম্পর্ক? সম্পর্কের নাম ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’। টুইট লিখলে যেহেতু কম কথা লিখতে হয়, ফলে লেখার সাথে আবার কোনো ছোট বা বড় ব্যাখ্যা লিখতে হয় না ফলে পাঠল কেউ আশা করে না। কারণ ব্যাখ্যা লেখার সুযোগ বা জায়গা নেই। এ এক বিরাট অজুহাত। ফলে যা লিখছি এর ব্যাখ্যা জানি আর না-ই জানি, তা ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না বলে অজ্ঞদের জন্য টুইট খুবই কাজের জিনিস। না, আমি এটা বলছি না যে- যারা টুইট করেন তারা সব অজ্ঞ। তবে বলছি, অজ্ঞদের টুইট লেখার বিশেষ সুযোগ আছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক যুদ্ধের অস্ত্র বিষয়ে একটি টুইট লিখেছেন এভাবেঃ “The United States must greatly strengthen and expand its nuclear capability until such time as the world comes to its senses regarding nukes”। এখান থেকে আমার অনুমান অচিরেই হয়ত বেইজ্জতি এড়াতে ট্রাম্পকে টুইট লেখা বন্ধ করে দিতে হবে। কেন?
টুইটের বক্তব্য বাংলা করে লিখলে হবে, “আমেরিকাকে অবশ্যই বেশ বিশাল করে তার নিউক্লিয়ার সক্ষমতা শক্তিশালী ও বৃদ্ধি করা উচিত, ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না দুনিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে হুঁশ আসে।” – এই ছিল বিদ্যাধর ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইট – ১৪০ অক্ষর।
অনুবাদ লেখকের; যারা মূল খবরের উৎস থেকে পড়তে চান তারা দুই দিন আগে ২২ ডিসেম্বরের রয়টার নিউজ এজেন্সির রিপোর্ট দেখে নিতে পারেন। ট্রাম্পের টুইটের কয়েক ঘণ্টা পরই ওই রিপোর্ট লিখে প্রকাশিত হয়েছিল।
সময়ের বিচারে দুনিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রের ইতিহাস বা আয়ু খুবই স্বল্প। যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে দুনিয়াতে এর প্রথম জোড়া ব্যবহারটাই শেষ ব্যবহার হয়েছিল। আর স্বল্প তিন দিনের গ্যাপে এই জোড়া ব্যবহার, দুটোই ঘটেছিল জাপানের ওপর; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট আমেরিকার হাতে এই তিন দিনের ব্যবধানে। তাও সেটা ওই যুদ্ধে শত্রু জাপানের বিরুদ্ধে আমেরিকার জয়-পরাজয় নির্ধারণের জন্য নয়, বরং জয় নিশ্চিত হয়ে গেলে পরেও, এ সুযোগে বোমা ব্যবহারের পরীক্ষা করে এর পরিণতি জেনে রাখার জন্য করা হয়েছিল। আর তাতেই – এর মারাত্মক ভয়াবহতা যা বোঝাবুঝি তা শেষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের চতুর্থ টার্মের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন হ্যারি ট্রুম্যান। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে চতুর্থবার প্রেসিডেন্টের শপথ নেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে, ১২ এপ্রিল ১৯৪৫ রুজভেল্টের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে পরে ওই দিন থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। আর এর প্রায় চার মাসের মাথায় ঐ ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট ১৯৪৫ ট্রুম্যান জাপানের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত দেন এবং তা পালিত হয়।
কিন্তু এরপরই হ্যারি ট্রুম্যান মূলত এই বোমা ব্যবহারের বিরোধী হয়ে যান। যদিও কোরিয়া যুদ্ধে (১৯৫০-৫৩) আমেরিকার জড়িয়ে যাওয়ার পটভূমিতে ১৯৫০ সালের ৩০ নভেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নের মুখে তাকে স্বীকার করতে হয় যে ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের জন্য তৈরি’। কিন্তু পরের বাক্য যোগ করে তিনি বলেন, ‘এই অস্ত্র দ্বিতীয়বার তিনি ব্যবহার করতে চান না’। এটাকে ‘এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র’, এটা ‘কারো ব্যবহার করা উচিত না’ বলে কথা শেষ করেন। আর ১৯৫৩ সালে ১৫ জানুয়ারি (তিনি দুই টার্মে প্রেসিডেন্ট ছিলেন) কংগ্রেস বা আমেরিকান সংসদে তার বিদায় ভাষণে যিশুর নামে কসম কেটে তাকে কৃতকর্মের পক্ষে সাফাই-মূলক প্রচুর কথা খরচ করতে হয়। কেন তিনি পারমাণবিক বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন এর একটি দুর্বল সাফাই তার ছিল। যেমন- “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানোর জন্য” নাকি তাকে এটা করতে হয়েছিল। এ ছাড়া আর এক দুর্বল সাফাই ছিল তাঁর যে, ইতোমধ্যে আমেরিকার বোমা ফেলার আট বছর পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যে অন্যান্য রাষ্ট্রও (ব্রিটেন ১৯৫২, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯) এমন বোমার অধিকারী হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি আর একা দোষী নন যেন এটাই বুঝে নিতে বলছিলেন। আর সেই সাথে তিনি বুঝেছিলেন তার সাফাই যথেষ্ট নয়। আর তাই প্রকারান্তরে তা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘স্টার্টিং আ অ্যাটমিক ওয়ার ইজ টোটালি আনথিঙ্কেবল ফর এ র্যাশনাল ম্যান’। বাংলা বললে, ‘যুক্তিবুদ্ধিতে চলা মানুষের পক্ষে একটা পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করা অচিন্তনীয়’। মডার্ন যুগ মানে, আধুনিক রাষ্ট্র-কায়েমের কালে আধুনিক দুনিয়ায় পশ্চিমের পৌঁছানোর পর থেকে, সেই সমাজের মাপকাঠিতে ‘র্যাশনাল’ মানুষ মানে আল্লাহর ভয় থাকুক আর না-ই থাকুক কিন্তু ‘সর্বোচ্চ যুক্তিবুদ্ধিতে হুঁশজ্ঞানওয়ালা মানুষ’ মনে করা হয় যাকে।
পরবর্তীকালে ১৯৬০ সালের মধ্যে চীন আর ফ্রান্সসহ আমেরিকা, ব্রিটেন আর সোভিয়েত ইউনিয়ন এই মোট পাঁচ রাষ্ট্র পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়ে যায়। যদিও ট্রুম্যান সেই ১৯৪৬ সাল থেকেই জাতিসঙ্ঘের অধীনে এই অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অন্য চার রাষ্ট্র বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে বিশ্বাস করেনি। করার কারণও ছিল না। কারণ ট্রুম্যানের প্রস্তাবের মূল সমস্যা ছিল, তিনি এমন প্রস্তাব দিচ্ছেন যখন ইতোমধ্যে আমেরিকা বোমা প্রস্তুত ও ব্যবহারকারী এবং সব টেকনিক্যাল ও ব্যবহারিক ডাটা একমাত্র নিজ রাষ্ট্রের হেফাজতে। ফলে তিনি সব রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়েই আছেন। মানে সে বাদে ওই পাঁচ রাষ্ট্র একেবারে বোমা হাসিল করে আমেরিকার সমান হওয়ার আগে এই বোমা নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণের পথ ধরা সঠিক মনে করার কোনো কারণ নেই। ইতিহাসে পাওয়া যায়, এ দিকটাও ট্রুম্যান প্রশাসনের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তারা নিজেরাই বিভক্ত হয়ে পড়েন এভাবে যে, একদল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে এই টেকনোলজির সব কিছু শেয়ার করার পক্ষে ছিল। অন্য পক্ষ মনে করে- সব কিছু শেয়ার করার পর এই বোমা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবে সোভিয়েতরা যদি উল্টে যায়, আমেরিকা যদি প্রতারিত হয় তাহলে কী হবে? সারকথায় বিশ্বাসের অভাব ছিল মারাত্মক। এ ছাড়া প্রত্যেকে বোমা হাতে পেলেই (মানে আসলে টেকনোলজি করায়ত্ত হওয়া) একমাত্র আমেরিকার সমান হবে এই ভাবনার কারণে বোমার নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার জন্য সমঝোতা হয়নি।
কিন্তু তবু প্রস্তাব চালাচালি অব্যাহত ছিল। যেমন ট্রুম্যানের পরের প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারও ১৯৫৩ সালের সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় প্রস্তাব রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে লিখিত প্রস্তাবও রেখেছিলেন। তবে দুনিয়াব্যাপী পারমাণবিক বোমাবিরোধী মনোভাব বাড়ছিল। এটা ধরা পড়ে ১৯৫৮ সালে সারা দুনিয়ার ১০ হাজার বিজ্ঞানী একসাথে স্বাক্ষর করে জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারির দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক আবেদন পাঠিয়েছিলেন। তবে ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই বোমার অধিকারী হয়ে যাওয়াতে আর অনেক নিগোসিয়েশনের পর ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে প্রথম জাতিসঙ্ঘের অধীনে বোমা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘আন্তর্জাতিক অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন’ গঠিত হয়। এরপরও প্রায় ১০ বছর পরে ১৯৫৮ সালে প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা পারমাণবিক বোমাবিরোধী আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি এনপিটি বা নন প্রোলিফারেশন ট্রিটি তে স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুসারে এটা ২৫ বছর পরে রিভিউ হওয়ার কথা ছিল। ১৯৯৫ সালে এটা আবার রিভিউ হয়ে নতুন করে গৃহীত হয়। এবং সংযোজিত আর এক নতুন চুক্তিতে আরো পোক্ত হয়। এবার শুধু বোমা বানানো নয়, পারমাণবিক বোমা পাওয়ার লক্ষ্যে ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বোমা বানিয়ে বাস্তবে টেস্ট করাও নিষিদ্ধ করার চুক্তি ‘সিটিবিটি’ নতুন সংযোজন হিসেবে এবার এটাও স্বাক্ষরিত হয়। অবশ্য ১৯৯১-৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া ও কোল্ড ওয়ারের সমাপ্তি এ ক্ষেত্রে এসব চুক্তি করতে পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করেছিল। ওদিকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বাইরে বোমা বানানোতে নিজে স্বীকৃত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারত পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া যুক্ত হয়েছে। ভারত ১৯৭৪ সালে, পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে সফল পরীক্ষাকারীর দলভুক্ত হয়। গত ১৯৯৮ সালে ভারত নতুন করে বোমা বানিয়ে সফল পরীক্ষা করার পর ক্লিনটনের আমেরিকা ভারতের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিল। একইভাবে পাকিস্তানের ওপরও। কিন্তু এখনো এনপিটিতে স্বাক্ষর না করা রাষ্ট্র হিসেবে ভারত-পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া বহাল আছে। যদিও এই টেকনোলজি ও ম্যাটেরিয়াল পাওয়ার ক্ষেত্রে সরবরাহকারী রাষ্ট্রগুলোর ক্লাব নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ (বা এনএসজির) সভায় ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তাদের শর্ত আরো কঠিন হয়ে আছে।
সারসংক্ষেপে এটাই পারমাণবিক বোমার জন্ম ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ ইতিহাস। বললাম কেন? বললাম এ জন্য যে ট্রাম্প এক টুইট করে এই ৬৬ বছরের ইতিহাস মুছে ফেলে আবার যেন ১৯৫০ সালে আমেরিকায় ফেরত যেতে চান, তা-ই বলছেন। তিনি আমেরিকার নিউক্লিয়ার সক্ষমতা শক্তিশালী ও বৃদ্ধি করা দরকারের কথা অবলীলায় মাত্র ১৪০ অক্ষরের মধ্যে খুবই সহজে সেরে ফেলেছেন। এটা তাদের দ্বারাই সম্ভব, যারা পারমাণবিক বোমার জন্ম ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা পৌঁছানোর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। কারণ অজ্ঞদের সুবিধা সবার চেয়ে বেশি। আমরা কল্পনা করতে পারি, এক খোশমেজাজি পার্টির কথা, যেখানে রাজনীতিবিদ বন্ধুদের সাথে সহপাঠী ব্যবসায়ী বন্ধুদের অনেক দিন পরে দেখা হয়েছে। তো ব্যবসায়ী বন্ধুরা যেভাবে সহজেই সরকার চালানো বন্ধুদের বিভিন্ন ইস্যুতে সবক দিয়ে থাকে তেমনই আর কী! যেন বলছে ও তোরা ওমুক জিনিসটা কন্ট্রোল করতে পারলি না? আমাকে একবার প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দে, দেখো আমি দুই দিনে করে সব ঠিক করে দেখাচ্ছি!
এমন কথা আমরা অনেকেই বলতে শুনেছি ও দেখেছি। অন্তত ‘এক দিনের মুখ্যমন্ত্রী’ এই কল্পনায় তৈরি হিন্দি সিনেমা ‘নায়ক’ দেখেছেন অনেকেই। তখন একজন ট্রাম্প হওয়া সহজেই সম্ভব। কিন্তু যেসব ইস্যু দুনিয়ার রাষ্ট্রস্বার্থগুলোর নানা লড়াই-ঝগড়া আর আপসের ফলাফলে সবসময় নির্মিত হয়ে চলে এগুলো নিয়ে তুড়ি বাজিয়ে পার্টিতে সমাধান বাতলানো তখনই সম্ভব, যখন আমরা ইতিহাসের ঘটনাবলি সম্পর্কে বেখবর থাকি। কারণ অজ্ঞতা এক বিশাল বাড়তি সুবিধা দেয়। কিন্তু ব্যবসায়ী ট্রাম্প যে এখন আর কোনো পার্টির চাপাবাজ নন, বাস্তবেই তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট? তাহলে এখন কী হবে?
ওপরে যে পারমাণবিক বোমার ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি তা আসলে এ বোমার উদ্ভব, তৈরি, ব্যবহার এবং পরিণতিতে এর ভয়াবহতা বোঝার পর সেই ১৯৪৫ সাল থেকে এ টেকনোলজিকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরে সম্পূর্ণ বন্ধের দিকে গেছে। এখন এ গ্রাফের ঝোঁক হলো এ টেকনোলজি লুপ্ত করে ফেলা। এটা এ ইতিহাস দেখে যে কারো বোঝার কথা। আমেরিকার মতো দেশের যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তার কী এতটুকু আক্কেলজ্ঞান নেই, যে টেকনোলজি গ্লোবাল ঝোঁক লুপ্তপ্রায়ের দিকে তাকে আবার জাগাতে চাওয়াটা কী সম্ভব, না করা উচিত? যেখানে এমনকি এ টেকনোলজির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহারও জার্মানি ও জাপানের মতো দেশ ২০২৫ সালের পর সম্পূর্ণ বন্ধ করার পরিকল্পনা করে ফেলেছে সেখানে এ টেকনোলজির ‘সক্ষমতা শক্তিশালী ও বৃদ্ধি করা উচিত’ এ কথা কী করে একজন হবু প্রেসিডেন্ট বলেন?
প্রেসিডেন্টের মুখ ও লিখিত নির্দেশ কোনো (পার্টির চাপাবাজি ধরনের) বেফাঁস কথা বলে বিপর্যয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ। কারণ প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করতে প্রত্যেক বিষয়ে অজস্র মন্ত্রী-উপদেষ্টা এক্সপার্ট নিয়োগ দেয়া থাকে। তাদের ব্রিফিং সব নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। কিন্তু টুইট করা? প্রেসিডেন্ট উপদেষ্টার পরামর্শ নিয়ে টুইট করবেন? না এটা খুবই হাস্যকর। কিন্তু কী আর করা। রয়টার জানাচ্ছে, এখনই ট্রাম্পের নিয়োজিত এক মুখপাত্র আছে। যাকে নিয়মিত মিডিয়ার চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কারণ বোকা বোকা টুইট লিখে ট্রাম্প যেন খুব মজা উপভোগ করেন। মজার খেলা একটা তিনি পেয়েছেন আর ওদিকে মুখপাত্রের প্রাণ যায়। রয়টার্স বলছে, ওই মুখপাত্র নানাভাবে ট্রাম্পের টুইট খেলাকে গুরুগম্ভীর দিকে অর্থ টানার কসরত করেই চলছেন। তিনি এবার বলেছেন, ট্রাম্পের ওই টুইটকে যেন ‘এ বিষয়ে আমেরিকার কোনো নতুন পলিসি বদল হিসেবে কেউ না দেখে, প্লিজ’। আচ্ছা এ কথাটাই কী ট্রাম্প মজা করা এক বালক মাত্র, তাই বলছেন না?
এখন একটাই পথ বাকি আছে। ট্রাম্প যদি টুইট করা বন্ধ না করেন, তবে শপথ নেয়ার পরের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি ইজ্জত নিয়ে টানাটানির মুখোমুখি হবেন, সম্ভবত।
ওদিকে ট্রাম্পের এ টুইটের বক্তব্য স্ববিরোধী। তিনি বলছেন, একালে আমেরিকার আসল শত্রু ‘টেররিজম’। ফলে কোল্ড ওয়ারে শত্রুতা সোভিয়েতের কথা ভেবে এখনো ন্যাটো টিকিয়ে রাখা অপ্রয়োজনীয়। এ ছাড়া জার্মানিতে বা জাপানের মতো যেখানে এখনো আমেরিকান মিলিটারি ব্যারাক আছে, তাদের খরচ নিজ নিজ রাষ্ট্র বহন করুক। তাহলে সেই ট্রাম্প আবার পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জা বাড়ানোর পক্ষে কথা বলেন কী করে? পোলাপান কখন কী করলে সে যে মজা পায়, সে নিজেও জানে না! তাই কী?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[লেখাটা এর আগে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় ২৫ ডিসেম্বর অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। এখানে তা আবার এডিট করে আবার ছাপা হল।]