ভ্যালু অ্যাডেড চেইনে চীন আছে, ভারত নেই
গৌতম দাস
০২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার

গত বছর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে “ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক” বিষয়ে ঢাকায় এক ‘সংলাপ’-এর আয়োজন করা হয়েছিল। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার এবং আইপিএজি (ইনস্টিটিউট ফর পলিসি অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্নেন্স) নামে এক সংগঠনের যৌথ নামে ও উদ্যোগে তা করা হয়েছিল। দিনব্যাপী ভারত ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, কূটনীতিক, সরকারি প্রতিনিধি ও একাডেমিকরা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান এতে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি গত ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকেই ভারতকে করিডোর দেয়ার পক্ষে কখনো ট্রানজিটের কথা তুলে, কখনো কানেকটিভিটির কথা তুলে সবার আগে থেকে যুক্তির হাল ধরার কাজ করে এসেছেন।
গ্লোবাল অর্থনীতিতে সত্তরের দশক থেকেই গ্লোবালাইজেশনের পক্ষে ঝাণ্ডা উড়তে শুরু করেছিল। আমেরিকা গ্লোবালাইজেশনের পক্ষে ব্যাপক তাগিদ তৈরিতে নেমে পড়েছিল। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের অবস্থানে। ইতিবাচকভাবে বললে, এরই প্রকাশ্য দিক হল – আমাদের মনে আছে নিশ্চয়, “রফতানিমুখী অর্থনীতির” শ্লোগান। মানে, কেবল জাতিবাদী অভ্যন্তরীণ বাজারমুখিতা আর নয়; এর বদলে রফতানিমুখী করে নিজ অর্থনীতি সাজানো। এর এক মৌলিক স্বীকৃত দিক হল, নিজের বাজারে অন্যকে ঢুুকতে দেয়া এবং অন্যের বাজারে প্রবেশের সুযোগ নেয়া। তবে বাস্তবে এই দেয়া-নেয়ার কোনো কিছুই একেবারে অবাধ নয়। মূল কথাটা বললে, গ্লোবাল অর্থনীতি কেবল কিছু পরাশক্তিগত বিশেষ ক্ষমতার অধীনেই কার্যকর, ফলে অসাম্য পণ্য বিনিময় এক বাস্তবতা। সুতরাই এখানে এ ক্ষেত্র ‘অবাধ’ বলে কিছু নেই। দুনিয়ায় উপস্থিত সেসব ক্ষমতাবান রাষ্ট্র ও তাদের অর্থনীতির আধিপত্যের অধীনে এবং তাদের মাতব্বরি মেনে নিয়েই এটা কেবল ঘটতে পারে। এই “রফতানিমুখী অর্থনীতির” ফাংশনাল দিকটাই এমন। যেমন আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পণ্য ঢুকতে গেলে সেটা অবাধে নয়; বরং কোটা, মাল্টি ফাইবার এগ্রিমেন্ট বা তেমন অনুমতি থাকলেই কেবল ঢুকতে পারে। নইলে রক্ষণশীল প্রটেকটিভ বিশাল অঙ্কের শুল্ক দিয়ে “অবাধে” ঢুকতে হবে। বিপরীতে বাংলাদেশে আমেরিকার পণ্যের বেলায় সেটা অবাধ। এই সমস্যা ছিল এখনও আছে। ফলে অসাম্য পণ্য বিনিময়ে আছে। এমন অসাম্যের পরও বাজার যতটুকু আমাদের দখলে থেকে যায়, সে ফ্যাক্টর হল নিজ শ্রম-দক্ষতা আর কোয়ালিটি পণ্য বা সস্তা প্রতিযোগী পণ্য দিয়ে নিজের জন্য তুলনামূলক বাড়তি সুবিধা যেখানে যার বেশি, সে ভিত্তিতে ও কারণে। এসব সীমিত অর্থে এই গ্লোবালাইজেশন – তবু এটা রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ধারণা ও অবস্থানের বিপরীত একটা অবস্থান অবশ্যই। এটাকে অনেকে পশ্চিমের “মার্কেট লিবারালাইজেশন” বলেও চেনাতে চান। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই গ্লোবালাইজেশনের সবচেয়ে ইতিবাচক অবস্থান হল, দুনিয়াজোড়া সবার মধ্যে এক এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থা- এক গ্লোবাল পণ্যবাণিজ্য, পণ্যবিনিময় ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলছে এটা। আর ইতোমধ্যেই এটা যে জায়গায় বিকশিত হয়ে বা পৌছে গেছে তাতে এটা আর আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব।
গ্লোবালাইজেশনের পক্ষে তত্ত্বগত ও প্রচারের দিকগুলো যখন প্রথম আনা হয়েছিল, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, তখন এখানে ১৯৮২ সালের সামরিক ক্ষমতা দখল ও সংস্কার কর্মসূচি চালু করার সময় ছিল। রফতানিমুখী অর্থনীতির নেতিবাচক দিকগুলো বাদ রেখে কেবল ইতিবাচক দিকগুলো আদর্শিকভাবে হাজির করলে যা হবার কথা, সে প্রসঙ্গে সে সময় একাডেমিক জগতে এক বয়ান চালু ছিল। যেমন, বলা হত – কল্পনা করুন, প্রত্যেক রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠী একটা বা কয়েকটা করে পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে দক্ষ হয়ে উঠলে, সারা দুনিয়ার বাজারের জন্য তৈরি করে এরপর সেসব পণ্য প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজেদের পরস্পরের মধ্যে বাধাহীন বিনিময় ঘটাতে পারলে এই বেনিফিট সব জনগোষ্ঠীই পেতে পারে। সবাই কোনো-না-কোনো পণ্য উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করবে এবং দক্ষ শ্রমের অধিকারী হয়ে উঠবে। এতে একটা গ্লোবাল বাজার ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে এবং এর মাধ্যমে এক গ্লোবাল বাণিজ্য গড়ে ওঠার কারণে গ্লোবালাইজেশন ঘটানো সম্ভব। সবাই যার সুফল ভোগ করবে। জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল ক্যাপিটালিজমের বিপরীতে এটাই এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ব্যবস্থার (বাস্তবায়ন করতে হবে এমন) মডেল ধারণা।
গত বছর ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক’ বিষয়ে ঐ সংলাপে রেহমান সোবহান এই গ্লোবালাইজেশনেরই আরোও এক কোয়ালিফায়েড বৈশিষ্ট্য আরোপ করে কথাটা পেড়েছিলেন। সে কথাটা হল – ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’ (value addition chain) তৈরির দিক থেকে প্রসঙ্গটাকে বিচার করা। ভ্যালু এড মানে কোন কাঁচামালে অথবা আধা-সম্পুর্ণ পণ্যে আবার শ্রমের প্রবেশ ঘটিয়ে তাকে আরও-সম্পুর্ণ পণ্য বা একেবারে সম্পন্ন পণ্যে রূপান্তর করা। একই দেশে কাঁচামাল থেকে সম্পুর্ণ পণ্যে রূপান্তর না ঘটিয়ে নানান দেশে তা সম্পন্ন করা এটাকে ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’ পণ্য উতপাদন বলা হয়। গ্লোবালাইজেশনের মধ্যে এটা আর এক জটিল ধাপ উপরে উঠে এটা এক ধরণের পণ্য উতপাদন ও বিনিময়। রেহমান সোবহান বলছিলেন ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’-এর দিক থেকে দেখে তুলনা করে বলছিলেন সিনসিয়ার মনোযোগী হওয়ার কারণে চীন কেন সফল আর ভারত কেন বিফল, সে আলোচনা তুলেছিলেন। চীনের ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’ মানে হল, একটা প্রডাক্টের কয়েকটা অংশ কয়েকটা চীনের পড়শি দেশ থেকে তৈরি হয়ে আসার পর অর্থাৎ ভ্যালু যোগ হয়ে আসার পর সেগুলো চীনে জড়ো হবে, এরপর সেগুলো সব চীনে অ্যাসেম্বল বা সংযুক্ত হয়ে একটা ফাইনাল প্রডাক্ট হিসাবে বের হবে। অর্থাৎ চীন পড়শি কয়েকটা দেশকে সাথে নিয়ে একটা ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’-এর মাধ্যমে তৈরী প্রডাক্ট এবার রফতানি করবে। এতে সংশ্লিষ্ট সব অর্থনীতিই পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে একসাথে বেড়ে উঠবে, সবাই লাভবান হবে। এ ছাড়া, পুরাটাই চীনে করতে হবে এমন জাতীয়তাবাদী ধারণা নয় এটা। ফলে এটা শুধু সবার ফিনিসড পণ্য বিনিময় বাণিজ্য ক্রবে তা নয়। পণ্য উতপাদনেই শেয়ার করা এক পণ্য উতপাদন। তিনি চীনের প্রশংসা করছিলেন চীনের পড়শিদের সাথে এমন ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’ প্রডাক্ট তৈরির সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে সে জন্য। প্রফেসর রেহমান সোবহানের বক্তব্যসহ পুরা অনুষ্ঠানের প্রায় এক ঘন্টার ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবে পাওয়া যায়, যা আগ্রহীরা দেখতে পারেন।
চীনের পথ ধরে বাংলাদেশের সাথে ভারত ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’-এর সম্পর্ক গড়তে পারেনি বলে তিনি ভারতের সমালোচনা করছিলেন। তিনি বলছিলেন, ৩৯০ বিলিয়ন ডলারের ভারতের আমদানি ব্যবসার ০.২ শতাংশও বাংলাদেশ পায়নি। এই তথ্য হাজির করে তিনি সমালোচনা করছিলেন। বলছিলেন, “অথচ বাংলাদেশ নাকি ভারতে বিনা কোটায় ও বিনাশুল্কে পণ্য রফতানির সুবিধাপ্রাপ্ত” “বন্ধুরাষ্ট্র”। এই হল ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বন্ধুরাষ্ট্রের” দশা। আসল বাংলাদেশের দশা বুঝানোর জন্য তিনি আরো শক্ত উদাহরণ তুলেছিলেন। তিনি তুলনা দিয়ে বলেছিলেন, ভারত নানা পণ্য রফতানিকারী যেসব দেশ ভারতে বাংলাদেশের মত কথিত কোনই ফ্রি ট্রেড সুবিধাপ্রাপ্ত নয়, যেমন- ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, এমনকি মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার মতো এসব রাষ্ট্রও ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি রফতানি করে থাকে।
অর্থাৎ, রেহমান সোবহান এখন ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’-এর জায়গায় দাঁড়িয়ে ভারতের সমালোচক হতে চাইছেন। সেটা প্রশংসনীয় সন্দেহ নাই। তবে ২০০৭ সাল থেকেই আমরা তাঁর মুখ থেকে ট্রানজিট বা কানেক্টিভিটির কথা শুনে আসছি, কিন্তু কখনো ‘ভ্যালু অ্যাডিশনের চেইন’ এই ক্রাইটেরিয়া দিয়ে তিনি কথা বলেছেন, এমন শোনা যায়নি। এখন সমালোচক হওয়াতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান দশার দায় তার ওপর কি কমে আসবে? তা দেখতে হবে।
তবে রেহমান সোবহান এখন কড়া সমালোচক হলেও পুরনো স্টাইলে ভারতের প্রশংসা করা এবং ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে পঞ্চমুখ হওয়ার লোক অনেকে এখনো বোধ হয় আগের মতোই আছেন। এদের একজন হলেন সাবেক কূটনীতিক ফারুক সোবহান। তিনি আমেরিকাকেন্দ্রিক থিংকট্যাংক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী। তিনি গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬ প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যেখানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের চারটি উন্নতি তিনি দেখেছেন বলেন। জানিয়েছেন, উন্নতির ক্ষেত্র এর চেয়ে বেশি থাকলেও তিনি সদয় হয়ে বেছে কেবল চারটি উল্লেখ করেছেন; যার প্রথম আর সবচেয়ে বড় সফলতার ক্ষেত্রটা নাকি “বিদ্যুৎ সহযোগিতা”। অথচ সোজা কথায় বললে, আসলে ভারতকে “বিদ্যুৎ ট্রানজিট” দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের এপার ওপার যোগ করে নেয়া হয়েছে। অথচ তিনি বলছেন, এই অবকাঠামো নাকি আমাদেরকে ভারতীয় বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য সদয় হয়ে করা হয়েছে। ফলে এটাই নাকি আমাদের স্বার্থে উন্নয়ন। আর ভবিষ্যতে নেপাল ও ভুটানে আকাশকুসুমে কল্পিত বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে কল্পিত সেই বিদ্যুৎ আমাদের কেনার পথ সুগম হয়েছে এতে। এটাই ‘সফলতা’। অথচ এখনই নেপালে যেসব বিদ্যুৎ কোম্পানী ভারতীয় মালিকানায় নয় তাদের বিদ্যুৎ বিক্রিতে জটিলতা শুরু হয়েছে। তাঁর দ্বিতীয় পয়েন্ট হল, ভারতের বাজারে বাংলাদেশ নাকি কোনো শুল্ক অথবা কোটা ছাড়াই অবাধ রফতানি সুবিধা ভোগ করছে। এমনকি নন-ট্যারিফ যেসব বাধা ছিল সেগুলোও নাকি অপসারণ হয়েছে। প্রকৃত পরিস্থিতি যে পুরা উল্টা, সেটা আমরা ওপরে খোদ রেহমান সোবহানের বরাতে জেনেছি। তিনি পরিসংখ্যান হাজির করে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের তৃতীয় ও চতুর্থ অর্জন হিসেবে ফারুক সোবহান এনেছেন বাংলাদেশ ভারতকে নিজের দু’টি পোর্ট ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছে। আর চতুর্থ হল ভারতের নর্থ-ইস্ট নাকি এখন আমাদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। অথচ হয়েছে ঠিক উল্টা। ট্রানজিট দেয়াতে বাংলাদেশী পণ্যের চেয়ে ভারতের অপর অংশের পণ্য তার নর্থ-ইস্টে আমাদের বেশি প্রতিযোগী হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের দু’টি পোর্টই বিনা শুল্কে ভারতকে ব্যবহার করতে দেয়ায় তাতে আমাদের কিভাবে উন্নতি হয়েছে তা তিনি ব্যাখ্যা করে কিছুই বলেননি।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[লেখাটা এর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ দৈনিক নয়াদিগন্ত অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। এখানে নতুন ভার্সান হিসাবে নতুন করে এডিট শেষে ছাপা হল। লেখকের সাথে কেবল জরুরি যোগাযোগের প্রয়োজনে উপরের ই-মেল ব্যবহার করা যাবে। ]