হাসিনার ‘র’-কে তুলাধুনাতে টার্গেট ছিল কে
গৌতম দাস
২৯ মার্চ ২০১৭ ভোর সাড়ে পাঁচটা
গত ১১ মার্চ মহিলা আওয়ামি লীগের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বোমা ফাটানোর মত এক বক্তব্যে বলেন, “২০০১ সালে পার্শ্ববর্তী দেশের কাছে দেশের সম্পদ বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসলেও তারা আজ ভারত বিরোধিতার কথা বলছে। ভারতবিরোধিতার কথা বিএনপির মুখে মানায় না”। বাসসের বরাতে প্রথম আলো এই সংবাদ ছেপেছিল।
এই বক্তব্য হাসিনা এর আগেও মানে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগেও অনেক সময় রেখেছিলেন, কম বেশি একই ভাষায়। সেখানে তার বলবার মূল পয়েন্ট থাকত যে, দেশের স্বার্থে তিনি নাকি আপোষ করেন নাই বলে ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন নাই। তাই কথাগুলা পুরানা কথার বরাতে আবার কমবেশি একই কথা ফলে সে হিসাবে হয়ত মনে হতে পারে কথার নতুন তাৎপর্য কিছু নাই। কিন্তু তাই কি? এবারের তাঁর বক্তব্যে সবচেয়ে নতুন এবং তাৎপর্যময় দিকটা হল বক্তব্যের পরের অংশে। প্রথম আলো লিখেছে, “শেখ হাসিনা আরও বলেন, এখন ভারতবিরোধী কথা বললেও আমেরিকান অ্যাম্বাসি, র-এর লোকেরা তো (তখন) হাওয়া ভবনে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকান এম্বেসি খুবই পুরানা রেফারেন্স। অন্তত বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে রাজনীতিতে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে রেফারেন্স দিয়ে কমিউনিস্ট প্রগতিশীলেরা যেদিন থেকে তাদের রাজনীতি পপুলার করার চেষ্টা করেছে সেদিন থেকে আমেরিকান এম্বেসির রেফারেন্স টানা খুবই চালু একটা ফর্মুলা। পরবর্তিতে আওয়ামি লীগ-বিএনপি ধরণের প্রধান ধারার দলগুলোও পরস্পর পরস্পরকে ‘এম্বেসির রাজনীতি’, বা ‘অমুক পাড়া’, ‘তমুক পাড়া’ বলে খোঁচা মেরে কথা বলেছে। একালে আবার ২০০৭ সাল থেকে আরও এক শব্দ — “সুশীল রাজনীতি”– বলেও শুধু খোঁচা নয়, কঠোর সমালোচনার রেফারেন্স হয়েছে। সত্যিকার অর্থে, আমেরিকার বিদেশ নীতির অংশ হল, তথাকথিত “সিভিল সোসাইটির” ঘাড়ে চড়ে “গুড গভর্নেস” কায়েমের রাজনীতি সচল রাখা। যার মর্ম হচ্ছে – ‘গণতন্ত্রের বুলি’ কিম্বা সুষ্ঠ নির্বাচন মার্কিন স্বার্থের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ না, বরং শাসন ব্যবস্থা ঠিক রেখে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষমতা ও তাদের পুঁজির বিনিয়োগ ব্যবসা-বাণিজ্য লেনদেনেও আমেরিকার আধিপত্যে রেখে চালিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন ‘নোংরা’ হস্তক্ষেপ বা-হাত ঢুকানোর মাজেজা এখানে। এটাকেই আমরা ঠাট্টাচ্ছলে আমেরিকার দেশি সাগরেদদের নাম চালু করেছি ‘সুশীলদের রাজনীতি’ হিসাবে। এই বিচারে হাসিনার মুখে আমেরিকান এম্বেসি – খুব নতুন কিছু রেফারেন্স নয়। বাংলাদেশের খোলা সমাজে বিরাজনীতিকরণের অপতৎপরতা আমরা ন্যাংটা করে ফেলতে পেরে গেছি বহু আগেই। কিন্তু ‘র’ এর রেফারেন্স? তাও একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখে? এটা খুবই নতুন, বিশেষ করে শেখ হাসিনার মুখে।
‘র’ মানে হল, ইংরাজিতে আর-এ-ডব্লিউ (RAW), রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং। ভারতের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ভিন রাষ্ট্রে ভারতের গোয়েন্দাগিরি ও সে দেশের চোখে যা সাবভারসিভ কর্মকাণ্ড, সেই তৎপরতা চালানোর ভারতের প্রধান গোয়েন্দা সংগঠন হল এই ‘র’, ১৯৬৮ সালে যার জন্ম। তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মুখে ভারতের ভিন দেশে (বাংলাদেশে) কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স চালানোর সংগঠনের রেফারেন্স শোনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিশেষ করে যখন প্রধানমন্ত্রী নিজের মুখে কথাটা তুলেছেন। এটা খুবই সিরিয়াস বিষয়। বিশেষ করে যখন বিরোধীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল – বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারে ভারত বা ‘র’ এর প্রভাব এখন সবচেয়ে বেশি; সেই সময় খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে ‘র’ এর নাম ধরে খুবই খারাপ নিন্দাসুচক মন্তব্য নিঃসন্দেহে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
প্রাথমিক ভাষ্য হিসাবে যদি বলি, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সংগঠন হিসাবে ‘র’ মানেই অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব থেকে শুরু করে মানুষ খুনোখুনি পর্যন্ত সবই পেশাদারি কায়দায় করা। নিজ দেশের স্বার্থে অন্য দেশের স্বার্থবিরোধী সব ধরণের তৎপরতা চালানো যেটাকে আমরা লিগাল টার্মে ‘সাবভারসিভ এক্টিভিটি’ বলি। কাজেই প্রধানমন্ত্রী নিজেই ‘র’ এর তৎপরতার জন্য খোলাখুলি তুলাধুনা করাকে খারাপ কী? আমাদের ত ইতিবাচকভাবেই নিতে হবে। কারণ এগুলো বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের প্রশ্ন। এখানে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভাবভালবাসার কিছু নাই।
পটভুমি হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর মুখে এই বক্তব্যগুলো আসারও পিছনের কথা হল, আগামি মাসে প্রথম সপ্তাহে হাসিনার আসন্ন ভারত সফর। যা আবার ভারতীয় মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী ‘বাংলাদেশের কাছে দাবি করা কথিত “ডিফেন্স প্যাক্ট” এর ভারতীয় প্রস্তাব’ – এই চাপের মুখে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর করছেন । সম্প্রতি বাংলাদেশ চীন থেকে দুটা সাবমেরিন কিনেছে। সেই কেনা কে কেন্দ্র করে পালটা প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাঁর তিন বাহিনী প্রধানকে নিয়ে গত বছরের ০২ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফর করেছেন। পত্রিকান্তরে ও সোশাল নেটওয়ার্কে বলা হচ্ছে বাংলাদেশকে ভারতের সাথে ২৫ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি (“ডিফেন্স প্যাক্ট”) করতে প্রস্তাব রাখা হয়েছে এবং তা স্বাক্ষরের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। – এই হল সংক্ষেপে ঘটনার কিছু ব্যকগ্রাউন্ড রেফারেন্স বা বড় পটভুমি। সর্বশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের বিদেশ সচিব জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ভারতের দিক থেকে আরও স্পষ্ট প্রস্তাব নিয়ে নাকি কথা হয়েছে ‘শুনা গেলেও’ বাংলাদেশের কোন মিডিয়া জয়শঙ্করের সফরে কি আলোচনা হয়েছে তার কোন রিপোর্ট প্রকাশি করে নি। এমনকি আনন্দবাজারের রিপোর্টে ডিফেন্স প্যাক্ট প্রসঙ্গে কিছুই বলা হয় নাই। তবে কেবল ২৩ ফেব্রুয়ারির ইংরেজি দৈনিক নিউএজ একটা রিপোর্ট ছাপলেও সেখানেও বিশেষ বা বিস্তারের কোন খবর সেখানেও ছিল না। কেবল শিরোনাম ছিল “দিল্লী ঢাকাকে ডিফেন্স ডিল করতে চাপ দিচ্ছে”। এমনকি ভারতের অন্য মিডিয়া থেকেও বিশেষ কিছু জানা যায় নাই। ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র সুবীর ভৌমিকের এক রিপোর্ট যেটা আবার ভারতের মিডিয়ায় না হংকংয়ের এক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু কে এই ভারতীয় সুবীর ভৌমিক, এখন কী করেন এটা আজও তিনি পরিস্কার করেন নাই।
ইতোমধ্যে ফেসবুকে “অস্ত্রের বদলে ফুল, স্কুল বা হাসপাতাল করা উচিত টাইপের ‘ইমোশনাল ফুল’দের প্রপাগান্ডা” দেখেছি আমরা। এরা রাষ্ট্র বুঝবে না। এরা ‘প্রতিরক্ষা’ এবং ‘উর্দি’ এসব শব্দের তাৎপর্য বুঝবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এদের নিয়ে কথা খরচ অপ্রয়োজনীয়। তবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা জুড়ে “ব্লু ওয়াটার” দেখতে পাওয়া, নজরদারি রাখা – এসব তো বাংলাদেশের থাকতেই হবে। এই এলাকায় নিজেদের নিরাপত্তা বিশেষত প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট স্ট্রাটেজিক বিষয়ের ওপর যথা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং সম্পদ রক্ষার স্বার্থ আমাদের জেনুইন স্বার্থ। শুধু রাষ্ট্রের নয়, বাংলাদেশের জনগণের সামষ্টিক স্বার্থও অবশ্যই। সেই বিচারে বাংলাদেশের সাবমেরিন হাতে আসাতে অনেকে অখুশি হতে পারেন। দিল্লির ক্ষোভ আমরা বুঝি। দিল্লির হয়ে দেশের ভেতরে যারা আপত্তি করছেন, তাদেরও তো আমরা চিনি। তা হলেও এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থ বটে। কিম্বা রাষ্ট্রের দিক থেকে – বিশেষত প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেনাবাহিনীর দিক থেকে দেখলে কোর রাষ্ট্রস্বার্থ। যারা অখুশি তাদের আরেক গোষ্ঠি হল রাশিয়ার পুতিন ও তার প্রপাগান্ডা পত্রিকা স্পুটনিক। যারা রাশিয়ান কিলো সাবমেরিনের কাস্টমার ছুটে যাওয়াতে অখুশি হয়েছে। দুজনেই অখুশি হলেও ভারতের স্বার্থগোষ্ঠি ও রুশ স্বার্থগোষ্ঠির আর্গুমেন্ট বা পয়েন্ট আলাদা। ভারতের স্বার্থবুঝের সার কথা হল – চীন থেকে কেন? চীনের সংশ্লিষ্টতা কেন? বরং ভারতের মাধ্যমে অন্য কোথাও থেকে হলেও আমাদেরকে নাকি সেটা কিনতে হত। ট্রেনিং চীন থেকে কেন? ভারতের থেকে নিতে হত। বাংলাদেশের সচিবালয়ে নাকি এখন চিন-প্রেমিক আমলা-সচিবে ভরে গেছে। এই অভিযোগ তুলে ভারতের টকশোতে এখন আলাপ হচ্ছে। এতদিন একই অভিযোগ শুনতাম চীনের জায়গায় ভারত শব্দ বসিয়ে। মানে বাংলাদেশের যেন স্বার্থ নাই, আছে চীন নাহলে ভারত!
তর্কের খাতিরে সাবমেরিন টা ভাল না মন্দ, নতুন না পুরানা অথবা ঠিক ‘না কিনলে হয় না’ টাইপের অবস্থান অনেকের হতে পারে। তবে এটা দিল্লির অবস্থান না। যদিও অনেক সময় তাদের কথায় তারা এমনটা ভাব ধরবার কোশেশ করে, যেন ভারতীয় মনোবাঞ্ছার স্বরূপ আমরা বুঝতে না পারি। আসলে দিল্লির চোখে বাংলাদেশের আলাদা অস্তিত্ব যেন নাই। তাই ভারতের স্বার্থের প্রাধান্যের নীচে বাংলাদেশকে রাখতে হবে। বাংলাদেশ তেমন করে তা রাখছে না কেন, সেখানেই দিল্লীর আপত্তি। কিন্তু দিল্লিকে বুঝতে হবে বাংলাদেশ সন্দেহাতীত ভাবে ইন্ডিপেন্ডেন্ট। এবং এটা দিল্লির ইচ্ছার উপর নয়। আর এই ইন্ডিপেন্ডেন্সে দিল্লির হাত ঢুকানোর কোন চেষ্টা ভারতের স্বার্থেরই বিপক্ষে যাবে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাংলাদেশকে চীন, ভারত কিংবা আমেরিকা থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট অর্থে নিরপেক্ষ থাকা, থাকতে দেয়ার মধ্যেই সবার জন্যই ভাল। যাতে একটা শক্তির ভারসাম্য দক্ষিণ এশিয়ায় বহাল রাখা যায়। এখানে ভারতের নাদানিতে নগদ লাভের লোভে আমরা ভারতের দিকে কান্নিমারা এক বাংলাদেশ সরকার অথবা রাষ্ট্র বানাতে পারি না। দেশ বেচে হলেও ক্ষমতায় থাকতে হবে এই পণ করে কাউকে ক্ষমতায় থাকতে দিতে পারি না। বিপদে বাংলাদেশের দায় একান্ত বাংলাদেশেরই। কেউ ভাগ নিবে না। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের দায়ভার নেয়া অথবা না খাদ্য না অর্থ সহায়তা আমাদের ‘বন্ধু’ ভারত অথবা রাশিয়া কেউই নেয় নাই। এই অভিজ্ঞতা শেখ মুজিবের চেয়ে ভাল কে বুঝেছিল! অতএব আমরা কারো কোন মোহ রাখা, বন্ধুত্ত্বের তত্ববাজি করার, সাফাই গাওয়ার কোনই সুযোগ নাই। বাংলাদেশে ভাগ্য আমাদের ভাল-মন্দ, আমাদের দায় দায়িত্ব এবং স্বার্থ একান্তই আমাদের। এই জোনের মধ্যে কাউকেই ঢুকতে দিবার কোন সুযোগ নাই। এমন আত্মঘাতি আমরা হতে পারব না।
আর ওদিকে আমাদের নেভির সাবমেরিন কমিশনিং বা আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাও ছিল গুরুত্বপুর্ণ। তাঁর বক্তৃতা থেকে মনে হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গুজব আগাম নাকচ করার কথা তাঁর খেয়ালে আছে। কিন্তু কে না জানে শেষ বিচারে তাঁর কথা না এক্ট মানে কাজের উপর নির্ভর করবে সত্য-মিথ্যা গুজবের ডালপালা তিনি ঠিকঠাক মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন কি না। বাংলাদেশের ব্লু ওয়াটার একান্ত স্বার্থকে বিঘ্নিত করলে কম্প্রোমাইজ করলে যে কোন সরকারকেই চরম কাফফারা দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। কারও ক্ষমতায় থাকার স্বার্থ দিয়ে এটা নিগোশিয়েবল নয়। এই ভুল না করাই বুদ্ধিমানের।
দুইঃ
আর এসব কিছুর শেষে এসেছে হাসিনার ‘র’ ব্যাসিং, যাকে বাংলায় ময়লা ঝাড়ু দিয়ে ঝাড়ি দেয়া বলা যায়। এটা সত্যি সত্যিই ছিল কঠোর ঝাড়ি দেয়া। কিন্তু কেন? আসল টার্গেট কে? উদ্দেশ্য কী?
উদ্দেশ্য একঃ ‘র’ এর নাম ধরে এই ব্যাসিং বা ঝাড়ি – এটা ছিল দ্ব্যর্থহীন এবং টার্গেটেড। তত্ত্বগতভাবে কোন রাষ্ট্রের ভিতর আমলা-গোয়েন্দা বনাম রাজনীতিবিদ এই দুইয়ের টেনশন অনেক পুরানা। তবে আমাদের সুনির্দিষ্ট কেসে এখানে একটা ক্রশকান্ট্রি ডাইমেনশনে হাজির হয়েছে। অর্থাৎ এখানে হাসিনার ব্যাসিং টা ঘটছে ভারতের ‘র’ (আমলা-গোয়েন্দা) বনাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা ( বা রাজনীতিবিদ) এদুইয়ের টেনশন হাজির আছে বা ছিল একথা মনে রেখে। হাসিনা বলতে চাইছেন ভারতের ‘র’ তোমরা লো-প্রফাইলে থাক ওটাই তোমাদের জায়গা। আমি ( বা দুদেশের আমরা) রাজনীতিক, ক্ষমতার পর্যায়ে দুই দেশে যারা আছি তারা বসে যা সাব্যস্ত করব তার অধীনে তোমরা ফাংশান করবা। সবকিছুই আমলা-গোয়েন্দাদের বিষয় নয়। ‘রাজনীতিক’ ডায়লগ ও নিগোশিয়েশন বলে একটা স্তর আছে, সেখানে এক কথায় রফা বলে উপরের স্তরে কিছু কাজ আছে। সেটা তোমাদের মানতে হবে। আর ভারত কি চায়, সে চাওয়া আমি ওয়াকিবহাল। কিন্তু আমার সমস্যাগুলো নিয়ে তোমাদের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি (যিনি আমার দুঃখ ভাল বুঝেন) তার মাধ্যমে আমাকে কাজ করতে দাও। তার মাধ্যমে ভারতীয় বাকি ক্ষমতা ও রাজনীতিকদেরকে পৌছানোর সুযোগ আমাকে নিতে দেও। মনে নাই এর আগে (১৯৯৬-২০০১) তোমরা এদিকটা বুঝ নাই, ডানে বায়ে হাত ঢুকিয়েছিলা! আমাকে পাশ কাটিয়ে বিএনপির সাথে রফা করে তোমাদের স্বার্থ উদ্ধারের পথে গিয়েছিলা!
এখানে হাসিনার এই ব্যাখ্যা ও ফ্যাক্টস সবটা সত্য অথবা না, কতদুর কী অথবা এটা তাঁর দিক থেকে স্রেফ তাঁর দলীয় বয়ান মাত্র কী না – সে প্রসঙ্গেও আমরা কিছুই নিশ্চিত নই। তবে এভাবে রেফারেন্স দেয়া এটা বড়ই তামাশার। কারণ ঘটনাবলি ঘটার যে রেফারেন্স এখন দেয়া হচ্ছে, আমরা জনগণ সেসময়ে এসবের কিছুই জানি নাই। জানানো হয় নাই। তখনকার সরকারও জনগণের কাছে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আসে নাই, বিচার দেয় নাই।
প্রধানমন্ত্রীর ঝাড়ি শুনে আগে ‘র’ এর প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে যাব। এরপর উদ্দেশ্য দুই’য়ে আসব। “শেখ হাসিনার ‘র’ বিষোদগারের নেপথ্যে” এটা – সুবীর ভৌমিকের ১৬ মার্চের লেখা। শিরোনামে লিখছেন, “হাসিনার বিষোদ্গার” (মানে হাসিনা বিষ উগলাইছেন)। এই উপস্থাপনায় যেন মনে হচ্ছে হাসিনা তাঁর ভারতেরই ভালা করেছেন, হিরো তিনি! কারণ অন্তত এখন ভারতের বিরুদ্ধে বিষ উগলানোর কাজটা তিনি করতে পেরেছেন। কিন্তু এটা আবার আমাদেরকে শুনতে হচ্ছে অজানা অচেনা এক সুবীর ভৌমিকের মুখ দিয়ে! সত্যিই অদ্ভুত! যা হোক, সুবীর ভৌমিকের লেখা আসলে পুরাটাই ‘র’ এর প্রতিক্রিয়া এবং হাসিনার ব্যসিংয়ের বিরুদ্ধে ‘র’ এর পালটা সাফাই। সুবীর ভৌমিক এখানে ‘র’ এর মুখপাত্রের ভুমিকা নিয়েছেন। হাসিনা তাঁর কথাগুলো বলেছেন ইঙ্গিতে, বিশেষ করে পরিপ্রেক্ষিত পটভুমি খুব একটা পরিস্কার করেন নাই বা করা সম্ভবও ছিল না। তবে যাদের বুঝার বুঝেছে। মজার দিক হল, তাঁর এই সিরিয়াস অভিযোগকে আইনি চোখে দেখলে হাসিনা বলছেন, ‘র’ এই প্রতিষ্ঠান মানে খোদ দিল্লী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে ‘র’ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। অথচ তা না। বরং এটা তামশা। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে এতে কোন আইনি একশনের প্রতিশ্রুতি নাই। খোদ ভারতীয় হাইকমিশনারও ভারতের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ নাকচ করেন নাই। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তিনি নো কমেন্ট বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁর ভাবটা এমন যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখানে ‘র’ এর ব্যাসিং করে ভারত রাষ্ট্রের প্রশংসা করেছেন! আসলেই এ’এক ভরপুর তামশাই তামশা!
পটভুমি অস্পষ্ট রাখা নিয়ে ‘র’ এর উপর প্রধানমন্ত্রীর ঝাড়ি প্রসঙ্গে বলছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের দৃশ্যমান দিক হল ‘র’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগের টার্গেট হল বিএনপি। ঝাড়ির আসল খাতক বিএনপি, নাকি ‘র’ এই দ্বৈততা শেখ হাসিনা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন মনে হয়েছে। তাই সেসব কিছু পরিস্কার করলেই এ প্রসঙ্গে ‘র’ এর সাফাই কিছুটা হাজির করা যাবে বলে হয়ত তা তিনি করতে চান নাই । সেটা যাই হোক, সুবীর ভৌমিকের বয়ে আনা ‘র’ এর সাফাই বলতে চাচ্ছে – হাসিনা বক্তব্যে যা বলেছেন সেটা ঘটনার একটা ব্যাখ্যা মাত্র, এর আরও ব্যাখ্যা আছে। ‘র’ তার সাফাই দিয়ে বলতে চাচ্ছে ঘটনা সেরকম নয়। সে সাফাই এর সারকথা হল, ব্যাপারটা সেসময় আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) বাদ দিয়ে বিএনপির সাথে রফা করা হয়েছে এরকম নয়। যা হয়েছে তা স্বাভাবিক ঘটনার লজিক্যাল কনক্লুশন হিসাবেই হয়েছে। আমরা ‘র’ বিশেষ কিছু করি নাই। সুবীর তাই লিখেছেন, “তারেক তার মায়ের পক্ষ থেকে ভারতে গ্যাস রফতানি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিনা,সে ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। তবে তিনি সম্ভবত ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক কিছু কৌশলী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পরে দক্ষিণে কৃষ্ণ গোদাবারি বেসিনে গ্যাসের বিপুল মজুত পাওয়া গেলে আম্বানিরা বাংলাদেশি গ্যাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে”। অর্থাৎ সুবীর বলতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন ফ্যাক্টস সেরকম নয়, এর ভিন্ন বয়ান আছে।
তবে আম পাঠকের কাছে (‘র’ এর পক্ষে) সুবীর জানাচ্ছেন যে হাসিনার ব্রজেশ মিশ্রের উপর রাগ করাটা ঠিক হয় নাই। ব্রজেশ মিশ্র মানে হল ততকালের (১৯৯৮-২০০৪) বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ভারতের প্রশাসনিক স্তর মানে মন্ত্রণালয়ের নানান স্তর বা ধাপ মেনে চলে ‘র’ এর পক্ষে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌছানো বা ফাইল নিয়ে দেখা করার সুযোগ ছিল না। অথচ দরকার, বিশেষ করে গোপনীয়তা বজায় থাকা আর দ্রুত উপরমহলের সিদ্ধান্ত পাওয়ার প্রেক্ষিতে। তাই এই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ তৈরি করা হয়। এই পদবীধারী সিভিলিয়ান তিনি ‘র’ এই প্রশাসনিক উইংয়ের যেন মন্ত্রী যার প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি প্রবেশাধিকার আছে। সেসময় একটা কথা প্রচলিত ছিল, বলা হত ব্রজেশ মিশ্র বাজপেয়ীর কান। অর্থাত এতই বিশ্বাস করতেন তিনি। সেসময়ে তাই ব্রজেশ মিশ্রের উপর শেখ হাসিনার নাখোশ হওয়ার মানে ছিল আসলে বিজেপি এবং বাজপেয়ীর সঙ্গে সম্পর্ক ঝুলে যাওয়া।
এখনকার ‘র’ ব্যাসিংয়ে হাসিনা তাই মনে করায় দিচ্ছেন – বলতে চাচ্ছেন ‘র’ তুমি সেকালের ব্রজেশ মিশ্রের মত ভুল করো না। আমাকে বাদ দিয়ে আবার বিএনপির সাথে ডিল করতে যাইও না। এই কথা ধরতে পেরে তাই সুবীর এখন ‘র’ এর হয়ে সে সময়ের একটা পালটা বয়ান দিচ্ছেন, সাফাই দিতে চেষ্টা করছেন। লিখছেন, “জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিত্র হাসিনাকে তার নীতিতে কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দিলে তিনি যা বলেছিলেন আমি হলফ করে বলতে পারি তা ছিল এ রকম : ‘ভারতের বন্ধু হিসেবে আমার বাবার মতো আমিও আপনাদের সব উদ্বেগ দূর করবো, তবে আমি কিভাবে আমার দেশ চালাবো, সে ব্যাপারে কখনো উপদেশ দেবেন না”। এতে এখানে এক কামে দুই কাম করা হয়েছে। এখানে হাসিনার বক্তব্যের পালটা সাফাই, (‘র’ এর পক্ষে) যে সাফাই হাজির করা হয়েছে সেখানে সুবীর বলতে চাইছেন হাসিনা ভারতের জন্য ত্রাতা তো বটেই কিন্তু আবার বাংলাদেশেরও ত্রাতা, স্বার্থরক্ষার চ্যাম্পিয়ান বলে পিঠ চাপড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন, এই পিঠ চাপড়ানো বা সার্টিফিকেট আসলে (‘র’ এর পক্ষে) তার হাজির করা ঠিক না। কারণ ‘র’ এর ক্রেডিবিলিটি বাংলাদেশে কখনই ছিল না, এখনও নাই। থাকার কথা না। জনগনের তো নয়ই, হাসিনার কাছেও নয়। হাসিনার সাথে সম্পর্কটা হল ব্যবহার করার। কোন খাতিরের সম্পর্ক হতেই পারে না। ফলে ‘র’ এর দেয়া সার্টিফিকেট এটা হাসিনার বিরুদ্ধে যাবে এবং গেছে। হাসিনাকে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার চ্যাম্পিয়ান হিসাবে সুবীর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সেই ইমেজ সত্যি হাসিনার হবে কি না সেটা যাই হোক ব্যাপার হল মানুষ যখন দেখবে ব্যাপারটা নিয়ে ‘র’-এর পক্ষেও সাফাই ওকালতি তৈরি করা হচ্ছে তখন এটা স্মার্ট কাজ মনে হলেও আসলে এটা উলটা। ‘র’ এর সার্টিফিকেট মানেই এটা হাসিনার জন্য দুর্নাম, নেগেটিভ। কারণ কথা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে ‘র’ কে দেখে, ইমেজ কেমন সেখানেই সব প্রশ্ন লুকানো। ‘র’ এর সার্টিফিকেট দিয়ে শেখ হাসিনার ইমেজ বাড়তেই পারে না।
মোট কথা সুবীর ভৌমিকের লেখাটা হাসিনার ‘র’ ব্যাসিংয়ের পালটা ‘র’ এর সাফাই হিসাবে পড়া যেতে পারে। কিন্তু যেটা আসলে হাসিনার জন্য বিরাট বিপদের।
উদ্দেশ্য দুইঃ প্রধানমন্ত্রী ভীত যে (তাঁর ব্যাখ্যা মতে) ২০০১ সালের মত তাকে বাদ দিয়ে ‘র’ আবার আগের মত বিএনপির সাথে কোন রফা করার দিকে যদি আবার তৎপরতা শুরু করে দেয়!! এই সম্ভাবনাকে মেরে ফেলতেই আসলে তাঁর এই ‘র’ ব্যাসিং। উনি বলতে চাচ্ছেন আমরা রাজনীতিকরা মানে প্রণব মুখার্জির মাধ্যমে বাকি ক্ষমতাসীন ও রাজনীতিকদেরকে বুঝাতে সুযোগ চান তিনি। এটা যেন ‘র’ নষ্ট করে না দেয়। আর তার সাথে ভারতীয় রাজনীতিকরা কথা বলার সুযোগ পেলেই ভারতের স্বার্থ ভারত পাবে। আবার এই একই কথা তিনি আভ্যন্তরীণ নিজ জনগোষ্ঠির কাছেও তুলে ধরতে চান। হাসিনা বলতে চান আপনারা তো জানেন লীগ বা বিএনপি দুজনেই ভারতের স্বার্থের নীচে বাংলাদেশের স্বার্থকে ফেলে মারিয়ে চলতে চায়। এব্যাপারে লীগ বা বিএনপি যেহেতু একই নৌকায়, বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকতে সবাই এটা করেছে, ফলে এটা আর কোন ‘দেশের স্বার্থ বেচা’ টাইপের কাজ কিনা সে বিচার করে লাভ নাই। কিন্তু এরপরেও আওয়ামি লীগ যদি এটা করে তবে “ সেটা আওয়ামি লীগ বলে” বাংলাদেশের জন্য তা তুলনামূলকভাবে ভাল হবেই। বাংলাদেশের জন্য কম খারাপ চুক্তি হবে। এই আর্গুমেন্টটাই মূলত তুলে ধরেছে প্রথম আলোর মিজানুর রহমান। তিনি বলছেন ব্যাপারটা দেখতে হবে কে “পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন” কারা এই জায়গা থেকে তুলনা করে। আমরা জানি না এটাই প্রধানমন্ত্রীর আর্গুমেন্ট কী না। নাকি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে থাকার উছিলায় প্রথম আলোর তাঁকে বিপদে ফেলা। কারণ এর কোন সারবত্তা নাই, ‘চেতনার’ সস্তা ইমোশন ছাড়া।
বাংলাদেশের সব কোনা জুড়ে সবখানে কেবল এই আলাপ, হাসিনা কী শেষে সামরিক চুক্তি করেই আসবেন? এ ব্যাপারে আপাতত মনে হচ্ছে, খুব সম্ভবত অন্তত এবার না। সম্ভবত আগামি জুন শেষ হবার আগে না। তবে একথা আগেই পরিস্কার বলে দেয়া যায় যারাই এই সামরিক চুক্তি করে আসবে তারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে বিপদাপন্ন করবে।
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২৯ মার্চ ২০১৭
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা এর আগে অনলাইন পত্রিকা দুরবীনে ২৩ মার্চ ২০১৭ ছাপা হয়েছিল। সে লেখাটাই পরবর্তিতে আরও সংযোজন ও এডিট করে নতুন ভার্সান হিসাবে আজ এখানে ছাপা হল। ]