বাংলাদেশে ‘ভারতের সমর্থনের সরকারও’ কাজ করছে না
গৌতম দাস
১৮ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষ হবার পর সপ্তাহ পার হতে চলছে। এই সফরকে কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনা এখন শেষ হয়েছে ধরে নেয়া যায়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনকেই সবচেয়ে বড় সমালোচনার আসর ছিল বলা যায়। যেকোনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর সফরকে কেন্দ্র করে শীর্ষ সম্মেলনের আবহাওয়ায় নিজ নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়কে ঘিরে সাধারণত প্রচুর জল্পনাকল্পনা হয়ে থাকে। আর তাতে উত্থাপিত বিভিন্ন ইস্যুর সম্ভাব্য অর্থ তাৎপর্য কী তা নিয়ে মিডিয়ায় বিভিন্ন বয়ান ব্যাখ্যা শুরু হওয়া সাধারণ ঘটনা। কিন্তু শেখ হাসিনার সফরকে ঘিরে সেসব বিবেচনায় যত আলাপ-আলোচনা উঠে থাকুক না কেন তা যথেষ্ট ছিল না। যেমন তিস্তার পানি ইস্যুতে আমরা মিডিয়াতে বিস্তর আলোচনা হতে দেখছি যে – কেন পানি দিচ্ছে না, কী সমস্যা, কী হলে দিতে পারে, কবে দিতে পারে, আদৌ দিবে কি না, অথবা কী হলে সমস্যার হাল হতে পারে ইত্যাদি প্রায় সব কিছুই আলোচনায় উঠে এসেছে। এরপরও নির্দ্বিধায় বলা যায় তবু মূল একটা বিষয় কোথাও আসেনি। কী সেটা? না, শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সবচেয়ে বড় সমর্থন জুগিয়ে চলেছে ভারত, বলা যায় এই সমর্থন সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। বাস্তবতা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে কম বেশি সব পক্ষই তা স্বীকার করেন। “ভারতের সমর্থনের সরকার” – ভারতের দিক থেকে দেখলে এটাই কী সবচেয়ে বড় কিছু দিয়ে দেয়া নয়? তাহলে এরপরে আরও কিছু কেন দিবার কথা ভাববে?
ব্ব্র
ব্যাপারটা ভারতের দিক থেকে দেখলে, এই সমর্থনকে তারা এক বিরাট দান বলে গণ্য করে। ভারতের এই দানের অনুভব এটা কেউ আমল করেনি। আর এই দান তারা বাংলাদেশকে দিলো, নাকি তাদের পছন্দের ব্যক্তি বা দলকে দিলো সবই তাদের কাছে সমান। কিছু আসে যায় না। যদিও এর ফারাক বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিশাল হয়ত। কিন্তু ভারত গণ্য করবে দুই ক্ষেত্রেই তারা বাংলাদেশকে বিশাল কিছু দিয়েছে। আর ঠিক সে কারণেই আমরা আর যা কিছু ভারত থেকে আশা করছি তা তাদের চোখে বিবেচনায় আরো অতিরিক্ত, বাড়তি। এ কারণেই সব সময়ই ভারতের মনে প্রশ্ন উঠে কোনো বাড়তি বা অতিরিক্তগুলো সে আর কেন দেবে? বিনা নির্বাচনে একটা সরকার বসিয়ে দেয়া বা তাতে ভারতের সমর্থন দেয়া – এর একটা বড় রকমের মূল্য যে আছে সেটা ভারতকে বুঝিয়ে বলার কিছু নাই। ভারত এটা না বুঝার কথা নয়।
হাসিনার ভারত সফরকে নিয়ে বিস্তর দিকে আলোচনা উঠেছে কিন্তু ভারতের এই দৃষ্টিকোণটা সব আলোচনাতেই অনুপস্থিত। অথচ এটাই ভারতের মুখ্য দৃষ্টিভঙ্গি।
তিস্তায় বা অন্য কোনো যৌথ নদীর বেলায় পানি, এটা তো বাড়তি; এই পানি ভারত কেন দিবে? অথবা ট্রানজিটের মূল্য কেন দেবে, বিনা পয়সায় পোর্ট ব্যবহার করতে পারবে না কেন, সীমান্তে লোক মারা বন্ধ করা ইত্যাদি। আগেই তো সরকারে সমর্থন দিয়ে রেখেছে! এক কথায় বললে সমর্থন দিয়ে সরকার ক্ষমতায় রাখার মূল্য এতই অমূল্য বা তা সীমাহীন হওয়ারই কথা। ফলে সেই অমূল্যদানের পরে এরপর আবার বাংলাদেশের আর কোনো মূল্য চাওয়ার আছে এটা তারা গণ্য করতে রাজি না হওয়ারই কথা। সরকার বসিয়ে দেওয়ার পর সেই সরকারের আর কতটা বারগেন-দড়কষাকষির অবস্থা অবশিষ্ট থাকে! বাকী সব ডিমান্ড সেকেন্ডারী গুরুত্বের হয়ে যায়।
তিস্তার কথাই ধরা যাক, সবশেষ ২০১১ সালে মনমোহনের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা ইস্যু প্রসঙ্গ সবচেয়ে জীবন্ত ছিল। ভারত তখ্নও পানি দিতে পারেনি বা চায়নি। কেবল নাম-কা ওয়াস্তে একটা চুক্তি করে রাখতে চেয়েছিল। বড় জোর যেমন গঙ্গাপানি চুক্তি। চুক্তির সাথে বাস্তবে পানি প্রাপ্যতার সম্পর্কিত নয়। সেবার তিস্তার বেলায় সেটাও হয় নাই। এরপর থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে হাসিনার দিক থেকে ভারতের সমর্থন পাওয়া স্বভাবতই এতই গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ছিল যে ওই নির্বাচনের দুই বছর আগে এবং পরে নির্বাচনের একই সাথে তিস্তা প্রসঙ্গ তোলা হত অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই তোলার বিষয়টা গুরুত্ওব যোগাড় করতে পারে নাই। নির্বাচনে সমর্থন পাওয়া ব্যাপারটা যতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে অন্য যেকোনো ইস্যু তুলনায় ততই গুরুত্বহীন হবে, তোলা হবে না এটাই তো স্বাভাবিক; বাংলাদেশ ততই ‘লেস ডিমান্ডিং’ হবে। বাংলাদেশের এই দুর্বলতার দিকটা ভারতীয় কূটনীতিকদের টের না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই ঠিক এর পাল্লা দিয়ে যেন ভারতের অবস্থা হয়েছে তাদের স্তবার্তথের ইস্যুতে ‘এন্ডলেস ডিমান্ডিং’।
সরকারে রাখার সমর্থনের ‘বিনিময় মূল্যও’ দাবি হয়ে পড়েছে অফুরন্ত। আবার ২০১৭ সালের হাসিনার ভারত সফর, এখানেও তিস্তা গত ছয় বছরের মতোই কোনো ইস্যু ছিল না, হতে পারেনি। কারণ এবার হাসিনার কাছে এর চেয়ে অনেক অনেক উঁচু প্রায়োরিটির একনম্বর ইস্যু ছিল ‘ডিফেন্স প্যাক্ট’। অর্থাৎ ডিফেন্স প্যাক্ট না করে আপাতত শুধু একটা এমওইউর মধ্যে তা সীমাবদ্ধ রেখে যদি ফিরতে পারেন, এটাই হবে তাঁর বিরাট অর্জন। রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আলী একবার স্পষ্ট এই ভাষাতেই কথাটা বলে ফেলেছিলেন।
ভারতের সাথে চীনের বিভিন্ন স্বার্থবিরোধ আছে, থাকাই স্বাভাবিক। সব রাষ্ট্রের সাথেই যেমন সবার থাকে। আর মূলত যে কারণে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা রাষ্ট্র বলে নিজেকে গণ্য রাখে, টিকিয়ে রাখে মিলে যায় না। যেকোনো বড় দুই ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্রেরও স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট আলাদাই হয়, সঙ্ঘাতমুখর হতে পারে। আবার সব রাষ্ট্র একই কূটনৈতিক পথে নিজের স্বার্থবিরোধ নিয়ে লড়ে আর, আদায় ও মোকাবেলা করে না। নানান কায়দা সেখানে থাকে, নরম-গরম, গিভ অ্যান্ড টেক, কোনো ইস্যুতে নরম হলেও আবার একই সময়ে আর এক ইস্যুতে গরম ইত্যাদি সব কিছুর মিশাল, এটাই এই শতকের কূটনীতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু শুধু এই স্বাভাবিক বিষয়টাই ভারত-বাংলাদেশ এখানে কার্যকর নয়। কিছু সীমিত কার্যকর দিক থাকলেও তা মুখ্য নয়। এখানে ব্যতিক্রম বা বাড়তি বিষয়টা হল, ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি যে, ‘বাংলাদেশ’ সেটা তো আমাদেরই সরকার। তাই ভারতের দাবি ও আকাঙ্খা হল, তাহলে চীন-ভারত স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ যেসব জায়গায় সঙ্ঘাতপূর্ণ সেখানে বাংলাদেশ মানে হাসিনা সরকার নিজের সব কিছু ভুলে ভারতের স্বার্থে অবস্থান নেবে না কেন? বাংলাদেশে যেকোন অবকাঠামো প্রজেক্ট থেকে চীনকে বাংলাদেশ দূরে রাখুক – এটা ভারতের কাম্য। ভারতের সব ডিম্যান্ডের-আর্গুমেন্ট, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আকাঙ্খা এখান থেকেই। এটাকে বলা যায় হাসিনা ভারতের ‘দাবির জবরদস্তির’ ভেতর পড়ে গেছে। কারণ ভারত এমন পেতে পেতে এভাবে নিতে ও পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কেন এমন হলো?
একটা উদাহরণ নেয়া যাক। ডিপ সি পোর্ট বা গভীর সমুদ্রবন্দর। কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় টেকনিক্যাল স্টাডি করে লোকেশন পছন্দ করা, ফিজিবিলিটি ভায়াবিলিটি নিরীক্ষা সব শেষ হওয়ার পরও ২০০৯ সালে এই সরকার আসার পর ঐ প্রজেক্ট ঠেলতে ঠেলতে এখন সোনাদিয়া একেবারেই বাদ করে দেয়া হয়েছে। আবার ভারত এর বদলে পোর্ট অন্য কোথাও কিছুই না করার পক্ষে ছিল। কিন্তু শেষে ‘পায়রায়’ বিকল্প বন্দর পছন্দ করেছে। যেন এটা খামখিয়ালের বিষয়। আর তবুও এই প্রজেক্টে ভারতকে অযাচিত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অযাচিত এই অর্থে যে অর্থনৈতিক মুরোদ না থাকা সত্ত্বেও ভারতকে ছোট অনুসঙ্গী করে প্রজেক্টে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। তবু প্রজেক্টে মূল পোর্ট গড়ার কাজ চীনকে দিতেই হয়েছে। কারণ অন্য কারও কোন অর্থ বিনিয়োগের সংস্থান মুরোদ নেই, কেবল ভারতের ইচ্ছাকে জায়গা দেয়া এটা বাংলাদেশ দিতে চাইলেও তো দিতে পারা সম্ভব নয়, সম্ভব নয়। মূল প্রশ্ন বিনিয়োগ কে দেবে? আর এই মারাত্মক কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। পিপিপি বা ব্যক্তি উদ্যোগ ঢুকানো হয়েছে। অবকাঠামো প্রকল্প আর বাণিজ্যিক প্রকল্পের ফারাক আর বজায় রাখা হয়নি। যেন যমুনা সেতু নামমাত্র সুদের অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে করে বাংলাদেশ ভুল করেছে। এতে ট্রাকপিছু এর টোল এখনো এক হাজার টাকা। এর বদলে ওই সেতু যদি (২-৬% সুদের) বাণিজ্যিক প্রকল্প অথবা পিপিপি করতাম তাহলে টোল পড়ত ট্রাকপিছু তিন হাজার টাকা, এটাই ভালো হত। তাই কী? এমন এক বেলজিয়াম কোম্পানিকে ঢুকানো হয়েছে মূল চ্যানেল খননের কাজে। আর পুরো প্রজেক্টটাই জি-টু-জি তে চীনকে। যার সোজা অর্থ বাংলাদেশ থেকে টেন্ডার আহ্বান উঠে গেছে। যদিও এখনো বিনা সিক্রি টকশোতে বলে বেড়াচ্ছেন মূল প্রজেক্ট নাকি চীনকে না, ডাচদেরকে দেয়া হয়েছে।
আচ্ছা সোনাদিয়ায় ভারতের আপত্তির মূল বক্তব্য কী? ভারতের বক্তব্যকে কোনো যুক্তি হিসেবে মেনে নেয়া মুশকিল। ভারতের একটা সুপ্ত স্বপ্ন-আকাঙ্খা আছে, তা হলো চীন বাংলাদেশে কিছুই করতে পারবে না। মুরোদের খবরহীন ফালতু এসব স্বপ্ন নিয়ে কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। ওবামার আমেরিকার একটা লক্ষ্য ছিল চীন ঠেকানো; চায়না কনটেইনমেন্ট। বুশ ও ওবামার আমেরিকা এটা ভারতকে সামনে রেখে ভারতকে দিয়ে যতদূর সম্ভব করাতে চাইত। ট্রাম্পের আমলেও ‘চীন ঠেকানো’ এখনও ট্রাম্পের আমেরিকার এজেন্ডা কিনা এখনও আমরা এর রিনিউয়াল কিছুই শুনিনি। কিন্তু ভারত তার পুরনো অবস্থানেই আছে, ‘চীন নাকি ভারতকে মুক্তমালার মতো ঘিরে ফেলল’, আমেরিকার এই শিখানো বুলি সে কপচে চলছে।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর একটা বাণিজ্যিক প্রজেক্ট। কোনো ডিপ সি পোর্ট প্রজেক্ট যেটা নাকি আসলে ছুপা স্ট্র্যাটেজিক বা সামরিক প্রজেক্ট হয়েছে বা হতে পারে এটা শোনা যায়নি। এর কারণ মূল প্রজেক্টটাই কমপক্ষে চার বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক বিনিয়োগের। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি একমাত্র এটা বাণিজ্যিক হলেই এই বিনিয়োগ ঋণের বোঝার দায় নিতে সে সক্ষম। কারণ স্ট্র্যাটেজিক বা সামরিক প্রজেক্ট হলে ওর বাণিজ্যিক রিটার্ন নেই। সারকথায় বাংলাদেশের কাছে অবকাঠামো প্রজেক্ট মানেই তা অবশ্যই বাণিজ্যিক প্রজেক্ট হতে হবে। নইলে ঋণ শোধ করতে পারবে না। তাই নিঃসন্দেহে সোনাদিয়া আসলেই ছিল এক বাণিজ্যিক প্রজেক্ট এবং বাংলাদেশকেও নিজে থেকেই যেটা নিশ্চিত করতে হবে – চীনের সাথে কথা বলতে হতে পারে যে এটা মাত্র বাণিজ্যিক প্রজেক্টই হবে। এ জন্য যে এই বন্দর ব্যবহার করে চীনের সাউথ-ইস্ট, ভারতের নর্থ-ইস্ট এবং বার্মা সবাই মূলত নিজের নিজের ল্যান্ডলকড অঞ্চল বা এলাকাগুলোকে সমুদ্র যোগাযোগের আওতায় নাগালে আনবে। এটাই সবার মুখ্য আর বার্ণিং স্বার্থ। ফলে এর যেন শুধু বাণিজ্যিক ব্যবহার নিশ্চিত হয় এটা বাংলাদেশ নিজেই দায়িত্ব ও লিড নিয়ে সম্ভব করে তুলতে পারে ও চায়। ভারত এটাই বাংলাদেশের কাছে আশা করতে পারত। আর চীনের এতে আপত্তিরও কোনো কারণ থাকত না। নিজের ল্যান্ডলকড দশা ছুটানোটাই চীনের বিরাট ও মূল স্বার্থ। বাংলাদেশের গভীর স্বার্থ হল, এটা যদি ব্যবহারকারীদের সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থ শক্তভাবে রক্ষা করা যায় তবে সবার ব্যবহারে ব্যবহারকারী বেশি হওয়ায় পোর্টের বিনিয়োগ খরচ তুলে আনা সহজ ও দ্রুত সম্ভব। কিন্তু ভারত সে পথে না গিয়ে আমাদের সরকারের ওপর আবদারের চাপ তৈরি করে সোনাদিয়া বন্ধ করে দিল। যদিও অন্য কোন ডিপ সি পোর্ট না করার পক্ষে থেকে চুপ থাকতে পারেনি। সরকারের ওপর চাপ দিয়ে পায়রাতে রাজি করিয়েছে। কিন্তু কেন? এতে ভারতের কী লাভ হয়েছে? একমাত্র ঈর্ষা হাসিল করা ছাড়া? আচ্ছা চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক সামরিক প্রভাবও বাড়বেই। সেটাকে ঠেকানো – ভারতের এই চিন্তা বড় জোর এক খড়কুটো নয় কী? আর এটা কি সেই পথ? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ভারতের সেই মুরোদ কৈ? আর বাংলাদেশ সেটা ভারতের ইচ্ছায় কেন ঠেকাবে? বাংলাদেশের কী লাভ হয়েছে এতে? ভারতেরই যেখানে মুরোদ নাই সেখানে বাংলাদেশের মুরোদ কোথায়? উলটা বাংলাদেশের বৈষয়িক সুবিধা আছে এখানে। হাসিনা সরকারকে কেন, ভারতের যেকোনো বসানো সরকারকে তারা নিজের ব্যক্তিগত গোলাম বানিয়ে রেখেও তো বাংলাদেশের কোনো ডিপ সি পোর্টের চাহিদা ঠেকানো সম্ভব নয়। এটা অবজেকটিভিটি, এক বাস্তবতা।
কিন্তু পায়রাতে সরিয়ে নেওয়াতে এখন ফলাফল কী হয়েছে? ভারতকে বাংলাদেশে চীনের সংশ্লিষ্টতাতেই একটা ডিপ সি পোর্ট তৈরি মানতেই হয়েছে। কিন্তু লোকেশন বদলে ভারতের কী লাভ হয়েছে? আমাদের অর্জন কী? সর্বশেষটা শোনা যাক। পায়রায় লোকেশন পছন্দ-পরিকল্পনার ভিতরে শুরু থেকেই ড্রাফটের সমস্যা ছিলই। ড্রাফট মানে গভীরতা বা নাব্যতার সমস্যা ছিল। তাই শুরু থেকেই নাব্প্রযতা ধরে রাখতে প্রবেশমুখ ও আশপাশের ১০-১৫ কিমি নিয়মিত ড্রেজিং করে যাওয়ার পরিকল্পনা রাখা হয়েছিল। এটাই সে পরিকল্পনাতে ত্রুটির প্রমাণ। এরপরেও এর ড্রাফট সোনাদিয়ার সমপর্যায়ের লেভেলে পৌঁছাবে না, সমান হবে না এটা সবাই জানত। এখন সেই দায়ভার আগেই ঝেড়ে ফেলতে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলে বসেছেন, ‘পায়রা বন্দরের স্থান নির্বাচন সঠিক হয় নাই’, গত ১০ এপ্রিলের দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বরাতে আমরা এ কথা জানছি। এখন একনম্বর প্রশ্ন হল, তাহলে সোনাদিয়া বাদ দেয়া আর পায়রায় নতুন স্থান নির্বাচন কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল? বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে বড় অবকাঠামো প্রজেক্টে এসব খামখেয়ালিপনা করা হচ্ছে কেন? আমরা চাইলেই কি ভারতের খামখেয়ালি আপত্তি বা ঈর্ষা আমল করতে পারব? করা উচিত হচ্ছে? এর অর্থনৈতিক দায় কে নিবে?
ভারত সফরের একমাস আগে থেকে আমরা দেখলাম ভারত চলতি সরকারের বদলে অন্য কাউকে সরকারে রাখার কথা ভাবতে পারে এই সন্দেহ হাসিনার সরকারে হাজির হয়েছে। আবার ভারতেরও সন্দেহ হয়েছে চীনের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের পক্ষে ‘তাদের সমর্থিত সরকার” সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সম্ভবত তাদের পক্ষে থাকছে না!
এসব মিলিয়ে এটা আজ পরিষ্কার ‘ভারতের সমর্থনের সরকার’ বাংলাদেশে এটা কোনো কাজের না, ফাংশনাল না, কাজ করছে না। এটা কার্যকর থাকছে না, থাকবে না। আমরা চাইলেই ভারতের খুশিতে খামখেয়ালিভাবে পায়রায় বন্দর করতে পারছি না। সম্ভব নয়।
ওদিকে ‘ভারতের সমর্থনের সরকার’ কথাটারই আর এক অর্থ হল, এর প্রভাবে বাংলাদেশে এখন নির্বাচন আয়োজন ঠিকঠাক মত করা না করার সাথে ক্ষমতার কোনোই সম্পর্ক নেই। নির্বাচনের বাইরে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা তৈরি করা সম্ভব। এটাই আজকের হাসিনার সরকারের রীতি। কিন্তু তা ওয়ার্কেবল কী? হাসিনার সব মিলিয়ে আট বছর অভিজ্ঞতা বলছে না যে তা খুব সুখকর কিছু। এর চেয়ে বড় বিষয় ইতোমধ্যেই হাসিনা নিজেকে ভালনারেবল বা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছেন। জনগণের সাথে থেকে মোকাবেলা, সাথে নিয়ে থাকা, নির্বাচন ইত্যাদি সবকিছু থেকে দূরে চলে গিয়েছে দল এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত ক্ষমতার বিকল্প যে ‘ভারতের সমর্থনের সরকার’ কোনো মতেই নয় এটা বোঝার মতো কানে পানি যাওয়ার কথা। ‘ভারতের সমর্থনের সরকার’ হাসিনার জন্য আরো রিস্কি ও অনিশ্চিত এক পথ, এই বাস্তবতা ক্রমে বাইরে আসা স্পষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে। হাসিনা কি সাহসের সাথে নিজের সে অনুভব পক্ষে কাজ করতে পারবেন? কারণ সেটা হাসিনা পারেন আর নাই পারেন এটা প্রমাণিত যে ‘আমরা চাইলেই ভারতের খামখেয়ালি আপত্তি বা ঈর্ষা আমল করতে পারব না।
হাসিনার ভারত সফর-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে, “ভারতে গিয়ে আরো পাঁচ বছরের দাসখত দিয়ে আসলেন কিনা, অথবা আরো পাঁচ বছরের ক্ষমতা নিশ্চিত করে আসলেন কিনা” , এমন প্রশ্ন উঠেছিল। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্ন হাসিঠাট্টা করে প্রধানমন্ত্রী জবাব দিয়েছেন। এটা কিন্তু তেমন ঠাট্টার বিষয় নয়। গত ২০০১ সালে বিএনপি ভারতের কাছে দেশ বেচছিল সেকারণে ২০০৯ অথবা ২০১৪ তে আওয়ামী লীগের বেচাটা জায়েজ বা ভালো। এটা গ্রহণ করার মতো বয়ান বক্তব্য নয়। বাংলাদেশ অথবা এর কোনো রাজনীতিকের ভবিষ্যৎও ঐ বয়ানে নেই। এই কথা তাই কাউকে ভালো লাগার মতো কথা নয়। ফলে আমরা যত ‘ভারতের সমর্থনের সরকার’ এরপরেও চেষ্টাই করতে দেখি না কেন, জনভিত্তি গড়া ও জনসমর্থন ধরে রাখা-মুখী রাজনীতি ও সরকার আবার ফিরে আসবেই। অচিরেই ফিরবে, অভিমুখ সেটাই। আমাদের কী সাহস হবে অভিমুখ চিনে সাড়া দিবার!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা এর আগে ১৬ এপ্রিল ২০১৭ দৈনিক নয়াদিগন্ত অনলাইন পত্রিকায় (প্রিন্ট পত্রিকায় পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। ১৮ এপ্রিল অনলাইন দুরবীন ম্যাগাজিনেও ছাওয়া হয়েছে। সে লেখাটাই পরবর্তিতে আরও সংযোজন ও এডিট করে নতুন ভার্সান হিসাবে আজ এখানে ছাপা হল।]