‘জাতিরাষ্ট্র’ এক বিভ্রান্তিকর ধারণা
গৌতম দাস
১৯ অক্টোবর ২০১৭
আমাদের একজন সিনিয়র সিটিজেন ড. আকবর আলি খান। তার মূল যে পরিচয়, যে কারণে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত তা হল, তিনি একজন দক্ষ আমলা বা বুরোক্র্যাট। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে তিনি পেশাজীবন শেষ করেছেন। একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে তিনি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক। গত ২৬ মার্চ ২০১৭ দৈনিক প্রথম আলোতে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। অনুমান করি, তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইটির কথা মাথায় রেখে সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের জন্য একটা কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসন গড়তে কী কী করা উচিত, তা নিয়ে যারা কিছু চিন্তাভাবনা করেছেন, করেন অথবা কিছু প্রয়োগ করেছেন, বদলিয়েছেন ও উদ্যোগ নিয়েছেন – এমন কাজের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন আকবর আলি খান। তার সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ ও কৌতূহল এখান থেকেই। অবশ্য ওই সাক্ষাৎকার পড়ার পর থেকে আমরাই আবার বেশ খানিকটা যেন হতাশ হতে যাই।
ওই সাক্ষাৎকারে আকবর আলি খানের রাষ্ট্রবিষয়ক বিভিন্ন মন্তব্য আছে। সেগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করি, ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণাকে তিনি এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন। ইংরাজি নেশন স্টেট (nation-state) শব্দের বাংলা আমরা করে নিয়েছি জাতিরাষ্ট্র। একথা সত্য যে, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে প্রবল প্রতাপে মডার্ন রাষ্ট্র মানেই তা জাতিরাষ্ট্র, এ ধারণা ছেয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে যেখানে নাগরিকেরা সবাই একই জনগোষ্ঠিগত বৈশিষ্টের একই ভাষা, একই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত এবং সম্ভবত একই ধর্ম বা মেজরিটির ধর্ম একই এমন একটা অবস্থা থাকে সেখানে জাতিরাষ্ট্র শব্দটার ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। আসলে একটা বহুল প্রচলিত শব্দ এখানে সাধারণত ব্যবহৃত হতে দেখা যায় যেটা আমরা ব্যবহার করিনি, সেটা হল ‘জাতি’, যা ইংরাজি নেশন শব্দের বাংলা। ভুখন্ডে বসবাসরত নাগরিক সকলকে বুঝাতে বহুল প্রচলিত শব্দ হল ‘জাতি’, যা এখানে ব্যবহার করা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তার বদলে এখানে আরও সাধারণ অর্থবোধক শব্দ ‘জনগোষ্ঠিগত’ দিয়ে তা বুঝানো হয়েছে। কী হলে জনগোষ্ঠি ‘জাতি’তে রূপান্তরিত হয়ে যায়? সে প্রশ্ন এখানে তুলব।
আবার একটা মর্ডান রিপাবলিক রাষ্ট্র কায়েম করা গেলেই কী সেটাই কী জাতিরাষ্ট্র কায়েম হয়ে যাওয়া? তাহলে রিপাবলিক রাষ্ট্র মাত্রই কী জাতিরাষ্ট্র? সে প্রশ্নও তো আছেই।
তবে এই শতাব্দি এসে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যায়। ধারণা ও উপলব্ধি ততদিনে থিতু হতে সময় পেয়ে যায় যে, না, জাতিরাষ্ট্র’ কথাটা আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ধারণা বা বিষয় নয়; বরং এক উটকো ধারণার অংশ।
আধুনিক রাষ্ট্রের ব্যাপারে সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল ‘রিপাবলিক’। আর রিপাবলিক ধারণার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নাগরিক সাম্য, মানুষের মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়বিচার। কিন্তু রাষ্ট্র গঠন বা রাষ্ট্রধারণার বাস্তবায়নের কালে দেখা সব সংশ্লিষ্ট ধারণাকে তুচ্ছ ও অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান ও গণ্য করে সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে শুধু ‘জাতিরাষ্ট্র’ শব্দ ও ধারণায়। রাষ্ট্রমাত্রই যেন জাতিরাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। অথচ অষ্টাদশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী শব্দ ও ধারণা এখনো রিপাবলিক। সে তুলনার সাথে জাতিরাষ্ট্র বলে একটা ধারণা এসে যাওয়া যেন হাতছুট ঘটনা। কারণ সেই থেকে এখনো নেশন কী, নেশন মানে কী, এগুলো অস্পষ্ট। এখনো তা নিজেকে প্রোথিত করতে পারেনি।
আবার লক্ষ্য করলে দেখব সেকালেও মানে অন্তত বিংশ শতকের শুরুতেও সবাই জাতিরাষ্ট্র বলতে রিপাবলিক বোঝেনি। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্ম নেয়া সোভিয়েত রিপাবলিক রাষ্ট্র (১৯১৭), মাওয়ের চীনের পিপলস রিপাবলিক রাষ্ট্র (১৯৪৯), এমনকি ইরানের ইসলামি রিপাবলিক (১৯৭৯)- এগুলোর একটিতেও জাতিরাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বলতে যা সেকালে বুঝা হত, তা বুঝে এসব রাষ্ট্র ও বিপ্লব কায়েম করা হয়নি। ফলে এগুলো জাতিরাষ্ট্র হিসেবে কায়েম হয়েছে, এমন কোনো দাবি তাদের নেই; বরং প্রত্যেকে নিজ রাষ্ট্রের নামের সাথে গৌরবোজ্জ্বলভাবে রিপাবলিক শব্দ ও ধারণা বয়ে বেড়াতে পিছপা হচ্ছে না বা ভুল করেনি। একেবারে রাষ্ট্রের নামের মধ্যেই তা খোদাই করে দিয়েছিল।
আবার আধুনিক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ১৭৭৬ সালের ইউএসএ পর্যন্ত নিজেকে কোনো জাতিরাষ্ট্র দাবি করে না। আবার লক্ষণীয় হল, ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে সব আধুনিক রাষ্ট্রই রিপাবলিক ধারণাকে মুখ্য রেখে তৈরি হয়েছে। এর প্রমাণ লেনিনের ইউএসএসআর (১৯১৭) রাষ্ট্রের নামের শেষের রিপাবলিক। মাওয়ের চীন পিআরসি (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না, ১৯৪৯) আর ইরানের ইসলামি রিপাবলিক (১৯৭৯)। বিশ শতকের এই তিন রাষ্ট্র রিপাবলিক হয়ে আধুনিক রাষ্ট্র বলে নিজেদের দাবি করলেও কেউই জাতিরাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র নয়, সে দাবিও করেনি। এই উদাহরণগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে আর রাষ্ট্রমাত্রই সেটা জাতিরাষ্ট্র, এমন ভুল বা পশ্চাৎপদ ধারণা আঁকড়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু আকবর আলি খান জাতিরাষ্ট্র ধারণাকে আঁকড়ে এর ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলছেন; দাবি করছেন- “জাতিরাষ্ট্র বিষয়টি আধুনিক ধারণা। ‘ …’ পৃথিবীর সবখানেই জাতিসত্তা পরে জন্ম নিয়েছে।”
সারকথায়, আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র মাত্রই যে তাকে জাতিরাষ্ট্রও বলা ঠিক হবে না এটা ক্রমশ মানুষের মধ্যে সতর্কতা আসতে শুরু করেছিল। তবুও এরপরেও অনেকে এখনও একাকার করে দেখে থাকেন। আকবর আলি খান তাদের একজন থেকে গেছেন দেখা যাচ্ছে। আর সব নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্রের ধারণাধারী যে বিপদে পড়েন, তিনিও সে একই ‘বিপদে’ পড়েছেন। একই সূত্র অনুসারে ‘জাতিসত্তা’ বলে শব্দটি তিনিও এনেছেন। এতে যে বিপদের মুখোমুখি হতে হয় তা হল – ‘জাতি’ জিনিসটি কী তা ব্যাখ্যা করতে হবে তাদের। এখন , এই ‘জাতি’ মানে কী? সেটা কি ইংরেজি (race) রেস নাকি (ethnicity) এথনিসিটি? নাকি কমন কালচারাল কোন বৈশিষ্ট্য অর্থে এথনিক অথবা নৃতাত্ত্বিক ধারণা? কোনটা? এরা সেটা পরিষ্কার করে বলেন না। তা সত্ত্বেও তারাই আবার জাতিসত্তা শব্দটি ব্যবহার করে আরও অস্পষ্টতা বাড়ান। আকবর আলি বলছেন, ‘কাজেই বাংলাদেশের উৎস প্রাচীন বা মধ্যযুগে খুঁজলে হবে না, বাংলাদেশের আদিসত্তার উৎস খুঁজতে হবে ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতকে।’ আর প্রশ্নকর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইয়ে আপনি লিখেছেন, …. সেদিক থেকে বাঙালি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের ধারণার উন্মেষ মধ্যযুগ থেকে।’
অর্থাৎ দু’জনেই খুঁজছেন বাঙালি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের ধারণার উন্মেষ কবে থেকে উত্থিত। কারণ এ ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে তারা এরপর তাদের পছন্দের জাতিরাষ্ট্র বা নেশন স্টেট ধারণাকে পোক্ত করবেন সম্ভবত। কিন্তু আসলে এই অনুমান অর্থহীন। কারণ মূল বিষয় জাতি কী, নেশন বলতে তারা কী বুঝাচ্ছেন তা তো অস্পষ্টই রয়ে গেছে। জাতি মানে কী – রেসিয়াল অথবা নৃতাত্ত্বিক ধারণা কী? অথবা অন্য কোনো ধারণা? তারা এদিকে খোঁড়াখুঁড়ি করেছেন বা করতে চান বলে মনে হয় না।
কিন্তু এই জট আমরা কী করে সহজে খুলতে পারি? একটি দিক লক্ষ করলেই সবাই এই জট খুলতে পারব।
রেসিয়াল অথবা এথনিক অথবা নৃতাত্ত্বিক যে ধারণাই হোক, ব্যাপারটাকে একটা কমন বৈশিষ্ট্য হিসাবে অবশ্যই দেখা যায়। কিন্যেতু সবচেয়ে গুরুত্মবপুর্নণ যেটা লক্ষ করলে দেখব, ‘জাতি’ বলতে যাই বুঝাতে চাই, তা আসলে এক ধরনের (given) গিভেন বৈশিষ্ট্য বা গিভেন ধারণা। তা কী অর্থে? মানে হল যে, “আগে থেকে দেয়া আছে”। যেমন দুনিয়ার কোনো জনগোষ্ঠী নিজেই নিজের রেসিয়াল (অথবা এথনিক অথবা নৃতাত্ত্বিক) বৈশিষ্ট্য বেছে নিতে পারে না, সম্ভব নয় বলে। রেসিয়াল বৈশিষ্ট মানুষের পছন্দ করে বেছে নিবার জিনিষ না। জন্মানোর আগে কেউ আল্লাহর সাথে চুক্তি করে, চয়েজে টিক দিয়ে বাঙালি হয় না, বিহারি হয় না; বরং বাঙালির ঘরে জন্মানোর পরে ওই ঘর মোতাবেক অর্থাৎ (given) গিভেন হিসেবে বাঙালি হয়। ফলে রেসিয়াল অথবা এথনিক অথবা নৃতাত্ত্বিক ইত্যাদি যাই হোক না কেন, এগুলোর মূল পরিচয় আসলে গিভেন ধারণার অন্তর্গত। সোজা কথা হলো, আমি জাতে বাঙালি হতে চাইছি বলে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাঙালি হতে পারি না। হই নাই। এখন একটা কথা স্পষ্ট করতে হবে। এর মানে কি এই যে, এখন তাহলে যার যার (আল্লাহর দেয়া) বা গিভেন পরিচয় অনুসারে তাকে এখন ওই পরিচয়ের রাজনীতিই করতে হবে? মানে এথনিক বাঙালিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিই করতে হবে?
এর জবাব-ফয়সালা পেতে আমাদের শেষ বাক্যে মনোযোগ দিতে হবে। ওই বাক্যে দুইবার বাঙালি শব্দটি ব্যবহার করেছি- এথনিক বাঙালি আর বাঙালি জাতীয়তাবাদী। অথচ লক্ষ করুন, এ দুই বাঙালি শব্দের অর্থ এক নয়। কেন? প্রথমে ব্যবহৃত বাঙালি শব্দটি গিভেন অর্থে বাঙালি। সেজন্য ওটা আমার গিভেন পরিচয় বা প্রাকৃতিক পরিচয়। তাহলে পরেরটা?
পরেরটা হল বেছে নিয়েছি, ইচ্ছামতো যেটা ভালো লেগেছে সেই রাজনীতি- নিজের রাজনৈতিক পরিচয়। স্বেচ্ছায় সচেতনে যেটা মানুষ করে কিংবা বেছে নেয়, সেটাকে রাজনৈতিক কাজ বা সিদ্ধান্ত বলে। এই পরিচয় বা রাজনীতি আবার শুধু আমার রাজনৈতিক পরিচয় নয়, এটা আমরা যতবার ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা বদলাতেও পারি। যেমন ১৯৪৭ সালে আমরা একই জনগোষ্ঠী ‘ইসলামি জাতিবাদী’ হয়েছিলাম। সে পরিচয় নিয়েছিলাম। আবার আমরাই ১৯৭১ সালে নতুন পরিচয় ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ হয়েছিলাম। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাড়াও আরো যেকোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা রাজনীতি আমরা আগামীতে করতে পারি, বেছে নিতে পারি। একটার বদলে আরেকটা রাজনীতি করতে পারি। মূল কথা, এথনিক বাঙালি হয়েও আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করতে পারি, না-ও করতে পারি। এর অর্থ, তাহলে এথনিক বাঙালি জনগোষ্ঠী এক আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়তে গেলে সেটা একটা জাতিরাষ্ট্রই হয়ে যাবে, বাঙালি জাতিবাদী (অথবা বাংলাদেশী জাতিবাদী) জাতিরাষ্ট্র হয়ে যাবেই- এমন ধারণা ভিত্তিহীন।
আকবর আলি খান এবং প্রশ্নকর্তা দু’জনই খুঁজছিলেন বাঙালি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের ধারণার উন্মেষ কবে হয়েছে, মধ্যযুগে কি না- এই খোঁজাখুঁজি অর্থহীন। কারণ এটা নৃতাত্ত্বিক বা থিনিক খোঁড়াখুঁড়ি গিভেন পরিচয়ের খোঁড়াখুঁড়ি। এর সাথে রাজনৈতিক পরিচয় মিলিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলা অর্থহীন। কারণ দুটো আলাদা জিনিস। রাজনীতি সচেতন হওয়া বা রাজনীতি মানে কী সেসব বোঝার বহু আগেই ‘গিভেন’ পরিচয় আমরা পেয়ে যাই। আমাদের জানা না থাকলে প্রাকৃতিক পরিচয় আর রাজনৈতিক পরিচয়- এ দুটোকে গুলিয়ে ফেলে কথা বলতে থাকি। শেখ মুজিব সর্বপ্রথম রাজনৈতিক বাঙালি বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি হাজির করেন। স্পষ্ট আকারে তা হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ছয় দফায়। অর্থাৎ এর সাথে গিভেন বাঙালি কবে থেকে শুরু হয়েছিল, এর কোনোই সম্পর্ক নেই। যেমন অনেকে ‘আবহমান বাঙালি’ বলে একটা শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। এই শব্দের সাথে বাঙালি জাতিবাদী ধারণার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ আবহমান বাঙালি একটি এথনিক বা প্রাকৃতিক বা গিভেন পরিচয়ের ধারণা।
এই কারণে আকবর আলি খানের ওই সাক্ষাৎকারে সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর শব্দ ও ধারণা হলো ‘জাতি’। প্রথমত, ওটা অস্পষ্ট যে, তা গিভেন না পলিটিক্যাল। তাই এটা অস্পষ্ট রয়েছে বলে পুরো আলোচনাই সেখানে অর্থহীন হয়ে গেছে।
তিনি বলছেন, ‘বাঙালিদের জন্য পরিচয়ের ভুল ঠিকানা ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবির্ভাব ছিল এক আকস্মিক ঘটনা। ভারতীয় উপমহাদেশে যত মুসলমান ছিল, তারা এক জাতি; হিন্দু যারা তারা আরেক জাতি- এমন ভাবনা থেকে এর সৃষ্টি। কার্যত মুসলমান বা হিন্দুদের সবাই এক ভাষা, এক জাতি, এক অঞ্চলের মানুষ ছিল না। … সেজন্য আমি মনে করি, আধুনিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া ছিল অনিবার্য।’
তার এই বয়ানের পর্যালোচনা করে বলতে হয়- প্রথমত, মানতে হবে যে, দেশ ভাগ সবার জন্য খারাপ অভিজ্ঞতা। আসলে এ কথা বাস্তবে সত্যি ছিল না। যেমন পূর্ববঙ্গের প্রজাদের কাছে দেশ ভাগ ছিল অনিবার্য এবং তাদের খুবই কাম্য। তাই এককাতারে প্রজারা তাতে খুশি হয়েছিল। হিন্দু বাঙালিরা জমিদারির পক্ষ নিয়ে, তা আঁকড়ে থেকে এ থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষমতার আধিপত্যের শেয়ার ভোগ করতে চাইল। জমিদারেরা এমন একক মোড়লিপনা চালিয়ে যেতে চাইলো প্রজাদের সাথে- দেশ ভাগ করা মানেই, প্রাকটিক্যালি জমিদারি উচ্ছেদ- এই পথে যেতে চাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
দ্বিতীয় কথা, দ্বিজাতির ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়নি। মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে আলাদা পাকিস্তান হওয়া আর মুসলমানেরা আলাদা জাতি বলে পাকিস্তান হওয়া এককথা নয়। যদিও দেশ ভাগের পর এমন সাফাই কেউ কেউ দিয়েছিলেন। আর কলকাতার জমিদারদের পক্ষের সাফাই হিসেবে অনেকে বলে- ‘মুসলমান যেহেতু জাতি নয়, একটা ধর্মের নাম; কাজেই ধর্মের ভিত্তিতে জাতি- এটা হয় না। এটা করা ভুল।’ এটাকে বিরাট জ্ঞানগর্ভ আরগুমেন্ট মনে করে অনেকে খুশি হয়ে যায়। ধরা যাক, ইসলামি জাতিবাদ ধারণা ভুল। তাহলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এটা সঠিক হয় কিভাবে?
বাস্তবে হিন্দুত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ভারত রাষ্ট্র হয়েছে। তবে সেটা তারা অকপটে স্বীকার করেছে, না ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ শব্দের আড়াল নিয়েছে সে কথা আলাদা। কিন্তু হিন্দুত্বের ভিত্তিতেই ৫০০-এর বেশি করদরাজার রাজ্য গুঁড়িয়ে দিয়ে আর ২৯ রাজ্যকে একসাথে বেঁধে আজকের ভারত রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে। আর একটি ফ্যাক্ট হলো, কংগ্রেস হিন্দু জাতিবাদী রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে দল হিসেবে খাড়া হয়ে ছিল। সে কারণেই এর ভেতর মুসলমানেরা নিজেদের খুঁজে না পেয়েই কংগ্রেস দল খোলার পর ২০ বছর অপেক্ষা করে শেষে মুসলিম লীগ গঠন করেছিল।
আসলে পুরো বিষয়ে মূল সমস্যা পরিচয়ের রাজনীতি বা আইডেন্টিটি পলিটিক্স। সব জাতীয়তাবাদ, সব জাতি ধারণাই একেকটা পরিচয়ের রাজনীতি; সেক্টেরিয়ান পলিটিক্স। সেটা কংগ্রেস হিন্দুত্বের জাতিবাদ করলেও যা, মুসলিম লীগের ইসলামি জাতীয়তাবাদ করলেও তা। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ করলেও একই সমস্যা থেকেই যাবে। বাংলাদেশে কেউ বাঙালি জাতিবাদ করতে চাইলে আরেকজন বলবে তিনি ইসলামি জাতীয়তাবাদ করবেন। আপনি ভাষার জাতীয়তাবাদ চাইলে আর একজন ভুখণ্ডের জাতিবাদ চেয়ে বসবেন। জাতিবাদী রাজনীতি মানেই পরিচয়ের রাজনীতি, মানে বিভক্তির রাজনীতি। অথচ এর বাইরে আসতে হবে আমাদের।
অতএব ‘জাতি’ ধারণা, জাতিবাদী রাজনীতির ধারণা ইত্যাদি আগে স্বচ্ছ করে না নিলে প্রাসঙ্গিক আলোচনা অর্থহীন থেকে যাবে।
আকবার আলি খানের বক্তব্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হলো তিনি বলছেন, জাতির পিতা স্বয়ং মনে করতেন আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের দু’টি উপাদান রয়েছে। একটি হলো ধর্ম, আরেকটি হলো ভাষা। তিনি যদি সত্যি সত্যিই মনে করে থাকেন, জাতির পিতার জাতীয়তাবাদের দু’টি উপাদানের একটা ধর্ম; তাহলে দ্বিজাতিতত্ত্বকে মানে ধর্মীয় পরিচয়কে সমালোচনা করার তো সুযোগ নেই। দেশ ভাগের ব্যাপারে কলকাতার বয়ানের পক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে সমালোচনা করার সুযোগ কই? এটা তো স্ববিরোধিতা। ফলে ‘পাকিস্তান হওয়া এক দুর্ঘটনা আর বাংলাদেশ হওয়া এরই সংশোধন!’-কথাটা খুবই স্ববিরোধী বক্তব্য হয়ে যায়।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা এর আগে গত ১৭ অক্টোবর ২০১৭ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করে দেয়া হয়েছে। ফলে নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]