কোল্ড ওয়ার ও রুজভেল্ট


কোল্ড ওয়ার রুজভেল্ট

গৌতম দাস

১৭ জানুয়ারি ২০১৮,  রবিবার, ১৮:৫১

 

 

কোল্ড ওয়ার বা ঠাণ্ডা যুদ্ধের যুগ বলে একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনি। এটা বলতে মোটা দাগে ১৯৫০-৯০ সাল, এই সময়কালকে বলা হয়, বিশেষত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠিক যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া নয়, তবে দুনিয়াটাকে দুই ব্লকে ভাগ করে নিয়ে এদের দু’জনের মধ্যে সব সময় প্রায় সব বিষয়ে রেষারেষি, উত্তেজনা, পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ ইত্যাদিকে বলা হতো ঠাণ্ডা যুদ্ধ। তবে সরাসরি যুদ্ধ লাগানোর পরিস্থিতি দু’পক্ষই এড়িয়ে চলেছিল আর পরস্পরকে হুমকি-ধমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পেরেছিল। কারণ উভয়েই জানত সঙ্ঘাত মুখোমুখি জায়গায় নিয়ে গেলে সেটা অন্তত ‘হাতছুট’ ঘটনা হিসেবেও পারমাণবিক যুদ্ধের স্তরে চলে যেতে পারে। ঠিক এ কারণেই সম্ভবত দু’পক্ষের মধ্যে রেষারেষি, উত্তেজনা,পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ যতই থাকুক না কেন তা যেন শেষ বিচারে ‘ঠাণ্ডা’ই থাকে, গরম হয়ে মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে যায়, সেদিকে উভয় পক্ষেরই প্রচেষ্টা থাকত। এ কারণে সময়টাকে ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা ইংরাজিতে কোল্ড ওয়ার বলার চল দেখা যায়। তবে এটা শুধু দুনিয়াটাকে দুই জোটে ভাগ করে নেয়া নয়, অর্থাৎ সব রাষ্ট্রকেই এই দুই ব্লকের কোনো একটাকে বেছে নিয়ে যোগ দিতে হতো তাই নয়; বরং এটা ছিল আসলে সেকালের প্রচলিত দুনিয়াতে প্যারালাল দুই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা; যাদের দুইয়ের মাঝে পণ্য, পুঁজি অথবা ভাব বা চিন্তা কোনো কিছুরই লেনদেন অথবা বাণিজ্য বিনিময় ধরনের মতো কোনো সম্পর্কও ছিল না। সব রাষ্ট্রকেই কোনো না কোনো একটা ব্লকে যোগ দিতে হতো এ জন্য যে, নইলে অস্ত্রশস্ত্রের উৎস বা সরবরাহ কোনো ব্লক থেকেই পাওয়া যেত না। ব্লকে যোগ দেয়া ছিল আনুগত্য বা বিশ্বস্ততা প্রদর্শনের উপায়, প্রাথমিক শর্ত পূরণ। আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যেতে পারে। এমন কোনো রাষ্ট্র ছিল না, যে একই সাথে সোভিয়েত অস্ত্র এবং আমেরিকার অস্ত্র পেত বা জোগাড় করতে পারত। একটা পেলে অপরটা পাওয়ার আর সম্ভাবনা থাকত না। অর্থাৎ ক্রস সোর্স বা অস্ত্রের দুই উৎস মাখিয়ে ফেলার পরিস্থিতির সম্ভাবনা ছিল না। আজ ব্লকে ভাগের যুগ বা কোল্ড ওয়ারের কাল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এটা এতই সিরিয়াস ছিল যে, একই রাষ্ট্রের দুই সোর্সের অস্ত্রের সরবরাহ পাওয়ার বা জোগাড়ের সম্ভাবনা কম ছিল। এটা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে থাকে। আবার অনেকের মনে হতে পারে, সেকালে ‘জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ বলেও তো দুই ব্লকের বাইরে কেউ কেউ ছিল। তা অবশ্য ছিল। কিন্তু মজার কথা, এদের অস্ত্রের উৎসের দিকে তাকালেই তাদের নিরপেক্ষতার ভুয়া দিকটি নজর করা সম্ভব। যেমন- নেহরুর ভারত, এটা ‘জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র’-এর প্রবল প্রবক্তাদের একটি। কিন্তু এর অস্ত্রের উৎস ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এমনকি ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও না, একেবারে ২০০১ সালে আলকায়েদা ফেনোমেনা দুনিয়াতে আবির্ভাবের পর ২০০৫ সালে বুশের ভারত সফরের পর থেকে ভারত এই প্রথম একই সাথে আমেরিকান অস্ত্রেরও সরবরাহ পাওয়ার ‘যোগ্য’ হয়। ওদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়াও এর আগে কখনো পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়নি। জন্মের শুরুতে পাকিস্তানের এককভাবে সরবরাহদাতা ছিল আমেরিকা, পরবর্তীকালে তাতে চীন যুক্ত হয়েছিল। এবার একালে এই প্রথম সোভিয়েত বা রুশ অস্ত্রও পাকিস্তান জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছে। এই হলো, ঠাণ্ডা যুদ্ধ সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা। এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা এখন ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে বোঝার চেষ্টা করব, কেন এমন কোল্ড ওয়ারের পরিস্থিতি সে সময় তৈরি হয়েছিল, পেছনে কী কারণ কাজ করেছিল।

আমাদের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের ইতিহাস পাঠ সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত ব্রিটিশদের চোখে দেখা ও লেখা ইতিহাস পাঠ হয়ে আছে। এর কারণ সম্ভবত একটাই, আমরা ব্রিটিশ কলোনির অংশ ছিলাম। সে কারণে আমাদের সাথে আমেরিকান পণ্য ও পুঁজি বিনিময় তেমন ছিলই না। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার সীমাবদ্ধতায় ভাববিনিময় অথবা আমেরিকার চোখে দেখা ও লেখা ইতিহাসের বয়ানের সাথে পরিচয় থাকা সীমিত থাকায় এর সুযোগও হয়নি। যেমন- সে সময়ে আমাদের কলোনির মালিক প্রভু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, তিনি আমাদের চোখে বিশাল ভূমিকার গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা। এমনকি তুলনায় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের নাম আমরা অনেকেই জানার বা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। কথাটা বলছি এ কারণে যে, রুজভেল্টের সাথে যদি চার্চিলের তুলনা করি, তবে রুজভেল্ট ছিলেন সাহায্যদাতা আর চার্চিল গ্রহীতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু ধরা হয় ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর। হিটলারের জার্মানি প্যারিস দখল করে ১৯৪০ সালের জুন মাসে ফরাসি সরকারকে বশ্যতা স্বীকার এবং ক্ষতিপূরণ চুক্তি করতে বাধ্য করেছিল। অর্থাৎ চার্চিলের ইংল্যান্ড থেকে হিটলার ছিলেন মাত্র ইংলিশ চ্যানেলের অপর প্রান্ত দূরে। ফলে চার্চিল শেষ আশ্রয় হিসেবে রুজভেল্টের কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছিলেন। আমেরিকা তখন পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধে নিজেকে কোনো পক্ষের সাথে জড়ায়নি। তবে চার্চিলের ইচ্ছা ছিল, আমেরিকা ইংল্যান্ডের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে জড়াক। অর্থ ও অস্ত্র সব ধরনের সাহায্য সহায়তা প্রার্থী তিনি। কারণ, ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর থেকে ব্রিটিশ অর্থনীতি আর কখনো সচ্ছলতার মুখ দেখেনি। ধারদেনা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি করে কোনো মতে চলছিল। এর বিপরীতে আমেরিকান অর্থনীতির অবস্থা ছিল সটান। অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আমেরিকার ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে যাওয়া শুরু হয় ১৯২০ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। আজ যেমন চীনের অর্থনীতি আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেছে, অনেকটা সে রকম। ফলে চার্চিলকে সহায়তা করার সামর্থ্য বা ক্ষমতা আমেরিকার ছিল। কিন্তু রুজভেল্ট চার্চিলকে বলছিলেন, তিনি সাহায্যই করতে চান, তবে যুদ্ধ তিনি একবারই করতে চান। তাই যুদ্ধের পরের পরিস্থিতিতে দুনিয়াটা দেখতে কেমন হবে সে চিত্র আমেরিকা যেভাবে দেখতে চায়, সে বিষয়ে চার্চিল রাজি না হলে রুজভেল্ট সে যুদ্ধে জড়াতে চান না। কী সে চিত্র? সরাসরি বললে তা হলো- এক. দুনিয়াতে কোনো রাষ্ট্রকে কলোনি করে রাখার অবসান ঘটাতে হবে। দুই. যুদ্ধে বিশেষত বড় যুদ্ধে বা বিশ্বযুদ্ধে বিপুল পরিমাণে পুঁজি বা সঞ্চিত সম্পদের ক্ষতি হয়। ফলে রুজভেল্ট এমন এক শেষ যুদ্ধে জড়াতে চান, যার পরে সহসাই আর যুদ্ধের দরকার না হয়। তা তিনি নিশ্চিত করতে জাতিসঙ্ঘের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চান, যার অধীনে সদস্য রাষ্ট্রের ঐকমত্যে কিছু কনভেনশন, সবাই একমত হয়েও পালনযোগ্য আইন আরবিট্রেশন চালু করতে চান, যাতে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার যেকোনো স্বার্থবিরোধ মীমাংসার ভিত্তি হিসেবে ওইসবের আলোকে আপসে বিচার-আচার, কূটনৈতিক সংলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাধান করা যায়; সব না হলেও অনেক বিরোধ এভাবে এড়ানো সম্ভব। আমেরিকার এই অবস্থান আকস্মিক ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সময় থেকেই আমেরিকান রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী বিশেষত পুঁজিবাজারে পুঁজির ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী অবস্থান ছিল এটা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এই অবস্থান নিয়েই ইউরোপে গিয়েছিলেন। অবশ্য ইউরোপ তখনকার বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানিকে শাস্তি দিতে, আর যুদ্ধে ক্ষতিপূরণ জার্মানির কাছ থেকে আদায় করতে উন্মত্ত ছিল। ফলে উইলসন ইউরোপের নেতাদেরকে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে স্বপক্ষে নেয়ার সুযোগ বের করতে পারেননি। তবে একটা আপস হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ার আইডিয়া তখনো উইলসন বোঝানো এবং এর পক্ষে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে যুদ্ধ শেষের ক্ষতিপূরণ আদায় বা বিপারেশন বিষয়ক ভার্সাই চুক্তির দুই অংশ করা হয়। প্রথম অংশ জার্মানি কাকে কী ক্ষতিপূরণ দেবে বিষয়ক। আর শেষ অংশ হলো লিগ অব নেশনস নামে এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়া, যার কাজ হবে ক্ষতিপূরণ আদায় ও তা বিতরণে কাজ করা। পরবর্তী সময়ে ওই চুক্তি বাস্তবায়ন করা যায়নি।
অপর দিকে (১৯৪০-৪১ সালে চার্চিলের সাথে আলাপের সময়) দুনিয়া থেকে কলোনি তৈরির ব্যবস্থা উঠানোর পক্ষে আমেরিকার শক্ত অবস্থান নেয়ার কারণ নিশ্চয়ই আমেরিকান রাষ্ট্র বা রুজভেল্টের কোনো বিপ্লবীপনা নয়। আসলে পুঁজিবাজারে পুঁজি ধার দেয়া কোম্পানিগুলোর ধার দেয়ার সক্ষমতা যতটা বেড়েছিল, সে তুলনায় বাজারে পুঁজি ধার নেয়ার ক্রেতা বাড়ছিল না। এর মূল কারণ কলোনিকৃত দেশ আর কলোনি মাস্টারের মধ্যকার সীমিত লেনদেনই ছিল অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রধান ধরন। যেমন, ব্রিটিশ-ভারতের সাথে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল একমুখী উদ্বৃত্ত পাচারের। ফলে পুঁজির পূর্ণ বিনিয়োগ, পণ্য, পুঁজি বিনিময় ইত্যাদি সব কিছুই একটা সীমিত বাজারের মধ্যে আটকে ছিল। এর বিপরীতে আমেরিকান পুঁজি বাজার যা প্রতীকীভাবে ‘ওয়াল স্ট্রিট’ নামে পরিচিত, সেই ওয়াল স্ট্রিট চাইছিল, দুনিয়া থেকে কলোনি সম্পর্ক উঠে যাক। ফলে উপনিবেশমুক্ত রাষ্ট্রগুলো সরাসরি রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের পণ্য, পুঁজির লেনদেন, বিনিময় বাণিজ্য ঘটাতে থাকবে। এরই সার ফলাফল, বিনিয়োগ পুঁজির চাহিদা বৃদ্ধি। পুরনো কলোনি ধরনের সম্পর্কটাই ওয়াল স্ট্রিটে পুঁজির বাজারে পুঁজির চাহিদা ব্যাপক না হওয়ার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই অনেক আলোচনা ও দরকষাকষির পর ১৯৪১ সালের আগস্টে চার্চিল-রুজভেল্ট যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল সেটাকে আটলান্টা চার্টার বলে। ওই চার্টারের প্রথম দফাই হলো দুনিয়ার সব জনগোষ্ঠী নিজেই ঠিক করবে, সে কিভাবে কার দ্বারা শাসিত হতে চায়, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বিষয়ক এই কালজয়ী ধারণার পক্ষে দাঁড়ানো। এর অর্থ, সব জনগোষ্ঠী নিজেই নিজেকে শাসন করার অধিকার পাবে। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার মানেই হলো কলোনি সম্পর্কের অবসান। তবে তামাশার ব্যাপার হলো, কলোনি মাস্টার চার্চিল যখন এই চার্টারে দাসখতের স্বাক্ষর দিচ্ছেন, তখনো ব্রিটিশ ইন্ডিয়া তাদের কলোনি। অর্থাৎ চার্চিলকে পরোক্ষে স্বীকার করতে হচ্ছে যে, কলোনি রাখা ভুল, তা করা ঠিক নয়। কেন এই বেকায়দায় পড়া? কারণ হলো, নইলে হিটলার ফ্রান্স দখলের মতো এরপর ইংল্যান্ডও দখল করে নেবে।
পরপর চারবার প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানো এবং জিতে আসা সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাট রুজভেল্ট। ১৯৩২, ১৯৩৬, ১৯৪০ ও ১৯৪৪- এভাবে চারবার তিনি জিতেছিলেন। আর ১৯৪৫ সালে চতুর্থবার শপথ নেয়ার মাত্র চার মাস পরে এপ্রিল ১৯৪৫ সালে তিনি মারা যান। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুুম্যান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুরো সময় পার করেছিলেন। পরের বার ট্রুম্যান সরাসরি প্রার্থী হন এবং জিতে আসেন। অর্থাৎ প্রায় আট বছর ট্রুম্যান প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আর এই পুরো সময়টা তিনি রুজভেল্টের নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। বিশেষত জাতিসঙ্ঘকে গড়ে তোলা এবং তা রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরিক স্বার্থবিরোধ অবসানের ডায়ালগ আর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ঐকমত্যে তৈরি কনভেনশন, চুক্তি, আইন, আরবিট্রেশন ইত্যাদির মাধ্যমে। তবে এগুলো ছিল এক ধরনের প্রস্তুতিমূলক এবং তত্ত্বীয় কাজ। এটা প্রথম পরীক্ষার সম্মুখীন হয় ব্রিটিশ-ইরান তেলবিষয়ক স্বার্থ সঙ্ঘাতে।
ইরানের তেল প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং সেই তেল তোলার চুক্তি প্রথম সম্পন্ন হয়েছিল ১৯০১ সালে। স্বভাবতই সেটা টেকনোলজির গরমে প্রায় একমুখী বা একপেশে চুক্তি। এরই পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে ইরানি প্রধানমন্ত্রী রাজমারা খুন হয়ে যান ১৯৫১ সালের ৭ মার্চ, আর সর্বসম্মতিক্রমে ড. মোসাদ্দেক মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হন। ২৯ এপ্রিল আর পয়লা মে সে দেশের সব তেলের খনি জাতীয়করণ করা হয়। ব্রিটেনের সাথে সঙ্ঘাতের শুরু এখান থেকেই। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এই বিরোধে ভূমিকা নেন মধ্যস্থতাকারীর, যেটা রুজভেল্টের স্বপ্নের জাতিসঙ্ঘের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্রিটেনের সাথে বিরোধ মীমাংসায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা দেয়া হয়। ট্রুম্যান বহু চেষ্টা করেছিলেন আপসে বিবাদ মেটাতে। তার প্রচেষ্টায় ব্রিটেন ইরানের সার্বভৌমত্বের খাতিরে জাতীয়করণের অধিকার মেনে নেয়। কিন্তু নিজের বিনিয়োগের ক্ষতিপূরণ দাবি করে। এসব বিতর্ক শেষ করার আগেই আমেরিকায় নতুন নির্বাচনে এবার রিপাবলিকান আইসেনহাওয়ার (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান মিত্রবাহিনীর কমান্ডার) জিতে আসেন। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে শপথ নেয়ার পর থেকে পুরনো রুজভেল্ট-ট্রুম্যানের নীতি সম্পূর্ণ বাতিল করে দেন। ইরান-ব্রিটেন ঝগড়ায় ব্রিটিশদের পক্ষ নিলেন। এটা ঠিক যে, ওই তেল তোলার অনুমতি সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেয়ার জন্য স্টালিন আগ্রহ প্রকাশ করলেও মোসাদ্দেক তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তবু রাশিয়ানরা সুবিধা নিতে পারে এই অজুহাতে নতুন প্রেসিডেন্ট সিআইএ পাঠিয়ে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে সরিয়ে শাহকে ক্ষমতায় আনা এবং এবার তেলের খনি ব্রিটিশ, ডাচ, ফ্রান্স ও আমেরিকান কোম্পানির এক কনসোর্টিয়ামের হাতে তুলে নেয়া হয়েছিল। এক কথায়, রুজভেল্ট-ট্রুম্যানের মধ্যস্থতাকারী আমেরিকার সেই থেকে হয়ে পড়ল ইম্পেরিয়াল এক ক্ষমতা; তেল কোম্পানির দখলের জন্য যে খুনোখুনি করতে প্রস্তুত।
বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার কোল্ড ওয়ারের যুগের শুরু সেখান থেকেই।

goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা এর আগে গত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) “কোল্ড ওয়ার ও রুজভেল্ট”, এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে  আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে।  ফলে  সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]

2 thoughts on “কোল্ড ওয়ার ও রুজভেল্ট

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s