কোটা বনাম নির্বাচনী ব্রান্ডিং – মুক্তিযুদ্ধ
গৌতম দাস
২৬ এপ্রিল ২০১৮, বৃহষ্পতিবার, ০০:০৫
এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন মনে হচ্ছে শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই সরকারি বিশেষত; বিসিএস চাকরিতে চেপে বসা কোটা, সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন আমরা হতে দেখেছি। সেটা আরও বেশি করে ঘটেছে সম্ভবত সরকারি চাকরিতে বেতন কাঠামো প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলার পর থেকে। অর্থাৎ সরকারি বিসিএস চাকরির প্রতি গ্রাজুয়েটদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ারই বিশেষ প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখছি। প্রতি বছরের পাস করে বের হওয়া গ্রাজুয়েটদের মধ্যে ওপরের ভালো ফল করা চাকরিপ্রার্থীদের দৃষ্টিতে বিসিএস চাকরি লোভনীয় হয়ে উঠেছে। সার করে কথাটাকে বলা যায়, গ্রাজুয়েট চাকরির বাজারে বিসিএস প্রথম পছন্দের চাকরি হয়ে উঠেছে তখন থেকে। কিন্তু এখানে চাকরিপ্রার্থী হতে এসে এবার তারা প্রধান বাধা হিসেবে আবিষ্কার করছে এই কোটা পদ্ধতিকে। কারণ এখানে ৫৬ শতাংশ আসন পূরণ করা হয়ে থাকে নানা ধরনের কোটার ভিত্তিতে। আর এই ৫৬ শতাংশের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এর পর বাকি মেধার আসন পূরণ হওয়ার প্রশ্ন।
স্বভাবতই শিক্ষার্থীদের নিজের ভেতর বঞ্চনার উপলব্দি এখান থেকেই। তবে বঞ্চনার উপলব্দির তীব্রতাও বেশ যথেষ্ট। সম্ভবত, এর মূল কারণ মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে ভুয়াপ্রার্থীদের অপব্যবহার। মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা ন্যায্য কী না এর চেয়েও বড় আপত্তির বিষট হল ভুয়া সনদ সার্টিফিকেটের ছড়াছড়ি। প্রশাসনের সর্বোচ্চপদ সচিব থেকে শুরু করে একটি সাধারণ সরকারি চাকরিতেও ভুয়ামুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের জয়জয়কার। আর সেই সাথে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স কত হবে তা নিয়ে সরকারের প্রায় প্রতি বছর একে নামাতে থাকা। অর্থাৎ এই জুয়াচুরিতে সরকারের প্রচ্ছন্ন সায় দেয়া। এসবেরই নীট ফলাফল হল, মুক্তিযোদ্ধা এই সেন্টিমেন্ট বা আবেগ নিজ নৈতিকতাকে নিজেই ঢিলা করে ফেলেছে।
দু-একদিন পরপর মিডিয়াতে কোনো না কোনো এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া কাণ্ডকারখানা ছাপা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যেন এক ব্যাকডোর, ফাঁকি দিয়ে চাকরিতে ঢুকে পড়ার এক সহজ রাস্তা হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার উপলব্দির তীব্রতা এখন থেকেই। তবে আসল বটম অব দা ফ্যাক্ট হল – মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধ তা যতই আবেগের জিনিষ হোক না কেন; এর ছত্রছায়ায় বা আড়ালে আমরা কেউ অন্যায্যকে ন্যায্য বলে বা অন্যায়কে ন্যায় বলে চালাতে চাইলে তা চলবে না। এতে তৈরি হওয়া অস্বস্তিটা শুরুর দিকে পাবলিক হয়তো প্রকাশ্যে আনবেন না আনেন না, কিন্তু একটা পর্যায়ে যখন এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসবে তখন এটা বিস্ফোরিত হয়ে উঠতে পারে। যেমন অনেক খোদ মুক্তিযোদ্ধা বা কমিউনিস্ট নেতাই আবেগাক্রান্ত না হয়ে গোড়ার প্রশ্ন তুলছেন। দেখা যাচ্ছে তারা যুক্তি তুলছেন যে কোনো মুক্তিযোদ্ধার গুণ, আদর্শ বা ব্যক্তিত্ব এগুলো কি জেনিটিক্যালি মানে, বংশ পরম্পরায় রক্তে বাহিত হয়ে বয়ে চলে; এমন জিনিষ? কথা তো সত্যি। মুক্তিযোদ্ধা গুণ কোন রক্তে প্রবাহিত বংশ স্বভাব তা তো নয়। তাহলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পেরিয়ে নাতিপুতি পর্যন্ত কোটার আওতায় থাকবে এর ন্যায্যতা কই? আর যদি প্রশ্ন হয় কোন মুক্তিযোদ্ধার আর্থিক অস্বচ্ছলতার; তবে এর জন্য বিসিএসের চাকরি ছাড়াও আরও বহু পথে সাহায্য করার রাস্তা আছে। এছাড়া প্রশাসনে মেধাবী প্রার্থীদের আকর্ষণ করার খুবই দরকার। এতদিন সেটা করা যায়নি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বেসরকারি চাকরির সাথে প্রতিযোগিতামূলক ছিল না বলে।
এ দিকে এখন কোটাটাই এক বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তাঁর ক্ষমতার পুরাটাই গত ১০ বছর ধরে তার ব্রান্ডিং ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ইস্যু। কিন্তু এরচেয়েও বড় প্রসঙ্গ হলো আগামী সম্ভাব্য এ বছরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচনী ইস্যু তিনি ঠিক করেছেন ‘উন্নয়ন’ আর এই ‘মুক্তিযুদ্ধ’কেই। শিক্ষার্থীদের এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রী ‘মুক্তিযুদ্ধকে’ তার নির্বাচনী ব্রান্ডিং ঠিক করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে এর সমস্যার দিকটি যথেষ্ট মনোযোগে খেয়াল করেননি তিনি। ফলে এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে পরে তিনি শিক্ষার্থীদেরকে তার নির্বাচনী ব্রান্ডিং নিয়ে আপত্তি তুলতে হুঁশিয়ার করার প্রয়োজন অনুভব করেন। হয়তো ভেবেছিলেন, শিক্ষার্থীরা তার দৃঢ়তা দেখলে থেমে যাবে। তাই গত ২১ মার্চ পটিয়ার জনসভায় দৃঢ় ভাবে জানিয়ে দেন যে “মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে”। দেখুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে: প্রধানমন্ত্রী (প্রথম আলো)। তিনি যুক্তি তুলে বলেন যে “মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কারণে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, এ কথাটা ভুললে চলবে না। কাজেই তাদেরকে আমাদের সম্মান দিতেই হবে। তাদের ছেলে, মেয়ে, নাতি, পুতি পর্যন্ত যাতে চাকরি পায়, সে জন্য কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোটা যদি পূরণ না হয়, তাহলে শূন্য পদে সাধারণ চাকরিপ্রার্থী মেধাবীদের নিয়োগ দিতে কোটার বিষয়টি শিথিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, যদি মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন না করতেন, তাহলে কেউ আমরা কোনো চাকরি পেতাম না”।
অর্থাৎ, তিনি কোটা সংস্কারের দাবিকারীদের জবাব দিলেন, যে উনি নিজের ব্রান্ডিং – “মুক্তিযুদ্ধ” থেকে সরতে পারবেন না। কারণ, এটা চলতি নির্বাচনী বছরে তার নির্বাচনী ব্রান্ডিং। কিন্তু তাতে ফল হল উল্টা। শিক্ষার্থীরা বুঝল তাদের এবার আরও শক্ত সংগঠিতভাবে আন্দোলন করতে হবে। আসলে এত বছর কোটা সংস্কার ইস্যুতে আন্দোলন হয়েছে কিন্তু সেটাকে তেমন অ্যাড্রেস না করেই প্রধানমন্ত্রী ইস্যুটাকে ভালো ম্যানেজ করতে পেরেছিলেন। এবার অ্যাড্রেস করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেছেন। তবে এবার তা না করে তিনি আদৌ সামনে যেতে পারতেন কি না সেটাও এক প্রশ্ন অবশ্য। তবে আমাদের যেন চোখ না এড়ায় যে, প্রধানমন্ত্রীর মূল সমস্যা তার অন্যতম নির্বাচনী ব্রান্ডিং ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এটা মারা পড়ল না বেঁচে উঠল তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো আবেদন নেই। সে আবেদন তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রী পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। সেখান থেকেই সব সমস্যার শুরু। অবশ্য এমন হবারই কথা সব সময় ছিল। কারণ, অতি-ব্যবহারে আর সবকিছুতে মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি করতে করতে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ শক্তিহীন, ধারহীন, আবেদনহীন আর কিছু দলবাজ মাফিয়ার আপন ভাগ্যগড়ার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটা কতদূর উঠেছে এর রেকর্ড হল – কয়েকজন সচিবের মত পদমর্যাদার লোকের ভুয়া সার্টিফিকেট ব্যবহার করে চাকরির এক্সটেনশন নেয়া থেকে বুঝা যায়। ফলে এসবের সারকথা হল – প্রধানমন্ত্রী আসলে সবশেষে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের কাছে এখানে হেরে গেছেন।
যদিও ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি আবার খুবই কৌশলে সেই হার স্বীকার করেছেন। ‘কোটাই রাখব না’ ধরনের জিদের ভাষায় তিনি তা করেছেন। তবে এখনও নিজ ঘোষণার স্বপক্ষে কোনো গেজেট প্রকাশ করেননি। অথবা জনপ্রশাসন দফতরকে কোনো নির্দেশনাও দেননি। বরং ২৪ এপ্রিল অন্তত তার দুই মন্ত্রী পাল্টা সমাবেশের আয়োজন করার কথা বলেছেন। একজন (মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী) ১৮ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বলছেন, কোটা বাতিলের ঘোষণায় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে’। আর একজন, নৌপরিবহন মন্ত্রী ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম সমন্বয় পরিষদ’ নামের সংগঠন থেকে ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন যার সার কথা- এবার তাদের কথা শুনতে হবে। তিনি নিজেই ১৫ এপ্রিল বলছেন, “যেসব ছাত্র জামায়াত-শিবির, রাজাকারদের সন্তান, তাদের কি চাকরি দেয়া উচিত?” মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে চাকরি দেয়া যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “স্বাধীনতার বিপক্ষের মেধাকে চাকরি দেয়া যাবে না” (বাংলা ট্রিবিউন)।
অর্থাৎ, এককথায় বললে, কোটা ইস্যু বনাম নির্বাচনী ব্র্যান্ডিং ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এই দুইয়ের লড়াইয়ে প্রধানমন্ত্রীর হার হয়েছে। যদিও হারটা তিনি কীভাবে মানবেন মনে হচ্ছে তা নিয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। তিনি হয়তো তা নানা কৌশলে অস্বীকার করে এখন ধামাচাপা দেয়ার পথ ধরতে পারেন। দুই মন্ত্রীর ততপরতা তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাতে এভাবে তিনি ইস্যুটাকে আরও জীবন্ত করে জাগিয়ে তুলবেন, আর এতে তুলনামূলক এই ছোট হার তাকে বড় হারের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এখনো পর্যন্ত কোটা ইস্যুটা ঠিক তার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে তেমন নয়। তবে তার নতুন সব কৌশলই তার ক্ষমতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে হাজির হতে থাকবে।
একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনি “মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ বা বিপক্ষ শক্তি”। এটা দিয়ে অনেক কিছু বুঝাতে চায় প্রগতিবাদীরা। যা বুঝানো যায় না তাও। অনেকে পত্রিকায় মতামত-কলামও লিখে থাকেন, “রাজাকার আলবদরের সন্তানদের জন্যে আইন করতে হবে”, এমন শিরোনামে। অথবা মন্ত্রী শাজাহান খান যেমন দাবি তুলছেন, “স্বাধীনতার বিপক্ষের মেধাকে চাকরি দেয়া যাবে না” অথবা “জামায়াত-শিবির-রাজাকার সন্তানদের চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ করতে হবে”। এসব বক্তব্যগুলো কি আগাম অনুমান ধরে নিয়ে তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে প্রসঙ্গের কিছু কথা।
দুনিয়ার সব রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থা (বা ধর্মীয় বিচারব্যবস্থাও) কোনো অপরাধীর অপরাধের জন্য তার সন্তানকেও কখনও অভিযুক্ত করেনি। কখনও করে না, করার সুযোগ রাখেনি। অনেক ধর্মে চোরের চুরির পয়সায় সংসার চালানোতে চোরের স্ত্রী-সন্তানেরা ওই চুরির আয় ভোগ করলেও তারা “চুরির দায়মুক্ত” বলে রায় দিয়ে রেখেছে। আমাদের কনস্টিটিউশনও এই নীতি অনুসরণ করেছে, এর বাইরের নয়। কিন্তু তবু আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিরা’ এটা সুবিধাভোগী এক কোটারি গোষ্ঠী, যাদের সময় নেই এদিকগুলো ভেবে দেখার। এরা সারা দুনিয়ার এই নীতিগত দিক নিয়ে পড়াশুনা বা জানার আগ্রহ রাখেন না। বরং সেন্টিমেন্টাল উস্কানিতে নীতিগত দিকটা আড়ালে রাখতে চান। আর এতে ঘিন ঘিনে ঘৃণা ছড়ায় কেবল। এরা ‘জামায়াত-শিবির-রাজাকার’, এদের অপরাধের দায়ভার সন্তানদের ওপর চড়াতে খুবই ব্যাকুল। এরা অপরাধকে অপরাধ হিসাবে দেখতে রাজি না বরং অপরাধীর “রক্তের দোষ” থাকে, “অপরাধীরা দুষিত” এমন ধরণের বর্ণবাদী রেসিজম এর বয়ান খাড়া করতে আগ্রহী। রক্তের দোষ দেখতে পাওয়া এটাই হিটলারি রেসিজম। তবে নিজ কোটারি স্বার্থে টনটনে হয়ে এই রেসিজম ব্যবহার করে। কেবল রগেরগে ঘৃণার জোশে এরা নিজের কোটারি স্বার্থের পক্ষে নানা সময় নানা দাবি তুলে।
এদের বক্তব্যগুলোর পেছনের আগাম ধরে নেয়া অনুমানটা হল, অপরাধীর অপরাধ এই দোষটা জেনিটিক্যালি বংশগতভাবে রক্তে প্রভাবিত হয়। আচ্ছা ধরা যাক এটা যদি তাই হত তাহলে এর মানে কী দাড়ায়? তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতে বিচারে যারা অপরাধী প্রমাণিত হয়েছেন তাদের সন্তান-সন্ততিদের সবাইকেই তো শাস্তির আওতায় আনতে হয়। এতে এমন লোক যার বংশের কেউ অপরাধ করেনি ফলে সে শাস্তিভোগের বাইরে থাকবে এমন কাউকেই আর সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ যারা এই দাবি জানাচ্ছে এদের সবাইও নিজ বংশের কারও না কারও অপরাধের দায়ের বাইরে থাকবে তা কে নিশ্চিত করতে পারে? এদিকটা কি তারা ভেবেছেন? রেসিজম আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, কীভাবে অন্ধ করে দেয়!
সবশেষে, কোটা নিয়ে যেকোনো আধুনিক রাষ্ট্রের মূলনীতি কী, তা নিয়ে দু’টো কথা। প্রথমত, যেই রাষ্ট্র তার নাগরিক নির্বিশেষে মানে – নাগরিকের ধর্ম পরিচয়, গায়ের রঙ, পাহাড়ি-সমতলি, ভুগোল ইত্যাদি নির্বিশেষে সব বিভেদ চিহ্নের উর্ধে সমান গণ্য না করে, এই সাম্যতার নীতিতে গড়ে না তুলে – সেটা কোনো রাষ্ট্রই নয়। তাতে সেটা যেকোনো (কমিউনিস্ট, ইসলামিস্ট ইত্যাদি) আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রই হোক না কেন! জনস্বার্থের রাষ্ট্র গড়তে গেলে সাম্যের এই নীতি আমরা মানতে বাধ্য। একইভাবে কোনো রাষ্ট্র এমন আইন করতে পারে না যা সবার ওপর সমান প্রযোজ্য হবে না। উল্টা করে বললে যা সবার ওপর প্রযোজ্য নয় তা কোন আইনই নয়। অর্থাৎ, আইনকে মুখ দেখে কারও কারও উপর অপ্রযোজ্য করে রাখা যাবে না। এ ছাড়া নাগরিক-ভেদে কোনো কিছুতেই রাষ্ট্র কোন বৈষম্য করতে পারে না। এসব হল রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠনের একেবারে আদি কিছু মৌলিক নীতি। কিন্তু নীতি না মানলে কী হবে? প্রথমত, এতে নাগরিক সাম্যের নীতি লঙ্ঘন করা হল। আর ওই রাষ্ট্রের উচ্চ আদালতকে স্বত্ব ক্ষমতা দেয়া থাকে, যে ‘সাম্যের নীতি লঙ্ঘন’ করে কোন আইন প্রণীত হলে সেই আইন বাতিল বলে ঘোষণা করবে। আমাদের রাষ্ট্রের মূল তিন নীতির একটি হল এই ‘নাগরিক সাম্য’; যেটা কোনো রাষ্ট্রকে চিনবার, এটা কেমন রাষ্ট্র এটা বুঝবার এক মৌলিক চিহ্ন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গৌরব্বোজ্জ্বল মুল্যবোধ হল এই “নাগরিক সাম্য” প্রতিষ্ঠাকে নীতি হিসাবে আকড়ে ধরা, মূল নীতি হিসাবে আর করণীয় বলে ঘোষণা করা। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে যদি মনে রাখে তবে এই “নাগরিক সাম্য” এই মূলনীতির জন্যই আর এর প্রতিষ্ঠার জন্যই মনে রাখবে। কোটা বা কোন বৈষয়িক সুবিধার লোভ দেখিয়ে মানুষকে “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে” রাখা যাবে না। তাহলে এখন আসি, নাগরিক সাম্যের নীতি আকড়ে ধরলে এসব রাষ্ট্রে আবার কোটা পদ্ধতি চালু করা যাবে কী করে?
কারণ, কোটা মানে তো কাউকে অন্যের ওপরে বিশেষ সুবিধা দেয়া, মানে বৈষম্য করা! এ কারণে এক্ষেত্রে বাড়তি একটি যুক্তি দেয়া হয়ে থাকে এবং বলা থাকতেই হয় যে এটা সাময়িক। সেই যুক্তির সার কথাটা হল, কনস্টিটিউশন চালুর আগে থেকেই নিজ সমাজের বিকাশ অসম ছিল, এই অসম বিকশিত হওয়াতে যে বৈষম্য আগেই তৈরি হয়ে আছে কেবল সেগুলোকে সবার আগে এক সাম্যের জায়গায় আনা প্রয়োজন। কেবল এমন এমন ক্ষেত্রে এসব কোনো ইস্যু থাকলেই তখন কেবল কোটা আনা যাবে এবং অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সময় পরে কোটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই কাজকে affirmative action বলা হয় এবং কোটা চালুর সময়ই এটা কতদিন থাকবে সেই সময় উল্লেখ রাখতে হয়। অর্থাৎ, নাগরিক সাম্যের মূলনীতি লঙ্ঘন না করেই কেবল কোটা নামে এক সাময়িক ব্যবস্থা চালু করা যায়।
কিন্তু মূলকথা মনে রাখতে হবে, সমাজের অসম বিকাশ আগেই যা তৈরি হয়ে আছে যেমন, নারীরা সামাজিক সুবিধায় আগে থেকেই হয়ে থাকা অসাম্যের কারণে পুরুষের চেয়ে তারা পিছিয়ে আছে। অথবা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের এলাকায় পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামো না থাকায় তারা বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেয়ে পিছিয়ে আছে। তাই কেবল এসব ক্ষেত্রে তাদেরকে সাম্যে না আনা পর্যন্ত একটা কোটা ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে বা যেতে পারে। কিন্তু এই বিচারে মুক্তিযোদ্ধা বলে কোটা করার সুযোগই নেই। যদিও স্বাধীনতার পর থেকে কেন এই কোটা থাকবে এর সাফাই বা ন্যায্যতা হাজির করা ছাড়াই এটা চলে আসছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন ‘সামাজিক অসাম্যকে’ সমান করতে affirmative action তা আমরা এখনো জানি না। যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখতে চান তাদেরকে এর জবাব দিতে হবে। তবে যুক্তি না পেলেও, মুক্তিযুদ্ধ এই আবেগের বিরুদ্ধে যাওয়া এড়াতে আমরা খুলে কিছু বলি না। আর এরই সুযোগ নিতে চাচ্ছে কথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি’।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা এর আগে গত ২৪ এপ্রিল ২০১৮ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) “কোটা বনাম নির্বাচনী ব্রান্ডিং“ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]