হামলার দাবি এখন দায় এবং তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্ততা


হামলার দাবি এখন দায় এবং তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্ততা

গৌতম দাস

১১ মার্চ ২০১৯, সোমবার ০০:০৬

https://wp.me/p1sCvy-2y9

 

ভারত-পাকিস্তানের বিরোধে তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন রয়েছে এবং তা অনিবার্য। যদিও এপ্রসঙ্গে ভারতের ঘোষিত নীতি হল  – “কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু’- যা ভারত একটা কথার কথা বলে থাকে। অর্থাৎ এটা কাগুজে নীতি, কথা কাজের অমিলের। তবে কখনও কূটনৈতিক বিপর্যয় ও বিপদে পড়ে গেলে নিজের ইজ্জত বাচাতে এই কাগুজে নীতিটাকেই ভারত আকড়ে ধরে থাকে। আর অন্যদিকে বাস্তবে, সবসময়ই ভারত নিজের স্বার্থেই এত দিন তারা তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতার সুযোগ সুবিধাগুলো ব্যবহার করে এসেছে। এ ছাড়া সরাসরি কাশ্মির ইস্যুতে ভারত সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন বা গুম, খুন, হত্যায় মানবাধিকার লঙ্ঘন অথবা কাশ্মিরি নাগরিকদের ওপর যেকোনো বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ভারতকে অবশ্যই সমালোচনা, নিন্দাসহ প্রতিকার চাওয়ার দাবি শুনতেই হবে। “কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু” – এই কথা আউড়ে, বা এই অকেজো দাবি করে ভারতের কোনো অপতৎপরতাই সমালোচনা-নিন্দার হাত থেকে রেহাই হয়নি বা আড়াল হয়নি। বাস্তবতা হল, ভারত তার নিজ স্বার্থও আড়াল করতে পারেনি, পারবেও না।

কোনো দু’জনের বিরোধে মধ্যস্থতা বলতে তা ঠিক মধ্যস্থতাকারীর মাতব্বরি বা অধীনস্থতায় চলে যাওয়া বুঝায় না। তবুও মধ্যস্থতা ধারণাটার মূল দিক হল, বিরোধে জড়ানো দুইপক্ষ বিরোধ মেটাতে বা রফা করতে সরাসরি কথা না বলেও শুরুতে অন্যের মাধ্যমে ডায়ালগ শুরু করে দিতে পারে। যাতে অন্যের মাধ্যমে সেই পরোক্ষ সংলাপ-আলোচনা একটি ইতিবাচক জায়গায় পৌঁছলে এরপর সরাসরিই উভয়পক্ষের কথা বলার সুযোগ নেয়া যায়। আর পরিশেষে ওই বিরোধের শান্তিপূর্ণ একটা সমাধান অর্জন করা যায়। এভাবে মধ্যস্থতায় বিরোধ মিটানোর বড় সুবিধার দিক হল – উভয়পক্ষ কতটুকু ছাড় দিতে বা যেতে রাজি, ঠিক কী হলে একটা রফা সম্ভব এর যাচাই-পরখ হয়ে যায় আর তা কোনো ধরনের আগাম দায় না নিয়েই পরিস্থিতি যাচাই, পরস্পরের মনোভাব বোঝা, দুর্বলতা-সবলতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া সম্ভব।

এটাই কঠিন বাস্তবতা। আর এতে ভারতের অবস্থা সবসময়ই এক উভয় সঙ্কটে। নেহরুর আমলে তিনি কাশ্মির ইস্যু জাতিসঙ্ঘে নিলে সেখানে কাউন্সিল থেকে কাশ্মিরে গণভোট করার প্রস্তাব পাস হয়েছিল। আর সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন না করে পাশ কাটাতে সেই তখন থেকেই তিনি “কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু” এই মুখরক্ষার বিদেশনীতি চালু করেন। “কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু” – এ কথা বলে এক পর্দা  তুলে দেয়া যে কাশ্মিরে যাই ঘটুক, তা নিয়ে অন্য রাষ্ট্র কোনো মন্তব্য যেন না করে বা গণভোটের কথা মনে করিয়ে দিয়ে; অথবা দাবি জানিয়ে- ভারতকে যেন কূটনীতিসহ যেকোনো ইস্যুতে বেইজ্জতি অবস্থায় না ফেলে দেয়। তবে ভারতের ঘোষিত নীতিই ফাঁপা বা ভুয়া, যা তারা নিজেরাই কখনো বাস্তবে অনুসরণ করেনি। বরং গোপনে বা প্রকাশ্যে ভারত তৃতীয়পক্ষ বা মধ্যস্থতাকারীর সাহায্য খুশিমনে মেনে নিয়েছে। এ নিয়ে এক রিপোর্ট করেছেন ভারতের সাংবাদিক কলামিস্ট পিকে বালাচন্দ্রন। তিনি কাশ্মির-সঙ্কট সংশ্লিষ্ট প্রতিবারের ইস্যুতে দেখিয়েছেন ভারত মধ্যস্থতাকারীর সাহায্যেই প্রতিটা সঙ্কট উতরিয়েছে। এর অর্থ, এটা ভারতের জন্য এক উভয় সঙ্কট হয়ে আছে এজন্য যে তৃতীয়পক্ষ বা মধ্যস্থতার সাহায্য যা পাবে এর সবটা ভারতকে চেটেপুটে নিতে হয়েছে; কিন্তু বিপদে পড়লেই মন্ত্রের মতো জপতে থাকতে হচ্ছে যে “কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু”।

বাস্তবে এবারের পুলওয়ামা[Pulwama] আত্মঘাতী হামলার পর “প্রতিশোধের উন্মাদনা তুলে” মোদীর ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা করতে পাঠিয়েছিল। মোদীর এই হামলাকে আসন্ন নির্বাচনে নিজের বীরত্ব হিসেবে দেখাতে ব্যবহার করা হবে – সে কাজে এই রসদ এতে সংগ্রহ হয়ে যায়। কিন্তু মোদী এতে অন্য এক সঙ্কটে পড়েন যে ভারতীয় বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট পাকিস্তানের হাতে আটকা পড়ে যায়, তাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা  এরপর তাঁর থামিয়ে ফেলা দরকার। কারণ, ভোটের বাজারের জন্য ‘বীরত্বগাথা’ সংগ্রহ হয়ে গেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তার সমস্যা হল –  থামাতে চাইলেই পাকিস্তান তা থামাবে কেন? আর ইমরান খান পাইলটকে ছেড়ে দিলেও এরপর পাকিস্তান আর পাল্টা হামলায় যাবে না, এই নিশ্চয়তা মো্দীকে এনে দেবে কে?

তাই লজ্জার মাথা খেয়ে আবার তৃতীয়পক্ষ মানে আবার মধ্যস্থতাকারীদেরই ডাকাডাকিতে মোদীকে ভরসা করতে হয়েছিল। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স, ওআইসি, ট্রাম্পের অফিসের এক সম্মিলিত মধ্যস্থতা এমন এক ভরসা কেন্দ্র হয়েছিল। আর অন্যদিকে চীনের নেতৃত্বে রাশিয়াসহ আরেক দূতিয়ালির ফ্রন্টের ওপর ভরসা করতে হয়েছিল মোদীকে। এই ছিল মোদির পদক্ষেপ। কিন্তু ভারতের কপাল খারাপ। ওআইসির সম্মেলন মোদীর বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দাওয়াতে গিয়ে মিষ্টি ভাষণ দিয়ে এলেও পরের দিন ওই সম্মেলন থেকে কাশ্মির-সংক্রান্ত গৃহীত প্রস্তাবে ভারতের কাশ্মিরনীতিকে তুলোধুনা আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ইস্যুতে কড়া সমালোচনা ও নিন্দার বক্তব্য রেখে তা পাশ করা হয়। এমনকি ভারতের এসব তৎপরতাকে “ভারতীয় সন্ত্রাসবাদ” বলে শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমন এক কূটনৈতিক বিপর্যয়কর অবস্থায় উল্টো নিজেদের বিপদ বুঝে ভারত এবারও সেই মন্ত্র জপা শুরু করে দিয়েছিল যে, ‘কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু’। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া এই বেইজ্জতির সমস্যায় পড়ে নিজেরা এর কোনো দায় না নিয়ে বরং তারাও সব দায় ও ক্রোধ মোদীর সরকারের ওপর উগরে দিয়েছিল।

কিন্তু এর পরও মুখে যাই বলুক, মোদিকে মধ্যস্থতার ওপরই ভরসা করে যেতে হচ্ছে; যা এখনো শেষ হয়নি। কারণ, পাকিস্তানের দিক থেকে পাল্টা আবার সব তৎপরতার সম্ভাবনা শেষ হয়েছে, এই নিশ্চয়তা পেতে হবে মোদীকে! ইতোমধ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের ক্রেডিট দাবি করে তা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। ইমরান খান ভারতীয় আটক পাইলটকে ছেড়ে দেয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই ভিয়েতনাম সফররত ট্রাম্প ‘নাটকীয় খবর আসছে’ বলে নিজের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ করেছিলেন। আর এবার চীনও নিজের ভূমিকা জাহির করে বলছে সে একটা ‘গঠনমূলক ভূমিকা’ [“constructive role” ] রেখে চলছে।

মধ্যস্থতা মানেই আসলে তৃতীয়পক্ষ। অর্থাৎ বিবদমান দুইপক্ষের বাইরের কেউ এই অর্থে তৃতীয়পক্ষ। আবার এটা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের আমল। মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের আমেরিকার নেতৃত্বে যে নিয়ম, প্রতিষ্ঠান ও বিধিব্যবস্থায় দুনিয়া গড়ে উঠেছিল সেটাই। এই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এখন বিগত প্রায় সত্তর বছর পার করে দিয়েছে। এমন এই দুনিয়ায় বাস্তবতা হল, কোনো দুই রাষ্ট্রের বিরোধে বিবদমান কোনো পক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অন্য তৃতীয়পক্ষ কাউকে ডাকুক আর নাই ডাকুক, সেখানে বহু তৃতীয়পক্ষেরই স্বার্থ আছে বা থাকে। কারণ, ৭০ বছর ধরেই অর্থনীতি বলতে সেটা আর কলোনি আমলের মতন একক কোন একটা রাষ্ট্রের নয়; বরং তখন থেকেই এই প্রথম কোন রাষ্ট্রের অর্থনীতি মানেই তা এক গ্লোবাল অর্থনীতির অংশ- এমন হয়ে গেছে। আর এতে গুলোএমন সব অর্থনীতি অন্য সবার সাথে গভীর নির্ভরশীলতায় মাখামাখি এমন একটা কিছুর আবির্ভাব ঘটে গেছে। তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের দুনিয়া যেটা ছিল তা আসলে কেবল হাতেগোনা কিছু উপনিবেশের মালিকদের, কিছু সাম্রাজ্যের দুনিয়া। আর এর বিপরীতে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দুনিয়া মানে এটা এখন ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত, স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর দুনিয়া। শুধু তাই নয়, এটা হল সব রাষ্ট্রই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এমন এক গ্লোবাল অর্থনীতির দুনিয়া। এরা সবাই পণ্য, পুঁজি, কাঁচামাল, বিনিয়োগ, বাজার ইত্যাদিতে সবার সাথে সবার এক ব্যাপক লেনদেন বিনিময়ের ভেতর দিয়ে পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল- এমন এক অর্থনীতির দুনিয়া। বিশেষ করে ১৯৮০-র শতক থেকে যেটাকে “গ্লোবালাইজেশন” বা “রফতানিমুখী করে সাজানো” অর্থনীতির দুনিয়া বলা হচ্ছে। এমন দুনিয়ায় এখানে যেকোনো দুই রাষ্ট্র বিবদমান হয়ে থাকা মানে হল – এ দুইপক্ষের সাথে বিভিন্ন বিনিময় সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা অনেক তৃতীয়পক্ষ আছে ও থাকবে, যারা ওই বিরোধের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের নিজ নিজ অর্থনীতি ও সমাজ প্রভাবিত হতে দেখবে।

যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু হওয়া এতদিনের আমেরিকান নেতৃত্বের দুনিয়া এখন এক অন্তর্বর্তী অবস্থায়, নতুন নেতা চীনের নেতৃত্ব স্থানান্তরিতকরণ প্রক্রিয়ায় আছে। ফলে ভারত-পাকিস্তানের চলতি বিবাদে  – ক্ষয়ে যাওয়া মুরোদের আমেরিকা ও ফ্রেশ মুরোদের চীন – এদের দুইয়ের স্বার্থও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভারত বা পাকিস্তান এরা কেউ তাদের ডাকুক আর না ডাকুক তারা সংশ্লিষ্ট তৃতীয়পক্ষ হয়ে হাজির হবেই।

ইদানীং এ প্রসঙ্গে আবার ভারতে প্যারিসের স্বার্থও খুবই জ্বলজ্বল করে উঠেছে। কারণ, ভারত পুরনো সোভিয়েত মিগ বিমানগুলো বাতিল বা ফেলে দিয়ে এখন ফরাসি মিরেজ বা লেটেস্ট রাফায়েল বিমান কিনে সে জায়গা পূরণ করে চলেছে। কিন্তু তাই বলে আবার সোভিয়েত স্বার্থ একালে পুতিনের রাশিয়ার স্বার্থ  হয়ে গুটিয়ে যায়নি। কারণ, সস্তায় সাবমেরিনসহ অনেক কিছুই এখনো পুতিনই দিতে পারেন। দামে সাশ্রয় করতে বাংলাদেশ চীন থেকে যে পুরনো সাবমেরিন কিনেছে তা চীনে পুনর্গঠিত করা হলেও সেটাও মূলত রাশিয়ান। গত সপ্তাহে পাকিস্তানের জলসীমায় ভারতীয় সাবমেরিন ঢুকেছিল কি না, যা পাকিস্তান ঠেকিয়ে দিয়েছিল বলে রিপোর্ট বেরিয়েছে, এর পক্ষে সাফাই রিপোর্টও এসেছে রাশিয়ার গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে।

আবার এসব সুনির্দিষ্ট স্বার্থ থাকলেও, তৃতীয়পক্ষগুলোর একটা অভিন্ন কমনস্বার্থও আছে। তা হল, ভারত-পাকিস্তানের সঙ্ঘাত যেন বিনাযুদ্ধেই সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকে। কারণ, এদের সঙ্ঘাত ছড়িয়ে গেলে তা থেকে গ্লোবাল অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হবে, যা নিজ নিজ রাষ্ট্রের নিজ অর্থনীতিতে বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে হাজির হবে – যেটা কেউই চাইবার বা বইবার অবস্থায় নেই। এ ছাড়া ভারত-পাকিস্তান দুটোই পারমাণবিক শক্তির রাষ্ট্র বলে তা আরও কারোই কাম্য নয়। কেউই তার পুঁজি, পণ্য, বিনিয়োগ, বাজার ইত্যাদি স্বার্থকে এ দুই বিবদমান রাষ্ট্রে অস্থির অনিশ্চয়তায় দেখতে চাইবে না। সারকথায়, ‘কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু’ বলে মালা জপে, সেই ভারত কাশ্মিরে যা খুশি তাই করে যেতে পারবে না। ইতোমধ্যেই কাশ্মিরের বাইরে ভারতের বিভিন্ন শহরে কাশ্মিরিরা নির্যাতিত বা নাজেহাল হওয়ায় ভারতেরই সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ভারতের মানবাধিকার কমিশন কয়েকটা শহরের নাম উল্লেখ করে সেখানে কাশ্মিরিদের ওপর কী ঘটেছে, সরকারের কাছে সেই মানবাধিকার রিপোর্ট তলব করেছে।

আর ওদিকে ভারতের বাইরে, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান [Michelle Bachelet ] কাশ্মিরিদের প্রতি “বিভেদ ও বৈষম্যমূলক নীতির প্রয়োগের” জন্য মোদি সরকারের সমালোচনা ও সতর্ক করেছে। কোনো রাষ্ট্রই (মুসলমান বলে) নিজের কোন কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক নীতির প্রয়োগ ও আচরণ করতে পারে না। আর এটাকে ‘কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু’ বলে মালা জপে ভারত দেশী বা বিদেশী অভিযোগ আড়াল করার চেষ্টা বৃথা এবং অকেজো। আর তা মোদি সরকার পারেওনি। এমনকি ভারত “বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ” বলে ফাঁপা ভ্যানিটি দেখিয়েও তা আড়াল হবে না।

অপর দিকে ভোটের বাজারে বিমান হামলার বীরত্ব ফেরি করে বাক্স ভরার যে পরিকল্পনা (বোমায় ৩০০ জঙ্গি মরেছে বলে যে দাবি) মোদী নিয়েছিলেন – সেটাও মাঠে মারা গেছে। এটা উলটা এখন মোদীর জন্য দায়। আন্তর্জাতিক নিউজ এজেন্সি রয়টার্স খবরের সত্যতা সংগ্রহে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের সক্ষমতা রাখে এমন মিডিয়া এজেন্সি কোম্পানি। তার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের একটা খাত হল উপগ্রহ থেকে ছবি ও তথ্য সংগ্রহ। পাকিস্তানের বালাকোটে কথিত জঙ্গি আস্তানায় ভারতীয় বিমান হামলা হয়েছে কি না, ক্ষয়ক্ষতি কেমন এর ফ্যাক্টস জানতে রয়টার্স হাই-রেজুলেশনের স্যাটেলাইট ছবি সংগ্রহ করতে এক বেসরকারি কোম্পানিকে নিয়োগ করে। তাদের সংগৃহীত ছবি ও তথ্য ৩০০ জঙ্গি মারা যাওয়ার দাবি দূরে থাক,  বরং এক মাদ্রাসার অটুট দাঁড়িয়ে থাকা যা ওই বিশ্লেষকের মতে, ১০০০ কেজি কথিত বোমা ফেলার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারার কথা নয়। রয়টার্স রিপোর্ট করেছে, এ সমুদয় তথ্য ও ছবি রয়টার্স “ভারত সরকারের বিদেশ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রকে ই-মেইল করে” পাঠায়। সরকারি অফিসে পাঠিয়ে মন্তব্য ও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি। কলকাতার উগ্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে তা সমর্থন করে রিপোর্ট লেখা আনন্দবাজার- সেও মোদির কাজ ও ভুয়া দাবির দায়দায়িত্ব না নিয়ে এ প্রসঙ্গে লিখছে, “মার্কিন বেসরকারি স্যাটেলাইট অপারেটর ‘প্যানেট ল্যাবস ইনকরপোরেট’-কে দিয়ে বালাকোটের একটি ছবি তোলায় সংবাদ সংস্থা রয়টার্স। মার্চের ৪ তারিখে তোলা হাই-রেজুলেশনের সেই ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, জাবা গ্রামের অদূরে পাহাড়ের মাথায় সেই মাদরাসাটি দিব্যি অক্ষত দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ছাদে কোনো গর্ত নেই, ভাঙনের কোনো চিহ্ন নেই দেয়ালেও”।

অবস্থা এমন শোচনীয় যে, জঙ্গি মারা যাওয়ার কথা সরকারের দায়িত্বশীল “কে” দাবি করেছিল তা এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় পাকিস্তানে বিমান হামলা করে প্রতিশোধ নিয়েছে মোদী, আসন্ন নির্বাচনে এই ‘বীরত্ব’ দাবি করার সুযোগ আর তার থাকল না মনে হচ্ছে। হিতে বিপরীত, এক লেজেগোবরে অবস্থায় বিশ্বাসযোগ্যতাহীন এখন এক মোদী ও তাঁর সরকার।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

[এই লেখাটা এর আগে গত ০৯ মার্চ ২০১৯ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) “মোদির বিমান হামলা এবং তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্ততা – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s