ইরানে হামলার নির্দেশ দিয়ে ট্রাম্পের পলায়ন
গৌতম দাস
২৪ জুন ২০১৯, ০০:০৬ সোমবার
বাংলাদেশের শুক্রবার সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে জানা গেল রয়টার্সের ব্রেকিং নিউজ জানাচ্ছে,[ United Airlines suspends Newark-Mumbai flights…] আমেরিকার ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের নিউ ইয়র্ক-মুম্বাই ফ্লাইটটা বাতিল করা হয়েছে।কারণ হিসেবে বলা হয়েছে আগের দিনের এক ঘটনা। আমেরিকান একটি ড্রোন (সামরিক কিন্তু মানুষবিহীন রোবট) বিমান ইরানের আকাশে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিল, যেটা ইরান মিসাইল ছুড়ে ধ্বংস ও ভূপাতিত করে ফেলেছে, এরই প্রতিক্রিয়ায় ঐ ফ্লাইট বাতিল। এ খবর কিছুটা গরমিলের আবার কিছুটা টেনশনেরও মনে হয়েছিল। কারণ, আগের দিন ইরান আমেরিকান ড্রোন [RQ-4 Global Hawk, Drone] ফেলে দিয়েছে কথা সত্য এবং ইরান-আমেরিকা উভয় পক্ষই এটা মিডিয়ায় স্বীকার করেছে। তবে যেটা গুরুত্বপুর্ণ – এটা কোন খেলনা ড্রোন নয়, বরং খুবই উঁচুমানের বা হাইটেক সফিস্টিকেটেড। এর একেকটার মূল্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার। সাধারণত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্যাসেঞ্জার বিমান চলাচল করে ৩০-৪২ হাজার ফুট উচ্চতায়। কিন্তু এই ড্রোন ৬০ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় চলাচল এবং নিখুঁত ছবি বা নানান তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তাই আমেরিকার কাছে এটা ছিল মহাবিস্ময় যে, এত উচ্চতার এই ড্রোনও নিখুঁতভাবে ভূপাতিত করার সক্ষমতা ইরানের আছে। এধরণের ড্রোন ভুপাতিত করার জন্য উপযুক্ত একমাত্র টেকনোলজি হল মিসাইল ছুড়ে একে নামানো। তা করতে হলে, ভূমি থেকে আকাশে ছুড়ে যুদ্ধবিমান নামানো যায় – এমন টেকনোলজির মিসাইল দিয়ে এটা করা সম্ভব। ইরান সম্ভবত রুশ ‘এস-৪০০’ [Russian S-400 missile] এখানে ব্যবহার করেছে, যা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।
খবরের গরমিলটা হল – সাধারণত কোনো রাষ্ট্রের আকাশসীমা নিরাপদ মনে না হলে তা এড়িয়ে ঘুরপথে অন্য দেশের ওপর দিয়ে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল করে থাকে। সে ক্ষেত্রে বড়জোর বাড়তি সময় লাগে এবং তেল বেশি খরচ হতে পারে মাত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে একেবারে ফ্লাইট বাতিল করা হলো কেন?
দিন গড়াতেই সেসব প্রকাশ পেয়ে গেল। বাংলাদেশের বেলা ১১টার মধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমসে পাওয়া গেল বিস্তারিত [Strikes on Iran Approved by Trump, Then Abruptly Pulled Back] আসল খবরটা হল, ড্রোন ভূপাতিত করার প্রতিশোধ হিসেবে ইরানের ওপর হামলা পরিচালনার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা গত শুক্রবার ভোরবেলায় (আমেরিকান সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে) ঘটার কথা ছিল। ওই নির্দেশ পাওয়ার পরে আমেরিকান যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুতিতে নেমেও পড়েছিল। কিন্তু হামলা শুরুর মাত্র ১০ মিনিট আগে হঠাৎ পাল্টা নির্দেশ দিয়ে ট্রাম্প ওই হামলার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন। ইরানের ওপর কোন বিদেশী হামলার বিরুদ্ধে তাদের নেয়া যেসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে যেমন- রাডার, মিসাইল ব্যাটারি ইত্যাদির এমন তিনটা টার্গেটে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
খবরটা তখনও আর কোন মিডিয়া বা কোন সরকারি ভাষ্য- কোথাও আসেনি। এমন প্রাথমিক পর্যায় বলে সেজন্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, [Here’s what we know so far… Here’s what we don’t know…] কেন ট্রাম্প ওই হামলা স্থগিত বা বাতিল করলেন তা এখনো জানা যায়নি, এমনকি ওই হামলা আবার করা হবে কি না, তাও জানা যায়নি।
পরবর্তিতে আমেরিকান সময় সন্ধ্যা ৭টা, ২১ জুনে ট্রাম্প নিজে দুইখানা টুইট করেন। আর সেখানেই মুখরক্ষার সাফাই দেন তিনি, এটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে বলে হামলার নির্দেশ বাতিল করেছেন।
তিনি টুইটে যা লেখেন এর সারকথা হল, ‘আমার জিজ্ঞাসায় যখন জেনারেলরা বললেন, এই হামলায় ১৫০ জনের মতো লোক মারা যাওয়ার সম্ভাবনা, তখন এটা অসামঞ্জস্য [disproportionate] হবে মনে করে বাতিল করে দিই। তবে এখানে তার “অসামঞ্জস্য” বলার যুক্তি সম্ভবত এই যে, মানুষবিহীন ড্রোন হারানোর বিরুদ্ধে দেড় শ’ মানুষ মারা – এভাবে তুলনা। কিন্তু এগুলো মুখরক্ষার মিছা কথা। কারণ এর মানে হল, ট্রাম্পের এমন উপদেষ্টা কেউ নেই যিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের বৈঠকে মানুষ মারা যাওয়ার ব্যাপারটা আমলে নিতে পারেননি অথবা বলতে হয়, ইরানের কাছে আমেরিকার ড্রোন হারানোর পালটা উপযুক্ত ব্যবস্থা কী হতে পারে, এর পরামর্শও কেউ ঠিকমতো দিতে পারেনি। সবচেয়ে বড়কথা, ট্রাম্পের এই কথিত পাল্টা হামলার নির্দেশে যে যুদ্ধ শুর্টাহয়ে যাবে তা শুধু আমেরিকা-ইরান নয়, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে তো পড়বেই, এমনকি এখান থেকে নতুন বিশ্বযুদ্ধও শুরু হতে পারে – এটাও তারা কেউ ভাবতেই পারেনি – এমন বোকা-বোকা কথা – এটাই কি ট্রাম্প বলতে চাইছেন? সত্যিই অবিশ্বাস্য! তাহলে আমেরিকা শুধু নয়, সারা দুনিয়া কার নাদানিতে বা কাদের হাতে পড়েছে? আমেরিকান কোন প্রেসিডেন্ট এর আগে এমন আনস্মার্ট, বোকা কথা বলেন নাই; আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হওয়ার মানে কী, দায়দায়িত্ব কী, তাঁর যেকোন পদক্ষেপের দুনিয়াজুড়ে পড়া প্রভাব ও পরিণতি কী হয় সেটা তাঁর অজানা বেখবর এমন নাদানি আচরণ কোন প্রেসিডেন্ট কখনও করেন নাই। ট্রাম্পের বেইজ্জতির শুরু এখান থেকেই।
আসলে বাস্তবে খুব সম্ভব যে, সৌদি আরবের অনুরোধে ট্রাম্প এই ইরান হামলার নির্দেশ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কারণ, ইরানে কোন হামলা হলে এর পাল্টা প্রথম ইরানি হামলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা সৌদি আরবের সবচেয়ে বেশি।
এরপর শুক্রবার বাকি সারা দিনের ঘটনা হল, সৌদি আরব ছাড়া আর কেউ ট্রাম্পের পাশে দাঁড়ায়নি। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া ও ভ্যাটিকানসহ সবাই ট্রাম্পকে সাবধান করে বিবৃতি দিয়েছে [‘Brink of war’: World leaders push for Iran-US restraint]। কিন্তু কোন দায় কেউ নেয়নি। বরং ট্রাম্পকে সংযত হতে ইরানের সাথে ডায়লগে যেতে পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া কেউই ইরানের নিন্দা করা দূরে থাক, ইরানের আমেরিকান ড্রোন ভূপাতিত করাতে কোন আপত্তিও জানায়নি। আমেরিকার নেতৃত্বের গত ৭০ বছরের দুনিয়ায় এটা এক বড় ব্যতিক্রম।
এমন হওয়ার পেছনে অন্তত দু’টি কারণ পাওয়া যায়। এক. এখন পর্যন্ত ২০১৫ সালে ইরানের সাথে করা নিউক্লিয়ার চুক্তি বাতিল করে কেন ট্রাম্প বের হয়ে এলেন তা তিনি ইসরাইল ও সৌদি আরব ছাড়া আর কারো কাছে উপযুক্ত ব্যাখ্যা ও সাফাই দিয়ে বলতে পারেননি। ট্রাম্পের একা হয়ে পড়ার শুরু এখান থেকেই। দুই. এ ছাড়াও সে চুক্তি বাতিলের পর ট্রাম্প আসলে ঠিক কী চাচ্ছেন, ইরানকে কোথায় নিতে চান? তা তিনি নিজ কথার মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে বলতে পারছেন না। যেমন এখন বলছেন, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র উঠতে দেবেন না। ভাল কথা। কিন্তু তাই যদি হবে, তবে আগের চুক্তি ভেঙে দিলেন কেন? কারণ, চুক্তিতে পরমাণু সমৃদ্ধকরণ, তা কেবল জ্বালানিতে ব্যবহারযোগ্যতার মধ্যে রাখতে হবে এই বাধ্যবাধকতা ছিল; আর তা জাতিসঙ্ঘের নিরপেক্ষ এক্সপার্টের তদারকিতে ছিল।
আসল ব্যাপার হল, ইসরাইল আর সৌদি আরব চায় চুক্তি বাতিল করে আর ইরানকে অবরোধে ফেলে অর্থনৈতিকভাবে চরম দুর্বল করে রাখতে। তাদের এই বায়না – এটাকে ট্রাম্প আর কারও কাছেই ন্যায্য বলে হাজির করতে পারেননি। এমনকি এতে আমেরিকার নিজের কী স্বার্থ, তাও দেখাতে পারেননি। কেবল ট্রাম্পের যুদ্ধবাজ জন বোল্টন অ্যান্ড গং – এসব উপদেষ্টা্রা আড়ালে [Bolton: ‘Our Goal Should Be Regime Change in Iran’] ইরানে ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর কথা আওড়াতে দেখা যায়। অথচ চাইলেই কী আমেরিকা তা করতে পারবে? আমেরিকা এ ব্যাপারে দিনকে দিন মুরোদহীন হয়ে পড়ছে সে খবর নাই।
আবার এ কথাগুলো খোদ ট্রাম্পেরই মৌলিক নীতিবিরোধী। কারণ, তিনি ২০১৭ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে তার জাতিবাদী “আমেরিকা ফাস্ট” [AMERICA FAST] নীতিতে তিনি বলে আসছেন, গ্লোবাল নেতা হিসেবে তাঁর আমেরিকা আর কোনও যুদ্ধে তিনি আর নেই। যুদ্ধবিষয়ক যা কিছু স্থায়ী “কাঠামোগত স্থাপনা” আছে সেগুলোর সব কিছুতেই খরচ কমানো – এমনকি ন্যাটো বা জাতিসঙ্ঘ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি। অর্থাৎ কোন গ্লোবাল দায়দায়িত্ব বা কোন যুদ্ধে জড়ানো থেকে তিনি আমেরিকাকে বের করে আনার পক্ষে – এই নাকি তাঁর মৌলিক নীতি। তাই যদি হয়, তবে ইরানের সাথে চুক্তি ভেঙে দিলেন কেন? আরো এগিয়ে এখন তিনি ইরানে হামলা করে শুধু আমেরিকা নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র দুনিয়াকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে চাইছেন। কেন? এমনকি তিনি তো আসলেই “অন্ধ”, যিনি আমেরিকাকে রাস্তা দেখানো ও গাইড পরিচালনা করার দড়ি নেতানেহায়ুর ইসরাইলের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন! এটা তার কোন ধরনের নীতি?
আরও স্ববিরোধের দিক হল, ইরানের সাথে চুক্তি থেকে বের হওয়ার পর আবার এখন ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টিতে অবরোধ দিয়ে রাখার পথ ধরেছেন ট্রাম্প। কিন্তু কেন করছেন, এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? ট্রাম্প দাবি করছেন, তার লক্ষ্য নাকি ইরানকে টেবিলে বসানো। কিন্তু এটা ইরান বিপ্লবের (১৯৭৯) পর থেকে কখনো করা যায়নি, শতচাপের মুখেও তা কাজ করেনি। ফলে এখনো তা হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আবার ট্রাম্পের এই চাপ সৃষ্টি করে ইরানকে টেবিলে বসানোর আশা করার কায়দাটা ছেলেভুলানো হাস্যকর খেলা বললেও কম বলা হয়। রয়টার্স বলছে [Exclusive: Trump warned Iran via Oman that U.S. attack was imminent, called for talks] ইরানে হামলার নির্দেশ যেটা পরে পিছু হটেছে এটার সাথে নাকি ওমানের মাধ্যমে ইরানকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল ট্রাম্প। আচ্ছা, এটা কী রাস্তায় ছিনতাই বা গুন্ডামি করার মত কাজ? যে বলবে যা আছে সব দিয়ে দেও নাইলে ছুরি মেরে দিব? সেভাবে – ট্রাম্প বলে পাঠিয়েছে ইরান তুমি আলোচনায় বস, না হলে বোমা মারতে পাঠালাম!
স্বভাবতই এতে ইরান কেন, কোন রাষ্ট্রেরই রাজি হবার কোনই কারণ নাই। তাই উল্টো ইরান বলছে,যাকে আস্থা-ভরসা করা যায়, ট্রাম্প এমন লোক নন, তাই সে কথা বলবে না, ট্রাম্পের সাথে ডিল করবে না। অর্থাৎ অন্য গ্যারান্টার দরকার। এটা ট্রাম্পের বড় সমস্যা। আসলে ট্রাম্প যা বলেন তাতে কেউ ভরসা রাখে না, মিডিয়াও না। যার কথার দাম নাই তিনি এমন প্রেসিডেন্ট। যেমন- ট্রাম্প ইরানে হামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এতে দুনিয়া অখুশি। আবার হামলা না করে ফেরত এলেন, যেটা এই প্রথম আমেরিকা করল। কিন্তু এটাকে মানুষ আমেরিকার দুর্বলতা মনে করে, যদিও প্রকাশ্যে বলছে না কেউ।
আবার ওদিকে ইরান-আমেরিকার মধ্যে বিতর্ক আছে যে স্থানে ইরান আমেরিকান ড্রোন ভূপাতিত করেছে, সেটা ইরানের ভূখণ্ডে নাকি বাইরে – মজার কথা হল এই তর্কে কোন রাষ্ট্র বা কোন মিডিয়া কেউ আমেরিকার পক্ষ নেয়নি, পরিস্কার দূরত্ব বজায় রেখেছে। এছাডা দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে মিডিয়ায় আমেরিকার সরবরাহ করা তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা তুলনায় কম। ড্রোন ইরানি আকাশসীমায় ঢুকেছিল কি না এ ব্যাপারে আলজাজিরার ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর জেমস বেসের মন্তব্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইরানের সরবরাহ করা জিপিএস থেকে নেয়া তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা আমেরিকার দেয়া তথ্যের চেয়ে বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমসই প্রথম ডিটেইল ম্যাপ জোগাড় করে ছেপেছিল। আর তাতে দেখিয়েছিল, ড্রোন যখন ইরানি হামলার শিকার হয় তখন আমেরিকা ও ইরানের দাবি করা স্থান দুটো কোথায়। এই দুই দেশের দাবির ফারাক কতটা। নিউ ইয়র্ক টাইমস তার সে রিপোর্ট আপডেট করেছে ইরানের পার্স টিভির দেয়া তথ্য থেকে।
ড্রোন হামলা বা পরে ট্রাম্পের পাল্টা হামলার সিদ্ধান্ত ও সেখান থেকে পিছিয়ে আসা- এই পুরো ব্যাপারটা জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলাই হয়নি। কোনো বৈঠকও ডাকা হয়নি। কারো যেন আগ্রহ নেই। আমেরিকার বন্ধুহীনতার বেলায় এটা বিরাট ব্যতিক্রম। সবশেষে জানা গেল, আমেরিকা নিজেই সোমবার মানে আরো ৭২ ঘণ্টা পরে এই বৈঠক চেয়েছে।
কিন্তু সেখানেও ট্রাম্পের জন্য আরো বিপদ। কারণ, এটা এক অদ্ভুত ব্যতিক্রম যে, আমেরিকার নিজের ড্রোন হামলার শিকার হওয়ার পরে সে কূটনৈতিক পথে যায়নি, নিরাপত্তা পরিষদে আসেনি; বরং এককভাবে পাল্টা সামরিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিল। তাহলে এখন আবার সেটা ত্যাগ করে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে এসেছে কেন? এমন পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা কারো নেই। ফলে আমেরিকার অবস্থান আসলে ঠিক কোনটা- সামরিক না কূটনৈতিক, এ ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের সবাই অনিশ্চিত ও অস্পষ্টতায়, অনাস্থায়। ব্যাপারটাকে তুলে ধরতে আমেরিকার প্রভাবশালী ব্লুমবার্গ মিডিয়ার রিপোর্টের শিরোনাম করেছে- ‘ট্রাম্প ইউটার্ন নিয়েছেন, ইরানে আকাশ হামলা বন্ধ করে রেখেছেন; কিন্তু তবু সাথী বন্ধুরা অস্বস্তিতে” [Trump Leaves Iran, Allies Uneasy Even After Stopping Airstrike]।’
সব দেখেশুনে আলজাজিরার এক কমেন্টেটর বলছেন, পুরো ঘটনা শেষে ইরান এখন ঘটনার ড্রাইভিং সিটে আছে। তা বিশেষত ইরানের দু’টি দাবির কারণে। ইরান বলছে, ওই ড্রোনটা চার ঘণ্টা ধরে আকাশে উড়ছিল। শেষের দিকে সেটাতে ইরান রেডিও মেসেজ পাঠায় যে, তুমি ইরান সীমায় ঢুকে যাচ্ছো, সামলাও নিজেকে। এই ড্রোনে মানুষ না থাকলেও ওর বেজ স্টেশনের সাথে সব সময় যুক্ত থেকেই ওটা পরিচালিত হয়। তাই সে বাইরের রেডিও মেসেজ পেলে সেটা বেজ স্টেশনের কাছে পাঠিয়ে করণীয় জানতে চেয়ে, জেনে সে মোতাবেক কাজ করতে পারে। কিন্তু ওই ড্রোন বা সংশ্লিষ্ট বেজ স্টেশন সব মেসেজ উপেক্ষা করে গেছে। সব আকাশযানের নিচে সাধারণত ওর পরিচিতিসূচক শব্দ লেখা বা চিহ্ন দেয়া থাকে, যা ভূমি বা নিচ থেকে পড়া যায়; যা থেকে বুঝা যায় ওটা কোন দেশের বা কী কাজের।
ইরান দাবি করছে, ওই ড্রোনের সেসব পরিচিতি সূচক লেখা বা চিহ্ন ঢেকে রাখা ছিল, যার মানে, সেটা গোয়েন্দাগিরি ইঙ্গিত। এ ছাড়া ইরান নিজের সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দেখানোর জন্য আর একটা তথ্য দিয়েছে। ইরান বলছে, একই সময়ে আর একটা আমেরিকান (সম্ভবত) গোয়েন্দা বিমানও আকাশে ছিল। ইরানের দাবি, তা তেত্রিশ জন মানুষ বহনের যান ছিল, তাই ইরান তাতে হামলা করেনি। চাইলে করতে পারত। সেটা না করে তাদেরকেও সতর্ক রেডিও বার্তা পাঠালে তারা ইরানি আকাশসীমা ছেড়ে চলে যায়। শেষে ইরান মানুষবিহীন ওই ড্রোনকেই ভূপাতিত করেছে। এ কারণে মন্তব্যকারীরা বলছেন, ঘটনা শেষে ইরানই ‘ড্রাইভিং সিটে’। ট্রাম্প সম্ভবত এই প্রথম বুঝছেন যে, একজন ‘আমেরিকান প্রেসিডেন্ট’ হওয়া বলতে ঠিক কী বুঝায়!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা এর আগে গত ২২ জুন ২০১৯ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) “ট্রাম্প আমাদের যুদ্ধে নিচ্ছিলেন প্রায় “ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]
গৌতম’দা ইওর এ্যনালাইসিস ইজ আল ওয়েজ গ্রেট।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike